শিল্পকলার রাজধানীতে শিল্পায়ন ও ঊপেনরা

 

বহু বছর আগে একই দিনে নুন শোতে চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস দেখে আর সন্ধ্যেবেলা শিশির মঞ্চে  রক্তকরবী মঞ্চস্থ করে পরের দিন সারা দিন কলেজ স্ট্রীট কফি হাউসে কাটিয়ে ছিলাম। ১৯৭৫ এর জানুয়ারি হবে। বসে বসে ইনফিউশন, পাকোড়া আর চারমিনারের ধোঁয়ার কুন্ডলীর মাঝে আড্ডা মারতে মারতে একটা চিরকুট লিখেছিলাম। সেই চিরকুটটা আজও আছে। এই বত্রিশ বছরে মানি পার্স বদলেছে গোটা দশেক বা তারও বেশী। কিছু ভালোলাগা ভোলা যায়না। এই চিরকুট আমার সব মানি পার্সে জায়গা করে নিয়েছে। আজ আরেকবার মানি পার্স বদলাতে গিয়ে দেখলাম যে সেই চিরকুট লেখাটা বাদামী হয়ে ভাঁজে ভাজে ছিঁড়ে গিয়েও ধূসর নীল লেখা জ্বলজ্বল করছে।

'রবীন্দ্রনাথ আর চ্যাপলীন চিরকাল শুধু প্রাসঙ্গিকই থাকবেন না,এঁরা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ দুই সমাজ বিজ্ঞানী হয়ে সর্বজনের মনে ও প্রাণে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছেন।' খুব সাবধানে পতে পতে খুলে পড়লাম। এই তত্ত্বের সত্যতার প্রমাণ বহুবার মিলেছে। এই লেখার শুরু সেখান থেকেই।

 

শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।

বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ ঊপেন'? এ জমি লইব কিনে ।

 

পশ্চিমবঙ্গে টাটা কোম্পানীর নতুন যুগের গাড়ী তৈরী হবে। এক লাখ টাকায় আধুনিক গাড়ি পাওয়া যাবে। বেশ উত্তম প্রস্তাব। শিল্পকলার রাজধানী পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের হাওয়া। এক লাখ টাকায় গাড়ী আর এক টাকায় ফুলকপি আর কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়া প্রায় সমার্থক। এহেন একলাখি গাড়ি বেচে টাটা কোম্পানী তার ঘরে কত তুলবেন? টাটার এন আর ভি কত? ডিস্কাউন্ট, ডিলার কমিশন, সার্ভিস সেন্টার ফেসিলিটেশন, ভ্যাট, বিজ্ঞাপন ও এন্ডর্সমেন্ট ফী এই সব বাদ দিলে এন আর ভি বা নেট রিয়ালাইজেবল ভ্যালু কত? মোটামুটি হিসেবটা এই রকম। উৎপাদন পরবর্তী খরচ প্রায় চল্লিশ শতাংশের কাছাকাছি চলে যায় এই শিল্পে। তাহলে টাটা সংস্থা এই নতুন যুগের গাড়ী দেবেন বা সেই গাড়ি বিক্রি করে টাটা কোম্পানীর ঘরে আসবে ষাট হাজারের আশেপাশে কোনও টাকার অঙ্ক। এই রকমই একটা কিছু দাঁড়ায়, বলাই বাহুল্য, যার মধ্যে মুনাফা অবশ্যই আছে।

এই গাড়ীর নাম আমি রেখেছি সিঙ্গাড়া গাড়ী। শ্রদ্ধেয় রতন টাটা তাঁর সফল কর্ম্মজীবনের সায়াহ্নে এসে ভারতের হেনরি ফোর্ড হতে চান। বিজ্ঞ, বিদগ্ধ ও বড়লোকদের সাধ হয় একই জীবনে কত কাজ করে যাবার তার কোনও শেষ নেই। শেষ থাকা উচিতও নয়। তাদের কল্পনার শেষ বা সীমা থাকলে দেশের অর্থনীতি থেমে যাবে। শিল্পপতিদের বাড়তি সঞ্চয়ে উঁই ধরবে যে! আর ব্যাঙ্ক গুলো? তাদের তো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হল ক্রমবর্ধমান পেস্ট কন্ট্রোলের বাজেট। টাকার ওপর উঁই এর আক্রমন ঠেকাতে এখন পেস্ট কন্ট্রোলের পেছনে খরচ করতে হয়। এহেন রতন বাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ীকে পৃথিবীর আলো দেখাতেই হবে।

শিল্পকলার রাজধানী পশ্চিমবঙ্গে যে শিল্পায়নের হাওয়া বইছে তার প্রথম বড়সড় নমুনা হল এই গাড়ী। বেশ তো! হোক না শিল্পায়ন। যে কোনও বাঙ্গালী চাইবে পশ্চিমবঙ্গের সেই সুদিন। চ্যাপলিনকে টানছি না এখানে। সে নিয়ে পরে কিছু বলা যাবে। রবীন্দ্রনাথ দূরদর্শী ছিলেন, না ঊপেনরা আজও সেই অন্ধকারে? এর উত্তর খুঁজতে এই লেখা নয়! সব দিক খতিয়ে দেখে মনে হয় আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী এখন বাবুর মতই আচরণ করছেন। তিনি এখন পশ্চিমবঙ্গের মালিক। বামফ্রন্টের লালবাড়ীর কান্ডারী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আজকাল দুই বিঘা জমির বাবুর মতই আচরণ করছেন। পশ্চিমবঙ্গের মালিক বাবুরা একেবারে সেই কায়দায়ই আজকের ঊপেনদের থেকে সিঙ্গুরের তিন ফসলী জমি নিয়ে নিলেন। তাই সিঙ্গুরের ঊপেনরা নিরুপায় ও নির্বাক দর্শক আজ। কবি ঊপেনদের জন্য 'দুই বিঘা জমি' কবিতার মত এক শক্তিশালী সৃষ্টি রেখে গিয়েছিলেন যা আজও যন্ত্রণাদায়ক ভাবে প্রাসঙ্গিক ও সত্যি। আজকের সিঙ্গুরের বা আগামীতে পশ্চিমবঙ্গের সব ঊপেনদের হয়ে কথা বলবে এই কবিতা। আর কেউ নেই ঊপেনদের। মিডিয়ার দৌলতে ঊপেনদের পাশে যাঁদের দেখা যাচ্ছে তাঁরা নিজেদের রাজনীতির টালমাটাল তরণীকে বাঁচানোর জন্যে বা আগামী নির্বাচনে 'স্বপনের ফল' খাবেন বলে তৃতীয় সন্তানের মত নেচে বেড়াচ্ছেন।

কহিলাম আমি, 'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই -

চেয়ে দেখ মোর আছে বড়জোর মরিবার মত ঠাঁই

সিঙ্গুরের ঊপেনরা কি এ কথা বলার সাহস জোগাড় করতে পেরেছিল? বা এ কথা বলে কোনও করুণার উদ্রেক করতে পেরেছিল কি বাবুদের মনে? প্রথম থেকে সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের বিতর্কের উর্দ্ধে এক তুরুপের তাস আছে, তা হলো ভূমি সংস্কার ও অপারেশান বর্গা। চাষীর স্বার্থ দেখা, চাষীর অধিকার রক্ষা করা আর চাষ করে যে জমির মালিক সে - এই তিনটে স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ঊপেনরা বামফ্রন্টকে ভগবান জ্ঞানে ভোট দিয়ে এসেছে এত দিন ধরে। আজ সেই তুরুপের তাসের রং ধূসর ও তার রূপ জীর্ণ। আজ সেই বামফ্রন্টের মালিকরা দুই বিঘা জমির বাবুর মতই আচরণ করছেন।

ঊপেনদের প্রথমটায় বিশ্বাসই হয়নি যে এই ভাবে জমি তিন ফসলী জমি হারাতে হবে রক্ষকের কাছে। ওঁরা ভেবেছিলেন লাল বাবুরা এরকমটা করবেক নাই। আর তাই ঊপেনদের কোনও প্রতিরোধই গড়ে উঠলনা।

শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো করেছি বাগানখানা,

পেলে দুই বিঘে প্রস্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা-

ওটা দিতে হবে।'

হায় হায় হায়। এ কণ্ঠস্বর কার? সিঙ্গুরের চাষীদের কর্ণপট বিদীর্ণ করে এ কার কথা শক্তিশেল বানের মত ঢুকল সবার কানে? একি লাল বাবুদের কণ্ঠ? একি কোনও জমিদার বা জোতদারের কণ্ঠ?

না না না। এই কণ্ঠ যার তিনি কিছুই বলেননি। বলতে হয়নি। কিন্তু শুনিয়ে দিয়েছেন ঊপেনদের তাঁর নির্বাক পুঁজির সদম্ভ কণ্ঠ, যে সিঙ্গাড়া গাড়ীর যন্ত্রোদ্যানের প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য যেন তাঁর মন মত হয়!

লাল বাড়ীর বাবুরা প্রমাদ গুনলেন। রতন বাবু বড় বাবু। মস্ত বড় বাবু। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতির এক স্তম্ভ তিনি। তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে চলে গেলে হিন্দুজা বা মাহীন্দ্রা বাবুরা আসবেন না। তার ফল?

লালবাড়ীর কান্ডারী লালবাবুর পশ্চিমবঙ্গের নবরূপকার হওয়া হবেনা। তাই লাল বাবুরা জানেন ঊপেনদের কি করে কথা শুনিয়ে নিতে হয় বা কি করে উপেনদের দিয়ে কথা বলিয়ে নিতে হয়।

- কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি

সজল চক্ষে করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।

সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া

দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষী ছাড়া!

ঊপেনরা এই সেদিনও লাল বাবুদের ভগবান জ্ঞানে পুজো করেছেন। ভোট দিয়েছেন। ঊপেনরা চিরকাল এক ভয় মিশ্রিত শ্রদ্ধা নিয়ে দেখেছেন লাল বাড়ির লাল বাবুদের। তাই কি পিতৃপুরুষের চাষ করা তিন ফসলী জমি দিয়ে দিতে হলো? চোখের সামনে ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর জোরে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া হলো। চরম অপমানের ডান্ডা ও লজ্জার লাথি খেয়ে বা সাঁইবাড়ির বা ভোগলুশোল-মহাশোল গ্রামের পরিণতির ভয়ে লাল বাবুদের দিয়ে দিতে হলো পিতৃপুরুষের চাষ করা তিন ফসলী জমি! বাহ রে বাহ, বামফ্রন্টের লাল বাবুরা! যিনি রক্ষক। তিনিই ভক্ষক।

আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌন ভাবে,

কহিলেন শেষে ক্রূর হাসি হেসে, 'আচ্ছা সে দেখা যাবে।'

দুর্ভাগা ও লক্ষিছাড়া ঊপেনরা আজ পি-টি-এস-ডি রোগের শিকার! পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসর্ডার। কিন্তু ওঁদের চিকিৎসা করা বা সান্ত্বনা দেওয়া তো দূরের কথা ওদের নিয়ে রাজনীতির বেসাতি হচ্ছে যা আমাদের দেশের নির্লজ্জ রাজনীতিকরা ভালই পারেন। এখন চলছে পুনর্বাসনের চাপান উতর খেলা।

কে আগে মুখ খোলে দেখি!  মুখ্যমন্ত্রী অনড়। ওই জমি তিনি টাটাদের দেবেনই। কিন্তু তিনি পুনর্বাসনের ওপর আলোচনা করার প্রটোকল মাফিক আমন্ত্রন জানিয়েছেন অনশনরতা অগ্নিকন্যাকে। আর অগ্নিকন্যা চান আগে টাটাদের সিঙ্গুর ছাড়তে হবে, তারপর আলোচনা। অদ্যাবধি ঊপেনরা উপেক্ষিতই থাকলেন।

এরপর কি হবে? দুই বিঘা জমি কবিতার স্তবকে স্তবকে তা লেখা আছে। কল্পনা শক্তি তা দেখতেও পায় কিন্তু রাজনীতি সচেতন পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিক সত্য বলাই ভাল। তবে এটা সত্যি যে ঊপেনরা শেষ। চাষীর সন্মান হারিয়ে ওঁদের শ্রমিকের মর্যাদা মিলবে কিনা তা জানা নেই। ওঁদের নতুন নাম হবে প্রান্তিক শ্রমিক। সস্তায় ওঁদের শ্রম কেনা বেচা হবে। জমি লাঙ্গল হাল গেল, সামনে এবার ঘোর কালো। কেউ সাইকেল রিক্সা চালাবেন। কেউ খুব কপাল করে রতন বাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ীর কারখানায় অদক্ষ শ্রমিকের কাজ পেলেও পেতে পারেন। অবশ্য সেই সম্ভাবনা খুবই কম কারণ রতন বাবুর আধুনিক গাড়ী কমপ্যাক্ট য়্যাসেম্বলি লাইনে তৈরী হবে। তবে দারয়ান বা চৌকিদারের কাজ পাওয়া গেলেও যেতে পারে। আজকাল সেখানেও বিপিও কালচারের ঢেউ। তাই প্রান্তিক শ্রমিক হয়ে ভেসে বেড়াও।

ঢক্কা নিনাদের ভূমি সংস্কার ও বর্গাদারীর কাজে যে বেশ ঢিলে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে, তা সিঙ্গুর সার্কাস থেকে বেশ বোঝা যায়। ভূমি সংস্কার তো আর এক পাঁচশালা নির্বাচনমুখী কর্ম্মকান্ড নয়। এ হলো এক প্রক্রিয়া যার পেছনে নীতি থাকবে ও ক্রমাগত সেই নীতির স্বচ্ছ প্রয়োগ হবে। নীতির পুনর্মূল্যায়ন হবে বাস্তবমুখী সততার নিরিখে। আবার প্রয়োগ হবে। কিন্তু তা কি হয়েছে। হয়নি। হলে আজ তিন ফসলী জমিতে থাবা বসাতে হতনা। ভূমি মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা সাহেব তো কৃষকদের প্রতিনিধি হয়ে মন্ত্রিসভায় আছেন। রেজ্জাক সাহেব একটু সক্রিয় হবেন কি? জানি যে অতি সম্প্রতি আপনি ও আপনার নতুন সচিব অগ্রবাল সাহেব এই ব্যাপারে উদ্যমী হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক -

১. সেই উদ্যম কি রাজনীতির কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর সাহস রাখে?

২. অপারেশান বর্গার প্রকৃত ছবিটা কি?

৩. বর্গার সঠিক চেহারাটা কি ভাবা হয়েছিল?

৪. ভাবা হয়েছিল কি কিছু?

৫. না ভাবা হয়ে থাকলে, আজ কি ভাবা হচ্ছে?

৬. অপারেশান বর্গায় জমির সঠিক সনাক্তকরণ কি বৈজ্ঞানিক উপায়ে করা হয়েছে না হবে?

৭. শিল্পের জন্যে জমি কোথায় দেওয়া হবে সেটা কি ভূমি, শিল্প ও অর্থ মন্ত্রকের মধ্যে সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও সমবায়ের মধ্যে দিয়ে করা যায় না?

৮. রেজ্জাক মোল্লা, নিরুপম সেন ও অসীম দাসগুপ্তদের কি এখনও বুঝতে অসুবিধা আছে যে ওনাদের দপ্তরগুলোর মধ্যেই চীনের প্রাচীর আছে?

৯. বুদ্ধবাবু কি শুধুই বিনিয়োগ বিনিয়োগ করে মন্ত্র জপে যাবেন?

 

বিনিয়োগ আরও আসবে। নিজের ঘর ঠিক করুন আগে। দপ্তর গুলোর কাজের মধ্যে গতিশীল স্বচ্ছতা আনুন। আপনাদের ক্যাডার বাহিনী (খাঁকি এবং সাদা পোশাক) যেমন ম্যানডেট শুনিয়ে ঊপেনদের ঠান্ডা করে দিতে পারে ঠিক তেমনি আপনাদের আমলারা এবং আপনারা একটু কড়া শাসনে একটা অশিথিল লক্ষ্য (ইনফ্লেক্সিবল ডেডলাইন) ঠিক করে নিয়ে কাজ করুন না! ভাল হবে। যদি না পারেন তবে প্রাইভেট সেক্টরের সাহায্য নিন। কো-অর্ডিনেশন কমিটির দাদাগিরি কে গান্ধিগিরিতে পরিনত করুন। না পারলে ওদের চুপ থাকতে বলুন। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের ভবিষ্যৎ আপনাদের হাতে - এর মানে এই নয় আপনারা যে ভাবে শিল্প আনতে চাইছেন সেটাই ঠিক। কৃষিকে মেরে শিল্প হয়না - হবেনা অন্ততঃ ভারতের মত চিরকৃষিপ্রধান দেশে। আরে বাবা এটা বোঝেন না কেন? কোনও মা তাঁর প্রথম সন্তানকে মেরে দ্বিতীয় সন্তানের স্বাস্থ্য কামনা করেন না। আর যারা করেন তাদের ডাইনি বলা হয়।

রতন টাটা বা সঞ্জীব গোয়েঙ্কা বা সঞ্জয় বুধিয়ারা যতই আপনার বন্ধু হোন না কেন, বুদ্ধবাবু, ওঁরা ব্যবসায়ী। ওঁদের স্বার্থের ল্যাজে পাড়া পড়লেই ফণাটা দেখতে পাবেন। শিল্পপতিদের সাথে আপনার বন্ধুত্বকে আমরা সাদা চোখেই দেখি। কিন্তু তাই বলে কৃষকের প্রতি এই অমানবিক নীতিজ্ঞানহীনতাকে মেনে নিতে পারবনা।

পরিশেষে আবার বলি - লাল বাবুরা কি এবার একটু ঠান্ডা মাথায় ক্ষমতার অহম কে পাশে সরিয়ে রেখে দাবার ভুল চালগুলো ঠিক করে নেবেন? বেশী সময় নেই। 'অগ্নিকন্যার অনশনের আজ আটদিন। আর বেশি দিন টানতে পারবেন বলে মনে হয়না।' এই কথায় সারবত্তা নেই। কারণ আনপ্রেডিক্টেবল মমতা যে হটকারী এটা তো আপনারাই বলেন। এবার যদি সত্যিই তিনি আমৃত্যু অনশন করে বসেন তবে আবার তাঁকে পুলিশ দিয়ে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। আর আপনাদের এই খাঁকীরা আগমার্ক খাঁটি ঠ্যাঙ্গারে। প্রয়োজনে অবশ্য সাদা পোশাকও নামবে। আবার অশান্তি। আবার ভাঙ্গা ভাঙি হানা হানি টানা টানি। ভুলে যাবেন না মমতার কাছে এটা তুরুপের শেষ তাস। সেটা তিনি বেশ নিষ্ঠাভরেই খেলছেন। খেলবেনও। কারণ সহানুভূতির ভোট আজও পড়ে। আর এখনতো আরও সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন হবে। এরপর, যত দিন যাবে ততই কিন্তু পাল্লায় মমত্ববোধের বাটখারার ওজন চাপতে থাকবে।

সমব্যথী কংগ্রেস, এস ইউ সি, নকশালদের গোষ্ঠীগুলি, বিজেপি এরা সবাই কিন্তু বামফ্রন্ট নিপা যাক বলে বেশ সুখ বোধ করেন। কেন্দ্রের কংগ্রেসের সাথে মিলিজুলি সরকার তো একটা আপোষ। এটা আপনারা জানেন। কেন্দ্রে বহুগামী হারেমে একসঙ্গে থাকেন বলে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেনা। এবার একটু নিজের ঘর গুছিয়ে নিন। একটু কথা বলে দেখুন রতন টাটার সাথে যে উনি অন্য কোনও জমি নিতে উৎসাহী কিনা। চাষের অযোগ্য অনেক জমি পশ্চিমবঙ্গে আছে যেখানে শিল্প গড়ে উঠতে পারে। টাটাদের সেখানে বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্র (SEZ) গড়ে তুলতে উৎসাহিত করুন। বিশেষ আর্থিক সুবিধা দিন। স্পেশ্যাল ট্যাক্স হলিডের মাত্রা বাড়ানোর জন্যে কেন্দ্রের সাথে সম্পর্ককে কাজে লাগান। একটু পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বা বীরভূমের দিকে তাকাবেন? টাটা বা অন্যান্য শিল্পগোষ্ঠীদের বলুন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে সেখানে। সেই পরিকাঠামো প্রথমে তাদের কাজে লাগুক। পরে BOT ভিত্তিতে সরকারকে হস্তান্তর করা যেতে পারে। সালিমরা দক্ষিণবঙ্গের উন্নয়নের দায়িত্ব নিক আর টাটা, মাহীন্দ্রা বা হিন্দুজারা মধ্য ও উত্তর বঙ্গের পরিকাঠামো গড়ার দায়িত্ব নিক। সবাই ব্যবসাও করুক। আপনারা জানেন কি করে শিল্পপতিদের উৎসাহ দিতে হয়।

এখানে একটা বড় লাভ আছে। সিঙ্গুর ইস্যুটা যদি নাই থাকে তবে মমত্ববোধের ঝরণাধারা বইবে কোথায়? আর তো কোনও ইস্যু নেই পশিমবঙ্গের বিরোধী দলগুলোর হাতে! ভেবে দেখেছেন খুলিমুদ্দিনের মস্তিষ্ক ভান্ডারের কান্ডারীরা?

এই লেখা যখন লিখছি তখন ১৪ই ডিসেম্বরের সদম্ভ বনধ্‌ ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে। বন্ধের রাজনীতি আর কতদিন?

সুপ্রভাত মুখ্যমন্ত্রী! লেগে পড়ুন এবার। অনেক কঠিন কাজ করতে হবে! মানুষ আপনার সাথে আছে।

সপ্রতীক অরূপ ঘোষ

ডিসেম্বর, ১১, ২০০৬

মুম্বাই