মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি ? - ৮
সম্প্রতি চিঠিপত্র বিভাগের একটি চিঠি পড়ে এক অদ্ভুত অনুভুতি হলো। খুব কষ্টের এক অনুভুতি! মনে হলো, আমরা কি মানসিক কুষ্ঠ রোগে ভুগছি? এরকম কোন প্রতিশব্দ চিকিৎসা বিজ্ঞানের চলন্তিকায় পাওয়া যাবে না। জানি। কিন্তু বলছি।
কুষ্ঠ রোগ যার ইংরেজী প্রতিশব্দ হল লেপ্রসি, সেই রোগের শিকার হলে শরীরের আক্রান্ত এলাকায় স্থানীয় স্নায়ুতন্ত্রীর অনুভূতি নষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ হাতের আঙ্গুলে কুষ্ঠ হলে সেই স্থানে কোনও অনুভুতি থাকেনা। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবার মালিকদের কি তাই হয়েছে! না হলে দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে হাসপাতালগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত হাল অপরিবর্তিত কেন! নাকি আরও অবনতি হয়েছে? কবে থেকে হয়েছে? এই সব বিচার করার মানে হল রোগী মরেছে কিন্তু কি করে মরেছে বা কবে মরেছে কেউ জানেনা! থাক সে কথা।
বেশ কিছুদিন আগে আমি লিখেছিলাম পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবার পরিকাঠামোর হাল নিয়ে। সেখানে বলেছিলাম যে সব রোগের ওষুধ আছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবার রোগটি দুরারোগ্য। আজও সেই অবস্থা বিদ্যমান। কিন্তু কেন? আই টি ইন্ডাস্ট্রীকে ’এসেন্সিয়াল সার্ভিস’ এর অন্তর্গত করে নেওয়া হল বন্ধের আওতার বাইরে রাখার অভিপ্রায়ে। সে চেষ্টা সফল হয়েছিল কি গত ১৪ই ডিসেম্বর! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবা যা কিনা নীতিগত ও আইনগত ভাবে একটি অতি জরুরী 'এসেন্সিয়াল সার্ভিস' তার এই হাল কেন! কেন সরকারের ডাক্তারবাবু স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্ভেজাল ভাবে নিরুত্তাপ! কেনই বা সুচারু, প্রগতিশীল, সুস্থ ও সুকুমার বোধের প্রতীক মুখ্যমন্ত্রীও এই ব্যাপারে একেবারে চুপ! কেনই বা তথাকথিত বিরোধী দলগুলিও চুপ করে আছেন। কলকাতার সংবাদপত্রগুলির ভূমিকার কথা আর নাই বা বললাম! তারা স্বাস্থ্যের ব্যাপারটাকে নিয়েছেন অভ্যাসের ভাতের থালার পাশে নুন এর মত। আজকাল নুন বা লবন নিয়ে জনমানস এতই সচেতন যে থালার ওপর নুন নয় যেন লেখা আছে - ’ওদিকে যেওনা, কাঁচা নুন খেওনা, খেলে হৃদরোগে আক্রান্ত হবে’ - তাই খাওয়া শেষ হয়ে আর পাতের পাশের নুন অস্পৃশ্য থেকে যায়!পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবার হাল নিয়ে কারও কোনও মাথা ব্যথা নেই! তাই কি ওপথে কেউ হাঁটেন না! বিরোধীরা সিঙ্গুরের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিধানসভায় ভাংগচুড় করেন। অনশন করেন তাই নিয়ে যা কিনা সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের ভালোর জন্যই। কিন্তু হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে থাকা মুমূর্ষু রোগীর শেষ টান উঠছে, রোজই কোন না কোন
হাসপাতালে, তাই নিয়ে তাদের কোনও মাথা ব্যথা নেই। তাহলে কি আমরা মেনে নিয়েছি পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের স্বাস্থের অধিকারের এটাই শেষ সীমা! এর বেশি আর কিছু করা সম্ভব নয়! কিসের বেশি? কি আছে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবায়? সেই রামকাহিনী আর নাই বা বললাম এখানে! মিডিয়ার দৌলতে তা আজ আর কারও অজানা নয়। আমি নিজে আর জি কর হাসপাতালের বাচ্চাদের ওয়ার্ডে পাঁচ কিলো বা তারও বেশি ওজনের ছুঁচো ঘুরে বেড়াতে দেখেছি। গাইনি ওয়ার্ডের বাথরুমের স্যানিটারী পাইপ ফেটে ধাবমান দুর্গন্ধ বাহী জলধারা ওয়ার্ডের দিকে। সেরিব্র্যাল স্ট্রোকের অচৈতন্য মুমূর্ষু রোগী করিডরের মেঝেতে শুয়ে বিনা চিকিৎসায়। তিনি ওখানে কি করে পৌঁছলেন সেটা জানতে হলে জানতে হবে হাসপাতাল আসলে কারা চালায়!
কলকাতার কয়েকটি প্রসিদ্ধ সরকারী হাসপাতালের অন্তর মহলের আসল চিত্রটি স্বচক্ষে দেখলে মনে হবে পশ্চিমবঙ্গের ডাক্তারবাবু স্বাস্থ্য মন্ত্রীর বর্তমান নীতি হলো - ‘কানে গুঁজেছি তুলো আর পিঠে বেঁধেছি কুলো - কি করবি কর’! মন্ত্রীসভার অন্যান্য সদস্যদের বা বামফ্রন্টের শরিক দলগুলির কারও কি কোনও ধারণা নেই পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য পরিসেবা সম্পর্কে? তাঁরা তাদের প্রয়োজনে পিজি হাসপাতালের ভেতরের কুলীন পাড়ার সৌখিন উডবার্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসা পেয়ে থাকেন বলে কি তাঁদের একবারও মনে হয়না তাদেরই মত দু’পেয়েদের কথা যাদের কে মানুষ বলেই মনে হয়! তাঁদের কি একবারও মনে হয় না যে একই হাসপাতালের চৌহদ্দির ভেতরে বা আরও অন্যান্য সরকারী হাসপাতালে অসুস্থ মানুষ বেওয়ারিশ জন্তুর থেকেও খারাপ ভাবে আছে, মেঝেতে পড়ে আছে বিনা চিকিৎসায়! মন্ত্রী সভার সদস্যরা বা তাদের আত্মীয় স্বজনরা কিন্তু জানেন এই মানুষ জনের ভোটেই তাঁরা ওই তখৎ-ও-তাজ এর ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বন্দোবস্তের মালিকরা, মনে রাখবেন এখন কিন্তু ভোটে জেতার অনেক মেশিন কাজ করেনা! অশেষ ধন্যবাদ নির্বাচন কমিশনকে। এখন একটাই মেশিন কাজ করে। সেটা হোল ই-ভি-এম এর বোতামটা। সেটার কিন্তু দরকার হবে খুব শিগগিরই, আবার।
তার আগে বলি কি! একটু উঠে পড়ে লাগুন। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের স্বাস্থ্য পরিসেবার অপদার্থতাকে মুছে ফেলুন। যেমন করে আপনারা শিল্পায়নের কথা বলছেন, যেমন করে বিনিয়োগের হাজার হাজার কোটী টাকা আনছেন ঠিক সেই উদ্যম নিয়ে হাসপাতাল গুলোকে মানুষের চিকিৎসার উপযোগী করে তুলুন। শুধু কলকাতায় নয়। জেলার হাল আরও খারাপ। সেই দুঃখের গাঁথা লিখে আরও হতাশা বাড়াতে চাইনা। শুধু মনে রাখুন। এই একটি জ্বলন্ত গাফিলতির নমুনা সাজিয়ে রাখার জন্য আপনাদের মানুষের কাছে ভোট চাইতে আসার কোন মুখ নেই আজ আর। মুখ তুলে, মাথা উঁচু করে, মানুষের চোখে চোখ রেখে ভোট চাইতে আসার আগে স্বাস্থ্য পরিসেবার আমূল পরিবর্তন করুন। এক অশিথিল লক্ষমাত্রা ঠিক করে নিয়ে কাজ শেষ করুন। কথা দিয়ে চিঁড়ে ভেজেনা, এটা আপনারা জানেন কিন্তু এটা বোধহয় মানেন না যে এই স্বাস্থ্য পরিসেবাই বামফ্রন্টের রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দুই স্বাস্থ্যই দুরারোগ্য ভাবে অত্যন্ত খারাপ করে দেবে যদি না স্বাস্থ্য পরিসেবার আমূল পরিবর্তন করা হয়।
মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি?
সুপ্রতীক অরূপ ঘোষডিসেম্বর ২২, ২০০৬
মুম্বাই