..................... ................................ |
যেথায় যে জন ১
কুড়ি বিঘে জায়গা জুড়ে বিরাট
ফার্ম
হাউসের
ঠিক মাঝখানের বাংলো প্যাটার্নের গেস্ট হাউসের সামনে তিনটে টাটা-সুমো এসে
থামতেই নীলেশ বারন্দা থেকে নেমে এলো। ওর পরনে সিল্কের একটা বাটিক-প্রিন্ট
লুঙ্গি। গায়ে হাফ-হাতা শর্ট-পাঞ্জাবি এবং বিস্ময়করভাবেই ওর পায়ে লাল
ক্যাম্বিসের কেডস্!
নীলেশ বৈদ্যনাথ বক্সির উচ্ছ্বাসের উত্তরে একটু গর্বের হাসি হেসে কিছু বলতে
যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই বক্সির বউ তন্দ্রা বক্সি
যথারীতি তার চিরন্তন
স্খলিত আঁচল সামলাতে সামলাতে
যথেষ্ট সময় নিয়ে নিজের আকর্ষণের ঝাঁঝালো
তীব্রতাকে সকলের চকচকে চোখে ছড়িয়ে দিয়ে বলল--
কাগজপত্র
হাতে নিয়ে গোল গোল বিস্ফারিত চোখে মেলে নতুন করে
বৈদ্যনাথকে বুঝতে চেষ্টা
করছিল তন্দ্রা। বৈদ্যনাথ যে
তার নামের প্রাচীনতার কারণে আর অপমান সইতে রাজি
নয়,
সেটা তন্দ্রা বোঝামাত্র নিজের অবস্থানটাও স্পষ্ট বুঝে ফেলল।
বৈদ্যনাথকে আচমকা বিমূঢ় করে তন্দ্রা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর ওপর। অপ্রস্তুত
বৈদ্যনাথ বেশ কিছু কিল-ঘুঁষি হজম করতে করতে বন্ধুদের উদ্দেশ্যে ছাপার
অযোগ্য কিছু বিশেষণ সাহেবি ঢঙে উচ্চারণ করে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত
বৈদ্যনাথের
নামের প্রাচীনতার ব্যাপারটা ভুলে যেতে পেরেছে তন্দ্রা।
ইতিমধ্যে
রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটেই বেরিয়ে এসেছে অঞ্জনা।
নীলেশের বউ। অঞ্জনার সঙ্গে
তাপসের একটা ইমোশন্যাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল নীলেশের অজ্ঞাতেই। তাপস একটা বড়
মাপের নিউজ-হাউসের আর্ট-ডিরেক্টর। শান্তিনিকেতনের
কলাভবন থেকে ছবি আঁকা
শিখেছে। ভাল রবীন্দ্রসঙ্গীতও
গায়। মেয়েদের কাছে সঙ্গত কারণেই ওর একটা
বিপজ্জনক আকর্ষণ আছে। তাপসের বউ শর্মিলা সেটা বোঝে এবং কিছু কিছু টের পায়।
যা টের পায় তার চেয়ে অনেক বেশি কল্পনা করে সবসময়েই প্রায় বিমর্ষ থাকে।
তাপসের উত্তপ্ত সঙ্গও ওকে উজ্জীবিত করতে পারে না। ফলে তাপসের মনেও মেঘের
আনাগোনা লেগেই থাকে।
বাচ্চাদুটো ছোটছুটি করতে করতে বেশ কিছুটা দূরে চলে গেছে। নীলেশ
দেখল এদের সঙ্গেই আসা একটা মেয়ে,
বেশ ছিমছাম এবং মোটামুটি সুন্দরী,
আপনমনে
একা একা ফার্মহাউসের এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। নীলেশ
ওকে চিনতে পারল না।
নামও জানে না। তবে মেয়েটির
সাজ-সজ্জায় কোনোরকম উগ্রতা নেই,
নেই অসহ্য
আধুনিকতা। নীলেশের বেশ ভাল লাগছিল মেয়েটিকে। দূর থেকে লক্ষ্য করছিল মাঝে
মাঝে। বাংলোর ঠিক সামনেই একটু বাঁ দিক ঘেঁষে দু'টো বড় বড় রঙীন ছাতার
নীচে বাঁশের তৈরি দুটো টেবিলের চারপাশে চারটে করে
বাঁশেরই তৈরি চেয়ার পাতা
আছে। আকর্ষণীয় ওদের গঠনশৈলী।
বৈদ্যনাথ বা বদু দু'পা দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে একটা
চেয়ারের ওপর নিজেকে প্রায় ভাসিয়ে দিল। বদুর রোগা রোগা দুটো পায়ের ছাড়ানো
ভঙ্গি তন্দ্রা বক্সির মোটেও ভাল লাগছিল না। একে তো বিদঘুটে পোষাক,
তার ওপর
ওই ভঙ্গি! বুড়ো ভামগুলো কেন যে ওই ঢোলা
হাফ-প্যান্টগুলো পরে কে জানে!
বিশ্রী লাগে দেখতে। চারপাশের
মনোরম দৃশ্যের মাঝখানে বদুকে একটা জংলী
কাঁটাঝোপের মতো অসহ্য লাগছিল তন্দ্রার। কিন্তু কিছু করার নেই।
একে একে
তাপস শর্মিলা তন্দ্রা অঞ্জনা
এবং নীলেশ চেয়ারে নিছকই আড্ডা মারার মেজাজে
বসল। বদু জুত করে দুটো পা টেবিলের ওপর তুলতে গিয়ে তন্দ্রার চোখের দিকে চোখ
পড়তেই সামলে নিল। এতটা বাড়াবাড়ি তন্দ্রার পক্ষে বোধহয় আজ সহ্য করা সম্ভব
হবে না। বদু অতঃপর তৃষ্ণার্ত ভঙ্গিতে নীলেশের দিকে তাকিয়ে বলল, নীলেশকে মনে মনে কামনা করে শর্মিলা। নীলেশের কথা-বার্তা, সৌন্দর্য্যবোধ, স্মার্টনেস এবং মেদহীন টানটান শরীর নিয়ে নিষিদ্ধ ভাবনায় ডুব দিতে ওর কোনো গ্লানিবোধ কেন হয় না তা বোঝে না। অঞ্জনাও তো তাপসের সঙ্গে.....একটু ঢোক গিললো শর্মিলা.....সত্যি কি কিছুই করে নি? নিশ্চয়ই কিছু গভীর গোপন ব্যাপার আছে। নীলেশ কি কিছুই জানে না, নাকি বোঝে না!
নীলেশ 'জল-টল'
এবং আনুষঙ্গিক সব কিছু নিয়ে এসে টেবিলে রাখলো। দু'টো
বড় বড় প্লেটে সত্যি সত্যি কুচো চিংড়ি এবং খাসির
চর্বির বড়া নিয়ে এল
অঞ্জনা। বদু পরিবেশনের দায়িত্ব
নিয়ে বোতল আর গ্লাসের ওপর ঝুঁকে পড়ল। তাপস
বলল,
২
নীলেশ গ্লাসে হাল্কা চুমুক
দিতে দিতে লক্ষ্য করছিল মেয়েটা পুকুরের ধারে চলে গেছে। পুকুরের জলে ফুটে
থাকা বড় বড় সাদা আর লাল শালুক দেখছে মুগ্ধ
চোখে।
বাংলাদেশ থেকে এই সব শালুকের বীজ আনিয়েছে নীলেশ। তাপস কিংবা
বদু কেউই মেয়েটার সঙ্গে পরিচয় করায় নি। তার
আগেই অবশ্য মেয়েটা পায়ে পায়ে বাগানের ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল। তাপস একটু
পরে ওদের পাশে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে এসে বসল। শর্মিলা শাড়ির
আঁচল ঠিক করার অজুহাতে তাপসের দিকে একটু বেশি রকম ঝুঁকে ওর শরীর থেকে উঠে
আসা একটা অচেনা গন্ধ পেল। সুযোগ পেয়ে নিশ্চয়ই
অঞ্জনাকে জাপটে ধরেছিল।
কিন্তু পুরুষগুলো এত বোকা হয়
কেন কে জানে! ওদের গায়ে অন্য মেয়ের গন্ধ যে
দীর্ঘক্ষণ লেগে থাকে তা টেরই পায় না। কিন্তু অঞ্জনার শরীরে তাপসের গন্ধ
পাবে না নীলেশ। ছেলেদের গায়ের গন্ধ শুধু বাতাসই কয়েকমুহূর্ত ধরে রাখতে
পারে,
মেয়েদের শরীর নয়।
শর্মিলার ইচ্ছে হচ্ছিল একটা বড় হাতুড়ি দিয়ে নীলেশের
মাথায় আঘাত হানতে। ওর পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁট দাঁতের ওপর শক্ত হয়ে চেপে
বসছিল। নীলেশের সঙ্গে আজ একটা বোঝাপড়া করতেই হবে। নীলেশ তাপসের দিকে তাকিয়ে
জানতে চাইল-- অঞ্জনা এল একটু পরে। নীলেশ আড়চোখে অঞ্জনাকে দু'এক মুহূর্ত লক্ষ্য করে বুঝল ইতিমধ্যে ওর শরীরে কিছু শারীরিক উপসর্গ দেখা দিয়ছিল যার আভাস নীলেশ দেখতে পাচ্ছে। এসব তো ওর খুবই চেনা। সব বুঝেও নীলেশ কি-ই বা করতে পারে? বাধা দেবার কিংবা মারামারি করার অবস্থানে ওরা কেউই নেই। যে যার অবস্থানে ইচ্ছে মতো বিচরণ করার স্বাধীনতার অধিকারী। বিশেষ করে শিক্ষিত স্বচ্ছল আধুনিক পরিবারে। তাপসকে অঞ্জনা ভালবাসে, নীলেশকে বাসে না। কিন্তু অপছন্দও করে না। কাউকে ভালবাসার অধিকারকে কেড়ে নেওয়ার সভ্য মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা কিংবা নিলেও তা সুখকর হয় কি না নীলেশের মতো মানুষের পক্ষে তা যাচাই করা সম্ভব নয়।
শর্মিলার দিকে চোখ পড়তেই ভেতরে
ভেতরে একটু চমকে উঠল নীলেশ। শর্মিলা অপলকে ওর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল নীলেশ। বলল,
আসলে পুকুরের ধারে ইতস্ততঃ ঘুরতে থাকা মেয়েটার প্রতি একটা আকর্ষণ অনুভব
করছিল নীলেশ। মনে হচ্ছিল ওর সঙ্গে দুটো কথা বললে ভাল
লাগবে। মেয়েটা ওদের
সঙ্গে চেয়ারে এসে বসে নি। ওদের
সঙ্গে গাল-গল্পে অংশ নেয় নি। কেন?
এই
প্রশ্নের উত্তরটা পাওয়া দরকার। নীলেশ মেয়েটির ঠিক পেছন থেকে বলে উঠল,
চুমুক দিয়ে
ডাবের জল খেতে গিয়ে জয়ন্তীর
বুকের কাপড় একটু ভিজে গেল। এভাবে ডাব খাওয়ার
অভ্যেস নেই ওর। ডাবে চুমুক দিতে দিতেই ওরা পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল গোলাপ
বাগানের দিকে। কাছাকাছি এসে মুগ্ধ হয়ে গেল জয়ন্তী। লাল হলুদ সাদা কালচে-লাল
ছাড়াও আরো কত রঙের গোলাপ! এতরকমের গোলাপ একসঙ্গে
জয়ন্তী কখনো চোখে দেখে
নি। নীলেশ জিজ্ঞেস করল,
জয়ন্তীর পিছু পিছু নীলেশ জটলার
মাঝখানে এসে গেল। জয়ন্তীকে দেখামাত্র শর্মিলা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল,
নীলেশের সামনে এসে দাঁড়াল
অঞ্জনা-- |
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট