‘শেষের পথ শুরুর পথ’
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
.. |
সকাল
থেকেই রাত্রি'র বিজ্ঞাপন আর ভৈরবী--এই দুটি বিষয় অনিমেষকে জড়িয়ে রয়েছে। সকালে চায়ের
দেকানেই দৈনিক পত্রিকার ব্যক্তিগত কলামের তৃতীয় বিজ্ঞাপনটা অনিমেষ বার কয়েক খুঁটিয়ে
পড়েছে। ওর স্ট্যাম্প সাইজের ছবি সহ বিজ্ঞাপনে রাত্রি লিখেছে--‘আমি খুবই নিঃসঙ্গ আর অসহায় বোধ করছি। দোহাই তোমার,
আমাকে আর কষ্ট দিও না,
ফিরে এসো।’
ব্যক্তিগত কলামে এ
ধরণের বিজ্ঞাপন হামেশাই ছাপা হয়। অনিমেষ এর আগে কখনো এই ধরণের বিজ্ঞাপন মন দিয়ে
পড়েনি। কিন্তু গত দেড় বছরে তিন বার রাত্রি’র দেওয়া প্রায় একই
বিজ্ঞাপন অনিমেষ মন দিয়ে পড়েছে। কেন না--অনিমেষ নিজেই এখন এই বিজ্ঞাপনের বিষয়। গত
দেড় বছর ধরে রাত্রি নিরুদ্দিষ্ট অনিমেষের ঠিকানা খুঁজে বেড়াচ্ছে!
কাগজে ছাপা অনিমেষের
ছবির সঙ্গে আজকের এই মুহূর্তের অনিমেষকে মেলানো প্রায় দুঃসাধ্যই বলা যায়। দেড় বছরে
না-কামানো দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল ভেদ করে ওর আসল মুখটা শনাক্ত করা অত্যন্ত কঠিন। আর এই
জায়গাটাও বেশ নির্জন--প্রায় পাণ্ডববর্জিত!
পুরুলিয়া-রাঁচী রোড
থেকে আড়াই ক্রোশ ভেতরে কাঁসাই নদী। সামান্য দূর থেকেও বিশাল বিশাল পাথর ছাড়া নদীর
উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না। বর্ষা ছাড়া সারা বছরই প্রায় হেঁটেই নদী পার হওয়া যায়।
নদী পেরুলেই দেউলঘাটার দেবস্থান। কচ্ছপের পিঠের মতো ভূ-খণ্ডটিকে কেউ কেউ
বৌদ্ধ-তান্ত্রিকদের পীঠস্থান বলে মনে করেন। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে
বৌদ্ধ-স্থাপত্যের বেশ কিছু ধ্বংসাবশেষ। পাথরের চমৎকার কারুকাজের কিছু অমূল্য
নিদর্শন এখনও রয়েছে। পাথরের বহু মূল্যবান মূর্তিও ছিল--অধিকাংশই চুরি হয়ে গেছে।
গোটাকয়েক কোনক্রমে রক্ষা করে নিত্য পুজো করে চলেছেন সনাতন সাধু। কেউ কেউ সনাতন
বাবাজীও বলে। যে যাই বলুক--কিছুতেই তাঁর আপত্তি নেই।
গোটা তিনেক মাটির ঘর
তুলে নিয়েছেন বাবাজী। ওঁর নিজের ঘরটাই কিছুটা বড়। ঠিক মাঝখানে চব্বিশ ঘন্টা ধুনী
জ্বলে। গরমে যেমন তীব্র গরম--শীতেও প্রচণ্ড শীত। সামনেই শ্মশান। ফলে প্রায় প্রতি
রাতেই দেহ সৎকার হয় এখানে। মাঝে মাঝেই দু‘একটা ভাল
চাদর-বালিশ-লেপ-তোষকও জুটে যায়! সনাতন সাধুর তাতে বেশ চলে যায়। প্রথম দিন পরিষ্কার
পরিচ্ছন্ন চাদর-বালিশ দেখে অনিমেষ স্বপ্নেও ভাবতে পারে নি ওগুলো মৃতের পরিত্যক্ত সব
জিনিস! প্রথম রাতে বলতে গেলে অনিদ্রায় কেটেছে। এখন আর বিশেষ কিছু মনে হয় না!
ঘর ছাড়ার পাকাপাকি
সিদ্ধান্তের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও সনাতন সাধু কোনও প্রশ্ন করেন নি। নিজে
থেকে কিছু জানতে চাওয়াটা সাধুদের কর্তব্য নয়। বলার হলে একদিন নিজেই বলবে। থাকুক না
দু’চার দিন।
কিন্তু দেড় বছর পরে
অনিমেষের মনে হচ্ছে--এই ভৈরবীর জন্যেই হয়তো শেষপর্যন্ত এমন চমৎকার জায়গাটা ছেড়ে
যেতে হবে।
অনিমেষেরও বছর তিনেক
আগে পথে পথে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন এখানে এসে উঠেছিল ভৈরবী। সাধনপীঠ হিসেবে জায়গাটা
এবং সনাতন সাধু--উভয়ের প্রতিই একটা অমোঘ টান নাকি সে অনুভব করেছিল। সাধুকে দুটো আতপ
চাল ফুটিয়ে দেবার মতো কেউ নেই দেখে তার বড় মায়া হয়। তাই সাধুর পুজো-পাঠের
নিত্যকর্মে আর দু-মুঠো আতপ চাল সেদ্ধ’র কাজে লেগে গিয়েছিল ভৈরবী!
মধ্য তিরিশেও ভৈরবী ভয়ঙ্কর রূপবতী। কোমর পর্যন্ত একরাশ
ঢেউ-খেলানো চুল। বড় বড় টানা টানা চোখের দুটি উজ্বল মণির দিকে কয়েক সেকেণ্ডের বেশি
তাকিয়ে থাকা যায় না। বাহুমূলের একটু নিচে এবং গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে আধুলি
সাইজের গোলা সিঁদুরের লাল টকটকে টিপ। সচারচর গায়ে জামা থাকে না। হাটে-বাজারে গেলে
অবশ্য একটা রক্ত রঙের ব্লাউজ পরে নেয়। শাড়ির রঙও রক্ত লাল! হাতে সর্বদাই একটা লোহার
লম্বা এবং তীক্ষ্ণ
চিমটে থাকে। চিমটে কেন হাতছাড়া করে না জিজ্ঞেস করায় মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল
--কুকুর-বেড়াল তাড়াতে এটা বেশ কাজে লাগে!
ভৈরবীর দেশ-ঘর সম্পর্কে
অনিমেষ এখনও কিছুই জানে না। জানতে চেয়েছিল একদিন। রহস্য করেই ভৈরবী বলেছিল --‘ভৈরবীর আবার ঘর-সংসার কি?
যখন যেখানে তখন সেটাই
দেশ বল দেশ,
ঘর বল ঘর।’
সঠিক
ঠাঁই-ঠিকানা হয়তো সনাতন সাধু জানে। অনিমেষ সাধুকে জিজ্ঞেস করে নি। শোভন হয় না
ব্যাপারটা।
তবে গত দেড় বছরে ভৈরবীর
সঙ্গে অনিমেষের একটা বিচিত্র সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মানুষ বলতে সনাতন সাধুকে নিয়ে মোটে
তিন জন। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সহস্রবার একে অপরের মুখোমুখি হচ্ছে। ফলে একে অন্যের
সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও নির্বিকার থাকতে পারে না। ফাঁকা সময় পেলে অনিমেষ নদীর মাঝ
বরাবর একটা বিশাল পাথরের মাথায় বসে নানান কথা ভাবে। রাত্রির কথা এখন আর তেমন করে
মনে পড়ে না। আজ অবশ্য বিজ্ঞাপনটা দেখার পর থেকে ঘরে ফিরে আসার পর রাত্রি অনিমেষের
নিজস্ব ভাবনার মধ্যে ফিরে ফিরে আসছে।
হাতে ঘড়ি না থাকলেও
অনিমেষ আকাশে ত্রয়োদশীর চাঁদের অবস্থান দেখে অনুমান করল রাত প্রায় বারোটা হবে।
সনাতন সাধু জ্বলন্ত ধুনীর সামনে মেরুদণ্ড টান টান করে চোখ বুঁজে বসে আছে। ভৈরবীও
অনেক রাত পর্যন্ত সাধন-ভজন কী সব করে। মাঝে মাঝে গলা ছেড়ে গানও ধরে--‘যদি কেঁদে কেঁদে এমন হয় তারা,/
আমি নয়নতারা-হারা হ’য়ে/ হারাই যদি নয়নতারা!!’
ভৈরবীর গলাটি কিন্তু বেশ মিষ্টি। ওর গলায় রাগ-রাগিনী ভালই
খেলে। এইসব কারণে সব মিলিয়ে অনিমেষের মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে--এ মেয়ে সংসার ছেড়ে
ভৈরবী হল কেন?
প্রশ্নটা ফের মনে হতেই অনিমেষ নিজের প্রসঙ্গে ফিরে এল।
তার মতো আপদমস্তক সংসারী লোক সবকিছু ছেড়ে হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশের বিষয় হয়ে গেল
কেন?
নরম তুলতুলে আদুরে
টাইপের মেয়ে রাত্রি। ঘর-সংসারের একটা কুটোও এদিক থেকে ওদিকে সরাতে ওর টুকটুকে
ফর্সা মুখটা লাল হয়ে যেত। কপালে জমে যেত বিন্দু বিন্দু ঘাম। বিয়ের পর পরই ঐ ঘামের
ফোঁটাগুলো টুকরো টুকরো হীরে মনে হত অনিমেষের। ধীরে ধীরে অবশ্য ওগুলো হীরের দ্যুতি
আর দাম হারিয়ে ফেলছিল।
কাজের মেয়েদেরও তো একটা
সীমাবদ্ধতা থাকে। যে সব কাজ রাত্রির করার কথা--সে সব কাজ কি কাজের মেয়েকে দিয়ে হয়?
অতএব মাঝে মাঝেই অসহায় বোধ করলেও--এমন কী মনে মনে যথেষ্ট
রেগে গেলেও বিশেষ কিছু বলতে পারত না অনিমেষ। রাতগুলোও প্রায়শঃই সুখের ছিল না।
বিছানায় আসতে একটু দেরি হলেই রাত্রি ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যেত। ঘুমের মধ্যে একমুঠো
এলোমেলো জুঁই ফুলের মতো রাত্রির শরীর অনিমেষকে দুর্নিবার টানলেও শেষপর্যন্ত
নিঃশব্দে উল্টোদিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়তে হতো! রাত্রির কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে আধখানা রাতও
কখনো মধুময় হতে পারে নি।
মনে
মনে অনিমেষ ভাবত--একটা সন্তান হলেই রাত্রি পুরোদস্তুর সংসারী হয়ে উঠবে। একদিন তাই
সন্তানের ইচ্ছে প্রকাশ করা মাত্র রাত্রির গোটা মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সাদা
ফ্যাকাসে মুখে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল রাত্রি--
--নার্সিংহোম থেকে আমি
ফিরব না!
বেশ কয়েক সেকেণ্ড
অনিমেষ বোবা হয়ে রইল। ওর কথাগুলো দ্রুত কানে গেলেও ভেতরে পৌঁছুতে সময় নিল কিছুক্ষণ।
প্রায় মিনিট খানেক পরে প্রশ্ন করল অনিমেষ--
--তার মানে?
--জ্যোতিষী আমার কোষ্ঠী
দেখে বলে নি আমার মা হওয়ার ক্ষেত্রে বিপদ আছে?
তাছাড়া আমার দিদির ঘটনা তুমি জান না?
ছেলে বেঁচে রইল কিন্তু
দিদি বাঁচল না!
--সকলের ক্ষেত্রেই একই
দুর্ঘটনা ঘটবে কেন?
--ঘটতেও তো পারে?
তুমি তো ঈশ্বর নও। এই তো সেদিন আমার কলিগ মালা’র কেসটা কি সাংঘাতিক হয়ে উঠেছিল! বাঁচার আশাই ছিল না--
--কিন্তু--’
অনিমেষ প্রায় উড়ে যাচ্ছিল রাত্রির তীব্র প্রতিরোধের
ধাক্কায়।
--প্রসব যন্ত্রণাটাও
ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তুমি তার বিন্দুমাত্র কল্পনা করতে পারবে না। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে
সব জেনেছি। তাছাড়া এত বড় পেট নিয়ে ধর পড়েই গেলাম--তখন?
না না সে আমি পারব না!
শক্ত একটা দাঁড়ি টেনে
দিল রাত্রি। ঠিক এই জায়গাটা থেকেই একটা ভয়াবহ অবসাদ মাথা তুলে ওদের দু’জনের মাঝখানের সরসতার শেষ তলানিটুকু চেটে নিল একদিন। অনিমেষ তাই অনেক
সহিষ্ণুতার পরীক্ষা দিতে দিতে একসময়ে ক্লান্ত বিধ্বস্ত হয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল তার
চেনা পৃথিবী থেকে!
--কি গো গোঁসাই,
রাত জেগে বসে বসে কার ধ্যান করছ?
কাঁধের ওপর হাতের চাপ
পড়তেই চমকে ঘুরে তাকাল অনিমেষ। ভৈরবী!
--তুমি! কখন এলে টের
পাই নি তো!
--কি করে পাবে বল?
তুমি কি আর এ জগতে আছ?
বলতে বলতে অনিমেষের
পাশেই পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল ভৈরবী। কিছুদিন আগে হলেও অনিমেষ সঙ্কুচিত বোধ করত। এখন করে
না।
--এদিকে তন্ত্র সাধনা
কর। নিজেকে ভৈরবী বল--অথচ আমাকে গোঁসাই বলে ডাক। কেন?
--তুমি তো আমার
সাধনসঙ্গী নও গো গোঁসাই। তুমি যে এখনও রাইবিনোদিনীর ভজনা করছ গো!
--কোনও ভজনাই আমি করছি
না। সাধন ভজন যতটা সহজ মনে করেছিলাম ততটা সহজ নয়--
--একা একা তো আরও কঠিন।
তাই তো এতভাবে এত করে বলছি গোঁসাই--আমার কুঞ্জবনে চল। আমাকে তোমার সাধন সঙ্গিনী করে
নাও। তার জন্যে না হয় ভৈরবীর ভেক ছেড়ে বোষ্টুমীই হব। পিছন ফিরে চলেই যখন এসেছ--ঘুরে
ঘুরে আর তাকাও কেন গোঁসাই!
--এতে তোমার পাপের ভয়
নেই ভৈরবী?
অনিমেষের প্রশ্ন শুনে
ঘাড় কাৎ করে মধুর হেসে ভৈরবী গেয়ে ওঠে--‘আমি পাপ-নদী কূলে/
পাপ-তরু মূলে/ বাঁধিয়াছি পাপ-বাসা;/
শুধু পাই পাপ-ফল/ খাই পাপ-জল/ মিটাই
পাপ-পিয়াসা!’
--পাপ তত্ত্ব এত শিখলে
কোথায় ভৈরবী?
আশ্চর্য্য অনিমেষ
জিজ্ঞেস করে।
--পাপের নদীতেই যে
এতকাল সাঁতার কাটলাম গো গোঁসাই--পাপ তত্ত্ব জানব না!
--কি রকম?
অনিমেষের মনে হল ভৈরবী
রহস্য আজ ভেদ হতে পারে।
--শুনবে?
খুব ঘেন্না হবে কিন্তু--
--এখন আর লজ্জা-ঘেন্না
খুব একটা হয় না ভৈরবী। তুমি শোনাও। তোমার কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে--
--বেশ হেসে-খেলে
বেড়াচ্ছিলাম। বাপ-মা দেখেশুনে বিয়ে-থা দিলে হয়তো সারা জীবনটাই হেসেখেলে কেটে যেত।
কিন্তু কপালে মরণের তেলক কেটে জন্মেছি--সুখ আমার সইবে কেন!
--বাপ-মা মারা গেল বুঝি?
--নাহ্। আমিই পিরীতি
আগুনে কপাল পোড়ালাম। সব গুণের আধার কালাচাঁদ আমার। তাস-পাশা-জুয়ো-মদ-মেয়েছেলে--সব
কিছুতেই লীলার সাগর! পরে পরে সব জেনেছিলাম। আমার আগেও তার একটা বউ ছিল। ভরা পোয়াতি
সেই বউয়ের পেটে লাথি মেরে শেষ করেছিল। পই পই করে বাপ-মা নিষেধ করেছিল। কিন্তু ওই যে
বললাম--কপালে মরণের তেলক কেটে জন্মেছি!
--তোমাকেও কি মারধোর--
--সে সব হলে হয়তো তাও
সইতাম গোঁসাই। সে সব নয়। চতুর্দিকে ধার দেনায় ডুবেছিল। দেনার দায় মেটাতে এক রাতে
আমার ঘরে লোক ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শেকল তুলে দিল। সেই রাতেই আমার যা ছিল তার সবই গেল!
জলে ডুবে মরতে গেলাম। বুড়ো কেষ্ট বৈরাগী মরতে দিল না। বললে--এতবড় পৃথিবীতে এলি মা
জননী--ক’জনকেই বা দেখলি কতটুকুই বা চিনলি! মরণ তো পালাচ্ছে
না--একটু দেখেশুনে যা না কেন?
কথাটা বেশ মনে ধরল। মরণ হল না!
--তারপর?
--বুড়ো কেষ্ট বৈরাগীর
সঙ্গেই গাঁ ছাড়লাম। ভিক্ষের চালে বেশ চলে যাচ্ছিল। তবে লোকের বিষ নজর সঙ্গ ছাড়ে না।
বুড়ো কেষ্ট বৈরাগীর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা মাগ-ভাতারের সম্পর্ক বলে নোংরা ইয়ার্কি
করে। তবুও দেশ-বিদেশ ঘুরে ঘুরে দিব্য চেনা-জানা আর জ্ঞানগম্যি বাড়ছিল। ঘুরতে ঘুরতেই
কেঁদুলি মেলায় পৌঁছে গেলাম। সেখানেই--
ভৈরবী হঠাৎ থেমে গেল।
অনিমেষ তাড়া দিল ভৈরবীকে--
--থামলে কেন?
এক রাত্রে চার-পাঁচজন
মিলে আমাকে ছিঁড়েখুড়ে খেল। বৈরাগী বাধা দিতে গিয়ে বেদম মার খেল।
আবার একটু থামল ভৈরবী।
সোজাসুজি তাকাল অনিমেষের চোখের দিকে। এবারে আর অনিমেষ তাড়া দিল না। একটু পরে ভৈরবী
নিজেই শুরু করল--
--আবারও কেষ্ট বৈরাগী
মরতে দিল না। বলল--ভেক পাল্টাও রাধে। বোষ্টমী নয়--এবারে ভৈরবী হও। লোকে ভয় পাবে।
কাছে খুব একটা ঘেঁষবে না। ভৈরবীরা তো তন্ত্রমন্ত্র জানে,
সহজে কেউ ঘাঁটাবে না।--কথাটা বেশ মনে ধরল। ভেক পাল্টে আবার নতুন সাজে পথে
নামলাম। বুড়ো কেষ্ট বৈরাগী কিন্তু সঙ্গ ছাড়ল। বলল--বোষ্টম আর ভৈরবী একসঙ্গে চললে
ভিক্ষে তো পাবেই না--উল্টে বড় বিপদের ভয়--বোষ্টম আর তান্ত্রিকদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধে
লেগে যাবে।
--সেই থেকে তুমি একলা?
--হ্যাঁ। একা হয়েই
প্রতি পদে পদে বুঝেছি সংসারেই বল কিংবা সাধন-ভজনের বিবাগী জীবনই বল--পৃথিবীতে একা
মেয়েমানুষের কিছু হবার নয়। যতক্ষণ না মরণ এসে একলা করে দিচ্ছে ততক্ষণ এই পৃথিবীতে
শরীর মন কিছুতেই একলা জীবন মানতে চায় না গো গোঁসাই!
--কি জানি,
তোমার মতো করে আমি এখনও এসব ভাবি নি ভৈরবী!
অনিমেষের মনে হল
প্রচলিত তত্ত্ব কথা নয়--জীবনের অভিজ্ঞতাই জীবন দর্শনের উৎসমুখ।
--তবে এখন থেকে আমরা
একলা নয়--কি বল গোঁসাই?
অনিমেষকে একটা হাল্কা
কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে তার পুরনো হাসি হেসে উঠল ভৈরবী। অনিমেষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে
উঠে দাঁড়াল। মাথার ওপর চাঁদ কখন পশ্চিমে ঢলে পড়ে তার যৌবনের ঔজ্জ্বল্য হারিয়ে
পাণ্ডুর হয়ে গেছে অনিমেষ টের পায় নি। দু’চার মুহুর্ত পরেই পাখি
ডাকবে।
--আমার ঠাণ্ডা লাগছে
ভৈরবী--আমি চলি।
অনিমেষ গা ঝাড়া দিয়ে
উঠে দাঁড়াল।
--যাবে?
যাও। আমি এখন নদীতে গা জুড়বো গো গোঁসাই। আমার কথাটা কিন্তু ভেবে দেখো।
বলেই ঝুপ্ করে পাথর
থেকে জলে ঝাঁপ দিল ভৈরবী!
সকাল হতে না হতেই ঝোলা
ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল অনিমেষ। সনাতন সাধু নদীর ঘাট পর্যন্ত নেমে এসে বললেন--
--তাহলে এখান থেকে
সত্যি সত্যি চললে?
--হ্যাঁ সাধু। এক
জায়গায় আটকে থাকার জন্যে তো পথে নামি নি!
--তা বটে! তবে হঠাৎ
হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাবনা-চিন্তা না করে পথে নামা ঠিক নয় বাবাজী! তাই
বলছি--যদি এখনও ঘরে ফেরার এতটুকুও ইচ্ছে থাকে তাহলে ঘরেই ফিরে যাও না কেন?
--না সাধু,
তা আর হয় না। শেষের পথে নেমে আর শুরুর পথে ফেরা যায় না। এখন শুধু অন্তহীন
চলা...
--এই আশ্রমের দরজা
তোমার জন্যে খোলা রইল। ইচ্ছে হলে ফিরে এস!
--আচ্ছা।
বলেই হনহন করে হাঁটা দিল অনিমেষ।
নদী পেরিয়ে তিন ক্রোশ
হেঁটে গড়জয়পুর স্টেশনে পৌঁছেই ভৈরবীর মুখোমুখি হল অনিমেষ!
--তুমি এখানে?
তোমার জন্যেই অপেক্ষা
করছি গো গোঁসাই! আমি জানতুম তুমি আজই পালাবে। ভোর রাত্রে সাধুর কাছে অনুমতি নিয়ে
নিয়েছি।
--কিন্তু আমি তো লাইনের
লোক নই। ওসব সাধন-ভজন কিছুই জানি না।
--তুমি যেমন তেমনই
থাকবে গোঁসাই! আমিই বা তন্ত্রমন্ত্রের কি জানি?
--কিন্তু--
--কালই আমি বুঝে গিয়েছি
তোমার সঙ্গেই আমার নিয়তি বাঁধা। আমরা কেউ কারুর কিছুই নই। তাই নির্ভয়ে একসঙ্গে পথ
চলতে পারি। সাধন-ভজনের জন্যে কতটা প্রয়োজন জানি না। কিন্তু ঠাঁই-ঠিকানাহীন এই পথ
চলার জন্যে তোমাকে আমার আর আমাকে তোমার প্রয়োজন হবে গো গোঁসাই। শরীরে রোগ-জ্বালা আর
পেট যদি সঙ্গে না থাকত তাহলে পথই বা কি সাগরই বা কি?
পিরীতেরও কি কোন মানে থাকত গোঁসাই?
|
প্রচ্ছদ www.modernarts.co.in