জোনাকী জীবন

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

.................................................
সকালে হাঁটতে হাঁটতে রাঁচীরোড স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল তৃষা। এই রাস্তা ধরে সোজা চলে গেলে হাজারিবাগ। উল্টোদিকে গেলে একটা গাঢ় সবুজ পাহাড় পেরুলেই রাঁচী। ঠিক মাঝখানে এই রামগড়। রামগড়ের ঠিক মাঝ বরাবর অজস্র বড় বড় পাথরের ফাঁকফোকর দিয়ে বয়ে চলেছে দামোদর। এখানকার লোকেরা দামোদর-ই বলে। তৃষা প্রথমবার এসে এটাকে একটা পাহাড়ী নদী ভেবেছিল। সকালে এবং বিকেলের নরম আলোয় জলের অজস্র ছোটবড় ধারায় ঘেরা পাথরের ওপর বসে থাকতে বেশ ভালোই লাগে। আজও ইচ্ছে ছিল নদীর দিকেই যাবে। কিন্তু রাস্তায় নামতেই দেখা হয়ে গেল শোভনের সঙ্গে। রামগড় গ্লাস ফ্যাক্টরির অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার শোভনের সঙ্গে তৃষার জামাইবাবু সুবীর বোসের সম্পর্কটা কিছুটা ভাই-ভাই, কিছুটা বন্ধুর। শোভনের চেয়ে অবশ্য সুবীর কিছুটা বড়-ই।

সুবীরের এখানে একটা সেরামিক ফ্যাক্টরি আছে। খুব বড় নয়, আবার খুব ছোটও নয়। এই সেরামিক ফ্যাক্টরি থেকে ফায়ার ব্রিক তৈরি হয়। সারা দেশের নানান পাওয়ার প্ল্যান্টে আর স্টীল ইণ্ডাস্ট্রিতে এই ব্রিকের চাহিদা রয়েছে। এই ফ্যাক্টরি থেকেই সুবীরের ভাগ্য বদলে গেছে। এখন প্রচুর টাকার মালিক। হৃদয়টাও অবশ্য অনেক বড়।

গ্লাস ফ্যাক্টরির অধিকাংশ কর্মচারীই বাঙালি। এদের মধ্যে অনেকেই বৃটিশ আমল থেকেই এখানে বসবাস করছে। কেউ সরকারি চাকরিসূত্রে, কেউ বা রেলওয়ের কর্মচারী হিসেবে এখানে বসবাস শুরু করেছিল। এক সময়ে রাঁচী ধানবাদ বোকারো হাজারিবাগ গিরিডি জামশেদপুর অঞ্চলে প্রচুর বাঙালির বাস ছিল। অনেকেই এখন আর নেই। তবুও এখনো যারা রয়ে গেছে তাদের সংখ্যাও খুব কম নয়। এইসব প্রবাসী বাঙালিরা প্রায় সকলেই পরস্পরকে চেনে। এই চেনা-চিনির সূত্রেই সুবীরের সঙ্গে শোভনের ঘনিষ্ঠতা।

তৃষার দিদি এষাকে নিয়ে সুবীর এই রামগড়ে পালিয়ে এসে বিয়ে করে ঘর বাঁধে। সদ্য সেরামিক ইঞ্জিনিয়ার সুবীর রামগড়ের একটা কোল রি-ফ্যাক্টরিতে সামান্য চাকরি সম্বল করে এষাকে নিয়ে আসার অল্প কিছুদিন পরে একটা ছোট্ট সেরামিক ফ্যাক্টরির চিফ ইঞ্জিনিয়ারের চাকরি পায়। নামেই চিফ। আসলে জনা কুড়ি প্রায় লেবারের মাথায় বসে ধীরে ধীরে ফ্যাক্টরির চেহারা বদলে দেবার স্বপ্ন নিয়ে ঢুকেছিল সুবীর। শেষপর্যন্ত কয়েকবছর যেতে না যেতেই পাঞ্জাবী মালিক ইন্দর সিং ফ্যাক্টরিটা সুবীরকে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেশে চলে যাওয়াতেই সুবীরের বরাত ফিরল। পৈতৃক বিষয় সম্পত্তির যতটুকু নিজের বলে ছিল সবকিছু বিক্রি করে এই ফ্যাক্টরি কিনে প্রচণ্ড লড়াইতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। নিষ্ঠা শ্রম আর একাগ্রতার ফল ফলতে দেরি হয়নি। কিন্তু একদিকে যখন স্বপ্ন সফল হচ্ছিল দারুণভাবে তখন অন্যদিকে তৈরি হচ্ছিল এক দারুণ শূন্যতা! বিদেশ বি-ভূঁইয়ে এষার গোটা দিন আর রাতেরও অনেকটাই কাটছিল একা। এককিত্বের যন্ত্রণায় অস্থির এষা মাঝে মাঝেই ক্ষোভে ফেটে পড়তো। সুবীর প্রাণপণ বোঝাবার চেষ্টা করতো কিছুদিন পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এষা বিশ্বাস করতে পারেনি। ক্রমশঃই সে তার মানসিক স্থিরতা হারিয়ে ফেলছিল। মাঝে মাঝে ভীষণরকম ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতো। এষার পরিবার এষাকে ত্যাগ করেছিল। সবকিছু মিলে মিশে এক দুর্বিষহ অস্থিরতার মধ্যে থাকতে থাকতে এষা সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল।

যথাসাধ্য চেষ্টা করেও এষাকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ করে ঘরে রাখতে পারেনি সুবীর। তীব্র একটা আতঙ্ক তাকে তাড়িয়ে বেড়াতো--হয়তো কোনোদিন ঘরে ফিরে দেখবে এষা সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলছে! বাধ্য হয়েই রাঁচীর মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠাতে হলো এষাকে। আজও প্রতি রবিবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সুবীর রাঁচীতেই কাটিয়ে আসে। বাকি দিনগুলোয় ডুবে থাকে নিজের কাজের মধ্যে এবং মদ্যপানে!

অবশ্য মদ্যপানের মধ্যেও তার একটা আভিজাত্যের চেহারা ফুটে ওঠে। ছোট সেন্টার টেবিলের ওপর দামী হুইস্কির বোতল (কখনো স্কচের), সুদৃশ্য বেলজিয়ান –কাট গ্লাসে এক প্লেট বাদামী রঙের ভাজা সল্টেড কাজু বাদাম সাজিয়ে নিয়ে বসে। মিউজিক সিস্টেমে বাজতে থাকে রবিশঙ্কর বা আমজাদ আলি কিংবা ভি জি যোগ! কখনো কখেনো দেবব্রত বিশ্বাস কণিকা রেজওয়ানার রবীন্দ্র সঙ্গীত! একেবারে একলা। নেশায় মাতাল হয়ে আজ পর্যন্ত কখনো প্রগলভ হয়ে ওঠেনি। বিন্দুমাত্র অশালীন আচরণ করেনি। বলতে গেলে গোটা সময়টাই প্রায় চোখ বুজে থাকে। দেখলে মনে হয় কোথায় যেন তলিয়ে গেছে। এই রকমই চলেছে আজ প্রায় বছর সাতেক।

দিদি এষার কথা মনে পড়তেই তৃষার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উজ্জ্বল সোনালি আলোয় মাখামাখি সবুজ আর আকাশের নীল কেমন যেন বদলে গেল। মুহূর্তেই যেন চারপাশ ঢেকে গেল কুয়াশায়।

এষাকে নিয়ে সুবীর যখন পালিয়ে আসে তৃষা তখন সপ্তদশী সদ্য তরুণী। সুবীরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে কোনোমতেই রাজি ছিলেন না বাবা। বংশ মর্যাদার অহমিকাকে জলাঞ্জলি দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে এষাকে পালাতে হয়েছিল সুবীরের সঙ্গে। মেন্টাল অ্যাসাইলামে আশ্রয় পাওয়ার আগে পর্যন্ত বাবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু দিদির এই মর্মান্তিক পরিণতি শেষপর্যন্ত মা-বাবা সহ্য করতে পারেনি। ওঁরা ছুটে এসেছিলেন। খুব কাছ থেকে কয়েকটা দিন সুবীরকে দেখে বাবার ধারণা বদলে গিয়েছিল। সম্পর্কটা সহজ হয়ে গিয়েছিল--কিন্তু এত দেরিতে যে দিদি তার বিন্দুমাত্র স্বাদ পেল না।

বাবা যখন অনুভব করেছিল দিদির ভালো হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তখন নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিল সুবীর যদি চায় তাহলে সে তৃষাকে বিয়ে করে নতুনভাবে সংসার শুরু করতে পারে। রীতিমতো হতচকিত ও বিস্মিত সুবীর সঙ্গে সঙ্গেই বাবার প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছিল। দিদির দুঃখজনক পরিণতি বাবাকে মানসিক দিক থেকে অসুস্থ করে দিয়েছিল বলে সেই মুহূর্তে শুধু সুবীরই ভাবেনি--তৃষাও ভেবেছিল। বছর দুয়েক আগে এসব কথাবার্তা তৃষার অজ্ঞাতে হলেও পরে মায়ের মুখ থেকে শুনেছিল তৃষা। প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দেওয়ার জন্যে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছিল তৃষা এবং সুবীরের প্রতি তার শ্রদ্ধাও বেড়ে গিয়েছিল অনেকটাই। সেই কারণেই এখন নিঃসঙ্কোচে দু'চার দিনের জন্যে তৃষা একাই চলে আসে এখানে দিদিকে দেখার জন্যেই মূলতঃ।
কিন্তু এবারের আসাটা সম্পূর্ণ অন্য কারণে। ভয়াবহ লজ্জায় মুখ লুকোতেই এবারে তৃষার এখানে আসা।

গতকাল রাঁচী স্টেশনে সুবীরেরই থাকার কথা ছিল। কিন্তু ছিল না। বিশেষ জরুরি কি একটা কাজে সুবীর বাইরে চলে যাওয়ায় স্টেশনে ছিল শোভন। অন্য সময়ে হলে স্টেশন থেকেই সুবীরের সঙ্গে গিয়ে দিদিকে দেখে রামগড়ে আসতো। কিন্তু কাল শোভনের সঙ্গে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মনটা তাই একটু খারাপ।
গভীর রাতে কোনো এক সময়ে সুবীর ফিরেছিল। তৃষা টের পায়নি। সকালে বারন্দার নীচে সুবীরের জীপ দেখেই বুঝেছিল সুবীর ফিরেছে এবং নিশ্চয়ই গভীর ক্লান্তিতে ঘুমুচ্ছে। না হলে খুব ভোরেই সুবীর উঠে পড়ে।

বারকয়েক এখানে আসার ফলে শোভনের সঙ্গে তৃষার সম্পর্কটা বেশ সহজ হয়ে উঠেছিল। সুবীরও চেয়েছিল শোভনের সঙ্গে তৃষার সম্পর্কটা বিয়ে পর্যন্ত গড়াক। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। তৃষা ভালোবেসেছিল এবং বিয়ে করেছিল এমন একজন সরকারি অফিসারকে যে ইতিমধ্যেই পরিচয় গোপন করে তিন-তিনটে বিয়ে করে বসেছিল!

খবরটা যখন জানা গেল তৃষা তখন মাস তিনেকের গর্ভবতী। অবৈধ বিয়ে এবং সেই বিয়ের সূত্রে অবৈধ সন্তান সম্ভাবনাকে তৃষা মেনে নিতে পারেনি। গর্ভপাত ঘটিয়ে লজ্জায় ঘেন্নায় পরিচিত পরিবেশ থেকে ওকে একরকম পালিয়ে আসতে হয়েছে এখানে। সুবীরই তৃষার বাবাকে বলেছিল এখানে পাঠিয়ে দিতে।

শোভন শুনেছিল তৃষার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরের ঘটনা কিছুই না জানলেও শুনেছিল বিয়েটা যে কোনো কারণেই হোক টেকেনি। কারণটা জানার কৌতুহল থাকলেও জানতে চাইতে পারেনি ভদ্রতার কারণেই। তবু তৃষার আজ সকালে শোভনের সঙ্গে আলাপচারিতায় মনে হয়েছিল শোভন সম্ভবতঃ তৃষার অসফল বিবাহিত জীবনের মাঝখানে কোথাও সুবীরের ছায়া দেখছে। কৌশলে তৃষাকে শুনিয়েছে স্ত্রীহীন সুবীরের বাংলোয় তৃষার থাকাটা কেউ কেউ ভালো চোখে না-ও দেখতে পারে। এই সন্দেহটা মাথায় ঢোকার পর থেকেই সকালে বেড়ানোর আমেজটাই মাটি হয়ে গেছে তৃষার।

বারন্দার শেষপ্রান্তে বেতের চেয়ারে সাত-সকালেই ড্রিংক নিয়ে বসে আছে সুবীর! মুখোমুখি একটা চেয়ারে তৃষাও বসে পড়ল। সুবীরের দুটো বড় বড় চোখ টকটকে লাল। রাত জাগার চিহ্ন স্পষ্ট। জীন্সের প্যান্ট আর গোল গলা অ্যাডিডাস গেঞ্জিতে ধুলোবালি লেগে রয়েছে। চুল উস্কোখুস্কো। গোটা শরীরে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।
--সরি, কাল একটা জরুরি কাজে--
--শোভনবাবুর মুখে শুনেছি। কিন্তু এই সাতসকালে এসব নিয়ে বসেছো? কখন ফিরলে? চেঞ্জও তো করোনি!
--আজকের সকালটাই যে একেবারে অন্যরকম--
--তাই বুঝি?
--এনিওয়ে--তোমার কথা বলো--
--আমার তো আর কোনো কথাই নেই সুবীরদা! বেঁচে থাকতেই বড় ঘেন্না হচ্ছে, জানো!
--ডোন্ট বী সিলি! ইটস্ আ গেম অফ লাইফ! এসব নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে--
--সেই জন্যেই হয়তো এখানে ছুটে এলাম। কিন্তু--
--কিন্তু?
--দিদি এখানে থাকে না। তুমি একলা থাকো। এখানে আমার আসা যাওয়াটা--
--কেউ কিছু বলেছে বুঝি? শোভন? মন খারাপ লাগছে?
--মানুষ মানুষের গভীর কষ্টটা বোঝে না কেন সুবীরদা?
--হাতে গোণা দু'একজন বোঝে বইকি! আসলে আমরা চাই সব্বাই বুঝবে। সেটা হয় না বলেই মন খারাপ হয়--
--তোমার মন খারাপ হয় না?
--হয় না। কারণ আমি যখন রাত্রে শুতে যাই তখন এই বিশ্বাস নিয়ে চোখ বুঁজি যে, কাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে তারা প্রত্যেকেই শয়তান। কেউ ভালো ব্যবহার করবে না। আমাকে অপদস্থ করার চেষ্টা করবে--হেনস্থা করার চেষ্টা করবে--
--সে কী! এমন কখনো হয়?
--হয় না। কিন্তু ঐ বিশ্বাস নিয়ে তুমি যদি সকালে জেগে ওঠো তাহলে সারা দিনের মধ্যে একটাও যদি ভাল লোকের দেখা পাও তাহলে তোমার প্রাপ্তির ঘর পূর্ণ হয়ে যাবে। না হলেও দুঃখ থাকবে না। কারণ শয়তান তো মানুষের মতো ব্যবহার করতে জানে না। তাহলে কীসের মন খারাপ!
--আশ্চর্য! এমন করে তো কখনো ভাবিনি!
--এখন থেকে ভাবতে শেখো। জীবনটাকে নতুন করে গড়তে হলে অনেক নতুন কথা ভাবতে হবে।
--সুবীরদা, দিদির সঙ্গে দেখা করতে যাব কবে?
--গেলেই হবে একদিন। দু'একদিন রেস্ট নাও--
--কাল গেলে হয় না?
--কয়েকদিন আমার হাতে একেবারেই সময় নেই। একটু সময় পেলেই--
--দিদিকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে--কতদিন দেখিনি!
হঠাৎই হাতের অর্দ্ধেক ভর্ত্তি হুইস্কির গ্লাসটা বারান্দার রেলিং টপকে ছুঁড়ে ফেলে দিল সুবীর। চমকে উঠে দাঁড়াল তৃষা।
--কি হল সুবীরদা?
--নাথিং। ভাল্লাগছে না। একটু ফ্রেশ হয়ে নিই।
বলে নিজের ঘরে দ্রুত ঢুকে গেল সুবীর। পেছনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তৃষা।



তিন-চারদিন সুবীরের প্রায় পাত্তাই পাচ্ছিল না তৃষা। অনেক রাতে যখন ফেরে তখন ঠিক না ঘুমিয়ে পড়লেও সুবীরের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছেটা থাকে না। সকালে যেটুকু সময় সুবীর বাড়ি থাকে তার প্রায় সবটাই তার কাজকর্মের প্রস্তুতিতেই কেটে যায়। দু'একবার দিদির সঙ্গে দেখা করে আসার কথা বলেওছে তৃষা। সুবীর সেই একই কথা বলেছে, কাজের চাপটা একটু কমলেই--
বিকেলের দিকে ফ্যাক্টরিতে ফোন করলে শুনতে হয়, স্যার বেরিয়ে গেছেন। পরপর তিনদিন একই কথা শুনে তৃষা একটু অবাকই হলো। তাহলে কি দিদির শরীর নিয়ে কোনো সমস্যা?
ঘড়িতে এখন ঠিক সাড়ে চারটে। সুবীর গাড়ি নিয়েই অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে। তৃষা রাঁচীর মেন্টাল অ্যাসাইলামে সরাসরি ফোন করলো।

সূর্য অনেকটাই পাহাড়ের পেছনে হেলে পড়েছে। দূর থেকেই নদীর ধারে শাল-মহুয়ার গাছের ফাঁকে সুবীরের গাড়ি চোখে পড়লো তৃষার। অনেকটা অনুমানের ওপর নির্ভর করেই সুবীরের সন্ধানে নদীর ধারে চলে এসেছে। অনেক উঁচু পার থেকে নদীর ঠিক মাঝ বরাবর বিরাট সেই পাথরের ওপর সুবীর চুপচাপ বসে আছে এদিকে পিছন ফিরে। অস্তগামী সূর্যের লালচে আভার সামনে সুবীর যেন তেলরঙে আঁকা একটা ছবি।
একটু পরেই চারপাশে অন্ধকার গড়িয়ে আসবে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে সুবীরের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকার পর আলতো করে সুবীরের কাঁধে হাত রাখলো তৃষা। চমকে পিছন ফিরে তাকালো সুবীর। অবাক হলো।
--একি! তুমি এখানে?
--চলে এলাম। মন বলছিল তোমাকে এখানেই পাওয়া যাবে।
--তাই বুঝি!
--সুবীরদা, এই জায়গাটাতে এসে বসলে দিদির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, না?
--তা বলতে পারো। এই জায়গাটা এষার বড় প্রিয় ছিল।
--হ্যাঁ, ছিল। এখনো কি--
--এখন তো সব বোধের বাইরে।
--সত্যি! আমারও এই জায়গাটা ভীষণ ভালো লাগে--আবার একই সঙ্গে ভয়ও লাগে--
--ভয় লাগে! কেন?
সোজা উঠে দাঁড়ালো সুবীর।
--তুমি কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। দিদি কতদিন একা একা এখানে এসে বসতো। পাথরের ফাঁক ফোকড় দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের শব্দের সঙ্গে দিদির নিঃসঙ্গতাও বয়ে যেত--শেষপর্যন্ত তো দিদি--
--বাংলোয় ফেরা যাক্। অন্ধকার হয়ে আসছে--
পা বাড়ালো সুবীর। এষাও সুবীরের পেছনে হাঁটা দিল নিঃশব্দে।

আজ নিজের হাতেই টেবিল সাজালো তৃষা। হুইস্কির বোতল, বেলজিয়ান –কাট গ্লাস,এক প্লেট ভাজা সল্টেড কাজু সেন্টার টেবিলে সাজিয়ে মিউজিক সিস্টেমে রবিশঙ্কর চালিয়ে দিল। ড্রেস চেঞ্জ করে বারান্দায় এসে অবাক হলো সুবীর।
--এস, আজ আমিই তোমার জন্যে সব সাজিয়ে রেখেছি।
তৃষার কথা শুনে ওর দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সুবীর। মুখোমুখি উল্টো দিকের চেয়ারে বসে সুবীর বলল--
--দারুণ অবাক হচ্ছি! তোমার দিদি এসব পছন্দ করতো না।
--করলে সম্ভবত দিদি পাগল হতো না!
--কী জানি!
--আমি পছন্দ না করলেও এ ব্যাপারে আমার কোনো রক্ষণশীলতা নেই। আমি সহ্য করতে পারি।
--শোভন কিন্তু এসব খায় না। একেবারে পেতি মধ্যবিত্ত শাবক।
--আমার ব্যাপারে শোভনকে নিয়ে আর ভাববে না তুমি।
--সেকি! কেন? শোভন তো খুবই ভালো ছেলে--
--আমি ভালো মেয়ে নই। আমার ঘটনা বিস্তারিত জানলে শোভন ঠিক তা-ই করবে যা মধ্যবিত্ত শাবকরা করে থাকে--
--কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমার একটা দায়িত্ববোধ থাকা স্বাভাবিক। তোমার দিদি থাকলে--মানে ঠিক থাকলে হয়তো সে নিজেই--
--আজ বিকেল থেকে আমার ভয়ানক মন খারাপ সুবীরদা--
--কেন?
তৃষার দিকে এবারে বেশ অবাক হয়েই তাকালো সুবীর। তৃষা বারান্দার নিচের নীলাভ আলোর বৃত্তের বাইরের নিঝুম অন্ধকারে তাকিয়ে রয়েছে। মুখের প্রোফাইল থেকে শরীরের দৃশ্যমান অংশের ওপর নীল আলোর আভা এক অসাধারণ রহস্যময়তার সৃষ্ট করেছে। তৃষা এষার মতো না হলেও যথেষ্ট সুন্দরী। হীরের নাকছাবি থেকে একটা তীব্র নীলচে দ্যুতি মাঝে মাঝেই তৃষার মুখের দিকে সুবীরের চোখ দুটো টেনে নিচ্ছে বলেই তৃষার সম্পর্কে সুবীরের ভাবনা সরে যেতে পারছে না।
--দিদি যে আর কখনোই ফিরবে না--এটা আজ বিকেলেই জেনেছি। তুমি কেন আমায় জানালে না সুবীরদা? আশ্চর্য!
--এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে এমন একটা খবর--
--মা-বাবাকে জানিয়েছো?
--সেদিনই ফোন করেছি।
--এখন তুমি কি করবে?
--জানি না! এখনো কিছু ভাবিনি--
--এমন একটা সময়ে আমি এখানে এলাম!
তৃষা সোজাসুজি তাকালো সুবীরের দিকে। রবিশঙ্করের সেতার বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলোর বাইরের অন্ধকারে অজস্র জোনাকী ওড়াউড়ি করছে। গাঢ় স্তব্ধতা ভেঙে মাঝে মাঝে দূর থেকে দেহাতি বস্তি থেকে ভেসে আসছে ভোজপুরী কোরাস!
--তুমি তাহলে কি করতে চাও? শোভনকে পছন্দ হচ্ছে না?
--হতে পারে। যদি শোভনকে সব ঘটনা আমার সামনে খুলে বলে ওকে রাজি করাতে পারো--
--তোমার কি ধারণা শোভন রাজি হবে না?
--আমার বিশ্বাস শোভন পালাবে।
--ইন্ ফ্যাক্ট--তোমার কথাই ঠিক। আজ দুপুরে শোভনকে আমি তোমার সব কথা বলেছিলাম--অ্যাণ্ড দ্যাট স্কাউণ্ড্রেল পেটের মধ্যে ল্যাজ গুটিয়ে সত্যি সত্যি পালিয়েছে!
--আমি ঠিক জানি না আমি কি করবো!
--তুমি কিছুদিন এখানে থাকতে পারো। পাঁচজনে পাঁচকথা অবশ্যই বলতে পারে। তবে যদি সাহস না হারাও তাহলে হয়তো কি করলে তোমার নিজের ভালো হবে সেটা তুমি বুঝতে পারবে।
সুবীর উঠে দাঁড়ালো। আজ এক ফোঁটাও হুইস্কি স্পর্শ করেনি। বারান্দার রেলিংয়ের ওপর ভর দিয়ে সুবীর তাকিয়ে রইলো অন্ধকারের দিকে।
তৃষা আশ্চর্য হয়ে হঠাৎই লক্ষ্য করলো অজস্র জোনাকীর অজস্র আলোর টুকরো কেমন যেন জমাট বেঁধে যাচ্ছে। জমাট আলোর বৃত্তের মধ্যে দিদি এষার বড় বড় চোখ দুটো যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। তৃষা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকেই!

***

গ্রাফিক্স - ইন্টারনেট

সূচীপত্র