অধরা মাধুরী (বর্ণময় অন্তরালে )

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

পর্ব-৯

 

 


অধরার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে এক মনে লেখা শুরু করেছে সুবুদ্ধি, খেয়ালই নেই। পৃথিবীর সব কিছু ভুলে গিয়েছিল সে। বিশ্রামের মধ্যেই বাড়ি থেকে সব কাজ করে সে এখন। কিন্তু কোনও কাজই এক বা দেড় ঘন্টার বেশী নয়। ডাক্তারের নির্দেশেই এই নিয়ম। বাড়ির সবাইকে,এমনকি নিজেকেও অবাক করে দিয়ে সে আজ চার ঘন্টা এক নাগাড়ে লিখেছে। মাঝে মাঝে লেখা বন্ধ হলেও মন ছিলনা বর্তমানে।
আজ সকাল থেকে সুবুদ্ধি অনেক কাজও করেছে। অনেক সকালে নিজের চা নিজেই বানিয়েছে, সাড়ে ছ'টায় শ্রীকে ডেকে তুলে চা দিয়েছে। শ্রীর চোখে সেই চিরন্তন সোহাগের হাসি দেখতে দেখতে চা খেয়েছে। নীরবেই থাকে সে এখন। কথা বলতে না পারলে কি হবে সুবুদ্ধি এখনও সেই রকমই আছে। আসলে খুব প্রাণবন্ত মানুষ সে। ওর সামনেই শ্রী'র বান্ধবীরা বলেই ফেলে,আপনার একটা অরা আছে জানেন, শ্রী কি সেটা মানে? কিছুটা শ্রীকে রাগাবার জন্যে। অনেক বছর আগে এই সুবুদ্ধি এই কথার উত্তর দিত এখন শুধু হাসে আর শ্রী বোঝে সেই হাসির মানে। শ্রীও মুচকি হাসি দিয়ে তাদের হতোদ্যম করে দেয়। বেশ মজা পায় দুজনেই। শ্রীর এক মালায়লি জুনিঅর কোলীগ আছে, সবে আই এ এস হয়ে পোষ্টিং পেয়ে এসেছে প্ল্যানিং কমিশনে। সে যে কেন ফিল্ম বা ফ্যাশানকে ক্যারিয়র না করে এই প্রফেসনে এসেছে সেটা প্রায়ই অনেকের গবেষণার বিষয় হয়ে যায় আজকাল পার্টিতে। মেয়েটির নাম প্রিয়া। সে শ্রীকে দিদি আর সুবুদ্ধি কে সুবুদা বলার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিল প্রথম আলাপেই। প্রিয়া ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখলেই বলে, time has changed… 50 is the new 30... this is what I feel when I see you together. ওরা দুজনেই হাসে প্রিয়ার কথা শুনে। শ্রী এখনও সেই বাঁধনেই আকর্ষণীয়া ও লাবণ্যময়ী। সুবুদ্ধি’র পোড় খাওয়া পেটা চেহারা অমলিন হাসি নীরব রেডি উইট আর আছে নিবিড় বোধশক্তি। মেয়ে শুভা ওদের দুজনের ভালটা পেয়েছে। সবাই তাই বলে।
ওদের মাঝে লুকোনো এক বৈচিত্র্যময় রোমান্টিসিজম আছে। সামনে দেখলে মনে হবে খুব সাদামাটা স্বামী স্ত্রী কিন্তু শ্রী ও সুবুদ্ধি দুজনেই পারস্পরিক নির্জনতায় মননশীল আর তাই এত কালের প্রেম আজও আছে। সকালে চায়ের পর ব্রেকফাষ্ট হয়েছে... মেয়ের সাথে দেখা হয়েছে... মেয়ে বাবার মাথায় হাত আদর করে বুলিয়েছে... সেটা তার ঠাম্মা দিদার কাজ ছিল সুবুদ্ধির ছোট বেলায়। এখন তা শুভার ভাললাগা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীর অফিসের গাড়ি এসেছে। কখন যে শ্রী বেরিয়ে গেছে সে জানেওনা। কিন্তু শ্রী যাওয়ার সময় রোজ বলে যায়। কখন শুভা কলেজে চলে গেছে কিছুই জানেনা সে... এখন দুপুর গড়িয়ে তিনটের ওপর...
সুবুদ্ধির জীবনে এই রকম লাগামহীন একটা দিন কাটল... এই ভাবে শেষ কবে একটা দিন কেটেছে তার মনে নেই। সে শুনতেই পায়নি মোবাইলে ১৮ টা মিসড কল, শুনতে পেলেও কল গুলো সে নিত কিন্তু শুধু শোনা ছাড়া বা টেক্সট মেসেজে উত্তর দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই তার। কিন্তু চিন্তার বিষয় হল ঐ ১৮টা মিসড কলই এসেছে শ্রীর ফোন থেকে এই ঘন্টা চারেকের মধ্যে আর সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মা তখন এক অন্য জগতে ছিলেন। সুবুদ্ধি সাধারণত সন্ধে বা রাতেই লেখে। কেন আজ সে এই রকম ভাবে দিনের বেলায় এক নাগাড়ে বসে লিখে গেল সেটা বোধগম্য হচ্ছেনা কারও! এমনকি সুবুদ্ধির নিজেরও। এখন নিয়মটা এরকম যে শ্রী ফোন করে যা বলার বলে দেয় আর সুবুদ্ধি উত্তর দেবার কিছু থাকলে টেক্সট মেসেজ করে দেয়। বেশীর ভাগ ফোনই আসে ওর ওষুধ বা খাবারটা সময় মত খাবার রিমাইন্ডার হিসেবে বা ফিজিওথেরাপিষ্টের বাড়িতে আসার য়্যাপয়েন্টমেন্টের কথা।
মাঝে সাঝে হয়ত এয়ারপোর্টে বসে আছে শ্রী... ফোন করে বলত, একটা কবিতা শোনাও না... সুবুদ্ধি বলত একবার, সুখের মাঝে তোমায় দেখেছি... গুনগুনিয়ে দাও আমাকে তবে শোনাব... এই তো গত বছরও এয়ারপোর্ট থেকে ফিরছিল শ্রী...তখন সন্ধ্যা নামছে সবে... ফোন করে বলল, কোথায় তুমি? একটা কবিতা শোনাবে প্লীজ... তক্ষুণি রচিত হল... ফোনেই আবৃত্তির সাথে তার জন্ম হল...
 

 

গোধূলী প্রেম...
 

গোধূলীর ধূসরে ও লালে রঙ্গিন মাতাল দুই মন মেতেছে
সোহাগে লালিতা কন্যার চোখে ধূসর লালিমা ছড়িয়েছে
একটু নীলের আশায় চোখ থেমে যায় অদেখা উপত্যকায়
ধূসর ক্যানভাসে সোনালী তুলি মিশে কি এক সন্ধি পাতায়
কন্যা মুখ তুলে চায় দীর্ঘ অন্তরালের বাহিরে
আকাশের আকুতি আজ সে তোমায় চাহে যে
কন্যার অবোত্থিত দিঠি, ঝলকে পলকে তার নির্বাক খেলা
তিরতিরে কাঁপন অস্ফুট রিনরিনে ভাষা, চলে এস এই বেলা
এই আলো অন্ধকারের সঙ্গমে কি ভাবে লালিমা চুপ করে
তার চুপ করে শুনতে ইচ্ছে করছে কবির কথা মন ভরে
ঋজু বজ্রনিনাদি কন্ঠ ঢালে আরও রতিরাগ, লালিমা সুখে ভাসে
শব্দগুলো ভাঙ্গছে বুকের মধ্যে, ভূমিকম্পের শরী্রে আগুন হাসে
নিঃশব্দ নিঃঝুম রাত নেমেছে, ওপারে শ্বাস-হাপর চলেছে
ঋজু কণ্ঠ শুধু শব্দ নয় অনেক পেল প্রকৃতি প্রেমের কাছে
নীরবতা ভাঙ্গছে সেই কথা অস্ফুটে প্রেম বলে প্রকৃতির কানে
মুখের লালিমা শেষ আলুথালু এলোকেশ গাল বেয়ে লোনা নামে
সহসা সদম্ভ লাল খেলে যায় কন্যার ভূকম্পিতা রূপের ছটায়
প্রেমের দৃষ্টি নামে প্রকৃতির আলতা স্নাতা পায়ের পাতায়
ঝুপ করে কাছে এসে এলিয়ে হৃদয় চোখে নিবিড় চাওয়া
কন্যালতায় চৈতী আগুন প্রেমের সুখ আজ বৃষ্টি ধোওয়া
দোঁহে মিলে সুখ সাগরে বিলীন অনাঘ্রাতা পুস্প রাগের মাঝে
লাবণী প্রকৃতির দিঠি কহে, মোরে দাও ব্যথা এই ভরা সাঁঝে...



বাড়ি ফিরে শ্রী সোজা চলে এল সুবুদ্ধির কাছে...তুমি কি কর জান? জান তোমার গলায় ঐ কবিতা আমার কি হাল করেছিল আজ... আমি চোখ বুঝে ডুব দিয়েছিলাম সেই পুরোন দিনগুলিতে... সুবুদ্ধি ওকে আলতো করে জড়িয়ে চুমু খেয়ে বলেছিল... পুরোন কেন বলছ? আমরা তো আজই তখন সৃষ্টি করলাম...চল আজ একসাথে স্নান করি...। শ্রীকে কোনও কথা বলতে না দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল স্নান ঘরে। ভাগ্যিস শুভা তখন পড়তে গিয়েছিল। অনেক আদরের পর এই বুড়ি বয়েসে আলতো করে শ্রীর অস্ফুট গলা... পাগল তুমি একটা...। সুবুদ্ধি ভাবে, আজ যদি শ্রী চেয়ে বসে আরেকটা তাতক্ষণিকা কবিতা! সুবুদ্ধি কি করবে? সে তো আর আবৃত্তি করতে পারেনা... শ্রী ওর কন্ঠে আবৃত্তি শোনার জন্যে আজও পাগল কিন্তু মুখ ফুটে বলেনা। একটা চাপা আর্তনাদ ডুবে গেল সুবুদ্ধির অন্তঃস্থলে। শ্রী অন্তঃসলিলা নারী, মুখে কিছু বলেনা। তাই শ্রী চাইলে সুবুদ্ধি তার সব কিছু নিংড়ে দিতে চায়। সে ঠিক টিপিক্যাল ওগো হ্যাঁগো করা পতিব্রতা গৃহিনী নয় তবে খুবই কর্তব্যপরায়না সবার প্রতিই। মাঝে মাঝে ওর কর্তব্যের শাসনের চাপে রেগে গিয়ে সুবুদ্ধি বলত আগে, জঙ্গলে চলে যাব...। আর শ্রী হেসে হেসে বলত, যাও, তবে যেতে যেতে কপালে হাত বোলাতে বোলাতে যেও...বুঝলে? সেটা সুবুদ্ধি নিজেও জানে এবং সর্বদা অনুভব করে তার জীবনে শ্রীর ভূমিকা কতখানি। শ্রী না থাকলে তার যে কি দশা হত সেটা সুবুদ্ধির মা বেঁচে থাকতে প্রায়ই মার কাছ থেকে শুনতে হত তাকে – তার থেকেও বেশী বলতেন সুবুদ্ধির দিদিমা। তিনি শ্রী’র অন্ধ সমর্থকই শুধু ছিলেননা তাঁকে যদি কেউ শ্রীর নামে কিছু বলত তবে তার তুলোধনা করে ছাড়তেন তিনি। মানে সে যা তা এক্কেবারে,দূর নচ্ছাড় চুপ কর, শ্রী’র মত একটা মেয়ে দেখা আগে আমাকে তারপর তোর কথা শুনব...দূর হ পাষন্ড। সুবুদ্ধির মা ও বাবা দুজনেই দিদিমার চোখের সামনে চলে গেছেন। আর ওঁদের দুজনকে তিনি প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। সুবুদ্ধির মাসী ও মামারাও শ্রী’র ফ্যানই বলা যায়। কি যেন একটা আছে ওর মধ্যে যাতে সবাই ওকে খুব ভালবাসে আর এটা সুবুদ্ধি খুব উপোভোগ করে।
কিন্তু সুবুদ্ধি এখন কি করে – একটা টেক্সট মেসেজে করবে শ্রীকে...? কি ব্যাপার! ১৮টা মিসড কল? লেখার কলম থেমেছে কিন্তু কেমন যেন অসাড় হয়ে নিজেরই অগোচরে এখনও অধরাকে লেখা চিঠির কথাই ভেবে চলেছে! বাইরে থেকে চাবি দিয়ে দরজা খোলার শব্দে সম্বিত ফিরল সুবুদ্ধির। শ্রী বাড়ি ফিরে এসেছে। খুব চিন্তিত ও উত্তেজিত। নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরে ঢুকেই সুবুদ্ধির কপালে হাত রেখে বলল, তুমি ঠিক আছ তো? অত্তগুলো কল করলাম আর তুমি নীরব! তুমি ফোনটা ধরলেই আমি নিশ্চিন্ত হই এটা তুমি জান! গলা চড়ার আগেই শ্রী নিজেকে সামলে নিল। কাছে এসে গলায় হাত বুলিয়ে বলল, আমি যে কি দুশ্চিন্তায় থাকি তুমি জাননা সুবু... তুমি ফোন ধরছনা আর আমার টেনশন বেড়ে চলেছে। আলতো করে শ্রীর কোমরে হাত রেখে সুবুদ্ধি ওর চোখের তারায় চেয়ে রইল। ছাড় আমাকে আবার অফিসে যেতে হবে। সুবুদ্ধি কেমন চিতার ক্ষিপ্রতায় শ্রীকে বুকের ওপর টেনে নিল আর শ্রী নীরবে সেই জোরের কাছে নিজেকে সঁপে দিল! এক সুনিবিড় একান্তে দুজনে হারাচ্ছে তখন। দেওয়াল ঘড়ির টিক টিক যেন একটু বেশী জোরেই শোনা যাচ্ছিল, নীরব তৃষ্ণা যেন মিটতেই চায়না। কে বলবে দুজনেই জীবনের পাঁচ পাঁচ দশকের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে!
বিকেলে চা খেতে খেতে শ্রী বলল,আজ কেমন তুমি সেই আমাদের প্রথম দিকের দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছিলে। সুবুদ্ধি নীরবে হাসল,আমি একা বুঝি ফিরে গিয়েছিলাম...? শ্রীর নীরব বঙ্কিম গ্রীবা বলে দিল, শুরুটা কে করেছিল... শুনি? শ্রী চুপ করে ভাবছে সে নিজেকে কেমন করে গুটিয়ে রেখেছিল অনেক দিন ধরে। মেয়ের কলেজ থেকে ফেরার সময় হয়ে এসেছে তবুও শ্রী বারান্দায় সুবুর সাথে বসে রইল। মাঝে একবার দুবার নিজের অজান্তেই সুবুর হাত ধরে বসে রইল। এক দীর্ঘ সুখী নীরবতা ভাঙ্গল শ্রী নিজেই, তুমি কি করছিলে সারা দুপুর? ফোনটা কেন ধরছিলেনা? সুবুদ্ধি আলতো করে লিখল শ্রীর হাতের তালুতে, অধরা। কিছুটা বিরক্ত হলেও সেই প্রকাশ গোপন রেখে বলল, তুমি কি করতে পার তার জন্য এত দূর থেকে? সুবুদ্ধি ধীরে ধীরে আরাম কেদারার থেকে উঠে ঘরের ভেতর চলে গেল। একটু পরে ফিরে এল হাতের মধ্যে লেখার খাতাটা নিয়ে। ধীরে ধীরে একটা একটা করে পাতা ওল্টাতে শুরু করে শ্রীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার একটা পাতায় এসে থেমে শ্রীর দুটো হাত ধরে নীরবে ওকে পড়তে দিল...
 

দূরের অধরা,
 

আমি ভাল আছি কিনা জানাতে আমি এই চিঠি লিখছিনা! আমি ভাল আছি। আমি ভাল বন্ধু হতে পারি একথা আজ আমি আর মানিনা। কত মাস পরে এই প্রথম আমি তোমাকে লিখছি আর তুমি কিনা আমাকে তোমার পরম আরাধ্যের আসনে বসিয়েছ! ভুল করেছ তুমি। অপাত্রে দান কি একেই বলে? আমি তোমাদের কোনও খবর রাখতেই পারিনা। আমি কেন তোমার কোনও চিঠির উত্তর দিইনি? আমি বাকরুদ্ধ আজ প্রায় নমাস হল। তবে আমি ভাল আছি এখন। কথা বলতে পারিনা... নিজের কষ্টের জ্বালা আছে তবে তা আমি মেনে নিয়েছি। ঈশ্বর আমাকে কন্ঠ দিয়েছিলেন, তিনিই ফিরিয়ে নিয়েছেন তার দান। দিলে আবার তিনিই দেবেন। চিকিতসার উপকার কি হচ্ছে বুঝিনা আমি। আমি যে আর কথা বলতে পারিনা সেটা আমি জানি। জানিনা কথা বলতে পারলে এই দীর্ঘ অন্তরালের মধ্যে ফোন করতাম কিনা! হঠাত মনে হল, বেলা পড়ে এল এবার সাঁঝের পালা। আমার জীবনের সাঁঝবেলাতে আমি রোজ প্রার্থনার সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাই সকলের তরে। সেই এক ভাল লাগা আমার। তোমরা ভাল থাক এই চাওয়া কেন স্বীকৃত হয়না আমার! জানিনা। দেখ, তোমার জানিনা বলার রোগ আমাকেও পেয়ে বসেছে।
তোমার বেশ কয়েকটা চিঠি এসেছে এর মধ্যে কিন্তু আমি তার প্রতি সুবিচার করে উঠতে পারিনি। একটারও উত্তর দিইনি। তোমাকে নিয়ে আমি লিখছি সেটা আমার মন ও আমার মনের অন্তরমহলে চীরস্থায়ী আরেক মনও জানে। আমি জানি তুমি ভাল নেই। তোমার বর্ণময় অন্তরালে থাকার কথা তোমার স্কুলের দিদি আমার স্ত্রীও জানেন। মাঝে মাঝেই আমার লেখার মধ্যে তোমার কথা জেনে নেন। কিন্তু সেই লেখাও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে আজকাল। তোমার সাথে গত এক বছর ধরে কোনও যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে আসা চিঠিগুলো ছাড়া। সেও একমুখী যোগাযোগ। সেই চিঠিও আবার শ্রীই এনে দেয় আমার হাতে আর আমি পাশে রেখে দিই। তোমার চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি কোনও দিনও। আজ কেন জানিনা মনে হচ্ছে তোমাকে লিখি। আজ আমি অনেকটা ভাল আছি। সেই বদ কাশিটা কম আছে। সিগারেট খাওয়া বন্ধ যা আমি খুব এনজয় করতাম।
সকাল থেকেই ভাবছি একটা চিঠি লিখে তোমাকে সব জানাই। এখন সকাল দশটা বাজে। আমি কলম ধরেছি তোমাকে চিঠি লেখার জন্যে। এই প্রথম। তুমি হয়ত অবাকই হবে আমার চিঠি পেয়ে কিন্তু আমি সম্পূর্ণ সচেতন যে আমি লিখছি তোমাকে। কেন? জানিনা বললে ভুল হবে তবে লেখার প্রয়োজনের থেকে ভেতরের তাগিদটা বেশী অনুভব করছি। তুমি আমার কে? এই প্রশ্ন আমাকে ভাবায় না। কিন্তু আমি তো এটা জানি তোমার দেওয়া সন্মানের প্রতি সুবিচার করিনি দীর্ঘ সময় ধরে নীরব থেকে। লিখেছি, লিখছি তোমাকে নিয়ে কিন্তু তোমার একটা চিঠিরও উত্তর দিইনি আমি। গত নমাস ধরে আমি জৈবিক ভাবেই নীরব। আমার কাজ কর্ম্ম সবই চলছে নীরবতার ভাষায়। আমার সহধর্মিণী আমার কোনও অসুবিধা হতে দেননা। এই অদ্ভুত অসুখের শুরু থেকেই তিনি আরও নতুন, আরও আবিষ্কৃতা। আমি ভালবাসার নতুন রূপ খুঁজে পেয়েছি। তোমার খবর নেই বেশ কিছুদিন হল। শেষ চিঠিতে তুমি লিখেছ যে অবস্থা ভাল নয়। তবে তুমি সামাল দিচ্ছ তোমার মত করে। জান তোমার একটা চিঠি এখনও পড়া হয়নি। নির্দ্বিধায় মেনে নিই যে আমার কোনও হেল দোল নেই আজকাল। আমি অকপটে স্বীকার করি আমি খুব খারাপ পাঠক। মানুষটা আসলে কেমন সেটা তুমি এত সার্টিফিকেট দিয়ে রেখেছ যে তোমার সামনে আমার সমালোচনা করাই মুস্কিল। শ্রী কিন্তু এক্কেবারে সাফ সাফ বলে দেয় এবং নিরানব্বই শতাংশ ঠিকই বলে। আমি হৃদয়হীন হয়েছি অধরা। না হলে একজন সুন্দরী মহিলার চিঠি এতদিন ধরে বন্ধ পড়ে থাকে, বল?
তোমার শেষ চিঠিটা আমি বার পাঁচেক পড়লাম। আমি পাথর হয়ে যাচ্ছি। তুমি এক বারও আমাকে জানাওনি? জানলেই বা আমি কি করতাম! আর এতটা অধিকার বোধের জমির মালিক তো আমি নই। আমি জানি আমার দৌড়। কিম্বা যদি বলি তোমার অবস্থা তোমাকে লেখার সময় বা ইচ্ছে কোনটাই এগিয়ে দেয়নি। তুমি জান যে আমাকে কোনও কথা বললে সেটা আমার থেকেও বেশী অনুবোধের মন দিয়ে শোনে তোমার স্কুলের দিদি যাকে তুমি দেখোনি প্রায় বত্রিশ বছর। আমি যে এতটা অন্ধকারে আছি আমি জানতাম না অধরা! কি বলছ তুমি? গত ছমাস ধরে বিক্রম ঘরে বসে? সে কাজ করেনা? ব্যবসা করবে? এই বয়েসে? আর যা যা লিখেছ তা আমি হজম করি কি করে একজন সচেতন মানুষ হয়ে? আমার সারা জীবনে আমি এরকম নীরবে কোনও অন্যায় সহ্য করিনি অধরা! তুমি আমাকে আগে জানাওনি কেন? যাক সেকথা ছাড়। তোমার মা বাবার কাছে ফিরে যাবার রাস্তা বন্ধ। বিক্রম চাইলে সেটা খোলা রাখা যেতে পারত। সে চায়নি কেন তা নিয়ে আজ আর আলোচনা করার কোনও মানে নেই। তুমি লিখেছ, তোমার ছোট্ট বেলায় পা ছড়িয়ে বসার অভ্যাস ছিল। আর তোমার ঠাকুমা বলতেন, এই মেয়ের অনেক দূরে বিয়ে হবে। কিন্তু কি অদ্ভুত দেখ মা বাবার একমাত্র সন্তান হয়েও, দেশের মধ্যে থেকেও তুমি কত দূরে আছ মা বাবার থেকে। তোমার বাবা অসুস্থ অথচ তুমি তাকে দেখতে যেতে পারনা? তাকে ফোন করতে পারনা! আমি যদি পারতাম তবে একবার তোমার মা বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। নাহ... কোনও প্রশ্ন করার জন্যে নয়। শুধু নীরবে দেখার জন্যে। তাঁরা কেমন আছেন একমাত্র আদরের সেই মেয়েকে ছেড়ে, দীর্ঘ আঠার বছর ধরে!
তোমার পাশে কেউ নেই। বিক্রম কাউকেই থাকতে দেয়নি। তোমার রূপ ও গুণ নিয়ে তোমার কোনও অহঙ্কার ছিলনা প্রকাশ্যে তাও সেইই তোমার এত বড় শত্রু হয়ে দাঁড়াবে সেটা কি কোনওদিন ভেবেছিলে অধরা? তোমার স্বামীর সেন্স অফ ইন্সিকিওরিটি তোমাকে এক দ্বীপের মধ্যে বন্দি করে রাখল সারা জীবন আর তুমি শিক্ষিতা হয়ে তা মেনে নিলে সারাটা জীবন! নিজের প্রতি কি যথেষ্ট অন্যায় তুমি করনি অধরা? এত পড়াশোনা করেছিলে কেন? কেমন যেন দমবন্ধ লাগে এই সব ভাবলে! তোমার কোনও বন্ধু নেই। বিক্রম চাইলে তুমি অন্তত কয়েকজন বন্ধুকে কাছে পেতে আজ। তোমার মেয়ের টীন এজ সিন্ড্রোম নিয়ে তুমি ভারাক্রান্ত আর তার দাওয়াই হচ্ছে বিক্রমের মেয়েকে পেটানো আর তোমার তাকে বুক দিয়ে রক্ষা করার নিস্ফল প্রচেষ্টা। এসব কি? ওয়েব ক্যাম এর তার দিয়ে তোমার গলায় পেঁচিয়ে তোমাকে মারার চেষ্টা! আমরা কি শিক্ষিত বা সভ্য সমাজে বাস করি? কিছু মনে করনা আমি কোনও ক্ষমা বা অনুমতি না চেয়েই এই সব কথা লিখছি – শুধু আমার মনের কষ্ট প্রকাশ করার জন্যে। আমাকে মাফ কর। এই পৃথিবীতে এরকম নীরবে একজন নির্মম ভাবে অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে বেঁচে থাকবে আর সেটা জেনেও কিছু করা যাবেনা?
বিক্রম এখন করে কি? ওর ব্যাঙ্কের চাকরীটা’র কি হল? ও কি চিরকালই পালিয়ে বেড়াবে? ওর আত্মহত্যা করার হুমকি এখন তোমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে! তুমি কি এখন ব্লাড প্রেসারের ওষুধটা খাও নিয়মিত? তুমি রাতের পর রাত জেগে কাটাও আতঙ্কের মাঝে! এর মধ্যে তোমাকে ও তিতলি কে প্রাণে মারার চেষ্টাও করেছে সে! এটা কি কোনও মানুষের পথ হতে পারে? আমি নিজেকে এরকম অসহায় মনে করিনি কখনও। এমনকি আমার কন্ঠস্বর স্তব্ধ হয়ে যাওয়াতেও নয়। আজ আমার মনে হচ্ছে আমাকে কেউ হাত পা বেঁধে এক গহীন কাল কূঁয়োর জলে ফেলে দিয়েছে আর আমি ভেসে থাকার মত সাঁতারও জানিনা।
এখন তোমার কি মনে হচ্ছে? গানটাকে চালিয়ে গেলে তুমি আজ অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বচ্ছল থাকতে। তোমার ঐ ঈশ্বরদত্ত কন্ঠ তুমি কোনও কাজেই লাগালেনা অধরা! তুমি কি করে চালাচ্ছ অধরা? হাতের, গলার ও কানের সব অহঙ্কারই বিক্রী করে দিয়েছে বিক্রম, তা হলে? একটু খুলে বলনা। আমি কি করে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি এই সময়ে? সেটাও সম্ভব নয় কারণ বিক্রমের অত্যাচার বেড়ে যাবে তা হলে! কি করে এই অবস্থার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়? আমাকে ভুল বুঝনা – আমি আমার কথা বলছি না অধরা। আমি কেবল ভেবে চলেছি তোমার কি কোনও বন্ধু, স্কুলের, কলেজের বা ল কলেজের বা এস আর এ’র কেউ একবারও তোমার কথা ভাবেনা? তারা ভাববে কি করে? বিক্রমের জেল খানায় তো কারও আসার অধিকার নেই। কেউ নেই চারপাশে যে একটু সাহায্যের হাত বাড়াবে? আমি নিজে অসুস্থ বলে এই কথা বলছিনা অধরা। আমার কেবল মনে হচ্ছে একটা রাস্তা বের করতেই হবে। আমি ভাবছি কি, তোমার দিদিকে বলি। যদি কোনও সরকারী হাত তোমাকে এর থেকে বের করে আনতে পারে। অনেক পথ আছে। জাতীয় নারী কমিশনের সঙ্গে শ্রী যুক্ত অনেকদিন ধরেই। তুমি শুধু একবার বল বা জানাও। তোমার গান বন্ধ হয়ে গেছে। তুমি ঘরের এক কোণে গলা সাধলে বাবা আর মেয়ের ব্যাংগোক্তি শুনতে হয়! তোমার মেয়েও তো খুব ভাল গান গাইত – তাই না? আমার কথাগুলো ঠিক ঠিক ভাবে সাজান নয় আমি জানি – কিন্তু কথাগুলো অসংলগ্ন নয় অধরা। আচ্ছা তোমার সাধু মামার এক দাদা ছিলেন। মানিক মামা। তিনি এখন কোথায় থাকেন জান? তোমার স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় টিচার বা বন্ধু,  তারা কে কোথায় থাকেন জান? তাদের কারও সাথে কি যোগাযোগ করা যায়না?এক এক বার ভাবছি খরদহের খগেনদা কে জানাব কিনা, তিনি এক্কেবারে সাচ্চা মানুষ। জাতীয় রাজনীতির সাথে আপোষহীন সম্পর্ক তার দীর্ঘ চল্লিশ বছরের। তিনি শুনলে নিশ্চয়ই একটা রাস্তা বের করে দেবেন। আমি কেমন অনর্গল নিজের অসহায়তার প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছি দেখ তোমার সামনে।
শোন একটা কথা না বলে পারছিনা, এখনও সময় আছে। এবার বাইরে বেরোও তুমি। তোমার সব আছে। রূপ, গুণ, শিক্ষা ও ব্যক্তিত্ব – তবে কেন তুমি পারবেনা অধরা? তুমি না অধরা মাধুরী। তোমার আরধ্য মানুষটি আজ কিছু চাইবে তোমার কাছে – দেবে? তুমি যদি কথা দাও তবে বলব।


জানিনা এই চিঠির উত্তর আসবে কি না! তাই চেয়েই ফেলছি এই পাতায়।


অধরা তুমি সব কিছুকে সামনে রেখে বিক্রমের সাথে খোলাখুলি কথা বল। বল যে তুমি কাজ করতে চাও। শুরুটা গান শেখান দিয়েই হোক। তাতে তুমি বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারবে। বিক্রমের চোখের আড়াল না হলেই তো হল। নাগপুরে অনেক বাংগালী আছে। আচ্ছা তুমি নাগপুরেও কাউকে বন্ধু হিসেবে পাওনি? তোমার গান শোনেনি কেউ ওখানে? একটু বেরিয়ে দেখনা! আমার কিছু পরিচিত আছেন নাগপুরে যাঁরা আমাকে খুব ভালবাসেন তুমি অনুমতি দিলে আমি তাদের বলব তোমাকে একটু এগিয়ে দিতে যাতে করে তুমি নিজেই চলতে পার। বিক্রমকে বল জীবনের নেতিবাচক পথে গিয়ে সে কি এত দিনের লড়াইটা ধূলোয় মিশিয়ে দেবে? আমি বিক্রমের লড়াই করার অহঙ্কারের মূল্য বুঝি বলেই বলছি এই কথা। সে কি বুঝবেনা যে তোমাদের তিনজনের একটু শান্তি পাওয়ার দরকার আছে। আমি বুঝিনা বিক্রম কেন তোমাকে অন্ধকারে রেখে দিতে চায়! এখন ছোট ছোট শহরে এমনকি গ্রামেও পুরুষ ও নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবিকা অর্জন করছে। আর তুমি? ঘরে বসে অর্থনৈতিক পরাধীনতার দাসী হয়ে কষ্ট পাচ্ছ! মাফ চাইছি আবার। তোমার জীবনের বাকী দিনগুলোতে আমি প্রার্থনা করি তুমি যেন তোমার প্রাপ্য মর্যাদা, সম্ভ্রম ও খোলা আকাশের নিচে নিশ্বাস নেবার স্বাধীনতার মধ্যে বেঁচে থাক।

 

পা বাড়িয়ে ভেতর থেকে বাইরে এস
জীবনের স্বাদ নাও – নিজেকে ভালবাস।
জীবনের স্বাদ তব সকাশে চিরন্তন সত্য এখন
গান গেয়ে ভেঙ্গে দাও সময়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বন্ধন
বিদূষী মানবী তুমি গন্ডিতে আবদ্ধ প্রাণী হয়ে নয়
বাঁচ নিজের স্বকীয়তায় নয় প্রাণের ক্ষুদ্র বাসনায়
সুরের বৈচিত্র্য ও আনন্দের স্বাদ নিয়ে নাও
আবিষ্কারি সেই আনন্দের ভাগ আমাকেও দাও
গান গেয়ে তুমি যবে প্রথম নিজের পাখায় উড়বে
দূরে কোথাও কেউ তোমার সেই মাধুকরী স্বীকার করে নেবে
তোমার ইচ্ছাগুলোকে চলার গতি দেবে বলে ওঠ তুমি এবার
নিজের অস্তিত্বের মরমে প্রবেশ কর। বল নিজেকে বার বার
কত সম্ভাবনা গাইছে নতুন গান মন পেতে শোন তুমি
উদারা মুদারা তারায় সিঞ্চিতা তোমার সংগীত ভূমি
তোমাকে এগিয়ে দেবে তোমার গান নতুন এই মোরাম পথে
পান কর সজীবতার পানীয়, আকাশের আশীর্বাদ নিয়ে মাথে
অদূরে রাজপথে চলার জন্যে সেই শুরু খুব দরকার আজ
গান গান গান শুধু গান তোমার নেই আর কোনও কাজ
তুমি হলে অধরা। সম্ভাবনা ভূমিষ্ট হোক তোমার
সংগীতের মূর্চ্ছনা, তোমার শৈলী ও মাধুর্যের বাহার
পিলু কিম্বা দরবারী বা মিয়া কি টোড়ি কিম্বা মিশ্র খাম্বাজ
শুরু কর - এই টুকু মাধুকরী চেয়ে নিই এই কলমে আজ...


ইতি
সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মা

 


চোখের কোণে চিক চিক করা রূপোলী আলো দেখতে পেয়ে সুবুদ্ধি কাছে গেল শ্রীর... অতলজলের আর্তনাদ শ্রীর কন্ঠে, তুমি এত প্রাণ নিয়ে চুপ করে আছ কেন... কেন... কেন...
 

 

 

 

পর্ব-১০

 

 

 

 

অনেকদিন পরে সুবুদ্ধি আবার কাজ শুরু করেছে। দিন মাস ঘুরে প্রায় দু’বছর। কথা বলছে। আগের মত দিনে দশ বারো ঘন্টা ঠাঁয়ে কাজ করতে পারেনা – কথা বলার বা পড়ানোর মাঝে বিরতি থাকে। ডাক্তারের বারণের থেকেও বেশী হল ভয়। নিজেও সে এখন অনেক সংযত। অতি সন্তর্পণে গলার ব্যবহার করে। তাও প্রকৃতি কি নিষেধ বারণ সংযম মানে! সে চলে তার নিজের মত। তাই মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে “আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে... সকল অহঙ্কার তুমি ডুবাও চোখের জলে...” কিম্বা “আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে...” – অমনি হয় মেয়ে নয় মা এমন ভাবে তাকায় যেন সুবুদ্ধি নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলেছে। এমনকি মায় রান্নার মাসী যে মাত্র ক’মাস আগে এ’বাড়ীতে এসেছে, রাণাঘাটের বৈষ্ণবী যে গান খুব ভালবাসে সেও পারলে বলে ফেলে “গলা চড়িয়ে গান নয়...”। এক কড়া ভালবাসার পুলিশ পাহারায় সে এখন। এখন বাড়িতে অফিসে এমনকি গাড়িতেও সব সময়ের পাহারা সজাগ। বাড়িতে শুভা বা শ্রী পালা করে নিষ্ঠার সঙ্গে কর্তব্য পালন করে চলেছে। গলার উচ্চস্বর তো দুরস্থান একটানা কথা বললে বা আবৃত্তি শুরু করলেই এলার্ম বেজে ওঠে – “তুমি আবার...!” ইত্যাদি। ব্যস আর কিছু বলার দরকার হয়না। সুবুদ্ধি নীরব হয়ে যায় অনেকক্ষণ। ওর মনে পড়ে যায় সেই দুর্বিহ দুই বছরের দিনগুলির কথা। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসত গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোত না। কত দিন শুভাকে শ্রীকে নাম ধরে ডাকতে পারেনি সুবুদ্ধি। এখনও পারেনা আগের মত সেই ভেতরের ঘর থেকে একটা আদরের লম্বা ডাক দিতে। এই দু’বছরের মধ্যে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ওদের নাম রেখেছিল ‘কলিং বেল সিনিওর’ আর ‘কলিং বেল জুনিওর’ – সিবিএস আর সিবিজে । এক মুহূর্তের জন্যে সুবুদ্ধিকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি এই দু’বছরে ওরা দু’জন। কি জ্বালা যে ভালবাসার! এক লাগাম ছাড়া বোহেমিয়ানকে মা ও মেয়ে বেঁধে ফেলেছে। আত্মীয় বন্ধুরা এখনও মাঝে মাঝে ঐ নামেই ডাকে ওদের। বেশ মজা করেই ওরা নাম দু’টিকে ধরে রেখেছে। কিন্তু ওই নামের মধ্যে সুবুদ্ধির যে কত কষ্ট চাপা আছে তা সে জানে আর জানে শ্রী। কিছু বলেনা – অল্প সময়ের জন্যে আত্মীয় বন্ধুরা আসে তাদের কিছু বলতে চায়না সে। ওরা মজা করে চলে গেলে শ্রী নীরবে আসে আর বলে ওদের কথায় তুমি কিছু মনে করনা – তুমি তো এখন একদম ঠিক হয়ে গেছ – এটাকে হালকা ভাবে নাও না! সুবুদ্ধি কিছু বলেনা। শ্রী যে কি করে বোঝে ওর সব কিছু! নাহ সুবুদ্ধি কিছু মনে করেনা তবে দু’বছরের নীরবতায় যে কত কথার মৃত্যু হয়েছে, কত কথা বলা হয়নি – সুবুদ্ধি অন্য কাজে মন দেয়। সে নিজেও জীবনকে যারপর নাই ভালবাসে। এই শাসন তার কাছে খুব অপছন্দের নয় তবে এই অপ্রাকৃতিক সুবুদ্ধিকে চিনে নিতে বেশ অসুবিধে হয় নিজের। দীর্ঘ দু’বছর ধরে বন্দী হয়ে থেকে ওজনটা বেশ বেড়েছে আর বেড়েছ রক্তে চিনির পরিমান। সুবুদ্ধি রংগ করে বলে – আমি এবার এতদিনে মিষ্টি হলাম, এতদিন ছিলাম তেতো, টক ঝাল আর নোনতা। রোজ সকালে একঘণ্টা নিয়ম করে হাঁটা। তারপর শ্রী’র সাথে প্রাণায়াম করা। তাতে ফল হয়েছে। বিনা ওষুধেই রক্তে চিনির পরিমান মাত্রাধীন এখন। শ্রী জানে ও খুবই মানে পতঞ্জলী যোগাভ্যাসের নিয়মপদ্ধতিগুলো। বন্ধুরা শ্রী কে বলে তুমি এবার একটা বামদেব আশ্রম খুলে ফেল ভি আর এস নিয়ে। সুবুদ্ধির নব পর্যায়ের দিনগুলি এইভাবেই শুরু হয়।

জীবনের এই নবপর্যায়ে হঠাতই পেছন ফিরে দেখা একদিন। ইন্টারনেটে ‘অধরা’ বলে একটা ইয়াহু গ্রুপ তৈরী হয়েছে। স্রষ্টা নব আলোকে বাংলার পাঠকবর্গের একাংশ। তাদের একটা মে’ল শ্রী ও’কে ফরোয়ার্ড করেছে। শ্রী কি ঐ ইয়াহু গ্রুপের মেম্বার! একটা টেক্সট মেসেজও করেছে –“তোমার অধরাকে পাঠালাম, মে’ল খুলে দেখ”। প্রায় মিনিট কুড়ি কেটে গেছে তার পর - সেই মে’লটা সামনে খোলা এখন সুবুদ্ধির। মে’লটার মধ্যে কি আছে সে’টা নিয়ে সে আদৌ চিন্তিত নয়। কারা এরা তাও জানার কোনও ইচ্ছে নেই তার।

 

অধরা – এই নাম এখন সাধারণের মুখে মুখে আন্তর্জালে ঘুরছে আর তার পরম স্রষ্টা তাকে ভুলতে বসেছে! হঠাত সেক্রেটারী মিসেস প্যাটেল বলল, “স্যার আপনার মিটিং আছে সুদর্শন কুমারের সঙ্গে একটু পরেই – আপনি কিন্তু...” সুবুদ্ধি হাসল, কিছু বললনা। ইনি হলেন মিসেস ওফেলিয়া প্যাটেল, সুবুদ্ধির অফিসের গার্ডিয়ান শ্রী তাকে বিশেষ ভাবে ট্রেইন করেছে যাতে সে গলা তুলে কথা না বলে। সুদর্শন কুমার মোটেই সুদর্শন নন। সেটা তিনি নিজেই বলেন আর হা হা করে হাসেন। ইনি হলেন এক বিরাট মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর ইন্ডিয়া হেড। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন – বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে সুদর্শন – এখন মধ্য চল্লিশের কর্পোরেট দাদা। তবে সুবুদ্ধি কে খুব সন্মান করে আর মাঝে মাঝেই বলে – আপনি স্যার আমাদের কিছু শেখান। সুবুদ্ধি হাসে।

মিটিং শেষ করে গাড়িতে উঠতে গিয়ে অধরার মুখটা মনে পড়ে গেল। সারা রাস্তা এক অস্বোয়াস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল সন্ধ্যেবেলা। অধরা ইয়াহু গ্রুপে অনেকেই কিছু না কিছু পোষ্ট করে রোজ। কি লেখে এরা? কেন তারা এই নামটাকে বেছে নিল! এর মধ্যে কারা সব আছে! কত প্রশ্ন ঘুরতে লাগল সুবুদ্ধির মনে। ভাবল একবার মানবী অধরাকে ফোন করে বলে যে তার নাম আজ পৃথিবীব্যাপী এক শব্দ কিন্তু সেটা ব্যঙ্গ করা হবে বলে মনে হল ওর। কারন সুবুদ্ধি জানে অধরা কি অবস্থার মধ্যে আছে। শ্রী বাড়ি ফিরে দেখল সুবুদ্ধি একা বারান্দায় অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। পিঠে একটা হাত রেখে বলল, কখন ফিরেছ! সুবুদ্ধি কিছু বললনা - ইশারায় বোঝালো খেয়াল নেই।

চা’ বানিয়ে ট্রে’ট্রলী ঠেলে আনার সময় শ্রী খেয়াল করল সুবুদ্ধি খুব উদাস।

চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বসে আছে সুবুদ্ধি।

শ্রী নীরবতা ভাঙ্গল। ‘কি হয়েছে তোমার!’ ‘কিছুনা...’ বলেই মনে হল ওর নিজের - সে কার কাছে গোপন করতে চাইছে যে তাকে আয়নার মত জানে ও চেনে – গোপন করতে আদৌ চাইছে কি! না কি ভাবছে শ্রী কেন বুঝতে পারছেনা সুবু কেন ভাল নেই এখন – শ্রী তো সব বোঝে! আলতো স্বরে প্রশ্ন করল সুবুদ্ধি,  আচ্ছা তুমি কি অধরা ইয়াহু গ্রুপের মেম্বার? শ্রী একটু হেসে জবাব দিল, ধূর আমি কি জানি নাকি এরা কারা কত লোকের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই তারা সব নতুন নতুন ইয়াহু বা গুগল গ্রুপ তৈরী করছে আর মে’ল বক্সে যত মে’ল আই ডি সেভ করা আছে তাদের পাঠাচ্ছে। আমি তোমাকে ঐ মে’লটা ফরোয়ার্ড করলাম ঐ নামটা দেখে... ডিলিটও করে দিয়েছি পরে। কিন্তু তুমি এত উদাস কেন আজ সুবু? একটানা কথাগুলো বলে শ্রী থামল কেমন যেন অদ্ভুত ভাবে ওর দিকে না তাকিয়ে শ্রী ওকে দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। স্বগোতক্তির সুরে বলল সুবুদ্ধি, ওরা কি আর কোনও নাম দিতে পারলনা! এই বার শ্রী তাকাল খুব নরম কঠোর চাউনিতে সুবুদ্ধির দিকে। বলল তুমি কথা বল সুবু – এই ভাবে একা একা না ভেবে কথা বল। কি হয়েছে ঐ গ্রুপটার নাম অধরা হওয়াতে? অধরা তো একটা বাংলা শব্দ – অভিধানে আছে আর সেই শব্দ যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। তুমি কি এত ভেবে চলেছ বলত! সুবুদ্ধির মনে হল শ্রী খুব ঠিক কথা বলছে। শ্রী কি আজ একটা কিছু বোঝাতে চাইছে সুবুদ্ধি কে। “সুবু তুমি ঠিক কি চোখে দেখ অধরাকে - তোমার জীবনে দ্বিতীয় নারী’র প্রবেশ ঘটার কোনও সম্ভাবনা নেই বলবনা, তোমার ফ্যান ফলোইং আমার জানা আছে ভালই, ভালই লাগে অনেকের চাওয়ার মানুষ সুবুদ্ধি সেনশর্মা শুধু এই শ্রী’তেই মজে রইল। আচ্ছা তুমি অধরা কে ভালবাস? তুমি কি তাকে চাও?” সুবুদ্ধি মুখ তুলে চাইল। নীরবে। শ্রী আরও বলে চলল,“অধরা আমার স্কুলের জুনিয়ার মেয়ে, ওর মধ্যে অনেক গুণ ছিল। ও তোমাকে আগে থেকে চিনতনা, তাই না? তোমার লেখা পড়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। সেই থেকে তোমাদের একটা বন্ধুত্ব তৈরী হয়েছিল। ওর লেখা চিঠিগুলি আমিই তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। তুমি ওকে নিয়ে বা ওকে কেন্দ্র করে লিখছ তাও জানি। ওকে লেখা শেষ চিঠিও তুমি আমাকে পড়িয়েছ। কিন্তু আজ তুমি ওকে নিয়ে এত উতলা কেন  বুঝতে পারছিনা। তুমি মাঝে এত অসুস্থ ছিলে যে যোগাযোগ রাখতে পারনি। তাই বলে এই রকম মুখ কাল করে বসে থাকার কোনও মানে হয়!” পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে শ্রী বলে “সুবু আজ চল ড্রাইভে যাই। অনেক দিন হল নিউ এয়ারপোর্ট রোডে যাইনি। ব্যঙ্গালোর থুড়ি বেঙ্গালুরু শহরটা চোখের সামনে কেমন পালটে যাচ্ছে। চল না...” শ্রীর নজর পড়ল সুবুদ্ধি দূরের আকাশে তাকিয়ে আছে। “ওহ এতক্ষ আমি যা কিছু বললাম সে সব তুমি...” শ্রী সুবুদ্ধি কে চেনে তার থেকেও বেশী। কাছে এসে বলল, ‘তুমি কি কিছু বলবে সুবু?’ শ্রীর কাঁধে হাত রেখে সুবুদ্ধি চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। অনেকক্ষণ পরে শুভার ‘মাআআ বাপিইই’ ডাক শুনে বর্তমানে ফিরে দুজনে ওরা বারান্দা থেকে ঘরে এল। শুভা ফিরেছে কলেজ থেকে। তারপর বাবা মা আর মেয়ের সারাদিনের খাস গল্প – খাওয়া দাওয়া শেষে সুবুদ্ধি বলল আজ আমি একটু লিখব। শ্রী বলল, ‘বেশ, কিন্তু বেশি রাত করনা’। মেয়ে বলল আমি টিভি দেখবে। শ্রী কেমন দলছাড়া হবার মত থতমত হয়ে বলল ‘আজ আমি তোমার পাশে বসে থাকব’ - সুবুদ্ধি বিশেষ হাসি বলল – মোষ্ট ওয়েলকাম...

 

ইণ্ডিয়া টুডে টা নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করার পরে শ্রী দেখল সুবু একটা শব্দও লেখেনি। চোখ বুজে কলম ধরে বসে আছে। গাল বেয়ে বেয়ে নামা যাওয়া লোনার দাগ শুখিয়ে আছে গালে। বড় ক্লান্ত লাগল সুবুদ্ধিকে। শ্রী ওর গলা জড়িয়ে বলল – এই কি হয়েছে! সুবুদ্ধি কঁকিয়ে ওঠার মত করে শুরু করে নিজেকে সামলে নিল ‘শ্রী জান আমি কখনও এত অসহায় বোধ করিনি। অধরা কেমন আছে জান? খুউব খারাপ’ শ্রী কেবল ‘কেন’ শব্দটা উচ্চারণ করার ফাঁকটুকু পেল ‘ওর স্বামী আজ অনেক দিন হল কিছু করেনা তুমি ওর চিঠিগুলো পড়, বুঝবে আমি কেমন নির্বিষ হয়ে গেছি জান – আগে হলে এত দিনে আমি কিছু একটা করে ফেলতাম’ ‘কি করতে?’ শ্রী’র এই কথাটা বেশ আলাদা লাগল কানে। সুবুদ্ধি উঠে দাঁড়াল শ্রী কে বোঝাবার চেষ্টা করল

‘তুমি কি অধরাকে ভালবাস সুবু?’

‘আমি তোমাকে ভালবাসি শ্রী’ -

‘তবে তুমি কি ওকে করুণা কর?’

‘না’

‘তুমি এই অসময়ে ওর পাশে দাঁড়াতে চাও?’

‘হ্যাঁ’ সংক্ষিপ্ত পরিস্কার উত্তর সুবুদ্ধির।

‘কি ভাবে?’

‘জানিনা

‘তুমি অধরা’র ফোন নাম্বার জান?’

‘ফোনের মধ্যেই ছিল, বছর দুয়েক কোনও কথা হয়নি’

‘এখনতো সাড়ে দশটা বাজে - ফোন করলে কথা বলা যাবে’

‘যাবে হয়ত, কিন্তু...’

‘কিন্তু কি?’

‘ওর স্বামী আবার পছন্দ করবে কি না...’

‘আরে আমি কথা বলব... সারপ্রাইজ দেওয়া হবে – ও তো জানে যে আমি তোমার স্ত্রী’

‘হ্যাঁ জানে - শুধু জানেইনা সে তার শ্রী দিদির নামে গর্বে একদম মাখামাখি...দু’বছর তো কোনও যোগাযোগ নেই...তাই...’

‘অধরাও খুব গুণী মেয়েছিল আমাদের স্কুলে। ঐ টুকু মেয়ে কি সুন্দর সুরবোধ আর সুরের জ্ঞান...কি ভাল গান গাইত...পুরো তালিম নেওয়া গলা। ওর মাও খুব ভাল গাইতেনওর বাবাতো মহাগুণী মানুষ ছিলেন তোমার মনে আছে আমি তোমাকে আমাদের স্কুলের কত গল্প করেছিলাম বিয়ের পর পর...তবে অধরার নামটা বোধহয় আসেনি কখনও – ও আমাদের থেকে অনেক জুনিয়ার ছিল... জান আমাদের স্কুল সাখাওয়াত মেমোরিয়ালের মেয়েদের মধ্যে একটা দারুন বণ্ডিং ছিল। সেই ২০০০ এর রি-ইউনিয়ানের সময় আমি কলকাতায় ছিলাম আর সেটা জানতে পেরে বৈশাখী আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। গিয়ে দেখি কত সব চেনা মুখ। বেশির ভাগই এসেছিল তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে - আমি একা গিয়ে ছিলাম। শুভার পরীক্ষা ছিল বলে তুমি যাওনি সে’বার কলকাতায়। আমি গিয়েছিলাম দাদু’র বার্ষকীতে। বৈশাখীকে আমি বারো বছর পরে দেখলাম সে’দিন। বনানী এসেছিল কানাডা থেকে। ইন্দ্রা আমেরিকা থেকে। আমাদের মনেই হয়নি যে আমাদের কোনও যোগাযোগ নেই। তবে অধরাকে আমি দেখিনি সেদিন। কে জানে – ও হয়ত খবর পায়নি...’

‘নাহ, ওর খবর পেলেও আসার উপায় নেই। ওর স্বামী ওকে কোথাও যেতে দেয়না। অধরা সেই ১৯৯১ থেকে গৃহবন্দী...’

‘কি? কি বলছ তুমি? ওর মত একটা ডানপিটে মেয়ে – এক্কেবারে ডাকাবুকো যাকে বলে সে কিনা গৃহবন্দী! তোমার লেখায় আমি এক আধবার পড়েছি এরকম একটা আভাষ তুমি দিয়েছ কিন্তু সেটা আমি ভেবেছিলাম সাহিত্যের খাতিরে...’

‘শ্রী তুমি জান... আমি বানিয়ে বলিনা... লিখিনা... যার জন্য বাজারী সাহিত্য করা আমার হয়ে উঠলনা! অধরা ভাল নেই...ওর কোনও চাওয়া নেই...পাওয়া নেই... ওর কিছু বলার নেই... ওর কথা কেউ শোনার নেই...শী ইজ আ চেইন্ড বার্ড ইন আ কেজ বা তার থেকেও খারাপ কিছু...’

‘ইউ মীন অধরা ইস আ কেস অফ ডোমেষ্টিক ভায়োলেন্স...?’

‘জানিনা এর মধ্যে আরও কত কি ঘটেছে...’

‘দাঁড়াও... এখনতো অনেক রাত... কাল সকালেই আমি কথা বলব ওর সাথে...’

‘দেখো ও যেন কোনও আঘাত না পায়...’

‘এই যে মশাই আমি একটা মেয়ে – আমার ঐ অভিজ্ঞতা নেই কারণ আমার স্বামী একজন মানুষ কিন্তু আমার কাছে অনেক কেস আসে যা শুনলে তুমি কানে আঙ্গুল দেবে...বুঝলেন সুবুদ্ধি সেনশর্মা!’

‘ঠিক আছে চল – শোবে চল’ - সুবুদ্ধি কিছুটা হালকা বোধ করল।

সকালে চায়ের টেবলে সব চুপচাপ। শুভা’র কাপে চামচ নাড়ার শব্দে পেপারটা রেখে শ্রী বলল – ‘এই অধরার নাম্বারটা দাও’ - সুবুদ্ধি নিজের সেল ফোনটা এগিয়ে দিল

ওপার থেকে গলা শুনে শ্রীর চোখের ভাষায় সুবুদ্ধি বুঝল কি মিষ্টি লাগছে অধরার গলাটা...

“আপনি কথা বলছেন আবার...কি ভাল যে লাগছে!”

শ্রী হ্যেলো বলারও সুযোগ পায়নি এতক্ষণ – ‘এই আমি শ্রী বলছি...’ একটু সময় লাগল অধরার...

“ও দিদি বল... বল... বল, তুমি? আমার যে কি ভাল লাগছে...তোমরা সবাই ভাল তো... কত বছর পরে তোমার গলা শুনছি...এই প্রথম টেলিফোনে...” ঝরণা ধারার মত বয়ে যায় অধরার কণ্ঠ...

শ্রী’ই ওকে থামায়...”শোন তোর সাথে আমার একটু কথা আছে...দুপুরের দিকে ফোন করব...কথা বলতে পারবি তো...?

“হ্যাঁ সেটাই বরং ভাল হবে দিদি...” শেষের দিকে উচ্ছ্বছলতা থিতিয়ে যেতেই শ্রী বুঝল ধারে কাছে কেউ এসেছিল কিম্বা ও হয়ত এক প্রাকৃতিক উচ্ছ্বলতা থেকে ওর নিষেধের গন্ডীর মধ্যে ফিরে গেল...

সুবু জান অধরা কিন্তু এখনও সেরকমই প্রাণবন্ত আছে – ফোনে তো তাই মনে হল...

সুবুদ্ধি বলল তুমিতো কথা বলবে...তখন বুঝবে সে কেমন আছে...

 

 

 

 

 

পর্ব-১১

 

 

 

 

 

অফিস থেকে ফিরে শ্রী আজ চুপ চাপ কাজ করছে রান্না ঘরে। মেয়ে গেছে বন্ধুর বাড়ি – জন্মদিনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। সুবুদ্ধির আজ চেম্বার অফ কমার্সের মিটিং আছে। এখন সাড়ে সাতটা বাজে। শ্রী মাঝে মাঝেই ঘড়ি দেখছে। মিসেস প্যাটেল একটু আগে ফোন করে জানিয়েছেন মিটিং দেরী করে শুরু হয়েছে। তাই সুবুদ্ধির ফিরতে দেরী হবে। মিটিং এ থাকলে সুবু ফোন স্যুইচ অফ করে রাখে। তাই কোনও উপায় নেই জানার কখন ফিরবে সে! সুবু কে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার অবধি নেই! যা গেল দু’বছর ধরে!
রান্না ঘরে কাজ করতে করতে শ্রী’র মনে পড়ল দুপুরের টেলিফোনে লম্বা আলাপ অধরার সাথে। সব যেন তাল গোল পাকিয়ে যাচ্ছে শ্রী’র। অধরা’র এত খারাপ সময় যাচ্ছে। তাই নিয়ে সুবু খুব দুশ্চিন্তায়। সাধারণের দৃষ্টিতে এই ব্যাপারটা যেন কেমন একটু বাড়বাড়িই। শ্রী'র দৃষ্টিতেও কি তাই! অধরা কিন্তু কোনও সাহায্য নেবার পাত্রী বলে মনে হলনা। তবে ও কিছু একটা করতে চায়। সুবুকে সে পরম আরাধ্য বলে উল্লেখ করেছে বেশ কয়েকবার। অনেকটা শরত চন্দ্রের উপোন্যাসের অনুল্লেখিতা নায়িকার মত। স্বপ্নে বিভোর কিন্তু প্রকাশে নারাজ। এক বার মনে হল শ্রী’র – ভাবল জিজ্ঞাসা করে – কিন্তু রুচিসম্মত বলে মনে হলনা। আর তেমন তো কিছু বলেনি অধরা। সে সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মাকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করে। তার সাথে কতটা ভালবাসা বা অন্য কোনও বোধ বা অনুভূতি মিশ্রিত আছে সেটা তার জানার কথা নয় - একজন নারী হয়ে এই চিন্তা তার মনে আসতেই পারে কিন্তু প্রশ্ন করাটা রুচি সম্মত বলে মনে হয়নি শ্রী’র। সুবুকে দেখে তেমন কিছু সে মনে করেনা তাও কেমন যেন একটু আনমনে আছে শ্রী তার পর থেকে! যদিও সুবু বা সে নিজে দুজনের কোনও কিছুই গোপন করেনা। হঠাত মনে হল অধরা কি আর স্কুলের সেই ছোট্ট মেয়েটি আছে! সে এখন গিন্নি বান্নি – কত অভিজ্ঞতার ঝড় ঝাপটা’র মধ্যে দিয়ে সে এসেছে বিয়ের পরের সুদীর্ঘ আঠের বছর! তার আগের জীবনের কথা খুব একটা হয়নি। ওর কলেজের দিনগুলি বা ইউনিভার্সিটিতে বা ল’ কলেজে কি ভাবে দিন কেটেছে – সে’ সব কথা কিছুই কথা হয়নি। আসলে অধরা শ্রী’র থেকে স্কুলে আট বছরের জুনিয়ার। কিন্তু এখন তো সেও গ্রোওন আপ টীন এজার মেয়ের মা। তার সম্ভ্রম তাকে দিয়েই শ্রী কথা বলেছে। কোনও একান্ত ব্যাক্তিগত কথা হয়নি। তা’ ছাড়া সুবু’র লেখার ভক্ত না হলে অধরা’র সাথে আবার দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল না বললে অত্যুক্তি হবেনা। স্কুলের মেয়ে হিসেবে আরও অনেকের মত একটা টান হয়ত থেকে যেতই।
কিন্তু অধরা ঐ কথাটা বলল কেন! আর সেটা বলার সময় ওর গলার স্বর কেমন যেন পালটে গেল! তার আগে সে তার প্রিয় দিদিকে ফোনেই গান শোনাল! ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা শ্রী! রাত পৌণে ন’টা বাজে। শুভা ফোন করে বলল ওর একটু দেরী হবে – বাবা যেন ওকে তুলে নিয়ে বাড়ি ফেরে – ও টেক্সট করে দিয়েছে বাবাকে। এখন শ্রী’র এই সময়টা যে ভীষ একাকীত্বে কাটছে তা সে কি করে কাউকে বোঝায়! কিন্তু এর আগেও সে এ’রকম একা একা বাড়িতে থেকেছে। আজ যেন কি একটা কষ্ট হচ্ছে ভেতরে ওর – কি কষ্ট তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেনা! কেমন যেন একটা দম বন্ধ লাগছে। কি করে সে এখন? ভাবল একবার সুবুদ্ধি কে ফোন করে কথা বলে কিন্তু ওর ফোন তো অফ করা আছে। তবে কি... অধরাকেই আবার ফোন করবে! কিন্তু কেন – কি বলবে সে ফোন করে! কেমন যেন অবাক হল নিজেই এই ভাবনা মাথায় আসতেই। এমনকি কথা অধরা বলেছে – কি যেন বলল – দু’বার বলেছে টেলিফোনে – আর তার রেশ ছিল ওর গলার স্বরে অনেকক্ষণ। শ্রী কি একটু বেশিই ভাবছেনা! নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল সে।
প্রায় দশটা বাজে এখন। চোখটা একটু লেগেছিল। টিভি’র সামনেই বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল শ্রী। গাড়ীর হর্নের শব্দে হঠাত সচকিত হল। দরজা খুলে সুবু’র হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে শুভাকে একটা হামু দিয়ে সব স্বাভাবিক ভাবেই করে গেল শ্রী – যেন এতক্ষণ কিছুই সে ভাবছিলনা! ‘খুব দেরী হল জান – এক এক জন কি বলে আর কি বলতে চায় – এই চেম্বার অফ কমার্সের মিটিং গুলো এবার থেকে এড়াতে হবে বুঝলে’ – স্নান করে এসে রান্না ঘরে শ্রী'র পাশে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বলল সুবু। শ্রী নিরুত্তর দেখে কেমন যেন অন্য রকম লাগল ওর। মেয়ে লাফাতে লাফাতে এসে বলল – ‘মা কি রান্না করেছ!’ ‘কেন বন্ধুর বার্থ ডে পার্টিতে কিছু খাওয়ায় নি?’ ‘হ্যাঁ অনেক কিছু খাইয়েছে ... তুমি কি রান্না করলে বল’ – ‘সে’ কাল খেও, এখন যদি ক্ষিদে না থাকে।‘ মেয়ে মায়ের সাথে একটু খুনসুটি করে চলে গেল নিজের ঘরে। শ্রী নীরবে খাবার সাজাচ্ছে টেবিলে আর সুবুদ্ধি একটা ফোন শেষ করে এসে বসল। বুঝতে কোনও অসুবিধে হলনা – শ্রী’র মন এখানে নেই। সুবুদ্ধি জিজ্ঞেসা করল – তোমার শরীর ঠিক আছে শ্রী? সংক্ষিপ্ত উত্তর – ‘কেন?’ ‘নাহ তুমি তো এরকম চুপচাপ থাকনা। আজ দেরী হল কেন সেটা তুমি জান শ্রী! কিন্তু তোমাকে কেন এত থমথমে লাগছে শ্রী!? ‘কিছুনা!’ আবার সেই সংক্ষিপ্ত উত্তর। সুবুদ্ধি একটু বিরক্ত হলেও তা চেপে গিয়ে রসিকতা করে বলল – ‘কিছুনা তো এরকম কালো মেঘ কেন আকাশে আজ?’ ‘এই নাও – শুরু কর’ – এ’ভাবে এত শীতলতা নিয়ে শ্রী খাবার দিচ্ছে এটা সুবুদ্ধির ঠিক লাগছেনা। খাওয়া শুরু করল দুজনেই। শ্রী’ই নীরবতা ভাঙ্গল। ‘কাল তোমার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করার কথা – সময় মত চলে যেও’ – ‘তুমি যাবেনা?’ শ্রী চুপ করেই ছিল কিন্ত সুবুর মুখের দিকে তাকিয়ে আর পারলনা। ‘নাহ – তা কেন – যাব তোমার সঙ্গে!’ ‘তা’হলে বললে কেন আমাকে সময় মত চলে যেতে!’ – ‘জানিনা – ঠিক – এমনিই – জাষ্ট এ রিমান্ডার আর কি...’ কথাগুলো বলে শ্রী’র নিজেরই মনে হল খুব স্বাভাবিক ভাবে সে কথাগুলো বলেনি। ‘ওহ তাই...’ সুবুদ্ধির সংক্ষিপ্ত সাড়াটা বেশ লম্বা মনে হল শ্রী'র! রাতে শুতে যাবার আগের প্রসাধন সারতে সারতে সুবু’র মুখে ছোট্ট ছোট্ট প্রশংসাগুলো আজও এল পেছন থেকে কিন্তু কেমন খাপ ছাড়া লাগল শ্রী’র।
সকালে চায়ের টেবলেও সেই চাপা একটা ভাব। শুভা বলেই ফেলল – ‘কি হয়েছে মা... বাপী চুপ তুমিও কিছু...’ শ্রী তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে উঠে কিচেনে ঢুকে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফিরে এল - সুবু তখন বাথরুমে ঢুকে গেছে। ‘কি হয়েছে মা...বলনা...এ’রকম টেন্সড কেন বাড়িটা আমাদের আজ...’ - ‘কাল থেকেই...’ কথাগুলো বিড়বিড় করে বলেই মনে হল নিজের – এ’কি করছে অধরা? অধরা শুধু ওর সুবুদ্ধির প্রতি শ্রদ্ধাবনত দুর্বলতার কথা অকপটে বলেছে শ্রী'কে। কিন্তু ঐ কথাটা কেন বলল! কি যেন – ‘আমার প্রথম প্রেমকে আমি হারিয়েছি না বুঝে আর আজ সে আমার কত কাছের কিন্তু তাকে ছোঁওয়া যায়না জান তো দিদি’ – দু’বার বলেছে কথাটা। তখন তার কন্ঠস্বর একেবারেই আলাদা। শ্রী তাকে বলতেই পারে – ‘এই বয়েসে এ’সব কথা আর মাথায় না রাখাই ভাল...' কিন্তু কি যেন ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তবে কি শ্রী সুবুদ্ধিকে আর বিশ্বাস করেনা? সেটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে ভেঙ্গে দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।
 

সময় মত অফিসে বেরিয়ে গেল দুজনেই। মেয়েকে কলেজে ছেড়ে শ্রী অফিসে যায়। গাড়ীতে একটা অস্বোয়াস্তিকর নীরবতা ভাল না লাগলেও শুভা চুপ করেই নেমে গেল কলেজের সামনে। দুপুরে লাঞ্চের রিমাণ্ডার বা ওষুধ খাওয়ার রিমাইন্ডার সবই সময় মত করে গেল শ্রী। সুবুদ্ধি বুঝতে পারছে শ্রী কোনও একটা ব্যাপারে প্রিঅকুপায়েড আছে কিন্তু বিকেলে নিজেই ফোন করে বলল আজ আমরা বাইরে খাব। শ্রী’র শীতল উত্তর ‘না’ – সুবুদ্ধি বেশ ভাবনায় পড়েছে, কি হয়েছে এমন যে শ্রী তাকে বলতে পারছেনা!
বাড়ী ফিরে দেখল শ্রী ফিরেছে অনেক আগেই – ঘরের পোষাকে দেখে বলল আজ একটা দিন বাইরে খেতে চাইলাম তুমি সপাটে না বলে দিলে! শ্রী বলল ঘরে রান্না করা আছে। সেতো আগেও থাকত শ্রী কিন্তু তুমি এই রকমের প্রস্তাবে বরাবরই শুধু সায় দিয়েছ নয় বরং তুমিই বেশী উদ্যোগী এই সব ব্যাপারে আর আজ... কথাটা শেষ করতে না করতে দেখল শ্রী অন্য ঘরে চলে গেছে। সুবুদ্ধি সেনশর্ম্মা সব সইতে পারে কিন্তু এই জায়গায় এক্কেবারে কাত। রাগ হচ্ছে কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা – তাতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। ভাবল জামা কাপড় না ছেড়েই একটু হেঁটে আসবে কিন্তু তা’তে প্রতিবেশীদের কাছে খোরাক হতে হবে। এই হল আমলা কলোনী’র পরিমন্ডল। কে কখন কি অনিয়ম করল সেটা কিটি পার্টির চাট হয়ে যায়। শ্রী ও সুবুদ্ধি এই বিশাল রেসিডেন্সিয়াল ক্যাম্পাসে এক বিদগ্ধ কাপল হিসেবে সন্মাণিত – তাই বাইরের ঘরের জানালায় মুখ রেখে কেমন উদাস হয়েই থমথমে মুহুর্তগুলো কাটাতে লাগল সুবুদ্ধি।
রাতে খাবার টেবলে বসে সুবুদ্ধি একটা কথাও বলল না।
শ্রী খাবার দিতে দিতে বলল – ‘কি ব্যাপার – এরকম থম মেরে আছ কেন আমরা অন্য কোনও দিন বাইরে যাব খেতে’ – সুবুদ্ধি চুপ। শুভা একটা খেই ধরার মত করে বলল – ‘ওহ আজ ডাইন আউট প্ল্যান হয়েছিল – তা কে ভেস্তাল সেটা – বাপী না তুমি?" প্রশ্নটা নিজেই লুফে নিল শ্রী যেন সুবু কে একটু শ্বাস নিতে দেবার চেষ্টা – ‘আমিই – তোমার বাপী অফিস থেকেই ফোন করেছিল আর আমিই তা’তে জল ঢেলেছি – দেখছনা সেই জন্যে তোমার বাপী কেমন থম মেরে আছে...’ সুবুদ্ধি এবার মুখ খুলল – ‘না তোমার মা’মনি কাল থেকে থম মেরে আছেন আর তার দায় ভাগ আমার ওপরে চাপানোর চেষ্টা করছেন এখন...’ – ‘বেশ বেশ বেশ তোমরা দু’জনে মুরগী লড়াই লড় আমি হুইসল টা নিয়ে আসি – কেমন...’ – সুবুদ্ধি খাওয়া শেষ হতেই উঠে সোজা নিজের লেখার টেবলে গিয়ে বসল। শুভা এসে বাপীর মাথার চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে জানতে চাইল কি হয়েছে! ‘কিছু না রে মা... তোর মায়ের কিছু কিছু ব্যাপার আমি আজও বুঝে উঠতে পারলাম না... – যাহ শুয়ে পড়’ – ‘বাপী আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ’ – মেয়ের এই কথা শুনে মনে হল যেন শ্রী’ই এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। ‘নাহ তবে কি জানিস শুভি আমি তোর মায়ের থমথমে মুখ একদম সহ্য করতে পারিনা...সেটা বোধ হয় তুই ও বুঝিস আর তাই তো এসেছিস এখন – হ্যাঁ রে চিরাগের কি খবর?’ – ‘কেহ কেহ কে চিরাগ?’ – ‘ও’রে আমার মা’মনি আমি কি কিছুই বুঝিনা – আমাকে বলে দিতে হবে কে চিরাগ!’ – ‘নাহ বাপী মানে আমি কি করে জানব কেন তুমি আমাকে এ’সব জিজ্ঞেসা করছ...’ – ‘আমি জানি... সে কে... আর তুই তাকে কত ভালবাসিস রে মা...’ বাপী বলে ডাকিস আর এটা বুঝিস না যে বাপের মন সব বোঝে...’ – ‘আমিতো শুধু মা’মনি কে বলে ছিলাম যে ওকে আমার ভাল লাগে... আর তুমি...?’ – ‘হ্যাঁ সব জানি’ – মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে মেয়ে লজ্জা রাঙ্গা হয়ে কখন পালিয়েছে। সুবুদ্ধি আপন মনে হাসে – ‘শ্রী মেয়ে কে বলেনি যে সে আমাকে বলেছে চিরাগের কথা...!' ব্যস্ততা’র মধ্যে এত বড় একটা কথা শ্রী বলতে ভুলে গেল? হয়ত ভেবেছিল যে সময় মত বেশ ঘটা করে সব জানাবে। নাহ, শ্রী’র ওপরে কোনও অভিমান করার কোনও জায়গা নেই সুবুদ্ধির।

বেশ রাত হয়ে গেল শুতে শুতে। বিয়ের পরে অনেক বার হয়েছে শ্রী ঘুমোচ্ছে আর সুবু তার ঘুমন্ত রূপ এক মনে চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মাঝের দুই দশক কেটে গেছে তা’র পর এই প্রথম সুবু দেখল শ্রী কেমন ক্লান্তিহীন নিদ্রামগ্ন...শ্রী কে ঘুমন্ত অবস্থায় শেষ কবে দেখেছে তা’র মনে নেই। আজ ও খুব ক্লান্ত তাই বোধ হয় নিয়মের ব্যাতিক্রম আজ। সাধারণত শ্রী ঘুম থেকে ওঠে সবার আগে আর ঘুমোতে যায় সবার শেষে। অনেকক্ষণ ধরে দেখল শ্রী’র ঘুমন্ত সুন্দর রূপ...
 

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখল শ্রী’ বসে আছে চা নিয়ে... খবরের কাগজটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল – "নতুন কিছু লেখা শুরু করলে নাকি কাল রাতে?" খবর কাগজটা মেলে ধরে সগোতোক্তি করেই বলে সুবুদ্ধি – "নতুন লেখা আর বেরোবে কি?" শ্রী’র কান এড়ায়নি কথাটা – "মানে...তুমি আর লিখবেনা?" – নীরবে কাগজটা পাশে রেখে শ্রী’র দিকে তাকিয়ে রইল। "চা ঠান্ডা হল যে..." –
"ওহ – নাহ ঠিক আছে..."
"কি ঠিক আছে... তুমি কি ভেবে চলেছ বলত..."
"কেন বলত শ্রী..."
"না কাল থেকে দেখছি তুমি কেমন অন্যমনস্ক হয়ে আছ...এই সুবুকে আমি চিনিনা তাই..."
"কি জানি কি ভাবছি... তবে সব কেমন ঘেঁটে আছে বলে মনে হচ্ছে জান শ্রী..."
"ব্রেকফাষ্ট রেডি করছি... স্নান করে নাও...
স্নান সেরে তৈরী হয়ে এসে টেবলে বসতেই নজর পড়ল সেল ফোনটার ওপর... কিন্তু এটাতো এখানে থাকেনা...
"তোমার ফোনে অনেকগুলো মিসড কল দেখলাম...তাই রাখলাম এনে"
‘থ্যাঙ্কস শ্রী..."
"সে কি! তুমি আবার কবে থেকে এত ফর্ম্যাল হলে..."
"নাহ... নিজের অজান্তেই বেড়িয়ে এল থ্যাঙ্কস..."
"বুঝলাম... কিন্তু তোমাকে মাঝ রাতে বা এত সকালে এত গুলো মিসড কল কে করল... দেখ – প্রয়োজন না থাকলে কি কেউ অসময়ে ফোন করে..."
"কে জানে... যার দরকার সে আবার করবে..."
"তুমি তো এরকম ছিলেনা সুবু... দেখ কে বা কারা প্রয়োজনে ফোন করে পায়নি তোমায়..."
"একটাই নাম্বার দেখছি... ১১টা মিসড কল... অচেনা নাম্বার..."
"কল ব্যাক করে দেখ না... কে"
বেশ কয়েক বার ডায়াল করে হাল ছেড়ে দিয়ে স্বাগোতক্তি করে বলল – "কে জানে কে... রিং হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে ফোন ধরেনা... তুমি এক বার ট্রাই করে দেখতে পার..."
নাম্বারটা নিজের মোবাইলে সেভ করে নিয়ে অফিসের জন্য বেরিয়ে গেল শ্রী। বাবা আর মেয়ে একটু আগেই বেরিয়ে গেছে। গাড়িতে বসে শ্রী সেই অচেনা নাম্বারটা ডায়াল করল... বেশ কয়েক বার রিং হবার ফোনটা ধরল কেউ কেমন একটা ঘুম জড়ানো গলায়...পুরুষ কন্ঠ। শ্রী জানতে চাইল কে ফোন করেছিলেন মাঝ রাতে তার স্বামী’র ফোনে তার উত্তরে যা শুনল তাতে কান মাথা গরম হয়ে গেল। ফোনটা কেটে দিয়ে সুবুদ্ধিকে ফোনে ধরার চেষ্টা করল কিন্তু ও বোধ হয় মিটিংএ এখন। সারাদিন ধরে মাথাটা আরও গরম হয়েছে। সেই নাম্বার থেকে বেশ কয়েক বার ফোন এসেছে কিন্তু সেই লোকটি’র কথা বার্তা শ্লীলতার ধার ধারেনি এক বারের জন্যেও। শেষে ফোনটা স্যুইচ অফ করে রেখেছে শ্রী। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেবেলা স্নান সেরে দেখল সুবু ফিরেছে তক্ষুনি। প্রায় দৌড়ে গিয়ে সুবু'র বুকে আছড়ে পড়ল শ্রী। অনেকক্ষণ লাগল শ্রী কে শান্ত করতে সুবুর। চা খেতে খেতে শ্রী'কে জিজ্ঞাসা করল ঠিক কি বলেছিল সেই লোকটি। শ্রী নিজেও হালকা হতে চাইছিল। শ্রী চেষ্টা করল সেই টেলিফোনের কথোপোকথন তুলে ধরার –
শ্রী – হ্যেলো ...
অচেনা – ইয়েস (জড়ানো গলা)...
শ্রী – দেয়ার মাস্ট হ্যাভ বিন সেভ্যার‌্যাল কলস লাষ্ট নাইট ফ্রম ইওর নাম্বার...মে আই নো হু ইস দিস...
অচেনা – হোয়াট?
শ্রী – হু ইস দিস?
অচেনা – অংরেজী ফরফরানা বন্ধ কর না...
শ্রী – হোয়াট?
অচেনা – ম্যায় কিসিকো ফোন ওন নাহি কিয়া...
শ্রী – আর ইউ আ বেঙ্গলী?
অচেনা – কিউঁ – হ্যাঁ আমি বাঙ্গালী –
শ্রী – আপনি কি ব্যাঙ্গালোরেই থাকেন
অচেনা – না আমি নাগপুরে থাকি কিন্তু আপনার কি দরকার তা’তে?
শ্রী – আমার কোনও দরকার নেই... দেখুন আপনার ফোন থেকে কাল রাত দু’টোর পরে বেশ অনেকবার ফোন এসেছিল আমার হাসব্যান্ড এর সেল ফোনে –
অচেনা – বাহ আপনার হাসব্যান্ড বেশ চালু দেখছি – সে তাই আপনাকেই লাগিয়ে দিল কাজে?
শ্রী – কি বাজে কথা বলছেন আপনি – আপনার নাম্বারে অনেকবার ট্রাই করেও তিনি আপনাকে পাননি... আপনি ফোন ধরেননি... আপনি কে আর কেনই বা...
অচেনা – মাইরী... স্টোরীতে দম আছে... হাজব্যান্ডের নাম করে বাবু ধরার নতুন ইষ্টাইল বেশ সেক্সি মাইরী...
শ্রী – হোয়াট দ্যা হ্যেল আর ইউ টকিং...
অচেনা – উফ কি দারুন লাগছে মাইরী... তা’ তুমি কোথায় থাক সুন্দরী?
শ্রী – গেট লষ্ট...
এর পর অনেক বার সেই নাম্বার থেকে ফোন এসেছে কিন্তু শ্রী ধরেনি...দুপুরের পর থেকে ফোনটা স্যুইচ অফ করে রেখে দিয়েছিল।
সুবুদ্ধি বলল থানায় একটা ডায়েরী করা দরকার। শ্রী বলল আর বোধ হয় ফোন আসবেনা। একটা মাতাল কা’কে ফোন করতে গিয়ে তোমার নাম্বার ডায়াল করে ফেলছে আর নেশা কেটে যেতেই আর কিছু মনে নেই... একটা অসুস্থ মানসিকতার লোক... ছাড় ও’সব থানা পুলিশ টুলিশ করার দরকার নেই।
ডিনারের পরে ব্যালকনীতে বসে দু’জনে হালকা কথাবার্তা বলছিল... ঠিক তখনই শুভা এসে বাপী’র হাতে দিল সেল ফোনটা – কানে লাগিয়ে হ্যেলো বলতেই...
"আমি অধরা বলছি..."
সুবুদ্ধি শ্রী’কে ঈশারা করে লাউড স্পীকার অন করল...
"হ্যাঁ...বল... কি ব্যাপার..."
"ব্যাপার আর কি...আপনি তো আমাকে ভুলেই গেছেন..."
"নাহ ঠিক তা’ নয়...ভুলে যাব কেন! তুমি তো স্কুলের দিদিকে পেয়ে আমাকে..."
"তা’ ছাড়া আবার কি... ভুলেই তো গেছেন আমাকে – কাল রাতে খুব আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করল... আমার ফোনের ব্যালান্স ছিলনা... তাই বিক্রমের ফোন থেকে ফোন করেছিলাম কিন্তু আপনি ফোন ধরেননি...জানেন কত বার ফোন করেছি...!"
শ্রী’র মুখের দিকে তাকাতেই সুবু বুঝতে পারল শ্রী বুঝে নিয়েছে দুপুরে’র ঐ লোকটি কে
"জানি... রাত দুটো’র পরে ফোন করলে কি করে ফোন ধরে কেউ...?"
"আমি কেউ কে ফোন করিনি...আমি আমার পরম আরাধ্যকে ফোন করেছিলাম কিছু কথা বলতে...যা আমি দিদিকে সেদিন বলতে পারিনি..."
"কে সেই কথা যা দিদিকে বলা যায়নি...!"
"দিদি বোধ হয় আমাকে ভুল বুঝেছেন... আমি যা বলতে চেয়েছিলাম তা’ আমি আপনাকেই বলব বলে কাল রাতে ফোন করেছিলাম... আমি চাইনা আমার ওপরে কেউ দয়া দেখাক...আমি আপনাকে আমার পরম আরাধ্য মনে করে সর্বদা কামনা করি...সে’দিন ফোনে দিদিকে সে’কথা আমি আকারে ঈঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছিলাম কিন্তু উনি কোনও পাত্তাই দেননি...তাই ভাবলাম আমি কথাটা আপনাকেই সরাসরি বলি..."
"তুমি বা তোমরা সুস্থ আছ তো? রাত দু’টোর পরে সে’ কথা বলার কথা মনে হল...?"
"আমি কি করে সুস্থ থাকতে পারি বলুন...আমার প্রেম আমার থেকে সহস্র যোজন দূরে... আমি তাকে ছাড়া ভাবতেই পারিনা কিছু আর তা’র স্ত্রী যিনি আমার স্কুলের দিদি তিনি আমাকে কোনও দিন বুঝবেনও না কারণ আমি তাঁর প্রেমে ভাগ বসাতে চাইছি..."
"এসব কথার মানে কি? এই দু’বছরে তুমি এই সব ভুল কথা ভেবেছ? সব জেনে শুনে এই সব করার মানে কি অধরা..."
"সে আপনি যাই বলুন আমি যা’ আমি তা’ গোপন করিনি..."
"যদি তাই হয় তবে বাকী জীবনটা বাকি কাজগুলো সুষ্ঠু ভাবে করাই কি বুদ্ধিমানের কাজ নয়?
"বুদ্ধিমান নয় বুদ্ধিমতী... আপনি লেখক... কি করে জেন্ডার বদলে দিলেন আমার... হা হা হা হা..."
"অধরা আমার কিন্তু এখন এই প্রসঙ্গে রসিকতা একদম ভাল লাগছেনা...
"আপনি আমাকে ভুলেগেলেন...?"
"শোন অধরা জীবনের কিছু অংশ স্বপ্ন হয়েই থাকে আর তা’ সেই ভাবেই থাকা ভাল...যাই হোক আমি একটা কথা স্পষ্ট করে দিতে চাই..."
"কি সেই কথা..."
"এই পরম আরাধ্য পুরুষকে একজন সাধারণ বন্ধু হিসেবে দেখলেই ভাল করবে..."
"সেটা কি করে সম্ভব...?"
"কেন সম্ভব নয়? আমাদের বন্ধুত্বের সীমার বাইরে অন্য কোনও স্বপ্নের যায়গা নেই বলেই আমি মনে করি... আর ত’ছাড়া..."
"তা’ ছাড়া কি..."
"কালকে রাতে তোমার আবেগ তাড়িত হয়ে ফোন করার চেষ্টা’র যে মূল্য আমাদের বিশেষ করে তোমার দিদিকে দিতে হয়েছে তার পর আমার মনে হয়...
"কি..."
"আমাদের মধ্যে একটা দূরের শুভাকাংক্ষী’র সম্পর্ক থাকাই ভাল – তোমার স্বামী’র সঙ্গে তোমার সম্পর্ক খারাপ হোক এটা আমরা চাইনা। তবে তার দুর্ব্যাবহারটাও মেনে নিতে পারা যায়না।"
"এ সব কি বলছেন আপনি?"
"কেন? বিক্রম কিছু বলেনি তোমাকে? থাক..."
"নাহ তো – কি হয়েছে? বলুন প্লীজ..."
"সে সব কথা আমরা আর তুলতে চাইনা। আমার অনুরোধ আমাকে বা আমার স্ত্রীকে আর যেন কেউ ফোন না করে...তোমার স্বামী আজ যে ভাষায় কথা বলেছেন তা’ কোনও সভ্য মানুষের কাজ নয়...আর কিছু বলবে?"
"তা’র মানে?"
"মানে জেনে আর কাজ নেই...এখনও না বুঝে থাকলে আর বুঝে লাভ নেই..."
"তার মানে আপনি আর লিখবেননা আমাকে নিয়ে...?"
"ব্যাপারটা তা’ নয়। আসলে আমার লেখার উতসাহের পেছনে অনেক ভাবনা ছিল"
"কি পরিকল্পনা...জানতে পারি?"
"আমি চেয়ে ছিলাম তুমি গানটা ঠিক করে সিরিয়াসলি গাও আর তার মধ্যে দিয়েই তোমার জীবনের ষ্টেবিলিটি আসুক – আজ আর সে’ সব আর ভেবে লাভ নেই।"
"আমার গান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে..."
"তা’ জেনে আজ় আর কোনও কাজ নেই... অধরাকে নিয়ে লেখা বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কষ্ট নেই আমার। তুমি তাতক্ষণিক আনন্দ ও প্রাপ্তিকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছে এই আঠের বছর ধরে। আসলে পরিবর্তন সবার জন্যে নয়...আঠের বছরের অভ্যাস যেমন চলছে তাই চলুক... অধরা মাধুরীর যে’ মাধুকরী লেখক পেল তাই নিয়েই সে নীরব হল। এই গল্প আগে বাড়তে পারেনা। কিছু পরিণতি না হওয়াই ভাল... ভাল থাকা এক অভ্যাস তা’র জন্য অনেক কিছু সিদ্ধান্ত সময় মত নিতে হয় আর তা' না নিলে জীবন জলের ধর্ম পালন করে চলে...সেই ধারায় বয়ে চলাই তখন জীবনের ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়..."
সুবুদ্ধি ফোনটা রেখে দিয়ে চুপ করে বসে ছিল। সময় যেন হঠাত থেমে গিয়েছিল।
শ্রী নীরবে উঠে এসে সুবুদ্ধির কাঁধে দুই হাত আর থুতনিটা ওর মাথার ওপরে রেখে আলতো করে ঝুঁকে দাঁড়াল...এক ফোঁটা গরম মুক্তো সুবু’র কপাল বেয়ে ওর চোখের পাতায় এসে থমকে থামল...


সমাপ্ত
 

 

   * প্রথম পাতা *