ফিরে এস চাকা
কবি। ইঞ্জিনিয়ার। গণিতজ্ঞ। ভাষাবিদ। কবি।
সত্যি এক ব্যতিক্রমাত্মক ব্যক্তিত্ব। আমাদের যৌবনের প্রাজ্ঞ প্রবুদ্ধ বিনয়দা। সত্তরের দশকের কফিহাউসের শ্রদ্ধেয় বিনয়দা। কবি বিনয় মজুমদার। এবার তিনি চাকাকে ফিরে আসতে বললেন না। তিনি পরপারের রথের চাকায় গতি এনে দিলেন। যেতে চাইছিলেন অনেকদিন ধরে। আর ভাল লাগছিলনা তাঁর।তাঁর গণিতের তত্ত্বের ওপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ হয়, থিসিস লেখা হয়, পি এইচ ডি ডিগ্রি দেওয়া হয়। তাঁর শিবপুর বি ই কলেজের
মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর পঞ্চাশ বছরের রেকর্ডস মার্কস আজও অটুট আছে। মগজে যন্ত্র ও গণিত আর হৃদয়ে কবিতা। কি অসম মেলবন্ধন! বহুমুখী এই প্রতিভার কোনও কদর হয়নি বস্তুবাদী পৃথিবীতে। তিনি অবহেলিত ও অনুচ্চারিত থেকেই যান। তাতে তাঁর কিছু এসে যায়নি। ওঁর কবিতার বইগুলো কথা বলে। বেনিয়াপনার চূড়ান্ত বিরোধী এই মানুষটি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার আমন্ত্রণ হেলায় ত্যাগ করতে পারেন। করেছিলেনও তাই। কত সন্মানীয় পুরস্কারে ভূষিত এই মানুষটি শরীরের প্রতিটি কোষে ও মনের প্রতিটি কোনায় কবিতা নিয়ে অভিমানী নীরবতায় চলে গেলেন।
যিনি তিনশ পঁয়ষট্টি দিন চব্বিশ ঘন্টা কবিতাকে ভালবাসতেন, তিনি নীরবে প্রায় বিনা চিকিৎসায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন! বাংলা কবিতার ছোট বড় নক্ষত্রদের কাউকেই দেখা গেলনা তাঁর স্বগৃহে শেষ যাত্রার চিতার পাশে! কবি মুখ্যমন্ত্রী পুস্পস্তবক পাঠিয়ে ছিলেন। নাকি প্রটোকল?
কবির অভিমানের কথা কেউ জানতেও পারলনা। কবি তো তাই চেয়েছিলেন। উত্তর চব্বিশ পরগণার গাইঘাটার ঠাকুর নগরের অনামী অখ্যাত তাঁর ভালবাসার কিছু মানুষ ছিলেন তাঁর শয্যা পাশে। ভালবাসা তো একমুখী। তাই কবিতাকে নিস্বার্থ ভালবাসার মূল্য এই প্রেমিক কবি অসূয়াবিহীন চিত্তে দিয়ে গেলেন।
বিনয়দাকে যেমন দেখেছি। অনসূয় প্রবুদ্ধ চিত্ত। মিতভাষী। মিতাচারী। মিতব্যয়ী। নির্লোভ। অকৃতদার গৃহী সন্ন্যাসী স্থিতধীরূপ এক মানুষ চুপ করে চলে গেলেন। চুপিসারে নয়। কাউকে কিছু না বলে চলে যাবার জন্যে মানসিক ভাবে তৈরী হয়েই ছিলেন। মানুষে মানুষে হানাহানি, মারামারি আর দুর্নীতির দাপট আর নিতে পারছিলেন না এই স্বল্পভাষী মানুষটি। চুপ করে থেকে কলমকে দিয়ে কথা বলাতেন সকলের বিনয়দা।
এরকম এক ব্যক্তিত্বের অধিকারি জীবনের কবি বিনয় মজুমদার নিঃশব্দে চলে গেলেন সোমবার এগারোই ডিসেম্বর। কি আশ্চর্য! জীবনানন্দ ধারার মুখ্য উত্তরসূরি কবি চলে গেলেন নীরবে আর কলকাতার বা বাংলার কবিমহলে তার কোনও দাগ নেই। চোখের চামড়া না থাকলে বা চামড়া খুব মোটা হলেই বোধহয় কোনও দাগ কাটেনা।
একটা কথা বলি বিনয়দা আপনাকে! চাকাটা তো ঘুরছে। ঘুরতেই থাকবে। আপনি যেমন ছিলেন তেমনই থাকবেন। আমাদের মনে। শুধু যদি আরেক বার ইচ্ছে করেন তো বলি - ফিরে এস চাকা।
ডিসেম্বর ১১, ২০০৬
মুম্বাই