হারানো প্রাপ্তি
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
১
দারুণ নকশা কাটা মেহগিনি কাঠের বেলজিয়াম গ্লাস বসানো আলমারির দুটো পাল্লা হাট করে খুলে হাঁ হয়ে গেল তৃষা। পাঁচটা তাকে থরে থরে সাজানো রয়েছে রঙ-বেরঙের দামি দামি শাড়ি, মোটা মোটা কয়েকটা অ্যালবাম, কয়েকটা ছোট-বড় পেতলের কৌটো, রূপোর কৌটো। নকশাদার ছোট্ট আয়না বসানো কয়েকটা গয়নার বাক্স। কয়েকটা দারুণ সুন্দর দেখতে চিনামাটির উজ্জ্বল আলো পিছলানো ছোট-বড় পুতুল ! একটা থাকে কয়েকটা ধুতি, গরদের পাঞ্জাবী শালও রয়েছে। তৃষা বুঝলো এগুলো দাদুর জিনিস। যাতে পোকায় না কাটে তার জন্য ভাঁজে ভাঁজে নিমপাতা রাখা আছে। শুকনো মুচমুচে। ছুঁলেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে।
স্বাধীনভাবে দিদার আলমারি খোলা এই প্রথম। ভেতরটা আড়াল করে বরাবর দিদাই আলমারির পাল্লা খুলে প্রয়োজনীয় জিনিস বের করে দেয় সকলকে। নিজে হাতে চাবি দিয়ে নিজের কাছেই চাবি রেখে দেয়। আজও সেরকমটাই হবার কথা ছিল। কিন্তু কাল বিকেল থেকে দিদার শরীরটা জ্বরে বেজায় কাহিল। মাথা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। এদিকে আজই তৃষা সতের থেকে আঠারোয় পা দেবে। বিকেলে একটা ছোটখাট সুন্দর অনুষ্ঠান হবে। যাতে তৃষার মা-বাবা ওকে পায়েস খাওয়াবে। আঠারোটা মাটির প্রদীপ জ্বালাতে হবে তৃষাকে। থালায় সাজানো আঠারো প্রদীপ দিদার ঠাকুরঘরে বাল-গোপালের সিংহাসনের সামনে তাকেই রেখে আসতে হবে।
একটাও নেভানো যাবে না। কেক কেটে বেলুন ফাটিয়ে জন্মদিন পালনের রেওয়াজ দিদার
কালচারে নেই। মায়ের অবশ্য তেমন ইচ্ছেই প্রবল। কিন্তু বাবা মাকে বুঝিয়েছে,
‘আমরা
ইচ্ছে করলেই সাহেবি কায়দায় মেয়ের জন্মদিন পালন করতে পারি। উনি (দিদা)
বাধা দেবেন না। ওঁর ইচ্ছেটুকু উনি প্রকাশ করেছেন মাত্র,
আমরা ওঁর সেই
ইচ্ছেটুকুকে সম্মান জানাতে কি পারি না?
এতেও তো কম আনন্দ হয় না। সকাল থেকেই
কেমন একটা কাজের বাড়ি কাজের বাড়ি বলে মনে হয় না?’
আসলে মায়ের
জন্মদিনগুলো একেবারে দেশি কায়দায়
পালিত
হয়ে এসেছে বলেই আধুনিক রীতির প্রতি
মায়ের একটা ঝোঁক গোপন থাকে না। কিন্তু যার জন্মদিন নিয়ে এত কথা তার
অর্থাৎ তৃষা নিজের জন্মদিনটাকে তার বন্ধু-বান্ধবদের
তুলনায়
একেবারেই আলাদা
করে দেখতে এবং
এনজয়
করতে ভালবাসে বলেই মায়ের ইচ্ছে বিশেষ বলবতী
হতে
পারেনি।
আজ দিদার অসুস্থতার কথা ভেবে জন্মদিন কোনরকমে নিয়মরক্ষার
মধ্য দিয়ে সারতে চেয়েছিল বাবা-মা দু’জনেই।
দিদার প্রচণ্ড আপত্তিতে তা হতে
পারছে না। যেমন হয় তেমনই হবে। বিকেলের মধ্যে দিদা অনেকটা
সুস্থ
হয়ে উঠবে
বলে দিদার জোরালো ঘোষণার
পর
আর কারুর কিছু
বলার ছিল না। প্রতি জন্ম দিনেই
দিদা তৃষার পছন্দ মতো উপহার দিয়ে থাকেন। এবারে অর্থাৎ তৃষা যখন সতের থেকে
অঠারোয় পা দিতে যাচ্ছে তখন তৃষার পছন্দের
বদলে
নিজের পছন্দের একটা উপহার
দেবেন অনেকদিন আগেই দিদা বলে রেখেছিলেন। আজ তাই তৃষাকেই আলমারি খুলতে
হয়েছে।
মাঝের
তাকের
বাঁ দিকে বেশ কয়েকটা চৌকো
ভেলভেটের
বাক্সের মধ্যে
একটাই নীল রঙের বাক্স রয়েছে। এটাই দিদাকে দিতে হবে। বাক্সটা
টান
দিতেই
হুড়মুড় করে আরও কয়েকটা বাক্স পড়ে গেল। সবার নিচে একটা অসাধারণ কাঠের
বাক্স
নজড়ে পড়লো তৃষার। মাথাটা একটু নিচু করতেই চন্দনের গন্ধ নাকে এলো। দু’হাতে
চন্দনের বাক্সটা তুলে নিল তৃষা। দিদা বললেন--
--কিরে
দিদি,
সব ফেলে দিলি বুঝি?
--এটা
কি চন্দনের বাক্স না কি গো দিদুন?
প্রচণ্ড
অসুস্থতা সত্ত্বেও ত্রস্তে বিছানায় উঠে বসলেন মালবিকা--
--ওটা
নয়,
ওটা নয় ! ওটা কে বের করতে বললো তোকে,
নীল ভেলভেটের বাক্সটা পেলি না?
ওটা রেখে দে দিদি--ওর মধ্যে কিছু নেই।
কিন্তু ততক্ষণে সুদৃশ্য চন্দনের বাক্সটার ডালা
খুলে
ফেলেছে তৃষা।
ভেতরে মূল্যবান কিছুই নেই। ভাঁজ করা কিছু কাগজ রয়েছে। ডালাটা বন্ধ করে
রাখতে গিয়েও কি ভেবে একটা কাগজের ভাঁজ খুলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল
তৃষা।
‘আমার
মালবি’
সম্বোধন করে এক পুরুষের চমৎকার হস্তাক্ষরে লেখা এতো রীতিমতো
রোমান্টিক প্রেম পত্র ! প্রায় পঁচিশ-তিরিশটা চিঠির এক গোপন সঞ্চয় চন্দনের
বাক্সে এত যত্ন করে রেখেছেন দিদা ! মাঝে মাঝে হয়তো রাত জেগে চিঠিগুলো এখনও
পড়েন। মাঝে মাঝেই অনেক রাতেও দিদার ঘরে আলো জ্বলতে দেখা যায়। আচমকা হৈ হৈ
করে ওঠে তৃষা। চিঠির গোছা হাতের মুঠোয়
ধরে
মালবিকার চোখের সামনে ঘোরাতে
ঘোরাতে প্রশ্ন করে--
--কে
এই সোমনাথ দিদুন?
মালবি-কে তো চিনতে পারছি,
কিন্তু এই সোমনাথবাবুটি কে,
দাদুর নাম তো সোমনাথ ছিল না। নাকি তুমি দাদুকে
সোমনাথ বলে ডাকতে?
গোটা
মুখে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে মালবিকার। পাতলা
টুকটুকে ঠোঁট দুটো থর থর করে কেঁপে ওঠে। তৃষা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে দিদার
অসাধরণ সুন্দর মুখের দিকে। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছিলেন না মালবিকা। এই
ষাট
বছর বয়সেও মালবিকার সৌন্দর্য্য দেখে
মধ্য
চল্লিশের অনেক মহিলাও
লজ্জা
পায়। বেশ কিছুকাল মাকে দিদার ছোট বোন বলে লোকের
হামেশাই
ভুল হতো। সেই
মালবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেল তৃষা। মালবিকার
দু’কাঁধে
হাত রেখে
উৎকণ্ঠিত তৃষা জিজ্ঞেস করল--
--তোমার
কি শরীর খারাপ লাগছে দিদুন?
--নীল
বাক্সটা নিয়ে আয় দিদি--
তৃষা
তাড়াতাড়ি নীল ভেলভেটের বাক্সটা মেঝে থেকে তুলে এনে মালবিকার হাতে দিয়ে বললো--
--কি
আছে এর মধ্যে?
সেকেলে প্যাটার্নের ভারি নেকলেস না সীতা হার?
আমার কিন্তু তা পছন্দ হবে না দিদুন।
চশমার
কাচের ভেতরেও মালবিকার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। অত্যন্ত যত্নের
সঙ্গে নীল ভেলভেটের বাক্সটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা নীলাভ সাদা মুক্তোর
মালা বের করে তৃষার চোখের সামনে তুলে ধরলেন মালবিকা।
সোনার পানপাতার ঠিক
মাঝখানে একটা গোল
চুনি
পাথর বসানো লকেট। চুনির তীব্র লাল রেখা তৃষার
নাক
চিবুক গলা গাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। মুগ্ধ তৃষা বড় বড় চোখ মেলে মালাটার দিকে
তাকিয়ে
রইলো।
--তোর
মাকে এর চেয়ে অনেক দামি গয়না দিয়েছি কিন্তু এটা দিইনি। কেন জানিস?
--কেন?
ঘোরের মধ্যেই যেন প্রশ্ন করে তৃষা।
--তোর
মা আমার চেহারা পায়নি। তোর দাদুর
ধরণ
পেয়েছে মেয়েটা। অবশ্য স্বভাবটা তার
মতো হয়নি। যেমনটা হয়েছে তোর মামার। স্বার্থপর,
নিষ্ঠুর দায়-দায়িত্ববোধহীন।
আমার মনে হয়েছিল তোর মায়ের গলায় এই মালা যতটা মানাবে তার চেয়ে তোর গলায়
অনেক বেশি ভাল লাগবে।
--আমি
অনেকটা তোমার মতো দেখতে বলে?
--অনেকটা
নয় দিদি,
তোকে দেখলে আমার মনে হয় আমি যেন তোর বয়সে ফিরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি--
তৃষা মালবিকার কথায় খুশি হয়। বাস্তবিকই
তৃষার
চেহারার মধ্যে যেন
সতের-আঠারোর মালবিকাই ফিরে এসেছেন নতুন করে। মালবিকা তৃষার গলায় মুক্তোর
মালাটা পরিয়ে
দিলেন।
আশ্চর্য্য হয়ে গেলেন তৃষার গলার দিকে তাকিয়ে। গলার
নিচে লকেটটা দুই বুকের মাঝখানে,
একেবারে ঠিক যেখান থেকে দুই পুরুষ্টু বুক
দু’ভাগ
হয়ে গেছে সেখানেই, পানপাতা লকেটের ওপর চুনির তীব্র লালিমা
তৃষাকে
সাংঘাতিক সুন্দর করে তুলেছে।
--আমাকে
তোমার মতো দেখাচ্ছে?
তৃষার
প্রশ্নে চমকে উঠলেন মালবিকা। ওর চিবুক তুলে বললেন--
--আমার
চেয়ে অনেক সুন্দর ! আয়নার সামনে
গিয়ে
দেখে
আয়--
--দাদু
তোমায় এই মালাটা বিবাহ বার্ষিকীতে দিয়েছিল বুঝি?
দীর্ঘশ্বাস
ফেললেন মালবিকা। বললেন--
--আমার
জন্মদিন,
বিবাহবার্ষিকী এসবের কোনো গুরুত্বই ছিলনা লোকটার কাছে। উপহার হিসেবে তার দেওয়া এমন
কিছুই নেই
যা
তোকে দেখাতে পারি।
চোখের কোণ দু’টো
চিক চিক করে ওঠে মালবিকার। মুখটা নিচু হয়ে যায়। চোখের
সামনে ভেসে ওঠে অজস্র জান্তব ভয়ানক দৃশ্য।
কিন্তু
সেসব তো তৃষাকে বলা যায়
না।
--এটা
তাহলে--
--সোমনাথের
দেওয়া। আমার বিয়ের ঠিক আগের জন্মদিনে।
তখনও তো
জানতাম
আমরা কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না। কিন্তু তখন আমাদের ইচ্ছেতে
কিছু হওয়ার ছিল না। ইচ্ছের জোরটাও বোধহয় এখনকার দিনের মতো ছিল না। আমি
ব্রাহ্মণ আর ও কায়স্থ। বিয়ে হতে পারে না। তোর দাদুর সঙ্গে আমার বিয়ে হলো।
বিয়ের পর সোমনাথের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। ফোনে কথা হতো। ঐ
কথা বলার সুযোগটুকু না থাকলে আমি এতদিনে মরে ভূত হয়ে যেতাম। একবারই শুধু
দেখা হয়েছিল আমার দাদার বিয়ের সময়। তোর দাদু সোমনাথের সঙ্গে
আমাকে
একান্তে
মিনিট দুয়েক কথা বলতে দেখেছিল। সেই থেকে শুরু। সোমনাথকে নিয়ে
সন্দেহ।
আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছিল।
মালবিকা ঘোরের মধ্যে যেন তাঁর অতীত ইতিহাস তৃষার সামনে মেলে ধরছেন। তৃষা খুব আস্তে
প্রশ্ন করে--
--তারপরে
আর দেখা হয়নি?
--না।
তবে কথা হত রোজ। একদিন যদি কোন কারণে কথা না বলা হত তহলে আমি অস্থির হয়ে
উঠতাম। ভীষণ অভিমান হত। মনে হত সোমনাথও আমাকে উপেক্ষা করছে!
--দেখা
করতে ইচ্ছে হতো না?
--তোর
দাদু আমার পেছনে গোটা ছ’য়েক
চোখ
নজর
রাখার
জন্যে রেখেছিল। ঘরের মধ্যে তো
ছিলই
তোর মায়ের পিসি। সারা জীবন আমার
হাড়-মাংস
ভাজা ভাজা করে খেয়েছে।
ভায়ের কাছে আমাকে যতভাবে ছোট করা যায় করেছে।
দুই
ভাই-বোনের অত্যাচারে আমার
নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত। স্কুলের যাতায়াতের পথেও তোর দাদুর নজর ছিল। ভয়ঙ্কর
সন্দেহ লোকটাকে যে পাগল করে তুলেছিল সেটাও বোঝার ক্ষমতা তার ছিল না।
--দাদুর
মৃত্যুর পরেও তোমার বয়ফ্রেণ্ডের সঙ্গে দেখা হয়নি?
‘বয়ফ্রেণ্ড’
শব্দটা কানে যেতেই একটু লজ্জা পেলেন মালবিকা। এখনকার
ছেলেমেয়েদের কাছে হয়তো এসব শব্দ কোনও রকম শিহরণ তোলেনা
শরীর
কিংবা মনে।
মালবিকা বললেন--
--তোর
দাদুর মৃত্যুর খবর পেয়ে এসেছিল। আমার সব খবর
রাখতো। আমি জানতাম না। সেই থেকে অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। তারপর হঠাৎ করে কোনো
খবর নেই। তাও কতদিন হয়ে গেল !
--তুমি
কোন খবর নাওনি?
--সাহস
হয় না। আছে কোথাও বেঁচে--এই মনে করেই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিচ্ছি। আমার অনেক স্বপ্ন
ওর কাছে গচ্ছিত আছে রে
দিদিভাই!
--এই
চিঠিগুলো তাহলে--
--হ্যাঁ,
ওরই লেখা।
--তুমি
লেখনি কোনো চিঠি?
--মনের
মধ্যেই অজস্র লিখেছি। খুব লজ্জা হতো। কিছুই কাগজে লিখতে পারতাম না। সোমনাথ
কী চমৎকার চিঠি লিখতো। একালের তোরা হাজার চেষ্টা করলেও ওরকম লিখতে পারবি
না। আমার
বুকের
ভেতরে কথার পাহাড় তৈরি হতো প্রতিদিন। কিন্তু লেখার সময়
কিছুই লিখতে পারতাম না।
--আচ্ছা
দিদুন,
একটা কথার ঠিক ঠিক জবাব দেবে?
লুকোবে না কিন্তু!
--কি
কথা?
--তোমাদের
দু’জনের
মধ্যে কোনরকম ফিজিক্যাল রিলেশন্ তৈরি হয়নি?
তৃষার প্রশ্নে মুহূর্তের জন্যে আমূল কেঁপে উঠলেন মালবিকা। খোলা জানলা
দিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তৃষাদের কালে এসব
প্রশ্নে কোনো দ্বিধা নেই। তাছাড়া তৃষা আজ আক্ষরিক অর্থেই বড় হয়ে উঠছে।
তৃষার সঙ্গে তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলতে কেন যে ভালো
লাগছে কে জানে! তৃষা কি দর্পণে তাঁর নিজেরই প্রতিবিম্ব বলেই?
একটা
দীর্ঘশ্বাস
ফেলে
মালবিকা বলেন--
--সোমনাথ
জোর করলে আমি বাধা দিতে
পারতাম না হয়তো। কিন্তু সোমনাথের চরিত্রে একটা অসাধারণ দৃঢ়তা ছিল। ওরও
দাম্পত্য জীবন ছিল বিষময়। তবু আমার নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের অপেক্ষায় ও
ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে গেল। আমার বুক ফাটলেও মুখ ফোটেনি যে! সোমনাথ আমাকে
আত্মহত্যা করতে দেয়নি। ভয়ঙ্কর সব মুহূর্তে ওর কন্ঠস্বর আর কথাই আমাকে
বাঁচিয়েছে বার বার।
--আমাকে
ঠিকানাটা দেবে?
--সেকি
! তুই তার ঠিকানা নিয়ে কি করবি দিদি?
--দেখতে
ইচ্ছে করছে খুব। তোমার আপত্তি আছে?
--ওমা
! আপত্তি থাকবে কেন?
দেখ ওই চিঠিতেই ঠিকানা আছে।
তৃষা একটা চিঠির ভাঁজ খুলে দ্রুত চোখ বুলিয়ে
উল্টোপিঠে
ঠিকানার খোঁজ
পেল। মনে মনে ঠিকানাটা মুখস্থ করে ফেললো। মালবিকা ম্লান হেসে তৃষার দিকে
তাকিয়ে বললেন--
--ওর
জীবনটাও বড় কষ্টের। তুই ঠিক বুঝতে পারবি। ওর বাড়ির কেউ যদি ছোট-বড় কোন কথা বলে
তাহলে
রাগ হবে না তো?
--দেখা
যাক। আগে খুঁজে তো বের করি !
তৃষা
দরজার বাইরে পা রাখার আগেই মালবিকা বলে ওঠেন--
--ও
যেখানেই থাক বেঁচে আছে,
ভালো আছে,
এই বিশ্বাস নিয়ে আমিও বেঁচে আছি। খোঁজ নিতে বড্ড ভয় করে--
--আমি
বুঝতে পারছি দিদুন। ভয় পেও না,
আমি তোমাকে নিশ্চয়ই ভালো খবর দেব!
২
বার তিনেক কলিং বেল টেপার পর দরজা খুলে যিনি সামনে দাঁড়ালেন তাঁর চোখে
মুখে সারা দুনিয়ার বিরক্তি আর অসহিষ্ণুতা লেপ্টে রয়েছে বলে মনে হল তৃষার।
বছর তিরিশের এই মহিলা মোটামুটি সুন্দরীই ছিলেন বলা যায়। এখন বেশ
ভারি-ভর্ত্তি শরীর সৌন্দর্য্য বেশ কিছুটা ঢেকে দিয়েছে। দরজা থেকে একটুও না
নড়ে প্রশ্ন করলেন--
--কাকে
চাই?
--সোমনাথবাবুকে।
আছেন উনি?
--দেখা
হবে না। থাকেন না এখানে।
--কিন্তু
ঠিকানাটা তো--
--ঠিকই
আছে। ছিলেনও এখানে। কিন্তু বছর পাঁচেক হল তিনি--
তৃষা
চোখ বুঁজে ফেলে। চোখের সামনে দিদুনের মুখটা ভেসে ওঠে। কি বলবে তাঁকে?
ভদ্রমহিলা বলে চলেছেন--
--নিত্যদিন
আমার সঙ্গে অশান্তি না করলে তাঁর পেটের ভাত হজম হত না। কত আর বরদাস্ত করা
যায়! সারাদিন টো টো করে সমাজসেবা করে বেড়াচ্ছেন--ইদানীং তো হাতটানও শুরু
হয়েছিল। সমাজসেবার জন্যে টাকা লাগে না?
শেষপর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে তবে
শান্তি!
--ঠিকানাটা
একটু দেবেন?
বৃদ্ধাশ্রমের চমৎকার বাগানে
ঘোরাফেরা করছিলেন কয়েকজন প্রবীণ মানুষ। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টাও
চলছিল।
একটু ভেতরের দিকে একটা বকুল গাছের নিচে যিনি চুপচাপ বসেছিলেন তাঁর দিকে
তাকিয়েই তৃষার মনে হল ইনিই দিদুনের সোমনাথ। দূর থেকে
খুব
স্পষ্ট চেনা না
গেলেও একেবারে সামনে এসে নিঃসংশয় হল তৃষা।
তৃষাকে দেখা মাত্র অপার বিস্ময়ে টান টান উঠে দাঁড়ালেন সোমনাথ। অস্ফূটে তাঁর মুখ
থেকে বেরিয়ে এল--‘মালবিকা!’
উজ্জ্বল
একমুখ হাসি নিয়ে কলকলিয়ে ওঠে তৃষা--
--যাক্
বাবা! চিনতে পারলে তাহলে--আমি তো ভেবেছিলাম এতদিনে তুমি তোমার মালবিকাকে
ভুলেই গেছ! কিন্তু তোমার এ কি হাল হয়েছে--এত রুগ্ন দেখাচ্ছে কেন?
ঠিকমতো
খাওয়া-দাওয়া কর না নিশ্চয়ই! যাক্গে--চলো তো এখন--হাঁ করে কি দেখছো বলো তো?
আমি তোমাকে নিতে এসেছি--আমি থাকতে তুমি এখানে এইভাবে একলা অনাদরে থাকবে
কেন?
বুকের মধ্যে প্রবল ঝড় বইতে শুরু করে দিয়েছিল
তৃষাকে
দেখা
মাত্রই। এখন ওর নিরবিচ্ছিন্ন কথা শুনতে শুনতে সোমনাথের শরীর ও চেতনা বিবশ
হয়ে পড়ছিল। দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা হারিয়ে ঝুপ করে বসে পড়লেন তিনি। বুঝতে
পারছিলেন হুবহু মালবিকার মতো দেখতে হলেও এ মালবিকা নয়--তবে কি এ মালবিকার
মেয়ে?
প্রায় সদ্য তরুণী মালবিকার মেয়ে কি করে হবে?
নাতনি?
হতেও পারে। যদি
হয় তাহলে বুঝতে হবে এ মেয়ে তার ও মালবিকার অতীত জানে এবং এ মেয়ে অসম্ভব
রসিকাও বটে! কেমন অবলীলায়
মালবিকার
ভূমিকায়
অভিনয় করে চলেছে!
আকস্মিকতার ঘোর কাটতে বেশ একটু সময় লাগল সোমনাথের। মালবিকা যে এভাবে
১৮
বছরের রূপ ধরে কোনো দিন যে তার সামনে এসে দাঁড়াতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবেন
নি। মালবিকা অবশ্য এই বয়সে এত উচ্ছ্বল ছিল না। তার অসাধরণ ব্যক্তিত্ব তার
রূপকে আরও মহার্ঘ্য করে তুলত। সংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মালবিকার হাত
ধরে অনিশ্চয়যাত্রায় পা বাড়ানোর মতো সামান্য সাহসের অভাব সোমনাথের সর্বস্ব
কেড়ে নিয়ে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিয়েছিল। আজও তিনি নিঃস্ব এবং পুরোপুরি
ব্যর্থ
এক মানুষ। একটু
হাসার চেষ্টা করলেন সোমনাথ। হাসিটা যে ঠিক ফুটলো না তা তিনি অনুভব করলেন। গলাটা
একটু ঝেড়ে বললেন--
--কোথায়
নিয়ে যাবে আমাকে?
--কেন,
আমার বাড়িতে--এতদিন তোমার ঠিকানা আমার জানা ছিল না। তা ছাড়া
সাহসও
তো ছিল না আমার! ছিল না স্বাধীনতাও--কি করব বলো?
সোমনাথের বুকের ভেতর পাহাড় ভাঙছে। এ মেয়ের নামটাও জানা হয়নিএখনো।
তাঁর
মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যি যদি মালবিকা তাঁর সামনে হঠাৎ এসে দাঁড়াতেন তাহলে
অবিকল
এইভাবেই কথা বলত হয়তো। অন্তত তেমনটাই বিশ্বাস করতে চাইছিলেন সোমনাথ।
ভেতরে ভেতরে একটা নিশ্চিত ধারণায় পৌঁছে সোমনাথ শেষপর্যন্ত বলতে পারলেন--
--তোমার
নামটা কিন্তু এখনো আমাকে বল নি দিদিভাই--
--কেন,
আমার নাম কি মালবিকা হতে পারে না?
বয়েসটাই যা এখনো আঠারোতেই আটকে
আছে--ভগবানের ইচ্ছের ওপর তো মানুষের কোনো হাত নেই! কিন্তু তোমার ব্যাপারটা
কি বলো তো--আমাকে বুঝি পছন্দ হচ্ছে না?
এবারে সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন সোমনাথ। তৃষার মাথায় হাত রেখে বললেন--
--তুমি
অবিকল মালবিকা হয়েই এসেছো--অপছন্দ করি এমন সাধ্য আমার কোথায়! তবু তোমার
নামটা বলো দিদিভাই--তুমি যে মালবিকার অতি আদরের নাতনি তা আমি বুঝেছি--
--আমার
নাম তৃষা। আচ্ছা সোমদাদু,
হঠাৎ এইভাবে যদি দিদুনের সঙ্গে তোমার দেখা হয়ে
যেত তাহলে কি দিদুন আমার মতোই এভাবে কথা বলতো না?
আমি কয়েক মুহূর্তের
জন্যেও কি দিদুন হয়ে উঠতে পারি নি?
--বললাম
যে,
অবিকল মালবিকা হয়েই তুমি হঠাৎ আমার সামনে এসে আমাকে ভীষণভাবে চমকে দিয়েছ--
--তাহলে
আর কোনো কথা নয়--যদি কিছু নেওয়ার থাকে গুছিয়ে নাও--আমার সঙ্গে যেতে হবে--
--না
না,
তা কি করে হয়?
তোমার মা-বাবা কি ভাববেন?
এই বৃদ্ধ বয়সে নতুন করে
কাউকে
আর বিব্রত করা সম্ভব নয়--
--আজ
আমার জন্মদিন। তোমাকে খুঁজে পেতে পেতেই বেলা শেষ হয়ে গেল। এতক্ষণে আমার
জন্যে সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে--আর দেরি কোরো না সোমদাদু--আমি তোমাকে না নিয়ে
যাব না--
--বিপদে
ফেলে দিলে দিদিভাই! ঠিক আছে,
জন্মদিন বলে কথা--তোমাকে
আশীর্বাদ করে ভালমন্দ খেয়ে আসব নিশ্চয়,
কথা দিলাম--তুমি আর দেরি কোরো না
দিদিভাই। তুমি যাও আমি সময়মতো ঠিক হাজির হব--
--তোমাদের
নিয়ে আমরা
একালের ছেলেমেয়েরা আর পারি না কেন জানো?
তোমাদের বুকের মধ্যে শেকড়বাকড়
ছড়ানো অচল ধ্যান-ধারণাগুলো আমরা কিছুতেই উপরে
ফেলতে
পারি না--ঠিক আছে,
কথা
দিলে তুমি কথা রাখ তা আমি জানি। তবে ঠিক সময়ে একটু সেজেগুজে এসো বাপু!
হাসিমুখে ঘাড় নাড়লেন সোমনাথ। অপ্রস্তুত সোমনাথকে ফের একবার চমকে দিয়ে
তৃষা ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। প্রণামের জন্য নিচু হতেই বুকের ভেতরে
এতক্ষণ অদৃশ্য থাকা পানপাতা লকেটটা বেরিয়ে এল। অবাক বিস্ময়ে তিনি
বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত মানুষের মতো দিগন্ত ঝলসানো চুনি পাথরটার দিকে তাকিয়ে
রইলেন।
মালবিকার
কণ্ঠে তিনি নিজে এই লকেটযুক্ত চেনটা পরিয়ে দিয়েছিলেন।
অসাধারণ সেই সৌন্দর্য্যের দ্যুতি এখনো তাঁর চোখে লেগে রয়েছে। মালবিকা
এতদিনএটাকে যত্ন করে রেখেছিল! তৃষা সোমনাথের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল--
--দিদুন
এটা আজই আমাকে পরিয়ে দিয়েছে। খারাপ লাগছে?
--চমৎকার
লাগছে!
তৃষা চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ চুপচাপ বকুল গাছের নিচে বসেছিলেন সোমনাথ।
মালবিকা আর তাঁর বিচিত্র সম্পর্ক নিয়ে ভাবছিলেন। পরিণতিহীন একেবারেই ব্যর্থ
এক সম্পর্ক তাঁকে চিরকাল তাড়িয়ে নিয়ে গেলেও প্রায় বায়বীয় সেই
সম্পর্কের
শেকল যে আজও ছিঁড়তে পারেন নি তা মর্মে মর্মে অনুভব করছিলেন সোমনাথ। তৃষার
জন্মদিন উপলক্ষ্যে তো দীর্ঘকাল পরে মালবিকার মুখোমুখি হতে পারবেন তিনি। এখন
তো আর কোনো ভয় নেই--কোথাও কোনো ভুল বোঝারও সুযোগ নেই আর! সোমনাথ তৈরি
হওয়ার জন্য উঠে পড়লেন।
গল্পটা এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু
হয় নি। তৃষা সাংঘাতিক এক সারপ্রাইজ পার্টির ব্যবস্থা করেছিল। ওর মা-বাবাও
যুক্ত ছিল ওর পরিকল্পনার সঙ্গে। তৃষা এই প্রজন্মের মুক্তমনের মেয়ে। ওর
যুক্তি তর্কের কাছে তাদের হার মানতে হয়েছে। কিন্তু তার জন্যে কোনো ক্ষোভ বা
দুঃখ নেই। তৃষার জন্মদিনের পার্টিতেই সকল অতিথি অভ্যাগতকে সামনে রেখে
সোমনাথের সঙ্গে মালবিকার রীতিমতো আইন সম্মত বিয়ে হয়ে গেল! দু’দুটো
আদিগন্ত
শূন্য জীবনকে মিলিয়ে দেওয়ার ভাবনা শুধুমাত্র একালের তৃষারাই ভাবতে
পারে--যতই ওদের জীবনযাপনের রং-ঢং নিয়ে প্রশ্ন তুলি না
কেন! নাটকীয়
আকস্মিকতায় প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিলেন মালবিকা। কিন্তু হারান নি--সোমনাথই
তাঁকে অচেতন হতে দেন নি শেষপর্যন্ত!
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট