রাত্রিভূমি

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।

....................

ট্রাক থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে লতিকা রোজকার মতোই চোখ নাচিয়ে হাসতে হাসতে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে হাত নাড়াল। পাঞ্জাবী ড্রাইভারও লতিকার শরীরের উষ্ণতামাখা ভারী হাত বাতাসে দোলাতে দোলাতে হুস্ করে ট্রাক নিয়ে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই লতিকা পাকা সড়কের মাঝখানে থুঃ-থুঃ করে বার কয়েক থুথু ফেললো। সড়কের পাশের চায়ের দোকানের মাচায় বসে হাতকাটা লালু নিত্যদিনের মতো আজও লতিকার কাণ্ড দেখে ছাই-ছাই অন্ধকারকে চমকে দিয়ে হা-হা করে হেসে উঠলো।
চারপাশে এখন জমাট অন্ধকার না হলেও নিঃস্তব্ধটা বেশ জমাট হয়ে থাকে বলেই লতিকা প্রতিদিনই লালুর হাসি শুনে চমকে ওঠে। দু’চারটে পাখির আচমকা ডানা ঝাড়ার শব্দও স্পষ্ট কানে ভেসে আসে। দু’একটা পাখি ডেকেও ওঠে। ঘুম ভাঙ্গার সময়ও তো হয়ে এল প্রায়।
লতিকা প্রায় টলতে টলতেই লালুর চায়ের দোকানের মাচায় উঠে এসে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। দু’হাতে ভর দিয়ে পিছনে হেলে লতিকা বিপজ্জনক ভঙ্গিতে লালুর দিকে তাকিয়ে তাড়া দেয়--
--চা হল লালন গোঁসাই? নেশা যে আর কাটে না গো !
হাতকাটা লালু লতিকার বিপজ্জনক ভঙ্গিতে শিকারী হয়ে ওঠার বদলে কেমন যেন মমতাময় গুরুজন হয়ে ওঠে। লতিকার ক্লান্ত বিধ্বস্ত শরীরটা মাচার ওপর সযত্নে মেলে দিয়ে মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে ক্লান্তি হরণের ইচ্ছে জাগে লালুর। কিন্তু সব ইচ্ছের কথা বলা যায় না বলেই লালু অন্য কথা বলে--
--অত ছাইপাঁশ গেলো কেন রোজ?
--ছাইপাঁশ গিলি বলেই তো এত টাকা বুকের মধ্যে ভরে নিয়ে আসি গো লালনগোঁসাই !
বলে ব্লাউজের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একমুঠো ঘামে ভেজা নরম বিশ-পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে লালুর চোখের সামনে তুলে ধরে নোটগুলো একটু নাচিয়ে লালুর টিনের ক্যাশবাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করে লতিকা। আজ কি একটু বেশি আমদানি হয়েছে? লালুর মনে হল দু’-আড়াইশো হলেও হতে পারে। নীট লাভ ! সারাদিন চা-বিস্কুট-বিড়ি-সিগ্রেট বেচে লালুর নীট লাভ দেড়-দু’শোর বেশি হয় না। অবশ্য তার জন্যে তার মনে একটুও দুঃখ নেই। তার একলার জীবন তাতেই বেশ কেটে যায়--কোনও অভাব বোধ হয় না। কিন্তু লতিকার টাকার পাই-পয়সার হিসেব তাকে রাখতে হয়। চাইলেই তার হাতে টাকা তুলে দিতে হয়--কত জমা থাকল কেত দেওয়া হল সব হিসেবই লালু ঠিকঠাক লিখে রাখতে ভোলে না। হিসেব রাখে না লতিকাই। কত জমলো কত খরচ হল তা নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা নেই। লালু তাকে ঠকাবে না এই বিশ্বাসটুকু তার কখনো হোঁচট খায় না। লতিকা বলে ওঠে--
--আমার এত টাকা লাগে না গোঁসাই। টাকার নেশাতেই টাকা হাতড়ে মরি। টাকার অভাবেই তো আমি নষ্ট মেয়েমানুষ হয়ে গেলাম -- তাই টাকা কামাতে আর নষ্ট করতে বেশ লাগে গো গোঁসাই !
বলতে বলতে মাচার একপাশে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল লতিকা। পা’দুটো তখনও ঝুলছেই। লালু আর দেরি না করে এক গ্লাস কড়া লাল চায়ের মধ্যে একটা গোটা লেবুর রস চিপে দিয়ে গ্লাসটা লতিকার পাশে রেখে এক হাতের প্রবল শক্তিতে শোয়া থেকে উঠিয়ে বসিয়ে দিল লতিকাকে--
--চা নাও। তাড়াতাড়ি কর--আলো জাগতে আর দেরি নেই।
গাঢ় বিশ্রামের লোভে গড়িয়ে পড়া লতিকা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে চা খেয়ে কাঁচা রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করে। দু’চারটে পাখির ডাকে ডাক মেলাতে শুরু করেছে আরও অনেক পাখি।
লতিকার টাকাগুলো আলাদা করে লতিকার নামে কেনা নতুন টিনের বাক্সে ঢুকিয়ে চাবি দিয়ে দিল লালু। তারপর অপসৃয়মান লতিকার দিকে চোখ রেখে মাচায় বসেই দরাজ গলায় গান ধরল হাতকাটা লালু--‘ভরা গাঙ্গেরে দিয়া রে পাড়ি আইলাম তোমার গাঁও।/ কত নিদ্রা যাও রে কন্যা চক্ষু তুলিয়া চাও। / ভোমরা বরণ কেশ রে কন্যা কমলা বরণ ফুল / সেই সে কন্যা ধুলায় লুটায় ছড়াইয়া এলো চুল / আমার আশার তরী ডুবিয়া গেল রে লাগিয়া গাঙ্গের বাও !’
শ্লথ পায়ে হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর পর্যন্ত লতিকা রোজ এই একই গান শুনতে পায়। শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমন্ত গ্রামের আলো-আঁধারি হঠাৎই ঝাপসা হয়ে যেন গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায়।

 

 

প্রতিদিনের অভ্যাসমতো দরজার তালা খুলতে অসুবিধে হয় না লতিকার। ঘরের পিছনের বাঁশঝাড়ে ততক্ষণে পাখিদের তুমুল চিৎকার শুরু হয়ে যায়। লতিকা সশব্দে দরজা খুলে ঘরে ঢোকে। একটানে শাড়ি খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঘরের এক কোণে। সারা দেহে বিছুটির জ্বালার অস্থিরতায় হাত বাড়ায় দড়িতে ঝোলানো গামছাটার দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই কানে এল পাশের ঘরের আতর পিসির কাশির শব্দ। অর্থাৎ জানিয়ে দেওয়া হল তাঁর ঘুম ভেঙ্গেছে। গামছাটা কাঁধে ফেলে মুখ ভেঙচে লতিকা বলে উঠল--
--ঘাটের মড়ার কান তো নয় যেন জালার ফাঁদ !
প্রত্যুত্তরে কাশির বেগ বেড়ে গেল। লতিকা কল পাড়ে গিয়ে ঘটাং ঘটাং শব্দে জল তোলে আর ঝরঝর করে বালতি বালতি জল গায়ে ঢালতে থাকে। কী শীত কী গ্রীস্ম লতিকার এই ঊষা-স্নানের কামাই নেই। আতর পিসি বিরক্ত হয়। শীতর দিনে লতিকার স্নানের শব্দে বুড়ি কেঁপে ওঠে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে বুকের কাছে হাঁটু চেপে শুয়ে থাকলেও মনে হয় বালতি বালতি জল লতিকা আতরের গায়েই ঢালছে। ভাবতেই শীত যেন হু-হু করে বেড়ে যায়। কাঁপন জাগে হি-হি শব্দে। জল-ঝরণার শব্দের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঝির ঝির করে হেসে ওঠে লতিকা। ক্রুদ্ধ বিরক্ত হতাশ আতর পিসি গজগজ করে ওঠে--
--মরণ আর কি ! কলের জলে কি পাপ ধোওয়া যায় রে মাগী?
--আগ বাড়িয়ে পাপ করি গো পিসি--পাপ ধুতে ভারি দায় আমার ! তাপ নামাই গো--তাপ নামাই !
--মুখে আগুন তোর। শ্যাল-কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়া শরীরের অত দেমাক ভাল নয় রে ছুঁড়ি !
--তা মুখে আগুনটা কে দেবে গো? তোমার গুণধর ভাইপো? সে তো তোমার মুখেই বেঁচে থাকতে জলটুকু দিল না আগুন তো দূরের কথা -- না হয় তুমিই দিও !
আতর পিসির অতঃপর বাক্ রোধ হয়ে যায়, কাশিই প্রবল হয়ে ওঠে। ততক্ষণে লতিকার শরীর জুড়িয়ে আসে। অকারণ বাচালতা হাসি হুল্লোড়ও কমে যায়। চারপাশে দেখতে দেখতে ভোরের আলো ছড়িয়ে পড়ে। মানুষজনের সাড়াশব্দে জেগে ওঠে গ্রাম।
লতিকার কোন কাজ নেই সংসারে। গুণধর ভাইপোর আতর পিসি পেটের দায়ে লতিকার সংসারে রাঁধেবাড়ে। গজগজ করতে করতেই বিছানা ছেড়ে ওঠে। চোখেমুখে জল দেওয়ার আগে ছড়াঝাঁট সেরে নদীতে নাইতে গিয়ে ঘন্টাখানেক গাঁওদেশের খবরাখবর নিয়ে আসে। মাঝে মধ্যে লতিকার দুঃসাহসিক বেহায়াপনার লোমহর্ষক কল্পিত কাহিনীও শুনে আসে। চারিদিকে ছিঃ ছিঃ শব্দ। লোকজন এ বাড়িতে আসে না। সমাজ সামাজিকতাও অনেক কাল আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। অথচ আশ্চর্য্যরে ব্যাপার হল এই যে, লতিকাকে নষ্ট মেয়েমানুষ বললেও, নষ্টামির খবরাখবর জানলেও লতিকাকে কেউ গ্রাম ছাড়ার কথা বলতে পারে না। মাতব্বরদের অনেকেই রাতের অন্ধকারে লম্পট হয়ে উঠলেও দিনের আলোয় সর্বদাই সম্মান হারানোর ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। লতিকার চোপা সকলেই জানে বলেই কেউ প্রকাশ্যে ওকে ঘাঁটায় না। লতিকাও অবশ্য গাঁয়ের কোনো সাতে-পাঁচে থাকে না। দিনভর বলতে গেলে ঘুমিয়ে কাটায়। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার আগে আতর পিসি ঠেলেঠুলে ঘুম ভাঙ্গিয়ে সামনে ভাতের থালা ধরে। কোনোদিন সাটিমাছের ঝোল-ভাত, কোনোদিন পুঁটি চচ্চড়ি। কোনোদিন ইলিশ মাছের কালোজিরে কাঁচা লঙ্কাকাটার পাতলা ঝোল-ভাত।
লতিকা প্রতিদিনই খেতে বসে মুগ্ধ হয়। আতর পিসির রূঢ় গালিগালাজ শক্ত কঠিন চাউনি শাপ-শাপান্ত সব কিছুই মিথ্যে মনে হয়। এক একদিন আচমকাই লতিকা অপ্রস্তুত আতরকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে ডুকরে ওঠে--
--তুই আমার নির্ঘাৎ মা ছিলিস রে পিসি !
সংসারের অসহায় বোঝাস্বরূপ আতর পিসি বোবা হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে জ্বলন্ত মোমের মতো গলে যেতে যেতে দহনের উত্তাপে পুড়ে খাক্ হয়ে যেতে থাকে। দুই ভিন্ন চরিত্রের নারীর মধ্যে নাড়ীর টান দু’জনকেই অজান্তে কেমন করে যেন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কে বেঁধে ফেলে !
আসলে আতর পিসির বুকের ভেতরে সর্বদাই একটা অপরাধবোধ কাজ করে। ভাইপো সুবল দেখে শুনে পছন্দ করে মা-বাপ মরা লতিকাকে বিয়ে করে ঘরে এনেছিল। লতিকার চেহারা ছবিতে তখন আজকের তুলনায় অনেক বেশি পেলবতা ছিল। তখনকার লতিকার যৌবন এত উগ্র ছিল না। চাপা ঐশ্বর্য্যে ঝলমল করত। সুবল আর লতিকার জীবনেও কোন জটিল সমস্যা ছিল না। বলতে গেলে লতিকার প্রতি সুবলের যথেষ্ট টান ছিল। তবু ঘর-সংসার তছনছ হয়ে গেল।
গাঁয়ে সুবলের রোজগার ছিল সামান্যই--অনেকটা নূন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা। সুবল দু’চার বার শহরে গেছে। সত্যিকারের জীবন কাকে বলে দেখে এসেছে। গাঁয়ের জীবনে স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই। টাকা নেই পয়সা নেই ফূর্তি নেই সিনেমা নেই টিভি-ভিডিও নেই। সুবলের মন টিকল না গাঁয়ে। হঠাৎই একদিন ঝোঁক চাপল মাথায় শহরে যেতেই হবে !
লতিকার অনুনয় বিনয়, আতর পিসির কান্নাকাটি সব তুচ্ছ হয়ে গেল। সুবল বোঝালো--শহরে অনেকরকম কাজ আছে। অঢেল পয়সা আছে। শহরে গিয়ে রিক্সা টানলেও অনেক টাকা। সুবল তখন মরিয়া। যাবার আগে বলে গেল, টাকা পয়সা কামাই হলেই লতিকাকে শহরে নিযে যাবে। শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে সংসার পাতবে। লতিকা আর আতর পিসি যেন কোন চিন্তা না করে !
সুবল সেই যে গেল আর ফিরে এল না। লতিকা অপেক্ষায় দিন কাটাতে কাটাতে টের পেল খালি পেটে বেশিদিন অপেক্ষায় থাকা যায় না। খেত খামারে মেয়ে মজদুরের অভাব এখন আর নেই। তুলনায় কাজ অনেক কম। তবুও দু’চারদিন মাঠে-ঘাটে কাজকর্ম করে টেনেটুনে দু’জনের পেট চালাবার চেষ্টা করতে চেয়েছিল লতিকা। শরীরই তার প্রতিবন্ধক হয়ে উঠলো। শরীর এলিয়ে দিলে কাজের অভাব নেই--টাকারও অভাব নেই। কিন্তু সেভাবে লতিকা কাজ পেতে চায় নি।
ভদ্রলোকের বাড়ি বাসন মেজে খেতে গিয়ে টের পেল কাজ না করেও ভরপেট খাওয়া জোটে কাপড় জোটে সিনেমা দেখার সুযোগ মেলে যদি নির্লিপ্ত জলঢোঁড়ার মতো ঝকঝকে যৌবন মেলে দিতে পারে। লতিকা তাও পারে নি।
লোভের থাবা ঝাপটা মেরে যত সরিয়েছে লালসার বিষে লতিকার দিনযাপনের স্বাভাবিক পথ ততই পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। নষ্ট না হয়েও লতিকার গায়ে নষ্টমেয়ের দাগা মেরে দিয়েছে আশাহত নষ্ট পুরুষমানুষগুলো। চারিদিকে ফিসফিসানি। চলাচলের পথে আশে পাশে অকারণ কঠিন চাউনি। প্রথমে আস্তে পরে সশব্দে মানুষের অমানুষিক আঘাত এসে লতিকাকে বিদ্ধ করতে শুরু করল। লতিকা তবু অপেক্ষার দরজায় হেলান দিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে ছিল--হঠাৎই একদিন সুবল ফিরে আসবে !
সুবল ফেরে নি। সুবলেরই বন্ধু হাতকাটা লালু একদিন বলে গেল, সুবল আর ফিরবে না। সুবল এখন ডেরাইভার হয়েছে। তার ওস্তাদের মেয়েকে বিয়ে করে শহরে ঘর ভাড়া নিয়ে নতুন ঘর-সংসার করছে। একটা ছেলেও হয়েছে তার।
লতিকা বিশ্বাস করে নি। আতর পিসি কিন্তু অবিশ্বাস করে নি। সেদিন থেকে আতর পিসি নিজের মনকে বুঝিয়েছিল--লতিকা যা খুশি তাই করতে পারে, করলেও সে বাধা দেবে না। লতিকা নিজে আর একটা বিয়ে করলেও আতর পিসি নিজেই লতিকার মায়ের কাজ করবে। কিন্তু লতিকা হাতকাটা লালুকে গিয়ে ধরলো--
--আমি শহরে যাব। দূর থেকে ওদের দেখে আসব--তোমার কথা ঠিক হলে আমি আর তার কথা কখনো মুখে আনব না।
অগত্যা রাসের মেলা দেখতে যাওয়ার অছিলায় লতিকা হাতকাটা লালুর সঙ্গে শহরে গেল। সুবলকে দেখলো। সুবলের নতুন বউকে দেখলো--তাদের ছেলেটাকেও দেখলো।
লতিকা বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেল। কি আছে সুবলের ঐ নতুন বউয়ের--যা লতিকার নেই ! লতিকার যা আছে তার কতটুকু আছে ঐ মেয়েটার মধ্যে। সমস্ত হিসেব লতিকার গোলমাল হয়ে গেল। লতিকা সেদিনই বুঝলো যা হওয়ার তা হয় না, যা হয় তা হওয়ার কথা থাকে না--তবু সেটাই হয় !

 


লতিকা লাইন হোটেলের ঘরে শরীর বেচে সত্যি সত্যি নষ্ট মেয়েমানুষ হয়ে পেট ভরাবে এমন কথা কি ছিল? তবু কেমন অনায়াসে তা হয়ে গেল ! কত সহজে সন্ধ্যা নামতেই লতিকা সেজেগুজে পাকা সড়কের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতকাটা লালুর চায়ের দোকানে তখন বেশ ভিড় থাকে। কথা হয় না কারুর সঙ্গে। তবে চোখে চোখ রেখে দু’এক মুহূর্তের জন্যে স্বাভাবিক নারী হয়ে ওঠে। ভেতরে কেমন যেন একটা শক্তি একটা সাহসের ঢেউ ওঠে। চেনা ট্রাক এসে থামে। ড্রাইভারের উল্টো দিকের দরজা খুলে যায়। বিশাল একটা থাবা লতিকার কব্জি ধরে ওপরে টেনে তুলে নেয় নিমেষে। হুস্ করে ট্রাক চলে যায় পাকা সড়ক ধরে।
ডুয়ার্সের লাইন হোটেলে এখন রমরমা বাণিজ্য। গভীর রাতে ভিডিওতে নীল ছবি। ভুটানের রাম-হুইস্কি থেকে নির্ভেজাল বাংলা পানীয়ের অঢেল ব্যবস্থা। বিশাল বিশাল সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের ভেতরে--লাইন হোটেলের পেছনের ছোট ছোট দেশলাই বাক্সের মতো খুপরি ঘরে ফার্স্ট ক্লাস সেকেণ্ড ক্লাস অর্ডিনারি ক্লাসের আদিম উত্তেজনার বিকিকিনি! পুলিশ সব জানে। জানে সব নেতা-সাংস্কৃতিক কর্মী-সমাজ কর্মীরাও। চেইন সিস্টেমে সকলেই প্রগাঢ় সমঝোতার শৃঙ্খলে বাঁধা।
গাঁয়ে ঘরের ডিভোর্সি, স্বামী পরিত্যক্তা তরুণী, দূরের শহরের দুঃস্থ তরুণী তো বটেই--গৃহপরিচারিকার কাজের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিত্য দিন এইসব নরকে দিন-রাত্রি কাটিয়ে একমুঠো কাঁচা টাকা-পয়সা নিয়ে যাচ্ছে কত মেয়ে তা এই লাইনে না এলে লতিকার জানাই হত না ! গভীর রাতে লাইন হোটেলের সামনে মাঝে মাঝে ছোট-বড় চার চাকাও থামে। চোখের ইশারায় সবকিছু নিমেষেই হাতের মুঠোয় চলে আসে। এ ব্যাপারে লাইন হোটলেগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। হোটেলের সামনের রাস্তার দু’পাশে সার সার দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের সংখ্যাই হোটেলের ইজ্জতের প্রমাণ দেয়। যেখানে যতবেশি ট্রাক ছোটবড় চার চাকা--সেই সেই হোটেলের ব্যবস্থা তত ভাল। ‘হোটেল সুপার হাইওয়ে’ এই রকমই একটা হোটেল। লতিকা এই হোটেলেরই বিশেষ বাণিজ্য লক্ষ্মী। লতিকা ট্রাকে বা প্রাইভেট গাড়িতে যায় না। হোটেলের পেছনেই লতিকার সাজানো ছোট্ট প্রমোদ কক্ষ !
স্নান সেরে পরিচ্ছন্ন কাপড় গায়ে জড়িয়ে লতিকা দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে আতর পিসির ঘরের দিকে তাকিয়ে গলা চড়াল--
--খাবার কিছু আছে না বাসিমুখেই শুয়ে পড়তে হবে?
--রান্নাঘরে জলভাত ঢাকা আছে, গিলে কেতাত্থ করো গিয়ে। লাটসাহেবের নাতিন এয়েছেন ঘরে। মরণও হয় না আমার !
লতিকা আর দেরি করে না। রান্না ঘরের শেকল খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। বুড়ির বকবকানি এখনই থামবে না, চলতেই থাকবে। সারাদিন ঘরে কথা বলার লোক থাকে না বলে লতিকাকে দেখা মাত্র আতর পিসির কথার বান ডাকে। অজও অনর্থক কথা বলতে বলতেই আতর পিসি ঘরদোরের কাজকর্ম শুরু করে দেয়।
খাওয়ার পর লতিকার ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনও কাজ থাকে না। পোড়া চোখে ঘুমও কি তাড়াতাড়ি আসে? চোখ দুটো জ্বালা করে, চোখের পাতা টেনে তুলতে কষ্ট হয়, তবু সহজে খুব আসে না। গত রাতের যন্ত্রণাদগ্ধ নানা ঘটনার খণ্ডাংশ মাঝে মাঝে অস্থির করে তোলে। বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতেই হাতকাটা লালু কেমন করে যেন তার ভাবনা দৃশ্যের অনেকটা জায়গা জুড়ে বড় হয়ে ওঠে। লালন গোঁসাইয়ের এক হাত সহস্র হাতের দোলনা হয়ে লতিকার শরীরটাকে পালকের মতো ভাসিয়ে নিয়ে দুলিয়ে দিয়ে কেমন করে যেন অনায়াসে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মাটির টানে হাজার হাজার স্রোতে ছুটে আসা ঝরণার মতো তখন ঘুম নামে চোখে--শুধুই ঘুম !

 


বিকেল থেকেই আকাশের মুখ ভারি। মেজাজ টং-এ চড়ানো টিপটিপে বৃষ্টির একঘেয়েমির মধ্যে ঘরে চুপচাপ বসে থাকা দায়। দিনের শেষে অন্ধকার নামলেই দুর্নিবার নেশার মতোই পা দুটো অস্থির হয়ে ওঠে। আনন্দ নেই তৃপ্তি নেই তবু কি যেন এক ভয়ঙ্কর টান অনুভব করে লতিকা। সাজগোজ করে ফোল্ডিং ছাতা হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা দিতেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে আতর পিসি--
--এই দুয্যোগেও কি শ্যাল-কুকুরদের ঘরে মন টেকে না? জাহান্নমে যেতেই হবে?
--দিলে তো পেছন থেকে ডেকে? বলি, তোমার আক্কেলটা কবে হবে বলতে পার--ম’লে?
--তোমার অন্ন যখন গিলছি তখন মরণ কি আর সহজে হবে? পাপের হাঁড়ি ভরতে এখনও অনেক বাকি !
--তবে তাই ভরুক এখন। আমি চললাম। দরজায় ভাল করে খিল দিয়ে ঘুমিও।’--বলে লতিকা টর্চের আলো ফেলে রাস্তায় নেমে গেল হনহন করে।
লালন গোঁসাইয়ের দোকান আজ একদম ফাঁকা। শুধু চা খেতে বৃষ্টির দিনে বিশেষ কেউ লালুর দোকানে আসে না। বৃষ্টি বাদলার দিনে অধরের চোলাইয়ের ঠেকে ভিড় বাড়তে থাকে। কিছুটা দূরেই চোলাইয়ের ঠেক বানিয়েছে অধর। এদিকে পুলিশের কোন ভয় নেই। তবু লালু এসব ব্যাপারে একেবারেই বোষ্টম। গাঁয়ের গরিব মানুষগুলো এমনিতেই আধমরা হয়ে আছে--তার ওপর ঐসব ছাই-পাঁশ গিলিয়ে দু’টো পয়সার জন্যে ঘরসংসারগুলো নষ্ট করার কথা লালু ভাবতে পারে না। অবশ্য সে ঐ ব্যবসা ধরে নি বলে যে আর কেউ সর্বনাশটা করছে না তা নয়। তবু নিজেকে অন্ততঃ অপরাধী ভাবার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলেছে লালু।
--কি গো ললিতে আজও অভিসারে যেতে মন চাইছে?
--কি করি বলো গোঁসাই--এখেনে তো আমার কালাচাঁদের কুঞ্জবন নেই গো !
--কুঞ্জবন বানাতে আর কষ্ট কি? আমার এই কুঁড়ে ঘর কি পছন্দ হয় না? অবশ্য কালাচাঁদের মতো মোহনবাঁশি বাজাতে পারব না। এক হাত খোঁড়া মানুষ আমি--বোঝা মনে হতে পারে !
শেষের কথাগুলোয় আর লঘু সুর বাজল না।
--লোভ দেখিও না গোঁসাই। এই লোভেই মেয়েমানুষের মরণ হয় বার বার। তুমি তো আমার এক মরণের কথা জান !
--জানি বলেই তো ডাক দিই গো ! জীবন থেকে বিশ্বেস উঠে যাওয়ার আগে মাথা উঁচু করেই আমার এই কুঞ্জবনে আসতে পার তুমি।
--লোকনিন্দের ভয় নেই তোমার?
--নিন্দেমন্দ লোকে করে না--করে কু-লোকে। ওতে আমার ভয় নেই।
--আর শ্যাল-কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়া এই শরীরটা?
--কুকুরের মুতে কি গঙ্গা অপবিত্র হয় ললিতে? হয় না। আর শরীর থেকে মনটাকে যদি আলাদা করতে পার তাহলে শরীর আর শরীর থাকে না, হয়ে ওঠে বিগ্রহ। যত পাপ সে তো মনে গো--শরীরের কি দোষ বলো?
লতিকা লালন গোঁসাইয়ের এসব কথা বোঝে না--বোঝার চেষ্টাও করে না। তবে সন্দেহাতীত এক সুস্পষ্ট বোধ ওকে কেমন যেন এক অতি প্রত্যাশিত নিরাপত্তার পবিত্র বাতাস বয়ে এনে দেয়! লতিকা বলে ওঠে--
--তাহলে সত্যিই হয়তো একদিন তোমার ঘাড়ে পেত্নী ভর করবে গো গোঁসাই !
বলতে বলতেই লতিকা বহুদূরের উজ্জ্বল হেডলাইটের আলো দেখে দোকান থেকে নেমে চঞ্চল হয়ে পাকা সড়কের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। ট্রাক আসছে। ট্রাকের শব্দ শুনে আর আলোর তীব্রতা দেখে লতিকা বুঝতে পারে ওটা ট্রাক-ই। দেখতে দেখতে ট্রাকের ইঞ্জিনের শব্দে চারপাশের শব্দগুলো চাপা পড়ে যায়। এমন কী লালন গোঁসাইয়ের শেষ কথাগুলোও শোনা গেল না। ট্রাকের দরজা বন্ধ হতে না হতেই লতিকা নিজের মনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রোজই মনটাকে শরীর থেকে আলাদা করে নিয়ে যুদ্ধে নামে লতিকা--ভয়ঙ্কর সে যুদ্ধ !
আজ সন্ধ্যে থেকেই লোডশেডিং। হোটেলের ভেতরে সাত-সাতটা হ্যাজাক জ্বলছে। খাটিয়াগুলো টানা লম্বা ছাউনির মধ্যে পাতা হয়েছে। জনা পনের ট্রাক-ড্রাইভার রুটি-তরকা নিয়ে খাটিয়ায় গুছিয়ে বসে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব চলেছে। হোটেল লক্ষ্মীদের উপস্থিতি আজ অনেক কম। অথচ চাহিদা আজ বেশি। মনে মনে প্রমাদ গোণে লতিকা !
লতিকার ছোট্ট ঘরে আজ একটা সরু মোম জ্বলছে। শূন্য ঘরে এখানেও লতিকার এই মুহূর্তে কোন কাজ নেই। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল যে কোন একটা গাড়ি ধরে ফিরে যায়। কিন্তু উপায় নেই। এসেই যখন পড়েছে তখন ফিরে যাওয়ার অনুমতি সহজে মিলবে না। আর একটু পরেই কেউ না কেউ এ ঘরে ঢুকবেই। রাত দশটা না বাজলে রাতের হোটেলে এসব শুরু হয় না। ঠিক দশটায় স্থানীয় থানার বড়বাবু’র জীপ টহলে যাওয়ার পথে এখানে দু’এক মিনিটের জন্যে থামে। হঠাৎ কখনো উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসারও সঙ্গে থাকে। যদিও তার চেয়েও বড় কেউকেটা থাকলে হোটেলে অনেক আগেই খবর এসে যায়। সেদিন হোটলে ফাঁকা করে দেওয়া হয়--ছুটি মেলে লতিকার।
হঠাৎই ভেজানো দরজা সশব্দে হাট হয়ে খুলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লতিকা চমকে ওঠে। আচমকা এক ঝলক জোরালো ভেজা বাতাসের ঝাপটায় নিভে যায় মোমবাতি। অন্ধকারে ভেসে এল অস্পষ্ট জড়ানো কণ্ঠস্বর--
--যাঃ শালা ! কী অন্ধকার গো মাইরি ! হাতটা আমার একটু ধরো না গো !
লতিকার স্নায়ু টান টান হয়ে ওঠে। অভ্রান্ত অনুমানে মদের নেশায় চুর লোকটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল লতিকা। হাতটা আঁকড়ে ধরেই নেশাগ্রস্ত লোকটা হুড়মুড় করে লতিকার গায়ের ওপর গড়িয়ে পড়ে। লতিকা গা ঝাড়া দিকেই তক্তাপোষের ওপর লুটিয়ে পড়ে খ্যাক-খ্যাক করে হেসে ওঠে
--মাটিতে ফেলে দিও না কিন্তু ! লেয্য টাকা দেব আমি। অন্য লোকের মতো আমাকেও খাতির যত্ন করবে।
লতিকা অভ্যাসমতো খাতির যত্নের ত্রুটি করে না। বিকারহীন উত্তেজনাহীন অভ্যস্ত শরীর মেলে দেওয়ার নিষ্প্রাণ পর্ব এক সময়ে শেষ হয়। বেসামাল অবস্থা কিছুটা সামলে লোকটা উঠে বসলো। হাসির নামে জঘন্য এক অসহ্য শব্দ ছড়িয়ে লোকটা বলে ওঠে--
--তোমার মুখটাই মাইরি দেখা হল না এখনও। কি কাণ্ড বলো তো !
কথাটা শেষ হতে না হতেই দপ্ করে ইলেক্ট্রিক বাল্ব জ্বলে উঠলো। লতিকার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল লোকটা। চোয়াল দুটো ঝুলে পড়েছে--চোখ দুটো বিস্ফারিত। লতিকার দৃষ্টিতে কোনো চাঞ্চল্য নেই। লোকটাকে দেখছে পলকহীন। লোকটার নেশা কেটে যাচ্ছে দ্রুত। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হচ্ছে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠার আগেই লতিকার গালে ঠাস করে এক প্রচণ্ড চড় কষালো লোকটা। লতিকা তক্তাপোষ থেকে ছিটকে পড়ে যেতে যেতে কোনরকমে সামলে নিল নিজেকে। চড়ের আঘাতে চোখে জল এসে গেল তার।
--আমি তখনই জানতাম তুই নষ্ট মেয়েমানুষ। তোর রং-ঢং দেখে আমার এই সন্দেহই হতো। আমি তোকে না ছাড়লে তুই নিজেই একদিন ঘর ছেড়ে এই বাজারে এসেই দাঁড়াতিস। ছিঃ--থুঃ-থুঃ !
টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে লতিকার শরীরে ও ঘরের মেঝেতে থুথু ছিটোতে থাকে লতিকার একদার স্বামী সুবল ‘ডেরাইভার’। শব্দহীন লতিকা লোকটার মুখের দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছে। এতক্ষণে একটা কথাও সে বলে নি। সুবল প্রচণ্ড ঘেন্নায় লতিকাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গিয়ে নিজেই দেওয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেল। টলতে টলতে দরজার দিকে পা বাড়াতেই লতিকা ছুটে গিয়ে দরজার এক পাল্লায় হেলান দিয়ে অন্য পাল্লাটা ভেজিয়ে দিয়ে শক্ত অবরোধ তৈরি করে আরও শক্ত গলায় বলে ওঠে--
--আমার রেটটা দিলে না?
--রেট?
বিস্ময়ে প্রায় বোবা হয়ে যায় সুবল।
--হ্যাঁ রেট--
বলতে বলতে সুবলের জামার পকেটে হাত ঢুকিয়ে যত টাকা হতে উঠে আসে সবটাই তুলে নিয়ে ব্লাউজের মধ্যে গুঁজে রেখে লতিকা বলে ওঠে--
--তুাম আমার কোন্ পিরীতের নাগর যে টাকা না দিয়ে ফূর্তি মেরে চলে যাবে? লজ্জা করে না?
বলে টলটলায়মান সুবলকে সজোরে এক লাথি কষিয়ে দরজার বাইরে ছিটকে দিয়ে দরজার ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দিল লতিকা।
প্রতীক্ষার রাত্রিভূমিতে সুবলই ছিল তার শেষ খদ্দের !

***

সূচীপত্র

গ্রাফিক্সঃ ইন্টারনেট