জননী সম্ভবা

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

................................. জষ্ঠ্যি মাসের রোদে আগুনের আঁচ। গায়ে যেন ছ্যাঁকা লাগে। চারিদিকে ঠা-ঠা পোড়া পোড়া ছবি। পায়ের নিচের বালি-কাঁকড়ে ধান ছড়ালে ফটাফট খই হয়ে যাবে। রাস্তার কুকুরগুলোও আধ হাত জিভ বের করে অন্ধকার খুঁজে মরছে। নদী বাঁধগুলোর বুকে বালি আর পাঁক। বালি খুঁড়ে খুঁড়ে এক মানুষ গর্ত করার পর জল জমে টলটলে। বাটি দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে কলসীতে ভরতে হয় অনেকক্ষণ ধরে। এক কলসী জল নিয়ে ঘরে ফিরতে ফিরতে সূর্য মাথার ওপর উঠে যায়।
বিমলি কাঁসাই নদী থেকে ঘরে ফেরার পথে ইদিক ওদিক থেকে চোত-বোশেখের দু’চার ফোঁটা জলের স্পর্শে মাটি ফুঁড়ে ওঠা কলমী নটে লাফরা শাক তুলে নিয়ে আসে। কখনো কখনো সুযোগ পেলে গৃহস্থের কলাটা শশাটা ছিঁড়ে নেয়। এক-আধটা গন্ধ লেবু হলে বিমলির আর কিছুই লাগে না। এক থালা মাড়ভাতের ওপর দু’চার ফোঁটা গন্ধ লেবুর রস আর নূন হলেই যথেষ্ট।

কিন্তু এই জষ্ঠ্যি মাসের শেষাশেষি মাড়-ভাত জোটাতেই প্রাণান্ত অবস্থা। এই সময় ক্ষেতখামারে কাজ নেই। মাঠঘাট সব ফুটিফাটা। বিমলির বাপ সখারামের ভিটের লাগোয়া দু’চার কাঠা জমি ছাড়া আর কিছুই নেই। চাষবাসের সময় ছাড়া বাকি সময়টা বলতে গেলে বেকার। বোশেখ মাসে ছো নাচের দলে জুটে গিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়ায়। মাস দেড়েক বাদে একটা বেঁচকা মাথায় ঘরে ফেরে। তখন তার রাজার মেজাজ। ট্যাঁকে দু’চার টাকা থাকে। বোঁচকার মধ্যে মা-মরা মেয়ের জন্যে আলতাপাড় লাল-হলুদের চেক কাটা শাড়ি, ফিতে, প্লাসটিকের চটি, কাচের চুড়ি, বাস সাবান, নানারঙের টিপ--এমন কী বিস্কুট চানাচুরের প্যাকেটও থাকে।

কিন্তু এতসব নিয়ে ঘরে পা দিতে না দিতেই বঁটি নিয়ে বাপের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়ে। যেভাবে তেড়ে আসে তাতে সখারামের ধর থেকে মুণ্ডু আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে অঘটন ঘটে নি। বিমলি ক্রোধে অন্ধ হয়েও বাপের গলায় বঁটির কোপ বসাতে পারে নি। উল্টে এক সময়ে হাউ-মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিজেরই গলায় বঁটির কোপ বসাতে যায়। চরম মুহূর্তে শিকারি বাঘের মতো সতর্ক সখারাম ঝাঁপিয়ে পড়ে বঁটি হাত থেকে কেড়ে নেয়। তারপর বেশ কিছুক্ষণ মান-অভিমানের পর বোঁচকা খুলে বিমলি সব ভুলে যায়। বাপটা তার সত্যি সত্যি ভাল মানুষ। মা-মরা মেয়েকে বুকে করেই তো লোকটা বেঁচে আছে। তা না হলে তো কবেই চঞ্চলা মাসিকে ঘরে এনে তুলতো।

সখারামের সঙ্গে বিমলির মায়ের দূর সম্পর্কের বোন চঞ্চলাকে নিয়ে গাঁয়ে বেশ কানাকানি হয়। বিমলি জানে মাসি সখারামকে বেশ আদর যত্ন করে। ঘরে বসায়। এটা সেটা খাওয়ায়। মাঝে মাঝে বিমলি বাপের গা থেকে মাসির মাথার বাসতেলের গন্ধও পায়।

মাসির বর ওকে ছেড়ে ধানবাদ না কোথায় যেন চলে গেছে। সখারাম নিজের চোখে দেখে এসেছে চঞ্চলার বর নতুন সংসার পেতেছে। কি একটা কারখানাতে লোহা পেটানোর কাজ করে। রোজগার খুব একটা মন্দ নয়। ওড়ায়ও দু’হাতে। নতুন বৌ কালো হলে কি হবে গায়ে-গতরে ঝকঝকে জলঢ্যামনা। সখারাম বুঝে এসেছে চঞ্চলার বর ফেরার চেষ্টা করলে জলঢ্যামনার খরিশ ভায়েরা ওকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।

সখারামের মুখ থেকে সব বিত্তান্ত শুনে বেশ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে ছিল চঞ্চলা। তারপর মনে মনে বোধহয় ভেবেছিল সামনের অতি দীর্ঘজীবন মরদ ছাড়া চলতে পারে না। সমাজ সংসারে ভরখর যুয়ান বিটি ছিইল্যার একা একা থাকা কেউ ভাল চোখে দেখে না। চঞ্চলা তাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সখার বুকের খুব কাছটিতে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলেছিল--‘তুমি আমায় সাঙা কর ন কেনে বুনাই?

বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠেছিল সখারামের। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিল সে। কিন্তু দরজার ফ্রেমে আটকে থাকা মেয়ের বড় বড় চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে রাজি হতে পারে নি। ওদের দু’জনের উষ্ণ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝখানে কিশোরী বিমলি এসে গিয়েছিল। বলা যায় না, মা-মরা মেয়ে যদি চঞ্চলার চোখের কাঁটা হয়ে ওঠে? সখারাম তাই মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছিল,
--না রে চঞ্চলা, তুকে সাঙা করতে লারবো। বিমলি আমার মা-মরা সিয়ানা বিটি বটে। উযার মনে লাইগবেক--
--উ কি বুইলছো বুনাই--তুমার বিটি কি হামার বিটি লয়?
কাতর আবেদনে চঞ্চলা সেদিন যথেষ্ট নুয়ে পড়েছিল। তবু সখারাম রাজি হয় নি। তখন ভেবেছিল মেয়ের হাবভাব বুঝে সে নিজেই বিমলিকে বলবে চঞ্চলাকে ঘরে আনার কথা। কিন্তু সাহসে কুলোয় নি। কয়েকবার চোখ বুঁজে বলে ফেলার চেষ্টা করেও বলতে পারে নি। মেয়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার প্রতিবারই মনে হয়েছে বিমলির বাবাময় জগতে আর অন্য কোনও অনুপ্রবেশ বিমলি সহজ মনে মেনে নেবে না।

সখারাম চঞ্চলাকে ঘরে তুলতে পারে নি। কিন্তু তাই বলে চঞ্চলা সখারামকে ছাড়ে নি। গোটা গাঁ এই কারণে চঞ্চলার বিরুদ্ধে চলে গেছে। প্রথম প্রথম দু’চারদিন শান্ত থাকলেও পরে সম্পর্কের সূত্র ধরে সদ্য বিপত্নীক সখারামের ঘরে যাতায়াত শুরু করতেই কানাকানি শুরু হয়ে গেল। বেটা ছিল্যার সোয়াদ পাওয়া সোমত্থ বিটিছিইল্যার হটহট করে গাঁ-ময় ইলচামি করে বেড়াবে অথচ সখারাম ছাড়া গাঁয়ের আর কোন মোড়ল মরদের দিকে তাকাবে না এটা ভূমিজ সমাজের মরদগুলো মেনে নিতে পারছিল না। ফলে সখার সঙ্গে চঞ্চলার সম্পর্ক নিয়ে গাঁয়ের ভূমিজ সমাজে হৈ-চৈ পড়ে গিয়েছিল। বেকায়দা দেখে চঞ্চলার বাপ-ই পঞ্চায়েত ডেকে সখার বিরুদ্ধে মেয়ে ফুঁসলানোর নালিশ জানালো। ভরা পঞ্চায়েতে সখাকে কিছু বলতে হল না। চঞ্চলাই খরিশ সাপের মতো ফণা তুলে বলেছিল,
--হঁ, সখা হামার মরদ বটে! আমি উয়ার। হামার এই গতর আমি উয়াকেই দিয়্যেঁছি।’
বলে ভরা পঞ্চায়েতে ভরখর যুয়ান শরীরে যেভাবে ঢেউ তুলেছিল চঞ্চলা যার ধাক্কায় গোটা পঞ্চায়েত কুপোকাৎ হয়ে গেল। এর পর আর কোন বিচারই দাঁড়ায় নি। তবু দু’একজন মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল,
--তবে তুই সখাকে বিহা করছিস লাই কেনে?
--বিহা তো বাপ-ট হামার দিয়্যেঁছিল। বিহার কাঁথায় আগুন দিয়্যেঁ মরদ যখুন ভাগল্যে তখন হামার এই বাপ আর তুরা কুথায় ছিলিস মোড়ল? বিহার কথা মুখে লিতে লাজ লাগে ন?
বলে দুরন্ত শরীরে আর একবার দুর্বার ঢেউ তুলে সভা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিয়েছিল চঞ্চলা। বিমলি ভিড়ের মধ্যে চুপি চুপি মিশে গিয়ে পঞ্চায়েতের বিচার সভা দেখছিল। চঞ্চলার অকপট ঘোষণা আর তেজ তার মন্দ লাগে নি। একবার মনেও হয়েছিল বাপকে বলে, চঞ্চলাকে ঘরে আনলে মন্দ হয় না। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয়েছিল বাপটা যদি অন্য মানুষ হয়ে যায়? বাপ ছাড়া তো তার আর কেউ নেই। বিমলি সাহস পায় না।

পঞ্চায়েতের বিচার পর্বের পর চঞ্চলা সখারামের রাখনী হিসেবেই গাঁয়ে চিহ্নিত হয়ে গেল। কিন্তু রাখনীকে স্বচ্ছলতা দেবার ক্ষমতা সখারামের ছিল না। অগত্যা চঞ্চলা ঘরে হাঁড়িয়া তাড়ি রসি বানায়। কাঁচা শালপাতার ঠোঙা বানায়। এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে কম দামে হাঁস-মুরগীর ডিম কেনে। এ সবই সে হাটে বিক্রি করে। খদ্দেরের অভাব হয় না। এসব থেকে তার আয় খুব একটা মন্দ হয় না।

এই আয় থেকেই চঞ্চলা আগে বিমলির জন্যে সখার হাতে ফ্রক কিনে পাঠাতো। এখন আলতাপাড় ডুড়ে শাড়ি কিনে পাঠায়। হাট থেকে শহরের মেয়েদের মতো বডিসও কিনে ভাল করে কাগজে মুড়ে সখার হাতেই পাঠায়। এসব কে কিনেছে বিমলিকে বলতে হয় না। সে এমনিতেই বোঝে তার বাপের এসব ব্যাপারে কোন হুঁশই নেই।

কাছাকাছি কোন মেলা লাগলে চঞ্চলা মুড়ির বস্তা ব্যাসনের বস্তা তেলের টিন ঘরে তৈরি ময়দার গজা এইসব রাশিকৃত মালপত্র নিয়ে সখারামের সঙ্গে মুড়ি-তেলেভাজার দোকানও দেয়। মেলা লাগলে খুশিই হয় বিমলি। সেও ওদের সঙ্গে মেলায় যাওয়ার সুযোগ পায়।

মরদ হয়েও সখারাম যা পারে না চঞ্চলা তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু করে। মেলার দোকানও বেশ ভালই চলে। চঞ্চলা বিমলিকে নিয়ে ফাঁক-ফোকড়ে মনোহারী দোকানে দোকানে ঘুরে না চাইতেই অনেক কিছু কিনে দেয়। সখারামের জন্যেও সিগ্রেটের প্যাকেট ভাল পকেট চিরুনি চকচকে বাহারি চটি কেনে। বিমলির খুব সঙ্কোচ হয়। চোখ ফেটে জল আসে যখন দেখে তার ছন্নছাড়া গরিব বাপও সসঙ্কোচে চঞ্চলার কেনা জিনিষগুলো হাত পেতে নেয়। অথচ তেমন কিছুই চঞ্চলার হাতে তুলে দিতে পারে না। বিমলির প্রায়ই মনে হয় তারা বাপ-বেটি দু’জনেই চঞ্চলা মাসিকে ঠকাচ্ছে।

অবশ্য বিমলির অজ্ঞাতে সখারাম শহর থেকে এক-আধটা ভাল শাড়ি, রূপোর নাকের ফু্‌ খোঁপার কাঁটা কিনে এনে দেয় না যে তা নয়। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই চঞ্চলা টের পায় সখার পেটে ভাত জুটছে না। বিমলিও শাকপাতার খোঁজে এদিক ওদিক ঘুরে মরছে। অতএব সখার হাতে চঞ্চলা মাঝে মধ্যেই দু’এক মুঠো টাকা গুঁজে দেয়। সখার গামছায় চাল আলু দু’একটা ডিম দেখলেই বিমলি টের পায় মাসি আবার ‘ধার’ দিয়েছে! সখারাম অবাক হয়ে ভাবে চঞ্চলাই বলতে গেলে সখারামকে ‘রেখেছে’--অথচ গাঁয়ের বিচারে চঞ্চলাই হল তার রাখনী !

জষ্ঠ্যি মাসের এই শষোশেষি সময় থেকেই বিমলিদের দুঃখের দিন শুরু হয়। সখারাম মাস দেড়েক হেথা-হোথা ঘুরে যা কিছু নিয়ে এসেছিল তা-ও প্রায় শেষ। শুধু দু’বেলা দু’মুঠো মাড়ভাতের জন্য কিছু চাল এখনও ঘরে আছে। এক কলসী জল নিয়ে আঙিনায় পা রাখতেই মুখোমুখি দেখা মাসির সঙ্গে। সখারাম বসেছিল দাওয়ায়। চঞ্চলা মাসি কিছু একটা বোঝাচ্ছিল বাপকে বলে মনে হল বিমলির। বিমলিকে দেখে দৌড়ে কাছে এসে কলসীটা মাথা থেকে নামিয়ে রাখলো চঞ্চলা। নিজের আঁচল দিয়ে বিমলির মুখ-ঘাড়-গলা থেকে ঘাম মুছে নিয়ে বলে উঠলো--
--আগুন পারা রাঙা হয়্যেঁ গেইলছ্যে মুখ-ট! বেদম কষ্ট হয় না রে বিমলি?
চঞ্চলার গলায় অবিকল মরে যাওয়া মায়ের গলা শুনতে পেল বিমলি। গলায় কি যেন একটা আটকে যায়। মুখে কথা সরে না। নিঃশব্দে ঘাড় নেড়ে বাপের পাশেই বসে পড়ে।
--ডিমডিমার মেলায় দোকান দিব রে বিমলি। ইবারও সনগে যাবি তো?
সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নাড়ে বিমলি। মেলার দিনগুলোই তো তার সুখের দিন। কোন চিন্তা নাই ভাবনা নাই। রান্নাও করা নাই, সনগে বাপটোও থাইকবেক। সুতরাং মেলায় যাওয়ার কথায় বিমলি মনে মনে নেচে ওঠে। শেষপর্যন্ত ঠিক হয় পরশু ভোরে ভোরে ডিমডিমার বুঢ়া-বাবার মেলার উদ্দেশ্যে ওরা রওয়ানা হবে। সঙ্গে হেল্পার পেহ্লাদকেও নেওয়া হবে।

দু’দিনের (আসলে একদিনের একরাতের) মেলা হলে কি হবে--হাঁকডাক দারুণ! গিজ গিজ করে লোকজন। বুঢ়া বাবা সাংঘাতিক জাগ্রত দেবতা। বহুদূর থেকে লোক আসে হো-হো পায়ে। মোটরগাড়ি চড়ে শহরের বাবুও আসে কত! ছো-নাচ আসে। সারারাত ধরে দুলমির নাচনী সুরবালা আর চাকোলতোরের নাচনী মালাবতীর মধ্যে লড়াই জমে যায় বেদম। ঢাক-ঢোলের আওয়াজ ওঠে--গেজা গেজা গিরিনতা। ঘোড়া নাচ, ডাঁড় নাচ, লাটুয়া নাচও আসে। মেলা যেন ফেটে পড়ে। এখানে ওখানে ঝাণ্ডির আসর ঘিরে মৌচাকের মতো জুয়াড়িদের ঠাস বুনোন। সখারামের খুব ইচ্ছে করে দু’চার দান ফেলার। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেই তো হয় না--নগদ টাকা লাগে। ইদিকে তার পকেট যে ফাঁকা!

বড় এক কড়াই ফুটন্ত তেলের মধ্যে নিপুণ কায়দায় ব্যাসনের ভাবরা ছাড়ছে চঞ্চলা। পেহ্লাদ আখার গর্ভে বড় বড় চ্যালা কাঠ কখনো ঠেলে দিচ্ছে কখনো সামনে টেনে আগুনের তেজ বাড়াচ্ছে কমাচ্ছে। সখারাম খদ্দের সামলাচ্ছে। ভাবরা ভাজতে ভাজতে চঞ্চলা মাঝে মাঝে সখাকে লক্ষ্য করছিল, আজকাল থেকে থেকেই কাজে অকাজে সখা আর বিমলির কথা চঞ্চলার মনে ঝনাৎ ঝনাৎ বাজে। মানুষটা বড় সরল। বড় ফূর্তিবাজ। হরদম ঝুমুর হাঁকতে চায়। বিমলির মা বেঁচে থাকতে সখা এমনই ছিল। এরম মরদ বিষয়-আশয় বোঝে না--সংসারের সব দায় বউয়ের ওপর ছেড়ে দিয়ে নাচ-গান নির্দোষ ফূর্তি নিয়েই থাকতে ভালবাসে। সংসার বিমলির মা ভালই সামলাতো। সখারামকে রোজগারের পথে ঠেলে দিতে দিতে বলতো--
--হামাকে দিয়্যাঁ ভিখ মাঙাতে চাইলে আমি কিন্তু তুকে ছাড়্যে দিব--অন্য মরদের সনগে ঘর--
বাকিটা সখারাম উচ্চারণ করতে দিত না। রোজগার করতো--ফাঁকে ফাঁকে তার আমোদ-আহ্লাদ নিয়ে মাথা ঘামাতো না বিমলির মা। তখনকার সখা এখন কেমন যেন গুটি গুটি হাঁটে।

চঞ্চলারও এখন আর নিজেকে নিয়ে ভাবতে ভাল লাগে না। সব সময়ে তার মনে হয় সখা-বিমলি আর তাকে নিয়েই একটা পরিপূর্ণ জীবন--কাউকেই বাদ দিয়ে এ জীবনটা ভাবতে ভুলে গেছে সে। অথচ সেই পরিপূর্ণ জীবনটা কিছুতেই তার হাতের নাগালের মধ্যে আসছে না। মাঝে মাঝে তার বড় অভিমান হয়--সখার ওপর তীব্র অভিমান মাঝে মাঝেই তাকে হতাশার মধ্যে ঠেলে দিলেও সে এখনও সখার জন্যেই নিজেকে সাজায়। সখাকে বুকের মধ্যে টেনে নেওয়ার তুমুল আকাঙ্ক্ষা থেকে নিজেকে কিছুতেই আড়াল করতে পারে না। সখা এ বিত্তান্ত বুঝে গেছে বলেই তার মধ্যে নতুন করে কিছু হারানোর ভয় কাজ করে না। বিমলি তাকে কেন মা বলে ভাবতে পারে না--চঞ্চলা কিছুতেই বুঝতে পারে না!

অনেকদিন পরে খদ্দের সামলাতে সামলাতে সখারাম দু’এক কলি ঝুমুর গেয়ে চলেছে আপন মনে। ঠিক আপন মনেই নয় উনুনের আঁচে লাল হয়ে ওঠা চঞ্চলার ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়েই সখারামের গলায় ঝুমুরের কলি উঠে আসছে,

‘কি বৈলব তোকে সজনী, ও তোর দুলছে সরু কোমরখানি
চৈমকে চৈমকে উঠে ছাতি, হামার হুদকে উঠে মন।’

চঞ্চলা বাধা দেয় না। দু’কান পেতে গান শোনে। অবশ্য বিমলি এখানে থাকলে মরমে মরে যেত সে। সখাও নিশ্চয়ই এ রসের গান গাইতো না। এদিক ওদিক ঘুরতে গেছে বিমলি। চঞ্চলা হাল্কা বাদামি হয়ে ওঠা ভাবরাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল আশপাশের দশ-বিশটা গাঁয়ে এমন কোন মরদ নেই চঞ্চলা চাইলে যে বিনা বাক্যব্যয়ে এই তেলের কড়াইতে ঝাঁপ দেবে না। সখারামও বোঝে চঞ্চলাকে পাবার জন্যে হদকিয়ে মরছে অনেকেই। সেই সঙ্গে এটাও বোঝে চঞ্চলা তার জন্যেই মরছে!

বিকেলের দিকে মেলা যখন বেশ জমে উঠেছে ঠিক তখনই এক প্রস্থ প্রকাণ্ড কালো মেঘ উঠতেই চঞ্চলার বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। চারপাশের আলো দেখতে দেখতে মরে গিয়ে আঁধার ঘনিয়ে এল। পেহ্লাদ মেঘের হুঙ্কার শুনে ভযার্ত গলায় সখারামের উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে ওঠে--
--হাঁ-ব-খুড়া, শেষটায় ডুবাবেক ন-কি?
--কি জানি!
সখারামও গতিক ভাল বুঝলো না। বড় ঝাঁঝরিতে ভাবরা ছাঁকতে ছাঁকতে চঞ্চলা সখারামকে জিজ্ঞেস করে--
--বিমলি কুথায়? উয়াকে দেখ ন-কেনে?
--হেথা হোথা ঘুচ্ছে লিচ্চয়--
--আকাশ ভাল্য ঠেকছে না গ বুনাই। বিমলিকে খুঁজ্যে লিয়ে এস আগে।
বলতে না বলতেই সোঁ সোঁ শব্দে বাতাস ছুটে এল পাগলা ষাঁড়ের মতো। দোকান-পাট প্রায় উড়ে যাওয়ার দাখিল। ধুলোয় বালিতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে ওঠে। দাউ দাউ জ্বলন্ত কাঠে জল ঢেলে দিল চঞ্চলা। চিৎকার করে ওঠে পেহ্লাদ--
--হা বুড়হা বাপ! ইকি সব্বলাশ হৈঁয়ে গেল ব-খুড়া!
--বিটিছিইল্যার মতন হদকিস ন-ত--দোকান গুটা আগে।

চঞ্চলা ধমক লাগায় পেহ্লাদকে। বস্তার খোলা মুখ দিয়ে ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে মুড়ি। পেহ্লাদ বস্তার মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝড় উঠতেই সখারাম মেয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে। দেখতে দেখতে উথাল-পাতাল বুষ্টিও শুরু হয়ে গেল। সঙ্গে চলেছে গোঁ-গোঁ শব্দে ঝড়ের প্রলয় নাচন। বেশ কিছুক্ষণ না বিমলি না সখারাম কারুর দেখা না পেয়ে অস্থির চঞ্চলা পেহ্লাদকে দোকান সামলাতে বলে নিজেও বেরিয়ে পড়ে।

আকাশ ফালা ফালা করে বিদ্যুৎ ঝলসে উঠছে। সেই সঙ্গে কড়কড় শব্দে আকাশ ফেটে যেন চৌচির হয়ে যাচ্ছে। দোকান-পত্র সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মানুষের চিৎকার কোলাহল থেকে কারও কোনো কথা শোনার উপায় নেই। চঞ্চলা তবু গলা ফাটিয়ে বিমলির নাম ধরে ডেকেই চলেছে। ছুটে চলেছে এদিক থেকে ওদিক। অন্ধের মতো ছুটতে ছুটতেই বুড়হা শিবের মন্দিরের পেছনে এসেই থমকে দাঁড়ালো চঞ্চলা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে জমে পাথর হয়ে গেল।

একটা মোটরগাড়ির সামনে কয়েকটা ছোকরা বিমলিকে জবরদস্তি গাড়িতে তোলার চেষ্টা করছে। ওর পরনের শাড়ি ছিঁড়ে ফালা-ফালা। ব্লাউজের অবস্থা আরও খারাপ। ঘন ঘন বিদ্যুতের চোখ ধাঁধানো আলোয় বিমলিকে চিনতে চঞ্চলার এক সেকেণ্ডও সময় লাগে নি। কয়েক সেকেণ্ড নিঃস্পন্দ থাকার পর বাঘিনীর মতো চিৎকার করে ছেলেগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো চঞ্চলা। আচমকা এই পরিস্থিতিতে ছেলেগুলো সামান্য হকচকিয়ে গেল। চঞ্চলাকে দেখে বিমলিও চিৎকার করে ওঠে--
--মা! মা গঅ--
--তু পালা বিমলি পালা! বাপের কাছে যা মা--
--ছেলেগুলোর হাত একটু আলগা হতেই বিমলি অন্ধকারে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে পালিয়ে গেল ওদের নাগালের বাইরে। কিন্তু চঞ্চলা একা ওদের সঙ্গে পেরে উঠলো না। গায়ে-গতরে বিমলির চেয়ে অনেক বেশি পরিণত যুবতী চঞ্চলাকে ওরা শেষপর্যন্ত মোটরগাড়ির পেছনের সীটে ফেলে বেধড়ক পেটাতে পারলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যেই প্রচণ্ড কালবৈশাখী শেষ।

পরিষ্কার আকাশে ফুটফুটে চাঁদ ওঠার পর সখারাম বিমলি আর পেহ্লাদ লণ্ডভণ্ড দোকানে একত্রিত হল। সখারাম বিমলির দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিল বিমলির এই লণ্ডভণ্ড অবস্থা ঝড়-বাদলের কারণেই কিনা। বাপের চোখের মধ্যে ফুটে ওঠা অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তরে হাউ-মাউ করে কেঁদে ওঠে বিমলি।

সখারাম পেহ্লাদ আর বিমলি ছুটতে ছুটতে মন্দিরের পেছনে এসে মোটরগাড়ি দেখতে পেল না। সখারাম আহত পশুর মতো ঘাড় গুঁজে জলকাদার ওপরেই বসে পড়ে। পেহ্লাদ এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। যদি ওরা চঞ্চলাকে অন্ধকারে কোথাও ফেলে দিয়ে গিয়ে থাকে! হঠাৎই বেশ খানিকটা দূর থেকে বিমলি গাঢ় স্তব্ধতাকে ফালাফালা করে চেঁচিয়ে ওঠে--
--মা--মা গঅ--
চমকে মুখ তুলে তাকায় সখারাম। দূর থেকে চাঁদের আলোয় স্পষ্ট বোঝা না গেলেও সখারামের মনে হল একটা শরীরের ওপর বিমলি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। দৌড়ে কাছে এসে সখারাম চঞ্চলাকে চিনতে পারলো। প্রায় নিঃস্পন্দ চঞ্চলা রক্তে-কাদায় মিলেমিশে পড়ে আছে--যেন একটা মৃত দেহ!

বিমলি আজ পরপর দু’বার চঞ্চলাকে মা বলে ডেকেছে। দু’বারই সে ডাক চঞ্চলার কানে গেছে। শরীর ও মনের যাবতীয় ক্ষতের ওপরে বিমলির এই মা ডাক যে কত সুখের তা আচ্ছন্নের মতো মাটিতে পড়ে থেকেও চঞ্চলা টের পাচ্ছিল।

বিমলি এখন চঞ্চলাকে মা বলেই ডাকে। একসঙ্গেই নদীর বালি সরিয়ে পাতাল থেকে জল তুলে আনে। সখারামও এখন যখন-তখন ঝুমুর হাঁকে। বিমলি আর সখারাম চঞ্চলার মা হয়ে ওঠার লড়াইটা যে বড্ড কাছ থেকে দেখেছে!

***

গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট

সূচীপত্র