বাইশে শ্রাবণ
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
................................................ |
রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে মৃত্যুকে বড় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মাত্র একচলিল্লশ বছর বয়সে স্ত্রী বিয়োগের মধ্য দিয়ে। কবি যখন দূরে থাকতেন স্ত্রী মৃণালিণী দেবীকে ‘ভাই ছুটি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখতেন। কবির সেই ‘ছুটি’ যখন সংসার জীবন থেকে সত্যিই একদিন ছুটি নিয়ে চলে গেলেন তখন তার বয়স ছিল মাত্র ঊনতিরিশ। কিশোর বয়সের গাঢ় বন্ধুপ্রতিম বৌদি কাদম্বরী দেবীর অকালমৃত্যু ও আরও পরে স্ত্রীর মৃত্যু এবং একে একে প্রিয়জনদের মৃত্যুর নীরব সাক্ষী ও মৃত্যুশোক রবীন্দ্রনাথের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভে সহায়ক হয়েছিল। কবি জীবনস্মৃতিতে ‘মৃত্যুশোক’ পর্যায়ে অকপটে লেখেন, ‘জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম, তাহা বড্ড মনোহর।’ ২২ শে শ্রাবণ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ দিবস। বাংলা
সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের অবাধ বিচরণ নেই।
সাহিত্যকর্মের সূচনালগ্নে তিনি বলেছিলেন , ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যামসমান।
মৃত্যু-অমৃত করে দান। তুহুঁ মম শ্যামসমান’! তিনিই আবার কিছুকাল পরে বলছেন,
‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’! রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্ম ধর্মের
উপাসক ছিলেন। শৈশবে কবি পিতার সাথে হিমালয় দর্শনে যেতেন। তপোবনের মুনি
ঋষিদের ধ্যানী চেতনা তাঁর সৃষ্টি কর্মে ঘুরে ঘুরে এসেছে নানান ব্যঞ্জনায়।
এছাড়াও বৈষ্ণব কবিদের রচনা, শ্রী চৈতন্যদেবের, লালন ফকিরের প্রভাব তাঁর
সাহিত্যকর্মকে সমৃদ্ধ করেছে । বিশ্বপ্রকৃতি , প্রেম ,আত্মনিবেদন, পূজা,
নারী, জীবন দেবতা, সমকালীন সমাজব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের সুখ দুঃখ ও বিরহ
মিলনের চিত্র অত্যন্ত সার্থকভাবে আমরা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মে দেখতে পাই।
১৯১৩ সালে তিনি ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন।
জীবনের শেষ নববর্ষে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তার সাধের শান্তিনিকেতনে। সে দিন তার কলমে রচিত হয়েছিল ‘সভ্যতার সংকট’ নামের অমূল্য লেখাটি। তারও ক’দিন পর ১৯৪১ সালেরই ১৩ মে লিখে রাখলেন, রোগশয্যায় শুয়েই ‘আমারই জন্মদিন মাঝে আমি হারা’। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলোতে কখনও তিনি শয্যাশায়ী, কখনও মন্দের ভাল। শেষের দিকে ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই, শান্তিনিকেতনের আশ্রম বালক বালিকাদের ভোরের সঙ্গীত অর্ঘ্য তিনি গ্রহণ করেন তার উদয়ন গৃহের পূবের জানালার কাছে বসে। উদয়নের প্রবেশদ্বার থেকে ছেলেমেয়েরা গেয়ে ওঠে কবিরই লেখা ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ,আজি প্রাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার।’ জানা যায়, মৃত্যুর মাত্র সাত দিন আগে পর্যন্তও কবি সৃষ্টিশীল ছিলেন। জোড়াসাঁকোয় রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি বলতেন, রানী চন্দ তা কবিতার ছন্দে লিখে নিতেন। কবি বলে গেছেন, ক্রমশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন কবিতাটি বলতে বলতে। দিনটা ছিল কবির শেষ বিদায়ের কয়েক দিন আগে ১৪ শ্রাবণ। রানী চন্দ সে দিন সূত্রধরের মতো লিখেও নেন রবীন্দ্রনাথ কথিত কবিতাটি ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বর্ণনা পাওয়া গেছে এভাবে --আগস্টের প্রথম দিন
দুপুরবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের হিক্কা শুরু হয়। আগস্টের ৩ তারিখ থেকে
কিডনিও নিঃসাড় হয়ে পরে। ৬ আগস্ট রাখি পূর্ণিমার দিন কবিকে পূর্বদিকে মাথা
করে শোয়ানো হল। পরদিন ২২শে শ্রাবণ, ৭ আগস্ট রবীন্দ্রনাথের কানের কাছে
মন্ত্র জপ করা হয় ব্রাহ্ম মন্ত্র ‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈতম..’ ‘তমসো মা
জ্যোতির্গময়.....’। |
***