স্বচ্ছ্বতোয়া ও সুজনসখা
১
কমনরুমের
জানলা দিয়ে বাইরের কৃষ্ণচূড়া গাছটা স্পষ্ট দেখা যায়।
কিছুদিন আগেও
পাতাগুলো বেশ ঝকঝকে সবুজ
ছিল। শরতের সোনালি রোদ পিছলে পড়তো ওদের গা থেকে।
হেমন্ত’র এই মাঝামাঝি সময়ে পাতা
গুলোর যে মন ভালো নেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়
ওদের চেহারা থেকেই। ঝরে পড়ার সময় ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। মানুষের জীবনের মতোই।
মেয়েদের পরীক্ষার খাতা থেকে
না-লেখা পৃষ্ঠা কিছু সংগ্রহ করে রাখে
স্বচ্ছ্বতোয়া। সকলেই রাখে। তবে একই উদ্দেশ্যে সবাই রাখে না। স্বচ্ছ্বতোয়া
কবিতা লেখে। গদ্যও লিখতে হয়
মাঝে মধ্যে। এখানে সেখানে কিছু কবিতা গল্প
প্রবন্ধ ছাপা হওয়ায় মাঝে মাঝে অনুরোধের দাবি মেটাতে হয়। লিখতে ওর ভালোই
লাগে। জীবনে আর আছেটাই বা কি?
স্কুলের নোংরা রাজনীতি,
কুৎসিত দলাদলি আর
একের আড়ালে অন্যের কেচ্ছা নিয়ে ছ’টা পিরিয়ড কাটিয়ে দৌড়ে বাড়ি ফেরা। বাড়ি
ফিরেই সেই মলমূত্রঘাটার জীবনে তলিয়ে যাওয়া। যদিও
স্বচ্ছ্বতোয়া জীবনে সেই
অর্থে সংসারের ঘানি টানার যন্ত্রণা নেই। সময়ে বিয়ে না হওয়াটাও অনেকের চোখে
নারীত্বের ব্যর্থতা হিসেবে
চিহ্নিত হয়। সুযোগ পেলেই আহা-উহু করতে কেউ ছাড়ে
না। উপদেশ পরামর্শও কম জোটে না। স্বচ্ছ্বতোয়ার গায়ের রং শ্যমলা। গড় উচ্চতার
চেয়ে সামান্য খাটো। কিন্তু
কি ছাত্রী হিসেবে কি দিদিমণি হিসেবে সে কারও
চেয়ে কম তো নয়ই বরং বেশ কিছুটা এগিয়েই আছে। লেখা-লেখিও করে । যদিও মলমূত্রে
নিমজ্জিত থেকে যারা তথাকথিত
সংসার করে চলেছে তাদের কাছে এসবের কোনো মূল্য
বা গুরুত্বই নেই।
কৃষ্ণচূড়া পাতাগুলোর সঙ্গে
তার জীবনের এই সময়টার কি
কোন মিল আছে?
তার জীবন থেকেও কি অমূল্য কিছু নিঃশব্দে ঝরে যাওয়ার
অপেক্ষায়
প্রহর গুণছে?
স্বচ্ছতোয়া প্রায় আধঘন্টা বসে বসে মাত্র দু’টো লাইন লিখেছে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই টিফিনের ঘন্টা পড়বে। গোটা কমনরুম
কলকল করে উঠবে। এ ওর
লেগ-পুলিং করবে। সদ্য জয়েন করা ছোট ছোট মেয়েগুলো বিবাহিত সেইসব সিনিয়র
কলিগদের গা ঘেঁষে বসবে যারা
তাদের গত রাতের রহস্য রোমাঞ্চে ভরপুর দাম্পত্য
জীবনের কল্পিত প্রায় নীলছবির বর্ণনা করবে। স্বচ্ছ্বতোয়া জানে এইসব গল্পের
নব্বই শতাংশই অবদমিত তৃষ্ণার
ছায়াছবি মাত্র। কিন্তু অল্পবয়সী মেয়েগুলোর
কাছে সে সবই নিষিদ্ধ সিনেমার মতোই তীব্র নেশা জাগায়।
স্বচ্ছ্বতোয়া
স্বপ্ন দেখার সময়গুলোতে স্বপ্ন দেখেনি এমন কথা অবশ্য বলতে
পারবে না। স্বপ্ন
দেখার সময় এখনও তো যায়নি। যায়নি বলেই এমন একজনের স্বপ্ন মনের মধ্যে থেকে
থেকে জেগে ওঠে যেখানে
স্মিতহাসি নিয়ে সেই একজন এসে দাঁড়ায়, যে তাকে বোঝে।
তার অনুভব উপলব্ধিকে সমীহ করে। হ্যাঁ এমন একজনের জন্য তার অপেক্ষা মনের
গভীরে কোথাও রয়ে গেছে।
একটা সময় ছিল যখন বিয়ের
প্রশ্নে তার বেশ কিছু
নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ ছিল।
ডাক্তার ইঞ্জিনীয়ার কিংবা নিদেনপক্ষে কলেজের
অধ্যাপক। বয়েসটাই তো তখন তেমনই ছিল যখন নিজের ইচ্ছেটাকেই বড় করে দেখা ছাড়া
অন্য কোনো বোধ কাজ করত না।
তখন একবারও মনে হয়নি তার জীবনে একজন প্রকৃত
মানুষ চাই। মানুষের সন্ধান করতে তার বেশ দেরি হয়ে গেছে। তার মাশুল গুণতে
হচ্ছে ঘরে বাইরে। বাড়ির
সকলের মুখ ভার। কলিগরা দুশ্চিন্তার মলাটের নিচে
সর্বদাই লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে তাদের নিজেদের গৌরবগাথা। একজনকে
‘গেঁথে
তোলা’র অক্ষমতা মেয়ে হিসেবে কম
ব্যর্থতা নয়। এসব পাত্তা না দিতে চাইলেও তার
ভুলে থাকার উপায় নেই।
টিফিনের ঘন্টা পড়তেই কমনরুম
হাটের চেহারা পেয়ে
গেল। স্বচ্ছ্বতোয়া দু’লাইনের অসমাপ্ত কবিতাটা ভাঁজ করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে
রাখলো। অনুরাধা একটু হেসে
বললো--
--আজ ক’টা নামলো রে তুয়া?
পারিসও বটে। কলম ধরলেই এত সব কাব্য নামে কি করে কে জানে !
--চেষ্টা
তো করলি না কখনো। মোটেও কঠিন নয়--
--কঠিন
নয় মানে?
আমি তো এখনকার কোনো কবিতার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি
না। লেখা তো দূর অস্ত!
টিফিনের
পেল্লায় বাটি বের করে অনুরাধা। বছর তিনেক হলো বিয়ে হয়েছে।
বরও মাস্টারী
করে।
ওর বর ওকে কেমন ভালোবাসে,
ওর বিরহে চোখে কেমন অন্ধকার
দেখে এবং সুযোগ
পেলই কেমন লোমহর্ষক দুষ্টুমি
করে সেসব ন্যাকা ন্যাকা ভঙ্গিতে যখন শোনায় তখন
সকলেই যে দারুণ আগ্রহ নিয়ে শোনে তা নয়,
তবু সাজানো-গোছানো বলার মধ্যে দিয়ে
নিজের আকাক্সক্ষার তীব্রতাটুকু মিশিয়ে বিষয়গুলোকে
বাস্তোবচিত করার চেষ্টা
করে। নিশ্চয়ই ভালো লাগে ওর। ইতিমধ্যেই ওর কোমরে ভাঁজ পড়েছে দু’টো। ফিগার
স্ট্যাটিস্টিকস্ চেঞ্জ হয়ে গেছে। খুব তাড়াতাড়ি গলার নিচে থেকে হাঁটু
পর্যন্ত পুরুষের মুখ্য
বিচরণভূমির প্রায় সবটাই আয়তক্ষেত্রিক হয়ে উঠবে। ওর
সৌভাগ্য যেভাবে শরীরে প্রকট হয়ে উঠছে তা দেখে শর্মিষ্ঠাদি একদিন বলেই
বসলো--
--সৌভাগ্যের
অ্যাসেট কিন্তু তোর এই শরীর। এখনও যদি সতর্ক না হোস তা হলে সব সুখ জানলা দিয়ে
পালাবে। তখন বুঝবি মজা !
--তোমরা
ওকে চেনোই না। আমার জন্যে পারে না এমন কোন বিষয়ই নেই ওর কাছে।
--নড়তে
চড়তে যখন হাঁফ ধরে যাবে
কিংবা দু’একটা বাচ্চার ধকল সামলাতে গিয়ে কণ্ঠা বসে
যাবে,
ব্লাউজ ঢিলে হয়ে যাবে,
কপালের ওপর টেনে চুল নামাতে হবে। তখন
টের পাবি
কত ধানে কত চাল!
--নিজের
অভিজ্ঞতা থেকে বলছো বোধহয়?
--যদি
তাই হয় তাহলে কি যা বললাম তা মিথ্যে হয়ে যাবে?
সেদিনের পরিবেশটা মুহূর্তের মধ্যে কেমন যেন বিষাক্ত মনে হয়েছিল স্বচ্ছ্বতোয়ার কাছে। আসলে শর্মিষ্ঠাদির বর কোন বিচারেই শর্মিষ্ঠাদির যোগ্য হয়নি। প্রচণ্ড দাপুটে। সমাজ সামাজিকতার ধার ধারে না। শর্মিষ্ঠাদির কোনো গুণই সংসারে বিন্দুমাত্র মর্যাদা পায়নি। যখন মনে হয়েছে তখন শর্মিষ্ঠাদির শরীর নিয়ে একতরফা নাড়াচাড়া করে একপাশে ঠেলে দিয়েছে। এসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা অত্যন্ত দুর্বল মুহূর্তে শর্মিষ্ঠাদিই চোখের জল মুছতে মুছতে বলে ফেলেছে। শর্মিষ্ঠাদির বরের অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে। সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করলে কি হবে, কোনো স্ত্রীর কাছেই তা গোপন রাখা যায় না। শর্মিষ্ঠাদি সব জানলেও নিজের সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং সম্মানের কথা ভেবে সব চুপচাপ সহ্য করে চলেছে। কিন্তু একদিন কি বিষ্ফোরণ ঘটবে না?
শর্মিষ্ঠাদিই বলেছিল,
বিয়ে
যদি হবার হয় ঠিকই হবে। তবে কি জানিস,
জীবনে একজন সত্যিকারের বন্ধুর বড়ো
প্রয়োজন হয় রে তুয়া। স্বামী কখোনোই বন্ধু হতে পারে না।
সম্পর্কটা ভীষণভাবে
স্বার্থের,
কর্তৃত্বের। বাধ্যতামূলক অধীনতার।
স্বচ্ছ্বতোয়া শার্মষ্ঠাদির
কথার অনেকটাই সত্যি বলে মনে
করে। কিন্তু সবটা নয়। সকলেই এক ছাঁচে ঢালা হতে
পারে না। দু’চার জন
‘মানুষ’ও স্বামী হয় বৈকি !
শর্মিষ্ঠাদি রোজগার করে।
স্কুলের সময়টুকু বাদ দিয়ে
নিঃশ্বাস বন্ধ করে সংসারের কাজকর্ম সামলায়।
নিজস্ব সময় বলতে প্রায় কিছুই নেই। শর্মিষ্ঠাদি ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে নতুন বাড়ির
টাকার ব্যবস্থা করেছে।
এলআইসি,
ইউটিসি এসবই শর্মিষ্ঠাদি করে যাচ্ছে। সব
কিছু কেটেকুটে যা থাকে তা
দিয়ে শর্মিষ্ঠাদি নিজের কোনো স্বপ্ন সাধই পূরণ
করতে পারে না। নাকের ডগায় ঝুলছে--‘যা করছো নিজের সংসার আর ছেলেমেয়ের জন্য
করছো। আমার জন্য কি করছো?’
স্বচ্ছ্বতোয়া বোঝে এও এক চতুর অর্থনৈতিক
প্রবঞ্চনা যা অত্যাচারের
সামিল। ক্ষেত্রবিশেষে প্রায়ই ইমোশন্যাল
ব্ল্যাকমেলের শিকার করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে ওদের বিন্দুমাত্র
দ্বিধা হয় না।
শর্মিষ্ঠাদির জীবনটা সুখের
হয়নি। এক সময়ে দারুণ গান
গাইতো,
ছবি আঁকতো,
দারুণ নাচতে পারতো। সেসব এখন
ইতিহাস। যার সঙ্গে বিয়ে হলো
কোনো
বিচারেই শর্মিষ্ঠাদির উপযুক্ত নয়। পাশাপাশি দেখলেই বিরাট ফাঁকটা
সহজেই ধরা পড়ে। স্বচ্ছ্বতোয়া অনুরাধার কথার জের টেনে
বলে--
--আসলে
গল্প-কবিতা এসব বুঝতে হলে
প্রচুর পড়তে হয়। পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্কটাই যে
তুলে দিয়েছিস। এখন তো আর চেষ্টা করলেও পারবি না। শাড়ি-গয়না আর--
--আর?
থেমে গেলি কেন?
বলেই ফেল--
--নাঃ
থাক্। বললেও তুই বুঝবি না এখন।
খাওয়া বন্ধ করে অনুরাধা
বললো--
--যে
ভাবেই হোক একটা ছেলে যোগাড়
করে বিয়ে করে ফেল তুয়া। এখনও সময় আছে। বিয়ে
হলেই বুঝবি আমাদের সম্পর্কে তুই যা ভাবিস তা কতটা ভুল। এই বয়সে একলা
জীবনটাই তো অর্ধেক। গোটা
ব্যাপারটা তুই বুঝবি কি করে?
--বোঝার
ইচ্ছে
আমার বিন্দুমাত্র নেই। তোদের
সকলকেই তো দেখছি। মাসে মাসে গয়না কেনা,
ক্যাশ
সার্টিফিকেট কেনা,
দৈবাৎ দু’তিন মিনিটের জন্যে স্বর্গসুখের মুহূর্ত মনে
রেখে দু’চার মাস পরপরই ভেলোর কিংবা অ্যাপেলো ছোটা আর নানা রকম রোগব্যাধির
যন্ত্রণায় কাতরানো--সুখের
জীবন বলতে তো এই?
আমার কথাগুলো তোদের কাছে
আঙুর
ফল টক-এর মতো শোনাবে জানি,
কিন্তু সময় পেলে একটু ভেবে দেখিস পৃথিবীতে কেন
এলি, কি দিয়ে যাচ্ছিস বা রেখে যাচ্ছিস--
--বলিস
কিরে স্বচ্ছ্বতোয়া,
তুই তো দেখছি ঠাকুরের কথামৃত
ঝাড়ছিস !
কনক
মিত্র,
শিক্ষিকা হিসেবে কোনো যোগ্যতাই নেই অথচ উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রবল বলে
নেতাদের পদসেবা করে আর টিচারদের মধ্যে দলাদলির বিষ ছড়িয়ে
এখন
‘নেত্রী’
হয়ে
ওঠায় সব ব্যাপারেই নিজের
নাকটা লম্বা করার অধিকার পেয়ে গেছে মনে করে বলেই
মন্তব্যটা করলো বেশ নেত্রীসুলভ ভঙ্গিতে। যদিও কনককে ব্যক্তি
বিশেষের দালাল (স্ত্রী-লিঙ্গ কি হবে
স্বচ্ছ্বতোয়া জানে না) ছাড়া অন্যকিছু কেউ ভাবে না এবং
আড়ালে ওকে নিয়ে যে যথেষ্ট পরিমাণে হাসাহাসি হয়,
কতরকমের চুটকি তৈরি হয় সে
সম্পর্কে হাল্কা মস্তিষ্কের কনক মিত্রের কোনো ধারণাই নেই।
স্বচ্ছ্বতোয়া তাই
হাসিমুখেই কনকের দিকে তাকিয়ে বললো--
-ঠাকুর তো তোমাদেরই সম্পত্তি
কনকদি। তিনি আমার মাথায়
থাকুন। তবে হ্যাঁ,
একটা কথা জোর দিয়ে বলতে পারি,
আমার জীবনযাপনের মধ্যে যে সব বড় বড় বুলি আর আদর্শের
বিন্দুমাত্র প্রতিফলন
নেই
আমি সে সব বিষয়ে লেকচার দিতে অভ্যস্ত নই। সে চেষ্টায় জীবনের ফাঁকগুলো
কোনোভাবেই গোপন করা যায় না।
তোমরা কি সত্যিই পারো নিজেদের ফাঁকগুলো গোপন
করতে?
পারো না।
বলে স্বচ্ছ্বতোয়া কমনরুম
ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সকলেরই মুখ
গম্ভীর। কনক মিত্র ওর কথাগুলো যথার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো কিনা বোঝা গেল
না। দু’এক সেকেণ্ড চুপ করে থাকার পর শর্মিষ্ঠাই বললো--
--ওকে
তুই বুঝবি
না কনক। ভীষণ সংবেদনশীল
মেয়ে। পড়াশোনা করে লেখালেখি করে। সময়ে বিয়ে না
হওয়ায় মেয়ে হিসেবে সামান্য হতাশা থাকতেও পারে,
কিন্তু তার জন্যে নিজের
বোধবুদ্ধি হারাবার মতো মেয়ে ও নয়। ওর সঙ্গে ভেবে চিন্তে
কথা বলাই উচিৎ।
কথাটা
কনকের পছন্দ হলো না। শর্মিষ্ঠার ব্যাপারে ওর একটা
যুক্তি-ব্যাখ্যার অতীত
অ্যালার্জি রয়েছে। নানাভাবে নোংরা রাজনীতির শিকার বানিয়ে শর্মিষ্ঠার ক্ষতি
করার চেষ্টা করেছে,
আজও ক্লান্তিহীন চেষ্টা করে চলেছে। অথচ শর্মিষ্ঠা আছে
তার নিজের অবস্থানেই। এইসব
কারণেই কমনরুমের আবহাওয়া আর আগের মতো নেই। কেউ
কারুর প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। সকলেই আজকাল নিজেকে নিয়েই প্রবল ব্যস্ত থাকার
ভান করে।
বাড়িতেও স্বচ্ছ্বতোয়ার মন
ভালো থাকে না। ইদানীং মা দাদা এমন
কী ছোট বোনটাও বুঝে গেছে স্বচ্ছতোয়া সারাজীবন এই বাড়িতেই থেকে যাবে।
বিয়ে-থা হবে না। মাস দেড়েক
আগে এক পাত্রপক্ষ এসেছিল। সেজেগুজে আনুষ্ঠানিক
দেখা-শোনার অসম্মানজনক ব্যাপার না থাকলেও তাকে বিপণনযোগ্য করে তোলার কম
বেশি চেষ্টা বৌদি করেছিল
তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও। পাত্র গ্র্যাজুয়েট।
পারিবারিক হার্ডওয়্যারের ব্যবসা আছে। তিন ভাই। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে।
স্বচ্ছতোয়া ইংরেজিতে এম এ,
বি এড। তবু আপত্তি করেনি।
পাত্রের বয়েস
পঁয়ত্রিশ। দোহারা চেহারা।
গায়ের রঙ স্বচ্ছ্বতোয়ার চেয়েও বেশ কালো। চোখেমুখে
একটা জান্তব ছাপ স্পষ্ট। প্রথম বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যে ম্যালিগন্যান্ট
ম্যালেরিয়ায় বউ মারা গেছে।
সেও বছর চারেক আগের ঘটনা।
স্বচ্ছ্বতোয়ার
নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দ এখন আর
খুব বেশি কাজ করে না। এই ব্যবসায়ী দোজবরে পাত্র
মা এবং দাদার বিচারে খারাপ তো নয়ই বরং বেশ মানানসই! অবস্থাও খারাপ নয়।
কাছাকাছির মধ্যে এর চেয়ে
ভালো আর কোথায়
‘জুটছে?’
প্রশ্নটা যখন
‘জুটে যাওয়া’
তখন আর কোনো প্রশ্ন তোলার মানেই হয় না। তবু সেই
পাত্রপক্ষও দেড়মাসের
মধ্যেও তাদের মতামত জানায়নি। আরও
‘মেয়েমানুষ’
দেখে বেড়াচ্ছে হয়তো !
হাল
ছেড়ে দিয়েছে মা এবং দাদা। শুরু হয়েছে অদ্ভুত সব
কথাবার্তা। সবই টাকা-পয়সা
সংক্রান্ত। দাদার ব্যবসা ভালো চলছে না কিছু টাকা দে। ছোট বোনের বিয়ের
ব্যবস্থা করা দরকার,
আর দেরি করলে স্বচ্ছ্বতোয়ার মতোই হাল হবে। অতএব কিছু
টাকার ব্যবস্থা ওকে করতে
হবে। দু’টো ঘর না তুললেই নয়। একটা ঘর তো তোর
জন্যেই লাগে--কাজেই তুই টাকা
না দিলে চলবে কেন?
বিয়ে না হওয়ার জন্যে
স্বচ্ছ্বতোয়া এভাবেই অপরাধী
হয়ে উঠেছে। বাড়িতে সব সময়ে এখন অভাব অনটনের কথা
ছাড়া অন্য কোনো কথা স্বচ্ছ্বতোয়ার সঙ্গে হয় না। বৌদি তার
ছেলেটাকেও
খাতা-পেন্সিল
খেলনা-জামা-প্যান্ট-বইপত্রের জন্যে পিসিমণির কাছে দাবি জানাতে
শিখিয়ে দিয়েছে। কোনো আবদারই
আর সে মা-বাবার কাছে করে না।
বাড়িতে তাই স্বচ্ছ্বতোয়া
নিজেকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ আর অসহায় বোধ করে। স্কুল ছুটির পর শর্মিষ্ঠা স্বচ্ছতোয়াকে
বললো--
--আমার
সঙ্গে যাবি এক জায়গায়?
আমি সপ্তাহে দু’দিন করে যাই ওখানে। একদিন নাচের ক্লাস নিই আর একদিন
গানের।
--সে কী
! কবে থেকে যাচ্ছো?
--তোরা
কেউ জানিস না। বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। কাউকে বলিনি। তুইও কিন্তু কাউকে বলবি না।
--অমলদা
জানে?
তোমার বাড়ির আর কেউ?
--তোর
অমলদা কিংবা বাড়ির আর কেউ
জানলে কি যেতে পারতাম?
কেউ জানে না। সপ্তাহে
দু’দিন বাড়ি ফিরতে দেরি হয়। প্রথম প্রথম খুব সন্দেহ করতো। কিন্তু শহর থেকে
এত দূরের প্রায় গ্রামের
স্কুলে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করি। বাসের সমস্যা তো
থাকতেই পারে।
--জায়গাটা
কোথায়?
--শহরে
ঢোকার দু’টো স্টপেজ আগে। সারদা নগরে।
--নাচ-গানের
স্কুল?
--নাচ-গান-বাজনা-আবৃত্তি-ছবি
আঁকা সবই শেখানো হয়।
--তোমার
নিজের স্কুল?
--ঠিক
তা নয় আবার হ্যাঁ-ও বলতে পারিস।
--বুঝলাম
না ঠিক।
--স্কুলটা
খোলার জন্যে আমি সমরেশকে ২৫ হাজার টাকা দিয়েছিলাম--
--কে
সমরেশ?
--আমার
একমাত্র খোলা জানলা। সমরেশ আমার বন্ধু। সমরেশ না থাকলে আমি কবেই ফুরিয়ে যেতাম।
--গোপন
প্রেম?
--কী
অদ্ভুত ট্র্যাজেডি
দ্যাখ্--যার নিষ্কলুষ বন্ধুত্ব আমাকে বেঁচে থাকতে
সাহায্য করছে তাকে সকলের চোখ বাঁচিয়ে গোপনে লুকিয়ে রাখতে হচ্ছে--আর যার
হৃদয়হীনতা, যার উপেক্ষা
অবহেলা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চাইছে,
তাকে বার বার প্রকাশ্যে নিজের মহার্ঘ্য অলঙ্কার হিসেবে তুলে ধরতে হচ্ছে।
যন্ত্রণায় বুকটা আমার ফেটে
যায় রে তুয়া !
--সমরেশকে
তুমি ভালোবাসো?
বিশ্বাস করো?
--করি।
কেন জানিস?
এক বিস্ময়কর সৃষ্টিছাড়া মানুষ। হাত বাড়ালেই অনেক কিছু
পেতে
পারে জেনেও হাত গুটিয়ে থাকে।
চাইলে আমার শরীরটাও পেতে পারেতো--কিন্তু ওর
চোখে আমার শরীরের প্রতি মুগ্ধতা থাকলেও কখনো হাত বাড়ায়নি। এমন কী কখনো কখনো
আমার দুর্বলতা প্রকাশ হয়ে
গেলেও নয়। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে হয়,
জানিস! হয়তো
একদিন আমি নিজেই......
কথাগুলো গিলতে ইচ্ছে করছিল
স্বচ্ছ্বতোয়ার। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল শর্মিষ্ঠার মুখের দিকে।
--সামান্য
প্রশ্রয়ের সুযোগ আমার দিক
থেকে ছিল। তোর অমলদা তো জীবনে কখনো শরীর নিয়ে
আমাকে আলাদা করে স্বপ্ন দেখতে শেখায়নি। নিজের প্রয়োজনটাকে গোগ্রাসে মিটিয়ে
নিয়েছে। প্রতিবারই আমার
নিজেকে একটা যৌনপুতুল ছাড়া অন্য কিছু মনে হয়নি।
কাজেই আমার তৃষ্ণা থাকাটা কি অস্বাভাবিক কিছু, না অপরাধের?
--এতবড়
সাহসের কথা উচ্চারণ করতে দেখে তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে শর্মিষ্ঠাদি।
--পরজন্ম
বলে সত্যিই কিছু আছে কিনা
জানি না। থাকলেও এই মন আর স্মৃতি নিয়ে জন্মাবো
বলে বিশ্বাস করি না। তাই একটা কথা ভাবলে মনে মনে ভীষণ ক্রোধ আর অপমানে
অস্থির হয়ে উঠি--
--কি
কথা শর্মিষ্ঠাদি?
--আমার
এই শরীরটা কেন আমার স্বামীর কাছে একটা মানবিক শিল্পের মর্যাদা পেল না বলতো?
--শর্মিষ্ঠাদি
দ্যাখো আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে ! তুমি কী সাংঘাতিকভাবে ভাবতে পারো--
--কেন
তুই তোর শরীর নিয়ে ভাবিস না?
নাকি তা পাপ এবং লজ্জা বলে
মনে করিস?
--না।
তা একদম ভাবি না। কিন্তু তোমার মতো এ ভাবে উচ্চারণ করতে পারতাম না হয়তো কোনোদিন।
--আমিই
বা গলা ফাটিয়ে উচ্চারণ করতে
পারলাম কোথায়?
তোর কাছে বলে ফেললাম। মেয়ে
হয়েও
অন্য মেয়েদের মাঝখানে এসব
বললে সকলেই আঁতকে উঠবে। ছিঃ ছিঃ করে উঠবে। আবার
রাতের অন্ধকারে বালিশে মুখ চেপে কান্না চাপবে। অনেকটা হাড়িকাঠে আটকে যাওয়া
বলির পাঁঠার মতো। পালাবার
কোনো পথ নেই--
--কিন্তু
তোমার সমরেশ?
--বললাম
যে,
একটা সৃষ্টিছাড়া আস্ত পাগল মানুষ। এদের জাতই আলাদা রে তুয়া--এরা
পুরুষমানুষ নয় আদ্যান্ত
মানুষ। এরকম কাউকে পেলে বন্ধুত্ব পাতাতে একটুও দেরি
করবি না। বাঁচার মানে খুঁজে পাবি। দেখবি কি ভাবে দু’হাতে তোকে আগলে রাখবে।
সমরেশের জন্যেই আমার আবার নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছে করে।
--আলাপ
করতে ইচ্ছে করছে। চলো তোমার সঙ্গেই যাই। আজ বিশেষ কোনো কাজও নেই।
বাস
থেকে নেমে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। গ্রাম হলেও শহরের ছোঁয়া
রয়েছে সর্বত্র।
বাসস্ট্যাণ্ডটা বলতে গেলে বাজার এলাকা। পাঁচ মিনিটের পথ এগিয়ে গেলেও
বাজারের মিশ্রিত কোলাহলের আওয়াজ শোনা যায়।
রাস্তার ধারেই
‘মনসিজ কৃষ্টি
নিকেতন’।
অশ্রুতপূর্ব নাম। লম্বা শেপের টিনের শেড দেওয়া বাড়ি। লম্বা
ঢাকা
বারান্দা। সামনে চমৎকার
ফুলের বাগান। নানা রঙে উজ্জ্বল। সামনে দাঁড়ালে মন
ভালো হয়ে যায়।
পাশাপাশি চারটি ঘরেই তখন
পুরোদমে নাচ গান বাজনার ক্লাস
চলছিল। বারান্দার শেষ মাথায় একটা অপেক্ষাকৃত ছোট অফিসঘরেই স্বচ্ছ্বতোয়াকে
নিয়ে ঢুকলো শর্মিষ্ঠা। ঘরের
এক কোণে শ্বেতপাথরের এক চমৎকার সরস্বতী মূর্তি
প্রথমেই দৃষ্টি টেনে নেয়। স্বচ্ছ্বতোয়ার মুখ থেকেও বেরিয়ে এলা--
--বাঃ !
কী সুন্দর মূর্তি !
--উড়িষ্যা
থেকে আনা। সমরেশ নিয়ে এসেছে।
শর্মিষ্ঠার
সঙ্গে একজন অপরিচিতাকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে
সমরেশ। শার্মষ্ঠা
একটা
চেয়ার টেনে বসে পড়লো। স্বচ্ছ্বতোয়াকে পাশের চেয়ারে বসার ইশারা করে
সমরেশকে বললো--
--আমার
কলিগ স্বচ্ছ্বতোয়া। খুব ভালো কবিতা লেখে। আরও অনেক কিছু লেখে। খুব ভালো মেয়ে।
আঁচল দিয়ে মুখের বিন্দু
বিন্দু ঘাম মুছতে মুছতে বললো শর্মিষ্ঠা।
স্বচ্ছ্বতোয়া শর্মিষ্ঠাকে বাধা দিতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই সমরেশ বললো--
--চমৎকার
নাম ! আমি এর আগে কখনো
শুনিনি। স্বচ্ছ্বতোয়া নদীর আর এক নাম। কিন্তু যে
কোনো নদী নয়। বেদে বেশ কিছু নদীকে স্বচ্ছ্বতোয়া বলা হয়েছে। কেন জানো?
--অল্পস্বল্প
জানি। কিন্তু আমার নাম আর
আমি এক নই। আমাদের দেশের অভিভাবকরা ভাবনা চিন্তা
করে নাম রাখলে কালো ছেলে বা মেয়ের নাম গৌরাঙ্গ বা গৌরী রাখবেন কেন?
হিংসুটে ঝগড়াটে মেয়ের নাম মায়া কিংবা মমতা-ই বা হয় কি করে?
শর্মিষ্ঠার
পাশের চেয়ারে বসতে বসতে বললো স্বচ্ছ্বতোয়া। সমরেশ হা হা
করে হেসে উঠলো
স্বচ্ছ্বতোয়ার কথা শুনে।
শর্মিষ্ঠাও হেসে ফেললো। স্বচ্ছ্বতোয়া সমরেশকে
লক্ষ্য করছিল। লম্বা মেদহীন একটু রোগার দিকেই টান টান চেহারা। এলোমেলো
কাঁচা-পাকা চুল। চোখে চশমা।
চোখ দুটো বড় বড় নয় কিন্তু অসম্ভব উজ্জ্বল এবং
অন্তর্ভেদী। পরনে অত্যন্ত সাধারণ খদ্দরের পাঞ্জাবী এবং পাজামা। হা হা হাসির
মধ্যেই বুকের ভেতরের বিশাল
সবুজ ময়দানের গেট খুলে যায়। ঠিক এমনটাই মনে হলো
স্বচ্ছ্বতোয়ার।
--আমি
আমার ডিউটিটা সেরে আসি। তোরা গল্প কর--
বলতে বলতে চেয়ার ঠেলে উঠে
দাঁড়াল শর্মিষ্ঠা।
--স্বচ্ছ্বতোয়ার
অনারে আজ বরং ছুটিই নিয়ে নাও--
--অন্ততঃ
আধঘন্টা দেখিয়ে আসি। আজ আমার নাচের ক্লাস রে তুয়া। বাচ্চা মেয়েগুলো কত দূর থেকে
আসে।
--ঠিক
আছে,
তুমি ঘুরে এসো।
শর্মিষ্ঠা ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল। সমরেশ স্বচ্ছ্বতোয়ার দিকে তাকিয়ে বললো--
--শর্মিষ্ঠার
সঙ্গে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছিল। তা প্রায় বছর পাঁচেক হবে--
--আপনাদের
গল্প আমি শর্মিষ্ঠাদির কাছে শুনেছি। তাই তো আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চলে এলাম।
--আমার
কথা কি শুনেছো?
--আপনি
পুরুষমানুষ নন,
আদ্যান্ত একজন মানুষ। মানে ভীষণ ভালো মানুষ। আপনাকে
বিশ্বাস এবং নির্ভর করা যায়
এবং যতটা ভালোবাসা যায় তার চেয়েও অনেক বেশি
শর্মিষ্ঠাদি আপনাকে ভালোবাসে--এটা কিন্তু শর্মিষ্ঠদিরই কথা।
--শর্মিষ্ঠা
জানে না আমার মতো একটা
মানুষের জীবনে ওর মতো একজন পরিপূর্ণ নারীর মূল্য
কতটা। আমি কতটা ওর বিশ্বাস এবং নির্ভরতার যোগ্য তা আমি জানি না, তবে
স্বীকার করতে লজ্জা নেই
শর্মিষ্ঠার সঙ্গে আমার যোগাযোগ না হলে এই
প্রতিষ্ঠান আমার স্বপ্নই থেকে যেতো। বলতে পারো আমার অস্তিত্বই থাকতো না আজ।
--শার্মষ্ঠাদির
মতো মানুষ হয় না। কিন্তু খুব দুঃখী মেয়ে জানেন তো !
--অনেকটাই
অনুমান করি। নিজের দুঃখ গোপন
রাখার একটা সহজাত ক্ষমতা আছে ওর। কিন্তু ওর
দুঃখ মুছে দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বলতে গেলে ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। তবে
হ্যাঁ,
নতুন করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে শর্মিষ্ঠার জন্যেই।
--আপনার
স্ত্রী--
--নিজের
জগতে নিজেকে নিয়ে আছে। নিজের
চাকরি পুজোপাঠ আর একমাত্র ছেলের ব্যাপারে
মাত্রাতিরিক্ত ভাবনা-চিন্তা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে যে বহুকাল যাবৎ আমি সংসারে
আছি কি নেই সেটাই মাঝে মাঝে
আবিষ্কার করতে হয়। দাম্পত্যজীবন বলতে যা বোঝায়
তা যে কবে কখন জানলা দিয়ে পালিয়ে গেছে আজ তা আর ভাবিও না। এই বেশ চলছে--
--আপনারা
দু’জন বোধহয় এই জন্যেই পরস্পরের এত কাছাকাছি আসতে পেরেছেন।
কিন্তু--
--তুমি
হয়তো এই সম্পর্কের পূর্ণতার
কথা ভাবছো। পূর্ণতার ব্যাপারটা পুরোপুরি মনের
ব্যাপার। পরস্পরের প্রতি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই
সেটা হয়। ফাঁক
থাকলে
অন্ততঃ একজনের কাছে ধরা পড়বেই। শর্মিষ্ঠার কোনো ক্ষতি আমার দিক থেকে
যাতে না হয়--
--চলুন
শর্মিষ্ঠাদির ক্লাসে মেয়েরা কেমন নাচছে দেখে আসি--
ওরা
চেয়ার ছেড়ে ওঠার আগেই শর্মিষ্ঠা ঘরে ঢুকলো। আঁচলটা কোমরে
পেঁচিয়ে গুঁজে
রেখেছে। অবাক হয়ে গেল
স্বচ্ছ্বতোয়া। কে বলবে শর্মিষ্ঠাদির একটা বছর বারোর
ছেলে আছে। চেহারার বাঁধুনি এখনও রীতিমতো দেখার মতোই। নাচের পরিশ্রমে সুগঠিত
বুক ওঠানামা করছে। মুখে
জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। কোমর থেকে আঁচল খুলে
নিয়ে ঘাড় গলা মুখ মুছে নিল।
স্কুলেরই একটি ছেলে ওদের
জন্য চা আর মিষ্টি রেখে গেল টেবিলে। স্বচ্ছ্বতোয়া বললো--
--মিষ্টি
কেন শুধু শুধু--
--শুধু
শুধু নয়। তুমি এখানে প্রথম
এলে,
এটুকু না হলে খারাপ দেখাবে না?
আর এসব
আমাদের ভেতরের ব্যাপার। আমি তো কাউকেই মিষ্টি আনতে বলিনি।
সমরেশ থামতেই শর্মিষ্ঠা বলে
ওঠে--
--আমার
খুব খিদে পেয়েছে। স্কুল থেকে সোজা এখানে এসে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে খিদেটা আরও
বেড়ে গেছে--আমি বাপু ভদ্রতা করতে পারবো না।
স্বচ্ছ্বতোয়া আর কথা না
বাড়িয়ে হাসিমুখেই হাত বাড়ালো। আর একটি ছেলে ঘরে ঢুকে শর্মিষ্ঠাকে বললো--
--দিদি
আপনার টাকাটা একটু সই করে নিয়ে নিন--
--প্রতিবারই
তুমি যে কেন টাকাটা নিয়ে নিন বলো কে জানে ! দাও দু’জায়গায় দু’টো সই তো?
স্বচ্ছ্বতোয়া
দেখলো একটা খাতায় আর একটা রসিদ বইতে শর্মিষ্ঠা সই করে
দিল। রসিদের একটা
অংশ
সযত্নে ছিঁড়ে শর্মিষ্ঠার হাতে দিল ছেলেটি। শর্মিষ্ঠা জিজ্ঞেস করলো--
--আমি
আর তোমাদের কাছে কত টাকা পাবো বলো তো?
--আর
পাঁচ হাজার টাকা দিদি।
--এই
পাঁচ হাজার আমি একসঙ্গে তোমাদের ডোনেট করতে পারি না?
মাসে মাসে এত হিসেবপত্র রাখার দরকারটাই বা কি?
ছেলেটি হাসিমুখে তাকালো
সমরেশের দিকে। সমরেশ স্বচ্ছ্বতোয়ার দিকে তাকিয়ে বললো--
--এই
য স্কুলটা দেখছো এটা শুরু
করা যেতনা যদি না শর্মিষ্ঠা নিজে থেকে জোর করে
পঁচিশ হাজার টাকা দিতে চাইতো। স্কুল এখন মোটামুটি ভালোই চলছে। ওর টাকাটা
ধীরে ধীরে শোধ করে দেওয়া হবে
এই শর্তে আমরা নিয়েছিলাম। একদিক দিয়ে আমরা শোধ
করছি অন্যদিক দিয়ে ও আমাদের ডোনেশন দিয়ে যাচ্ছে। এই জায়গাটাতে আমাদের হার
মানতে হয়েছে। তবে এই
প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার হিসেবে যোগ
দেওয়ার শর্তেই আমরা ডোনেশন নিতে রাজি হয়েছি।
--আসলে
কি জানিস তুয়া,
জীবনে যে কোনো সময়ে ভীষণভাবে
একলা হয়ে যেতে পারি। তেমন যদি কিছু ঘটে তাহলে
এইরকম একটা কাজকর্মের আশ্রয়ে অন্ততঃ নিজের শূন্যতা ভুলে থাকা যাবে। এখানে
না এলে জীবনটা আমার পুরোপুরি
চেনাই হতো না।
বাড়ি ফিরতে আজকাল একটু বেশি দেরি হলে নানাভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেরির কারণ জানার চেষ্টা করেন কমলা। স্বচ্ছ্বতোয়া যে এই ধরণের খোঁজখবর আদৌ পছন্দ করে না তা স্পষ্টাস্পষ্টি বুঝিয়ে দিলেও মা তা গ্রাহ্য করে না। ভেতরে ভেতরে একটা আশঙ্কা আজকাল মায়ের মনের মধ্যে কাজ করে--যদি হঠাৎ করে মেয়ে বাড়ি ছেড়ে স্কুলের কাছাকাছি ঘর ভাড়া করে থাকতে শুরু করে কিংবা কোনো কেলেঙ্কারী যদি ঘটে যায় তাহলে মানসম্মানও যাবে, সংসারের একটা নিয়মিত রোজগারও হাতছাড়া হয়ে যাবে।
আজও বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতে
মা সামনে এসে হাজির। কিন্তু আজ মুখ খোলার আগেই স্বচ্ছ্বতোয়া বললো--
--আমার
ভীষণ মাথা ধরেছে। আমাকে একটু একলা রেস্ট নিতে দাও।
--তোর
দাদা বলছিল সামনে পুজো,
দোকানে কিছু মালপত্র বেশি
করে তুলতে পারলে--
--তুলুক
না। আমি কি বারণ করেছি?
--হাজার
দশেক টাকা তুই দিতে পারিস যদি--
--পারি।
কিন্তু ধার হিসেবে। শোধ করে দিতে হবে।
--হঠাৎ
এ কথা বলছিস যে?
--বলছি,
কারণ আমার ভবিষ্যত নিয়ে তোমাদের কোনো ভাবনা-চিন্তা আছে
বলে আমার মনে হচ্ছে না--
স্বচ্ছ্বতোয়া কখনো এভাবে কথা
বলে না। কমলা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎই ঘর ছেড়ে
বেরিয়ে গেলেন।
৩
দূর থেকেই কাঠের ব্রিজ
পেরিয়ে স্বচ্ছ্বতোয়াকে আসতে দেখে হাত নাড়লো
শঙ্খনীল। আধঘন্টা দেরি করে ফেলেছে স্বচ্ছ্বতোয়া। কাছে এসে বললো--
--আগের
বাসটা ধরতে পারলাম না। দেরি হয়ে গেল একটু।
কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে দু’টো পত্রিকা বের করে স্বচ্ছ্বতোয়ার হাতে দিয়ে শঙ্খনীল
বললো--
--দু’টো কাগজই তোমার কবিতা ছেপেছে। সামনের মাসে
‘বসুধা’
সাহিত্য সম্মেলন করছে। তোমাকে কবিতা পাঠের জন্যে আমন্ত্রণ জানাবে--
--তোমার
কাগজ কবে বেরুবে শঙ্খদা?
পুজো তো এসে গেল--
--সময়
করে উঠতে পারছি না। এত চাপ চতুর্দিকে--
--আসলে
তোমার ইচ্ছেটাই আজকাল আর কাজ করছে না। তাই না?
--কী
জানি,
হবে হয়তো--
--আজকাল
তুমি লিখছোও না একেবারে। কেন?
--বললাম
যে,
সময় পাচ্ছি না। আমার কথা থাক--
--থাকবে
না। তোমার আগ্রহ আর উৎসাহেই আমার লেখালেখি। সে-ই তুমিই যদি লেখা ছেড়ে দাও তাহলে
আমি--
--তোমার
এখন শুরু। আমার তো তা নয়। বলতে পারো শেষ--
--গানটা
সুর করেই গাও না কেন?
ভালোই তো গাও !
স্বচ্ছ্বতোয়ার কথা শুনে হেসে
ফেললো শঙ্খনীল--
--আচ্ছা
আচ্ছা ঠিক আছে--লিখবো। লেখা
ছাড়া তো আর কিছুই পারি না আমি। ছাই-পাঁশ যাই
হোক না কেন লিখতে তো ভালোই লাগে। যাকগে,
তোমার সেই গল্পটা শেষ হয়েছে?
--কি
হয়েছে জানি না। দ্যাখো--
কাঁধের
ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা পাণ্ডুলিপি বের করে শঙ্খনীলের হাতে
দিল
স্বচ্ছ্বতোয়া। পাণ্ডুলিপির
ওপর এক ঝলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে শঙ্খনীল বললো--
--পরে
পড়বো। তোমার লেখা কিন্তু দিন দিন বেশ ভালোই হচ্ছে--
--কি
করে হচ্ছে সে তো আমি জানি। তুমি গাইড না করলে তো আমার লেখার সাহসই হোত না। এই গল্পে
যদি কোথাও কিছু বদলাতে হয় তা হলে করে নিও--
--কারুর
লেখায় আমি নিজের বিদ্যে জাহির করি না। তবে বানানটা আমি দেখে দেবো।
---আমার
লেখা আর কারুর লেখা বুঝি এক হলো?
ঠিক আছে,
দেখতে হবে না।
গল্পটা ফেরৎ নেওয়ার জন্য হাত
বাড়ালো স্বচ্ছ্বতোয়া। ওর নাকের ডগায় তর্জনীর একটা ছোট্ট টোকা মেরে শঙ্খনীল বললো--
--রাগলে
তোমাকে বেশ দেখায় তুয়া। তবে
কথায় কথায় রেগো না। রাগ সৃষ্টিশীল মানসিকতার
খুব ক্ষতি করে। আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে ব্যাপারটা বেশ বুঝি। আগে নিজেকে
নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না।
এখন পারি। রাগ হলেই উদ্দেশ্যহীনভাবে রাস্তায়
রাস্তায় ঘুরি। যার ওপর রাগ হয় তার চোখের সামনে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে তাকে
উপেক্ষা করি--
--কিন্তু
এভাবে কতদিন চলবে?
বউকে নিয়ে কোনো ভালো ম্যারেজ
কাউন্সিলারের কাছে যাচ্ছো না কেন?
--বলেছিলাম।
হিতে বিপরীত হয়েছে। আমি নাকি
ওকে পাগল প্রতিপন্ন করার ষড়যন্ত্র করছি।
ইদানীং সন্দেহ প্রবণতা মারাত্মক বেড়ে গেছে। এখন আর লোকজন মানে না,
যাচ্ছেতাই সব কথাবার্তা। মানসম্মান কিছুই আর বজায় থাকছে
না। তোমরা তো আমাকে
দেখছো--উচ্ছন্নে যাওয়া চরিত্রহীন লোক বলে আমাকে মনে হয়?
মাঝে মাঝে আমার এই
জীবনটাকেই একটা বিরাট প্রহসন বলে মনে হয়। কেন বেঁচে আছি--কেন বাঁচবো বুঝে
উঠতে পারি না।
--আজও
কি কিছু--
--নতুন
আর কি?
চলছে--
--মন
ভালো নেই?
চলো না কোথাও একটু বেড়িয়ে আসি?
--বেড়িয়ে
আসবে?
কোথায়?
আমার
সঙ্গে?
--হ্যাঁ।
তোমার সঙ্গে। দূরে কোথাও। এখানকার কথা কিচ্ছু মনে রাখবো না--
--লোকে
কি বলবে?
একজন অবিবাহিত মেয়ে আর--
--জানি।
দু’জন ছেলে হলে কোনো প্রশ্নই উঠতো না। একটা পরিচয় লাগবে,
তাই না?
বেশ
তো,
যে পরিচয় দিলে কোনো সমস্যা হবে না তেমন একটা মিথ্যে পরিচয়
নিয়েই না হয়
যাবো।
কি--তোমার ইচ্ছে হয় না?
--বড়
বেশি সাহসের কথা বলছো তুয়া--
--শর্মিষ্ঠাদির
কথা তোমাকে বলেছিলাম না?
কাল শর্মিষ্ঠাদির বন্ধু সমরেশদার ওখানে
গিয়েছিলাম। শর্মিষ্ঠাদির
সাহস দেখে আমি জীবনটাকে রাতারাতি একেবারে অন্যভাবে
দেখতে শিখে গিয়েছি। জীবনে মা বাবা ভাই-বোন স্বামী-সন্তান যে যেখানেই থাক
না কেন কোথাও নিজেকে অকপটে
মেলে ধরা যায় না। এসব সম্পর্ক পুরোপুরি দাবি ও
শর্তশৃঙ্খলে বাঁধা। কাঁধে মাথা রেখে কাঁদার জন্যে একজন বন্ধুর যে কত
প্রয়োজন তা সমরেশদার সঙ্গে
আলাপ না হলে--
--এইভাবে যে পরম সত্যটা
স্পষ্ট হয়ে যাবে তা একমুহূর্ত আগেও ভাবেনি স্বচ্ছ্বতোয়া!
৪
কয়েকদিন
পরে স্বচ্ছ্বতোয়ার ঘরে ঢুকে একটু অবাক হয়ে গেলেন কমলা।
কেথাও যাবার
প্রস্তুতি চলছে মনে হলো
তাঁর। স্বচ্ছ্বতোয়া মায়ের গম্ভীর মুখের দিকে একপলক
তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো--
--কিছু
বলবে?
--ওরা
রাজি হয়েছে। সামনের অঘ্রাণেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চায়--
--কারা
রাজি হয়েছে?
কিসের বিয়ে?
--মাস
দেড়েক আগে যারা তোমাকে দেখে গিয়েছিল তারা রাজি হয়েছে--
--হঠাৎ
রাজি হলো যে?
--হঠাৎ
আবার কি?
অন্য কোথাও পছন্দ হলো না হয়তো। আমি তো কথা দিয়ে
দিয়েছি--তোরও তো আপত্তি ছিলো না--
মেয়েকে নিরুত্তর দেখে
দ্বিগুণ উৎসাহে কমলা বলে ফেললেন--
--ওদের
ব্যবসাটা একটু বাড়াতে চায়। তাই নগদ তিন লাখ টাকা চেয়েছে--আর কিচ্ছু চায় না--
স্বচ্ছ্বতোয়ার হাত পা নিশ্চল
হয়ে গিয়েছিল আগেই। এবার চোয়াল শক্ত হলো--
--টাকাটা
কে দেবে?
দাদা না তুমি?
বাড়ি বিক্রি করবে নাকি?
স্বচ্ছ্বতোয়ার কঠিন প্রশ্নে
আমতা আমতা করে কমলা বললেন--
--তোকেই
দিতে হবে।
--একবারে
নিঃস্ব হয়ে যেতে বলছো?
--তা
কেন?
চাকরিটাতো থাকবে--
--আমার
কালো রঙের জরিমানা হিসেবে
যারা তিনলাখ টাকা দাবি করে তাদের কাছে সম্পর্কের
কোনো দামই নেই। তারা ব্যবসা ছাড়া কিছুই বোঝে না। আমাকে আত্মহত্যা করতে
বলছো?
--এ
আবার কি কথা?
তার মানে তুই বিয়ে করবি না?
--না।
--যাচ্ছিস
কোথায়?
--ঠিক
নেই। তবে নিরুদ্দেশে যাচ্ছি না। বেড়াতে যাচ্ছি। দু’সপ্তাহ পরে ফিরবো--
--কে কে
যাচ্ছে সঙ্গে?
--একজনই।
সুজন-সখা। তুমি চিনবে না !
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট