মা
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
বাড়ির পাশ দিয়েই নরকের রাস্তা। রাত্রে টালমাটাল পায়ে লোকের যাতায়াত বাড়ে। সঙ্গে জড়ানো গলায় খেউড় মিশ্রিত দু’চার কলি গানও কানে আসে। গোটা শরীর রি রি ক’রে ওঠে মালতীর। বহুবার বলেছে, এই বাড়ি বেচে দিয়ে ভেতরের বামুন-কায়েতের পাড়ায় দু’এক কাঠা জায়গা কিনে ছোট্ট একটা বাড়ি বানিয়ে নাও। বাদল মোটেও কান দেয়নি। বলতে গেলে উড়িয়ে দিয়েছে। ভেতরে আর এক ছটাকও জায়গা নেই। এখানেই বেশ ভালো আছে তারা। সামনেই রেল স্টেশন। ওপারেই জমজমাট বাজার, ওষুধের দোকান, ডাক্তারখানা, স্কুল। এই জায়গা কেউ ছাড়ে? দু’জনের নির্ঝঞ্ঝাট ছোট্ট সংসার। সমস্যাটা কিসের? দু’জনের নির্ঝঞ্ঝাট সংসার- এই কথাটাতেই মালতীর যত যন্ত্রণা। দেখতে দেখতে সাত-আট বছর কেটে গেল। কবচ-তাগা-মাদুলি ওর শরীরে কোথায় নেই! গলায় হাতে কোমরে। বাদল বিরক্ত হয়। মালতীর শরীর নিয়ে আজকাল আর সেই প্রবল উন্মাদনা না থাকলেও মাঝে মাঝে তো লাগেই। অনিয়ন্ত্রিত তীব্র মুহূর্তটিতে অন্তত: আজও বাদল আগের মতোই দুরন্ত হয়ে ওঠে। আর তখনই তাগা-তাবিচ-মাদুলির খোঁচাখুঁচিতে বাদলের মেজাজ খিঁচড়ে যায়। সংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবাদী মনের উস্মা দু’চারটে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ হয়ে যায়। মালতী মনে মনে তেত্রিশ কোটি দেবতার উদ্দেশ্যে নাক-কান মুলে ক্ষমা চায়। অন্য সময়ে বাদলের বিরক্তিতে মালতী ক্ষুব্ধ হলেও এসব মুহূর্তে হয় না। শুধু কবচ-মাদুলিতে তো আর মনোষ্কামনা পূর্ণ হবে না!
সব মিলিয়ে খুব অসুখে না থাকলেও ছোটখাট এই জায়গাটাই মালতীর চোখের বিষ। বাড়িটা ছোট হলেও মন্দ নয়। সামনে ছোট্ট এক ফালি বাগান। তুলসী, নয়নতারা, গাঁদা, টগর, জবা, শিউলি যে যার সময়ে ফুটে বাগান আলো করে তোলে। দু’চারটে পাখ-পাখালিও এসে বসে বাগানে। বাদল ছুটি-ছাটার দিন সকাল-বিকেলে এই ছোট্ট বাগানে বসে বহুবার বলেছে, ‘কলকাতায় চলো। মাদারের কাছ থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে আসি।’ মালতী তার শক্ত ঘাড় নরম করেনি কখনো। মাথা খারাপ! কার না কার বাচ্চা। বাদল বলতে চেষ্টা করেছে, ‘আফটার অল্ মানুষের বাচ্চা তো!’
মালতী কোন যুক্তিতেই কান দেয়নি। নিজের নাড়িছেঁড়া ধন আর অন্যের নামগোত্রহীন পরিত্যক্ত বাচ্চা কি এক হলো! আমার বুকে দুধের ঢল নামবে না? আমার দুধ না খেলে সে আমাকে মা বলে মানবে কেন? হতাশ ও বিস্মিত বাদল তবু বলার চেষ্টা করেছে, ‘মাদারকে দেখো! এই যে কত রাস্তার শিশু বুকে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন নিজের কাছে, এরা তো মাদারকে ‘মা’ ছাড়া অন্য কোন নামে ডাকে না!’ আড় চোখে মাদারের ছবির দিকে এক পলক তাকিয়েও নিজের মত বদলাতে পারে না মালতী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেই ফেলে, ‘ওসব সাধু সন্ন্যাসীদের ব্যাপার। আমাদের পোষায় না!’
প্রাইমারি স্কুল মাস্টার বাদলের এর পরে আর বাক্য সরে
না। বিষয়টা মালতীর মগজে ঢোকাবার আশা ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে মন টেকে না। সন্ধ্যায় বাড়ি
থেকে বেরিয়ে যায়। ক্লাবে তাস-ক্যারাম পিটিয়ে দশটা সাড়ে দশটায় ঘরে ফিরে খাওয়া দাওয়া
সেরে সোজা শুয়ে পড়ে। কখনো সখনো রাতের শো’য়ে রগরগে হিন্দি-ইংরেজি ছবি দেখে রাতে সে
নিজের উদ্যোগেই মালতীকে বুকের ওপর তুলে নেয়। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও মালতী আপত্তি করে
না। সে এক অলৌকিক মুহূর্তের আশায় প্রহর গোণে। ভগবান যদি মুখ তুলে তাকান শেষ
পর্যন্ত।
ভালো করে আলো ফুটে ওঠার আগেই মালতী বিছানা ছেড়ে উঠে যায়। বহুদিন আগেই বিছানায় ভোরের
রোমাঞ্চ শেষ হয়ে গেছে। তখন বিছানা ছাড়তে বেশ বেলা হয়ে যেত। এখন বাদল গভীর ঘুমে
তলিয়ে থাকে। মালতী ঝাঁট-পাট সেরে স্নান করে নেয়। তারপর চা দিতে এসে বাদলের ঘুম
ভাঙায়। ঘুমন্ত বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে মালতীর। বাদলও হয়তো মালতীর
মতোই এক গভীর শূন্যতার যন্ত্রণা ভোগ করছে নিঃশব্দে!
অন্য দিনের মতো আজও খুব ভোরে
বাগানে নেমে এলো মালতী। আবছা অন্ধকার এখনও কাটেনি। শরতের শিশির ভেজা সকাল। সামান্য
শীতল আমেজ। শিউলি গাছের নিচে অজস্র ফুল ছড়িয়ে রয়েছে। রোদ ফুটলে আজ বেশ কয়েকটা জবা
ফুটবে। পায়ে পায়ে বেড়ার ধারে এসেই চমকে উঠলো মালতী। সাদা কাপড়ে জড়ানো একটা ছোট্ট
মাথা দেখা যাচ্ছে রাস্তার ঠিক পাশেই ওর বেড়ার নিচে। এই রাস্তাটাই গিয়েছে নরকের
দরজায়। ঘেন্নায় গা ঘুলিয়ে উঠলো মালতীর। ভোর বেলায় একি দৃশ্য! মুখ ঘুরিয়ে নেবার আগেই
জড়ানো ন্যাকড়া থেকে একটা ছোট্ট লালচে হাত বেরিয়ে আসতে দেখলো মালতী। চারপাশে কেউ
কোথাও নেই! বেঁচে আছে নাকি! হিমেল একটা স্রোত বয়ে গেল গোটা শরীরে। থরথর করে একবার
কেঁপে উঠলো সে। বাদলকে কি ডাকবে? গোটা ন্যকড়ার পুঁটলিটাই নড়ছে এখন। মালতী পায়ে পায়ে
ঝাঁপ ঠেলে কাছে গিয়ে ঝুঁকে তাকালো। সবে চোখ ফুটেছে। ঝকঝকে কাচের গুলির মতো দুটো চোখ
কাউকে খুঁজছে বলে মনে হল মালতীর। মালতী আবার চারপাশে তাকালো। জনপ্রাণী নেই আশেপাশে।
হাত পা নাড়াচ্ছে বাচ্চাটা। শব্দ করার চেষ্টা করছে কিন্তু শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
অন্ধকার বেশ ফিকে হয়ে আসছে। ফেলে চলে যাবে ভেতরে? যদি কুকুর শেয়ালে টেনে নিয়ে
গিয়ে-দৃশ্যটা মনে হতেই মালতী শিউড়ে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাটা তুমুল চিৎকারে
কেঁদে উঠলো। একটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী আওয়াজে ঘরের মধ্যে বাদলও চমকে ধড়মড় করে উঠে
বসলো বিছানায়। হঠাৎই কি করছে বুঝে ওঠার আগেই বাচ্চাটাকে দু’হাতে বুকের মধ্যে তুলে
নিল মালতী। ওর বুকের কোমল উষ্ণতার মধ্যে ডুবে গিয়ে বাচ্চটা কান্না থামালো। মালতী
বাগানের ভেতরে চলে এলো দ্রুত পায়ে। বাদল ফের শুয়ে পড়তেই যাচ্ছিল, মালতী ঘরে ঢুকলো।
-একি! কোথায় পেলে? তাজ্জব বাদলের ঘুম ছুটে গেল
মুহূর্তে।
-রাস্তায়। আমাদের বেড়ার পাশে।
-সে কি! আর কেউ ছিল না?
-না। ঠাণ্ডায় কাঁদছিল তাই-
-কার না কার বাচ্চা-নিশ্চয়ই পাপের ফল, ছিঃ -ছিঃ!
-আহা, এর দোষটা কি শুনি? দেখো না মুখটা, মায়া হয় না!
অনেক
বুভুক্ষু নারীর মুখচ্ছবি এর আগে বাদল দেখেছে। অনেক ম্যাডোনার ছবিও দেখেছে সে।
মালতীর মুখটাও আজ দেখছে সম্পূর্ণ অন্য রকম। বাদলের চোখে জল এসে যাচ্ছিল। তবু বললো-
-থানায় জমা দিতে হবে যে!
-কেন?
-বাঃ! যার বাচ্চা সে যদি খোঁজ করে-
- খোঁজ করার হলে কেউ এভাবে রাস্তায় শেয়াল-কুকুরের মুখে ফেলে যায়? নেহাত নিজের হাতে
মেরে ফেলতে পারেনি তাই! আমি যদি মানুষ করি, তুমি রাগ করবে?মালতীর অবিশ্বাস্য করুণ
আর্তির উত্তরে কিছু বলার আগেই মর্নিংওয়াক করতে বেরুনো রমেশদা জানলার সামনে দাঁড়িয়ে
গলা তুলে বললেন,
‘কাল রাত ন’টা পঁয়ত্রিশে মাদার মারা গেছেন, তুমি কি শুনেছ বাদল?’
কথাটা শোনামাত্র লাফিয়ে জানলার সামনে এসে বিস্মিত বাদল বললো, না তো!
-'ভেরি স্যাড! ভারি খারাপ লাগছে জানো! মাতৃবিয়োগের যন্ত্রণা জীবনে দু’বার অনুভব
করছি।’ বললেন রমেশদা।
বাদল ঘরের ভেতরে ঘুরে তাকালো।
মালতীর মুখটা ঝুঁকে পড়েছে বাচ্চাটার মুখের ওপর।
-এই, গলার মাদুলিটা খুলে দাও তো! বাচ্চাটার কচি মুখে লাগছে।
নিঃশব্দে বাদল মাদুলিটা খুলে নিল। কোমরের তাগা, হাতের একাধিক ভারি ভারি তাবিজ কবচও
খুলে নিল। মালতী বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করলো না! যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো!
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট