রতনবাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ি


বড় মুস্কিলে পড়েছেন রতন বাবু। বয়স হয়েছে তার। কি করে যে এই শীতের ফুলকপি আর কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়া খাবেন নিজের কোনও রকম শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি না করে - তাই নিয়ে প্রায় রোজই ভাবেন আর মাঝে মাঝে তাঁর নতুন প্রেমিকা বুধিয়ার সাথে ফোনে কথা বলেন।বুধিয়া পুরোপুরি প্রণয়ীতা ও বাগদত্তা। বুধিয়াকে নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা হল তার আত্মীয় স্বজন নিয়ে। বড় সাধ রতন বাবুর - এক টাকায় সিঙ্গাড়ার মতন উনি আম জনতাকে এক লাখ টাকায় গাড়ী দেবেন। সাফল্যের চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে গেলে বোধ হয় এই রকম ভাবের উদ্রেক হয়! উনি কলকাতার সিঙ্গাড়া খেতে খুব ভালবাসেন। তার প্রেমিকা বুধিয়ারও ইচ্ছে - গাড়ীর নাম হোক - সিঙ্গাড়া গাড়ী। তার প্রেমিকা বুধিয়া এই প্রস্তাবে খুব গদগদ, কেননা তারই রাজ্যের জমিতে গড়ে উঠবে এই সিঙ্গাড়া গাড়ীর কারখানা।


রতনবাবুর ম্যানেজার রবিকান্ত। তিনি আবার একটু আগ বাড়িয়ে গিয়ে বলে এসেছেন এক লাখ টাকাতেই দেবেন তিনি রতনবাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ী। পশ্চিমবঙ্গের তথা ভারতবর্ষের মানুষকে তিনি সিঙ্গাড়া গাড়ি চড়াবেনই। এ’ব্যাপারে তার সাথে পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের কথা হয়ে গেছে। তারা তাদের সব রকম সাহায্যের হাত বাড়াবেন বলে কথাও দিয়েছেন। এমনকি ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীও তৈরী রেখেছেন দাদারা। পশ্চিমবঙ্গের মাসি বা মামাদের সাথে তিনি কথা বলবেন না। তার দরকারও হবেনা।


ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলি। রতনবাবু বেশ বড়সড় শিল্পপতি। তাঁর তিন পুরুষের লোহা ইস্পাতের কারবার। লরী, গাড়ি, বাস, বাড়ী, সিনেমা, আই টি থেকে মাইটিভ্যাক সব তৈরী করেন, বেচেন দেশে ও বিদেশে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও বেশ বড়সড় একটা জায়গা করে নিয়েছেন দেশে ও বিদেশের মাটীতে। আরও কি কি সব কারবার যে আছে রতন বাবুর সে সব আমজনতার জানা নেই। তবে এটা জানি নিঃসন্তান, থুড়ি, চির কুমার রতন বাবু ব্যবসা ও কারবারকেই সংসার ধর্ম্মের অন্তর্গত করে তিনি নিজের অন্তরমহলকে সক্রিয় রেখেছেন। বয়স এখন প্রায় আটষট্টি। কিন্তু বেশ সুঠাম পুরুষ রতন বাবু। তিনি গত আট দশ বছর ধরে ইতিউতি ঘোরাঘুরি করছেন। যদি কিছু জমির ব্যবস্থা হয় তবে সেখানে তার সাধের সিঙ্গাড়া গাড়ির কারখানা করবেন। তিনি এক অবিশ্বাস্য কাজ করবেন। এক লাখ টাকায় আধুনিক চার সীটের গাড়ী দেবেন আমজনতাকে। ১৯০৬ সালে এ ফোর্ড সাহেব ফক্স ভাগেন গাড়ী দিয়েছিলেন আর একশ বছর পর ২০০৬ এ রতন বাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ী আসবে।

 

সিঙ্গাড়া নামটা পছন্দ নয় - তাই না? এক টাকায় ফুলকপি আর কড়াইশুঁটির সিঙ্গাড়া পাওয়া যায়? যায়না। কিন্তু সাধ হয় নাকি টাকা টাকা দামে হাতে গরম সেই সিঙ্গাড়া খেতে? রতন বাবুরও সাধ হয়েছে এক লাখ টাকায় গাড়ী চড়াবেন! এবং সিঙ্গাড়াই নাম হবে গাড়ীর। মনে আছে সঞ্জয় গাঁধীর আটচল্লিশ হাজারের মারুতীর কথা? সে গাড়ী পথে নামতে নামতে ছাপ্পান্ন হাজারে এসেছিল। তার পর এরোডায়নামিক উইন্ডশীলড এর দোহাই দিয়ে দাম বাড়ল মাস তিনেকের মধ্যেই আশি হাজারে। সিঙ্গাড়া গাড়ী কি এক লাখে থেমে থাকবে?


পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবুও বেশ সন্মান করেন রতন বাবুকে। মানসিক স্তরে দুজনে দুজনার সন্মানীয় অতিথি। তা বেশ! এ হেন রতন বাবু মনের কথাটি বেশ কয়েক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধবাবুকে বলে ফেলেন লালবাড়ীর মূল কামরায় বসে। বুদ্ধবাবু নুতন পশ্চিমবঙ্গের রূপকার। বিনিয়োগের 'ব' এর গন্ধ পেলেই তিনি শিকারি বেড়ালের মত থাবা আঁচড়াতে থাকেন। তিনি কিন্তু অনেক পরিণত আজ। ১৯৭৭ এর সেই বন্দীমুক্তি ও গণদাবী প্রস্তুতি কমিটির মুখিয়া থেকে পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, এ যে সে লোকের কম্ম নয়! এক্ষেত্রে রতন বাবুর সাধের কথা শুনে বুদ্ধবাবু তো প্রায় তক্ষুনি হ্যাঁ বলে দিচ্ছিলেন কিন্তু প্রোটোকল নামক যন্ত্রণা সহ্য করে আর খুলিমুদ্দিনের জ্ঞাতিভাইদের বুঝিয়ে দীর্ঘকাল বুকে চেপে রাখা শ্বাস এক লহমায় ফেলে রতন বাবুকে বলেই দিলেন যে তাঁর সাধ পশ্চিমবঙ্গেই পূর্ণ হবে, তাঁকে আর ইতিউতি ঘোরাঘুরি করতে হবেনা।


বেশ! কিন্তু গেরোটা হল জমি নিয়ে। মধ্য বা দক্ষিণ পশ্চিমবঙ্গে দো-ফসলী বা তিন-ফসলী জমি বেশ চোখে পড়ে। মধ্য বঙ্গ বা দক্ষিণ বঙ্গের প্রায় সব জমিই বেশ উর্ব্বর। জমি চাই রতন বাবুর কারখানার জন্য। খুঁজতে খুঁজতে নজর পড়ল হুগলী জেলার সিঙ্গুর গ্রামাঞ্চলে। চাষীদের বলা হল জমির পাট্টা বা মালিকানা হস্তান্তর করার জন্য। চাষীর বন্ধু বামফ্রন্ট সরকার চাইছে জমি, তায় আবার তিন ফসলি জমি। বিরোধ ও প্রতিরোধের আওয়াজ উঠল। বুদ্ধবাবুর সরকারী আমলারা যখন চাষীদের প্রায় হয় মানিয়ে নিয়েছেন বা তাদের পেড়ে ফেলেছেন তিন ফসলি জমি থেকে উৎখাত করতে ঠিক তখনই বাংলার অগ্নিকন্যার মমত্ববোধের বন্যায় ভেসে গেল সিঙ্গুর ও কলকাতার মাটি। অগ্নিকন্যা মমতা বুদ্ধকে পশ্চিমবঙ্গের মাটি থেকে উৎখাত করার সঙ্কল্প নিলেন। সিঙ্গুরে গিয়ে জনসভা করার পথে পুলিশের জিপসীর খাঁচায় বাঁধা পড়লেন।তাকে শহরের আশেপাশে এনে ছেড়ে দেওয়া হলে তিনি সোজা বিধানসভা ভবনে ঢুকে তার চেলা চামুন্ডাদের নিয়ে বিধানসভা ভবনে দক্ষজ্ঞ বাঁধিয়ে দামী দামী য়্যান্টিক আসবাবপত্র ভাঙ্গচুড় করলেন। বিধান সভার স্পীকার হালিম সাহেব বকলমে খুলিমুদ্দিনের বাম ব্রক্ষ্মত্বের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করার এই সুযোগ সম্পূর্ণ কাজে লাগালেন বিধানসভায় তৃণমূলের তান্ডবনৃত্যের বিজ্ঞাপণ জনগণের সামনে তুলে ধরে। এই খেলা যখন চলছে তখন সুপ্তিসুখী ভারতীয় জনতা পার্টীর প্রায় হারিয়ে যাওয়া সভাপতি শ্রী রাজনাথ সিং কোথা থেকে ধূমকেতুর মত উড়ে এসে জুড়ে বসলেন মমতার পাশে। কি অসহ্য সহানুভূতি আর কি সীমাহীন ভ্রাতৃত্ববোধের সাথে তিনি মমতাকে বোঝালেন যে সিঙ্গুরে রতন বাবুর গাড়ীর কারখানা হলে হোক কিন্তু আমজনতা যেন বোঝে যে মমতা-রাজনাথ এর নবতম জুটি সিঙ্গুরের চাষীদের স্বার্থ রক্ষার্থে প্রাণও দিতে পারেন। একেই কি বলে রাজনীতি রাজনাথ! এই সুযোগে যদি পশ্চিমবঙ্গে আবার একটু ঠাঁই পাওয়া যায়! মনে রাখতে হবে এই সব ঘটছে এমন সময় যখন মমতা কংগ্রেসের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন। বিজেপির রাজনাথ এসে সেই বিয়ে ভেস্তে দিলেন!
 

রাজনাথেরও এক বিষফোড়া আছে। সে হল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রাক্তন মোল্লা মুলায়েম সিং যাদব। তিনি তার ভ্রাতৃপ্রতিম অমর সিং এর সমর্থনে রতন বাবুর গাড়ীর কোম্পানীর এম ডি রবিকান্তকে এক চিঠি পাঠিয়ে দিয়ে বসে আছেন। কি, না রতন বাবু যদি চান আর পশ্চিমবঙ্গে যদি মমতা-রাজনাথ সফল হন (এটা উহ্য ছিল সেই চিঠিতে) তাহলে তিনি লক্ষৌ এর উপকণ্ঠে কানপুরের উদ্দেশে রাজপথের ধারে রতন বাবুর জন্যে দেওয়ার জন্য সমধিক পরিমানের জমি কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছেন। সেই চিঠির কপি আবার বুদ্ধবাবুকেও পাঠিয়েছেন প্রাক্তন মোল্লাজি। বুদ্ধবাবুও তড়িঘড়ি সেই দিনই সাংবাদিকদের ডেকে জানিয়ে দিলেন যে কালই সিঙ্গুরের জমি রতনবাবুর লোকজনদের হস্তান্তর করিয়ে দেবেন। রাজনাথও বুঝলেন যে যদি রতন বাবু উত্তরপ্রদেশে চলে যান তার সিঙ্গাড়া গাড়ীর কারখানা করতে, তাহলে আগামী নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে মুলায়েম সিং যাদব আরও বেগ দেবেন প্রায় হারিয়ে যাওয়া ভারতীয় জনতা পার্টীকে। রাজনাথের শ্যাম রাখি না কুল রাখির দোটানার ভাঁটার টানে সিঙ্গুরের জমি রতন বাবুর নামে লেখা হয়ে গেল। সে তো হলো। এখন রতনবাবুর সমস্যা হলো তিনি ঠিক জানেননা যে কত টাকা বেশী দিতে হতে পারে চাষীদের পুনর্বাসনের খেসারত দিতে। অবস্থা সামাল দিতে মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে পুনর্বাসনের কথা বলে ফেলেছেন রাজনৈতিক অস্তিত্বের পরম ব্রক্ষ্ম মিডিয়ার কাছে।
 

ইতিমধ্যে এই সিঙ্গুর কেচ্ছায় নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের মেধা দিদিও টুক করে মাথা গলিয়ে দিয়ে বসে আছেন মমতাদিদির পাশে। রতন বাবুর চোখে ঘুম নেই। রতন বাবুর নিবেদিত প্রেম, প্রেমিকা বুধিয়া স্বীকার করেছে। কিন্তু বুধিয়ার তৃণমূলী মাসী বা সিটু মামারা সবাই খুব ঝগরুটে, কেবল ত্রুটি খুঁজে বেড়ায় রতন বাবুর আর বুধিয়ার। খালি বাগড়া দিতে উদ্যত তারা। আগামীতে, বিয়ের পর প্রেমিকা থেকে স্ত্রী হয়ে যদি মামা মাসীর দাপট বুধিয়া সামলাতে না পারে? তখন? তখন এই ডামাডোলের বাজারে ১৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রতনবাবু ব্যবসা করবেন না তৃণমূলে দই ঢালবেন না কি লালশালুর ডান্ডার দাপট সামলাবেন - ঠিক করে উঠতে পারছেনা রতন বাবু। ইতিমধ্যে বুধিয়ার জঙ্গী (সিটু) মামারা আবার ১৪ই ডিসেম্বর বনধ্‌ ডেকেছে। সদ্যপ্রসূত তথ্যপ্রযুক্তি অনুভাগকেও রেয়াত করেনি সিটু মামারা। ‘এরা কি সময় এলে আমার সিঙ্গাড়া গাড়ীর কারখানাকে ছেড়ে কথা বলবে? এখনও সময় আছে - এ বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে পালিয়ে যাও রতন।' রতন বাবুর দ্রুত শ্বাস চলে! কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম! রতন বাবু এখন ভাবছেন। লক্ষৌ যাবেন কি না! প্রাক্তন মোল্লার মোলায়েম প্রেম পত্রের টানও কি কম?
 

আর বুদ্ধদেব বাবু ভাবছেন নববঙ্গের রূপকার উপাধিটা বোধহয় নাকের সামনে দিয়ে ফস্কে গেল!
 

একদিকে এই বেয়াক্কেলে অগ্নিকন্যা আর অন্য দিকে আপন ঘরে শুঁড়ি জ্ঞাতি শ্যালক সিটু। এরা সবাই মিলে নববঙ্গের রূপকার হতে দেবেনা বুদ্ধবাবুকে। তিনি পশ্চিমবঙ্গের ভাল চান। তিনি চান, যে কোনও মূল্যে রতন বাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ীর কারখানা চালু হোক। আজ আর সেই অবস্থা নেই যে তিনি বলবেন - রতন বাবু টাটা! কারণ রতন বাবু এসে গেঁড়ে বসতে পারলে মাহীন্দ্রা ও হিন্দুজা আসবে। তারপর আজিম প্রেমজী, নারায়ণ মূর্তী বা রামলিঙ্গমরাজু আসবে তাদের তথ্যপ্রযুক্তির বড় বড় বিনিয়োগ নিয়ে। ইন্দোনেশিয়ার সালিম গোষ্ঠীর বেনী সান্তোসরা তো এখন ঘরের লোক। ওদেরও জমি দিতে হবে। ওরাও অসন্তুষ্ট হবে যদি এই সিঙ্গুর সার্কাস বেশি দিন চলে। বুদ্ধবাবুর শঙ্কা - খুলিমুদ্দিনের তখতে বসে বিমানদাও ভরসা দিতে পারেন না এক এক সময়। যদিও তিনি সিঙ্গুর নিয়ে একই মঞ্চে সবাইকে আনতে পেরেছেন - এমন কি খেল মন্ত্রী খিলাড়ী সুভাস চক্কত্তিকেও। কিন্তু মন মানেনা। খুবই কঠিন সময় এখন বুধিয়া আর রতন বাবুর। রতন বাবুর সিঙ্গাড়া গাড়ী সিঙ্গুরেই তৈরী হবেতো?
মুখ্যমন্ত্রী কি বলেন?

 

সুপ্রতীক অরূপ
ডিসেম্বর ০৭, ২০০৬

মুম্বাই