নিঝুমবাস
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
.................................................. |
টিভিটা চলছিল। টিভির পর্দাতেই চোখ ছিল সুখময়ের। কিন্তু তাঁর মনটা সেখানে ছিল না। তিন কামরার সুদৃশ্য এই ফ্ল্যাটের বাসিন্দা বলতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী কাবেরী। সময় কাটানোর জন্য টিভির সামনে বসেন সুখময়। কোনও চ্যানেলেই বেশিক্ষণ থাকেন না। ঘুরতে থাকেন চ্যানেলের পর চ্যানেলে। ভারত বহুভাষীর দেশ বটে, তবু ভারতে এত রকম ভাষায় লোকে কথা বলে, গান গায়, সিনেমা-নাটক করে, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক করে--এটা ভাবতে গেলে সুখময় বেশ আশ্চর্য্য বোধ করেন। এখনও তিনি বাংলা, হিন্দি,ইংরেজি ছাড়া আর কোনও ভাষা স্বচ্ছন্দে পড়তে বা লিখতে পারেন না। অসমীয়া-ওড়িয়া কান পেতে শুনলে অবশ্য মোটামৃটি বুঝতে পারেন। অসমীয়া স্ক্রিপ্ট বুঝতে পারলেও ওড়িয়া বা অন্য কোনও ভারতীয় অক্ষর বুঝতে পারেন না। তবু কন্নড়,তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, গুজরাতি, পাঞ্জাবি ভাষার চ্যানেলও তিনি দেখেন। কাবেরী ভীষণ বিরক্ত হন। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষার সিনেমা সিরিয়াল দেখতে বসলে তাঁর মেজাজ বিগড়ে যায়। যে সব ঘটনা চোখের সামনে পর্দায় ফুটে উঠছে তার অর্থ পরিষ্কার বুঝতে না পারলে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। সুখময় কাবেরীর অস্থিরতা যে বোঝেন না তা নয়, বুঝেও তিনি ক্ষণে ক্ষণে চ্যানেল পাল্টে দেন। কাবেরী উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সুখময়ের সঙ্গে ঝগড়া করেন। সুখময় প্রতিদিনই চান কাবেরী তাঁর সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উচ্চকণ্ঠে ঝগড়া করুন। ঝগড়ার সময়টুকুতে অন্ততঃ তাঁদের এই সুদৃশ্য তিন কামরার দামি ফ্ল্যাটটা প্রাণ ফিরে পায়। যেন ঘুম থেকে জেগে ওঠে। অবশ্য আজ ঠিক এই মুহূর্তে সুখময়ের মাথায় টিভি চ্যানেল চেঞ্জ করার বিষয়টি নেই। তিনি মনে করার চেষ্টা করছিলেন, শেষ কবে তাঁর ফ্ল্যাটের কলিংবেল বেজেছিল। হাজার চেষ্টা করেও মনে করতে পারলেন না। সকালে দুধওয়ালা আর কাগজওয়ালা দরজার বাইরে রাখা বক্সের মধ্যে দুধের প্যাকেট আর কাগজ রেখে যায়। কাজের মেয়ে ফ্ল্যাটে আসার ঠিক দু’মিনিট আগে কাবেরীর মোবাইলে মিসড্ কল করে। কাবেরী দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে কাজের মেয়ে মালতীর জন্য। মালতী ঝড়ের বেগে ফ্ল্যাটে ঢোকে। মিনিট কুড়ির মধ্যে সামান্য দু’চার পিস বাসন ধুয়েমেজে ঘর ঝাঁট দিয়ে চলে যায়। সপ্তাহে তিন দিনের বেশি মালতী তাঁদের এক হাজার দু‘শো বর্গ ফুটের মার্বেল মেঝে মুছবে না--এই শর্তেই কাজ করছে। আজ ঘর মোছার দিন ছিল না। থাকলে আরও মিনিট পনের এই ফ্ল্যাটটা মালতীর বিদ্যুৎগতিতে শিহরিত থাকতো। সুখময় ভাবছিলেন, এক সময় তিনি কোলাহল হৈ-চৈ একদম বরদাস্ত করতে পারতেন না। বিরক্ত হতেন। ছেলেমেয়েদের বকাঝকা করতেন। অথচ সেই তিনিই আজ এই ফ্ল্যাটের নৈঃশব্দ্য বরদাস্ত করতে পারছেন না। কাবেরী ইদানীং কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসে অবশ্য সুখময়ের ছেলেমানুষীতে বিরক্ত হন, গজগজ করেন। আজ তিনিও টিভিতে মনোযোগী নন। সুখময় এবং কাবেরী তাঁদের সারা জীবনের পুঁজির একটা বৃহদাংশ খরচ করে, ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে যখন এই ফ্ল্যাট কেনেন তখন ছেলে বিকাশ ক্লাস নাইনের ছাত্র। মেয়ে তিতাস ক্লাস এইটে পড়ে। নতুন গড়ে ওঠা বারো তলার এই ফ্ল্যাটবাড়ি তখন কলকল্লোলে পরিপূর্ণ। প্রতিটি ফ্ল্যাটে তিন থেকে পাঁচ জনের পরিবার। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আবাসনের গেটের সামনে থেকে স্কুলবাসে চেপে নিজের নিজের স্কুলে যাচ্ছে আসছে। আবাসনের বাসিন্দাদের মধ্যে সিংহভাগই চাকুরিজীবি। কাবেরীও একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। বারো তলার ফ্ল্যাটবাড়ির প্রতিটি ফ্লোরেই তখন অগুন্তি পায়ের শব্দ, হাসির শব্দ, হাঁকহাঁকি ডাকাডাকির শব্দ। এখন সে সব শব্দ নেই। আবাসনের অঙ্গনে এখন শীতকালে বাচ্চারা ক্রিকেট খেলে না। বড়রা ভলি কিংবা ব্যাডমিন্টন খেলে না। ছোটরা সবাই বড় হয়ে গেছে। দেশ বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। অধিকাংশেরই আর মা-বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। বড়রাও দেখতে দেখতে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে ভুগতে জলের দামে ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে কোথায় কে জানে চলে গেছে। কয়েকজন নতুন বাসিন্দা এলেও ফ্ল্যাটে প্রথম পা রাখার সময়ের সেই উষ্ণতা সেই উত্তেজনা অনুভব করে না। এখানে সকলেই এখন সম্পর্কহীনতায় ভুগছে। সুখময়ের সঙ্গে যাদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল তাদের সঙ্গেও দেখা বা কথা হয় খুব কম। সকলেই একাকিত্বের প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সুখময় ফ্ল্যাট কেনার পর সর্বস্ব পণ করে ছেলেমেয়ে দুটিকে মানুষ করেছেন। কোনও ত্রুটি রাখেন নি। ছেলে এখন কানাডায় প্রতিষ্ঠিত। বিয়ে করেছে এক বিদেশিনীকে। সুখময়-কাবেরী সেই বিয়েতে হাজির থাকতে পারেন নি। সুখময় ছেলের ব্যাপারে উদাসীন হতে পারলেও কাবেরী এখনও বিশ্বাস করেন, ছেলে একদিন তার পরিবার নিয়ে দেশেই ফিরবে। গত তিরিশ বছরের মধ্যে এ দেশের সন্তান ও বাপ-মায়ের মধ্যবর্তী সম্পর্কের সমীকরণ যে কী ভয়ানক ভাবে বদলে গেছে তা ভাবতে বসলে সুখময় দিশেহারা হয়ে ওঠেন। তাঁর নিজের শৈশবজীবনের সঙ্গে তাঁর সন্তান-সন্ততির শৈশবজীবনের আকাশ-পাতাল পার্থক্যটা তিনি এখন অনুভব করতে পারেন। তাঁদের শৈশবে কোনওরকম নিঃসঙ্গতা বা একাকিত্ব ছিল না। স্কুল আর পড়াশোনার ফাঁকফোকরে অফুরন্ত অবকাশ ছিল। মাথার ওপর ছিল অনন্ত অনাদি আকাশ। জলখেলার জন্য নদী কিংবা দৌড়ঝাঁপ করার জন্য ছিল একটা গোটা গ্রাম, অজস্র সবুজ বৃক্ষ ও বনস্পতি। তাঁর সন্তানদের জন্য এসব কিছুই ছিল না। ফ্ল্যাটের চারদেওয়ালের মধ্যে তারা তাদের একটা নিজস্ব ছোট্ট ভুবন গড়ে নিয়েছিল। কোলাহলমুখর একটা পারিবারিক আবহাওয়া বঞ্চিত তাঁর সন্তানেরা সম্পর্কের মূল্য অনুভব করার সুযোগ পায় নি। পড়াশোনা এবং অন্যান্য বহুবিধ গুণের আধার হয়ে ওঠার লড়াইয়ের মাঝখানে তাদের কোনও অবকাশও তেমন ছিল না। আবেগ এবং সংবেদনশীলতার কোনও স্বাভাবিক শিক্ষায় তাদের শিক্ষিত করে তোলা যায়নি। উদারতা, সমঝোতা কিংবা স্বার্থত্যাগের প্রয়োজনীয়তা বোঝার মতো পরিবারে ওরা বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়নি ফলে পরিবার বিচ্ছিন্ন প্রতিষ্ঠিত জীবনে তারা ঠিক কেমন আছে, সুখময় জানেন না। ছেলেমেয়ের কাছে সুখময়-কাবেরীর কোনওরকম অর্থনৈতিক প্রত্যাশা নেই। একটাই প্রত্যাশা ছিল তাঁদের, সন্তানরা মাঝে মধ্যে সপরিবারে এসে তাঁদের গভীর নিঃসঙ্গ জীবন দুটিকে নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দুলিয়ে যাবে, দু’চারদিনের জন্য হলেও এই বারো’শো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটটাকে তোলপাড় করে দিয়ে যাবে। এ প্রত্যাশা মেটে নি। আর মিটবে বলেও ভাবেন না সুখময়-কাবেরী। জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়গুলো যে সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার লড়াইতেই চোখের পলকে অন্তর্হিত হয়ে গেল, সেই সন্তানরাই শেষপর্যন্ত এক অসহনীয় শূন্যতা তৈরি করে বহু দূরে নিজেদের স্বপ্নের দুনিয়ায় ভেসে গেল! তবে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সুখের ঠিকানায় যথার্থ পৌছুতে পেরেছে কিনা তা সুখময়ের জানা সম্ভব হয় নি। ইদানীং সুখময়-কাবেরী মাঝে মাঝেই খুব অসহায় বোধ করেন। বিশেষ করে দু’জনের একজন যখন শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন, তখন অন্যজনের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। একটা হিমশীতল আতঙ্ক বুকের মধ্যে চেপে বসে। যদি কিছু হয়ে যায়! কিছুই অসম্ভব নয়। প্রায় নিঃসঙ্গ অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ মানুষের হৃদযন্ত্রের ওপর সুখময় বা কাবেরী, কেউই বিশেষ ভরসা করেন না। একজন সরে গেলে দ্বিতীয়জনের জীবনে যে অন্ধকার নেমে আসবে তার ভয়াবহতাই আতঙ্কিত করে অপরাহ্নের আলো-ছায়া মাখা ও প্রগাঢ় নৈঃশব্দ্যে ডুবে থাকা ফ্ল্যাটের দম্পতিকে। মাঝে মাঝেই ছেলে বিকাশ কানাডা থেকে ই-মেইল পাঠায় সুখময়কে। ফ্ল্যাট বিক্রি করে তার কাছে মাকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্যে। জীবনের বাকি কয়েকটা দিনের জন্য দেশ ছেড়ে কোথাও নড়ার কথা ভাবতে চান না সুখময়। এ ব্যাপারে কাবেরীও তাঁর পাশে। দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। সোজাসুজি দরজার দিকে মুখ করেই বসেছিলেন সুখময়। একটু নড়েচড়ে বসলেন। ওরা কি এল? কিন্তু এখনও তো সময় হয় নি! আরও মিনিট চল্লিশ সময় লাগার কথা। ইতিমধ্যে কাবেরী দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়িয়েছেন। বহুদিন পরে সঙ্কুচিত এবং আরষ্ট ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকলেন সুজন মিত্র। তাঁর ফ্ল্যাট-পড়শি। একই দিনে ফ্ল্যাটের দরজার নতুন তালা খুলে ঘরে ঢুকেছিলেন তাঁরা। সুজন তখন মহাকরণেরি ইউডি-ক্লার্ক। ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে কিনা জানা নেই, সুজন বেশ স্বচ্ছল জীবনযাপন করতেন। মোটা টাকা চাঁদা দিয়ে আবাসনের দুর্গাপুজো কমিটির সেক্রেটারি হওয়ার ব্যাপারে তাঁর ছেলেমানুষী নিয়ে আড়ালে অনেক হাসাহাসি হলেও তাঁর মহাকরণীয় যোগাযোগের কারণে তাঁকে সেক্রেটারি পদে মেনে নেওয়ায় বিশেষ আপত্তি উঠত না। সুখময়ের বিবেচনায় সুজন মিত্র সুখী মানুষ ছিলেন। স্ত্রী এবং একটি বছর পাঁচেকের কন্যা নিয়ে এই আবাসনে সুজন এসেছিলেন। খুব দ্রুতই সুখময়ের সঙ্গে সুজনের সখ্য গড়ে উঠেছিল। সময় পেলেই সুজন চলে আসতেন সুখময়ের ফ্ল্যাটে। উদ্দেশ্য, জমিয়ে আড্ডা দেওয়া। এদিকে আড্ডা যত জমে উঠত, ওদিকে সুজন মিত্রের ফ্ল্যাটে ততটাই জমে উঠত কালো মেঘ। সুজনের স্ত্রী আরতির মনে হত, সুজন কাবেরীর টানেই যখন-তখন সুখময়ের ফ্ল্যাটে আড্ডার ছলে চলে যেতেন। আরতির এই সন্দেহের কথা সুখময় বা কাবেরী জানতেন না। অনেক পরে জেনেছিলেন। ধীরে ধীরে এ ফ্ল্যাটে আসা সুজনও কমিয়ে দিতে দিতে একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনার সুখময়-কাবেরী বেশ অবাক হয়েই বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতেন। শেষপর্যন্ত সুজনকে একদিন বাজারের পথে চেপে ধরতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়েছিল। ঘরের মধ্যে এ নিয়ে হাসাহাসিও করেছিলেন সুখময়-কাবেরী। চোখমুখ লাল করে কাবেরী আরতির উদ্দেশ্যে বেশ কিছু অসংসদীয় মন্তব্যও করেছিল। ঘটনাটা জানার পর দুই পরিবারের মধ্যে অকারণ এবং অযৌক্তিক শীতলতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারপর দেখতে দেখতে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। সুজনের মেয়ের বিয়েও হয়ে গেল। ফ্ল্যাটের মধ্যে তৈরি হল বিরাট এক শূন্যতা। সুখময়ের মতোই। নিয়মতান্ত্রিক ও যান্ত্রিক জীবনের চারপাশে দেখতে দেখতে এত বড় শূন্যতার পাহাড় গড়ে উঠবে তা সুখময় ও সুজন দুজনের একজনও দুঃস্বপ্নেও ভাবেন নি। --শূন্যতা আর সহ্য হয় না সুখদা! বয়স হয়ে গেছে,মাঝে মাঝে খুব অসহায় পড়ি। স্বজনশূন্য সন্তানশূন্য এই ফ্ল্যাটঘরে জীবনের শেষ মুহূর্ত কীভাবে ঘনিয়ে আসবে কে জানে! সুখময়ের মুখোমুখি একটা চেয়ারে গুছিয়ে বসে বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুজনবাবু। কাবেরী আজ ঘোরতর অবাক হলেন সুজনের এইসব কথা শুনে। শূন্যতা নিয়েই ইদানীং সুখময়ের সঙ্গে বেশিরভাগ সময় মত বিনিময় হয়ে থাকে। শূন্যতাবোধ কি ক্যান্সার? কিংবা ভয়ঙ্কর কোনও সংক্রামক রোগ, নাকি জীবনের বিশেষ একটা সময়ের অনিবার্য ও অসহনীয় সঙ্গী? কাবেরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন-- --কফি করি সুজনবাবু? --করবেন! করুন তাহলে, অনেকদিন আপনার হাতের কফি খাওয়া হয় নি। --চিনি ছাড়া? --হ্যাঁ। আপনি ভুলে গেছেন! একটু লজ্জা পেলেন কাবেরী। আসলে অনেক কথাই ইদানীং ভুলে যান তিনি। অনন্ত শূন্যতার মধ্যে ভাসমান জীবনকে হাল্কা করার জন্যেই হয়তো বিস্মৃতি বিস্তৃত হতে থাকে। কাবেরী তাঁর সুসজ্জিত কিচেনে চলে গেলেন মন্থর পায়ে। এখন তাঁর চলাচলের মধ্যেও কোনও শব্দ তৈরি হয় না। --আমরা চলে যাচ্ছি সুজনবাবু। যেখান থেকে একদিন স্ত্রী-সন্তানদের হাত ধরে এই ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিলাম, আমার সেই গ্রামের বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি। --সে কী! এই বয়সে গ্রামের বাড়িতে? রাস্তাঘাট, চিকিৎসার অভাব, গ্রাম্য পলিটিক্স, এসব নিয়ে সেখানে এই বয়সে থাকতে পারবেন? শুধু বিশুদ্ধ অক্সিজেনই তো বাঁচার জন্যে যথেষ্ট নয় সুখদা! --অন্য কিছু নিয়ে আমার দুর্ভাবনা নেই সুজনবাবু। তবে হ্যাঁ, গ্রাম্য পলিটিক্স নিয়ে দুর্ভাবনা আছে বই কী! অনেকটা সেই কারণেই আমি গ্রামে ফিরে যাচ্ছি বলতে পারেন। --কি রকম? --আমি যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলাম সে গ্রাম আর এখন নেই। গ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে রাজনীতি। তার বিষাক্ত ছোবল আমার পরিবারকেও দংশন করতে ছাড়ে নি। সুখময় একটু থাকলেন। সব কথা কি বলা যাবে? সুজনবাবুর পেটে আবার কথা থাকে না। গোটা আবাসনের ঘরে ঘরে সুখময়ের পারিবারিক কাহিনী ছড়িয়ে পড়তে পারে। --আপনার পরিবার! কে আছেন সেখানে? এখানে তাঁরা কি এসেছেন কখনও? --এক-আধবার এলেও থাকেন নি কেউ। আমার দাদা-বৌদি-ভাইপো-ভাইঝি--এরা সব আর কী! অবশ্য দাদা এখন নেই। বৌদি আছেন। ভাইপোকে গ্রাম্য রাজনীতি নৃশংসভাবে খুন করেছে। থাকার মধ্যে এখন ওই ভাইপোবউ আর তার একমাত্র বছর পাঁচেকের সন্তান আর বৌদি রয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। ভাইঝির বিয়ে হয়ে গেছে। ওদের দেখাশোনার কেউ নেই। ভয়ানক আতঙ্কের মধ্যে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে! --আতঙ্ক কেন? --ভাইপো খুন হওয়ার পর ভাইপোবউ গণধর্ষণের শিকার হওয়ায় গ্রামে জীবনযাপন ওদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে উঠেছে। এ বিপর্যয়ের কাহিনী আমার জানা ছিল না সুজনবাবু। গ্রামেরই এক পরিচিত ভদ্রলোকের সঙ্গে আচমকাই দেখা হওয়ায় এসব কথা জানতে পারি। কলকাতার এই দামি সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে বসবাস করতে করতে নিজের পৃথিবীটাকে বড় বেশি ক্ষুদ্র ও সঙ্কীর্ণ করে ফেলেছি আমি। এতটাই ছোট করে ফেলেছি নিজস্ব ভুবনটাকে যে, রীতিমতো দম আটকে আসছে এখন! কাবেরী একটা ট্রে-তে তিন কাপ কফি নিয়ে এসে কাচের সেন্টার টেবিলে রাখলেন। নিজে একটা কাপ তুলে নিয়ে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন। সুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন-- --কফি নিন সুজনবাবু। নিঃশব্দে আচ্ছন্নের মতো হাত বাড়িয়ে কফির কাপ তুলে নিলেন সুজন মিত্র। সুখময়ের মুখের ওপর তাঁর দৃষ্টি তখনও আটকে রয়েছে। সুখময় নিজে এক চুমুকে গলা ভিজিয়ে নিলেন। --গ্রাম্য রাজনীতির আতঙ্ক এখন কোন স্তরে পৌঁছেছে আপনি তা কল্পনাও করতে পারবেন না সুজনবাবু। আমাদের গ্রামের বাড়ি সামান্য কিছু জমি-জমা যা আছে তার দিকে নজর পড়েছে কিছু নিম্নস্তরের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের। এসব জেনেশুনে ঝামেলাশূন্য দূরের এই ছোট্ট পৃথিবীতে মুখ লুকিয়ে থাকি কী করে বলুন তো! ওরা যে আমার ধমনীপ্রবাহের অংশ--ওদের নিয়ে বাঁচাটা কি উচিত নয়? প্রশ্নটা যেন নিজেকেই করলেন সুখময়। সুজন তাকালেন কাবেরীর দিকে। সুখময়ের এই বিস্ময়কর অস্বাভাবিক সিদ্ধান্তে তাঁর সমর্থন রয়েছে কিনা বোধহয় বোঝার চেষ্টা করলেন। সুখময়ের সিদ্ধান্তের একেবারে প্রাথমিক স্তরে বেশ কিছু সংশয় এবং প্রশ্ন ছিল কাবেরীর। কিন্তু শেষপর্যন্ত তাঁর বহুকাল আগে ছেড়ে আসা একান্নবর্তী রান্নাঘর ঠাকুরঘর দালান এবং খোলা উঠোন তাঁকেও ভীষণভাবে টানতে শুরু করেছে। সুখময়ের বৌদি অর্থাৎ বড়-জা কনকের সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল। সম্পর্কের মধ্যে কোথাও কোনও মলিনতা ছিল না। একান্ত বাধ্য হয়েই গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে হয়েছিল কাবেরীদের। কাজেকর্মে অবশ্য সুযোগ পেলেই প্রথম প্রথম ছুটে যেতেন তিনি। কিন্তু পরে আর বহুকাল ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া হয়ে ওঠে নি। সুতরাং এই বদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর জীবন থেকে পালিয়ে আর একবার নতুন করে বাঁচার কথা তিনিও ভাবছেন। প্রচুর সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হবে নিশ্চিতভাবেই, তবু সুখময় তো আছেন! অতএব মনস্থির করে ফেলেছেন কাবেরীও। কাবেরী কিছু না বললেও সুজন বুঝলেন ওঁর অমত নেই! --গ্রাম্য রাজনীতি বড় ভয়ঙ্কর বস্তু সুখদা! পারবেন তো এই বয়সে সামলাতে? --পারতেই হবে সুজনবাবু। জানেন তো, গাছের ডালপালা যতই ছড়িয়ে যাক না কেন, মূল কাণ্ড থেকে ততদূর যেতে পারে না, যতদূর গেলে মূল গাছটাকেই ভুলে থাকা যায়। এটা এক সময়ে না এক সময়ে সকলকেই বুঝতে হয়। আমিও মর্মে মর্মে বুঝতে পারছি। আমি তো আমার সেই গ্রাম্য বৃক্ষেরই শাখাপল্লব! --চিন্তা করবেন না আপনি, রাইটার্সের হোম ডিপার্টমেন্টের দু’একজন কেষ্টবিষ্টুর সঙ্গে আমার গাঢ় পরিচয় আছে, লোকাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন যাতে আপনার পক্ষে থাকে আমি দেখব-- --প্রশাসন চিরকালই রাজনীতির দাস সুজনবাবু। তারা আমার পক্ষে কতটুকু থাকবে জানি না। তবু লড়াইটা কঠিন বটে, কিন্তু এ লড়াই থেকে আর দূরে থাকা সম্ভব নয়। দেখা যাক-- কলিংবেল বেজে উঠল। কয়েক মুহূর্ত সকলেই স্তব্ধ হয়ে রইলেন। প্রায় আধ মিনিট বাদে ফের কলিংবেল বেজে উঠতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সুখময়। শহরের লোকজন এভাবে কলিংবেলের বোতাম টেপে না। শব্দটা ভাঙা ভাঙা শোনায় না। অনভ্যস্ত আঙুলের ছোঁয়ায় যেন বাধ্য হয়েই বেলটা বেজে বেজে উঠছে। দরজা খুলে একপাশে সরে দাঁড়ালেন সুখময়। শীর্ণ চেহারার কালোপাড় সাদা শাড়ি জড়ানো জড়সড় এক মহিলার পিছনে একটি বাচ্চা ছেলের হাত শক্তমুঠোয় ধরে থাকা অতীব বিষণ্ণ এক তরুণী ঘরে ঢুকলো। ওদের পিছনে ঘাড় তুলে একবার দেখে নিয়ে সুখময় সামনের মহিলাকে প্রশ্ন করলেন, --সুবল তোমাদের সঙ্গে আসে নি? --হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই তো এলাম। আমাদের পৌঁছে দিয়ে কী একটা কাজ আছে বলে গেল-- কাবেরী সাধ্যমতো দ্রুততার সঙ্গে কনকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। দু’জনেরই নির্বাক চাউনির মধ্যে ফেলে আসা অতীতের বহু ছবি নিশ্চয়ই ভেসে যাচ্ছিল। দু’জনেরই ঠোঁট কাঁপছিল। গাল ভাসছিল চোখের জলে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ওঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলেন। পিছনের বিষণ্ণ মেয়েটি সুখময়ের গণধর্ষিতা ভাইপোবউ। তার হাতের মুঠোয় ধরা তাঁরই দাদার একমাত্র পুত্রের শিশুসন্তান। অতলান্ত বিষাদ ছুঁয়ে আছে এই অপাপবিদ্ধ শিশুর মুখটিকেও। সুখময় হাত বাড়িয়ে বিস্মিত নির্বাক বালকটিকে তুলে চেয়ারের ওপর দাঁড় করিয়ে তার মুখের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। আচমকাই এই অতি সাধারণ দৃশ্য ভিজিয়ে দিল সুজনবাবুর দুটি চোখও। তাঁর মনে হল, প্রায় জীভনসায়াহ্নে এসেও সুখময় ফের একবার নিজেকে নিজের মতো করে গড়ে তোলার মরণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছেন মনে মনে। --আমি এখন যাই সুখদা! কেন জানি না আমারও মনে হচ্ছে আপনি যদি ডাকেন, তাহলে আমিও এই নিঝুমবাস ছেড়ে আপনার গ্রামে আপনার প্রতিবেশী হয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি! ফ্ল্যাটের যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে ট্রাক আগেই রওয়ানা হয়ে গেছে। আবাসনের লনে অপেক্ষা করছে গাড়ি। শেষবারের মতো বারো’শো স্কোয়ার ফুট ফ্ল্যাটের সর্বত্র চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন সুখময়। বহু স্মৃতি এই ফ্ল্যাটের দরজা-জানালা-দেওয়ালে জড়িয়ে থাকল। আজ সুজন ও তাঁর স্ত্রী আরতিও ওঁদের সঙ্গে নেমে এলেন লন পর্যন্ত। জীবনের অত্যন্ত মূল্যবান দীর্ঘ সময় কেটেছে এই আবাসনে। সুজনবাবু ঘন ঘন চোখ মুছছিলেন। সকলেই একে একে গাড়িতে গিয়ে বসেছেন। সুখময় শেষবারের মতো আর একবার তাকালেন আবাসনের দিকে। যেদিন প্রথম এই লনে পা রেখেছিলেন সেদিন চারপাশে ছিল উচ্ছ্বলতা, নতুন রঙ, ঝকঝকে দেওয়াল, নারী-পুরুষের কলোধ্বনি। আজ সে সব কিছুই নেই। আবাসনের দেওয়ালে অজস্র ফাটলচিহ্ন। রঙ ঝলসে গেছে। যত্রতত্র শ্যাওলার দাগ। কোথাও কোথায় বট-অশ্বত্থের উঁকিঝুঁকি। বুক ভরে শ্বাস নিলেন সুখময়। যন্ত্রচালিত এক জীবন থেকে অন্য জীবনের যাত্রাপথকে যতটা অনিশ্চিত মনে হওয়া স্বাভাবিক ছিল, ততটা প্রায় একেবারেই মনে হচ্ছে না! সুখময় প্রায় হাসিমুখেই গাড়িতে গিয়ে বসলেন। সুখময়ের হাসিমুখ পরম বিস্ময়ের মধ্যে নিঝুমবাসে রেখে গেল সুজনবাবুদের! |
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট