কোমা
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
১
জয়া'র কথাঃ
আমি এখন এমন একটা অবস্থার মধ্যে রয়েছি যা সত্যি ভারি অদ্ভুত এবং বেশ মজারও বটে। আমি সকলের কথা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। আমার চোখের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে না। ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে না। আমি সব দেখছি, সবাইকে দেখছি, কিন্তু কেউ তা টেরই পাচ্ছে না। সিনেমায় দেখেছি আমার মতো এইভাবে নিঃস্পন্দ ভাবলেশহীন চোখ-মুখ নিয়ে চিত্ হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থাকে বলে কোমায় থাকা। সিনেমায় দেখা এইরকম একটা ব্যাপার যে আমার জীবনেই ঘটবে তা কে জানতো! কোমায় থাকলে যে বিছানা ছেড়ে যেখানে খুশি যাওয়া যায়, যার পাশে খুশি গিয়ে দাঁড়ানো যায় অথচ আমার শরীরটা বিছানাতেই পড়ে থাকে--সবাই যখন আমার বিছানা ঘিরে আমার দিকে ভারি দুঃখু দুঃখু মুখ করে তাকিয়ে থাকে তখন আমি ঠিক তাদেরই পাশে দাঁড়িয়ে থেকে আমি আমার বিছানায় পড়ে থাকা শরীরটা দেখি। আমারও মুখ দিয়ে আহা-উহু শব্দ বেরিয়ে আসে অথচ কেউ শুনতে পায় না। ব্যাপারটা বেশ মজার নয়?
সেদিন বাথরুম থেকে তড়িঘড়ি বেরুতে গিয়েই তো যত বিপত্তি। মার্বেলের মেঝেতে তেল আর সাবানের জলের মতো কিছু ছিল বোধহয়, দড়াম করে পড়ে গেলাম মার্বেলের মেঝেতে। দু'এক মুহূর্তের জন্যে শ্বাস-প্রশ্বাস আটকে গেল। চোখে ঘন অন্ধকার। ভারি শরীর পতনের একটা নিজস্ব শব্দ থাকে, তার কান টানার ক্ষমতাও থাকে বেশ--প্রথমে শুনতে পেল কাজল, আমার ছায়ায় লতার মতো বেড়ে ওঠা দূর সম্পর্কের দিদির মেয়ে। ভীষণই দূরবস্থা। পড়াশোনায় ভালো। স্কুলে ভর্ত্তি করে দিয়েছিলাম। এবারই কলেজে ঢুকেছে। আমি যদি কোমা থেকে না ফিরি তাহলে বড়বউ তপতী সবার আগে কাজলকে বাড়ি থেকে তাড়াবে।---কাজল ছাদে জামাকাপড় মেলতে গিয়েছিল। পড়িমরি করে যেভাবে ছুটে আসছিল তাতে আমার নিজেরই হাত-পা কাঁপছিল। পড়ে না মরে মেয়েটা।
আমার বড়সড় ভারি শরীরের ওপর হুমড়ি খেয়ে মরণ আর্তনাদে গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে দিল ছুঁড়ি। যে যেখানে ছিল দৌড়ে এলো। তিনি এলেন বেশ কিছুটা পরে। তাঁর হাই সুগার, হাই ব্লাডপ্রেশার, হাই মেজাজ। তাঁর অবস্থা দেখে আমার মনে হচ্ছিল তিনি না আবার আমার পাশে শুয়ে পড়ে জগঝম্প বাধিয়ে তোলেন। স্নান সেরে তাঁকে ওষুধ দেওয়ার কথা ছিল আমার। দিতে পারিনি। খুবই প্রয়োজনীয় ওষুধ। বাদ পড়লে বিপদ হতে পারে। কাজলকে বারবার বলছিলাম ওষুধটা তাঁকে দিতে--কিন্তু কে কার কথা শোনে!
তিনি আমার মুখের দিকে তাকালেন। এমন দৃষ্টি কখনো দেখিনি। কোনো ভাষা নেই। তাঁকে বললাম, ভয় নেই, আমি ঠিক আছি। তুমি ওষুধটা খেয়ে নাও।--কথাটা মনে হলো গ্রাহ্যই করলেন না। এমনটা তো উনি করেন না কখনো। ওঁর চোখে জল দেখলাম। গালের ওপর দিয়ে গড়াচ্ছে অথচ তিনি মুছছেন না। আমার বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পাচ্ছিলাম।
পাড়ার ডাক্তার সুদর্শন বোস (নামের এমন সাংঘাতিক অপচয় এই ডাক্তারকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না) আমার নাড়ি টিপে-টুপে বললেন, মনে হচ্ছে হার্ট অ্যাটাক--ফেলিওরও হতে পারে!
কে ওকে ডাক্তারি ডিগ্রি দিয়েছে তা ভগবানই জানেন! হার্টফেল হলে এতসব দেখছি শুনছি কি করে? ডাক্তারের কথা শোনামাত্র সবাই ডুকরে উঠলো হাউ-মাউ করে। এমন কী বড়বউ তপতী পর্যন্ত!
না, কিছুই ভুল দেখছি না। আমি মরে গেছি এটা শুনে সকলকে যেভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলাম তাতে নিজের হাতে গড়ে তোলা এই সংসারের কর্ত্রী হিসেবে সানন্দে নাচতে নাচতে স্বর্গে যাওয়াই উচিত। কিন্তু আমি জানি আমি এখনো মরিনি। সবাইকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। সকলের কথা-কান্না শুনতে পাচ্ছি। ওই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তিনি দেওয়ালে হেলান দিয়ে কাঁপছেন থরথর করে। পড়ে না যায় লোকটা! কেউ কেন ওঁর দিকে তাকাচ্ছে না--
--আর এক মিনিটও দেরি না করে নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়া দরকার।
সুদর্শন ডাক্তারের কথা শুনে সকলেই চমকে তাকালো তার দিকে। তার মানে তারও মনে হচ্ছে আমি মরিনি। বড় ছেলে তাপস তাড়াতাড়ি মোবাইল অন করে শহরের এক নামী নার্সিংহোমে ফোন করে আ্যম্বুলেন্স পাঠাতে বললো। তপতীর চোখের জল মুহূর্তে উধাও। প্রথম থেকেই ওকে আমার পছন্দ হয়নি। স্রেফ ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিতে হয়েছে। তাপসের কপালে অনেক দু:খ আছে।
তিনি এতক্ষণে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। জামার হাতায় চোখ মুছে আবার তাকালেন আমার মুখের দিকে। আমি আবার বললাম, শোবার ঘরের টেবিলের ওপর ট্যাবলেট রাখা আছে, খেয়ে নাও।--তিনি গ্রাহ্যই করলেন না!
নার্সিংহোমে দ্রুত গতিতে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলো। ডাক্তার রায় দিল, মিসেস মিত্র কোমায় চলে গেছেন।
কথাটা শোনামাত্র সবাই কেমন শান্ত হয়ে গেল। তাপস ওর দুই দিদিকে ফোন করেছিল। তারা কয়েকঘন্টা পরে যখন একজন টালা আর একজন বালীগঞ্জ থেকে সোজা উদভ্রান্তের মতো ছুটে এলো আমার বিছানার পাশে তখন তাদের দিকে তাকিয়ে আমার বেশ লজ্জাই করছিল। এত সেজেগুজে কেউ নার্সিংহোমে রুগী দেখতে আসে--বিশেষ করে যে সে রুগী নয়, নিজেরই মা!
সকলের চোখেই আবাক দৃষ্টি। আমার দুটি মেয়েই বেশ সুন্দরী। তাই সম্ভবত ওদের ধারণা--সব সময়ে সেজেগুজে থাকাটা ওদের হকের বিষয়। বোকা মেয়ে দুটোকে বোঝাতে পারিনি--সৌন্দর্য্যকে কোথায় কখন তুলে ধরতে হয়।
তিনি আমার মাথার কাছে একটা প্লাস্টিকের টুলের ওপর বসেছিলেন। মেয়েদের নাটকীয় প্রবেশ ও তাদের সাজসজ্জা যে তাঁর মোটেও ভালো লাগেনি তা তাঁর চোখের ভাষাতেই স্পষ্ট। কিন্তু আশ্চর্য, আজ তিনি হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন না! এই আচরণ তাঁকে মানায় না।
বড় মেয়ে আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তার বাবাকে বলল, মায়ের গলা থেকে এত ভারি হারটা খুলে রাখোনি কেন বাবা? হাতে অতগুলো চুড়ি, মায়ের কষ্ট হচ্ছে না?
--এসব নিয়ে ভাববার সময় পাইনি। তোর মায়ের কষ্ট হচ্ছে কি না তা-ই বা বুঝবো কি করে?
ছোটমেয়ে আমার পায়ে হাত বোলাচ্ছিল। দ্রুত উঠে এলো দিদির পাশে। একবার হাত বুলিয়ে আমার গলার চারপাশের অবস্থাটা অনুভব করে হয়তো বুঝতে চাইছে কতটা কষ্ট হচ্ছে আমার। আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছিলাম এই হার-চুড়ি-আংটি-দুল নিয়ে দুই মেয়ের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেবে। আমি তাঁকে বললাম, এগুলো তুমি খুলে নিয়ে নিজের কাছে রেখে দাও।--তিনি আমার দিকে তাকালেন না পর্যন্ত! দুই মেয়ের মধ্যে না চুলো-চুলি বেধে যায়।
কাজলটাও যে কোথায় গেল কে জানে। হয়তো কোথাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আমার ছোট ছেলে দীপু ব্যাঙ্গালোরে পড়তে গেছে। খুব নাকি শক্ত পড়া। এখানে ওসব পড়ার ভালো ব্যবস্থা নেই। ওকেও ফোন করেছে তাপস। শুনলাম কাল সকালেই নাকি সে আসছে।
দীপু আর তাপস দুটোই মা-পাগলা ছেলে। তপতী তাই উঠতে বসতে তাপসকে হেনস্থা করে। ধিক্কার জানায় এখনও কথায় কথায় 'মা' 'মা' করার জন্যে। কিন্তু এখনো তাপস টলেনি। এই নিয়ে বড়বউয়ের অশান্তির শেষ নেই। সংসারের কর্তৃত্ব নিজের হাতে নেওয়ার প্রহর গুণছে। এমন সময়ে আমার কোমায় চলে যাওয়াটা ওকে কি ভেতরে ভেতরে কিছুটা আশান্বিত করছে? না হলে ও ডাক্তারের কাছে কেন জানতে চাইবে--কোমা থেকে ফিরে আসার চান্স কতটা, বিশেষ করে আমার ক্ষেত্রে। ডাক্তার বেশ গম্ভীর হয়েই উত্তর দিয়েছিলেন--সাতদিনের মধ্যেও হতে পারে আবার সাত বছরও হতে পারে। ফিরে আসার চান্স যে নেই তা তো বলতে পারি না। বড়বউ ডাক্তারের এই কথা শুনে গুম হয়ে গিয়েছিল।
আমি কাজলের সঙ্গে দীপুর বিয়ে দেবার কথা ভেবে রেখেছি। ওঁকেও কথাটা বলেছি। উনি বলেছেন--আশা কোরো না কিছু। আজকালকার ছেলেদের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত তাদের অগোচরে না নেওয়াই উচিত। দীপুর সঙ্গে কথা না বলে আগ বাড়িয়ে কিছু ভেবো না।
আমি অবশ্য ভাবনাটা ছাড়িনি। দেখা যাক্ কি হয়!
কাজলের কথাই ভাবছিলাম। কাজল ঘরে ঢুকে ওঁর পাশে গিয়ে বললো, মেসমশাই, ডাক্তারবাবু মাসিমার গয়নাগাটি খুলে নিতে বলেছেন। আমি কি খুলে দেবো?
সঙ্গে সঙ্গে দুই মেয়ে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকের ওপর। প্রায় ছিনতাইয়ের স্টাইলে হারটা দুই মেয়ের হাতের মুঠোয় চলে যাচ্ছিল আর একটু হলেই! ডাক্তার প্রায় শিউড়ে ছুটে এলেন আমার পাশে। আমার বোকা মেয়েদুটিকে ধমক দিলেন। ওরা থতমত খেয়ে একটু সরে দাঁড়ালো। উনি কাজলের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন--
--খুব সাবধানে ওগুলো খুলে নে তো মা--দেখিস যেন না লাগে।
আমার আছাড় খেয়ে মাটিতে পড়া এবং তারপর কোমায় চলে যাওয়ার ঘন্টা দশেক পর এই প্রথম ওঁর গলার আওয়াজ শুনলাম। একেবারে অপরিচিত শোনালো। তবু এতক্ষণে যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। গলা শুনে এটুকু অন্ততঃ বুঝলাম শরীরটা খুব খারাপ হয়নি। এখন আমার গোটা শরীর এবং চেতনায় বড় ক্লান্তি টের পাচ্ছি। আমি কাজলের দিকে তাকিয়ে বললাম--যদি ঘুমিয়ে পড়ি তুই তোর মেসোমশাইকে মনে করে রাতের খাবার খাইয়ে ওষুধটাও দিয়ে দিস মা।
২
কাজলের কথাঃ
জয়ামাসিকে আমি মায়ের মতোই ভালোবাসি। শুধু এই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী বলেই নয়--জয়ামাসিকে মা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না বলেই জয়ামাসির মুখে আমার মায়ের মুখটাই অবিকল সেঁটে থাকে সব সময়। এই বাড়িতে আশ্রিত হয়ে আসা এবং তারপর অবধারিতভাবে ক্রমশ: এই বাড়ির বিনা মাইনের ঝি হয়ে ওঠার ব্যাপারটা জয়ামাসির জন্যেই সম্ভব হয়নি। আমি নিজের মনের তাগিদে কর্তব্য বলে যা মনে করি যতটুকু করি তা মাসির জন্যেই করি। করতে আমার ভালো লাগে খুব।
জয়ামাসি বাথরুম থেকে বেরুতে গিয়েই যে ওভাবে মৃত্যুমুখে চলে যাবেন আমি তা ভাবতেই পারিনি। আমি ভেবেছিলাম মাসি বোধহয় সত্যি সত্যি মরে গেল। বুকটা আমার ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল। নিরাশ্রয় হবার ভয়ে নয়--একটা দাপুটে প্রাণবন্ত জননী-মানবী এভাবে মারা যাবেন কেন? ইতিমধ্যে ঘন্টাদশেক কেটে গেলেও মাসির জ্ঞান ফেরেনি এখনো। ডাক্তারের মতে তিনি কোমায় চলে গেছেন। এই অবস্থা থেকে তিনি ঠিক কবে সুস্থ হবেন কিংবা আদৌ হবেন কিনা সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে ডাক্তারের পক্ষে কিছু বলা সম্ভব হয়নি।
ডাক্তারের এই কথা শুনে তপতী বৌদি তাপসদাকে নার্সিংহোমের সিঁড়ির নীচে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে রাগে ফেটে পড়েছিল--
--সাত বছর ধরে যদি তোমার মা এইভাবে শুয়ে থাকেন পারবে নার্সিংহোমের হাতির খরচ জোটাতে? দুম্ করে এত বড় নার্সিংহোমে না তুলে এসএসকেএম হাসপাতালে কি তোলা যেত না? ওখানেও তো শুনেছি বড় বড় ডাক্তার আছে--
--তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না। তোমার বাবার কাছে টাকা চাইতে যাব না আমার মায়ের জন্যে। মায়ের ট্রিটমেন্ট করাবার মতো সামর্থ্য আমাদের আছে--
তাপসদার কথা শুনে বোবা হয়ে গিয়েছিল বৌদি। মিনিট দশেক উদাসভাবে এদিক ওদিক ঘুরে বাড়ি চলে গিয়েছিল।
সময় যত পার হচ্ছে ততই কেমন যেন মানুষগুলোও বদলে যাচ্ছে। জয়ামাসির খারাপ কিছু ঘটে গেলে কিংবা সত্যি সত্যি সাতবছর কোমায় থাকলে আমাকে ফিরে যেতে হবে এখান থেকে। যাবার আগে অবশ্য গোছাবার কিছুই নেই তেমন--দু'একটা শাড়ি চুড়িদার ছাড়া। তবু মনে মনে প্রস্তুত হবার চেষ্টা করছিলাম আমি।
মেসমশাই হয়তো প্রথম ধাক্কাটা সামলে উঠতে পেরেছেন। সকালে দুর্ঘটনার সময়ে আমার মনে হচ্ছিল উনিও হয়তো হার্টফেল করে মারা যাবেন। জয়ামাসির নির্বাক মুখের দিকে যেভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন তাতে আমি বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মাসির দুই খোলা চোখে কোনো ভাষা ছিল না। তবু কেন জানি না ঐ চোখ দুটো আমাকে তীব্রভাবে কিছু বলতে চাইছিল। আমিও মাসিকে বলতে চাইছিলাম, তুমি চিন্তা কোরো না--আমি মেসমশাইকে ওষুধ খাইয়েছি। যতদিন না আমি বিতাড়িত হই এ বাড়ি থেকে ততদিন আমি ওঁকে দেখাশোনা করবো। শুধু তুমি কোমা থেকে তাড়াতাড়ি এসো জয়ামাসি! না হলে এতবড় সংসারটা যে তছনছ হয়ে যাবে--
তিনদিন ধরে আত্মীয়-স্বজনের মেলা লেগে গেল নার্সিংহোমে। দীপুদা পরদিনই ব্যাঙ্গালোর থেকে সোজা নার্সিংহোমে এসে জয়ামাসির দিকে তাকিয়ে বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেললো। ওর কান্না দেখে সকলেরই চোখে জল এলো আবার। আমার চোখের জল তো কিছুতেই থামে না। ছোট ছোট এই দুটো চোখের ভেতরে জলের এত সঞ্চয় থাকে কি করে?
তারপর যত দিন যায় ভিড় কমতে কমতে প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়ালো। বাড়িতে তপতীবৌদির দাপটে সকলের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। যেকোনো ব্যাপারেই অশান্তি। বিশেষ করে আমাকে এখন হাতের মুঠোয় পেয়ে যা খুশি তাই করিয়ে নেওয়ার জেদ ক্রমশ:ই বেড়ে যাচ্ছে। রান্না থেকে বাসনমাজা পর্যন্ত যতটা আমাকে দিয়ে করানো যায় তার চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেরই সুখের বারোটা বাজাচ্ছে বৌদি। কিন্তু কে তাকে বোঝাবে। মেসমশাই আমাকে রক্ষা করে চলেছেন। তবু বুঝে পারছি জয়ামাসি যদি না ফেরে তাহলে আমার পড়াশোনা শেষ। এ বাড়ির আনাচে-কানাচে বেড়ে ওঠা আমার স্বপ্নগুলো মাটিতে মিশে যাবে নিশ্চিত। এখন তাই অপেক্ষা।
৩
জয়ার কথাঃ
দু'মাস কোমায় থাকার সময়ে আমি যা দেখলাম যা শুনলাম তাতে বাঁচার ইচ্ছে মানুষের থাকার কথা নয়। হয়তো এই অনিচ্ছাই মানুষকে আর কোমা থেকে জাগতে দেয় না। যাদের বাঁচার ইচ্ছে প্রবল থাকে তারাই হয়তো কোমা থেকে ফিরে আসে।
গত দু'মাসে আমি যা দেখলাম, শুনলাম তাতে কি সত্যি সত্যি আমার বাঁচার আর ইচ্ছে হয় না? বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।
আমার বড় ছেলে তাপস আর তার বউ আমারই পাশে দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছেআমি সাগ্রহে কান পেতে অপেক্ষা করছিলাম এই আশা নিয়ে যে ওরা আমার জন্যে কতটা উদ্বিগ্ন সে কথাই বলাবলি করবে। আমার অভাবে সংসারে যে কতবড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে ওরা তাই নিয়ে কথা বলবে। ওরা সে-সব কিছুই বলেনি। তপতী আমার ঘরের নির্জনতার সুযোগে তাপসকে পরামর্শ দিচ্ছিল--
--কতদিন এভাবে উনি পড়ে থাকবেন তার তো কোনো ঠিক নেই। ওঁকে বাড়িতে নিয়ে গেলেই তো হয়--
--এই অবস্থায় বাড়িতে নেওয়া যায়? কে দেখাশোনা করবে? তারচেয়েও বড় কথা বাড়িতে এরকম রোগের ট্রিটমেন্ট হয় না। চব্বিশঘন্টা ডাক্তারের নজরে থাকা দরকার।
--তুমি কি বিশ্বাস করো উনি আবার সুস্থ হয়ে উঠবেন?
--কি বলতে চাও তুমি--আমার মা লস্ট কেস?
বলতে বলতে দৃশ্যতঃই ভেঙ্গে পড়লো তাপস। আমি পাশ থেকে বলে উঠলাম--
--বোকার মতো কাঁদিস না যেন বাবা--আর দু'চারদিন অপেক্ষা কর। যদি আমার বেঁচে ওঠার ইচ্ছেটা আর একটু বেড়ে যায় তাহলে কোমা থেকে উঠে বসতে পারি।
তাপস আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল চুপচাপ। বুঝলাম আমার কথা ও শুনতেই পায়নি। ওর বুকের ভেতর ঝড় বইছে। মা-পাগলা ছেলেদুটো আমার বেঁচে ওঠার অপেক্ষায় মুহূর্ত গুণছে। মেয়ে দুটো ধরেই নিয়েছে আমার আর কোনো আশাই নেই। তাই এখন আর ঘন ঘন আসে না। মাঝে মধ্যে বরের সঙ্গে মার্কেটিংয়ে বেরুলে ফেরার পথে ঘুরে যায়।
ওদিকে কাজলের ওপর দিয়ে রোলার চালাচ্ছে তপতী। আজ আমার মৃত্যু ঘোষণা হলেই তপতী কাজলকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু তাপস আর দীপু কি তা হতে দেবে? জোর দিয়ে বলা কঠিন। আমি না থাকলে তপতীর ওপরেই সকলকে নির্ভর করতে হবে।
আমার সমস্যা তো শুধু আমার ছেলেমেয়েদের সুখ-শান্তি নিয়েই নয়। শুধু কাজলকে নিয়েও নয়। ওঁকে কে দেখবে। এই তো গত বছরেই একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে। মানসিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছেন সে তো আমি জানি। সবাই কপালে সিঁদুর নিয়ে মরতে চায়--কিন্তু আমি ওঁকে বলেছিলাম উনি বেঁচে থাকতে আমি মরবো না। ওঁকে অসহায় রেখে যাবো না। আমার সে অঙ্গীকার কি ব্যর্থ হবে?
সময়ে ওষুধ খাওয়ানো, মেজাজ বুঝে খেতে দেওয়া, হাতের কাছে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রাখা--এসব আমি না থাকলে কাজল নিশ্চয়ই করতো। কিন্তু কাজলকে তাড়িয়ে দিলে কি হবে? মানুষটা একেবারে অসহায় হয়ে পড়বে না? শেষের কটা দিন বড় কষ্টের মধ্যে দিয়ে কাটবে। ভাবতেই আমার বুকের ভেতরের হাওয়া নি:শেষ হওয়ার উপক্রম! প্রবলভাবে আমি হাত নেড়ে নেড়ে মৃত্যুকে ঠেকাবার চেষ্টা করছি। প্রবলভাবে আমার মধ্যে বাঁচার ইচ্ছে তৈরি হচ্ছে!
আমার বিছানার পাশে ঠিক এই মুহূর্তে তিনি প্লাস্টিকের টুলের ওপর চুপচাপ বসে আছেন। আমার পায়ের কাছে বসে আছে কাজল। আমার ডান দিকে তাপসও একটা টুলের ওপর বসে আছে। গতরাতে নাকি আমার অবস্থার অবনতি হয়েছিল। আসলে গত রাতে আমি আমার মৃত্যুকে ঠেকাবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলাম। তীব্র উত্তেজনায় আমি বিছানা ছেড়ে নেমে ছুটে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। কিন্তু কয়েকজন ডাক্তার আমার মুখের ওপর হুমড়ি খেয়ে থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
এই মুহূর্তে আমি একদৃষ্টে ওঁকে লক্ষ্য করছিলাম। এতদিন একবারের জন্যেও বুঝতে দেননি আমার থাকা না থাকাটা কতটা গুরুত্বপর্ণ ব্যাপার তাঁর কাছে। আমার অবস্থার অবনতির কথা শুনে সকাল হতে না হতেই ছুটে এসেছেন আমার পাশে। আমি সকলের মুখের দিকে একবার করে তাকালাম। তাপসের চোখে জল। কাজলের উদভ্রান্ত দৃষ্টি--আহা বেচারি! ওঁরও চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। আমি তাপসের নাম ধরে প্রাণপণে ডাকলাম--তাপস তোর বাবার আবার স্ট্রোক হতে যাচ্ছে--ডাক্তারকে এক্ষুণি একবার ডাক বাবা!
কেউ কিচ্ছু শুনছে না। আমি প্রবলভাবে হাত নাড়ছি পা ছুঁড়ছি--প্রবল শব্দে ডাক্তারকে ডাকছি! উনি চমকে উঠে আমার হাত চেপে ধরলেন। সবাই হৈ-হৈ করে উঠলো। আমার বাঁচার ইচ্ছের কাছে মৃত্যু কি শেষপর্যন্ত হার মানছে?
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট