মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি?

 

শিল্পকলার রাজধানীতে শিল্পায়নের হাওয়া! বেশ সুন্দর লাগে এই হোর্ডিংটা দেখতে যখন কলকাতায় ঢুকি। মন খুশীতে চাঙ্গা হয়ে যায়। ট্যাক্সিতে বসে মনে মনে বলি - শালা নিন্দুকের দল, আর বেশিদিন নয়। মৃত শহর, রুগ্ন রাজ্য এই সব শুনতে শুনতে কানের পোকা নড়ে গিয়ে মনের মধ্যে হতাশার শ্যেওলা জমে যুক্তিবাদী মস্তিষ্কের পক্ষে সুস্থ্য থাকাই দায় হয়ে উঠেছিল। এবার দাঁড়াও, সব শালা নিন্দুকের মুখে ছেঁড়া চপ্পল। মাফ চেয়ে নিই পাঠকের কাছে। কিন্তু সত্যিই এরকম একটা মানসিকতা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে নিজের রাজ্যের কথা বলি। ভালবাসি বলেই তো। প্রশ্ন হতে পারে আমি রাজ্যের বাইরে কেন? আমার কোনও কাজ নেই আমার রাজ্যে, তাই। যদি কোনও দিন কোনও ভাবে রাজ্যের উন্নয়নের কাজে লাগতে পারি তবে এক মুহুর্ত সময় নেব না সিদ্ধান্ত নিতে।

শিল্পায়নের হাওয়াতো এসেছে। বিনিয়োগও আসছে! এই মহাযজ্ঞের কান্ডারী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও যার পর নাই চেষ্টা করে চলেছেন। সঙ্গে মন্ত্রীসভার সবাইকে নিয়ে তিনি বেশ ইম্প্রেসিভ চেষ্টা করছেন। ভাল লাগছে। মন দিয়ে শিল্পপতিদের বোঝাচ্ছেন কেন তারা পশ্চিমবঙ্গে আসবেন! শিল্প্পতিরাও বুঝছেন! আমি খুবই আশাবাদী। তবে অন্ধ নই।

এখানে যে কথাই লিখি না কেন তার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য - তা হলো পরিবর্তন চাই।

আমূল পরিবর্তন চাই। আমি মনে করি - আমরা বাঙ্গালীরা সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে বাঙ্গালী জাতি এই মননের মাটী থেকে তৈরী। আমরা পারবনা কেন?

একটা প্রশ্ন প্রায়ই খোঁচায়! শিল্পায়নের এই মহাযজ্ঞের জন্য সরকারী পরিসেবার পরিকাঠামো কি প্রস্তুত? পরিসেবার পরিকাঠামো বলতে মূলত আমি কাজের মানসিকতার কথা বলছি। পরিসেবার মূল উপাদান হোল কাজের মানসিকতা। 'আজ নয় এখুনি করে দিচ্ছি, একটু অপেক্ষা করুন'' - এই মানসিকতা। মাফ চেয়ে নিই আগে। কেউ কি জানেন বা বোঝেন কি আমূল পরিবর্তন আনতে হবে সরকারী কাজের প্রক্রিয়ায়! কেউ কি চিন্তা করেন, কাল পর্যন্ত কি ভাবে কাজ হয়েছে সরকারী দপ্তরগুলোতে আর আজ বা আগামী দিনগুলিতে কি ভাবে কাজ করতে হবে! যদি সত্যি শিল্পায়নের হাওয়াকে চালু রাখতে হয় বা সেই হাওয়ায় আরও গতি এনে দিতে হয় তবে একবার উঁকি মেরে নয় ভেতরে ঢুকে দেখুন মুখ্যমন্ত্রী কি ভাবে কাজ হয় আপনার মন্ত্রীসভার দপ্তরগুলিতে! ওপর ওপর মন্ত্রীদের বা আমলাদের কথা শুনে চললে খুব একটা বৈপ্লবিক কিছু করতে পারবেন কি? আমি বিশ্বাস করি আপনি পিছিয়ে যাবেন না। শিল্পায়নের ব্যাপারে আপনার চিন্তা ভাবনা খুবই ভাল এবং বৈপ্লবিক কিন্তু আপনার লালবাড়ি বা অন্যান্য সরকারী ভবনস্থিত দপ্তরগুলিতে কি ভাবে কাজ হয়!

কি দিয়ে শুরু করব! কোথা থেকে শুরু করব! রাজ্য সরকারের কাজের ধরণের কিছু নমুনা দিই এখানে।

জনগণের সরকারের দ্বারা প্রকাশিত খবর। প্ল্যানিং কমিশনের সাথে রাজ্য সরকারের শেষ পারফরম্যান্স রিভিউ হয়েছে ২০০৫ এর ১৬-১৭ নভেম্বরে। ভাল কথা। কবেকার পারফরম্যান্স? ২০০৫-০৬ বানিজ্য বছরের প্রথম ভাগের। অর্থাৎ এপ্রিল - সেপ্টেম্বর ২০০৫ এর। এই রিভিউ করে কি পাওয়া গেল বা জানা গেল?

রাজ্য সরকারের প্রেজেন্টেশন এখনও সাইক্লোস্টাইল ফরম্যাটেই আটকে আছে। ৫৪ পাতার ওই পিডিএফ যদি আপনাকে পড়তে হয় তবে আপনার সব মেধা ও ধৈর্য্য কোন অজানা ফোঁকর গলে পালিয়ে যাবে আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন না। যাই হোক, পড়ার অভ্যাস আছে সেই লাইনো টাইপের যুগ থেকে তাই পড়লাম। শেষে চোখের কষ্ট ও মনের কষ্ট কি করে লাঘব করব না বুঝতে পেরে পাঠকের কাছে এলাম।

২০০৫-০৬ এ মোট ৬৪৭৬ কোটী টাকার প্ল্যান আউট লের মধ্যে ২০৮৯ কোটী টাকা রাজ্য সরকারের নিজস্ব দায় ছিল আর ৪৩৮৭ কোটী টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের দেয় দায়। অর্থাৎ দুই তৃতিয়াংশ কেন্দ্রীয় সরকারের দায়। দায়িত্ব বলায় বোধ হয় ভাল। কেন্দ্র কি এখনও বৈমাতৃক আচরণ করে?

প্রথম ষান্মাসিক সরকারী খাতে খরচের লক্ষমাত্রা রাখা হয়েছিল সারা বছরের লক্ষের ৩৫ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ৫০ শতাংশ সময়ে ৩৫ শতাংশ খরচ করা হবে। আর বাকী ৫০ শতাংশ সময়ে ৬৫ শতাংশ খরচ করা হবে! শুরুতেই গেরো। পরের ছমাসে নির্ঘাৎ কোনও অত্যাধুনিক যন্ত্রকুশলতা আসবে যা কাজের গতি বাড়িয়ে দেবে বা সরকারী কর্মচারীদের কর্মকুশলতা বেড়ে যাবে যে ৬৫ শতাংশ খরচ সময়ের মধ্যেই করা যাবে এবং উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাগুলোও পূর্ণ করা যাবে। তা কিন্তু হয়নি। আমরা সবাই জানি এখন।

পড়ুন।

􀂷 ৩৫ শতাংশ লক্ষমাত্রা নিয়ে শুরু করে ৩৩ শতাংশ খরচ করা গেছে। ২১৬৩ কোটি টাকা। বেশ! এটা ২০০৪-০৫ এর থেকে ১৩ শতাংশ ধ্বনাত্মক। তা হলে ২০০৪-০৫ কি হয়ে ছিল! পাঁচ বছরের রাজত্ব কালে এক বছর হোল ২০ শতাংশ সময়। আর প্রত্যেকটি বছরেই যদি এই রকম ধীরে ও পিছিয়ে পড়া গতিতে সরকার চলে থাকে তাহলে উন্নয়ন, শিল্পায়ন ও প্রগতি এই শব্দগুলো কি শুধু চলন্তিকায় সীমাবদ্ধ থেকে যাবেনা!

􀂷 ৬৭ শতাংশ টাকা বাকী ছয় মাসে খরচ করা হবে এই আশায় মুখে হাসি নিয়ে রিভিউ হয়েছে। রিভিউ হয়েছে কখন? পরের ছয় মাসের দুই তৃতিয়াংশ সময় যখন শেষ। অক্টোবর বা নভেম্বরের খরচের বা প্রগতির কিছু ঝলক থাকলে ভাল হতো। আশাবাদী হওয়ার সঠিক কারণ খুঁজে পাওয়া যেত।

􀂷 এর পরের বছর থেকে প্ল্যানিং কমিশনের কর্তা ব্যক্তিদের অনুরোধ যে রাজ্য সরকার যেন অন্তত ৪০ শতাংশ খরচ করার লক্ষমাত্রা রাখেন প্রথম ছয়মাসের মধ্যে।

􀂷 লিখছি ২০০৬ এর ডিসেম্বরে বসে। ২০০৬-০৭ এর দুই তৃতীয়াংশ সময় কিন্তু শেষ।

কি কাজ হয়েছে বা কোন খাতে কি খরচ হয়েছে তার কোনও খবর পাবলিক ডোমেন-এ নেই। দয়া করে বিহার বা ঝাড়খন্ড সরকার কি ভাবে কাজ করেন তার সঙ্গে তুলনা করবেন না। দোহাই।

􀂷 মন্ত্রীত্বের দপ্তরওয়াড়ী প্রকাশিত হিসেবটা যদি দেখা যায় তবে বোঝা যাবে কি তাগিদ নিয়ে কাজ হয় রাজ্য সরকারের দপ্তর গুলোতে! দু একটি দপ্তর বাদ দিলে সব দপ্তরই খরচ করেছে ২০০৪-০৫ এর তুলনায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ কম। যদি মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব, তা সে যতটুকুই হোক, এর কথা মাথায় রাখি তাহলে খরচ আগের বছরের তুলনায় ২০-২৫ শতাংশ কম হয়েছে মানে কাজ তার থেকেও বেশী কম হয়েছে। কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? মনে রাখতে ২০০৪-০৫ এর প্ল্যান আউট লে ২০০৫-০৬ এর থেকে প্রায় ১৫ শতাংশ কম ছিল। তাহলে কি দুটো প্রশ্ন প্রকট হয়ে উঠছেনা -উন্নয়নের কোনও ব্লু প্রিন্ট আছে কি? থাকলেও তার সাথে খরচের কোনও সম্পর্ক আছে কি? এহ বাহ্য!

􀂷 পঞ্চম বেতন কমিশনের চাপে ৪০ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি হয়েছে বেতন খাতে। সেই কারণে রাজ্যের কোষাগেরের স্বাস্যù ভালনা। তাহলে কেন্দ্রের দেওয়া টাকা ফেরত চলে যায় কেন? রাজ্যের স্বার্থে ফেরত যাওয়া ফান্ড কে কি অন্য খাতে বা অন্য উন্নয়নমূলক কাজে লাগানো যেত না? তার জন্যে প্রয়োজনে আইনের প্যাঁচ আলগা করা যায় না?

ডক্টর এম এম এস কিন্তু যথেষ্ট প্রগতিশীল চিত্তের মানুষ। 'Well Monitored flexibility in fund utilization in the needed sectors in the event of availability of unspent fund'-- এই ব্যাপারটা কি চালু করা যায় না? হাজার হাজার শিক্ষকের পদ খালি। অথচ শিক্ষা খাতের টাকা খরচ করা যায়নি!!!

􀂷 একষ্টার্নালি এইডেড প্রোজেক্টস এর লো ইনটেক হওয়ার জন্য নাকি টাকা খরচ করা যায়নি! অর্থ দপ্তরের সেক্রেটারীর মতামত তাই বলে। ষ্টেট প্ল্যানিং বোর্ড বলে কি একটা দপ্তর ক্যামাক ষ্ট্রীটে এখনও আছে? বা অন্যত্র, অন্য কোনও খানে!

􀂷 পশ্চিমবঙ্গের ট্যাক্সঃজিডিপি রেশিও ৫ শতাংশ যেখানে সর্ব ভারতীয় রেশিও হল ৭ শতাংশ। কেন? জানিনা। এটুকু জানি আমি য়্যাডভানস ট্যাক্স দেওয়ায় বিশ্বাস রাখি ও তাই করে থাকি। বিল ছাড়া কিছু কিনিনা। এটা এখানে বলার অর্থ হোল এই যে যারা রাজ্য সরকারের সমালোচনায় মুখর এবং বিল ছাড়া যারা কেনা কাটা করেন বা ট্যাক্স দিতে যাদের বুক ফেটে যায় তারাও একটু শুধরে নিন এবার। সরকারী দপ্তরগুলো এব্যাপারে আরও কঠোর হোন।

কি গতিতে কাজ হয় সরকারী দপ্তর গুলিতে? এর পরেও কি বলে দিতে হবে!!!

শেষ করার আগে কয়েকটি প্রশ্ন -

􀂷 সেপ্টেম্বর ২০০৫ এর পর কি সরকারী কাজকর্ম্ম কি কিছু হয়নি?

􀂷 নাকি সেই কাজের রিভিউ করার সময় এখনও আসেনি?

􀂷 নাকি রিভিউএর গুরুত্ব সাময়িক বা চিরতরে লুপ্ত হয়েছে?

􀂷 নাকি রাজ্যের মানুষের জানার অধিকারের সীমা আরও সীমিত হয়েছে?

􀂷 নাকি তথ্যপ্রযুক্তির নবতম মক্কা পশ্চিমবঙ্গেরই রাজ্য সরকারের ওয়েব সাইট আপডেট করা হয়নি গত ১৩ মাসে!!!

জানিনা। জানতে চাই। রাইট টু ইনফরমেশন য়্যাক্টের মুখ্য প্রবক্তা মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি?

 

সুপ্রতীক অরূপ ঘোষ

মুম্বাই

ডিসেম্বর ১৬, ২০০৬