ডাইনি বৃত্তান্ত

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।

....................................
বাঁউড়ির (পৌষ সংক্রান্তির আগের রাত) রাত জেগে ছেলে-ছোকরারা যখন আগুন জ্বেলে হৈ হৈ করে ছড়া কেটে গান গেয়ে টুসুরাণীর চৌদল সাজাতে ব্যস্ত কুসুমের চোখে তখন না ঘুম না জাগরণের খুশি। সারারাত অন্ধকার দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে বসেই রাত কাবার করে দিল। আর-বছরে এই বাঁউড়ির রাতে আঙ্গিনায় গানের আসর বসিয়েছিল চৈতন। ঘরের মধ্যে পাড়া প্ড়শীদের বউ-ঝিদের নিয়ে টুসুরাণীর পাশে মাটির প্রদীপ আর কেরোসিনের ডিবি জ্বেলে কুসুম নিজেও কত গান গেয়েছিল। চৈতন তার বন্ধুদের নিয়ে মুখ লাল করা রসের গান গেয়ে গেয়ে আসর মাতিয়ে দিয়েছিল।
বাঁউড়ির হিমেল রাত এবারেও টুসুগানের সুরে মাতাল হয়ে উঠেছে। রঙ-বেরঙের গানের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে এ ঘর লে উ ঘর। শুধু কুসুমের আঙ্গিনাই আজ শুনশান। দেখতে দেখতে রাত শেষ হয়ে এল। পাড়া-ঘর ঝেঁটিয়ে বউ-ঝিরা সরা মাথায় চৌদল মাথায় টুসুরাণীর মূর্তি মাথায় দলে দলে বেরিয়ে পড়বে টুসুরাণীকে বিসর্জন দিতে। কুসুম শুনতে পাচ্ছিল বিসর্জনের গান—
'আরে আরে বাজনাদারিয়া ঢাকে খাড়ি দে না রে—
শেষ রাইতে কোকিল ডাকে রে,
টুসু বিদায় দে না রে।'

রাত শেষ হয়ে মকর সংক্রান্তির সকাল শুরু হতেই মকর পরবের উৎসবে মেতে উঠবে গোটা গ্রাম। কুসুমই শুধু নদীতে মকর স্নানে যাবে না। গায়ে হলুদ মাখবে না। পায়ে আলতা দেবে না। রূপোর মল জোড়া আগেই খুলে রেখেছে। টিনের বাক্সে তুলে রেখেছে দু'হাতের চারগাছি করে আটগাছি রূপোর কাঁঠালকোষ চুড়িও। কুসুম আজ হলুদ গাবা আলতাপাড় শাড়িও পড়বে না। শাড়ির খুঁটে বাঁধবে না রূপোর খুঁট-চাবি। অনেকদিন চোখে কাজল পরে না। কপালেও পরে না মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। এক সঙ্গে বেশ কয়েকটা মোরগ ডেকে উঠতেই নড়েচড়ে বসলো কুসুম।
চৈতন শেষপর্যন্ত মেঘু মোড়লের বউকে নিয়েই পালালো! গোটা গাঁ চৈতনের হিম্মত দেখে হাঁ হয়ে গেছে। মেঘু মোড়ল পঞ্চায়েতের প্রধান নয় বটে তবে চলতাতোড় গ্রামে সে-ই শেষ কথা। সেই মেঘু মোড়লও কি করে যেন কানাকানি থেকে জেনে গিয়েছিল তার দ্বিতীয়পক্ষের বউ মশুরী নাকি মেলায় মেলায় চৈতনের সঙ্গে রঙ করে বেড়াচ্ছিল। ছাতাটাঁড়ের ছাতাপরবের মেলায়, বুধপুরের মেলায়, ইঁন্দকুড়ির ইঁন্দ গোস্বামীদের রাস, ডিমডিমার ভৈরববাবার মেলায়--এমন কী নাচনী কি ছো নাচের আসরেও মেঘুর বউ মশুরী আর চৈতনকে ঢলাঢলি করতে দেখা গেছে।
চৈতন মেলায় মেলায় ঝাণ্ডি পাতে। সে নিজে অবশ্য কখনো ডাব্বা বা মগ ধরে না। বড় বড় করে যত্নে আঁকা রঙিন ইস্কাপন-রুপিতন-হরতন শোভিত পাইলের কোণায় বসে শুধু দান গুটোয় আর দান মেটায়। ডাব্বার ভেতর ঘুঁটি খড়খড়িয়ে দান ফেলে সাগরেদ সনা। বাঁকুড়ার গাজনের মেলা থেকে সনাকে তুলে এনেছে চৈতন। এ ব্যাপারে সনা বেশ ওস্তাদ। ঝাণ্ডির সঙ্গে সনার যেন রক্তের সম্পর্ক। লোকে তাই ওকে ঝাণ্ডিসনা বলেই ডাকে এবং চেনে।
এরমধ্যেই একদিন ধর্মের কল বাতাসে নড়ে গেল। মেঘু মোড়ল হাতে নাতে ধরে ফেললো চৈতন আর মশুরীকে খয়ের বনে। বড়ই আপত্তিকর অবস্থায়। চৈতনকে হিড় হিড় করে টানতে টানতে বুঢ়াশিবের চাতালে আনা হল। তারপর বেদম জুতো পেটা। মেঘুর জুতোর পেরেকে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল চৈতন। স্তব্ধ কুসুম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চৈতনের উত্তম মধ্যম প্রত্যক্ষ করলো।

তিন চারদিন ঘরের বাইরে পা রাখেনি চৈতন। একটা কথাও কুসুম বলেনি। চৈতনও ছিল বেজায় চুপচাপ। এইভাবে প্রায় নিঃস্তরঙ্গ কেটে গেল মাস দেড়েক। তারপরেই ঘটে গেল সেই অঘটন। গোটা গাঁ তোলপাড়। মেঘু মোড়লের যুয়ান বউ আর কুসুমের যুয়ান মরদ একসঙ্গে সর করে পালিয়েছে। কাছে দূরে তাদের কোনো হদিশই মিললো না! চৈতনের হিম্মতকে গাঁয়ের অনেকেই আড়ালে আবডালে বাহবা দিয়েছে। দুষেছে কুসুমকেই!

কুসুমের বয়সী সমস্ত বিবাহিতা অবিবাহিতা মেয়েদের চেয়ে কুসুমের শরীর স্বাস্থ্য অনেক ভালো। বিয়ের চার বছরের মধ্যে গোটা চারেক পুঁয়ে পাওয়া বাচ্চা না বিয়োনোর জন্যেই হয়তো তার ডাগর-ডোগর শরীর লোকের চোখে বেঁধে। দু'হাতে দশভুজার মতো কুসুম গাছগাছালি লাগায়। ছাগল মুরগী চরায়। নদী-ঝোরা থেকে জল আনে। রান্না করে। কাঠকুঠো ডাঁই করে উঠোনে। এ সবের জন্যেই তার শরীর জুড়ে দুদ্দার যৌবন। তবু কেন সে চৈতনকে বেঁধে রাখতে পারলো না! আধবুঢ়া মেঘু মোড়লের বিছানায় ষোল বছরের মশুরী যদি বেশিদিন না ওঠে তবে তাকেও খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। অতএব কুসুমের মতো মেঘু মোড়লেরও মাথা হেঁট।
মশুরীর সঙ্গে চৈতনের গ্রাম ছাড়ার খবরটা নিয়ে এসেছিল ঝাণ্ডিসনা--
--হা বুঢ়া বাপ! ইকি সব্বোলাশ হঁয়্যে গেইল আ কুসুম! ইপর কুথায় দাঁড়াবে গো?

কুসুম প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। চিৎকার করে কাঁদতেও পারেনি। হঠাৎই যেন জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। পাতা পড়ার শব্দ শুনেও প্রথম প্রথম চমকে উঠতো। এই বুঝি ফুলেল তেল বাস-সাবান কিংবা কাচের চুড়ি নিয়ে বাতাসে গতরের বাস ছড়িয়ে ঘরে ঢুকবে চৈতন। দেখতে দেখতে ছ'মাস কেটে গেল। চৈতন ফেরেনি। চৈতন জানে এর পর গাঁয়ে ফিরলে মেঘু তাকে দু'টুকরো করে কাঁসাই নদীতে পুঁতে ফেলবে।
কুসুমও অবশ্য চৈতনের ফেরার আশা করে না। ফিরলেও উয়ার সনগে ঘর করা যাবেক লাই। ওদিকে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে মেঘু মোড়ল মাঝে মাঝেই কুসুমের সামনে যমদূতের মতো উদয় হয়ে কুসুমকে তার ঘর সংসারের চাবিকাঠি খুঁটে বেঁধে দেবার বাসনা জানায়। মেঘুর জ্বালায় কুসুমের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। পরিত্রাণের পথই খুঁজে পাচ্ছে না কুসুম।

দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল গানের সুর আর বিসর্জনের মিছিল। গোটা বাঁউড়িকুলি এখন ফাঁকা। মানুষের স্রোত চলেছে নদীর দিকে। টুসু বিসর্জনের সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীতের এই সকালে হাঁটু জলে স্নান করবে সবাই। মকর সংক্রান্তির স্নানে পুণ্যি হয়। স্নানের কথা মনে হতেই উঠে পড়লো কুসুম।
অনেকক্ষণ ধরে দীঘিতে স্নান করলো। অনেকদিন পরে হাত-পা ছুঁড়ে একটু সাঁতারও কাটলো। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। এক কলসী জল কাঁখে উঠে আসার মুখেই শরীর থেকে ঝরে যাওয়া অবসাদ মুহূর্তেই ফিরে এল। যমের মতো পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছে মেঘু মোড়ল।
--আমি আর সময় দিতে লারবো কুসুম। তর শেষ কথাটা তকে আজই বুইলতে হবেক। হামার ঘরকে তুই যাবিস কি লাই?
মেঘুর বাঘের মতো চোখ দুটো কুসুমের আপাদমস্তক চেটে যাচ্ছে। আজ একটা হেস্তনেস্ত করার উদ্দেশ্য নিয়েই মেঘু এই নির্জনতার সুযোগ নিয়েছে। ভেতরে ভেতরে একটু ভয় পেলেও ঝনকে ওঠে কুসুম--
--কুনজর দিও না মোড়ল। সরে যাও--
--কথাটুকু শোন কুসুম। দু'মুঠো ভাতের জইন্যে, একটা ট্যানা কাপড়ের জইন্যে, শরীরের সোহাগের জইন্যে লকের মুখ ভালতে (তাকাতে) হবেক নাই। গাঁয়ের কেউ আর তকে কুলকুলি দিবেক নাই। আমি তকে সাঙা করেই ঘরে লিব--
--মশুরী কেনে শরীরের সোহাগের জইন্যে ঘর ছাড়লো মোড়ল? কেমুন তুমি মরদ বঠে?
--উসব কথা ছাড়্যে দে কুসুম। তর ভাতারও তকে ছাড়্যে গেইলছে। তরই বা এত দেমাক কেনে? টুকু শোন কুসুম--যতই কেনে দেমাকের বিটি হ, বিটি ছেইল্যার ভাতার ছাড়া কুনো গতি লাই। লচরপচর ছাড়্যে হামার ঘরকে চল কুসুম--
--হামার সাফ কথা মোড়ল, নাই যাব তুমার ঘরকে। যার ঘর ছাড়্যে যুয়ান বউ পালায় তাকে আমি মরদ মানতে লারবো মোড়ল--
বারবার তার পৌরুষের প্রতি কুসুমের তীব্র কটাক্ষ মেঘুকে ভেতরে ভেতরে ভয়ঙ্কর ভাবে হিংস্র করে তুলছিল। ইচ্ছে করলে এই নির্জন দীঘির ঘাটেই মেঘু তার পুরুষত্বের প্রমাণ দিতে পারে। কিন্তু সে সব কিছু না করে দাঁতে দাঁত চেপে মেঘু বললো--
--জেবনটাকে লষ্ট করবি কুসুম! একদিন এই চালতাতোড় গাঁয়ের লক তকে পাথর ছুঁড়ে মাইরবেক। তখন বুঝবি মেঘু মোড়ল কেমন মরদ বঠে!
বলে হন হন করে নিজের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল মেঘু।



মকর সংক্রান্তির দিনই ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনা। নদীর পারের অস্থায়ী মেলার দোকান থেকে জিলিপি গজা খেয়ে নদীর গর্তের জমা স্রোতহীন জলে তৃষ্ণা মিটিয়েছিল যে পাঁচটি ছেলে-মেয়ে তাদের ডায়রিয়া হয়ে গেল। হাসপাতালে নিতে নিতেই তারা মারাও গেল। মকর পরবের আনন্দের ওপর আচমকাই নেমে এল শ্মশানের স্তব্ধতা। পুত্র-কন্য হারা মায়েদের আর্তনাদে গোটা বাঁউড়িকুলিতে মধ্যাহ্নেই আঁধার নেমে এল।
অনেকদিন পরে মেঘুর আঙ্গিনা উপচে ভিড় জমে গেল। গাঁয়ে খারাপ হাওয়া লেগেছে। ওঝাকে ডাকা হল। গাঁয়ের বয়স্ক লোকজনদের নিয়ে মেঘু 'গল্প' (পরামর্শ) করতে বসলো। ওঝা সনাতন বেশ কিছুক্ষণ ধরে নানান আঁকিবুকি কেটে তেলপাতা পড়ে সর্বসমক্ষে জানাল--
--কুসুমের উপর ডাহিন ভর করেছে। তাই চার বছরেও উয়ার পেটে ছগনা জন্মায়নি। মরদ ঘর ছাড়্যে চল্যে গেইলছে। ওই ডাহিন-ই বাচ্চাগুলানরে খাঁয়েছ্যে।
--কিন্তু অপদেবতা ট কে বঠেন?
জানতে চাইল মোঘু।
--কেনে চৈতনার মা বঠে! উয়ার গতি হয় নাই এখুনও।
উপস্থিত সকলের মেরুদণ্ড বেয়ে একটা হিমশীতল স্রোত বিদ্যুতের মতো বয়ে গেল। বছর পাঁচ আগে চৈতনার মা জলে ডুবে অপঘাতে মারা গিয়েছিল। সকলেরই সে বৃত্তান্ত মনে পড়লো।
নিষ্ফলা হওয়া এবং যুয়ান বউ ছেড়ে যুয়ান মরদের ঘর ছেড়ে পালানোর মতো গুরুতর অপরাধের সঙ্গে পাঁচ-পাঁচটি ছেলে-মেয়ের অপমৃত্যু কুসুমকে মেঘু আর ওঝার থাবার মধ্যে দ্রুত তুলে দিল। মোড়লের অন্নদাস যৌনব্যাভিচারী ওঝা তেলপাতা পড়ে তার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে গোটা গ্রামকে কুসুমের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে দিল নির্ভুল অঙ্কে।
ভগ্নদূতের মতো এবারেও এই ভয়ঙ্কর সংবাদটি কুসুমকে পৌঁছে দিল ঝাণ্ডিসনা। এবারে সত্যি সত্যি কুসুমের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। মেয়্যালোকের সবেই বদনাম--যুয়ানে কসবী , নইলে ডাহিন! সকালে মেঘুকে ফিরিয়ে দেওয়ার পরিণাম রাতের মধ্যেই এত নির্মম এবং ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে এতটা কুসুম দু:স্বপ্নেও ভাবেনি।

সারারাত দু'চোখের পাতা এক করতে পারলো না কুসুম। সামনে পড়ে থাকা দীর্ঘ ভবিষ্যৎ নিয়ে অজস্র ভাবনা ভাবলো। যেভাবেই হোক তাকে বাঁচতে হবে। ডাহিন অপবাদ মুছে বাঁচতে গেলে মেঘু আর তার অন্নদাস ওঝাকে তার পক্ষে চাই। ঝাণ্ডিসনার সঙ্গেও নানাভাবে শলা করলো কুসুম। শেষ পর্যন্ত সকাল হতে না হতেই সনাকে দিয়ে গোপনে মেঘুর কাছে খবর পাঠালো--রাতে যেন মেঘু একবার চুপিচুপি কুসুমের ঘরে আসে।
অনেকদিন পরে আজ মাথায় ফুলেল তেল মাখলো কুসুম। কপালে আঁকলো মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। দু'হাত ভরে পরলো রঙিন কাচের চুড়ি। গায়ে জড়ালো লাল সিল্কের শাড়ি। কাজল টানলো বড় বড় দু'চোখের কোলে। কুসুমের রূপ এবং দুদ্দার যৈবন দেখে ঝাণ্ডিসনার চোখ ঝলসে গেল। চৈতন তার ওস্তাদ ছিল বলে কুসুমের দিকে আগে সরাসরি তাকায়নি। এমন মেয়্যাকে ছাড়্যে যে মরদ মশুরীর মতো ঢেপসি কদুকে নিয়ে গাঁ ছাড়ে তার জন্যে সনার দুকখুই হয়! এ সনসারে বেজন্মা সনার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই বলেই সে অন্যের দুকখে হচরপচর করে মরে।
অনেক রাতে চাদরমুড়ি দিয়ে কুসুমের ঘরে এল মেঘু। কেরোসিনের ডিবি জ্বালিয়ে আপেক্ষা করছিল কুসুম। মেঘু ঘরে ঢুকতেই সনা বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিল।

মিনিট দশেকের মধ্যেই কথাবার্তা শেষ হয়ে গেল। যেমন নিঃশব্দে এসেছিল তেমনি নিঃশব্দেই মেঘু ফিরে গেল। বুকের মধ্যে নিয়ে গেল একরাশ সুখ-সম্ভাবনা।
পরদিন আবার মিটিন বসলো বুঢ়াশিবের চাতালে। মেঘুই জনতাকে জানালো কুসুমের বয়স অল্প। স্বভাব চরিত্তিরও খারাপ নয়। চৈতনার মা ওর ঘাড়ে ভর করেছে বটে, তবে তাকে ছাড়ানোর পথও আছে ওঝার কাছে। মেঘুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সনাতন ওঝা বললো--
--স্বপুন দেখেছি গয়া যাঁয়ে চৈতনার মা'র পিণ্ডি দিলে বুড়ি কুসুমকে ছাড়্যে দিবেক।
ওঝা কুসুমের কাছে জানতে চাইলো যে সে গয়া যেতে রাজি আছে কিনা। নিস্তারের এর চেয়ে সহজ এবং গ্রহণযোগ্য পথ যে আর খোলা নেই এটা বুঝেই কুসুম বলে ওঠে--
--তুমরা বইলছ যখন যাবো। কিন্তু--
--উসব তকে ভাবতে হবেক নাই। মেঘু মোড়ল উয়ার বাপমায়ের পিণ্ডি দিবেক। আমিও এই মওকায় যাঁয়ে পিণ্ডি দিব। চাঁদু লাপিত, গদাই রসিক, লগেন মাহাতোও সনগে যাবেক--
--আমার সনগে সনাও তাইলে যাবেক--

কথাটা কুসুম বলেই ফেলে। মেঘু আর ওঝায় চোখাচোখি হল। শেষ পর্যন্ত ওঝা এবং মেঘু কুসুমের ইচ্ছে মেনেই নেয়।
মিটিনের বৃত্তান্ত শুনে নামোপাড়ার অহল্যা ছুটে এল কুসুমের কাছে। চৈতনার মায়ের অপঘাতের মৃত্যুর দায় চেপেছিল অহল্যার ঘাড়ে। অহল্যা তখন ভরখর যুয়ান। ঘরের মরদ সাপুড়েদের সনগে বন-বাদাড়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। যখন তখন মহুল গিলে যেখানে সেখানে বেঁহুশ হয়ে পড়ে থাকে। বাঁজা অহল্যার বেওয়ারিস যৈবনের দখল নিতে চেয়েছিল ফেতো লবাব মেঘু। সে তখনো মোড়ল হয়নি। লোকে বলে প্রথম পক্ষের বউয়ের গলায় পা দিয়ে মেঘু মেরে ফেলেছিল।

একদিন বাড়াবাড়ি রকমের উপদ্রব সহ্য করতে না পেরে হাটের মাঝেই বুকে লাথি মেরে মেঘুকে মাটিতে ফেলে মুখে থুথু ছিটিয়েছিল অহল্যা। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই চৈতনার মা জলে ডুবে মারা গেল। মাস না ঘুরতেই অহল্যার মরদও জঙ্গলের মধ্যে খরিশের ছোবলে প্রাণ হারালো। অতএব অহল্যাকে ডাহিন ঘোষণা করলো ওঝা। সমস্ত তেজ দেমাক ভুলে অহল্যা লুটিয়ে পড়লো মেঘুর পায়ের ওপর। চিরস্থায়ী ভোগদখলের গোপন শর্তে অহল্যাও গয়ায় যাবার বিধান পেয়ে প্রাণে রক্ষা পেয়েছিল বটে--তবে গয়ায় সহায় সম্বলহীন অহল্যাকে একা পেয়ে মেঘু ইচ্ছে মতো ছিঁড়ে কামড়ে খেয়েছে। চিরস্থায়ী ভোগদখলের বন্দোবস্ত করে নিয়েছে অহল্যার শরীরটা। তাই ফিরে এসেও অহল্যা আজও মেঘু মোড়লের রাখনী। একথা আজ সবাই জানে।
অহল্যার বিত্তান্ত নিয়ে আবার সারারাত ভাবলো কুসুম আর ঝাণ্ডিসনা। কুসুমের মনে হল একদিকে জল তো অন্যদিকে আগুন। এ দু'য়ের মাঝামাঝি এমন কোনো উপায় নেই যাতে নিজের মতো করে বেঁচেবর্তে থাকা যায়। অনেক ভেবেও চালতাতোড় গ্রামে নিজের মতো করে বাঁচার কোনো পথ খুঁজে পেলো না। হয় মেঘুর রাখনী হয়ে সারাজীবন কাটাতে হবে, না হয় গ্রামের লোকের পাথর বৃষ্টিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মরতে হবে!
শেষ পর্যন্ত শেষরাতে ধানের মরাইয়ের পিছনে টাঙানো ভারি তলোয়ারটা আর একটা পুঁটলি নিয়ে গ্রাম ছাড়লো কুসুম আর ঝাণ্ডিসনা। চৈতন আর মশুরীর মতো এরাও যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এবারেও মেঘু মোড়লের মাথা হেঁট।

এর ঠিক মাসখানেক পরে মেঘু মোড়ল আর সনাতন ওঝার কবন্ধ দেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল নদীর পারে আর বুঢ়াশিবের চাতালে। গোটা গ্রাম তোলপাড়। ছ'মাসের জন্যে পুলিস ক্যাম্প বসলো চালতাতোড় গ্রামে।

পরের মকর সংক্রান্তির সকালে গাঁয়ের তামাম লোক নদীর পারে নির্বাক হয়ে দেখছিল একটি মেয়ে ফুটফুটে এক ছেইল্যা কোলে হাঁটু জল ভেঙে নদী পেরিয়ে চালতাতোড় গ্রামের দিকেই আসছে। তার পরনে হলুদগাবা আলতাপার শাড়ি। কপালে জ্বলজ্বল করছে মেটে সিঁদুরের বড় টিপ। কাছাকাছি হতে সকলেই হৈ হৈ করে পার ভেঙে নেমে এলো নদীতে।
--ই কি গো! তুই ত কুসুম বটিস! তর পেছে পেছে কে বঠে?
--উঠা সনা হে--ঝাণ্ডি সনা!

***

[এই গল্পের অংশবিশেষের জন্যে আমি পুরুলিয়ার বিশিষ্ট কবি ও গল্পকার এবং আমার খুব প্রিয় বন্ধু জ্যোৎস্না কর্মকারের কাছে বিশেষভাবে ঋণী। এ গল্প লেখা সম্ভব হয়েছে জ্যোৎস্নার জন্যেই! -বিশ্বদেব]

সূচীপত্র