নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ও নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমার

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়

 

১৮৮৯ খ্রীষ্টাব্দ। স্থান মহারাষ্ট্র প্রদেশের সোলাপুর। সময় গ্রীষ্মকাল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম মৌলিক নাটক রাজা ও রানী লিখছেন। বাঙলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চ তখন কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছে। তাঁর বয়স তখন সবে মাত্র আঠাশ বছর। শিশিরকুমার ভাদুড়ির তখনও জন্ম  (জন্ম--১৮৮৯, অক্টোবর) হয় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস বৌ-ঠাকুরানীর হাট অবলম্বনে কেদারনাথ চৌধুরী-কৃত নাট্যরূপ রাজা বসন্ত রায় ১৮৮৬-র ৩ জুলাই ন্যাশানাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। রবীন্দ্রকাহিনীর সেটাই প্রথম মঞ্চাভিনীত নাটক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম মৌলিক নাটক রাজা ও রানী প্রকাশিত হয়। প্রকাশের এক বছর পরে ১৮৯০ সালের ৭ জুন  রবীন্দ্রনাথের প্রথম এই মৌলিক নাটক মঞ্চস্থ হয় এমারেল্ড থিয়েটারে। শিশিরকুমার ভাদুড়ির বয়স তখন ঠিক নমাস।

বাঙলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চে তখন প্রবল প্রতাপে চলছে নাট্যকার ও নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের স্বর্ণযুগ। অনেকেরই একটা ধারণা রয়ে গেছে যে, সে সময় সাধারণ রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাটকের (মৌলিক অথবা গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ) বিশেষ আদর ছিল না। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত রবীন্দ্রনাটকের তালিকার দিকে তাকালে বোঝা যায় রবীন্দ্রনাট্যানুরাগের বিশেষ অভাব ছিল না। মোটামুটি ১৮৮৬-তে রবীন্দ্রনাটকের শুরু থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাট্য চর্চা ঝড়ের গতিতে না হলেও উল্লেখযোগ্যভাবেই হয়ে এসেছে। যদিও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের পক্ষে যেটা একান্ত জরুরি সেই আর্থিক দিক থেকে মঞ্চসফল নাটকের তালিকায় খুব কম রবীন্দ্রনাটকই উল্লেখযোগ্য।

সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম পাঁচ দশকে নাট্য প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা গিরিশচন্দ্র এবং অমৃতলাল রবীন্দ্রনাটকে আগ্রহী ছিলেন না। ফলে গিরিশচন্দ্র-অমৃতলাল প্রমুখ বিখ্যাত নট-নাট্যকারের অধীনস্থ মঞ্চে রবীন্দ্রনাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সুযোগ পায় নি। সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম পঞ্চাশ বছরকে প্রকৃতপক্ষে বাঙলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তীব্র সংগ্রামের কাল বলেই চিহ্নিত করা উচিত। প্রকৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেই অসংখ্য সামাজিক-পৌরাণিক-ঐতিহাসিক-প্রহসন-গীতিনাট্য ইত্যাদি রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র-অর্দ্ধেন্দুশেখর  এবং একান্ত রবীন্দ্রানুরাগী অমরেন্দ্রনাথ দত্তের অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও যত্নে বাঙলা নাট্যশালা আজ স্ফীতকলেবর হতে পেরেছে। সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে প্রধানতঃ এই চারজন চারটি সুদৃঢ় স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবেন।

অনেক বিদগ্ধ সমালোচক সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম পঞ্চাশ বছরকে গিরিশযুগ হিসেবে গণ্য করেছেন। এই গিরিশযুগের পরেই বলতে গেলে শিশিরযুগের সূচনা। ১৯২১ সালে বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানি ১০ ডিসেম্বর ম্যাডান বাঙলা থিয়েটারে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত ঐতিহাসিক আলমগীর নাটক প্রথম মঞ্চস্থ করে। সাধারণ রঙ্গালয়ের পঞ্চাশ বছর পূর্তির মুখে এক বিস্ময়কর নাট্যপ্রতিভার আবির্ভাব ঘটে ঐ নাটকেই। নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ ঘটলো এক ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে! অবশ্য এটাই শিশিরবাবুর প্রথম অভিনয় নয়। প্রথম অভিনয় সম্পর্কে তিনি নিজেই জানাচ্ছেন,

পুরনো ডালহৌসি ইনস্টিটিউট যেটা এখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে--এতে বেশ সুন্দর একটা স্টেজ ছিল। এখানে আমি প্রথম অভিনয় করি ১৯১৩ সালের শেষের দিকে। একটা বই ঠিক করে অভিনয় করার ব্যবস্থা হল।....ওয়ার ফণ্ড না কি ফণ্ডের জন্যে চ্যারিটি হিসেবে অভিনয় করা হল....। সেই আমার বাইরের লোকের সামনে প্রথম অভিনয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল Winter visitor. তারা আমার অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। কিন্তু ও প্রশংসার খুব বেশি মূল্য দেওয়া যায় না।

কিন্তু শিশিরকুমারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্রও ছিল একটি নাটকে শিশিরকুমারের অভিনয়। ১৯১২ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে বৈকুণ্ঠের খাতা নাটকে শিশিরকুমার কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের আয়োজনেই এই অভিনয় দেখতে রবীন্দ্রনাথ নিজে এসেছিলেন। শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি হয়েছিলেন। এই কেদারের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই অভিনয় করেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। এই সংবাদে শিশিরকুমার খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবু আলমগীর নাটকে অভিনয় করার সূত্রেই নাট্যাচার্য্য শিশির ভাদুড়ির গৌরবোজ্জ্বল নট জীবনের শুরু হয়েছিল বলা যেতে পারে। এরপর নানা দল ও মঞ্চ ঘুরে ১৯২৪ সালে মনোমোহন রঙ্গমঞ্চ লিজ নিয়ে শিশিরকুমার নিজের নাট্যমন্দির দল গঠন করেন। ১৯২৪ সালেরই ৬ আগস্ট যোগেশচন্দ্র চৌধুরী রচিত সীতা নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। অভিনয় এবং প্রয়োগনৈপুণ্যে সীতা শুধুমাত্র অসাধরণ জনপ্রিয়তাই অর্জন করে নি, শিশিরবাবুর নটজীবনে এক বিশেষ সাফল্যের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। বাঙলা রঙ্গমঞ্চে, প্রকৃত অর্থে সেই হল নতুন যুগের সূচনা। ১৯২৬ সালে নাট্যমন্দির চলে আসে কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে এবং ২৬ জুন রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নতুন মঞ্চের উদ্বোধন হয়। রবীন্দ্রনাটকের সঙ্গে শিশিরবাবুর ঐ প্রথম বড় সংযোগ। এরপর ১৯২৭-এর ৭ সেপ্টেম্বর নাট্যমন্দির গোড়ায় গলদ এবং স্বয়ং কবিকৃত নাট্যরূপ শেষরক্ষা মঞ্চস্থ করে। এরই দুবছর পরে ১৯২৯-এর ২৫ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের তপতী নাটক মঞ্চস্থ হয়।

 এই তপতী নাটকের একটা ইতিহাস আছে। ১৮৮৯-তে যে নাটক রাজা ও রানী নামে রচিত হয়েছিল, সেই নাটকই চল্লিশ বছর পরে কিছু পরিবর্তিত হয়ে ভৈরবের বলি নামে গগণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু কিছু পরিবর্তন সত্ত্বেও নতুন নাটক ভৈরবের বলি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হল না। কবির মতে--এর নাট্যভূমিতে রয়েছে লিরিকের প্লাবন, তাতে নাটককে করেছে দুর্বল, এ হয়েছে কাব্যের জলাভূমি। কাজেই নাট্যাচার্য্য শিশির ভাদুড়ির হাতে তুলে দেওয়ার আগে রাজা ও রানী আমূল রূপান্তরিত হল গদ্য নাটক তপতীতে!

গদ্যে রূপান্তরিত করার স্বপক্ষে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য,

নেড়া ছন্দে ব্ল্যাঙ্কভার্স-এ  এ নাটক লেখা থেকে গদ্যে তার চেয়ে ঢের বেশি জোর পাওয়া যায়। সাহিত্যে পদ্যটা প্রাচীন, গদ্য ক্রমে ক্রমে জেগে উঠেছে....সুতরাং আত্মপ্রকাশের (গদ্যে) সুযোগ খুবই প্রশস্ত।

অতএব রাজা ও রানী নাটকের পরিবর্তিত রূাপ তপতী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই প্রথম চারদিন অভিনীত হল। নাট্যকার স্বয়ং রাজা বিক্রমের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তারপরই ২৫ ডিসেম্বর শিশির ভাদুড়ির নাট্যমন্দিরে তপতীর সাড়ম্বর শুভমুক্তি ঘটে!

সাত বছর পরে ১৯৩৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর শিশিরবাবু রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ নাটক (নাট্যরূপ দেন কবি স্বয়ং) মঞ্চস্থ করেন স্টার থিয়েটারে নবনাট্যমন্দিরের ব্যানারে। ১৯৩৩ সালের জুন মাসে আর্ট থিয়েটার উঠে গেলে ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে আমেরিকা থেকে ফিরে (যাত্রা ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০) শিশিরবাবু স্টার থিয়েটার ভাড়া নিয়ে নবনাট্যমন্দির গঠন করেন। নবনাট্যমন্দিরের শেষ রবীন্দ্রনাটক যোগাযোগ। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের নাটকের ব্যাপারে নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় নি। তাঁর জীবনের শেষ নাট্য সংগঠন শ্রীরঙ্গম’-এর নাট্য প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাটকের কোন অভিনয় হয় নি। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন, শিশিরবাবু ১৯৩৫ সালের ২৮ জুলাই রবীন্দ্রনাথের শ্যামামঞ্চস্থ করেছিলেন। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়। শ্যামা নাটকটি সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত রচিত একটি গদ্য নাটক। এ নাটকের সঙ্গে ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত পরিশোধ কবিতার নৃত্যনাট্য পরিশোধ (১৯৩৬) থেকে রূপান্তরিত নৃত্যনাট্য  শ্যামার (১৯৩৯) কোনো সাদৃশ্য নেই।

কিন্তু ১৯০৮ সালে রবীন্দ্র-গ্রন্থাবলীতে প্র্রথম প্রকাশিত প্রজাপতি নির্বন্ধ উপন্যাসের নাট্যরূপ চিরকুমার সভা মঞ্চস্থ করার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকেই দিয়েছিলেন। সেই সময় শিশিরবাবু অন্য একটি নাটক নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং সম্ভবত অক্ষয় চরিত্রের জন্য গায়ক-অভিনেতা সংগ্রহ করতে না পারার কারণে চিরকুমার সভা মঞ্চস্থ করতে পারেন নি। এ প্রসঙ্গে শিশিরবাবু নিজেই জানিয়েছেন,

ঐ বইটাও কিন্তু উনি আমাকেই লিখে দিয়েছিলেন। তার প্রথম এডিশনের কাটা বই-এ কাগজ মেরে রবিবাবুর হাতে লেখা কারেকশন, এতকাল আমার কাছেই ছিল। এখন এই নতুন বাড়ি বদলাতে গিয়ে হারিয়ে গেল। তপতীর কাটা কাগজ মেরে কারেকশন করা বইটা এখনও আছে।.....বইটা (চিরকুমার সভা) পাবার পর আমি অন্য বই অভিনয় করছি, সেই সময় প্রবোধচন্দ্র (সেন?) গিয়ে ওঁকে বললে--এই তো শিশিরবাবু এতদিন রেখে দিয়েছেন, এখন আবার অন্য বই করছেন। উনি করবেন না।--কান পাতলা লোক (রবীন্দ্রনাথ) ছিলেন তো, তখনি ওকে (অহীন্দ্র চৌধুরী) দিয়ে দিলেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, শিশিরবাবু রবীন্দ্রনাথের মোট চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। এ কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাটকের সূত্রে শিশিরবাবুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে নি। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে ছিল প্রধানতঃ আলমগীর, সীতা, মাইকেল মধুসূদন, বিরাজ বৌ এবং বিশেষ করে ষোড়শী ইত্যাদি নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অসাধরণ অভিনয় নৈপুণ্য।  এ ছাড়াও কয়েকটি বিশেষ কারণও ছিল। শিশিরবাবুই প্রথম গিরিশযুগ’-এর অভিনয় ধারার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটান। বাস্তবানুগ দৃশ্যপট, পোশাক-পরিচ্ছদ, আলোক নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে দর্শকদের চোখের সামনে উপস্থাপিত করে এবং যাত্রাঘেঁষা দীর্ঘ সময়কে তিন ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ নাটককে বেঁধে ফেলার মধ্যে দিয়ে বাঙলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চে শিশিরবাবু নতুন যুগের সূচনা করেন। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র বর্ণিত সাত্ত্বিক-বাচিক-আঙ্গিক-আহার্য--এই চার রীতির অভিনয়ের সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য রঙ্গালয়ের মঞ্চ-কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন প্রয়োগ নৈপুণ্যের ইতিহাস রচনা করেছেন শিশিরবাবু। সেইজন্য রবীন্দ্রনাথের মতো বিরল প্রতিভাও শিশিরবাবুর প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে বলেছেন,

‘শিশিরবাবু কেবল অভিনেতা নহেন, তিনি একজন মর্মজ্ঞ রসস্রষ্টা। দুই চারিটি এমন-জিনিষের সমাবেশ তাঁহার অভিনীত নাটকের মধ্যে তিনি করেন, তাহাতে নাটকটিতে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ছায়া স্বরূপ একটি অবাস্তব ও অনুভবযোগ্য লোকেরও আভাস আসিয়া যায়, নাটকটির পার্থিব ঘটনাকে একটি অতিন্দ্রীয় মিস্টিক জগতে উন্নীত করা হয়, এক অপূর্ব বেদনা-পুলকে চিত্ত আপ্লুত হয়।’

রঙ্গ জগতের এক সমালোচক যথার্থই বলেছেন,

অবহেলিত এই শিল্পকলাকে মর্যাদা দিয়েছেন শিশিরকুমার, অভিনেতা ও অভিনয় শিক্ষক হিসেবে, আধুনিক রঙ্গমঞ্চের দুই এক জন বাদ আর সব অভিনেতা এক রকম তাঁরই হাতে গড়া বললেই হয়। তাই রঙ্গালয়ে অভিনেতা শিশিরকুমার অপেক্ষা, অভিনয় শিক্ষক শিশিরকুমারের অবদান যথেষ্ট পরিমাণে বেশি।’ (দেশ/ ১৬সংখ্যা।)

এইসব সুচিন্তিত মন্তব্য এবং সমালোচনা থেকে একটা কথা খুবই পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে, বাঙলা নাট্য জগতের ইতিহাসে শিশিরকুমার এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কাজেই নাটক অভিনয় এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে শিশিরবাবুর মন্তব্য বা মতামতের গুরুত্ব বড় কম নয়। নাট্যবিষয়ক তাঁর বহুবিধ বক্তব্য আছে। তাঁর সব বক্তব্য বিশ্লেষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর যে সব মন্তব্য আমাদের চমকিত করে সেইসব মন্তব্য স্মরণ করে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।রবীন্দ্রনাথের কাছে শিশিরবাবুর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। তাঁর কথায়,

‘বাঙলাদেশে দু’জন সত্যিকারের নাট্যকার হতে পারতেন--রবীন্দ্রনাথ আর শরৎচন্দ্র। রবীন্দ্রনাথ মিশতে পারলেন না বলে হলেন না, আর শরৎদা হলেন না চেষ্টা করলেন না বলে।.....রবীন্দ্রনাথের লেখার মধ্যে কেবলই তত্ত্ব আর উপমা--অবশ্য সাধারণভাবে কথাও তিনি অমনি করেই বলতেন।’

অর্থাৎ নাটকে শিশিরবাবু চাইতেন নাটকের যোগ্য কিছু উপাদান,যা তাঁর নিজস্ব ভাবনা-চিন্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং যার অভাব তিনি রবীন্দ্রনাটকে অনুভব করতেন। তাই তিনি অসঙ্কোচে বলতে পারেন,

‘রবীন্দ্রনাথ করতে পারতেন অনেক কিছু , কিন্তু করলেন কই? কবিতায়, গানে, গল্পে উনি অনেক কিছু দিয়েছেন মানি। কিন্তু নাটকে বা উপন্যাসে কি দিলেন? নাটকও লিখেছেন মোটে দুটি।’

আমরা চমকে গেলেও তিনি এখানেই থামেন নি,

‘রবীন্দ্রনাথের নাটক বলতে তো দুখানা। ‘তপতী’ আর ‘মালিনী’। ‘গোরায় গলদ’ শুধু কথা দিয়ে সাজান, তবে কথা যা আছে খুবই সুন্দর। অথচ লোকে বলে রবিবাবুর ভাল বই হল ‘ডাকঘর’ ‘তাসের দেশ’;কিন্তু ওগুলো কি ঠিক নাটক হল? ওঁর কোনো বই-ই দাঁড়ায় নি, এমন কী ‘তপতী’ও নয়।’

তপতী নাটকটির প্রতি শিশিরকুমারের দুর্বলতা ছিল এতই তীব্র যে ‘তপতী’কে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ নাটক হিসেবে গণ্য না করার জন্য তাঁর ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে এইভাবে,

‘বাঙলা নাটকের আর মঞ্চের একটা সত্যিকারের ইতিহাস লেখা হল না। সবাই জানল নাটক যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। গিরিশবাবুরা ত বাদ গেলেন-ই রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ও নাটক নয়, নাটক হয়েছিল পোস্ট অফিস (ডাকঘর)!’

অথচ তাঁর কথায় রবীন্দ্রনাথের লেখা মাত্র দুটি হলেও একাধিক রবীন্দ্রনাটক মঞ্চস্থ করেছেন শিশিরকুমার। পছন্দ না হলেও তিনি নাটক মঞ্চস্থ করতেন কি অন্য কোন কারণে? উত্তর দিয়েছেন তিনি নিজেই, ‘সবকটাই পছন্দ। নয় ত করব কেন’ ব্যাপারাটা কি পরস্পর বিরোধী হয়ে যাচ্ছে না? আসলে নানা ধরণের নাটক মঞ্চস্থ করার মধ্য দিয়ে তাঁর নিজস্ব ধারণা যা গড়ে উঠেছে সেটাই প্রকাশ করেছেন শেষ বয়সে। একসময়ে যেটা পছন্দ হয়েছিল পরবর্তীকালে সেটারই উৎকর্ষতা সম্পর্কে সংশয় দেখা দিয়েছে। তিনি নানাভাবে সে সব অনুভবের বিশ্লেষণ করেছেন। যখন যেমন সিদ্ধান্তে এসেছেন সেটাই প্রকাশ করেছেন। প্রসঙ্গতঃ ‘লিভিং থিয়েটার’ গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক এলমার রাইস্-এর একটা কথা মনে পড়ছে,

‘স্থপতি, গীতিকার এবং নাট্যকার সম্পর্কেও বলা চলে--যখন তাঁর পেন্সিলটা নামিয়ে রাখলেন তখনই তাঁদের বক্তব্য শেষ হল।....যেমন স্থপতিসুলভ অঙ্কন হলেই অট্টালিকা হয় না, স্বরলিপি সঙ্গীত নয় এবং ...নাটকের পাণ্ডুলিপি নাট্যাভিনয় নয়।....বক্তব্যকে সুস্পাষ্ট এবং বোধগম্য করে তোলার জন্য এসব ক্ষেত্রে দরকার হয় বিস্তৃতির ব্যাখ্যামূলক প্রয়োগবিদ্যা।’

এই প্রয়োগবিদ্যার ক্ষেত্রে শিশিরবাবুর যোগ্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই। শুধুমাত্র একজন দক্ষ প্রযোজক পরিচালক হিসেবে কোন্ নাটক কতটা উপযোগী সে ব্যাপারে শিশিরবাবুর মতামতকে একেবারে নস্যাৎ করা অসম্ভব। অথচ নাটকের আধুনিক প্রয়োগনৈপুণ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণাও তুচ্ছ করার নয় আদপেই। তাহলে রবীন্দ্রনাটকের সঙ্গে শিশিরবাবুর এই দ্বন্দ্ব কেন? রবীন্দ্রনাট্যের তাত্ত্বিকতা, সুকুমার কারুকাজ এবং নাটকীয়তা উপলব্ধি করার মতো বোধ বা ক্ষমতা শিশিরবাবুর ছিল না একথা বলা যাবে না। আসলে প্রয়োজনীয় বোধের অভাব ছিল সাধারণ দর্শকদেরই। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দর্শকদের আনুকূল্য থেকে রবীন্দ্র নাটক প্রায়শঃই বঞ্চিত হয়ে এসেছে।

আর্থিক সাফল্যের সম্ভাবনা যে নাটকের যত কম পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে সে নাটকের চাহিদা ততই কম। শিশির ভাদুড়ি এই সত্যকেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন বারবার। বাঙলা রঙ্গমঞ্চে নবযুগের প্রবর্তক শিশিরবাবুর মতামতকে তাই পাশ কাটিয়ে যাবার উাপায় থাকে না। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে যাঁর কর্মকাণ্ড কয়েক যুগ এগিয়ে থাকে তিনিই নতুন যুগের প্রবর্তক হিসেবে চিহ্নিত হতে পারেন। সামাজিক ঐতিহাসিক পৌরাণিক প্রভৃতি নানা বিষয়ের ওপর নানা ধরণের নাটক মঞ্চস্থ ও অভিনয় করে শিশিরবাবু অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বিদেশী নাটক সম্পর্কেও তাঁর পড়াশোনা বা আগ্রহ কম ছিল না। ‘দ্য বেল’ নাটকটিকে সম্পূর্ণ দেশী ধাঁচে ঢেলে তিনি ‘শঙ্খধ্বনি’ নামে মঞ্চস্থ ও অভিনয় করেছেন। আজকাল ব্রেশট্ নিয়ে এত হৈ-চৈ--শিশিরবাবুর আমলে ব্রেশট্-এর নাম কলকাতায় প্রায় শোনাই যেত না--কিন্তু শিশিরবাবু শুধু নাম-ই শোনে নি--ব্রেশট্ পড়েছেনও। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন,

‘আমায় ব্রেশট্ পড়িয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। তখন কলকাতায় ব্রেশট্-এর নামও শোনা যেত না। শিশিরবাবুর উৎসাহেই ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’ (দি এক্সেপশন অ্যাণ্ড দি রুল) লিখেছিলাম। বাংলা নামকরণও তাঁরই।’

এ হেন এক বিরল নাট্যপ্রতিভা যখন বিশ্বনাট্যসাহিত্যের অন্যতম নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের যাবতীয় নাটক ‘নাটক নয়’ বলে মাত্র দুটি নাটককে (ডাকঘর এবং রক্তকরবীকেও বাদ দিয়ে) নাটক হিসেবে চিহ্নিত করেন তখন নাট্য সাহিত্যের পণ্ডিত বিশেষজ্ঞদের একটু নড়েচড়ে বসতেই হয়। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ও নাট্যাচার্য্য শিশির ভাদুড়ি বাঙলা নাট্য জগতে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্যবিষয় হয়ে ওঠেন বৈকি!

শিশিরকুমার রবীন্দ্রসান্নিধ্যে এসে নানাভাবে যে প্রভাবিত হয়েছিলেন তা তাঁর নাট্যজীবন ও ব্যক্তিজীবনের অনেক ঘটনাতেই প্রতিফলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নাট্য প্রতিভার প্রতি শিশিরকুমারের এতদূর শ্রদ্ধা ছিল যে তিনি রবীন্দ্রনাথকে সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টাও করেছিলেন। তিনি লিখেছেন,

‘বাংলার জাতীয় রঙ্গমঞ্চে বিশেষ প্রয়োজন ছিল রবীন্দ্রনাথের মত নাট্যকারের। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে কবি, নট ও প্রয়োগকর্তা। যৌবনের প্রারম্ভ হতে যদিও ব্যবসাদার হিসেবে নয়, তিনি নট ও প্রয়োগকর্তারূপে তাঁর গুণমুগ্ধদের সম্মুখে অনেকবার আবির্ভুত হয়েছেন। এমন কি বার্ধক্যে পদার্পণ করার পরও তাঁর আশ্চর্য্য প্রয়োগনৈপুণ্যের বিবিধ কলাকৌশল দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।...আমাদের রঙ্গমঞ্চের দুর্ভাগ্য সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠভাবে গড়ে উঠল না। আমি নিজে তাঁকে এদিকে আনবার অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বাধা এসেছে নানা দিক থেকে।’

রবীন্দ্রনাথও এ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন এইভাবে,

‘আমি যে পরিবেশের মধ্যে লালিত পালিত ও বর্ধিত হয়েছি, সে পরিবেশের সঙ্গে পেশাদার থিয়েটারের একটা বড় রকমের অমিল দেখতে পাই। শিশিরকুমার আমার সঙ্গে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন সাধারণ মঞ্চে, আমি সম্মত হতে পারি নি এই কারণেই। সহানুভূতি বা সহযোগিতার প্রশ্নটা অপ্রাসঙ্গিক, কেননা অমর দত্ত’র যুগ থেকেই আমার নাটক থিয়েটারে অভিনীত হয়েছে, সে অভিনয় দেখতে আমি এসেছি, একালের থিয়েটারেও আমি একাধিক নাটকের অভিনয় দেখেছি, বিশেষ করে শিশিরের অভিনয়। তোমরা যে ন্যাশানাল থিয়েটারের কথা বলো, তার মধ্যে একটা যুগের প্রেরণা ছিল, গিরিশচন্দ্র ছিলেন তারই প্রতীক। তবুও আমি এর থেকে দূরে ছিলাম, কাছে আসতে পারি নি।’

প্রতিবাদী রবীন্দ্রনাথকে আমরা শুধু ‘রক্তকরবী’ নাটকের মধ্যে দিয়েই চিনি না, ১৩ এপ্রিল ১৯১৯--জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে এক হাজার নিরস্ত্র মানুষের নির্মম হত্যা ও প্রায় দু’হাজার আহত মানুষের পক্ষে তাঁকে যেভাবে দাঁড়াতে দেখেছি তার তুলনাও বিরলই বলা যায়। ১৯১৫ সালে পাওয়া ‘নাইটহুড’ সম্মান ত্যাগ করতে চেয়ে তিনি লর্ড চেমসফোর্ডকে যে চিঠি লেখেন সেই চিঠিও শিশিরকুমারকে প্রভাবিত করেছিল তাঁর ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান ত্যাগ করার ক্ষেত্রেও। ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় হোম সেক্রেটারী বি এন ঝা’কে শিশিরকুমার যে চিঠি লেখেন সেই চিঠির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের চিঠির মতো বিনয় ও সৌজন্যবোধ ছিল না। তাঁর এবং রবীন্দ্রনাথের চিঠির মধ্যে সমযের ব্যবধান ৪০ বছর হওয়ার জন্য কিনা জানি না এবং তা স্বাধীন ভারতের নাগরিক হওয়ার কারণেও হতে পারে। কিন্তু রবীন্দ্রসান্নিধ্যে যে শিশিরকুমারের ব্যক্তিসত্তা প্রকাশের সাহসকে উদ্দীপিত করেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

পেশাদার রঙ্গমঞ্চকে শিশিরকুমার যথেষ্ট সাবালক এবং আধুনিক করে তুলে এক নতুন যুগের সূচনা করলেও আর্থিক দিক থেকে তিনি সাফল্য বড় একটা পান নি। এই উচ্চশিক্ষিত সৌম্যদর্শন মার্জিত রুচির অভিনেতাকে শেষপর্যন্ত নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণার জন্য আবেদন করতে হয়েছিল! কোর্টে নিজের জবানবন্দি দেওয়ার সময়ে তিনি যা বলেছিলেন তার সঙ্গে সময়ের কিছু গরমিল ছিল। তিনি বলেছিলেন,

‘১৯২৩ সালের নভেম্বর মাসে আমি অভিনয়কে পেশা হিসেবে গ্রহণ করি এবং ডিসেম্বর মাসে ইডেন উদ্যানে পেশাদারী নাটক মঞ্চস্থ করি। ১৯২৪ সালে আমি আলফ্রেড থিয়েটার ভাড়া নিয়ে অভিনয় শুরু করি। সেই বছরেই জুন মাসে আমি মনমোহন থিয়েটার হাতে নিই। আমার নাট্যসংস্থার নাম ছিল ‘নাট্যমন্দির’। ১৯২৬ সালে জানুয়ারির চার তারিখে সেটা যৌথ প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হয়। মে মাসে নাট্যমন্দির লিমিটেড কর্ণওয়ালিশ থিয়েটার লিজ নেয়। ১৯৩০ সালে নাট্যমন্দির লিমিটেড লিকুইডেশনে যায়। আমি এবং মন্মথনাথ ঘোষ যুগ্ম লিকুইডেটর। আমাদের কোম্পানির হিসাব নিকাশের সমস্ত কাগজপত্র মন্মথনাথ ঘোষের কাছে আছে। আমি বরাবরই নাট্যমন্দিরের অন্যতম ডিরেক্টর ছিলাম এবং আমার শেয়ারের দাম ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। কোম্পানিতে আমার গুডউইলের জন্যে ওই দামের শেয়ার কোম্পানির ছিল না। প্রথমে আমি মাসিক ১২০০ টাকা পেতাম। দু’বছর ব্যবসা চলার পর আমি মাসিক হাজার টাকা পেতাম। থিয়েটার বন্ধ হওয়ার ছ’মাস আমি রঙমহলে অভিনয় করি। মোট বিক্রির শতকরা কুড়িভাগ আমি পারিশ্রমিক পেতাম। ১৯৩২/৩৩ সালে নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় দুখানি ছায়াছবিতে আমি অংশগ্রহণ করি। মাঝে মাঝে নবনাট্যমন্দিরে অভিনয় করি। তখন আমার বার্ষিক আয় ছিল ১৮ হাজার টাকা। কিন্তু তারপর সেটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় সাত হাজারে। আমার আয় থেকে প্রতিমাসে আমি সাধ্যমত পাওনাদারের টাকা মিটিয়ে দিতাম। আমি কোনদিন আমার আয়ব্যয়ের হিসেবের খাতা রাখি নি।’

প্রায় বছর চারেক পরে তিনি দেউলিয়া আখ্যামুক্ত হন।

যে দেশ শিশিরকুমারের মতো বিস্ময়কর প্রতিভাকে স্বচ্ছন্দে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারে না তিনি সেই দেশের ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান হাত পেতে কেন নেবেন? অন্ততঃ শিশিরকুমারের মতো আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন অসামান্য প্রতিভাধর মানুষরা তা নিতে পারেন না।

যাইহোক, নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুই বিশেষ প্রতিভাকে পাশাপাশি রেখে বিচার বিশ্লেষণের যথেষ্ট অবকাশ থাকলেও এবং রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমাদের ঔৎসুক্য যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও (প্রয়োজনীয়ও বটে) শিশিরকুমার ভাদুড়ি সম্পর্কে আমাদের ঔৎসুক্য কতটুকু? নমুনা হিসেবে তুলে ধরি তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর দিনটিতে শ্মশানের বর্ণনা দিয়ে,

‘একদা যিনি নাট্য জগতকে ভালবেসে অধ্যাপনার সম্মানবৃত্তি পরিত্যাগ করে ‘নেটো’র অসম্মান মাথা পেতে নিয়েছিলেন; একদা যাঁর পদচিহ্ন অনুসরণ করে বাংলার নাট্য অঙ্গনে তাবৎ গুণীব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল; একদা যাঁর আবির্ভাব বাংলার নাট্যালোকে একটি যুগের সৃষ্টি হয়েছিল বলে পরবর্তীকালে উল্লেখিত; একদা যাঁর পদতলে বসে অভিনয় শিক্ষা তৎকালীন বহু অভিনেতা-অভিনেত্রীর দিনের কামনা ও রাতের স্বপ্ন ছিল; নাট্যালোকের সেই আশ্চর্য্য পুরুষ শিশিরকুমার ভাদুড়ির মৃত্যুবার্ষিকীতে কাশীপুর শ্মশান ঘাটে একজনও অভিনেতা অথবা অভিনেত্রীর দর্শন পাওয়া যায় নি। এতে অনেকে বিস্ময়বোধ করলেও আমরা করি না। কারণ, আমরা জানি এই রাজ্যের নাম পশ্চিমবঙ্গ এবং আরও জানি, দেহ পট সনে নট সকলি হারায়!’

শিশিরকুমারের ক্ষেত্রে প্রবাদবাক্যটি আক্ষরিক অর্থেই সত্য প্রমাণিত হলেও এই বাংলার সৌভাগ্যবশতঃ নট-নাট্যকার-পরিচালক রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে এই নির্মম প্রবাদবাক্যটি শেষ সত্য হয়ে ওঠে নি। রবীন্দ্রনাথ এখনো বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জগতে স্মরণে ও মননে প্রবলভাবেই রয়েছেন। জন্মের ১৫০ বছর পরেও--আত্মঘাতী বাঙালির এ এক পরম সৌভাগ্য বৈকি!

***

সূচীপত্র