‘বামাবোধিনী’: নারীমুক্তির প্রথম বাতাস

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।


‘মেয়ে বিনে পুরুষ তো না হয় কখন
তবে কেন মেয়েদের না করে যতন।’

১২৫৬ সালের বৈশাখ সংখ্যায় ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় একজন মহিলা যখন এই প্রশ্ন তোলেন তখন বাংলাদেশে মেয়েদের হালচাল কেমন ছিল সে কথা লিখলে এখন এই কালে রীতিমতো অবিশ্বাস্য মনে হবে। তখন সমাজের প্রায় প্রতিটি পরিবারের বিশ্বাস ছিল পতি পদে মতি ছাড়া সতী নারীর অন্য কোনও কামনা বাসনা থাকা উচিত নয়। ঊনিশ শতকের প্রায় গোটাটাই গ্রাম শহরের অন্দর মহলের প্রধান শিক্ষাই ছিল,

‘তীর্থ ভ্রমণ নাহি প্রযোজন
যদি থাকে স্বামী পদে মন!’
 

১৮২৯ সালের আগে সতীদাহ প্রথা, কুলীন প্রথা, বাল্য বিবাহ, বাল্য বিধবার অভিশপ্ত জীবন--ইত্যাদি ভয়ঙ্কর রকমের সব জ্বলন্ত লৌহশলাকায়  বিদ্ধ হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হওয়াই ছিল অধিকাংশ বঙ্গ মহিলার অনিবার্য নিয়তি। ঐ সমাজ ব্যবস্থার কিছু কিছু ছবি লিখে রেখে গেছেন রাসসুন্দরী দাসী ও কৈলাসবাসিনী দেবী নামে দুই মহিলা। কৈলাসবাসিনী দেবী তাঁর হিন্দু মহিলাগণের হীনাবস্থা গ্রন্থের প্রথম পাতায় তাঁর যে মনোবেদনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন তার কিছুটাও যদি এখনো আমাদের সমাজে বর্তমান থাকতো তাহলে ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।

 

১২ বছর বয়সে রাসসুন্দরী দেবীর বিবাহ হয়। তিনি তাঁর আত্মকথায় লিখেছেন

সকলে আমাকে যত্নে আনিয়া পাল্কীর মধ্যে উঠাইয়া দিলেন।.....যখন দুর্গোৎসবে কি শ্যামাপূজায় পাঁঠা বলি দিতে লইয়া যায়, সে সময়ে সেই পাঁঠা যেমন প্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া হতজ্ঞান হইয়া মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে, আমার মনের ভাবও ঠিক সেই প্রকার হইয়াছিল।

 

১২ বছর বয়সে বিয়ে এবং ১৪ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের জন্মের পর ৪১ বছর বয়স পর্যন্ত অর্থাৎ ২১, ২৫, ২৮, ৩০, ৩২, ৩৬ (এই সন্তান গর্ভেই নষ্ট হয়ে যায়), ৩৭, ৩৯, ও ৪১ বছরে ১০টি সন্তানের জন্ম দিতে দিতে রাসসুন্দরী দাসীর অবস্থা কেমন হয়েছিল? তাঁর নিজের ভাষাতেই শোনা যাক্,

ঐ ২৩ বৎসর আমার যে কি প্রকার অবস্থায় গত হইয়াছে তাহা পরমেশ্বর জানিতেন, অন্য কেহ জানিত না !

 

সংস্কারের অন্ধকারে নির্বাসিত থেকে বহুলাংশে সন্তান উৎপাদনের মতো সতীব্রত পালন করতে করতেই ইহলীলা সাঙ্গ করাই ছিল তাদের একমাত্র জীবনধর্ম। ঊনিশ শতকের মধ্যভাগেও বদ্ধমূল সংস্কার ছিল লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা বিধবা হয়। উচ্চশিক্ষা পেলে পর-পুরুষে আসক্ত হয়ে বিপথগামী, এমন কী পতিতাও হতে পারে ! এই বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানার জন্য সুলভ পত্রিকাতে দ্বারকানাথ লিখলেন,

‘স্ত্রীলোকেরা বিদ্যাশিক্ষা করিলে বিধবা হয়, এ প্রশ্নে আমরা আর হাস্য সম্বরণ করিতে পারি না। কারণ, বিদ্যার কী মারাত্মক শক্তি আছে? বিদ্যা কি নরভোজী ব্যাঘ্র? যদি নারী বিদ্যাবতী হইলে পতিহীনা হয়, তবে ইহাও বলা যাইতে পারে যে পুরুষ বিদ্বান হইলেও স্ত্রীহীন হইতে পারেন। অতএব স্ত্রীজাতি বিদ্যাবতী হইলে যে বিধবা হয়, এ কথা কেবল হাস্যজনক মাত্র।’

 

নানাদিক থেকে নানাভাবে স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের চেষ্টা চললেও প্রকাশ্যে শিক্ষালাভে আগ্রহ সে তুলনায় সামান্যই ছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে ১৮৪৭ সালে কলকাতার কাছে বারাসতে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালী ভদ্রলোক প্যারীচরণ সরকার  প্রথম বালিকা বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। প্যারীচরণ বারাসত সরকারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কলকাতার হিন্দু কলেজে এবং বারাসতের এই বালিকা বিদ্যালয়--এই দুটি প্রতিষ্ঠানই সম্পূর্ণভাবে বাঙালীদের নিজস্ব উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

 

এর বছর দুই পরে কলকাতায় বেথুন সাহেব প্রতিষ্ঠা করলেন ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। একই বছরে প্রতিষ্ঠিত হল উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয়। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক এই সংবাদে উচ্ছ্বসিত হয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলেন,

সেই দিবস কি সুখের দিবস হইবেক--যে দিবসে জননী এবং ভগিনী, পুত্র এবং সহোদরগণকে কূনীতি শিক্ষাদানের বিনিময়ে পুস্তক ধরাইয়া বিদ্যা বিষয়ের উপদেশ প্রদান করিতে থাকিবেন।.....লক্ষ্য করিবার বিষয় এই যে, নারীশিক্ষার ওকালতি অস্মৎপক্ষে কুশলের জন্য। সুমাতা ও সুভগিনী সৃষ্টিকল্পে নারীর নিজ বিকাশের প্রয়োজনে যে শিক্ষার সার্থকতা, তার আত্মবিশ্বাস, আত্মপ্রতিষ্ঠা, আইনগত সম অধিকার এবং উপার্জন ক্ষমতা অর্জনের একমাত্র পদ্ধতি যে শিক্ষা, এই ভাবনা সাধারণ মধ্যবিত্ত পুরুষ মানসে আসে নাই।

 -- এই ভাবনাকে পুরুষ হৃদয়ে ছড়িয়ে দিতে এবং সমাজের যথার্থ এবং সার্বিক উন্নতি ও মঙ্গলার্থেই স্ত্রী-পুরুষ সকলেরই যে শিক্ষালাভে সমান অধিকার ও সুযোগ থাকা প্রয়োজন সেটা বোঝাবার দায়িত্ব পালনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে এসেছিল বামাবোধিনী পত্রিকা। বামাবোধিনীর জন্ম তাই বঙ্গ নারী সমাজের ইতিহাসে এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ।

 

বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে ১৮১৮ সাল একটি ক্রান্তিকারী বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ঐ বছরেই এপ্রিল মাসে শ্রীরামপুর থেকে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রথম মাসিকপত্র দিগদর্শন প্রকাশিত হয়। ২৩ মে প্রথম সাপ্তাহিক সমাচার দর্পণ এবং পরের মাসেই অর্থাৎ জুনে মাতৃভাষায় সাময়িক পত্রের প্রথম উদ্যোক্তা ও প্রকাশক এবং প্রখ্যাত সম্পাদক গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য বাঙ্গাল গেজেট প্রকাশ করেন। সাময়িকপত্রের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র হিসেবে ঈশ্বর গুপ্তের সাপ্তাহিক সংবাদ প্রভাকরই ১৮৩৯ সালের ২৮ শে জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে। ইতিমধ্যে বহু সাময়িক পত্র-পত্রিকা  প্রকাশিত হয়েছে এবং প্রকাশের প্রস্তুতিও চলছে। লেখালেখির ক্ষেত্রে রামমোহন রায়, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (বীজাকারে প্রথম বাংলা উপন্যাসের সূত্রপাত হিসেবে বাবুর উপাখ্যান রচয়িতা), ঈশ্বর গুপ্ত, অক্ষয়কুমার দত্ত, রঙ্গলাল-বঙ্কিমচন্দ্র-হেমচন্দ্র-দীনবন্ধু-দ্বারকানাথ অধিকারী-গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ (গুড়গুড়ে ভটচায্)-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন প্রমুখ বহুজনের সক্রিয়তায় উজ্জ্বল আলোর পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল।

 

এইভাবে ১৮৬৩ পর্যন্ত অজস্র সাময়িকপত্রের জন্ম হলেও শুধুমাত্র নারী সমাজের কথা ভেবে তাদের মুক্তির পথ দেখাতে তাদের জন্যেই কোন পত্র-পত্রিকার জন্ম হয় নি। অবশেষে মূক নারীসমাজের মুখে ভাষা দিতে এবং নারীসমাজের প্রয়োজনীয় উন্নতির বাতাবরণ তৈরি করতে ১৮৬৩র আগস্ট মাসে প্রকাশিত হল বামাবোধিনী পত্রিকা। সাময়িক পত্র-আশ্রিত বাংলা গদ্যসাহিত্য নামে এক প্রবন্ধে সজনীকান্ত দাস এই পত্রিকা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন,

‘স্ত্রীলোকদিগের আবশ্যক সমুদায় বিষয় প্রচারের জন্য উমেশচন্দ্র দত্ত ১৮৬৩’র আগস্ট হইতে মাসিক ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। দেশের অর্ধেক মানুষকে মানসিক পঙ্গুতা হইতে উদ্ধার করিবার সক্রিয় উদ্যোগ করিয়া ‘বামাবোধিনী’ পত্রিকা চিরদিন বাঙালী জাতির স্মরণীয় হইয়া আছে (সত্যি কি আছে? কজন এই ‘বামবোধিনী’র কথা জানেন?)। বাংলার মূক নারীসমাজ এইখানেই সর্বপ্রথম বাঙ্ময় হইবার সাধনা করেন।’

মূক নারীসমাজকে বাঙ্ময় করে তোলার ক্ষেত্রটা রাতারাতি তৈরি হয় নি। কয়েকজন চিরস্মরণীয় মনীষীর উদ্যোগ এর পিছনে ছিল। বিশেষ করে ব্রাহ্মবন্ধুসভার প্রতিষ্ঠাতা তরুণ বাংলার কণ্ঠ কেশব সেনের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সংষ্কারাচ্ছন্ন অন্দরমহলের অন্ধকারকে আঘাত করা তৎকালীন অভিজাত বঙ্গসমাজে অত্যন্ত কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব যে নয় সে কথা প্রমাণের জন্যই ১২৬৯ সালের পয়লা বৈশাখ নববর্ষের দিন তরুণ কেশব সেন তাঁর পনের বছরের স্ত্রীকে নিয়ে প্রকাশ্য রাজপথে হেঁটে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অনুগামী লিখেছিলেন--`Thus was Laid  The first stone of woman's education and emancipation.' যথার্থই লিখেছিলেন তিনি।

ফলে স্বভাবতঃই কেশব সেন প্রতিষ্ঠিত বন্ধুসভা মনে করেছিল,

অস্মদেশীয় লোকদিগের স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে যে সংস্কার আছে, তাহাতে প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ হয় না। উর্দ্ধকল্প ৮/১০ বৎসর কাল প্রকাশ্য বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিয়া শিশুর শিক্ষাপোযোগী কয়েকখানা সামান্য পুস্তক পাঠ করতঃ সকল বালিকাই বিদ্যালয় পরিত্যাগ করে এবং অতঃপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হইয়া চিরজীবনের মতো অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ হয়। কাজেই অন্তঃপুর শিক্ষার প্রসার ঘটাতে এবং প্রয়োজনীয়তা বোঝাতেই জন্ম হল ১৮৬৩ সালেই বামাবোধিনী সভা

 

পত্রিকার প্রথম সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য এবং জন্মবৃত্তান্ত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন,

যখন এ দেশের স্ত্রী জাতির অবস্থা অতি হীন ছিল, তাহার তাহাদিগের শিক্ষার্থে বিদ্যালয় সকল অঙ্গুলির অগ্রে গণনা করা যাইত, তাহাদিগের পাঠ্যপুস্তক সংখ্যা অতি অল্প ছিল, তাহাদিগের বিশেষ অভাব পূরণ জন্যি একখানি সাময়িকপত্র বিদ্যমান ছিল না, তাহাদিগের উন্নতির জন্য একটিও নারী সভা স্থাপিত হয় নাই, কেবল কতকগুলি দেশহিতোৎসাহী কৃতবিদ্য পুরুষ স্ত্রীলোকের বিদ্যাশিক্ষার আবশ্যকতা বিষয়ে প্রকাশ্য সভায় বক্তৃতা করিতেন, সেই সময় এই বামাবোধিনীর সূচনা। যশোহর নিবাসী আমাদিগের এক শ্রদ্ধেয় বন্ধু (বাবু বসন্ত কুমার ঘোষ, অমৃতবাজার পত্রিকা সম্পাদক শিশির কুমার ঘোষ মহাশয়ের অগ্রজ) কলিকাতাস্থ রঘুনাথ চাটুজ্যে লেন, ১৬-নং বাসায় আসিয়া অবস্থিতি করেন। স্ত্রীলোকদিগের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির সহায়তার জন্য একখানি সাময়িক পত্রিকার নিতান্ত প্রয়োজন, এই বলিয়া তিনি এই কার্যে  আমাদিগের কয়েকজনকে অগ্রসর হইবার জন্য উৎসাহিত করেন। ইঁহারই বিশেষ উদ্যোগে বাসায় এক ক্ষুদ্র গৃহে আমাদিগের এক বন্ধুসমিতি (বামাবোধিনী সভা) হয়। তাহাতে পত্রিকার নামকরণ লইয়া অনেক কথা হয়, অবশেষে আমাদিগের প্রিয় বামাবোধিনী নামটি কোমল, সরস ও উদ্দেশ্য সঠিক বলিয়া সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়।

 

কলকাতার মীর্জাপুর স্ট্রীটের মথুরানাথ তর্করত্নের প্রাকৃত যন্ত্রে এক হাজার কপি বামাবোধিনী ছাপা হয়। দাম ধার্য হয় প্রতি কপি এক আনা এবং প্রথম গ্রাহক হন একজন মহিলা--ভুবনমোহিনী বসু। যদিও বামাবোধিনীর প্রথম সংখ্যায় কোনও মহিলার লেখা ছিল না। মহিলাদের লেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব ছিল সে সময়। প্রকৃতপক্ষে প্রথম সংখ্যার একমাত্র লেখক ছিলেন সম্পাদক উমেশচন্দ্র নিজেই ! বাবু বসন্তকুমার ঘোষ এবং বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী ঐ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও প্রথম সংখ্যায় তাঁরাও লেখেন নি। মেয়েদের জন্য পত্রিকায় মেয়েদের লেখা থাকবে না এটা বেশিদিন চলতে পারে না। চলা উচিত নয় বুঝে সম্পাদক বিজ্ঞাপন দিলেন,

বামাবোধিনী সভাতে স্ত্রীলোকদিগের লেখা সমাদর পূর্বক গৃহীত হইবে এবং যোগ্য হইলে পত্রিকাতে প্রকাশ করা যাইবে। লেখিকাগণ সম্পাদকের নিকট স্ব স্ব নাম ধাম সম্বলিত পত্র প্রেরণ করিবেন।

 

এই বিজ্ঞাপনে মুষ্টিমেয় কৃতবিদ্য মহিলা সাড়া দিয়ে বামাবোধিনীকে নানা সময়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন। পঁচিশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যায় পত্রিকার তেত্রিশ জন প্রধান প্রধান লেখকদের তালিকার মধ্যে যে সব মহিলা লেখক ছিলেন তাঁরা হলেন--রাধারাণী লাহিড়ী, শ্যামাসুন্দরী দেবী, স্বর্ণপ্রভা বসু, কাদম্বিনী বসু, কামিনী সেন, রমাসুন্দরী ঘোষ, লক্ষ্মীমণি দেবী, স্বর্ণলতা ঘোষ, জয়কালী গুপ্ত, হরিমতি বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদিনী ঘোষ, রাজকুমারী রায়চৌধুরী এবং শ্রীমা ছদ্মনামে মানকুমারী বসু। কয়েকজন বিদেশিনীও এই পত্রিকায় লিখেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন--মিস্ কার্পেন্টার, মিস্ কলেট, মিস্ ম্যানিং ও বিবি নাইট। কেশব সেনের কারণেই এঁরা এই পত্রিকার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন।

পত্রিকার বিষয়সূচীর মধ্যে বেশ বৈচিত্র্য থাকতো। সাহিত্য ভূগোল বিজ্ঞান ইতিহাস নীতিবোধ পারিবারিক শিক্ষা ইত্যাদির পাশাপাশি এই বিশ্বাস সবসময়ের জন্যই প্রকাশ করা হত যে,

বলী রাজা একশত মূর্খ লইয়া স্বর্গে গমন কষ্টকর বিবেচনা করিয়াছিলেন। আমরা স্ত্রী কন্যা প্রভৃতি সহস্র সহস্র মূর্খ বেষ্টিত হইয়া যে মর্ত্যলোকে সুখী হইব ইহা কোনক্রমেই সম্ভাবিত নহে।‘ (সোমপ্রকাশ / ১৭ জ্যৈষ্ঠ, ১৮৬৫)

 

পত্রিকার মাধ্যমে নারী চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য সম্পাদক উমেশচন্দ্র দত্ত নানা রকমের ভাবনা চিন্তা করতেন। ১৮৮৮ সনে পত্রিকার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সম্পাদক একাধিক বিষয়ের ওপর মেয়েদের রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। প্রতিযোগিতার সেই বিষয়গুলি শতাধিক বৎসর পরেও ভাববার মতোই ছিল। যেমন--ভারতে দুঃখিনী বিধবা বা অনাথা স্ত্রীলোকদিগের জীবিকা লাভের কত প্রকার উপায় হইতে পারে, বিশ্বসেবাব্রতে স্ত্রীলোকের সহকারিতা, প্রাচীন ও আধুনিক গৃহকার্য  প্রণালী ও তার উন্নতির উপায়, বাঙালী স্ত্রী-পরিচ্ছদ ও এর উৎকর্ষ সাধন, নব্য গৃহিণীদের নূতন অভাব ও তন্মোচনের উপায় ! এই বিষয়গুলির প্রতিটিই কি গবেষণাযোগ্য বিষয় নয়?

 

বামাবোধিনীর অনেক পরে বঙ্গমহিলা’ (১৮৫৭) এবং অবলা’ (১৮৭৮) নামে আরও দুটি মহিলা পত্রিকা প্রকাশিত হলেও বামাবোধিনীর সমকক্ষ তারা হতে পারে নি। যদিও সাময়িকপত্রের ইতিহাসে বঙ্গমহিলা স্মরণীয় হয়ে আছে প্রথম পাক্ষিক পত্রিকা হিসেবে এবং প্রথম মহিলা সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত মেয়েদের পত্রিকা হিসেবে।

 

মোক্ষদায়িনী মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত বঙ্গমহিলা যখন ১৮৮২ সনে ছড়া কেটে মেয়েদের বলছে,

‘হোক না সে নারী চম্পকবরণী
হোক না সে নারী মুধুর ভাষিণী
হোক না সে নারী কেন বিদ্যা বিচক্ষণা
কিন্তু যদি তার মন না থাকে পতিতে
পতিতা হইবে সেই এসব থাকিতে !’

তখন বামাবোধিনী ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে থাকা সুমাতাদের আহ্বান জানাচ্ছে এই বলে যে--তাহাদিগের বাইরের জগতের কঠোর কর্মক্ষেত্রে জনসংঘের সহিত মিলিত হইতে হইবে।

 

কমবেশি ৬০ বছরের ইতিহাসে বামাবোধিনীর ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন করার সামান্য সুযোগও এই পরিসরে নেই। ১৮৬৩ থেকে ১৯০৭-এর ১১ জুন মৃত্যুদিন পর্যন্ত সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা উমেশচন্দ্র দত্তের জীবন ইতিহাসও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। তিনি তাঁর অসাধরণ মেধা এবং উদ্যমকে সম্বল করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এই পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করে গেছেন ! শুধুমাত্র কোচবিহার-বিবাহ এবং অন্যান্য কিছু অভ্যন্তরীণ মতানৈক্যের ফলে ব্রাহ্মসমাজে ভাঙন ধরার সময়ে ১৮৭৮-এর মে, জুন, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরে পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে নি। ১৯২১ সালে আনন্দকুমার দত্ত সম্পাদক থাকাকালীন এই পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। বামাবোধিনী কিন্তু তার শেষ নির্যাস অমলিন রেখেছিল এই বলে যে,

আমাদের আদর্শ শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইলে বর্তমান সময়ের উপযোগী পাশ্চাত্য শিক্ষা ও পূর্বকালের আধ্যাত্মজ্ঞান লাভের ব্যবস্থার একত্র সমাবেশ করিতে হইবে। কেবল জড় বিজ্ঞান শিক্ষা করিয়া কি করিবে, যদি আধ্যাত্মজ্ঞান না জন্মে।

 

ইতিহাসের পাতায় পাতায় ধুলো জমে। পাতাগুলো জীর্ণ হয়ে যায়--এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবু কখনো মানুষকে ফিরে তাকাতে হয় পেছনে। এখন যা কুড়িয়ে চলেছি সে সব কতটা মহার্ঘ্য যেগুলো পিছনে ফেলে এসেছি সেগুলোর তুলনায়? হাতে আধুনিকতম প্রযুক্তির কল্যাণে অফসেটে ছাপা ঝকঝকে রঙিন মহিলা পত্রিকা (মূলতঃ নারী প্রসাধনী ও সৌন্দর্য্য বিপণনের উদ্দেশ্য সাধনই যাদের মূল প্রতিযোগিতা) হাতে তুলে নেওয়ার সময় কি একবারও মনে পড়ে মাত্র ১০০ বছর আগের মহিলা পত্রিকাগুলোর কথা? সময়ের প্রেক্ষাপটে তাদের লড়াই ও সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতি একনিষ্ঠ দায়িত্ব পালনের ইতিহাস একালের মহিলা লেখকদের সিংহভাগই অনুসন্ধানের প্রয়োজন মনে করেন না। সেই অন্ধকার অন্দরমহল-আঁতুরঘরের দিকে কদাচিৎ কেউ ফিরে তাকাবার কথা ভাবেন কোন বিশেষ উপলক্ষ্য সামনে এলে, দুএক ঝলক সামান্য আলোর ফুলকি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে। বলাই বাহুল্য, তাতে যে বিশেষ কিছু কাজের কাজ হচ্ছে না তা বোঝা যাচ্ছে আমাদের গৌরবময় ইতিহাস দ্রুত বিস্মৃতির অন্ধকারে যে ভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তা দেখেই !

 

***

 

তথ্যসূত্র :

বামাবোধিনী পত্রিকা / তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা / শনিবারের চিঠি / প্রবাসী / বঙ্গশ্রী / সমাজবিজ্ঞানী বিনয়ঘোষ এবং অধ্যাপক উদয়ন মিত্র /যোগেশচন্দ্র বাগল রচিত স্ত্রীশিক্ষার কথা

সূচীপত্র