ভৌমপুত্র

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।

.........................

সকালে ঘুম ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গে পারিজাতের মনে পড়ে গেল আজই পারমিতা সেনের সঙ্গে তাকে দেখা করতে হবে। গত কয়েকদিন ধরেই সে মনে মনে তৈরি হচ্ছিল এই জরুরি সাক্ষাৎকারের জন্যে। কথার পিঠে অনেক কথা উঠতে পারে। বলার কথাগুলো স্পষ্ট করে বলবে বলে ঠিক করে রেখেছে পারিজাত। বাইশ বছর আগেকার জীবন সম্পর্কে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই তার জানা হয়ে গেছে। দিনলিপির প্রায় প্রতিটি অক্ষর তার মুখস্থ। এই দিনলিপিই তাকে প্রতি এক বছরে প্রায় দেড় বছরের ম্যাচিওরিটি দান করেছে। ভবিষ্যতে আর কখনো পারমিতা সেনের সঙ্গে তার দেখা হবে কিনা ঠিক নেই। কোথাও কোন অস্পষ্টতা যাতে না থেকে যায় তার জন্যে বেশ কয়েক দিন ধরে নিজেকে তৈরি করেছে পারিজাত।
বিছানা ছেড়ে ওঠার আগেই সুধামামী এক কাপ চা দিয়ে গেছে। সুধামামীর মন ভাল নেই। পারিজাত হাজার হাজার মাইল দূরের পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন টেকনোলজির স্নাতকোত্তর কোর্স করতে যাবে শুনে পর্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে আছে।
নিঃসন্তান সুধামামী পারিজাতকেই নিজের সন্তান বলে মনে করে। সুধামামীর জীবনের এক বিরাট শূন্যস্থান পূরণের অবলম্বন হলেও পারিজাত সুধামামীর অকৃত্রিম বাৎসল্যকে কখনও অস্বীকার করতে পারে না। সন্তান থাকলে সুধামামী এতটাই স্নেহময়ী থাকতে পারতেন কিনা সে সম্পর্কে স্পষ্ট জিজ্ঞাসার চিহ্ন রয়েছে পারিজাতের মনের মধ্যে। তবু সুধামামীর বিষণ্ণতা ওকে ছুঁয়ে যাচ্ছে বার বার।
--পরী, তোর ফোন--
দিবাকরমামার শখের কর্ডলেসটা নিয়ে ঘরে ঢুকল সুধা।
--এত সকালে আবার কার ফোন!
পারিজাত হাত বাড়াল। গম্ভীর সুধা বলল--
--তোর কোন বান্ধবী মনে হয়।
সুধা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর পারিজাত সাড়া দিল--
--পারিজাত বলছি--
--ঘুমুচ্ছিলিস বুঝি? রাত সাড়ে বারোটায় ডিস্কো থেকে ফিরেও আমি সান-রাইজ দেখলাম ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে। অথচ তুই এখনও ঘুমুচ্ছিস!
পৃথার গলা। ঝরঝর করে কথা বলে। ওর নাম কেন পৃথা রাখা হয়েছে পারিজাত ভেবে পায় না। পৃথা যে মহাভারতের কুন্তী এটা সম্ভবত পৃথার মা-বাবা জানেন না। জানলে কেউ এত নাম থাকতে পৃথা রাখবেন কেন? ওর জন্যে কুর্চি নামটা কেন কেউ খুঁজে পেল না! জীবনের সঙ্গে নামের সঙ্গতি নিয়ে খুব বেশি কেউ মাথা ঘামায় না কেন কে জানে! ঘামালে পারিজাতের নাম পারিজাত রাখা হবে কেন? পারিজাত মানে তো স্বর্গের ফুল। পারিজাত বলল--
--ঘুমুচ্ছি না। কিছু বলার থাকলে চটপট বলে ফেল।
--টাকার জোগাড় হল?
পৃথার গলায় উৎকণ্ঠা স্পষ্ট।
--এখনও হয় নি। তবে আজই হয়ে যাবে মনে হয়।
--হাতে একদম সময় নেই কিন্তু! আমার পাসপোর্ট-ভিসা সব রেডি। তোর তো কিছুই হল না এখনও। অবশ্য চিন্তার কিছু নেই। আমার আইএসএস মামা আছে। দু’এক দিনেই সব হয়ে যাবে।
কথা বলার সময় পৃথা দম নিতে জানে না। মাঝে মাঝে ওকে ফলো করতে বেশ হিমশিম খেতে হয়। পারিজাত বলল--
--তাহলে ওই কথাই রইল--
--এই এই ফোন রাখবি না! শোন্ আজই বিকেলে রিং-ব্যাক করে জানাবি টাকার ব্যবস্থা হল কিনা। না হলে আমি বাবাকে বলব।
--তার মানে? তোর বাবা টাকা দেবেন কেন?
--আমি চাইলে দেবে না কেন? আফটার অল আমি বাবার একমাত্র লাডলী বেটি। সবই তো আমার ভবিষ্যতের জন্যেই--
--ঠিক বুঝলাম না তো!
--তোকে বোঝাবার মতো সময় আমার নেই--সরি!
--কিন্তু তোর বাবা একটা বাস্টার্ডকে এত টাকা দেবেন কেন?
পারিজাতের এই আকস্মিক রূঢ় প্রশ্নে প্রচণ্ড ধাক্কা খেল পৃথা। বেশ কয়েক সেকেণ্ড কোন কথাই বলতে পারল না।
--কী হল পৃথা--চুপ করে গেলি তো?
--তুই একটা স্টুপিড পারিজাত। তাই নিজেকে গালিগালাজ করতে তোর ভাল লাগে। এনিওয়ে, আমরা পেনসিলভানিয়ায় যাচ্ছি এটাই আপাতত চূড়ান্ত। বিকেলে ফোন করিস। না হলে আমিই করব। বাই--!
পারিজাত কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিল পৃথা। বেঙ্গালুরুতে একই ইয়ারের ছাত্রী হিসেবে পৃথার সঙ্গে আলাপ। ছাত্রী হিসেবে পৃথা অসাধারণ কিছু নয়। বাবার অগাধ টাকার জন্যেই পৃথা মোটামুটি একটু ভাল মেধা নিয়ে ইচ্ছেমতো পড়াশোনার সুযোগ কিনে নিতে পারছে। কিন্তু মেয়ে হিসেবে ওর কোন তুলনা হয় না। যেখানে যখন হাজির হয় ঝরণার মতো নিজের উচ্ছ্বল উপস্থিতি ঘোষণা করে। সব সময়েই ওর গুণমুগ্ধ সহপাঠীদের একটা বৃত্ত ওকে ঘিরে থাকত। পৃথা কিন্তু মাঝে মাঝেই সেই বৃত্ত কেটে পারিজাতের কাছে পালিয়ে আসত। কলকল করে কথা বলত। শুনতেও চাইত। শুনতে শুনতে একটু একটু করে পারিজাতের সবকিছুই জেনে নিয়েছিল পৃথা।
পারিজাতকে ভাললাগার পেছনে অন্যান্য কারণের মধ্যে যে দুটো কারণ প্রধান ছিল তার একটা হল ওর বয়সের তুলনায় বেশ কিছুটা বেশি ব্যক্তিত্ব এবং দ্বিতীয়টা হল অসম্ভব পড়াশোনার নেশা। মাঝে মাঝে পৃথা তাই অবাক হয়ে বলত--
--পড়াশোনা না করে তোর কাছাকছি থাকলেই পণ্ডিত হওয়া যায় রে পারিজাত!


রবিবার সকাল ন’টায় যে কোন বাড়ির পরিবেশ একটু অন্যরকমই হয়। একটা দিন ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটতে হয় না। জরুরি কথাবার্তা বলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাওয়া যায়। পারমিতা সেনের সঙ্গে দেখা করতে আসার আগে ফোন করে আসে নি পারিজাত। তিনি এমন কিছু কেউকেটা নন যে ফর্মাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে হবে। আর পাঁচজন উপার্জনশীল মহিলার দিন যাপনের সঙ্গে ওঁর বিশেষ কোন পার্থক্য থাকার কথা নয়। মাঝারি উচ্চতার সরকারি চাকরি করেন। স্বামী সুমন্ত সেন একটি ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। ওঁদের একটি ছেলে ও একটি মেয়েও আছে। বেশ পরিকল্পিত গোছানো সংসার!
মেয়ে শ্রীপর্ণাই পারিজাতকে বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলে গেল। এ বাড়ির সকলেই তাকে কমবেশি চেনে। তবু সকলের মধ্যেই একটা আড়ষ্ট অস্বস্তির ভাব গোপন থাকে না। অবাক হয় না পারিজাত। বাইশ বছরের পারিজাতের মধ্যে এমন একটা ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায় যা তার বয়সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় অথচ তাকে উপেক্ষাও করা যায় না। ফলে এই বাড়ির কারুর সঙ্গে তার কোনরকম ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে নি। পারিজাত নিজেও অবশ্য সেরকম কিছু চায় নি।
পারমিতা মাঝে মাঝে পারিজাতের সঙ্গে দেখা করতে বেহালার বাড়িতে যায়। সবদিনই ওর সঙ্গে দেখা হয় না। কখনও দেখা হলেও দু’চার কথা যা বলার পারমিতাই বলে। পারিজাত শোনে। প্রয়োজনে হ্যাঁ বা না ছাড়া বাড়তি কোন কথাই ওর বিশেষ বলার থাকে না। পারিজাতের পড়াশোনার খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় টাকা দিবাকর মামার হাতে দিয়ে যায়।
দিবাকর মামা পারিজাত এবং দিদার খাওয়াপরার জন্যে দাদুর পেনশনের টাকা দাবি করে নি কখনো। দিবাকর মামা এবং সুধামামী দু’জনেই স্কুলটিচার। সংসারে লোকও কম। তাই আইনের কুশ্রীতা কাউকে মলিন করে না।
কিন্তু পারিজাতের এখন অনেক টাকার দরকার। একা দিবাকর মামার পক্ষে এত টাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। মেরে কেটে লাখ দু’য়েক টাকার ব্যবস্থা তিনি করতে পারেন। এর জন্যেও অবশ্য পৈতৃক বাড়ির অর্দ্ধেক দাবি পারমিতাকে ছেড়ে দতে হবে। পারিজাত আমেরিকা চলে গেলে আর ফিরবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে দিবাকর চায় না তারপর এই বাড়ির সঙ্গে পারমিতার কোনরকম সম্পর্ক থাকুক। দিবাকর মামার প্রস্তাব নিয়ে তাই পারমিতার সঙ্গে আজ দেখা করতে আসা।
পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে পারমিতা দেখল পারিজাত ভেতরের দরজার দিকে পাশ ফিরে বসে আছে। কোলের ওপর একটা নীল রঙের প্লাস্টিকের ফাইল রয়েছে। পারিজাতের প্রোফাইল স্পষ্ট দেখা গেলেও ওর মুখের ভাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা যায়ও না কখনও। এমন নিস্পৃহ নির্বিকার মুখ পারমিতা খুব বেশি দেখে না। দূর থেকে দু’এক মুহূর্ত লক্ষ্য করে এগিয়ে গিয়ে পারমিতা মুখোমুখি একটা সোফায় বসল।
--দু’চার দিনের মধ্যে আমি বেহালায় যাব ভাবছিলাম।
পারমিতাই কথা শুরু করল।
--কেন?
--কেন আবার! যেমন যাই----
--ও। আমি ভাবছিলাম--
--তুমি ফোন করে এলে অবাক হতাম না।
--আপনি অবাক হয়েছেন!
--তা একটু হয়েছি বৈকি! আসলে তুমি তো খবর না দিয়ে আস না--
--জরুরি প্রয়োজন ছিল। তাই--
--ঠিক আছে। এটা কোনও ব্যাপারই নয়। তুমি কি কিছু খাবে?
--খেয়ে এসেছি। কিছু লাগবে না।

জরুরি প্রয়োজন সম্পর্কে ভেতরে ভেতরে একটা অনুসন্ধান চালাতে চালাতে পারিজাতকে লক্ষ্য করছিল পারমিতা। বাইশ বছর হয়ে গেল পারিজাতের বয়স। ভাবতে গেলে মনে হয় এই সেদিনের কথা!
পারিজাতের জন্ম নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল অজয়ের। এমনিতেই বিয়ে না করে একসঙ্গে থাকা নিয়ে পারমিতা এবং অজয়ের পরিবারে তুলকালাম অশান্তি চলছিল। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে ওদের ‘লিভ টুগেদার’ বিষয়টাই ছিল মারাত্মক রকমের গা-ঘিনঘিনে ব্যাপার। পরিচিত সমাজে ওদের সহজ স্বাভাবিক গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পারিবারিক উৎসব অনুষ্ঠানে ওরা ছিল অবাঞ্ছিত। ‘লিভ টুগেদার’ করতে গিয়ে ওদের পৃথিবীটাই মারাত্মক রকমের ছোট হয়ে গিয়েছিল। স্রেফ দু’চারজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব ছাড়া ওদের সঙ্গে প্রায় কারুর কোন সম্পর্ক ছিল না।

একেবারেই স্বাধীন সমস্যাহীন জীবনযাপনের স্বপ্ন নিয়ে ওরা একসঙ্গে থাকতে গিয়ে টের পেল স্বাধীন যৌনতা ছাড়া এ জীবনে তেমন কোন আহামরি ব্যাপার নেই বা আকর্ষণও নেই যা নিয়ে সত্যি সত্যি খুব সুখে থাকা যায়। ফলে বছর খানেকের মধ্যেই এই সম্পর্কটা বর্ণহীন যান্ত্রিকতায় ক্লিশে হয়ে উঠল। দু’জনেই প্রতিজ্ঞা করেছিল কেউ বিয়ের দাবি করবে না এবং যখন একজনেরও মনে হবে বিয়ে করাটা জরুরি তখন তারা নিজেরাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

এইরকম একটা অসহনীয় দম বন্ধ করা জীবনে একটু অন্যরকমের বৈচিত্র্য আনার জন্যে পারমিতা সন্তানের কথা ভেবেছিল। অজয়ের তীব্র আপত্তি ছিল এ ব্যাপারে। সন্তান মানেই সাংঘাতিক দায়-দায়িত্ব। স্থায়ী বন্ধন। অজয় পারমিতাকে তাদের বন্ধনহীন জীবনের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিল। কিন্তু পারমিতা সমাজের চিরকালীন প্রথা ভেঙ্গে সংসারে বজ্রপাত ঘটিয়ে ‘লিভ টুগোদার’-এর জীবন বেছে নেওয়ার সাহস দেখাতে পেরেছিল বলেই অজয়কে সাফ জানিয়ে দিল সন্তানের দায় দায়িত্ব সে একাই সামলাবে। তথাপি অজয়ের এ বাপারে ঘোরতর আপত্তি ছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারমিতা একদিন জানিয়ে দিল সে মা হতে চলেছে!

প্রচণ্ড টেনশনের মধ্যেই জন্ম হল পারিজাতের। ওর জন্ম নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা ছিল না। পারমিতা ছাড়া আর কারও মনে এতটুকুও প্রতীক্ষা ছিল না। এমন কী জন্মের মুহূর্তে নার্সিংহোমে অজয়ও পারমিতার পাশে ছিল না!
প্রায় নিঃশব্দেই সদ্যজাত পারিজাতকে নিয়ে ফ্ল্যাটে ফিরেছিল পারমিতা। অজয় তখন ফ্ল্যাটেই ছিল। ভয়ানক গম্ভীর। পারিজাত পেটে থাকতে প্রয়োজনীয় সেবা-যত্ন পায় নি পারমিতা। অসম্ভব জেদ তাকে বিধ্বস্ত করে ফেললেও পারিজাত টিকে গেছে শেষপর্যন্ত। ফলে সন্তানের জন্ম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাময়িকভাবে জৌলুস লাবণ্য ইত্যাদি সব মিলিয়ে গেল পারমিতার শরীর থেকে। গাল ভাঙ্গা কণ্ঠা উঁচু শীর্ণ পারমিতার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেল অজয়। একরাশ বিরক্তি এবং হতাশা ছাড়া অন্য কোন অনুভূতিই সে টের পেল না।
দু’এক সপ্তাহের মধ্যেই পারমিতা টের পেল একটা শিশুকে স্রেফ একরোখা জেদ দিয়ে বাঁচানো অসম্ভব। ছেলের কান্না ভোলানো, কাঁথা পাল্টানো, দুধ খাওয়ানো ঘুম পাড়ানো এবং সদা সতর্ক নজর রাখা ইত্যাদি সবকিছুই চরম বিশৃঙ্খলায় তলিয়ে যাচ্ছিল প্রায়। গোটা ব্যাপারটাই অজয়ের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠায় পারমিতার ঘাড়ে চুক্তিভঙ্গের দায় চাপিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেল পারমিতাকে একলা রেখেই!
শেষপর্যন্ত নিজে বাঁচতে এবং পারিজাতকে বাঁচাতে পারমিতাও তার বেহালার বাড়িতে ফিরে এল। বাবা পত্রপাঠ দরজা থেকেই বিদেয় করে দিতে চেয়েছিলেন। মা ও সুধামামীর জন্যে সেটা না পারলেও এই ঘটনার পর পারমিতার বাবা ছ’মাসও বাঁচেন নি। সংসারে সম্মান হারিয়ে শান্তি হারিয়ে তিনি ভেঙ্গে পড়েছিলেন ভীষণভাবে।

অজয় আর কোনও খোঁজ-খবর নেয় নি। পারমিতাও ওর কাছে কোন মানবিক প্রত্যাশা রাখে নি। ওদের এই দুঃসাহসিক এক সঙ্গে থাকার পেছনে একদিন নিশ্চয়ই ভালবাসা ছিল। কিন্তু প্রচলিত রীতিনীতি ভেঙ্গে অন্যরকমের জীবনযাপন করতে গিয়ে তাদের সেই ভালবাসা বা প্রেম--যাইহোক না কেন, ক্রমাগত বাইরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে হতে একসময় কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল। অথচ সময় মতো পারমিতা সেটা টের পায় নি। পেলে ব্যাপারটা আজ এই জায়গায় আসতে পারত না।
পারমিতার মা এবং বৌদির লালনে পালনে পারিজাত হাঁটতে শিখল। কথা বলতে শিখল। সময়মতো একটা মিশনারি স্কুলে পারিজাতকে ভর্তি করে দিল পারমিতা। অভিভাবক হিসেবে নিজের নাম লিখিয়ে পারিজাতকে দিয়ে দিল নিজের পিতৃ পদবী--পারিজাত হল কাগজেকলমে পারিজাত দাশগুপ্ত। বাইশ বছর ধরে পারিজাত এই পরিচয় বহন করছে।

ঘরে-বাইরে পারমিতার দিনগুলো সে সময় প্রচণ্ড যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে মা আর বৌদি ছাড়া কারও সঙ্গে দু’একটা কথাও হত না। এক সময়ের প্রিয় বন্ধুর মতো একমাত্র দাদা দিবাকরও সামাজিক অসম্মান এবং খোঁচা সহ্য করতে করতে প্রায় নির্বাক্ হয়ে গিয়েছিল। সেই ভয়ঙ্কর দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতে এগিয়ে এসেছিল ওর একসময়ের সহপাঠী সুমন্ত সেন। সমবেদনার পথ ধরে একসময়ে দু’জন দু’জনের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল এবং শেষপর্যন্ত সুমন্তরই আগ্রহে ওদের সামাজিক নিয়েমেই বিয়ে হয়ে গেল!
সবকিছু জেনেশুনেই সুমন্ত এগিয়ে এসেছিল। একটাই শর্ত ছিল সুমন্ত’র--পারিজাত যেমন মামার বাড়িতে মানুষ হচ্ছে হোক। পারমিতা যেমন ছেলের আর্থিক দায়িত্ব পালন করছে করুক। নিয়মিত দেখাশোনাও করুক। কিন্তু নতুন সংসারে পারিজাতকে নিয়ে একই সঙ্গে পারিজাতের ও তাদের নিজেদের জীবনে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা চলবে না।
প্রথমে এই শর্ত পারমিতার কাছে অসম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য মনে না হলেও পরে গভীরভাবে ভেবে দেখেছে সুমন্ত খুব ভুল কিছু বলে নি। এই শর্তে রাজি হওয়ার জন্য পারমিতার মা বৌদিও কম চাপাচাপি করে নি। ফলে পারমিতা ভবিষ্যতের কথা ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিল।

--আমার কিছু টাকার প্রয়োজন।
পারিজাতের কথা শুনে একটু চমকেই ওর মুখের দিকে তাকাল পারমিতা।
--পোস্ট-গ্র্যাজুয়েশন কি বেঙ্গালুরুতেই করবে?
--না। আমেরিকার পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে করব। একটা ফরেন স্কলারশিপ পেয়েছি।
--আমেরিকায়!
অবাক হয়ে গেল পারমিতা। ভাল রেজাল্ট করেছে পারিজাত--কিন্তু এতটাই ভাল করেছে জানা ছিল না।
--হ্যাঁ, দু’বছরের কোর্স ভালভাবে শেষ করতে পারলে ওখানেই ভাল চাকরি হতে পারে।
--ওখানেই সেটল্ করার ইচ্ছে?
--হ্যাঁ, আমার কাছে আমেরিকা ইণ্ডিয়া বা আফ্রিকার মধ্যে কোন ফারাক নেই।
--কিন্তু আমেরিকায় দু’বছর পড়াশোনার খরচ তো অনেক--
--পড়াশোনার জন্যে বিশেষ খরচ লাগবে না। তবে ওখানে থেকে নিজের বই-পত্র এবং অন্যান্য খরচ মিলিয়ে মাসে মোটামুটি সাড়ে চার’শো ডলারের মতো লাগতে পারে--
--সাড়ে চার’শো ডলার মানে--
--কমবেশি পঁচিশ হাজারের মতো। দু’বছরে প্রায় ছ’লাখ।
--কিন্তু এত টাকা আমি একসঙ্গে কী করে জোগাড় করব !
--বেহালার বাড়ির অংশ দিবাকর মামাকে লিখে দিলে দু’লাখ টাকার ব্যবস্থা হবে।
--তবু বাকি চার লাখ টাকাও তো এখন--
--দু’লাখ অজয় বোস দিয়েছে। আপনাকে নগদ দু’লাখ টাকা দিতে হবে।
--তুমি অজয়ের কাছে গিয়েছিলে? ওর নাম ঠিকানা জানলে কি করে? মামার কাছে?
--না, বেহালার বাড়িতে আপনার একটা কাঠের আলমারি আছে। সেই আলমারিতে আপনার কিছু বইপত্রের সঙ্গে একটা ডায়রি আছে। বাইশ বছর আগে আপনি আপনার দিনলিপি লিখে রেখে ছিলেন। তার প্রতিটি অক্ষর আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।
নির্বাক্ বিস্ময়ে পারিজাতের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল পারমিতা। প্রায় স্বগোতক্তির মতো করে বলল--
--তুমি অজয়ের কাছে কেন গেলে? ওর সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক!
--ডিএনএ টেস্ট করলেই সম্পর্কটা প্রমাণিত হতে পারে। স্রেফ বায়োলজিক্যাল রিলেশন। ক্ষেত্রবিশেষে সেটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
--মাত্র বাইশ বছর বয়সেই তুমি এত বড় হয়ে গেলে পারিজাত!
--আপনার ঐ ডায়রিই আমাকে বয়সের চেয়ে অনেক বেশি বড় করে তুলেছে। সেই সঙ্গে অবশ্য পৃথা নামের একটি মেয়েও আমাকে নিজের সম্পর্কে সঠিক চিন্তা ভাবনা করতে সাহায্য করেছে।
--পৃথা তোমার বান্ধবী? কলেজ মেট?
--হ্যাঁ।
--কিন্তু কখনো কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে তোমাকে বাধ্য করবে না বলে তুমি বিশ্বাস করো?
--করি। কারণ, ওর বাবার অগাধ টাকা। ইচ্ছেমতো জীবন যাপনে ওর কোন বাধা নেই। তবু ওর ধারণা, পৃথিবীতে এমন কিছু বন্ধন আছে যার স্বাদ পেলে প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া যায়।
--পৃথা নামটি শুনতে বেশ ভাল। কিন্তু এটা তো কুন্তীর নাম--পৃথা কি তা জানে?
--জানে। নাম নিয়ে ওর কোন মাথাব্যথা নেই। আপনার নাম পারমিতা--অদ্ভুত মনে হয় না আপনার?
--কেন মনে হবে?
--তাহলে পৃথা কেন অন্য মেয়ের নাম হবে--আপনার ভাবতে অবাক লাগে না?
কয়েক সেকেণ্ড অবাক বিস্ময়ের সঙ্গে পারমিতা পারিজাতের চোখ চিবুক এবং কপাল লক্ষ্য করছিল। দৃষ্টি তীক্ষ্ন এবং উজ্জ্বল। দৃঢ় চিবুক এবং উন্নত মসৃণ চওড়া কপাল। পারিজাতের মুখের একটা রেখার সঙ্গেও পারমিতা কিংবা অজয়ের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। এমনটা সচারচর দেখা যায় না। পারমিতা প্রসঙ্গ পাল্টাতে জিজ্ঞেস করল--
--অজয় তোমাকে টাকা দিল?
--প্রথমে দিতে চায় নি। আমি যে কখনো কোন দাবি নিয়ে সামনে হাজির হতে পারি ভাবতেই পারে নি। ভেবেছিল আপনি-ই পাঠিয়েছেন আমাকে।
--বলল এই অসম্ভব কথাটা?
--বলবে না কেন? আমি তো তাকে চিনি না। সেও চেনে না আমাকে। কাজেই--
--অজয়কে চিনতে আমার ভুল হয়েছিল--
--অনেকটা আনাড়ি জুয়ারির মতো। দূরদৃষ্টি বলে যাদের কিছুই থাকে না।
--তবুও টাকা দিল?
--ডিএনএ প্রসঙ্গ তোলার পর অনেকটা বাধ্য হয়েই দিল। আামদের দেশের আইনে অবৈধ সন্তনের দায়িত্বও বায়োলজিক্যাল ফাদারকে বহন করতে হয়। তার আগে অবশ্য আদালতে যেতে হয়। অজয় বোস সেটা একেবারেই চায় নি। বিশেষ করে যখন বুঝল আমি চিরকালের মতো দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি তখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েই দিয়ে দিল।
--আমার সন্তান হয়ে তুমি অজয়ের কাছে যাবে আমি ভাবি নি।
--আমাদের দেশে আট রকমের সন্তানের কথা জানা যায়। স্বয়ংজাত, কানীন, প্রণীত, কৃত্রিম, ক্রীত, পরিক্রীত, দত্ত এবং পৌনর্ভব। আমি আপনার কোন্ শ্রেণীর সন্তান?
পারমিতার চোখমুখ লাল হয়ে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেল কপালে। নিঃশ্বাস নিতেও ওর কষ্ট হচ্ছে।
--এসব তুমি কি বলছ পারিজাত!
--আমি কোন বিবাহিত দম্পতির সন্তান নই অতএব আমি স্বয়ংজাত নই। স্বামীর সম্মতিতে অন্য পুরুষের সৌজন্যে আমার জন্ম হয় নি, সুতরাং আমি প্রণীতও নই। অর্থের বিনিময়ে অন্য পিতামাতার কাছ থেকে আামকে কেনা হয় নি কিংবা কোন অনাথ আশ্রম থেকেও আমাকে আনা হয় নি, কাজেই ক্রীত বা পরিক্রীত সন্তানও নই।
--তুমি চুপ কর পারিজাত। এভাবে তুমি বোলো না--
--আমি নলজাতকও নই, ফলে কৃত্রিম সন্তানও নই। কোন পিতামাতা আমাকে দান করে নি কিংবা আমার মৃত শরীরে প্রাণসঞ্চার করে পুত্র হিসেবে গ্রহণও করা হয় নি, অতএব আমি দত্ত কিংবা পৌনর্ভব সন্তানও নই।
ইতিমধ্যে সুমন্ত সেন ঘরে ঢুকে পড়েছে। চুপচাপ অবাক হয়ে শুনে যাচ্ছে পারিজাতের কথা। পারমিতা একবার অসহায়ের মতো তাকাল ওর দিকে। পারিজাত বলে চলেছে--
--যতদিন আপনি অবিবাহিত ছিলেন ততদিন কানীন পুত্র হিসেবে আমার কর্ণের স্ট্যাটাস ছিল। কিন্তু এখন--
--আমি তোমাকে জন্ম দিয়েছি পারিজাত। তুমি আমার গর্ভজাত সন্তান। তোমাকে আমি নামও দিয়েছি--
--হ্যাঁ, পারিজাত দাশগুপ্ত। কিন্তু এই নামটা একটা হিউম্যান ফিগারকে আইডেন্টিফাই করছিল মাত্র। ওতে কিছুই প্রমাণ হয় না। পিতৃপরিচয় ছাড়া এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমাকে বাস্টার্ড ছাড়া কেউ কিছু ভাববে কি?
--সেই জন্যেই তুমি কোর্ট থেকে এফিডেভিট করে নাম পরিবর্তন করেছ?
--পদবীটা বদল করেছি। আমার এই ফিগারটার একটা আইডেন্টিফিকেশনের প্রয়োজন রয়েছে বলেই একটা নতুন অর্থবহ নাম নিতে হয়েছে।
--কাগজে দেখলাম। পারিজাত ভৌমপুত্র--অদ্ভুত!
পারমিতা তাকাল সুমন্ত’র দিকে। সুমন্ত নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।
--এ ছাড়া আমার আর অন্য কোন নাম হয় কি? আপনিই বলুন!
--আজ আমি তোমাকে একটুও চিনতে পারছি না পারিজাত। ভয়ঙ্কর আশ্চর্য্য লাগছে তোমাকে। কেন পারিজাত?
--হয়তো আমি আপনার মতো হেরে যাই নি বা গুঁড়িয়ে যাই নি--তাই !
এরপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল পারমিতা। পারিজাতও। যেন দু’জনেরই আর কাউকে কিছু বলার নেই। অনেকক্ষণ পরে কথা বলল পারমিতাই--
--তুমি তাহলে সত্যি সত্যি আমেরিকায় সেটল্ করবে? আর ফিরবে না?
--সেটাই আমার ইচ্ছে। অবশ্য আমার কোন নির্দিষ্ট চয়েস নেই। আমার কাছে ইণ্ডিয়া আমেরিকা আফ্রিকা সবই সমান।
ফের ঘরে ঢুকল সুমন্ত। পারিজাতের সামনে এসে বলল--
--তোমাদের কথা কিছু কিছু আমি শুনেছি। তোমাদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে আমার কিছু বলারও নেই। তবু যদি কোনভাবে আমি তোমাদের সাহায্য করতে পারি বলতে পার--
পারিজাত উঠে দাঁড়াল। পারমিতাকে লক্ষ্য করল দু’এক মুহূর্ত। তারপর বলল--
--তাহলে আমি আবার কবে আসব?
--টাকাটা জোগাড় করতে একটু সময় লাগবে--
যথেষ্ট চিন্তিত দেখাচ্ছিল পারমিতাকে। সুমন্ত পকেট থেকে একটা চেক বের করে পারিজাতের দিকে এগিয়ে দিল।
--তিন লাখ টাকার চেক। আপাতত আমার অ্যাকাউন্ট থেকেই দিলাম। ধরো পারিজাত--
--আমার দু’লাখ লাগবে। তাছাড়া--
--পারমিতা পরে এই টাকাটা আমাকে দিয়ে দেবে। তোমাদের অপমান করার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। কিছু বেশি হাতে রাখা ভাল।
--প্রয়োজনে আমাকে খবর দিও পারিজাত।
অনেক কষ্টে উচ্চারণ করল পারমিতা। পারিজাত হাত বাড়িয়ে চেকটা নিল। চোখের সামনে মেলে ধরল। চেকের ওপর সুন্দর করে লেখা রয়েছে--‘পে পারিজাত ভৌমপুত্র!’

***

সূচীপত্র

গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট