স্বীকৃত সাহিত্য : সাহিত্যে
স্বীকৃতি
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
................................ |
প্রবন্ধের শিরোনামের মধ্যেই বিষয়ের ব্যাপকতা এবং কাঠিন্য স্পষ্টতঃই অনুভূত হচ্ছে। এ বিষয়ে কলম ধরার ধৃষ্টতা অনুশীলিত পাঠকদের কাছে কী ভাবে আপ্যায়িত হবে সে ভাবনা দূরে রেখেই ব্যক্তিগত কিছু চিন্তনের প্রকাশ করতে হচ্ছে সম্পাদকের আগ্রহাতিশয্যেই।
সাহিত্যরসিক পাঠকদের
‘সাহিত্য’
শব্দের ব্যুৎপত্তি
সংক্রান্ত ব্যাখ্যা শুনিয়ে ক্লান্ত না করে ‘সাহিত্য’
বিষয়টি কি তা
বোঝার চেষ্টা করা যাক্। আমরা সকলেই জানি অনির্দিষ্ট কোনো এক আদিম মহূর্তে
আগুনকে ঘিরে মানুষের সংলাপ নির্ভর গল্পের সূচনা হয়েছিল। কলম তখনো মানুষের
চিন্তা-চেতনার ধারে
কাছেও ছিল না। গল্পের একমাত্র অবলম্বন ছিল কথা।
কথা নির্ভর সেই গল্প এবং মানুষের কল্পনাকে আশ্রয় করে দানা বেঁধে ওঠা নানান
কাহিনী বহু বহু যুগ পরে ‘সাহিত্য’
হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল। স্বীকৃতির বিষয়টা নিয়ে তখন ভাববার
কোনো অবকাশই ছিল না। বংশ পরম্পরায় কথানির্ভর গল্প-কাহিনীর বহু খণ্ডই
নিশ্চিতভাবেই হারিয়ে গেছে গ্রহণযোগ্যতার অভাবে। যেসব গল্প-কাহিনীর
গ্রহণযোগ্যতা ছিল না,
তা জন্মের অল্পদিনের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে
সঙ্গত কারণেই। যেসব গল্প-কাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা যুগের পর যুগ অটুট ছিল তারা
কালোত্তীর্ণ হয়েও মুখে মুখেই টিকে ছিল বহু কাল,
অন্ততঃ যতদিন না সেসব ছবিতে বা কলমের আঁচড়ে মানুষ ধরে রাখতে
পেরেছে। তখন সেই সব গল্প-কাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করত জনপ্রিয়তার
নিরিখে। মানুষের ভালোলাগার বিচারে। কোনো সমালোচকের মতামতের ভিত্তিতে নয়।
লিখতে শেখার পর মানুষ কিন্তু অল্প-স্বল্প লেখায় তৃপ্ত থাকত না। কাহিনী লিপিবদ্ধ হতে থাকল মহাকাব্যের আঙ্গিকে ছন্দোবদ্ধভাবে অর্থাৎ পদ্যের ঢঙে। যা কাব্য হিসেবে স্বীকৃত হলেও তাকেই ‘সাহিত্য’ বলা হত। গদ্য এসেছে অনেক অনেক পরে। গদ্য আসার পর কাব্য শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের একটা শাখা হিসেবে গণ্য হয়েছে। বিরাট বিশাল মহাকাব্যের কাহিনীর জটাজাল ধরা থাকত সর্গের পর সর্গে। ইলিয়ড, মহাভারত, রামায়ণ বিশ্বসাহিত্যের অমর উপাচার। শত শত কাহিনীকে গাঁথা হয়েছিল এক সূত্রে! আধুনিক সাহিত্যে এ ধরণের উদ্যোগের কথা ভাবার মতো কলমচির আর জন্ম হয় না। ভাবেও না কেউ। যদিও বা কেউ লেখার চেষ্টা করে পাঠকদের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা কি আদৌ তৈরি হবে? গ্রহণযোগ্যতাই যদি তৈরি না হয় তাহলে সে সাহিত্য স্বীকৃতি পাবে কি করে? তাহলে কি পাঠকদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা কিংবা তার ‘রিডিবিলিটি’র ওপর স্বীকৃতি পাওয়া না পাওয়া নির্ভরশীল?
গ্রীক দার্শনিক প্লেটো মনে
করতেন সাহিত্য আর কিছুই নয় পরিদৃশ্যমান
জগত-সংসারের অনুকৃতি মাত্র। তাঁর প্রশ্ন ছিল যে জগৎ দৃশ্যমান সেই
জগতই যখন তার রূপ-স্রষ্টার সন্ধান দিতে পারছে না তখন মানুষের তৈরি
সাহিত্যের নকল জগৎ কি করে পরম সত্যের সন্ধান দেবে?
তাঁর ‘আদর্শ রাজ্য’
থেকে তিনি তাই সাহিত্যিকদের নির্বাসন চেয়েছিলেন বলে কথিত আছে। কিন্তু প্লেটোর
এই ধারণা সর্বগ্রাহ্য ছিল না। কারণ কবি বা সাহিত্যিকরা শুধুমাত্র
পরিদৃশ্যমান জগতের বর্ণনাতেই
বা প্রতিফলনের চেষ্টাতেই নিজেদের নিয়োজিত রাখতেন না। বাস্তব দৃশ্যমান জগতের
সীমার বাইরে অসীম ও অনন্তের রহস্যময় জগত আছে তার অদেখা অশ্রুত অনুরণন
হৃদয়ের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছেন। যাঁদের সেই চেষ্টা নতুন জগতের সন্ধান
দিতে পেরেছে তাঁরাই সাহিত্য রচনা করেছেন,
তাঁদের সৃষ্টিই আলোচিত হয়েছে,
যুগে যুগে তার ‘রিডিবিলিটি’
গড়ে উঠেছে। ‘সাহিত্য’
প্রসঙ্গে
সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘যাহা প্রকৃতির
প্রতিকৃতিমাত্র,
সে সৃষ্টিতে কবির তাদৃশ
গৌরব নাই। তাহার কারণ,
সে কেবল
প্রতিকৃতি-অনুলিপি মাত্র--তাহাকে সৃষ্টি বলা যায় না। যাহা সত্যের প্রতিকৃতি
মাত্র নহে,
তাহাই সৃষ্টি। যাহা স্বভাবানুকারী অথচ
স্বভাবাতিরিক্ত তাহাই কবির প্রশংসনীয় সৃষ্টি।
কাব্যের
অন্তঃপ্রকৃতি ও বহিঃপ্রকৃতির মধ্যে যথার্থ সম্বন্ধ এই যে,
উভয়ে উভয়ের
প্রতিবিম্ব নিপতিত হয়,
অর্থাৎ
বহিঃপ্রকৃতির গুণে হৃদয়ে ভাবান্তর
ঘটে এবং মনের অবস্থাবিশেষে বাহ্যদৃশ্য সুখকর বা দুঃখকর বোধ হয়--উভয়ে
উভয়ের ছায়া পড়ে। যখন বহিঃপ্রকৃতি বর্ণনীয়,
তখন অন্তঃপ্রকৃতির সেই
ছায়াসমেত চিত্রিত করাই কাব্যের উদ্দেশ্য। যখন অন্তঃপ্রকৃতি বর্ণনীয় তখন
বহিঃপ্রকৃতির ছায়াসমেত বর্ণনা তাহার উদ্দেশ্য। যিনি ইহা পারেন তিনিই সুকবি।
ইহার ব্যতিক্রমে এক দিকে ইন্দ্রিয়পরতা অপর দিকে আধ্যাত্মিক দোষ জন্মে।’
বঙ্কিমচন্দ্রের এই বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হচ্ছে যে, পরিদৃশ্যমান বাস্তব জগতকে অন্ধের মতো অনুকরণ করলে অথবা শুধুমাত্র কল্পনায় ভেসে গেলে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। কল্পনাকেও বাস্তবানুগ হতে হবে এবং অবশ্যই রসোত্তীর্ণ হওয়া জরুরি। প্লেটোর শিষ্য এরিষ্টটল গুরুর ধারণাকে মানতে না পেরে বলেছিলেন--The truth of poetry is not a copy of reality but a higher reality : what to be, not what it is. বিখ্যাত সমালোচক হাড্সনও প্রায় একই কথা বলেছেন-- By poetic truth we mean fidelity to our emotional apprehensions of facts......Our first test of truth in poetry, therefore, is its accuracy in expressing, not what things are in themselves, but their beauty and mystery, their interest and meaning for us. অর্থাৎ হাড্সনের মতে সাহিত্য হল interpretation of life.
সাহিত্য প্রসঙ্গে
রবীন্দ্রনাথের মতামতটিও কিন্তু বিশেষভাবে স্মরণ করতে হচ্ছে প্রসঙ্গতঃ— ‘বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সঙ্গীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষারচিত সেই চিত্র এবং সেই গানই সাহিত্য। অন্যান্য কলাবিদ্যার আলোচনা করিলেও আমরা দেখিতে পাইব যে, তাহারা প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ নহে। কেবল সাহিত্য কেন, কোনো কলাবিদ্যাই প্রকৃতির যথাযথ অনুকরণ নহে।’
এর পরেও কি ‘সাহিত্য’
ঠিক কী এই
প্রশ্নের সঠিক জবাব পাওয়া গেল?
একটা নির্দিষ্ট
সংজ্ঞার মধ্যে আজও ‘সাহিত্য’
কিংবা ‘সাহিত্যের
সাহিত্যত্ব’কে বেঁধে ফেলা সম্ভব হয়নি।
খুব কম কথায় বলতে গেলে বলতে হয়,
যা পড়লে মনের মধ্যে কিছু প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং পড়ার আগের মনের সঙ্গে পড়ার
পরের মনের মধ্যে যে পরিবর্তন সৃষ্টি হয় তাকেই ‘সাহিত্য’
বলে মনে করেছেন
অনেকেই। মনের এই পরিবর্তন সৌন্দর্য্য,
সত্য কিংবা আনন্দ উপলব্ধির কারণে ঘটতে পারে,
যা ‘সাহিত্য’
মানুষকে দিতে
সক্ষম। সৌন্দর্য্য-সত্য-আনন্দ খুঁজে বেড়ানো যদি সাহিত্যিকের কাজ হয় তাহলে
সাহিত্য গড়ে উঠবে সাহিত্যিকের মন,
বস্তুজগৎ এবং তার
প্রকাশভঙ্গির ওপর। সাহিত্যিকের হৃদয়ানুভূতির প্রকাশই সাহিত্যের বিষয়। এক
একজনের বিষয় এক একরকমের যে হবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রকাশভঙ্গির
বিভিন্নতা এবং পাঠকের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার ওপর নির্ভর করে সাহিত্যত্ব।
স্রষ্টার সৃষ্ট সাহিত্য
স্বীকৃত হবে কি হবে না তা স্রষ্টার ওপর নির্ভরশীল নয়। তা প্রধানতঃ নির্ভর
করে পাঠকদের ওপর। আলোচক বা সমালোচকদের ওপরেও তা প্রধানতঃ নির্ভরশীল নয়।
বিদগ্ধজনের মতে প্রকৃত সাহিত্য রসকে ব্যঞ্জনা করে আর তা আস্বাদনের
বাইরে রসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আবার— ‘কেহ কেহ মনে করেন সাহিত্য কেবলমাত্র বাস্তব সত্যকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করিয়া বাস্তবজগতের সহিত তাহার সম্পর্কটি সুস্পষ্ট করিয়া তোলে। গ্রীক দার্শনিক প্লেটো এই অর্থে সাহিত্যকে জগৎ ও জীবনের অনুকৃতি বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। আবার অন্য দলের মতে যে সাহিত্য উচ্চশিক্ষার বাহন নয়, যাহার মাঝে কোন সুস্পষ্ট নীতি অনুপস্থিত তাহা কোনমতেই সাহিত্যপদবাচ্য হইতে পারে না। সাহিত্য রসকে ব্যঞ্জিত করে সত্য এবধং আস্বাদনের বাহিরে এই রসের কোন অস্তিত্ব নাই একথাও সত্য কিন্তু কেবলমাত্র আস্বাদেই ইহার শেষ হইতে পারে না, কেবলমাত্র রসের ব্যঞ্জনাই নহে, নীতির ব্যঞ্জনাও সাহিত্যের অন্যতম উদ্দেশ্য। তাঁহাদের মতে নিছক সৌন্দর্য্যসৃষ্টি সাহিত্যের কখনই উদ্দেশ্য হইতে পারে না, কারণ মানুষের সৌন্দর্য্যবোধ একক, অন্য-নিরপেক্ষ একটি ধারণামাত্র নয়, তাহা অন্যের বোধের উপরেও নির্ভরশীল। আর মানুষের অন্যান্য বোধশক্তি বা প্রবৃত্তিগুলি যাহাতে বিকশিত হইয়া উঠিতে পারে তাহার প্রতিও সাহিত্যকারের সজাগ দৃষ্টি রাখা কর্তব্য। আদর্শকে বাদ দিয়া জীবনের পরিপূর্ণতা কখনই সম্ভবপর নয়।’
স্বীকৃত সাহিত্য তাকেই বলা
যেতে পারে যার মধ্যে সৌন্দর্য্য সত্য জ্ঞান আদর্শ এবং আনন্দের উপকরণ থাকে।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বলছেন— ‘জ্ঞানের কথা একবার জানিলে
আর জানিতে হয় না। আগুন গরম,
সূর্য গোল,
জল তরল,
ইহা একবার জানিলেই চুকিয়া যায়। কিন্তু ভাবের কথা
বারবার অনুভব করিয়া শান্তিবোধ হয় না। সূর্য যে পূর্বদিকে ওঠে এ কথা
আর আমাদের মন আকর্ষণ করে না। কিন্তু সূর্যোদয়ের যে সৌন্দর্য্য ও আনন্দ
তাহা জীবসৃষ্টির পর হইতে আজ পর্যন্ত আমাদের কাছে অম্লান আছে।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘কোন একটা বিশেষ তত্ত্ব নির্ণয় বা কোন একটা বিশেষ ঘটনা বর্ণনা যাহার উদ্দেশ্য তাহার লক্ষণ অনুসারে তাহাকে দর্শন বিজ্ঞান বা ইতিহাস বা আর কিছু বলিতে পারো। কিন্তু সাহিত্যের উদ্দেশ্য নাই।’ এখানে এসে এটুকু অন্ততঃ আমাদের মনে হতেই পারে যে, সত্যকে চোখ দিয়ে দেখে বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে তা যথাযথ প্রকাশ করলেই সাহিত্য হয় না, তাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে হৃদয়সংবেদী করে তোলাটাই সাহিত্য। একটু জটিল বলে মনে হলেও সত্যি কথাটা এই যে হৃদয় এবং সংবেদনা নিয়েই সাহিত্যিকের কারবার। আর মানুষের জীবনে--‘নিষ্প্রয়োজনের যদি কিছু অবকাশ কোথাও থেকে থাকে তো এই হৃদয়। যাহা প্রয়োজনীয় তাহা বুদ্ধিগম্য, যাহা লোকায়ত তাহা কেবলমাত্র বৃদ্ধিগ্রাহ্য। কিন্তু যাহা লোকাতীত তাহাকে লাভ করা যায় ‘ন মেধয়া ন শ্রুতেন’। তাহাকে অনুভূতির জারকরসে সঞ্জীবিত করিয়া সমগ্র হৃদয় দিয়া আস্বাদন করিতে হয়’ (সাহিত্য ও পাঠক)। রবীন্দ্রনাথ যা সরাসরি বলেছেন, ‘বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সঙ্গীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষারচিত সেই চিত্র এবং গানই সাহিত্য।’ রচনা যদি এই ভাবের পথে হাঁটতে হাঁটতে সাহিত্য হয়ে ওঠে তাহলে তা স্বীকৃতি লাভের যোগ্য হতে পারে। আগেই বলেছি ‘সাহিত্য’ প্রথমে মৌখিক গদ্যের মধ্যে জন্ম নিয়ে যুগে যুগে যা টিকে থাকার টিকে থেকেছে। নীতি ও ধর্মশিক্ষার উদ্দেশ্যেই প্রধানতঃ জন্ম নেওয়া সে সব গল্প কথা ধরা আছে বিভিন্ন দেশের রূপকথার গল্পে, পুরাণের গল্পের মধ্যে। প্যারাবল্স, ফেবল্স, ফেয়ারিটেল্স, পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, কথা সরিৎ সাগর, বৃহৎকথা, দশকুমার চরিত সহ নানা গল্প-গাথার আগেও সাহিত্য বলতে কাব্য-মহাকাব্য- কাব্যোপন্যাস-নাট্যকাব্য (মহাভারত, রামায়ণ, ওডিসি, ইলিয়ড-এই চারটি মহাকাব্যকে Primitive Epic এবং প্যারাডাইস লষ্ট, ঈনিদ্, জেরুজালেম ডেলিভারড্ এবং বাংলার প্রথম মহাকাব্য ‘মেঘনাদ বধ’ ছাড়াও হেমচন্দ-নবীনচন্দ্র-রঙ্গলালের মহাকাব্যকে Imitative Epic বা অনুকৃত মহাকাব্য বলা হয়) গান, নাটকের জন্ম। তারও অনেক পরে গল্প। গল্পের অনেক পরে উপন্যাস এবং এই গল্প এবং উপন্যাসের গ্রহণযোগ্যতা আদি সাহিত্যের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে বিস্ময়করভাবে পেছনে ফেলে দ্রুত যেভাবে এগিয়ে গেল তাতে নতুন একটা শব্দের জন্ম হল--‘বিশ্বসাহিত্য’! নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে ‘বিশ্বসাহিত্য’ অবশ্যই স্বীকৃত সাহিত্য। তার স্বীকৃতির বিষয়টা কেমন সেটা বৃঝতে হলে প্রথমে সাহিত্যের আধুনিক অবদান ‘ছোটগল্প’ সম্পর্কে দু’চার কথা বলতেই হয়। বিশ্ব যত আধুনিক হয়েছে, দেশের সঙ্গে দেশের যোগাযোগ বা সম্পর্ক যত নিবিড় হয়েছে একটি দেশের সাহিত্য তত সর্বজনীন হতে পেরেছে সাহিত্যিকের চিন্তন ও মননের গুণে। ‘যে-কোন ভাষায় রচিত গ্রন্থ যখন ভৌগোলিক সীমা অতিক্রম করিয়া, ভাষার বন্ধনকে এড়াইয়া সর্বমানবের হৃদয়ে আনন্দের ধ্বনি জাগাইয়া তুলিতে পারে তখন তাহাকেই আমরা বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ বলিয়া অভিহিত করি। ডেনমার্কের যুবরাজ হ্যামলেটের মধ্যে যে অস্থিরচিত্ততা ও indecision আমরা লক্ষ্য করি, ওথেলোর যে অমূলক অসূয়া পরিণামে তাহার জীবনে ভয়াবহ পরিণতিকে টানিয়া আনে, কিং লিয়রের অর্ধোন্মাদ প্রলাপ যে নিদারুণ মর্মযাতনাকে ফুটাইয়া তোলে তাহা বিশ্বমানবের মনের মর্মমূলে নাড়া দেয়। ‘গুড আর্থ’-এর দরিদ্র চীনা চাষীর সুখী হইবার আকাঙ্ক্ষা পৃথিবীর তাবৎ মানবসমাজের সুখী হইবার আকাঙ্ক্ষারই প্রতিরূপ।’ ---(সাহিত্য ও পাঠক) সাহিত্য কিভাবে বিশ্বসাহিত্য হয়ে উঠতে পারে তার একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এখানে দেবার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করছি এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ থাকলেও উপায় থাকছে না।
প্রকৃতপক্ষে চতুর্দশ
শতাব্দীতেই আধুনিক ছোটগল্পের সূচনা হয় ইতালীয় লেখক বোকাচ্চিও’র হাত ধরেই। তার আগে কাব্য রীতির বাইরে সাহিত্যের ছোটখাটো স্বয়ংসম্পূর্ণ
‘ফর্ম’
ছিল না। মহাকবি
দান্তের মৃত্যুর আট বছর আগে
জন্ম নেওয়া (১৩১৩ খৃঃ) বোকাচ্চিও-ই প্রথম ছোট গল্প রচনা
করেন তাঁর জন্মস্থান ফ্লোরেন্সের এক ভয়াবহ মহামারীর (প্লেগ)
মর্মান্তিক বর্ণনার মধ্য দিয়ে। ১৩৪৮ সালের এই বিপর্যয়কে পটভূমি করে লেখা
‘দেকামেরণ’
(দশদিন) সেই স্বীকৃত বিশ্বসাহিত্য যা আজও সাহিত্যের ইতিহাসে
অমর হয়ে আছে। ধর্ম-গির্জা-মঠ-যাজক-যাজিকা’র স্বরূপ বোকাচ্চিও প্রায় সাতশো বছর আগে অত্যন্ত নির্মমভাবে উদ্ঘাটন করে গেছেন।
মধ্যযুগীয় ধর্মীয় কুসংস্কার যখন প্রবলভাবে সমাজ জীবনকে আচ্ছন্ন করে আছে তখন
বোকাচ্চিও’র এই সাহস চিরকালীন
স্বীকৃতি পেল কিসের জোরে?
বোকাচ্চিও
‘নোবেল পুরস্কার’
পেয়ে অমরত্ব পাননি। পুরস্কার তাঁর সাহিত্যকে ‘স্বীকৃত সাহিত্য’-এর মর্যাদা দেয়নি। যুগের পর যুগ অনুশীলিত বিদগ্ধ পাঠকের গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে
সক্ষম সর্বজনীন সহৃদয় হৃদয়-সংবেদী লেখনী চিরকালই স্বীকৃত সাহিত্যের মর্যাদা
পেয়ে থাকে। অসাধারণ লোকচরিত্রজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া গেছে বোকাচ্চিও’র যাবতীয় লেখনীর মধ্যেই। তাই বিদগ্ধজনেরা তাঁকে বিশ্বের
প্রথম জনসাধারণের লেখক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সমসাময়িক দান্তে এবং
পেত্রার্ক স্ব স্ব ক্ষেত্রে ভাস্বর হলেও তাঁদের অসাধরণ বৈদগ্ধ এবং আভিজাত্য
সাধারণ জনসমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। বোকাচ্চিও’র বিরুদ্ধে
অশ্লীলতার বাজে অভিযোগ থাকলেও তাঁর সাহিত্যের স্বীকৃতির প্রধান কারণ ছিল,
The book is full of people, living people--that is the secret of its
immortality. ছোট গল্প সাহিত্যের যদি অন্যতম বাঁক হয় তাহলে উপন্যাস হল সাহিত্যের বিপ্লব। ১৯০১ সাল থেকে প্রচলিত ‘নোবেল পুরস্কার’-এর দৌলতে বিশ্বসাহিত্য বলতে প্রধানতঃ উপন্যাসকেই বুঝতে হচ্ছে। যদিও বেশ কয়েকজন কবিও নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, যাঁদের মধ্যে আমাদের রবীন্দ্রনাথ অন্যতম। বিশ্বের প্রথম উপন্যাস রচনা শুরু হয়েছিল ১০০১ খ্রীষ্টাব্দে। শেষ হয় ১০১০ খ্রীষ্টাব্দে! উপন্যাসের ইংরেজি নাম ‘টেল অব গেঞ্জি’--বাংলায় ‘গেঞ্জির উপাখ্যান’। একাদশ শতকে পূর্বদেশীয় এক অসূর্যম্পশ্যা অভিজাত নারী লেডি মুরাসাকি সেই উপন্যাসের রচিয়তা! মানুষ একবিংশ শতকেও সেই উপন্যাস বা তার রচয়িতার কথা ভুলে যায়নি। কোনো পুরস্কারের লেবেল এই রচনার শরীরে নেই। বিশ্বের প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘ফিয়ামেত্তা’ রচনা করেন বোকাচ্চিও চতুদর্শ শতাব্দীতে এবং প্রথম ইংরেজি উপন্যাস লেখেন রিচার্ডসন (পামেলা) ১৭৪০ খৃষ্টাব্দে। ১৩৭৫ খ্রীষ্টাব্দে বোকাচ্চিও’র মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পরে ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে ফ্লোরেন্স থেকেই তাঁর রচনাবলী প্রথম ১৭ খণ্ডে প্রকাশিত হয়। কোন্ স্বীকৃতির দৌলতে তাঁর রচনাগুলি কালের থাবা থেকে রক্ষা পেল এবং বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব পেল? স্বীকৃত সাহিত্যের মৃত্যু হয় না বলেই বোধহয় এইভাবে বেঁচে থাকা! চাকরাণীকে নায়িকা করে লেখা রিচার্ডসনের উপন্যাস ‘পামেলা’র প্যারডি লিখতে গিয়েই নিজের প্রতিভার চমকে চমকে গেলেন ফিল্ডিং। তার পরেই ইংরেজি সাহিত্যের অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘টম জোন্স’ লেখা হয়ে গেল তাঁর! চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে শত সহস্র সাহিত্য রচিত হয়েছে। অনেক রচনাই হয়তো নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে, লেখকও সম্বর্ধিত হয়েছেন হয়তো (এখনকার মতো মুড়িমুড়কির এক মঞ্চে সম্বর্ধনার রেওয়াজ তখন না থাকলেও), কিন্তু তার অধিকাংশই স্বীকৃত সাহিত্যের মর্যাদা পায়নি। আর তা পায়নি বলেই সাহিত্যের ইতিহাসে তাদের ঠাঁই হয়নি। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর সময়কালে (দুশো বছর) রচিত বিশ্বসাহিত্যের সেরা ১৫টি উপন্যাসের তালিকা প্রকাশিত হয়েছিল ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির এমেরিটাস অধ্যাপক উইলিয়াম লায়ন ফেলপ্স-এর প্রচেষ্টায়। তিনি এই এই তালিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোরামে নথিবদ্ধ করার জন্য দিয়েছিলেন। উপন্যাসগুলি হল--ডানিয়েল ডিফো’র ‘রবিনসন ক্রুসো’ (১৭১৯), জোনাথান সুইফ্ট-এর ‘গালিভার্স ট্রাভেলস্’ (১৭২৬), সামুয়েল রিচার্ডসনের ‘ক্লারিসা’ (১৭৪৭), হেনরি ফিল্ডিং-এর ‘হিষ্ট্রি অব টম জোন্স’ (১৭৪৯), বালজাকের ‘ইউজেন গ্রাঁদে’ (১৮৩৩), আলেকজাণ্ডার ডুমা’র ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ (১৮৪৪), চার্লস ডিকেন্সের ‘ডেভিড কপারফিল্ড’ (১৮৪৯), নাথানিয়েল হথর্ণ-এর ‘স্কার্লেট লেটার’ (১৮৫০), থ্যাকারে’র ‘হেনরি এসমণ্ড’ (১৮৫২), ফ্লবেয়ার-এর ‘মাদাম বোভারি’ (১৮৫৭), তুর্গেনেভের ‘ফাদার্স এণ্ড চিলড্রেন’ (১৮৬১), ভিক্টর হুগো’র ‘লা মিজারেবল্’ (১৮৬২), টলষ্টয়-এর ‘আনা কারানিনা’ (১৮৭৩-৭৬), ডষ্টয়েভস্কি’র ‘ব্রাদার্স কারামাজাভ’ (১৮৭৯), মার্ক টোয়েনের ‘হাকল্ বেরি ফিন্’ (১৮৮৪)। এই তালিকা অবশ্যই সর্বজনগ্রাহ্য নয়। দুশো বছরের অনেক লেখার মধ্যে মাত্র ১৫টির তালিকা রচনার সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই তালিকা নিয়ে বিতর্ক থাকা স্বভাবিক। তবু এই ১৫টি উপন্যাসও যে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের আগে বিশ্বসাহিত্যকে যথেষ্ট উজ্জ্বলতা দান করেছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কালীপ্রসন্ন সিংহ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের কলমে যে উপন্যাসের জন্ম হয় তা বিশ্বসাহিত্যে স্বীকৃত সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত উপন্যাসগুলির শ্রেণীতে পৌঁছতে পারেনি নিছকই সাহিত্যিক দুর্বলতার কারণে নয়, যথাযথ অনুবাদ এবং প্রচারের দুর্বলতার কারণেও বাংলা উপন্যাস নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। এই দুর্বলতা ভালভাবে টের পেয়েছিলেন শুধু মাইকেল মধুসূদন-ই নন, বঙ্কিমচন্দ্রও। তাই এঁরা দুজনেই নিজেদের সময়ে ‘টোয়াইস বর্ণ ফিকশন’ (দ্বিজ সাহিত্য)-এর কথা ভেবে কবিতার ক্ষেত্রে মধুসূদন এবং উপন্যাসের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংরেজিতে লেখার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁদের উৎসাহ অল্পদিনেই শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা নিজেদের মাতৃভাষার আশ্রয়ে ফিরে আসেন এবং ভারতীয় সাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেন। তাঁদের রচনা স্বীকৃত সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পথটা মোটেও সহজ ছিল না। সময়ের তুলনায় অনেক এগিয়ে থাকা স্রষ্টাদের চলার পথ যে কতটা কন্টকিত হতে পারে তা আজকের যুগে আনুগত্যের বখশিশ পেতে অভ্যস্ত সাহিত্যিক কিংবা পাঠকের পক্ষে যথাযথ উপলব্ধি করা বেশ কঠিন। এখন এমন সৃষ্টিও পুরস্কৃত হয় যার হয়তো সাকুল্যে ১০০ পাঠকও নেই। কিন্তু সেই সৃষ্টিকে ‘সাহিত্য’ হিসেবে প্রমাণের জন্য ‘সমালোচক’ এবং ‘পত্র-পত্রিকা’র যেমন অভাব নেই, তেমনই অভাব নেই পুরস্কার বিক্রয়ে উন্মুখ সংস্থারও। এইসব ‘পুরস্কৃত’ সাহিত্য কিংবা তার ‘সম্বর্ধিত সাহিত্যিক’রা ঝড়ে উড়ে যাওয়া হলুদপত্রের মতো কোথায় যে হারিয়ে যায় তারও একটা সমীক্ষা হওয়া দরকার আছে বলে মনে হয়। সে যাইহোক, মধুসূদন কিংবা বঙ্কিমের ইংরেজিতে সাহিত্য রচনার ফলাফল দেখেও কিন্তু বেশ কিছু ভারতীয় নিরুৎসাহিত না হয়ে বিশ্বসাহিত্যে স্বীকৃতি লাভের আশায় ইংরেজিতে গল্প-উপন্যাস রচনা করে গেছেন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ১৯০৯ সালে এস এস মিত্র ‘হিন্দুপুর’ নামে ইংরেজি উপন্যাস লেখেন। রমেশচন্দ্র দত্ত ঐ বছেরেই ‘দ্য স্লেভ গার্ল অফ আগ্রা’ লেখেন। দু’বছর পরে এম আর কৃষ্ণ’র ‘পদ্মিনী’ প্রকাশিত হয়। তারপরে একে একে মুলুকরাজ আনন্দ, আর কে নারায়ণ, রাজা রাও, অরুণ যোশী, আহমেদ আলী, অনীতা দেশাই, বাণী ভট্টাচার্য প্রমুখ ইংরেজি উপন্যাস লিখে ‘কুশলী ঔপন্যাসিক’ হিসেবে খ্যাত হলেও নোবেল পুরস্কারের উপযুক্ত বলে গণ্য হননি। অল্প কয়েকজনের নামই এখানে উল্লেখ করলাম। আঞ্চলিক স্বীকৃতিও সৃষ্টিকে ‘স্বীকৃত সাহিত্য’-এর মর্যাদা দেয় বটে তবে বর্তমান স্বীকৃতির চূড়ান্ত মানদণ্ড হল বিশ্বসাহিত্যের স্বীকৃতি, সেটা না জুটলে সেই অর্থে ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ হিসেবে ছাড়পত্র মেলে না। কিন্তু বহু সৃষ্টি নোবেল না পেয়েও সমান্তরালভাবে অনুশীলিত ও বিদগ্ধ পাঠকের স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে। তার তালিকা ও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়ার লোভ সংযত করতেই হচ্ছে। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে ‘সাহিত্য’ হিসেবে তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথ। সেটাও সম্ভব হয়েছে তাঁর ‘নোবেল পুরস্কার’ প্রাপ্তির কারণেই। কিন্তু ১৯০১ সালে নোবেল চালু হওয়ার পর থেকে প্রকাশিত বাংলা গল্প কবিতা উপন্যাস যে উচ্চতায় উঠেছে তার যথাযথ স্বীকৃতি তার কপালে জোটেনি। সত্যি বলতে কী, নোবেলপ্রাপ্ত সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের উপযুক্ত তুলনামূলক আলোচনাও সেভাবে হয়নি বা হচ্ছে না। নানাভাষায় অনুবাদের সীমাবদ্ধতাও বাংলাসাহিত্যকে ভৌগোলিক সীমার ভেতরেই আবদ্ধ রেখেছে বলা যায়। বিংশ শতাব্দীতে নোবেলপ্রাপ্ত সাহিত্যের তালিকা হাতে নিয়ে যদি বাংলা সাহিত্যের তুলনা করা যায় তাহলে অন্ততঃ ৫০জন লেখকের ৫০টি গল্প-উপন্যাস-কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে যেগুলো নোবেল পুরস্কারের দাবি করতে পারে। সামারসেট মম নিজে বিশ্বসাহিত্যের জগৎ থেকে মাত্র ১০টি উপন্যাসকে বেছে নিয়ে ‘ক্লাসিক’ বলে স্বীকৃতি দিয়েও মন্তব্য করেছিলেন, ‘নো নভেল ইজ পারফেক্ট’! টলষ্টয়ের ‘ওয়ার অ্যাণ্ড পিস’ উপন্যাসকে বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলেও মম বলেছেন এই উপন্যাসের বহু চরিত্র ‘ক্রিয়েচার্স অব হিজ ওন ইনভেনশন।’ এসব মন্তব্যের পাশাপাশি তিনি আর একটি অত্যন্ত দামী কথা বলেছিলেন। তাঁর মতে, ‘এ নভেল ইজ টু বি রেড উইথ এনজয়মেন্ট। ইফ ইট ডাজ নট গিভ দ্যাট, ইট ইজ ওয়ার্থলেস।’ যে নভেল বা সাহিত্য পড়তে ভাল লাগবে না তা বাজে। খুবই স্পষ্ট কথা। এখানেই কিন্তু লুকিয়ে রয়েছে ‘স্বীকৃত সাহিত্য’-এর আসল রহস্য। একাডেমিক সংজ্ঞায় কিংবা নির্দেশের অনুসারী না হলেও সার্থক সাহিত্যের মাপকাঠি হয় শেষপর্যন্ত সেই ‘রিডিবিলিটি’। কিন্তু শুধুমাত্র ‘রিডিবিলিটি’ নয়, কারণ, একই গল্প উপন্যাস কাব্য সকলকেই একই রকম আনন্দ দেয় না, তা নির্ভর করে পাঠকের ব্যক্তিগত রুচি শিক্ষা ও বোধের ওপর। এ কারণেই শুধুমাত্র জনপ্রিয়তার ওপর সাহিত্যের স্বীকৃতি নির্ভর করে না। সাহিত্যের অনুশীলিত পাঠকের বিচারেই শেষপর্যন্ত চূড়ান্ত সাহিত্যের টিকে থাকা না থাকা নির্ভর করে। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু দৃষ্টান্ত তুলে আলোচনার অবকাশ থাকলেও প্রবন্ধ দীর্ঘ হয়ে যাবে যথেষ্ট, কাজেই তাড়াতাড়ি ইতি টানার কথা ভাবতে হচ্ছে। জানি না, খুব স্পষ্ট করে ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ সম্পর্কে সহজবোধ্য এবং যুক্তিগ্রাহ্য ধারণা দিতে পারলাম কি না। বিষয়টি বাস্তবিকই বেশ গম্ভীর এবং দীর্ঘ আলোচনাসাপেক্ষ বলেই আমার বিশ্বাস। ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ প্রসঙ্গেই অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে ‘সাহিত্যে স্বীকৃতি’ বিষয়টিও। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নও, কিসের স্বীকৃতি, কার স্বীকৃতি?
‘স্বীকৃত সাহিত্য’ই সাহিত্যিকের প্রতিভার স্বীকৃতি। সাহিত্যই যদি স্বীকৃত না হয়,
তাহলে সে সাহিত্যিক ঝড়ে উড়ে যাওয়া হলুদপত্র ছাড়া আর কি?
‘স্বীকৃত সাহিত্য’-এর বিষয়,
মতামত,
দর্শন,
অনুভব,
দ্বন্দ্ব,
আনন্দ,
দুঃখ সবই স্বীকৃতি পাওয়ার যোগ্য। পাঠক যদি সাহিত্যের বিষয়ের
সঙ্গে হৃদয়ের যোগ খুঁজে পেতে সমর্থ হন তাহলে সেই বিষয়ের স্বীকৃতিও আপনা
আপনি জুটে যায় বৈকি! সাহিত্যের পাঠকমাত্রেই,
বিশেষ করে
অনুশীলিত পাঠকমাত্রেই সাহিত্যে প্রচারিত বা বর্ণিত কিংবা বিশ্লেষিত প্রতিটি
বিষয় সম্পর্কে ভেবে থাকেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভাবনাই শেষ কথা। তাঁর ব্যক্তিগত
যুক্তিগ্রাহ্যতায় যা গ্রহণীয় হবে তার ওপরে আর কারুর কোনো কথা চলে না।
সাহিত্যিকও এ ক্ষেত্রে অসহায়। লেখা প্রকাশের আগে পর্যন্ত সাহিত্যিকের যদি
বা কিছু বলার থাকে,
প্রকাশের পর পাঠকের মানসলোকে তার প্রতিক্রিয়ার
ওপর আর কারুর কোনো কথা খাটে না। সমালোচকও আগে একজন পাঠক এবং তার মতামতও
একজন পাঠকের মতামতের চেয়ে বেশি কিছু নয়। তবে সাধারণতঃ সমালোচকদের
অনুশীলিত পাঠক হিসেবে ভাবার প্রাচীন প্রথা আজও চলে আসছে।
সেকালে সাহিত্য-সমালোচকরা লেখকের বা প্রতিষ্ঠানের এজেন্ট হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে আজকের মতো অতি আগ্রহী ছিলেন না, তাই তাঁদের মতামতের মূল্য ও ভিত্তি ছিল বেশ নির্ভরযোগ্য। ফলে সেকালের সাহিত্যে স্বীকৃতির ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই তর্ক বিতর্কের বাইরের বিষয়। সাহিত্যে বাস্তবতা কতটা স্বীকৃত হতে পারে, কিংবা অশ্লীলতা কতদূর স্বীকৃত হতে পারে এসব নিয়ে বিতর্ক অবশ্য সাহিত্যের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। হয়তো এই কারণেই মহৎ সাহিত্যের ধর্মই হল নির্লিপ্ততা বা ‘ডিটাচমেন্ট’! এসব সত্ত্বেও কিন্তু সাহিত্যে মানুষের ব্যবহারিক সম্পর্ক, সামাজিক সংস্কার ইত্যাদি কিছু কিছু বিষয়ে লেখকের নতুন নতুন চিন্তা ধারণা এবং প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়ে আসছে। সেসব সাহিত্য স্বীকৃত হলে এইসব বিষয়ও সাহিত্যে স্বীকৃতি যে পেয়ে আসছে সে বিষয়ে মতানৈক্য হওয়ার কথা নয়। বিশ্বসাহিত্যের বহু শক্তিশালী লেখক ‘অশ্লীলতা’র অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে নিন্দিত হয়েছেন, কিন্তু কালক্রমে সেই ‘অশ্লীলতা’ সাহিত্যে স্বীকৃতি পেয়েছে বলেই না সেসব সাহিত্য আজও প্রবলভাবে টিকে আছে। পৃথিবী মানুষের কাছে যত ছোট হয়ে এসেছে, বিশ্বায়নের ধারণা যত পরিস্কার হয়েছে সাহিত্যে অশ্লীলতার স্বীকৃতির চেহারাও তত দ্রুত বদলিয়ে গেছে। বিশ্বসাহিত্যের কথা বাদই দিলাম, সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যে নীলছবির নিখুঁত বর্ণনার কারিগর হতে না পারলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে! নীলছবি আমদানির এই প্রতিভা সাহিত্যে স্বীকৃতি পাবে কি না তা নির্ভর করছে এইসব রচনা ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ হিসেবে আদৌ কল্কে পায় কি না তার ওপর। আগেই বলেছি ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ই সাহিত্যিকের ‘সাহিত্যে স্বীকৃতি’র একমাত্র উপায়। শেষ কথাও বলতে গেলে বলতে হয়, যে কোনো কিছুরই ‘সাহিত্যে স্বীকৃতি’ নির্ভর করে সেটা ‘স্বীকৃত সাহিত্য’ কি না তার ওপর। কোনোরকম চালাকি বা স্টান্টবাজি কিংবা রাজনীতির ওপর নয়। অন্ততঃ সাহিত্যের ইতিহাস তো সেই কথাই বলছে! |
***