পুষ্পদেশে ঘাসপুরুষ
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
............... | কুলগাছিয়া ছেড়ে হাইওয়ে ধরে বাগনানের
কাছাকাছি গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ির ভেতরে এসি চলছিল বলে বাইরের উত্তাপটা
একটুও টের পাওয়া যায় নি। গাড়ি অচল হতেই কালঘাম ছুটতে লাগল সকলের। বাইরে
প্রচণ্ড তাপ--একেই হয়তো দাবদাহ বলে লোকে। টিভিতে বড় বড় জঙ্গল পুড়তে দেখেছি।
কাছ থেকে দেখতে চাই না
কখনো। কাঁধের ঝোলাব্যাগ সামলে তপন গাড়ি থেকে নেমে বলল-- --অটো ছাড়া আপাততঃ গতি নেই। আমি কি অটো রিজার্ভ করবো? আমার দিকেই তার সপ্রশ্ন দৃষ্টি। আমি তাকালাম গাড়ির জানলা দিয়ে সারসের মতো গলা বাড়িয়ে থাকা দৃতা’র দিকে। দৃতা কোনো সুন্দরী মেয়ের নাম হতে পারে আমার জানা ছিল না। আগে কখনো শুনি নি। এই নামে দ্বিতীয় আর কেউ আছে বলেও জানি না। ‘দৃতা’ তো একটা বাংলা শব্দ--অবশ্যই তার একটা অর্থ থাকা উচিত। কিন্তু ‘দৃ’ যুক্ত বাংলাশব্দই তো মাত্র হাতে গোণা কয়েকটা--দৃক্, দৃঢ়, দৃপ্র, দৃশব্দতী (পাঞ্জাবের নদী)--কিন্তু দৃতা? শব্দভাণ্ডারে খুঁজে পেলাম না। অবশ্য ওর চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নাম ‘দৃঢ়তা’ হলে ঠিক হতো। যিনি নামটা রেখেছেন তিনি হয়তো দৃঢ়তা শব্দটাই মধ্যপদলোপী করে দৃতা’র সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। --আকাশের অবস্থা ভাল নয় বিশ্বদেবদা, তুমি তপনদাকে বলো অটো রিজার্ভ করতে। একটু চেঁচিয়ে বলল দৃতা। জুলাইয়ের মাঝামাঝি হলেও এবারে বর্ষা কতদূরে ঘাপটি মেরে বসে আছে ঠিকঠাক কেউ জানে না। হঠাৎ হঠাৎ দু’এক পশলা বৃষ্টির সঙ্গে উন্মাতাল বাতাস অবশ্য বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মাঝরাস্তায় বৃষ্টি মোটেই সুস্বাদু নয়। রীতিমতো বিরক্তকর। আমরা চলেছি বাগনান থেকে অনেক ভেতরে ছয়-আনি গুজরাটে। ওখানে তপনের আদি বাড়ি। এখন সেই বাড়িই তপনের কর্মশালা--আমরা যাকে শিল্পাশ্রম বলে থাকি। এক-আনি থেকে ছয়-আনি যোগে ছয়টি গ্রাম গুজরাট যুক্ত হয়ে কতকাল থেকে গা-ঘেঁষাঘেঁষি করে টিকে আছে কেউ জানে না। তবে বিস্ময়করভাবে সরকারি খাতাপত্রে পাঁচ-আনি গুজরাটের নাম থাকলেও তার কোনো অস্তিত্ব আজ আর নেই। গুজরাট নামটা এখানে এল কি করে তা-ও বলা কঠিন। কোনোও গুজরাটি পরিবার এখানে কস্মিনকালেও ছিল বলেও কেউ জানে না। দৃতা’র জন্যেই ছয়-আনি গুজরাটে চলেছি অনেকটা আকস্মিকভাবেই। হঠাৎ করে দৃতা আমেরিকা থেকে তপনকে ফোন করে জানালো ওকে নাকি একবার ছয়-আনিতে যেতে হবে। দৃতা’র বর নাসা’য় কাজ করে। পদার্থ-বিজ্ঞানী। দৃতাও সেখানে একটা কলেজে অ্যানথ্রোপলজি পড়াতো। ইতিহাস এবং পদার্থবিজ্ঞানের রসায়ন ঠিকমতো জমে নি শেষপর্যন্ত। দৃতা ওখানকার পাট চুকিয়ে ফিরে এসেছে দিন সাতেক আগে। ডিভোর্স নিয়ে এসেছে। কোনো ইস্যু নেই বলে সমস্যাও অনেক কম ছিল। বাগনান স্টেশন থেকে অটো চেঞ্জ করার আগে দৃতা বলল-- --তপনদা, এখানে ভাল ল্যাংচা পাওয়া যায় না? --তুই জানলি কি করে বাগনানের বিখ্যাত ল্যাংচার কথা? --জানি। আরও অনেক কিছু আমি জানি। --খাবি এখন?’ তপন জিজ্ঞেস করল। --খাবো। কতকাল বাংলার মিষ্টি খাই না! কাছের একটা ভিড়ঠাসা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দৃতা এমনভাবে শালপাতার বাটি থেকে ল্যাংচা মুখে তুলছিল যেন বহুদিন ধরেই ও এভাবে খেতে অভ্যস্ত! তপন ওর ডিজিটিাল ক্যামেরায় দৃতা’র কয়েকটা ছবি তুলে নিল। দৃতাকে ঘিরে একটা চঞ্চল ভিড় তৈরি হচ্ছিল দোকানের সামনে। দৃতার পরনে টাইট জিন্স আর ঢিলেঢোলা হাওয়াই গেঞ্জি। ভেতরের অন্তর্বাস স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ঘামে প্রায় ভিজে গেছে ওর গেঞ্জি। গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকার দরুণ অনেকেই নজর ফেরাতে পারছে না। দৃতা কিন্তু নির্বিকার। কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। থাকার কথাও নয় অবশ্য! রেল গেট পেরিয়ে অটো ছুটলো বিচিত্র আওয়াজে। সামনের রাস্তাটা সোজা চলে গেছে গাদিয়ারা। সেখানে পর্যটকদের জন্যে রিসর্ট আছে। তপন বলেছিল ছয়-আনি যেতে যেতে বেলা গড়িয়ে যাবে। রাস্তাঘাট ভাল নয়। রাতটা গাদিয়ারাতে কাটিয়ে সকালে ছয়-আনি যাওয়াই ভাল। দৃতা এক কথায় তপনের পরামর্শ উড়িয়ে দিল। বলল-- --তোমার আশ্রমেই রাত কাটাবো আমরা। দৃতাকে বোঝানোর চেষ্টা করি নি যে, এটা ওয়াশিংটন নয়, আমরা যাচ্ছি প্রত্যন্ত একটা গ্রামে। সেখানে এখনও দু’জন পুরুষ একজন মহিলাকে নিয়ে মহিলাশূন্য বাড়িতে রাত কাটাতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। অনেকটা পথ পেছনে ফেলে আমাদের অটো বেঁকে গেল বাঁদিকে। তারপরেই আচমকা নামলো প্রবলবেগে বৃষ্টি। দৃতা বসেছিল সাইডে। জলের প্রবল ছাটে ভিজে একাকার। অন্য সাইডে তপন। সে–ও ভিজে গেল বেশ। আমি মাঝখানে থাকায় কিছুটা রক্ষা পেলাম। অফুরন্ত রাস্তা আর ফুরোয় না। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শেষ প্রান্তে গিয়ে আমরা থামবো। অটো থামলো দোলনতলায়। জলকাদা ভেঙে এবড়োখেবড়ো ইটের লাল রাস্তা দিয়ে অটো আর যাবে না। ভ্যানের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ থেকে শেষপর্যন্ত হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। আমার পায়ে চামড়ার চটি। তপনের ওয়াটারপ্রুফ জুতো। দৃতার পায়ে হাজার তিনেক টাকার অ্যাডিডাস! নদীবাঁধের ওপর দিয়ে ভাঙা ইটের টুকরো ছড়ানো রাস্তা দিয়ে হাঁটতে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছিল আমার–ই। মাইলখানেক হাঁটার পর বাঁ–দিকে বোঁধ থেকে নামতে হল অনেকটা। তারপর রাস্তা বেশ সরু। অসমান ভাঙা ইট ছড়ানো এই রাস্তা দিয়ে সাইকেল বাইক ভ্যান ছাড়া আর কিছু চলে না। দৃতার গাড়ি খারাপ না হলেও দোলনতলা থেকে আমাদের এইভাবেই যেতে হতো। হোঁচট খেতে খেতে এ –ওর হাত ধরে টাল সামলাতে সামলাতে এগোতে হচ্ছিল। সরু রাস্তার দু’পাশে যতদূর চোখ যায় সবুজ ক্ষেত। জলে ভেজা। বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ। সূর্য্য পশ্চিমে একটু হেলে পড়েছে। অপূর্ব এক রঙিন মায়াময়তাকে হ্যাণ্ডিক্যামে বন্দি করছিল দৃতা। হঠাৎই রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার লাল ফুলে পরিপূর্ণ জবার ক্ষেত দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আমি। দৃতাও। ধানক্ষেতের পাশাপাশি বিঘের পর বিঘে জবা ফুলের গাছ। মাঠ ভরা এত জবা গাছ একসঙ্গে এর আগে আমি দেখি নি। --জবা এখন বারোমাসের অর্থকরী গাছ। একবিঘে ধানের জমি থেকে সারা বছরে যে আয় হয় তার থেকে অনেক বেশি আয় হয় এক বিঘে জমিতে জবার চাষ করলে। সারা বছর রোজগার। বারবার চারা বসাতে হয় না। সার–জলের খরচ প্রায় নেই বললেই চলে! হাঁটতে হাঁটতে বলছিল তপন। দৃতা অবাক বিস্ময়ে সব যেন দুচোখে গিলছে। পেছনে লাল ফুলভর্তি জবার ক্ষেত--সামনে বহুদূর বিস্তৃত ধানক্ষেতের মধ্যে নিচু হয়ে একটা লোক ধানের চারা গুঁজে দিচ্ছিল জলকাদা ভরা মাটিতে। আরও কয়েকজনের মধ্যে ঐ লোকটিকে একটু বেশ আলাদা মনে হওয়ার কারণ লোকটির শরীর। বেশ লম্বা-চওড়া পেটানো চেহারা। মাথায় গামছা জড়িয়ে রেখেছে। প্রায় হাঁটু অবধি জলকাদায় একাকার। নিবিষ্ট মনে চারা লাগিয়ে চলেছে লোকটা। সারা শরীরে সবুজ ঘাসের টুকরো লেগে রয়েছে। আমাদের কথা-বার্তার শব্দ কানে যেতেই লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তাকালো আমাদের দিকে। তপনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল-- --ভাল আছেন তো তপনদা? এবারে তো অনেকদিন পরে এলেন! --হ্যাঁ, নানান কাজের ঝামেলায় ইচ্ছে থাকলেও হয়ে ওঠে না। রোয়া শুরু হল শেষপর্যন্ত? চারাগুলো জলের অভাবে শুকিয়ে যাবে না তো? --দেরিতে হলেও বৃষ্টি ভালই হবে। ততদিনে যেভাবে হোক বাঁচাতে হবে। থাকবেন তো কয়েকদিন? --দু’এক দিনের বেশি নয়। এদের ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি-- লোকটা চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকালো আমাদের দিকে। তপন বলল-- --আমার বন্ধু বিশ্বদেব। এসেছে সেই কোচবিহার থেকে--প্রতিদিন সকালে হাত বাড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা ছুঁতে পারে--ভাবা যায়! তপনের কথা শুনে আমরা দু’জনেই হেসে ফেললাম। চারপাশ ক্রমশঃ আবছা হয়ে আসছে। দৃতা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল-- --আপনি জবার চাষ করেন না? --না। আমার জমির পরিমাণ অনেক বেশি--ধানেই লাভ বেশি। খাদ্যের সংস্থানটা তো ঠিক রাখতে হবে। যাদের দু’এক বিঘের বেশি জমি নেই--ধান চাষে তাদের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। তারাই জবা’র চাষ করে। ওতে বারোমাস আয় হয়। সংসারটা অচল হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে না। ভাগ্যিস আমাদের দেশে তেত্রিশ কোটি দেবদেবী রয়েছেন এবং তাঁদের শ্রীচরণে ফুল নিবেদনের লোকজনেরও অভাব নেই--তাই প্রতিদিন আর কিছু না হোক প্রচুর ফুল বিক্রি হয়। সময় পেলে একবার হাওড়ার রবীন্দ্রসেতুর নিচে ফুলের হাটটা দেখে যেতে পারেন--মানুষের অন্ধ বিশ্বাসেরও কী প্রচণ্ড বাণিজ্যিক মূল্য! লোকটার কথা শুনে আমি অবাক হচ্ছিলাম। গাঁয়ের এক কৃষকের মুখে এত পরিশুদ্ধ ভাষা, এত পরিষ্কার উচ্চারণ আমি কখনো শুনি নি। আমি জানতে চাইলাম-- --আপনাদের জমিতে যদি টাটা-আম্বানিরা কারখানা করতে চায় আপনারা জমি দেবেন? --এক কথায় এর কোন উত্তর হয় না। রাতে তপনদার বাড়িতে আমি আসব--তখন না হয় এ বিষয়ে কথা হবে! লোকটার ঠিক পিছনেই সূর্য্য অস্ত যাচ্ছে। সূর্য্যাস্তের শেষ লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ছে চরাচরে। প্রস্ফুটিত লাল জবাফুল গাঢ় রক্তবর্ণ ধারণ করছে। দৃতা লোকটার সামনে হ্যাণ্ডিক্যাম নিয়ে দাঁড়াল। অস্ফূটে বলে উঠল-- --ফুলের দেশে ঘাস-মানুষ! দৃতার ক্যামেরা সচল ছিল। দূর থেকে এক আদিবাসী তরুণীকে আসতে দেখে ক্যামেরা ঘোরালো দৃতা। তরুণীটির মাথায় একটা ঝুড়ি। তাতে কিছু শাক-সব্জি-চাল-ডাল রয়েছে হয়তো। ওর ডান হাতে একগোছা সবুজ পাতাভর্তি কাঁঠালের সরু সরু ডাল। যে বাঁ হাত দিয়ে নিজের বাচ্চাটাকে কোমরে আটকে রেখেছে সেই হাতের মুঠোর মধ্যেও ধরা রয়েছে আর এক গোছা সবুজ পাতাভর্তি গাছের ডাল। তরুণীটির উন্মুক্ত বাঁদিকের বুকে মুখ ডুবিয়ে রেখেছে বাচ্চাটা। দৃতা ক্যামরাবন্দি করল আদিবাসী তরুণীটিকে। লোকটা অর্থাৎ দৃতার কথিত ‘ঘাসমানুষ’ বলে উঠল, --ওর নাম লক্ষ্মী হেমব্রম। ওর বর দোলনতলায় রিক্সা চালায়। লক্ষ্মী জমিতে বাগাল খাটে। দিনের শেষে হাটবাজার করে বাড়ি ফেরে প্রতিদিন। ও আর অন্য কোন কাজ জানে না। নিজের জমি নেই। কিন্তু ও নিজেকে এই আদিগন্ত সমস্ত জমির মালিক বলে মনে করে। আপনি যদি ওর সঙ্গে ওর বাড়ি যান তাহলে দেখতে পাবেন খুঁটিতে বাঁধা দু’তিনটে ছাগল রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। লক্ষ্মীর পায়ের শব্দ শুনলে ওরা চঞ্চল হয়ে ওঠে। লক্ষ্মী যখন কাজ শেষে ঘরে ফেরে তখন ওর মাথায় বোঝা--কাঁখে শিশু--দু’হাতেও কয়েকগাছি কাঁঠালপাতা ভর্তি ডাল। উঠোনে পা দিয়েই ও তার ছাগলের মুখের কাছে ডালগুলো ধরবে। অনাবিল এক সুখে ও কয়েকমুহূর্ত আশ্চর্য্য নীরবতায় ডুবে যাবে। ওর জগৎ শুধু ওর স্বামী সন্তান নিয়ে নয়--এই আদিগন্ত সবুজ ক্ষেতখামার আকাশ নদী এবং ওর ঘরে ফেরার অপেক্ষায় অস্থির হয়ে ওঠা গৃহপালিত পশুগুলোকে নিয়েই ওর জগৎ। ঠিক এভাবে আমি অন্ততঃ ভাবি নি। মনে হল, সত্যিই তো--এই লক্ষ্মী হেমব্রমকে বাদ দিলে এই অপূর্ব নিসর্গের কতটুকু থাকে! --একদিন বাঁধের ওপর একটা বেঢপ পুলিশের গাড়ি আর একটা লম্বা দামি গাড়ি এসে থেমেছিল। বন্দুকধারী পুলিশ আর কয়েকজন সরকারি আমলার সঙ্গে ছিল শিল্পপতির চাকর-বাকরদের একজন। সরকারি গোলাম আলি’রা তাদের বাপ চোদ্দপুরুষের জমি দেখানোর ভঙ্গিতে তর্জনি তুলে কিছু বোঝাচ্ছিল। ক্ষেতে যারা কাজ করছিল তারা একে একে হাতে হেঁসো কাস্তে নিয়ে ওদের বৃত্তবন্দি করে ফেলছিল ক্রমশঃ। ওদের সঙ্গে জুটেছিল কিছু রাজনৈতিক ষণ্ড, যারা কৃষকের জমি থেকে মোটারকমের দালালি মারার লক্ষ্যে যেকোনভাবেই হোক জমি লুঠের ধান্ধায় ছিল। চারপাশে জড়ো হওয়া চাষীদের হাতে হেঁসো আর কাস্তে ঝলসে উঠছিল রোদের ছটায়। জমির রাজনৈতিক দালাল, শিল্পপতির চাকর আর আমলাদের নিয়ে গড়ে ওঠা রক্তখাদক চক্রটি শেষপর্যন্ত পিছু হটতে হটতে ফিরে গিয়েছিল সেদিন। আমি নিজে সে দৃশ্য দেখেছিলাম। তপনই শোনাল সে কাহিনী। লোকটা বলল-- --আমিও ছিলাম সে দলে! --কিন্তু কারখানার কি দরকার নেই?’ সামনে একটু এগিয়ে এল দৃতা। --সোনা ফলানো জমিতে কেন? উৎপাদন বেশি হবে? আপনি কি জানেন, এই রাজ্যে কত লক্ষ একর অনাবাদী, এক ফসলী জমি অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত এ দেশের সরকার একটা সম্পূর্ণ ল্যাণ্ড-ব্যাঙ্কও তৈরি করে উঠতে পারল না! সেইসব জমির চারপাশের জনপদে কত চাপ চাপ মধ্যযুগীয় অন্ধকারে এখনও পিঁপড়ের ডিম খেয়ে মানুষ বেঁচে আছে! কারখানার জন্যে প্রথমেই চাষের জমি ধ্বংস করার কেন প্রয়োজন হচ্ছে? কেন প্রয়োজন হচ্ছে কৃষি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার? শিল্পপতিদের হাতে কৃষকের জমি তুলে দেওয়ার ফাঁকে কত কত ‘সর্বহারা’ রাতারাতি পুঁজিপতি হয়ে উঠছে তার খবর কে রাখে? --আপনি কি তৃণমূল করেন?’ আচমকা প্রশ্ন করল দৃতা। --খুব ভাল, মাওবাদী বলেন নি! না, যে প্রতিবাদ নিজের অস্তিত্ব-সংস্কৃতি-পরম্পরাকে রক্ষার জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে তার জন্যে কোন ঝাণ্ডার দরকার হয় না। আমার অন্ততঃ হয় নি। --এর নামটা তোমাদের বলা হয় নি। এর নাম তাপস কারক। ইতিহাসে এমএ-এমফিল। কলেজে চাকরি পেয়েছিল, দু’বছর পরে চাকরি ছেড়ে গ্রামে এসে উন্নততর চাষ-বাস নিয়ে পড়াশোনা করছে, ফলও পাচ্ছে হাতেনাতে। পারিবারিক জমির পরিমাণও বেড়েছে। গ্রামের চাষীদেরও শেখাচ্ছে কী ভাবে আবাদ বাড়াতে হয়। জবার চাষও তাপসেরই আইডিয়া। অল্প জমির মালিকের ঘরেও এখন প্রতিদিন দু’চার পয়সা আসছে। ওর তিন-তিনটে কবিতার বই ছাপা হয়েছে। আমার কাছে ছবি আঁকাও শিখেছে কিছু কিছু। টেরাকোটার কাজেও বেশ আগ্রহী। পুতুল বানিয়ে ছেলেদের বসিয়ে দেয় মেলায়। বাস্তবিকই--নতুন দৃষ্টিতে দেখতে হচ্ছিল তাপসকে। চারপাশে অন্ধকার নামছে একটু একটু করে। পায়ে পায়ে দৃতা তাপসের একেবারে মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াল। ওর পায়ের হাজার তিনেক টাকার দামি কেডস্ জলকাদায় ডুবে গেল। --আশ্চর্য্য! তোকে আমি প্রথম দেখাতে চিনতেই পারলাম না। অথচ তোর জন্যেই তো আমার এখানে আসা। আমি আমেরিকা চলে যাওয়ার পর তুই কলেজের চাকরি ছাড়লি--সাহস করে বলার কথাটা বলবি, এই অপেক্ষাতেই আমি ছিলাম। অথচ-- দৃশ্যতঃই আমরা হতভম্ব। আমেরিকা ফেরৎ একটা অত্যাধুনিক মেয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের ক্ষেতের জলকাদায় দাঁড়িয়ে এসব কি বলছে! --তুই বিয়ে করিস নি তো? তাপস ‘না’ সূচক ঘাড় নাড়তেই ওকে জাপ্টে ধরে দৃতা বলে ওঠে-- --আমাকে বিয়ে করবি তাপস? --পাগল নাকি! কলকাতা থেকে অনেক দূরের এই অজ গাঁয়ে তুই থাকতেই পারবি না--আমিও গাঁ ছেড়ে কোথাও যাব না। দু’চার দিনের মধ্যেই রোমান্টিক আবেগ-টাবেগ সব ভেসে যাবে--এসব হয় না একেবারেই-- --এক্ষুণি তো তুই বললি--দু’চার দিন হলেও রোমান্টিক আবেগ-টাবেগ থাকবে। জীবন খুবই ছোট রে তাপস--সে হিসেবে দু’চারদিন খুব কম নয়--যদি সব ভেসে যায়ও বাকি জীবনটা আমার ঐ দু’চারদিনের সম্বলেই দিব্যি কেটে যাবে--তুই কিচ্ছু ভাবিস না! এরপর আর ঘন অন্ধকারে একটু দূরেই পরস্পরকে আঁকড়ে ধরে থাকা পুষ্পদেশের ঘাসমানুষ তাপস ও দৃতাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল না! |
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট