এগারোই সেপ্টেম্বর

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।

..................... [১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পরদিন এক সিটিংয়ে আমি এ গল্প লিখে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম 'বর্তমান' কাগজে। ভেবেছিলাম মাসখানেক পরে গল্পটা ছাপা হতে পারে। কারণ দু-তিন সপ্তাহের রবিবাসরীয় পাতার ম্যাটার এবং লেআউট তৈরি থাকে। কিন্তু আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করে ৯ দিন পরেই রবিবারের পাতায় গল্পটি ছাপা হয়ে গেল! স্বয়ং সম্পাদকের ফোন সহ অনেকের ফোন পেয়েছিলাম এ গল্পের জন্য। এ গল্পের অনেকটাই চুরি করে একটি টেলিফিল্মও তৈরি হয়েছিল। বিভিন্ন ছোট কাগজে গল্পটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। -- বিশ্বদেব]



গাছগাছালির মাথা ছাড়িয়ে সকালের সূর্য উঁকি দিতেই আরামদায়ক উষ্ণতার ছোঁয়া লাগে বলে পূবের ব্যালকনিতে এসে বসেন আদিনাথ। সকালের প্রথম রোদ শরীরে ছোঁয়া দিলে কেমন যেন একটা দিব্য প্রেরণা অনুভব করেন। মনে হয় আজকের সারাটা দিন বেশ নিরুদ্বেগে ভালই কেটে যাবে। যেদিন আকাশ মেঘলা থাকে, সকালে সূর্যের মুখ দেখা যায় না, সেদিন সকাল থেকে মনটাও মেঘলা হয়ে থাকে। আজ অবশ্য আকাশ পরিষ্কার। লালচে-সোনালী রোদের মোলায়েম উষ্ণতা পাঁচ-দশ মিনিট ভালই লাগবে। খবরের কাগজ হাতে আদিনাথ চেয়ারে বসলেন নিশ্চিন্ত হয়ে।....কাগজে এখন মন দিয়ে পড়ার মতো খবর প্রায় থাকেই না। বিবমিষা জাগাবার মতো কিছু ভয়ঙ্কর খুন জখম ধর্ষণ অপরহণ আর ন্যক্কারজনক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির বর্ণনা ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু পড়ার থাকে না। তবু কাগজ পড়তে হয়। সময় কাটাবার জন্য পড়েন প্রায় সবকিছুই কিন্তু মনের মধ্যে প্রায় কিছুই থাকে না।

কাগজের পাতায় চোখ রেখে আদিনাথ অপেক্ষা করছিলেন অপর্ণার। সকালের চা নিয়ে আজ কয়েকদিন অপর্ণার আসতে দেরি হচ্ছে। ওর হাতে এখন সময় খুব কম। বড় বড় তিনটে ভিআইপি স্যুটকেশ, গোটা চারেক ঢাউস ব্যাগ গোছাতে ওর নাজেহাল অবস্থা।
--লোকে শীতের রোদ-ই গায়ে মাখে। কিন্তু এই ভাদুরে রোদে পিঠ দিয়ে তুমি যে কী আরাম পাও কে জানে!
চোখের সামনে থেকে কাগজ সরিয়ে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে হাসলেন আদিনাথ--
--তোমার গোছগাছ কতদূর?
--প্রায় হয়ে এসেছে।

একটা থামের ছায়ায় মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলেন অপর্ণা। বছরখানেক হলো তিনিও রিটায়ার করেছেন। বছর পাঁচেক আগে আদিনাথ। আদিনাথ ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অপর্ণা রিটায়ার করেছেন হেডমিস্ট্রেস হয়ে। তারও অনেক অগে অবশ্য অপর্ণা ছিলেন সামান্য কিছুদিনের জন্যে আদিনাথের ছাত্রী। এই তো সেদিনের কথা। অথচ ভাবতে গেলে মনে হয় এতকাল সত্যি সত্যি পেরিয়ে গেল!
--তুমি শুধু শুধু একগাদা আচার-বড়ি-মিষ্টি-মেঠাই বানাচ্ছ অপর্ণা। কে খাবে ওসব?
--আর কেউ না খাক আদিত্য খাবেই। ও এসব বড্ড ভালবাসে।
--ভালবাসতো। এখন আর বাসে না। এসব তারিয়ে তারিয়ে খাবার সময় কোথায় ওদের?
--কী যে বল তার ঠিক নেই! ওরা কি অনাহারে থাকে নাকি? ঠিক খাবার সময় পাবে।
অপর্ণার আত্মবিশ্বাসকে অক্ষত রেখেই আদিনাথ বললেন--
--আমরা কি ওখানে শেষপর্যন্ত থেকে যেতে পারব?
--কেন পারব না! ওখানেই তো ছেলে-বউ-নাতি-নাতনি সবাই রয়েছে।
--হ্যাঁ, তা রয়েছে বটে। তবে তোমার ছেলের বউ খাঁটি আমেরিকান। নাতি-নাতনির সোনালী চুল, নীল চোখ। বাংলা বোঝে না, জানে না। ওদের নামগুলোও খাঁটি আমেরিকান!
--ওরা ওদের মায়ের চেহারা পেয়েছে।
--কেন পেল? ওরা তো অন্তত আদিত্য'র মতো হতে পারত!
--এখন আর ওসব ভেবে কি হবে বলো!
--এখন একটু ভাবতেই হচ্ছে অপর্ণা। ওখানে গিয়ে ওদের মতো হয়ে ওঠা কি সম্ভব হবে? নাতি নাতনিদের আমেরিকান ইংলিশে গল্প শোনাতে পারবে? কিংবা ধরো ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে ওদের নিয়ে আউটিংয়ে যেতে পারবে? কিংবা ধরো--
--আহ্! তুমি আমায় ভয় পাইয়ে দিচ্ছ কেন বলো তো? তুমি তো আছ নাকি?
আদিনাথ অপর্ণার হাঁসফাঁস অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন। যদিও বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে জমে ওঠা মেঘ একটুও হাল্কা হলো না।


আদিত্য আমেরিকায় গিয়ে স্রেফ 'অ্যাডি' হয়ে গেছে। ওখানে মুখোপাধ্যায় তো কেউ উচ্চারণই করতে পারে না। এমন কী ওর পরিচিতরাও মুখার্জ্জী উচ্চারণে সময়ের অপচয় করে না।...,আদিত্য বরাবরই মেধাবী ছাত্র ছিল। মাধ্যমিকে সেকেণ্ড। উচ্চমাধ্যমিকে ফোর্থ। ফলে এম-টেক করার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় চাকরির অফার এল। আদিনাথ অপর্ণা কেউ-ই চাননি আদিত্য দেশ ছেড়ে ঘর ছেড়ে আমেরিকা যাক। কিন্তু আদিত্য'র চোখে তখন হাইটেক্ দুনিয়ার স্বপ্ন। ওকে আটকে রাখা গেল না।

গত পনেরো বছরে মধ্যে আদিত্য মাত্র তিনবার কলকাতায় এসেছে। একবারও দিস সাতেকের বেশি থাকেনি। এখানে বিয়ের কথা বললে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। অথচ হঠাত্ই একদিন মাঝ-রাতে ফোন করে জানিয়ে দিল ওর আমেরিকান কলিগ ম্যারেল-কে বিয়ে করেছে। বিয়েটা যেন কোনো ব্যাপারই নয়। একমাত্র সন্তানের বিয়েতে মা-বাপের কোনো ভূমিকাই থাকল না!

প্রথমে ছেলে, পরে মেয়ের জন্মের খবরও এসেছে ফোনে। তারপর প্রায় প্রতিমাসে এসেছে গোছা গোছা রঙিন ছবি। ছবির পেছনে আদিত্য লিখে দিয়েছে--এটা ম্যানহাটেনের ফ্ল্যাট। ওটা হোয়াইট হাউস। এটা পেন্টাগন, লাসভেগাস, মিয়ামি বিচ, ডিজনিল্যাণ্ড, হলিউড....আরো কত কি! অপর্ণা মুগ্ধ হয়ে যেতেন।
একবার আদিত্য সপরিবারে মিয়ামি গিয়েছিল ছুটি কাটাতে। নীল সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউয়ের সামনে আদিত্য আর ম্যারেল ছেলেমেয়েদের ঘিরে নাচানাচি করছে--এমন কিছু ছবি পাঠিয়েছিল। ম্যারেলের সমুদ্র-পোশাক দেখে আদিনাথের সামনে লাল হয়ে গিয়েছিলেন অপর্ণা। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সেসব চোখে সয়ে গেছে। তবু যখনই এয়ারমেলে ছবির মোটা খাম আসে অপর্ণা অনেকটা সেন্সর করার মতো সন্তর্পণে ম্যারেলের তেমন কোনো ছবি থাকলে সরিয়ে রাখতেন। যে দেশের যা রীতি বলে মেনে নেওয়া ছাড়া তো উপায়ও কিছু ছিল না। আদিত্য যে তাঁদের একমাত্র স্বপ্নের সন্তান।....যখনই বুকের ভেতরটা গ্রীস্মের ফাঁকা মাঠেন মতো হু হু করে ওঠে, অপর্ণা তখন আদিত্য আর তার পরিবারের ছবিগুলো চোখের সামনে মেলে ধরে পেছনের দিনগুলোতে ফিরে যেতেন।

আদিত্য'র শৈশবে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই বেরিয়ে যেতেন। বিশ্বস্ত 'কাজের মাসি'র কাছেই বলতে গেলে আদিত্য মানুষ হয়েছে। সারাদিন স্কুল আর গৃহশিক্ষকের কাছেই ওর অনেকটা সময় কেটে যেত। মাঝে মাঝে হঠাত্ কখনো বিকেলে জানলার শিক ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যেত ওকে। দূর থেকে অপর্ণাকে দেখামাত্র আদিত্য'র চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠত। অপর্ণারও বুকের মধ্যে অথৈ কান্নার সমুদ্র উথলে উঠত। আদিত্য'র সেই প্রায় নি:সঙ্গ শৈশবের টুকরো টুকরো ছবিগুলো আজও অপর্ণার দু'চোখে মেঘ টেনে আনে। আদিনাথ অপর্ণার বেদনায় প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টায় বলতেন,
--শৈশবে ওকে আমরা নি:সঙ্গতা দিয়েছি। আদিত্য এখন তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে
অপর্ণা। আমরা দু'জন হয়েও আদিত্য'র অভাবে এখন কত নিঃসঙ্গ দ্যাখো!

তিল তিল করে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সল্টলেকের এই বাড়িতে আদিত্য'র জন্যে সাজানো তিনটে ঘর আছে। কোনো কাজেই লাগছে না। ঐ তিনটে ঘরের বিকট শূন্যতা ছড়িয়ে আছে গোটা বাড়িতে। কোনো হৈ-চৈ নেই। কোনো ব্যস্ততা নেই। কোনো উত্সব নেই। শুধু অবসরপ্রাপ্ত দু'জন নারী-পুরুষের মাঝে মাঝেই স্মৃতিচারণার মধ্যে ফিরে যাওয়া আর আসা ছাড়া আর কিছুই নেই।

ইতিমধ্যে আদিনাথের দুবার স্ট্রোক হয়ে গেছে। দু'বারই আদিত্য ভীষণ দুঃখ এবং উদ্বেগ প্রকাশ করে একগাদা ডলার পাঠিয়ে বলেছে, কিছুতেই আসতে পারছে না!...আদিনাথ অবশ্য ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বুঝেছেন আদিত্য এখন আর আবেগসর্বস্ব ভাবপ্রবণ ভারতীয় নয়। প্রতিটি সেকেণ্ড সে মাপতে শিখেছে ডলারের মাপে। আমেরিকান বিয়ে করে সে দেশে থাকতে থাকতে ইণ্ডিয়াকে যাতে ভুলে না যায় তার জন্যে ইণ্ডিয়ার একটা ম্যাপ ক্যালেণ্ডার করে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেদিকে হঠাত্ চোখে পড়ে গেলে তার মনে পড়ে যায় ক্যালকাটার সল্টলেকের বাড়িতে তার বাবা আর মা বসবাস করেন। মধ্য দুপুরেই অফিস থেকে সে যখন ফোন করে সল্টলেকের রাত দশটায় বিনিদ্র আদিনাথ আর অপর্ণার চোখ ছেড়ে ঘুম পালিয়ে যায় সারা রাতের মতো।

দুবার স্ট্রোক হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি দিন কাঁটা হয়ে থাকেন অপর্ণা আদিনাথের জন্য। ইতিমধ্যেই আদিনাথকে লুকিয়ে আদিত্যকে কাতর অনুনয় করেছেন কলকাতায় ফিরে আসার জন্যে। আদিত্য স্পষ্ট জানিয়েছে সেটা আর কোনোমতেই সম্ভব নয়। বরং ওঁরাই আমেরিকায় পাকাপাকিভাবে থাকার জন্যে চলে আসুন। কলকাতায় আছেটা-ই বা কি? নিজের বলতে তো সবই আমেরিকায়!



অপর্ণা ভেবেছেন। ভেবে ভেবে সিদ্ধান্তে এসেছেন আদিনাথের জন্যেই আদিত্য'র কাছে যেতে হবে। আদিনাথ শেষ সময়ে ছেলেকে পাশে পাবেন না এটা ভাবতেই পারেন না অপর্ণা। একমাত্র সন্তান বাপের পারলৌকিক কাজকর্ম করবে না এটা কী করে সম্ভব! অপর্ণার গোপন উদ্বেগ অনুমান করে আদিনাথ হো-হো করে হেসেছেন--
--আমেরিকায় মুখে আগুন-ফাগুনের আইন নেই। ওসব ক্রিয়াকর্ম ওখানে কেউ করবে না অপর্ণা।
নির্মম সত্য উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে আমূল কেঁপে উঠলেও অপর্ণা তর্ক জুড়েছেন--
--এত ভারতীয় আছে ওখানে সবাই কি ধর্মকর্ম লাটে তুলে দিয়েছে? সবকিছুই হয়। কথাটা তা নয়। আসলে ওদের ছেড়ে এতদূরে এভাবে থাকবেই বা কেন? আমাদেরও তো বয়স হচ্ছে। আর যদি শেষপর্যন্ত থাকতে ভাল না লাগে তখন না হয় ফিরেই আসা যাবে।

যতরকমের নেগেটিভ দিক আছে আদিনাথ ব্যাখ্যা করলেন। তবু অপর্ণাকে নিরস্ত করা গেল না। অপর্ণার বুকের মধ্যে একটা তীব্র আতঙ্ক চেপে বসেছে। হঠাত্ যদি আদিনাথ তাঁকে ছেড়ে চলে যান--কী করবেন তিনি? কেমন করে নিজেকে সামলাবেন? অপর্ণা এসব ভাবতেই চান না। শেষপর্যন্ত অবশ্য রাজি হয়ে যান আদিনাথ। তবু আজ আরো একবার বললেন,
--আর একবার ভেবে দ্যাখো অপর্ণা। এই বয়সে ওখানে গিয়ে আমরা ভীষণ অসহায় হয়ে পড়ব না তো?
--চিরকাল থাকতেই হবে এটা এখনই ভাবছ কেন? মনে কর দু'চার মাসের জন্যে বেড়াতে যাচ্ছি--
--মনটাকে এইভাবেই প্রস্তুত করে নাও। ওদের জীবনযাপনের সঙ্গে আমাদের খাপ খেতে পারে না। আমাদের ফিরে আসতেই হবে অপর্ণা!
--ঠিক আছে । তেমন হলে না হয় ফিরেই আসব।
--তুমি আদিত্য আর তার ছেলেমেয়েদের জন্যে খুব কাতর হয়ে পড়েছ--
--হয়তো তাই। এই বাড়িতে আর দু'জনে একা একা সত্যি ভাল লাগছে না!

অপর্ণার দিকে তাকিয়ে আবার হেসে ফেললেন আদিনাথ। 'দু'জনে একা একা' কথাটা যতটা মজার ঠিক ততটাই গভীর অর্থবহ। কথাটা হয়তো অপর্ণা ইচ্ছে করেই ব্যবহার করেছে। দীর্ঘ এই পঁয়ত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে দু'জনের মাঝখানে কোথাও এতটুকু আড়াল নেই। গোপনতাও নেই। সুখ-দুঃখে একে অপরের অভাব দুঃস্বপ্নেও কখনো কল্পনা করেননি। মানসিক যেকোনো বিপন্নতায় তো বটেই সামান্য শারীরিক অসুস্থতায়ও পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ কামনা করেছেন তীব্রভাবে। এখনো ওঁদের বাঁধা ছকে নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মধ্যেও সম্পর্কের এই ছন্দ এতটুকু নষ্ট হয়নি। তবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে অপর্ণাকে বলতে হচ্ছে 'দু'জনে একা একা'! আদিত্য কি তার মায়ের এই দীর্ঘশ্বাস কখনো টের পেয়েছে?
--কলকাতায় তাহলে আর ছত্রিশ ঘন্টা!

প্রায় স্বগতোক্তির মতো শোনালো আদিনাথের কথাটা। অপর্ণা ভেতরে ভেতরে আদিনাথের শেকড় ছেঁড়ার যন্ত্রণাটা অনুভব করছিলেন। তবু এছাড়া আর অন্য কোনো উপায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। চায়ের কাপ তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন অপর্ণা। আদিনাথের মাথায় ডান হাতটা বুলিয়ে দিয়ে বললেন--
--মাথা তেতে উঠেছে। আর এই রোদে থেকো না। বাইরে যদি কোনো কাজ থাকে সেরে এসো।
--হ্যাঁ, টুকটাক দু'একটা কাজ আছে। তোমার ভাইকে ফোন করেছ? ঘরের চাবি-টাবি তো বুঝিয়ে দিতে হবে?
--ওরা ঠিক সময়েই আসবে। কথা হয়ে গেছে--
--বেশ। আমি তাহলে ঘুরেই আসি।

বিকেলের দিকে বেশ কয়েকজন পরিচিত বন্ধু-বান্ধবকে ফোন করলেন আদিনাথ। এদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যোগাযোগই ছিল না। তাঁরা অবাক হলেন। সকলের সঙ্গে কথাবার্তায় স্মৃতিচারণই মুখ্য বিষয় ছিল। সকলের কাছেই আদিনাথ বিদায় নিলেন। কেউ কেউ বিস্মিত হলেন। কেউ কেউ আদিনাথের সৌভাগ্যে ঈর্ষান্বিত হলেন। আদিনাথের অবসর জীবনের দিনগুলো কাটবে আমেরিকায়! এমনটা ক'জনের ভাগ্যে ঘটে?

ফোন করতে করতেই প্রায় সাতটা বেজে গেল। অপর্ণা গোটা কয়েক বিস্কুট আর চা নিয়ে এসে আদিনাথের পাশের সোফায় বসলেন। অপর্ণা রিমোটের স্যুইচ অন করে টিভি খুলে দিলেন।
এখন সংবাদ হবে।
কিন্তু এ কী!
সংবাদের জায়গায় হলিউডের অ্যাকশন ছবি কেন? নড়েচড়ে বসলেন আদিনাথ। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠতেই আমূল ঝাঁকুনি খেলেন বারকয়েক। অপর্ণাও ততক্ষণে পাথর হয়ে গেছেন।
সিএনএন-এর সৌজন্যে দুনিয়ার মানুষ অপ্রত্যাশিত রোমহর্ষক দৃশ্য দেখছে ভয়ঙ্কর বিস্ময়ে। দুটো যাত্রীবাহী বিমান মিসাইলের মতো তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে আছড়ে পড়ল বিশ্ব-বাণিজ্য কেন্দ্রের আকাশ-ছোঁয়া সৌধের বুকের ওপর। তাসের ঘরের মতো চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেল আমেরিকার গগনস্পর্শী অহঙ্কার। সর্বগ্রাসী কালো ধোঁয়া আর বিকট আগুনের কুণ্ডলী গোটা নিউইয়র্ক শহরটাকে প্রায় ঢেকে দিল।

থরথর করে কাঁপছেন আদিনাথ। ট্রেড-সেন্টারেই আদিত্যর অফিস। স্পষ্ট করে কথা বেরুচ্ছে না। হাতের ইশারায় ফোনটাকে চাইছেন। অপর্ণারও উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। প্রায় শুয়ে পড়ে কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে ফোনটাকে কোলের ওপর টেনে নিলেন অপর্ণা। বার বার ডিজিট ভুল হয়ে যাচ্ছে। নিজের ওপর বিরক্ত হতে হতে সশব্দে কেঁদে উঠলেন। আদিনাথেরও হাত কাঁপছে। তবু কোনোরকমে নম্বর টিপে টিপে কানের সঙ্গে ফোনটা চেপে ধরলেন। এনগেজ টোন। বার বার। সময়টা যেন অন্তহীন সমুদ্রে তলিয়ে যাচ্ছে। টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবি দেখানো হচ্ছে বারবার। পেন্টাগনও জ্বলছে। হলিউডের কোনো বিখ্যাত ছবিতেও এত জীবন্ত ভয়াবহ অ্যাকশন আদিনাথ দেখননি। এমনটা যদি খোদ আমেরিকার বুকের ওপর ঘটতে পারে তাহলে এর পরে এর চেয়েও ভয়াবহ কিছু ঘটবে না কেন? এই মারাত্মক আশঙ্কা আদিনাথের বুকের ওপর দশমণ পাথরের মতো চেপে বসে যাচ্ছে।
--কি হলো? ওদের ফোনটাও কি গ্যাছে?
অপর্ণা ভয়ানক অস্থির হয়ে উঠছেন ক্রমশ:ই--
--হ্যাঁ-হ্যাঁ, এখন রিং হচ্ছে! কিন্তু ওরা কেউ বাড়িতে নেই মনে হচ্ছে--
--সে কী! বাড়িতে কেউ নেই?
নেতিবাচক মাথা নাড়লেন আদিনাথ। ধ্বংসস্তুপের নীচের হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানারকম মতামত জানানো হচ্ছে।

শেষপর্যন্ত রাত চারটে নাগাদ আদিত্যকে পেলেন আদিনাথ। আদিত্য জানালো ট্রেড-সেন্টারে ঢোকার এক মিনিট আগেই বিস্ফোরণ ঘটায় ওরা বেঁচে গেছে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবার পথেই ঘটনাটা চোখের সামনে ঘটতে দেখেছে। তারপর স্কুলেই ছিল নিরাপদে। সকলেই ঠিক আছে।
--নো প্রবলেম ড্যাড! কিছু ডাস্ট আর স্মোকের জন্যে সামান্য প্রবলেম হচ্ছে।
আদিনাথ অনেক কষ্টে বললেন--
--তোরা এখানে চলে আয় আদিত্য। এখানেও তো অনেক কৃতী মেধাবী ছাত্র বেশ ভালই আছে--
--ডোন্ট ওয়্যারি ড্যাড! ইটস্ আ পার্ট অফ লাইফ! যেকোনো জায়গায়ই এরকম হতে পারে। পিপল্ আর সো পাওয়ারফুল নাউ---কোথা থেকে কোথায় পালাবে তুমি?
--আমেরিকা আর কোনো মতেই নিরাপদ নয় আদিত্য। বোঝার চেষ্টা কর। এই বয়সে তোর জন্যে আর কত টেনশন সহ্য করব বাবা--প্লিজ চলে আয় আদিত্য।
--তুমি সেন্টিমেন্টাল হচ্ছ ড্যাড। সব ঠিক হয়ে যাবে। টিভিতে দেখছ না কীভাবে ওরা সবকিছু নর্ম্যাল করতে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
--তুই তোর নিজের সন্তানদের কথাও ভাববি না?
--ওদের কথা ভাবছি বলেই তো ইণ্ডিয়ায় ফেরার কথা ভাবতে পারছি না। তুমি আননেসেসারি ভয় পাচ্ছ। ছেলেমেয়েরা অনেকগুলো ক্যাণ্ডেল কিনে এনেছে। কাল বাড়ির লনে জ্বালিয়ে প্রে করবে। ফ্ল্যাগ হাফমাষ্ট করবে। ক্যাণ্ডেল জ্বালিয়ে মিসিংদের জন্যে 'মোর্ন'ও করবে। তুমি ভাবতে পারবে না ওরা এখন কত বিজি। আমেরিকাই ওদের স্বদেশ!
--কিন্তু আদিত্য--
--প্লেন চলাচল শুরু হলেই তোমরা চলে এসো--

আদিত্য'র কথা শুনতে শুনতে ভয়ঙ্করভাবে ঘামছিলেন আদিনাথ। বাতাসের প্রচণ্ড অভাবে তাঁর বুক শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তাঁর হাত থেকে টেলিফোন খসে পড়তেই অপর্ণা দু'হাতে আদিনাথকে ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে চিত্কার করছেন--
--কী হলো তোমার? এমন করছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?
দিশেহারা অপর্ণা আদিনাথের মাথাটা সোফায় হেলিয়ে দিয়ে দৌড়ে একগ্লাস জল নিয়ে এসে আদিনাথের মুখের কাছে ধরলেন--
--এই নাও একটু জল খাও--
আদিনাথ তাকালেন অপর্ণার দিকে। ঠোঁটদুটো কাঁপছে থরথর করে। কিছু বলার চেষ্টা করছেন। একটা অস্পষ্ট গোঙানি ছাড়া কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। টিভিতে তখনো বারবার গগনচুম্বী সৌধ দুটি ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখাচ্ছে। মিসাইলের মতো যাত্রীবাহী বিমানের ছুটে আসা, আঘাত হানা এবং তারপরেই ভেঙে পড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতেই আদিনাথের মাথাটা দু'হাতে নিজের বুকের ওপর চেপে ধরলেন অপর্ণা। আদিনাথ তাঁর বুকের মধ্যেই ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছেন ধীরে ধীরে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অপর্ণা টের পেলেন মায়া-মমতা-স্নেহ-বাত্সল্য-প্রেম এবং আবেগে মাখামাখি এক প্রজন্মের হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল তাঁর দু'হাতের বেষ্টনীর মধ্যেই!

***

গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট

 সূচীপত্র