মহারাজ তুমিই মহারাজা
সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ। সবচেয়ে সফল ক্রিকেট অধিনায়ককে দশ মাস টীমের বাইরে থাকতে হয়! তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে দশ হাজারেরও বেশি রান। সম্পৃক্ত বোলিং ও ফিলডিং এর সমাহার।তাও তাকে টীমের বাইরে থাকতে হয়! হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে মহারাজের ব্যাটে বেশ কিছুদিন ধরে রানের খরা লেগেছিল। সেই নিয়ে মিডিয়ার মহাভারতের টি আর পি কোন উচ্চতায় পৌঁছেছিল কে জানে তবে তা বেশ গসিপের রসদ হয়ে গিয়েছিল। ক্রিকেটের কিংবদন্তী শচিন তেন্দুলকারের ব্যাট থেকে তো বছরের পর বছর ধরে রান আসেনি। সেক্ষেত্রে, টীমে থাকার জন্য তার আসল ক্লাস এর কথা মাথায় রাখা হয়েছিল বা এখনও হয়ে থাকে। সেটা নিয়ে কেন মিডিয়া প্রশ্ন করেনা! আমি কিন্তু শচীনের ভক্ত হয়েই কথাটা বলছি।ভি ভি এস লক্ষণ তাঁর আগে টীমে ডাক পেয়ে যায়! কিন্তু মহারাজের ডাক পেতে আরও বেশী সময় লাগে।
সৌভাগ্যের কথা, মহারাজ টীমে এসেই রান পেয়েছে শুধু নয়, তাঁর উপস্থিতি টীমের সকলের মধ্যে সেই প্রাণ নিয়ে এসেছে যা দিয়ে শত্রুর জমিতে শত্রুকে বধ করা যায়। এই লেখা লিখছি যখন সাউথ আফ্রিকার মাটীতে সাউথ আফ্রিকাকে ভারতের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিতে হয়েছে ১২৩ রানের ব্যবধানে। এই জয় যে টীম ইন্ডিয়াকে কতখানি মনোবল ফিরিয়ে দেবে তা ভেবে নিতে চরম ক্রিকেট বিদ্বেষীরও খুব একটা অসুবিধা হবেনা।
সেই সৌরভকে দলে দরকার ছিল যে শুধু নিজে ভাল খেলেনা, টীমের সবাইকে ভাল খেলতে উৎসাহিত করে। এরকমও শোনা গেছে যে শচিন মাঠে থাকলেই নাকি তার উপস্থিতি যথেষ্ট ভাল টনিকের কাজ করে নব প্রজন্মের ক্রিকেটারদের ওপর! দেখেছি কি সেরকম কিছু ঘটতে গত দশ মাসের পরাজয়ের ধারার মধ্যে? টীমটা নুব্জ হয়ে কোমর ভাঙ্গা অজগরের মত যেন নড়তেই পারছিলনা। কি আশ্চর্য দেখুন,এই শ্রীশান্থ আগেও টীমে ছিল। এবার যেন প্রকৃত কেরল এক্সপ্রেস হয়ে সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইন আপকে তছনছ করে দিল। জহীর খান! কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল ছেলেটা - ফিরে এল এই ওয়ান্ডারার্সেই। প্রাজ্ঞ অনিল কুম্বলের কথা বাদ রাখছি। কারণ তাঁর মত ক্রিকেটীয় অভিজ্ঞতার ঝুলি ক’জন ক্রিকেটারের আছে! তবে তাঁর ক্ষেত্রেও এতটা টীম ম্যানশিপ আগে দেখিনি যা দেখলাম এই টেস্টে।
অফিসের এক সহকর্মী এসে বললেন যে আমাকে পার্টী দিতে হবে! কারণ? সৌরভ রান পেয়েছে তাই! আমি মনে মনে বললাম যে আপনি কি শোক পালন করবেন শচীন দ্বিতীয় ইনিংসে শুন্য করেছে বলে!
আসলে সৌরভকে মিডিয়ার দেওয়া 'দাদা' ডাকটার খারাপ দিক এটা। সৌরভ দল থেকে বাদ পড়ার পর শুধু কলকাতায় নয় সারা ভারতের বিভিন্ন কোনায় প্রতিবাদের আওয়াজ উঠেছিল। মিডিয়ার কানে তা পৌঁছয়নি। আমি নিজে দেখেছি রাহুল দ্রাভিড়ের শহর ব্যঙ্গালোরে, শচিনের শহর মুম্বাইতে বা রাজ সিং দিল্লিতে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ কি ভাবে ফেটে পড়েছিল সেই দিনগুলিতে। সৌরভকে বাঙ্গালী হিসেবেই কেন দেখতে হবে আমি বুঝিনা। যিনি ভারতের ক্রিকেটীয় সন্মান পুনরুদ্ধারের সক্রিয় সৈনিক তিনি মুখ্যতঃ বাঙ্গালী হিসেবে কেন চিহ্নিত হবেন! আমি বুঝিনা। এ কোন সংকীর্ণতার প্রকাশ! আমি নিজে বড়িশায় চব্বিশ বছর কাটিয়েছি। বড়িশা স্পোর্টিং এর মাঠে খেলেছি এবং সৌরভ পিতা চন্ডী গাঙ্গুলী কে খেলতে দেখেছি। আমি সৌরভকে আমার বড়িশার ছেলে হিসেবে বা শুধু একজন বাঙ্গালী হিসেবে দেখতে আদৌ রাজী নই। সৌরভের সুবাস সারা পৃথিবীর জন্য।
পরিশেষে বলি। সৌরভ এই দশ মাসে শুধু নিজেকে তৈরী করেছে টীমে তাঁর প্রাপ্য স্থান ফিরে পাওয়ার জন্যে তাই নয়, সে একাগ্রতার মহারাজ হয়ে উঠেছে। সৌরভ মানুষের কাছে একাগ্রতার এক সুন্দর উদাহরণ হয়ে থাকবে। আর যদি সেই সঙ্গে তার ক্রিকেটিয় বিকাশের চূড়ান্ত বিচ্ছুরণ ঘটতেই থাকে আগামী কয়েকটি বছরে তবে ক্রিকেট নিয়ে রাজনীতি করা লোকগুলোর থোঁতা মুখ ভোঁতা হয়ে যাবে চিরতরে।
ওয়ান্ডারার্স টেস্টের তৃতীয় দিনের শেষে মিডিয়ার প্রশ্ন গুলোকে সৌরভ সোজা ব্যাটে সাবলীল ভঙ্গিমায় ও স্থিতধী চিত্তে খেলে যাচ্ছিল। দেখে খুব ভাল লাগল। এবার নতুন পালার শুরু। সৌরভ তুমি শুধু ভাল খেলে যাও। ওয়ান্ডারার্সে তোমার প্রাণ জুড়ান হাসির সৌরভ টীমে মহারাজের উপস্থিতিকে প্রকট করেছে। এই হাসির সুবাস যেন এত টুকু ফিকে না হয় যত দিন তুমি ক্রিকেট খেলবে এবং তারও পরে!
এই প্রার্থনা করি।
মুম্বাই
ডিসেম্বর, ১৬, ২০০৬