বৃত্তভাঙার খেলা
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
জয়ন্তীর অপেক্ষায় বাড়ির সকলেই প্রায় বিস্মিত এবং বিরক্ত হয়ে উঠছে ক্রমশঃ। হওয়াই স্বাভাবিক। অন্ততঃ আজকের দিনটিতে নিজের ভূমিকাটা কি সেটা জয়ন্তীর বোঝা উচিত ছিল। নতুন গৃহ-প্রবেশের অনুষ্ঠানে হাজির থাকার জন্য মা-বাবা সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই সল্টলেক থেকে শ্রীরামপুরে চলে এসেছেন। ব্যাণ্ডেল এবং কালনা থেকে দুই বোন কল্যাণী আর জয়াও চলে এসেছে সাড়ে আটটার মধ্যে। পুজোর আয়োজনও সম্পূর্ণ। এদিকটা এবারেও মাকেই সব করতে হলো। অথচ আজকের দিনটিতে অন্ততঃ এসব কাজ নিজে পুরোপুরি করতে না পারলেও জয়ন্তীর উচিত ছিল মায়ের পাশাপাশি থাকা। তাঁকে সাহায্য করা। বিভাসের মনে হলো সে আজও জয়ন্তীকে ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারেনি।
গোটা বাড়িতে আজ পাঁচমিশেলি কথা-বার্তা হৈ-হুল্লোড়-হাসি চকিতে দু'চার কলি গান ঠাট্টা তামাশায় ঝলমল করছে। এসবেরই ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ করে লোডশেডিং-এর মতো সকলেরই মনে পড়ে যাচ্ছে জয়ন্তীর অনুপস্থিতির কথা। দু'এক মুহূর্তের জন্যে সকলেরই মুখ অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকে না-হোক হাজার বার বিভাস সেলফোনে জয়ন্তীর নাম্বারে ট্রাই করে চলেছে--কিন্তু স্যুইচ্ অফ করে রাখলে কথা বলবে কার সঙ্গে!
সকাল ন'টার মধ্যে পুজোয় বসার কথা। সাড়ে দশটা বাজতে চলেছে। জয়ন্তী নাকি সকাল ছ'টার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়েছে কালীঘাটে পুজো দিয়ে সোজা শ্রীরামপুরে চলে আসবে বলে। বিভাস গতকাল অফিস থেকে সোজা এখানে চলে এসেছিল। প্রাথমিক প্রস্তুতির প্রয়োজনেই ওকে আসতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই আসবাবপত্র দিয়ে ঘর সাজানোর কাজটা অবশ্য ইন্টিরিয়র ডেকরেটরই করেছে। আলোর সাজ-সজ্জাও যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শেষ করতে হয়েছে। গত সেপ্টেম্বর থেকেই গ্লোব নার্শারি খেকে বাছাই করে নানান রকমের ফুলের চারা-বীজ আনিয়ে লোক দিয়ে শ'খানেক টব সাজিয়েছে বিভাস এবং এসবই হয়েছে জয়ন্তীরই ইচ্ছেতে।
নানা
রঙের ফুলে পূর্ণ টবগুলো ডেকরেটররাই গোটা বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে
দিয়েছে। বাড়ির চেহারাটাই দুচোখ ভরে দেখার মতো হয়ে উঠেছে। নতুন বাড়িটা আজ
সত্যিই স্বপ্নের বাড়ি হয়ে উঠেছে। অথচ জয়ন্তী...
মা-বাবা এবং ছোটভাই
প্রবাল কারুরই ইচ্ছে ছিল না বিভাস আলাদা বাড়ি করে সল্টলেকের বাড়ি থেকে বউ
নিয়ে চলে যায়। সল্টলেকের বাড়িতে সকলের জন্যেই যথেষ্ট জায়গা ছিল। পরিবারও
এমন কিছু বৃহৎ নয়। পারিবারিক ক্রিয়াকর্ম ছাড়া বাড়িতে ভিড়-ভাট্টা হয় না।
যদিও সেরকম পরিস্থিতিতে দু'চার
দিনের জন্যে সকলেই বেশ মানিয়ে নেয় এবং
মানিয়ে নেওয়াটা কর্তব্য বলেই বিভাস মনে করে। তবু বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলো
জয়ন্তীর জন্যেই। ওর স্বাধীনতা নাকি বিঘ্নিত হচ্ছিল। একটু রাত করে বাড়ি
ফিরলে মা-বাবার মুখ ভারি হয়ে ওঠে। জয়ন্তীর আধুনিক সাজসজ্জা পছন্দ না হলে মা
মুখের ওপর নাকি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনিয়ে দেয়। মোটকথা জয়ন্তীর আধুনিক
জীবনযাত্রা নাকি পদে পদে বিঘ্নিত হচ্ছিল। কিন্তু এসব বিশ্বাস করা বিভাসের
পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ মা-বাবা দুজনের একজনও প্রাপ্তবয়ষ্ক ছেলেমেয়েদের
ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি-ঝুঁকি মারার কথা ভাবতেই পারেন না। সে ধরণের গ্রাম্য
সংস্কৃতি ওঁদের আদৌ নেই। আর নেই বলেই শ্রীরামপুরের নতুন বাড়িতে উঠে যাওয়ার
কথা শুনেও কেউ কোনো কথাই বলেননি। জানতেও চাননি বিভাসরা এরকম একটা গুরুতর
সিদ্ধান্ত কেন নিল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ওঁদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করার
সাহস হয়নি বিভাসের। ভেবেছিল যে কোনো সুযোগে বলে দেবে কথাটা। মা শুধু একবার
জানতে চেয়েছিল এ বাড়িতে ওদের কি অসুবিধে হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বলেছিল ওরা
বাড়ি ছেড়ে চলে যাক এটা এ বাড়ির কেউ চায় না। তবু যদি যেতে চায় তাহলে অবশ্য
কেউ বাধাও দেবে না!
নতুন ছাদের রেলিঙে হেলান দিয়ে নীচের লনে খোশমেজাজে যাতায়াতরত লোকজনদের দেখছিল বিভাস। ভেতরে ভেতরে একটু দুর্ভাবনাও হচ্ছিল। রাস্তায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? বিভাসের হঠাৎ মনে পড়ে গেল অঞ্জনের কথা। ওরও তো সকাল সকাল আসার কথা ছিল। অঞ্জনের এতো দেরি হচ্ছে কেন?
জয়ন্তীর সঙ্গে অঞ্জনের বন্ধুত্ব নিয়ে বিভাসের তেমন কোনো সংশয় ছিল না বটে, তবে অন্যান্য বন্ধুদের তুলনায় অঞ্জনকে জয়ন্তী একটু বেশি গুরুত্ব দেয় কেন এটা বোঝার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখেছে অঞ্জনের ব্যাপারে জয়ন্তীর একটা মানসিক সংযোগের ব্যাপার কিছু আছেই, যেটা খুব হাল্কা করে অন্য কেউ হলে বোধহয় দেখতো না।
বিভাস অঞ্জনকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলো। বাড়ি থেকে ওর মা বললেন,
অঞ্জন
কোথাও বেড়িয়েছে। হয়তো বিভাসের নতুন বাড়িতেই গেছে। ওখানেই তো যাওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু অঞ্জন এখনো আসেনি!
--বিভাসদা,
তুমি সত্যিই জানো না দিদি কোখায় গেছে?
ঠিক ঘাড়ের ওপর কঙ্কনার নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠলো বিভাস। জয়ন্তীর ছোট বোন কঙ্কনা। চমৎকার দেখতে। একটা বেসরকারি চ্যানেলে খবর পড়ে। আধুনিকতার এবং অত্যাধুনিক সাজসজ্জার একটা জীবন্ত মডেল হতে পারতো কঙ্কনা। কিন্তু সে তা হয়নি। একেবারেই না সাজার মধ্যেই নিজেকে অসাধারণ সজ্জিত করে তোলার স্বাভাবিক দক্ষতা আছে মেয়েটার এবং এটাই ওর সবচেয়ে নজর কাড়ার মতো প্রধান গুণ। শুধু এদিকেই নয় অন্যান্য সমস্ত দিক থেকেই কঙ্কনা একবারে জয়ন্তীর বিপরীত মেরুর মেয়ে। অনেক বিষয়েই ওর নিজস্বতা আছে যা সহজেই অন্যকে আকৃষ্ট করে। বিয়ের বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু বিয়ের কথায় তেমন করে গুরুত্বই দেয় না!
কঙ্কনা কিন্তু সকাল আটটার মধ্যেই এসে গেছে। শুধু তাই নয়,
দিদির দায়িত্বজ্ঞানহীনতার লজ্জা গায়ে মেখে মাকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে।
--আমাকে
কিছুই বলেনি। একটা ফোনও যদি করতো--কিছুই বুঝতে পারছি না--
দৃশ্যতঃই বিভাসকে বেশ হতাশ দেখাচ্ছিল। বাড়ি ভর্ত্তি লোকজন যে যার মতো সিদ্ধান্তে
পৌঁছুচ্ছে।
--দিদি
কালীঘাটে গেছে বলে আমার মনে হয় না। অন্য কোথাও--
--কোথায়?
তুমি জানো?
--জানি
না। তবে দিদি চিরদিনই এ রকম আশ্চর্য সব কাণ্ড করে সকলকে ভীষণভাবে দিশেহারা
করে তোলে। তোমাকে বিয়ে করাটাও তো এ রকমই আশ্চর্য ঘটনা--
--তার
মানে?
--মানে
ওর চরিত্রের একেবারে বিপরীত মেরুর একটা লোককে যখন বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে
দিয়ে বললো,
আমি বিভাসকে ভালোবাসি--ওকে বিয়ে করবো,
শুনে বেশ কয়েক মিনিট বাবা
কোনো কথাই বলতে পারেনি। তুমি লক্ষ্য করোনি?
অনেকক্ষণ পরে তুমি মঞ্চ থেকে
প্রস্থান করার পর বাবা দিদিকে বলেছিল,
বিয়ের মতো একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে
দিদির আরো কিছুটা সময় নিয়ে ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু দিদির তখন ভাবার সময় ছিল
না--
--আমি
তো এসবের কিছুই জানি না!
--দু'চার
মাসের মধ্যেই দিদি
বুঝেছিল তুমি ঠিক সেই মানুষ নও যার স্বপ্ন দিদি দেখতো। আমি বুঝেছিলাম,
কিন্তু এসব কথা তোমাকে বলতে আমার মায়া হতো। আমার কিন্তু খুব ভয় করছে
বিভাসদা--
অসম্ভব দুটো সুন্দর চোখ মেলে বিভাসের মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে
কঙ্কনা। বিভাস শেষ শরতের ঝকঝকে নীলাকাশের দিকে তাকালো। এক টুকরোও মেঘ নেই।
চারিদিকে উজ্জ্বল সোনালি রোদ। বাড়ি ভর্ত্তি কলহাস্যমুখরিত স্বজন পরিজন।
নতুন গৃহ সেজেগুজে তৈরি। বসবাসেরও শুভমুহূর্ত এসে গেছে। যার ইচ্ছাতেই মূলতঃ
এই নতুন বাড়ি তারই কোনো হদিশ নেই! কতক্ষণ বিভাস নিজেকে এইভাবে লুকিয়ে
রাখবে?
--পুজোপাঠ
আজ বন্ধ রাখতে বলবো?
বিভাসের গলায় একজন হতাশ ভেঙে পড়া মানুষের কাতরতা ফুটে উঠলো। কঙ্কনা বললো--
--সে
কি! তাই আবার হয় নাকি?
পুজো কেন হবে না?
--জয়ন্তী
ছাড়া গৃহপ্রবেশের পুজো--
--তোমার
মা-বাবা পুজোয় বসবেন। কি আর করা যাবে বলো?
এত লোকজন এসেছেন দূর-দূরান্ত থেকে--এঁদের সকলকে ফেরাতে পারবে?
--কিন্তু
সবাই যখন জানতে চাইবে জয়ন্তী কোথায় গেল--আমি স্বামী হয়েও জানি না এটা কেমনভাবে নেবে
সকলে?
--সে
যা হোক কিছু বললেই হবে। জরুরি কাজে বাইরে গিয়ে আটকে গেছে--
--জয়ন্তী
এমন একটা কাজ ঠিক আজই কেন করলো বলোতো?
পারিবারিক মানসম্মানের কথাটাও একবার ভাবলো না!
--গত
কাল-পরশুর মধ্যে ওর সঙ্গে তোমার ঝগড়া-ঝাঁটি হয়নি তো?
--তোমার
কি মনে হয়,
আমি ঝগড়ুটে?
বিভাসের প্রশ্নের ভঙ্গি দেখে এই সঙ্কট মুহূর্তেও হেসে ফেললো কঙ্কনা। বললো--
--হলে
বোধহয় একটু ভালো হতো। এতো শান্ত নিপাট ভালোমানুষ দিদির স্বপ্নে ছিল না
বিভাসদা। সব মেয়ে পছন্দও করে না। একটু রাফ-টাফ্ টাইপের হলে হয়তো--। জানি
তোমার খুব খারাপ লাগছে,
কিন্তু এটাই সত্যি এবং অবশ্যই আমি দিদির পছন্দ
সমর্থন করি না--
--তোমার
দিদির কোনো অ্যাফেয়ার-টাফেয়ার কিছু--
--যদি
কিছু হয়েও থাকে তবে তা বিয়ের পর তোমার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ভালোমানুষীর জন্যেই হয়ে
থাকতে পারে--
সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। মা আর কল্যাণী। মা মৃন্ময়ী বললেন--
--আর
তো দেরি করা যায় না বিভাস। পুরুতমশাই বলছেন সময় পেরিয়ে যাচ্ছে--
--আর
আধঘন্টাটাক অপেক্ষা করতে বলো মা--এর মধ্যে নিশ্চয়ই এসে যাবে--
--আমার
তো বেশ চিন্তাই হচ্ছে। রাস্তাঘাটের যা অবস্থা--
--মাসিমা,
আপনি আর মেসোমশাই তো পুজোয় বসতে পারেন--
জয়ন্তীর
কাণ্ডজ্ঞানের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা না রেখেই কথাটা বললো কঙ্কনা। ও জানে
এমনটা ঘটাতেই জয়ন্তী কোথাও চলে গেছে নিশ্চয়ই। অস্বস্তিকর আর কিছু ভাবতে
চাইছিল না কঙ্কনা। অসম্ভব অপ্রত্যাশিত কিছু করে বসা জয়ন্তীর পক্ষে একটুও
কঠিন নয়। আজ পর্যন্ত বাড়ির সকলকে শিহরিত করার মতো অনেক কাণ্ড ঘটিয়েছে বলেই
ভেতরে ভেতরে বেশ দুশ্চিন্তাই হচ্ছিল তার। একটা এলোমেলো পরিস্থিতি তৈরি
হওয়ার আগেই কঙ্কনা চাইছিল মাঙ্গলিক ব্যাপারটা ভালোয় ভালোয় মিটে যাক। কিন্তু
মৃন্ময়ী বললেন--
--না
না,
তা কি করে হয়--যার ইচ্ছেয় এই বাড়ি,
পুজোয় তারই বসা উচিত। না হয় আরো কিছুক্ষণ দেখাই যাক--
--তুই
কি রে দাদা,
সকাল থেকে তোর বউ কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে তুই তার কিছুই জানিস না?
বৌদির আবার আজকের ব্যাপারটা মনে আছে তো?
এই
প্রশ্নের কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর হয় না। বিভাসের অসহায় অবস্থাটা মৃন্ময়ী
অনুভব করলেন। তিনি ইশারায় মেয়েকে চুপ করতে বলে মেয়েকে নিয়েই নীচে চলে
গেলেন।
গোটা বাড়িটাই এখন বিরাট একটা বিদ্রূপের মতো বিভাসকে গিলতে আসছে। গত কয়েকমাস যাবৎ এই বাড়ির পেছনে বিভাস সর্বস্ব পণ করেছিল। হাড়ভাঙ্গা এই পরিশ্রমের কোনো প্রয়োজনই ছিল না তার। শুধুমাত্র জয়ন্তীর খেয়াল আর জেদের কারণেই এই বাড়ি শেষপর্যন্ত তৈরি হতে পেরেছে। মনের মতো করে বাড়িটাকে সাজাতে যা যা করণীয় জয়ন্তীর চাহিদা অনুযায়ী তা করেছে। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়েই সকলে বিভাসের রুচি এবং পছন্দের তারিফ করেছে মুক্ত কণ্ঠে। সে সব শুনে যার আনেন্দে খুশিতে ঝলমল করে ওঠার কথা তারই কোনো হদিশ এই মুহূর্তে নেই!
--আর
কতো অপেক্ষা করবে?
আমার মন বলছে দিদি ইচ্ছে করেই কোথাও চলে গেছে। এমন কিছু
একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে যার জন্যে আর ওর পক্ষে এখানে আসা সম্ভব হচ্ছে
না--
--সিদ্ধান্ত!
তার মানে কি বলতে চাইছো তুমি?
কঙ্কনার আশঙ্কার শব্দগুলো আমূল নাড়িয়ে দিল বিভাসকে। কঙ্কনা বিভাসের উদ্বেগ পুরোপুরি
টের পাচ্ছিল। বিভাসের প্রশ্নের উত্তরে বললো--
--ঠিক
ঠিক জানি না ব্যাপারটা। তবে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে দিদির জীবনে এমন কেউ একজন
এসেছে যার জন্যে
হয়তো--
কঙ্কনার কথা শেষ হওয়ার আগেই বিভাসের ভাই প্রবাল একটা খাম নিয়ে এল বিভাসের কাছে--
--এই
খামটা একটা লোক দিয়ে গেল তোকে দেওয়ার জন্য। বললো খুব জরুরি। আর হ্যাঁ,
পুরুতমশাই কিন্তু আর দেরি করতে রাজি হচ্ছেন না--
--ঠিক
আছে আমি দেখছি।
হাত
বাড়িয়ে খামটা নিল বিভাস। খামের ওপর জয়ন্তীর হাতেই বিভাসের নাম লেখা।
প্রবাল নীচে নেমে যেতেই খামটা ছিঁড়ে ভেতর থেকে চার-পাঁচ পাতার একটা চিঠি
বের করলো বিভাস। কঙ্কনা বিভাসের পাশ থেকেই সামান্য উঁকি দিয়েই জয়ন্তীর
হাতের লেখা চিনতে পারলো। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাচ্ছিল
কঙ্কনা। কি আছে ওই চিঠিতে?
বিভাস পড়ছিল--
বিভাস,
আমি জানি আজ এই চিঠি
না লিখলেই ভালো হতো। কিন্তু আজ ওই বাড়িতে কাটিয়ে দু'দিন
পরে এই চিঠি
পাঠালে আরো খারাপ হতো। যতই হোক সেটা বড় রকমের প্রতারণার ব্যাপার হযে যেতো।
আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা নিয়েছি মাস তিন-চার আগেই। কিন্তু ঠিক কিভাবে কেমন করে এই ব্যাপারটা তোমাকে জানানো যায় ভেবে পাচ্ছিলাম না। অবশ্য অন্য কোনো লোক বা অন্য কোনো সামান্য সেন্সেটিভ হাজব্যাণ্ড হলে আমার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকেই ব্যাপারটা টের পেতো। কিন্তু তোমার তো ও-সবের বালাই নেই। ফলে আমাকে এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায় তিনমাস ধরে ভাবতে হয়েছে। এদিকে দেখতে দেখতে তোমার নতুন বাড়িতে সাড়ম্বরে প্রবেশের দিন এসে গেল। তোমার মা-বাবার মতে গৃহপ্রবেশের পুজো-পাঠে আমাদের যুগলে বসা উচিত বলে রায় দিলেন। আমাদের এই বাঙালী পরিবারেও 'কিঁউ কি শাস্ ভি বহু থী' কালচার জাঁকিয়ে বসছে--অবশ্য আমার এতে কোনো আপত্তিই নেই।
নতুন বাড়ির জন্যে তুমি ভীষণ ছোটাছুটি করছো, প্রায়ই রাত করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরো--মনে মনে গুছিয়ে রাখা সত্ত্বেও কথাগুলো বলতে পারিনি। বলার সুযোগই হচ্ছিল না। শেষপর্যন্ত আজকের এই দিনটাকেই বেছে নিতে হলো। আমি আজ কি করে তোমার সঙ্গে পাশাপাশি বসে গৃহপ্রবেশের পুজোপাঠে অংশ নিই? যে বাড়িতে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো না--ঘর-সংসার করবো না, অন্য একজনের সঙ্গে জীবন কাটাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে-ই আমি কি করে আজ ওই বাড়িতে যাই?'
এই পর্যন্ত পড়ে মুখ তুলে বিভাস কঙ্কনার
মুখের দিকে তাকালো। চোখেমুখে একরাশ প্রশ্ন নিয়ে কঙ্কনা ওর দিকেই তাকিয়ে
রয়েছে। বিভাস প্রথম পাতাটা কঙ্কনার দিকে এগিয়ে দিল। প্রায় ছোঁ মেরে কঙ্কনা
সেটা নিয়ে দ্রুত পড়তে লাগলো। বিভাস ফের পড়তে লাগলো--
--বিয়ের
আগে
সামান্য মাস ছয়েকের আলাপে কেন তোমাকে আমি পছন্দ করেছিলাম আমি নিজেই আজ তা
বুঝতে পারছি না। সকলকে অবাক করে তোমাকে বিয়ে করার সাত দিনের মধ্যেই আমি টের
পেয়েছিলাম আমি মারাত্মক ভুল করে বসেছি।
না, তোমার মধ্যে দোষের কিছুই নেই। তুমি মদ খাও না। ক্লাবে যাও না। মেয়েদের নিয়ে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ফ্লার্ট করো না। মা-বাবার মুখের ওপর কথা বলতে পারো না। কারুর সঙ্গে ঝগড়া করো না। কেউ কোনো কারণে যেন তোমার দিক থেকে দু:খ না পায় সে ব্যাপারে সদা সতর্ক থাকো। এমন কী তোমার প্রচণ্ড প্রয়োজনেও আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার শরীরে হাত দাও না। সদ্যবিবাহিত স্ত্রীর প্রতি বিশেষ মনযোগ দিলে পাছে কেউ কিছু মনে করে কিংবা তোমাকে স্ত্রৈণ বলে--এই আশঙ্কায় সকাল সকাল বেডরুমে আসতেও তোমার সঙ্কোচ ছিল। সর্বদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতে। আমি ঘরের মধ্যে একলা ক্লান্ত হতাম। আমার শরীর ঘুমিয়ে পড়তো। আমার স্বপ্ন আমার উচ্ছ্বলতা সব কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যেতো।
আমাদের একসঙ্গে বাইরে গিয়ে হৈ-চৈ করা উচিত ছিল। মাঝে মাঝে বাইরে খাওয়া দাওয়া করে রাত করে বাড়ি ফেরার প্রয়োজন ছিল। সময়-অসময়ে আমাকে নিয়ে আমার শরীর নিয়ে তোমার উন্মত্ততার প্রয়োজন ছিল। এসব প্রয়োজনকে আমি আমার জীবনে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতাম--তুমি তা করতে না। আমার শরীর নিয়ে খেলা করার সময়েও (দৈবাৎ কখনো) যদি হঠাৎ তোমার মা-বাবার গলার আওয়াজ পেতে কিংবা জানলার পাশ দিয়ে হঠাৎ কোন পাখি উড়ে যাওয়ার শব্দ হতো তুমি একেবারে রক্তশূন্য মমি হয়ে ছিটকে যেতে পাঁচ হাত দূরে। তুমি একজন পুরুষ বটে--কিন্তু তার আগে তুমি একজন অসম্ভব রকমের ভালো মানুষ--যার সঙ্গে দু'চার পা হাঁটা গেলেও বিছানা শেয়ার করা যায় না। আমি একজন স্বাভাবিক কামনা বাসনায় চঞ্চল পুরুষমানুষ চেয়েছিলাম -- যে তার চাহিদা পূরণের আকর্ষণীয় রাস্তাগুলো খুঁজে নিতে পারে। তোমার মতো ভালোমানুষের আকাঙ্ক্ষা আমার স্বপ্নেও ছিল না কখনো!
বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তোমার মা-বাবা সেই আদিম আদিখ্যেতা নিয়ে
আসরে নেমে পড়লেন -- নাতির মুখ দেখে মরতে চান! যেন রাত কাটে তো দিন কাটে না।
কেন জানি না তোমার বাবার নানারকম আদিখ্যেতা আর কথাবার্তা শুনে আমার
ভদ্রলোকের ভেতর-বার একরকমের মনে হয়নি। যদিও আমার জীবনে সেটা কোনো সমস্যা
ছিল না। কারণ আমার জীবনে তোমার ভূমিকাটাই ছিল প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ!'
কঙ্কনা এবার নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে পরের পাতাগুলো টেনে নিল। বিভাসের একটু দ্বিধা
ছিল মনে হলো কঙ্কনার।
বিভাস চিঠিটা যতই পড়ছে ততই যেন নিজেকে অন্যরকম করে আবিষ্কার করছে। নতুন সম্পর্ক মানেই কি চরিত্র বদলের অলিখিত শর্ত পূরণ? নিজেকে বদলাতে না পারলেই কি পরিচিত পৃথিবী, নিজস্ব বৃত্ত-রেখা-মুখ বদলে যাবে?
জয়ন্তী যে সব অভিযোগ করেছে হয়তো ওর দিক থেকে তার যথার্থতা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু বিভাস তো ওই সব ব্যাপারগুলোকে ঠিক এই ভাবে দেখেনি কখনো। দুটো মানুষের ভাবনা চিন্তা কি একই রকম হওয়া সম্ভব? না হলে কোথাও না কোথাও দুজনকেই কিছুটা দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে বোঝাপড়া করে নিতে হয়। জয়ন্তী তো সেরকম কোনো সুযোগই রাখলো না! এত সহজে এত অঙ্গীকার এত স্বপ্ন পেছনে ফেলে চলে যাওয়া যায়? অবশ্য জয়ন্তীর মতে বিভাসের কোনো স্বপ্নই ছিল না। বিভাস শুধু ভালো মানুষই হতে চেয়েছে--জয়ন্তীর মতো মেয়ের স্বামী হতে চায়নি!
বিভাস দেখতে পেলো একটা
সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ ছেলে (কাছা পরিহিত),
সদ্য মা বা বাবাকে হারিয়েছে,
বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। হয়তো সাহায্য-টাহায্য চায়। বিভাস ফের চিঠিতে মন
দিল। জয়ন্তী লিখেছে--
--কিন্তু
তোমার ভূমিকা আমাকে শুধু হতাশই করেনি,
আমার গোটা ভবিষ্যতকেই অনিশ্চিত করে তুলছিল ধীরে ধীরে। এই রকম একটা সময়েই
তোমার বন্ধু অঞ্জনের সঙ্গে তুমি আমার আলাপ করিয়ে দিয়ে পরোক্ষে আমার দারুণ
উপকার করে ফেলেছো। আমি ঠিক যেমন মানুষের স্বপ্ন দেখতাম--অঞ্জন ঠিক সেই
মানুষ। তোমার সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব হলো কি করে বলো তো?
এমন অসম চরিত্রের দুটো
মানুষ আর যাই হোক বন্ধু হয় কি করে?
যাইহোক,
প্রথম দিকে অঞ্জনের একটু দ্বিধা
ছিল তোমার কথা ভেবে। ও তোমাকে ঠকাতে চাইছিল না। কিন্তু যখন বুঝলো আমার
নিজেরই নির্বুদ্ধিতার জন্যে আমি নিজের কাছেই নিজে ভীষণভাবে ঠকে গেছি তখন আর
ওর কোনো দ্বিধা ছিল না। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আমরা বিয়ে করবো। কারণ
আমরা ঠিক ততদূর এগিয়েছি যতদূর এগুলে বিয়েটা অনিবার্য হয়ে ওঠে এবং আমি যাকে
দেহে মনে গ্রহণ করবো তাকে বিয়ে করেই তার সঙ্গে জীবন কাটাবো এটাই আমার
সিদ্ধান্ত। কারণ উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপনে আমার রুচি নেই।
বিভাসের হঠাৎ মনে
হলো গোটা বাড়ি কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। কোনো হৈ-চৈ নেই! তাহলে কি সবাই
ব্যাপারটা জেনে গেছে?
জয়ন্তী কি মা-বাবাকেও চিঠি দিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথা
জানিয়ে দিয়েছে?
পরের পাতাটাও যন্ত্রচালিতের মতো কঙ্কনা টেনে নিয়ে পড়তে লাগলো। বিভাস আবার পড়তে শুরু
করলো--
--এখন
আমাকে আবার বিয়ে করতে হলে তোমার সঙ্গে আমার আইনসম্মত বিচ্ছেদের প্রয়োজন।
দু'এক
দিনের মধ্যে আমি কাগজপত্র পাঠিয়ে দেবো। আমি জানি তুমি সই-সাবুদ করে
দেবে। কারণ সই না করে জোর-জবরদস্তি করে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমাকে ধরে
রাখার চেষ্টা করার মতো হিম্মত তোমার নেই। বিশেষ করে এসব ব্যাপারে অনেকেই
অনেককিছু বলবে যা তুমি কিছুতেই শুনতে চাইবে না। কারণ অসম্ভব ভালোমানুষের এই
দুর্বলতাটাই মারাত্মক দুর্বলতা। এর জন্যে জীবনকেও বাজি ধরা যায়--তাই না?
তোমার
ওই বাড়ি বানাবার জন্যে আমি যে চার লাখ টাকা দিয়েছিলাম সেটা একসঙ্গে ফেরৎ
পেলেই আমার উপকার হয়। অসুবিধে থাকলে তুমি গোটা চারেক ইনস্টলমেন্টেও দিতে
পারো। অবশ্য কঙ্কনা তোমাকে ভালোবাসে (যাঃ! বলে ফেললাম শেষপর্যন্ত! কঙ্কনা
চায়নি তুমি কোনোদিন টের পাও। তোমার টের পাওয়ার কথাও নয়। তুমি কি কঙ্কনার
চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো ওর মনের কথা বোঝার চেষ্টা করেছো?),
বেচারী
কঙ্কনা--ভাবতে পারো--স্রেফ তোমার জন্যেই চিরকুমারী থাকবে বলে পণ করেছে!
তোমার মতো
'ভালোমানুষের
জন্য'
এত সৌভাগ্য ঈশ্বর কোন আক্কেলে বরাদ্দ করেন কে
জানে! সে যাইহোক,
তুমি যদি কঙ্কনাকে বিয়ে কর তাহলে ওই চার লাখ টাকার সবটাই
আমি আমার নির্বোধ বোনের বিয়েতে যৌতুক হিসেবে দিয়ে দেবো। সেই সঙ্গে একটা
অযাচিত উপদেশও দেবো--জীবনটাকে চেনার এবং জানার চেষ্টা করে একা একা নয়,
জীবনে যদি কাউকে আনো তাকে সঙ্গে নিয়েই সে চেষ্টা কোরো--জীবনের যথার্থ মানে
খুঁজে পাবে।
আচমকা এখানেই চিঠিটা শেষ করেছে জয়ন্তী। বিভাস সত্যিই সবিস্ময়ে মুখ তুলে তাকালো
কঙ্কনার মুখের দিকে। কঙ্কনা হাত বাড়িয়ে বললো--
--দাও
শেষটুকু দেখি--
বিভাস
নিঃশব্দে শেষ পৃষ্ঠাটা বাড়িয়ে দিল। কঙ্কনা মন দিল চিঠিন পাতায়। বিভাস
লক্ষ্য করছিল কঙ্কনাকে। চিঠি পড়তে পড়তে কঙ্কনার চোখমুখ লাল হয়ে উঠছে। চিঠি
শেষ করে কঙ্কনা নিঃশব্দে ছাদের কার্নিশের ধারে গিয়ে দাঁড়ালো।
বিভাস
অনুমান করছে নীচে সবাই বিভাসের বিপর্যয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে নির্বাক হয়ে গেছে
হয়তো। গৃহপ্রবেশের এই দিনটা এমনভাবে আসবে কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। কঙ্কনার
চিঠি পড়া হয়ে গেলেও বিভাসের দিকে ফিরতে পারছে না। আজ পর্যন্ত কঙ্কনা ওর
মনের কথা কোনো ছলেই বিভাসের সামনে প্রকাশ করার চেষ্টা করেনি। বিভাসও আজ
পর্যন্ত এর বিন্দুবিসর্গ জানতো না।
পায়ে পায়ে বিভাস কঙ্কনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আড়চোখে ওর দিকে একবার তাকিয়ে বললো--
--জয়ন্তীর
সব কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তোমার এ মতিভ্রম হলো কেন কঙ্কনা!
কঙ্কনা
কোনো উত্তর দিল না। কিন্তু জয়ন্তীর মূল্যায়নের পর বিভাসের ভীষণভাবে জানতে
ইচ্ছে করছিল কঙ্কনার কাছে বিভাসের গ্রহণযোগ্যতার মধ্যে অন্য কোনো বড় রকমের
ভুল নেই তো?
বিভাস তাই বোঝার চেষ্টায় জিজ্ঞেস করলো--
--আমার
প্রশ্নের উত্তর দিলে না তো?
কঙ্কনা বিভাসের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। সরাসরি বিভাসের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো--
--দিদির
কিছু কিছু অভিযোগের ভিত্তি আছে। আমারো মনে হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দিদির
ধারণা ঠিক। তবু সবটাই এভাবে রিয়্যাক্ট করার মতো বলে আমার মনে হয়নি। চেষ্টা
করলে হয়তো দিদি পারতো তোমার সঙ্গে জীবনটাকে গুছিয়ে নিতে। আমি বহুবার
দিদিকে এ ব্যাপারে বোঝাবার চেষ্টা করেছি। সেই থেকেই হয়তো দিদির মনে হয়েছে--
--যা
মনে হয়েছে তা কি সত্যি ঠিক নয়?
কঙ্কনার
মনে হলো বিভাস ওর মুখ থেকে ছোট্ট
'হ্যাঁ'
শব্দটাই শোনার জন্যে নিঃশ্বাস
বন্ধ করে অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ বলে দিতে পারলেই হয়তো ভালো হতো। কিন্তু
কঙ্কনার মনে হলো--এই মুহূর্তটাকে বিশ্বাস করার মতো মুহূর্ত নয়। আবেগ আর
জীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ঠিকই--কিন্তু পাল্লা একদিকে বেশি ঝুঁকে আছে কি না
সেটাও তো বোঝা দরকার। কঙ্কনা বললো--
--এ
ব্যাপারে পরে কথা হবে। এখন চলো নীচে যাওয়া যাক্--
--কিন্তু
কোন্ মুখে যাবো সেখানে?
--যেতেই
হবে বিভাসদা। এটা তোমার নিজের সমস্যা। এর মুখোমুখি তোমাকে হতেই হবে। পলাবার উপায়
নেই যে!
বিভাস ভয়ঙ্কর এই মুহূর্তেও বুঝতে পারছিল জয়ন্তী ঠিক এইভাবে ওকে পুরুষ মানুষ হতে
সাহায্য করেনি। বিভাস বললো--
--তুমি
ঠিকই বলেছো! চলো নীচেই যাই--
সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়ে কঙ্কনা বললো--
--দিদির
চার লাখ টাকা ফেরৎ দিতে কি খুব অসুবিধে হবে?
--এই
মুহূর্তে এই বাড়ি করার পরে তো--
--এ
বাড়ির আর কি প্রয়োজন?
কিক্রি করে দেওয়া যায় না?
দিদির জেদের জন্যেই তো এ বাড়ি--
--হ্যাঁ,
তা ঠিক--দেখা যাক্--তাই হবে!
ড্রইংরুমে
সকলে নিশ্চল হয়ে বসে দাঁড়িয়ে যেন ওদেরই অপেক্ষা করছিল। দরজার কাছে
কাছা-পরিহিত ছেলেটাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল। বিভাস ঘরে ঢুকেই দেখলো মা
মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওদের পায়ের শব্দ পেয়ে আঁচল
সরিয়ে ডুকরে উঠলো--
--আমার
সর্বনাশ হয়ে গেছে বাবা! আমি আর এ মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না বাবা!
হকচকিয়ে গেলো বিভাস। মায়ের এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ওকে স্তম্ভিত করে দিল একেবারে!
কোনোক্রমে বিভাস বলার চেষ্ট করলো--
--কি
আর করা যাবে মা--
--তোর
বাবার কাণ্ড দেখ তুই। ওই ছোঁড়াটা তোর বাবাকে বাবা বলছে! ওর মা মারা গেছে,
তাই তোর বাবাকে নিতে এসেছে ছোঁড়াটা--
বিভাস প্রায় টলে পড়েই যাচ্ছিল। পাশ থেকে কঙ্কনা ওকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল।
--বাবা
নিজেও স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে দু'দিকে
দু'টো
সংসার--তুই ভাবতে পারিস দাদা!
ছোট
বোন জয়ার চোখমুখ টকটকে লাল! জীবনের অদ্ভুত অপ্রত্যাশিত সব ঘটনা মানুষের
নিজের নিজের ঢঙে গড়ে তোলা চেনা বৃত্তগুলোকে কি ভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, তা এক
লহমা আগেও টের পাওয়া যায় না। বিভাস দেখলো ওর বাবা ছেলেটার সঙ্গে নিঃশব্দে
বেড়িয়ে গেল। কঙ্কনা মা-কে কিছু বোঝাচ্ছে। বিভাসের মনে হলো--ওকে আর একটা
নতুন বৃত্ত গড়তে হবে যেখানে জয়ন্তী থাকবে না,
আর অবশ্যই বাবাও থাকবে না--!
***
গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট