রাত্রিভূমিতে ভোর

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।

............ কাল বিকেল থেকে শুরু হওয়া ঘিনঘিনে বৃষ্টিটা শেষরাতের দিক থেকে থেমে গেছে। আকাশ এখন অনেকটা পরিষ্কার। চারপাশে এখনো ছাই ছাই অন্ধকার। গাছগাছালিতে দু'একটা পাখির ডানা ঝাপ্টানোর শব্দও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। চারপাশের এমনই স্তব্ধতার মধ্যে লালন গোঁসাই উনুন ধরিয়ে জলভর্ত্তি বড় কেটলিটা চাপিয়ে দিয়েছে। ভোর ভোর যারা মাঠে ক্ষেতি করতে যায় তারা যাবার পথে লালনের দোকানে চা খেয়ে তবেই যায়।
পাকারাস্তার ধারে বটগাছের নীচে লালন গোঁসইয়ের চায়ের দোকানে মাঝে মধ্যে ট্রাক ড্রাইভাররাও চা খেতে দু'দশ মিনিট থামে। দোকানের পাশ দিয়ে কাঁচা রাস্তা সোজা ঢুকে গেছে গাঁয়ের মধ্যে। পাকারাস্তার দু'পাশেই যত জমি-জিরেত। ফলে লালনের খদ্দেরের অভাব হয় না। পাখির ডাকে চরাচর জেগে ওঠার আগেই লালন গোঁসাই নিত্যদিন গান ধরে গলা ছেড়ে। গলাটি ভারি মিষ্টি। অনেকে এই গানের টানেই সাতসকালে গুটি গুটি দোকানে হাজির হয়।
আজও লালন ফুটন্ত জলের সোঁ-সোঁ শব্দ শুনতে শুনতে গান ধরলো--'ভরা গাঙ্গেরে দিয়ারে পাড়ি আইলাম তোমার গাঁও / কত নিদ্রা যাওরে কন্যা চোক্ষু তুলিয়া চাও / ভোমরা বরণ কেশ রে কন্যা কমলা বরণ ফুল / সেই সে কন্যা ধুলায় লুটায় ছড়াইয়া এলো চুল / আমার আশার তরী ডুবিয়া গেল রে লাগিয়া গাঙ্গের বাও।'
তন্ময় হয়ে গান গাইতে গাইতে অন্য জগতে চলে গিয়েছিল লালন। হঠাৎই একসঙ্গে বটগাছের ডালে ডালে অজস্র পাখি ডেকে উঠতেই চমকে উঠলো। ধরমর করে মাচা থেকে নেমে দোকানের বাইরে বেরিয়ে থ হয়ে গেল। বটগাছের ঝুরি ধরে আপনমনে দোল খাচ্ছে লতিকা। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না বটে--তবে লতিকাকে চিনতে লালনের ভুল হয়নি। পায়ে পায়ে লতিকার কাছাকাছি এসে ভেতরে ভেতরে একটু অবাকই হলো লালন গোঁসাই।
লতিকা আজ নেশা করেনি। শাড়িটাও শহুরে মেয়েদের মতো পরিপাটি রয়েছে। মাটিতে ডান পায়ে ভর দিয়ে বাঁ পা মুড়ে মাটি থেকে শূন্যে ভেসে যাচ্ছে এ মাথা থেকে ও মাথা। চেহারায় ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই। কখন যে ট্রাক থেকে নেমে লতিকা তার দোকানের পাশে চলে এলো লালন টেরই পেল না! কালকের দুর্যোগের সন্ধ্যায়ও লতিকাকে লালন বলেছিল--'কি গো ললিতে, আজও অভিসারে যেতে মন চাইছে?' উত্তরে লতিকা বলেছিল--'কি করি বলো গোঁসাই, এখেনে তো আমার কালাচাঁদের কুঞ্জবন নেই গো!'
--কুঞ্জবন বানাতে আর কষ্ট কি? আমার এই কুঁড়েঘর কি পছন্দ হয় না? অবশ্য কালাচাঁদের মতো মোহনবাঁশি বাজাতে পারবো না। এক হাত খোঁড়া মানুষ আমি--বোঝা ভাবতে পারো!
--লোভ দেখিও না গোঁসাই। এই লোভেই মেয়েমানুষের মরণ হয় বারবার। আমার এক মরণের কথা তো তুমি জানো!
এইসব কথাবার্তা কাল বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় হয়েছে। তখনো লতিকার সারা অঙ্গে ছিল নিত্যদিনের কালি ক্লান্তির ছাপ। আজ সেসব যেন কোথায় উবে গেছে!
--কি গো গোঁসাই আজ চা খাওয়াবে না?
বটের ঝুরি ছেড়ে লালনের সামনে ঝুপ্ করে এসে দাঁড়ালো লতিকা।
--তা তো খাওয়াবো। কিন্তু আজ যেন কেমন কেমন ঠেকছে--
--আজ আমার নরক থেকে ছুটি মিলেছে গো গোঁসাই--
--সুবলের সঙ্গে কি তাহলে--
--কাল রাতে এসেছিল আমার ঘরে। তেজ যদি তুমি দেখতে গোঁসাই! সেই কথায় বলে না--ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারার গোঁসাই? এমন শিক্ষে দিয়েছি--
--সত্যি তুমি শান্তি পেয়েছো ললিতে?
--সত্যি বলছি গোঁসাই--এত শান্তি আমি জীবনে পাইনি গো!
--এখন তাহলে কি করবে?
--ঘরে গিয়ে সিঁদুর মুছে ফেলবো। এই শাঁখা ভাঙ্গবো। তারপর দেখি কি করা যায়--
--কিন্তু--
--লোডশেডিংয়ের অন্ধকারে ফূত্তি লুটে যাবার সময়ে আলো জ্বলে উঠেছিল। আমায় দেখে তার সে কী মূর্তি! টাকা না দিয়েই চলে যাচ্ছিল। তখন আমি কি বলেছি জানো?
--কি?
--বলেছি, তুমি আমার কোন্ পিরীতের নাগর যে টাকা না দিয়ে ফূত্তি মেরে চলে যাচ্ছ? লজ্জা করে না? ...বলে ওর পকেটে যা ছিল সব নিয়ে নিয়েছি।
--তারপর?
--ক্যাঁৎ করে এক লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। সেই থেকে আমার মনের মধ্যে আর কোনো ময়লা নেই গো গোঁসাই।
--চলো, চা খাবে না?
দোকানের দিকে পা বাড়ালো লালন গোঁসাই। লতিকাও দোকানে ঢুকে মাচায় পা ঝুলিয়ে বসলো।
ঝনাৎ করে শেকল খোলার শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই আতর পিসির কাশি শুরু হয়ে গেল। শেষরাতে বুড়ির ঘুম ভেঙ্গে যায় নিত্যদিন। কাশির শব্দ শুনে লতিকাও নিত্য একটা না একটা পিত্তিজ্বলানো বাক্য ছুঁড়ে দেয়। কিন্তু আজ কিছুই বললো না। আতরপিসি কিছুক্ষণ কান খাড়া করে থাকার পর বেশ একটু অবাক হলো। চোর-ছ্যাঁচোর নয় তো? শেষ পর্যন্ত একটু সাড়া নেওয়ার জন্যেই পিসি ঘরের ভেতর থেকেই জিজ্ঞেস করে--
--লতিকে এলি নাকি?
--হাঁ গো পিসি।
ভেতরে ভেতরে তাজ্জব হয়ে যায় বুড়ি। এত মধুমাখা কথা তো কখনো কয় না লতিকা! ক্রোধ ঘেন্না বিরক্তি মেশানো ঝাঁঝালো কথাই তো ওর জিভের ডগায় নাচে। আজ এমন কী ঘটলো--
একটু পরেই যথারীতি কলতলায় ঘটাং ঘটাং শব্দে জল তোলা আর ঝর ঝর করে বালতি বালতি জল গায়ে ঢালার শব্দ শোনা গেল। শীত গ্রীস্ম বর্ষা নিত্যদিন মোরগডাকা ভোরে স্নান করে লতিকা। আতরপিসি গজগজ করে--
--মরণ আর কি! কলের জলে কি পাপ ধোওয়া যায় রে ছুঁড়ি?
লতিকাও সপাটে জবাব দেয়--
--আগ বাড়িয়ে পাপ করি গো পিসি--পাপ ধুতে ভারি দায় আমার! তাপ নামাই গো পিসি--তাপ নামাই!
কিন্তু আজ আর বুড়ি কিছু বললো না। আজ শুধু তাজ্জব হবারই পালা আতরবুড়ির। গায়ে জল ঢালতে ঢালতে লতিকা গুন গুন করে গান গাইছে--'প্রেম বাজারে নাও গো মোরে চালাইয়া গাড়ি
গো মোর প্রেমরসের দড়ি
প্রেমবাজারে যাইবার ইচ্ছা হাতে ছাড়া কড়ি
তূষের অনল বুকে লইয়া ফিরি বাড়ি বাড়ি--'
লতিকার মা কেত্তন গাইতো। লতিকার গলাটাও কান পেতে শোনার মতোই মিষ্টি। গানের মাথামুণ্ডু কিছু স্পষ্ট না বুঝলেও বুড়ির মনে হলো লতিকা আজ পিরীতের গান গাইছে। বিস্ময়ের পর এত বিস্ময় নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকা যায় না। অন্ধকারও পাতলা হয়ে এসেছে বেশ। ছড়াঝাঁট সারতেও কম সময় লাগে না।
বুড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে হকচকিয়ে গেল লতিকার সদ্য স্নানসারা মূর্তির দিকে তাকিয়ে। সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলেছে। হাতে শাঁখা-পলার চিহ্ন নেই। তাহলে কি তার ভাইপো সুবল আর নেই? কয়েক সেকেণ্ড স্তব্ধ থাকার পর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো আতরপিসি। এতবড় সব্বোনাশের পরেও লতিকা পিরীতের গান গাইছে সাত সকালে! বুড়ির বুকফাটা চিৎকারে পাড়া মাথায় ওঠার দাখিল।
--হলো কি তোমার পিসি? সাতসকালে মরণ কান্না জুড়লে কেন? বলি, কে মরেছে তোমার?
--তুই কেন বেধবার সাজ সাজলি রে মুখপুড়ি। আমার সুবল কি--
--তোমার নটবর ভাইপো যমেরও অরুচি পিসি। সে মরেনি। দিব্যি বেঁচে আছে। কাল রাতে আমার হিসেব আমি বুঝে নিয়েছি--আর কোনো সম্পক্ক তার সঙ্গে আমার নেই--
সঙ্গে সঙ্গেই বুড়ির কান্না থেমে গেল। ঘর আলো করা এমন বউ ফেলে সুবল কাঁচা টাকার নেশায় শহরের এক কেলে ধুমসি মাগীর খপ্পরে গিয়ে পড়েছে। পেটের জ্বালায় চেষ্টা করেও সতী থাকতে পারেনি লতিকা। বুকের ভেতর জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে গেলেও আতরবুড়ির কিছু করার ছিল না। তার ক্ষিদেটাও তো লতিকাই মিটিয়েছে!
নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বুড়ি বললো--
--এ একরকম ভালোই হলো রে বউ। নেহাৎ রক্তের সম্পক্ক তাই--
--লাইন হোটেলের নরক থেকে আমি ছুটি নিয়ে এসেছি পিসি। আর কক্ষণো যাবো না--
বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল লতিকা। কাল সন্ধ্যাতেও পিসি বলতে ছাড়েনি--
--এই দুয্যোগেও কি শেয়াল কুকুরদের ঘরে মন টেকে না? জাহান্নমে যেতেই হবে?
--দিলে তো পেছন থেকে ডেকে? বলি তোমার আক্কেলটা কবে হবে বলতে পারো? ম'লে?
--তোমার অন্ন যখন গিলছি তখন মরণ কি আর সহজে হবে? পাপের হাঁড়ি ভরতে এখনও অনেক বাকি!
কথাগুলো মনে হতেই অন্য এক ধরণের কান্না উঠে এলো বুড়ির বুকের ভেতর থেকে। নিজের পোড়া পেটের জন্যে লতিকাকে আর আটকাবে না বুড়ি। নদীতে নাইতে যাবার পথে একটু ঘুরে হাতকাটা লালনের কাছে গিয়ে বুড়ি নিজেই বলবে, দরকার হলে হাতে-পায়ে ধরতেও কসুর করবে না, লালন যেন লতিকার সঙ্গে কন্ঠী বদল করে নেয়। বুড়ি অনেক আগেই টের পেয়েছে লালন লতিকার জন্যে পথ চেয়ে বসে আছে। লতিকাও যতদূর মনে হয় লালনকে পছন্দই করে। ওরা ঘর বাঁধলে ভালোই হবে।
তাঁতের একটা লাল-সাদা ডুরে শাড়ি পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লতিকা দেখলো আতরপিসি দাওয়ায় চুপচাপ বসেই আছে। সামনে এসে দাঁড়াতেই বুড়ি যেন ঘুম থেকে জেগে উঠলো। বেশ লাগছে লতিকাকে। চোখে একটু ধাক্কা লাগলেও লতিকার চোখে মুখে আজ আর সেই শক্ত রূঢ় ভাবটা নেই। চরম অপমানের যোগ্য প্রতিশোধ নিতে পেরে লতিকা এখন ভারমুক্ত গ্লানিমুক্ত হয়েছে। এক রাতেই সে তার হারানো শ্রী হারানো লাবণ্য ফিরে পেয়েছে। সামনে এখন অতি দীর্ঘ পথ। পথ চলার একজন যোগ্য সঙ্গী ওর চাই। কিন্তু যে বদনাম এবং কলঙ্ক লতিকার মাথায় চেপে বসেছে তা থেকে ওকে মুক্তি দিতে সহজে কেউ এগিয়ে আসবে না--
--কি ভাবছো গো পিসি?
--তোর কথাই ভাবছি রে বউ! কি করবি এখন?
--এখন আমি কিছুই ভাবছি না। কপালে যা আছে তা-ই হবে--
--যেভাবেই হোক নতুন করে একটা ঘর বাঁধ--একজন ভালো মানুষ দেখে কন্ঠী বদল করে নে--
--সে না হয় করলাম। কিন্তু তুমি যাবে কোথায়? নটবর ভাইপো বুঝি মাথায় করে নিয়ে যাবে?
আবার কান্নায় গলা বুঁজে এলো আতরবুড়ির। জড়ানো গলায় বলার চেষ্টা করলো--
--আমার একটা পেট যা হোক করে চলে যাবে। তুই আর আমার কথা ভাবিসনি--
আতরপিসির রূঢ় গালিগালাজ, শক্ত কঠিন চাউনি শাপ-শাপান্ত সব কিছুই এই মুহূর্তে একেবারে মিথ্যে বলে মনে হলো লতিকার। আচমকাই অপ্রস্তুত শীর্ণ ক্লান্ত বিধ্বস্ত আতরপিসিকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো লতিকা--
--তোকে আমি মা বলেছি রে পিসি! আমি তোকে ফেলবো কি করে!
সংসারের অসহায় বোঝা স্বরূপ আতরপিসি বোবা হয়ে যায়। ভেতরে ভেতরে জ্বলন্ত মোমের মতো গলে যেতে যেতে দহনের উত্তাপে পুড়ে খাক্ হতে থাকে। দুই ভিন্ন চরিত্রের নারীর মধ্যে নাড়ির টান আর একবার দুজনরেই অজান্তে কেমন করে যেন অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে।
'ওরে আমার মন যমুনা, না পাইলাম তোর তল
জনম ভরি ডুব খাইলাম অথই নদীর জল রে
সাগরের কূলে গেলাম--আছে পাড়ি তার
মন-যমুনার নদীর ঢেউয়ে নাইকো পারাপার রে--'
লালন গোঁসাই গান গাইতে গাইতে এদিকেই আসছে। চারপাশ এখন বেশ পরিষ্কার। কিন্তু সকালের বিক্রিবাটা ছেড়ে এদিকে কেন? পিসি ও লতিকা দু'জনেই চোখ মুখ মুছে পরস্পরের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো।
--সাত সকালেই চলে এলাম পিসি! তর সইলো না--
বলতে বলতে রাস্তা থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ালো লালন গোঁসাই।
--এসো বাপধন। তোমার কথাই ভাবছিলাম--
--আমার মনও তাই বলছিল গো পিসি। তাই তো কাক ডাকতে না ডাকতেই ছুটে এলাম--
--বউকেও বলছিলাম এবার তাহলে--
--পিসি আজ ছড়াঝাঁট নেই বুঝি? কত বেলা হলো দেখেছো?
আতরবুড়ি বুঝলো লতিকার সামনে কথা পারা যাবে না। ওরা দু'টিতে বরং কথা বলুক। পরে না হয় সুযোগ বুঝে কথা বলা যাবে। উঠে পড়লো আতরবুড়ি।
--তোরা কথা বল্। আমার ছিষ্টির কাজ পড়ে আছে--
লতিকা দাওয়ায় একটা পিঁড়ি পেতে দিল। লালন জুত করে বসলো। নতুন সাজে লতিকাকে রাইকিশোরীর মতোই লাগছে।
--মনে আছে ললিতে, আমি একদিন বলেছিলাম, জীবন থেকে বিশ্বেস উঠে যাওয়ার আগে মাথা উঁচু করেই আমার ভাঙ্গা কুঞ্জবনে আসতে পারো!
--মনে আছে। কিন্তু আবারো বলছি গোঁসাই শ্যাল-কুকুরে ছিঁড়ে খাওয়া এই শরীর নিয়ে--
--আমি আবারো বলছি ললিতে, কুকুরের মুতে কি গঙ্গা অপবিত্র হয়? হয় না। শরীর থেকে মনটাকে যদি আলাদা করতে পারো তাহলে শরীর আর শরীর থাকে না ললিতে, হয়ে ওঠে বিগ্রহ! যত পাপ সে তো মনে গো! শরীরের কি দোষ বলো?
--সবাই যদি তোমার মতো করে বুঝতো গোঁসাই!
--যেদিন তোমাকে নিয়ে গোপনে সুবলের নতুন ঘর-সংসার দেখে এসেছি সেদিন থেকেই কেন জানি না আমার মনে হয়েছে তুমিই আমার রাইকিশোরী হবে--
--লোকের কুৎসা--দুর্নাম এসব--
--আমি তোমার পিরীতে মজেছি ললিতে। তোমাকে যে আর কিছুতেই ছাড়বো না। লোকে কুৎসা গাইবে? গাক্ না! আমি বলবো, মারিও না মারিও না মোরে, আমি তো পাগল! পাগলের মনে তো মান-সম্ভ্রমের আশা নেই, আমি যে শুধু তোমাকেই চাই ললিতে!
লতিকা আর লালনের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। হু হু করে দু'চোখ বেয়ে জল নামে। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারে না। লালন গোঁসাই বুঝতে পারে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে লতিকা। সে-ও আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়ে--
--চলি গো প্রাণ সজনী। কুঞ্জ আমার সাজাতে হবে তো!
লতিকা হ্যাঁ না কিছুই বললো না। উঠোনে নেমেই লালন গোঁসাই গান ধরলো—
'আমায় আর কত ঘুরাবি দেশান্তরে
প্রাণসজনী রে
আমায় আর কত ঘুরাবি দেশান্তরে--'



তারপর বেশ কয়েকদিন কেটে গেল। আতরবুড়ি চাতকের মতো লতিকার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এখন একটাই কথা শুনতে চায়--লতিকা কন্ঠীবদলে রাজি। কিন্তু মেয়ের মুখে রা' নেই। লতিকার এখন অখণ্ড অবসর। কত কথাই বলছে, কিন্তু আসল কথাটা বলছে না দেখে আতরবুড়ি ভেতরে ভেতরে ছটফট করে মরছে।
একদিন লালন গোঁসাইয়ের বাড়ি ঘুরে এসেছে বুড়ি। একটা নতুন কুঁড়ে তুলে ফেলেছে লালন। মাটির উঁচু দাওয়ায় মাঝে মাঝে কেত্তনের আসর বসাবার বড় সাধ তার। কুঁড়ের মাথায় নতুন খড়ের চাল। দরজার দু'পাশে নকশা এঁকেছে বড় যত্ন করে। ছোট্ট উঠোনে বানিয়েছে একটা তুলসী মঞ্চ। নধর একটি তুলসী গাছও পুঁতেছে। গোটা বাড়িতে একটা স্বপ্ন যেন ঘুমিয়ে আছে। লতিকা এই আঙ্গিনায় পা দিলেই স্বপ্ন যেন জেগে উঠবে!
লতিকা কিছু বলছে না দেখে শেষপর্যন্ত আতরবুড়ি সরাসরি জানতে চাইলো--
--লালনের কথাটার জবাব দিলি না তো বউ?
--কোন্ কথাটার গো পিসি?
মেয়ের ঢঙ দেখে হাড়পিত্তি জ্বলে গেল আতরবুড়ির। কড়া চোখে লতিকার দিকে কিছুক্ষণ নির্বাক্ তাকিয়ে রইলো। লতিকা বুঝলো বুড়ি এক্ষুণি ফেটে পড়বে। তাড়াতাড়ি সামনে এসে বললো--
--আমার মা কোথায় মরেছিল তুমি তো জানো পিসি!
--বেন্দাবনে। তা হঠাৎ মায়ের কথা কেন?
--ক'দিন থেকেই মনে হচ্ছে গো পিসি! তুমিও তো এই নরক থেকে কোথাও যাওনি। চলো না পিসি মায়ে-ঝিয়ে বৃন্দাবনে যাই?
হাঁ হয়ে গেল আতরবুড়ি! বলে কি মেয়েটা? এই কাঁচা বয়েস, ঘর-সংসার ছেলে-পুলের কথা ফেলে, লালনের মতো সব জেনেও পথ চেয়ে বসে থাকা নাগর ফেলে বেন্দাবনে যাবার বাই চাপলো কেন?
--বেন্দাবনে যাবি! তাহলে লালনের কি হবে?
--কি আবার হবে! তাছাড়া--
--তাছাড়া?
--নিজেকে বড় ঘেন্না হয় গো পিসি! লালন গোঁসাই বড় ভালো মানুষ। নিজের ওপর থেকে নিজের ঘেন্না দূর না হলে ঐ মানুষের ঘরে গিয়ে উঠি কি করে বলো তো?
--কিন্তু--
--বৃন্দাবনে মহাপ্রভুর চরণে গিয়ে কিছুদনি পড়ে থাকি চলো। যদি নিজেকে শেষপর্যন্ত কখনো পাপমুক্ত মনে হয় তখন না হয় ফিরে আসবো। মনের মধ্যে মেঘ নিয়ে ঘর আলো করা যায় না পিসি!
--তুই তো দেখিসনি। তোর জন্যে কত যত্ন করে ঘর-দোর সাজিয়েছে ছেলেটা! বড় দাগা পাবে রে মনে--
--তেমন তরল মনের মানুষ নয় গো পিসি। আমি জানি--
--সত্যিই তুই বেন্দাবনে যেতে চাস বউ?
--হ্যাঁ। আমাকে যেতেই হবে। তোমাকে নিয়েই যাবো।
--মহাপ্রভুর মনে শেষপর্যন্ত এই ছিল!
ট্রেনের বাঙ্কে সব জিনিসপত্র ঘুছিয়ে দিয়ে আতরবুড়ির দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলো লালন গোঁসাই--
--সুস্থ শরীরে ফিরে এসো পিসি।
--ফিরতে আমার ইচ্ছে হবে না বাছা! ওখানেই যেন গতি হয় আমার--
--ফিরতে তোমাকে হবেই পিসি। তোমার কপালে যে আমার আগুন লেখা আছে--
--গাড়ি এবার ছাড়বে গোঁসাই--
লতিকা তাকালো লালনের দিকে। লালন লতিকার দিকে তাকিয়ে হাসলো--
--মনের মধ্যে তাঁকে ধরতে পারলে না ললিতে! এত পথ পেরিয়ে তাঁর শরণ নিতে চলেছো--যাও!
--তোমার কুঞ্জবনে আমি যেন ফিরতে পারি গোঁসাই, এই প্রার্থনাই তুমি কোরো আমার জন্যে।
--প্রার্থনার প্রয়োজন নেই ললিতে। সোজাপথের বদলে ঘুরপথে আসতে চাইছো তুমি। আসলে তো তুমি এসেই গেছো--সত্যি কি না সেটাই যাচাই করতে যাচ্ছ বেন্দাবনে। জানি বলেই আমি বাধা দিলাম না।
গার্ডের হুইসল্ শোনা গেল। লালন গোঁসাই নেমে গেল স্টেশনে।
--এখনো সময় আছে বউ--নেমে যাবি?
--না গো পিসি! দুদিনের জন্যে হলেও ঘুরেই আসি চলো!
ট্রেন ছেড়ে দিল। ক্রমশ: ছোট হতে হতে মিলিয়ে গেল লালন গোঁসাই।

(শেষ)

সূচীপত্র

গ্রাফিক্সঃ ইন্টারনেট