নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ ও নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমার
বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
১৮৮৯
খ্রীষ্টাব্দ। স্থান মহারাষ্ট্র প্রদেশের সোলাপুর। সময় গ্রীষ্মকাল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর
প্রথম মৌলিক নাটক
‘রাজা ও রানী’
লিখছেন। বাঙলা
সাধারণ রঙ্গমঞ্চ তখন কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গেছে। তাঁর বয়স তখন সবে
মাত্র আঠাশ বছর। শিশিরকুমার ভাদুড়ির তখনও জন্ম
(জন্ম--১৮৮৯,
অক্টোবর) হয় নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত উপন্যাস
‘বৌ-ঠাকুরানীর হাট’
অবলম্বনে কেদারনাথ চৌধুরী-কৃত নাট্যরূপ
‘রাজা বসন্ত রায়’
১৮৮৬-র ৩ জুলাই ন্যাশানাল থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়ে গেছে।
রবীন্দ্রকাহিনীর সেটাই প্রথম মঞ্চাভিনীত নাটক হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৮৮৯
সালের আগস্ট মাসে রবীন্দ্রনাথের প্রথম মৌলিক নাটক
‘রাজা ও রানী’
প্রকাশিত হয়। প্রকাশের এক বছর
পরে ১৮৯০ সালের ৭ জুন
রবীন্দ্রনাথের প্রথম এই মৌলিক নাটক মঞ্চস্থ হয়
এমারেল্ড থিয়েটারে। শিশিরকুমার ভাদুড়ির বয়স তখন ঠিক ন’মাস।
বাঙলার সাধারণ
রঙ্গমঞ্চে তখন প্রবল প্রতাপে চলছে নাট্যকার ও নটগুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের স্বর্ণযুগ।
অনেকেরই একটা ধারণা রয়ে গেছে যে,
সে সময় সাধারণ রঙ্গমঞ্চে রবীন্দ্রনাটকের (মৌলিক অথবা
গল্প-উপন্যাসের নাট্যরূপ) বিশেষ আদর ছিল না। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। সাধারণ
রঙ্গমঞ্চে অভিনীত রবীন্দ্রনাটকের তালিকার দিকে তাকালে বোঝা যায়
রবীন্দ্রনাট্যানুরাগের বিশেষ অভাব ছিল না। মোটামুটি ১৮৮৬-তে রবীন্দ্রনাটকের শুরু
থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে রবীন্দ্রনাট্য চর্চা ঝড়ের গতিতে না হলেও
উল্লেখযোগ্যভাবেই হয়ে এসেছে। যদিও সাধারণ রঙ্গমঞ্চের পক্ষে যেটা একান্ত জরুরি সেই
আর্থিক দিক থেকে মঞ্চসফল নাটকের তালিকায় খুব কম রবীন্দ্রনাটকই উল্লেখযোগ্য।
সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম পাঁচ দশকে নাট্য
প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতা গিরিশচন্দ্র এবং অমৃতলাল রবীন্দ্রনাটকে আগ্রহী ছিলেন না।
ফলে গিরিশচন্দ্র-অমৃতলাল প্রমুখ বিখ্যাত নট-নাট্যকারের অধীনস্থ মঞ্চে রবীন্দ্রনাটক
মঞ্চস্থ হওয়ার সুযোগ পায় নি। সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রথম পঞ্চাশ বছরকে প্রকৃতপক্ষে
বাঙলার সাধারণ রঙ্গমঞ্চের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার তীব্র সংগ্রামের কাল বলেই
চিহ্নিত করা উচিত। প্রকৃত পরীক্ষা-নিরীক্ষার কারণেই অসংখ্য
সামাজিক-পৌরাণিক-ঐতিহাসিক-প্রহসন-গীতিনাট্য ইত্যাদি রচিত ও মঞ্চস্থ হয়েছে। সেই
সঙ্গে অবশ্যই বঙ্কিমচন্দ্র-অর্দ্ধেন্দুশেখর
এবং একান্ত রবীন্দ্রানুরাগী অমরেন্দ্রনাথ দত্তের
অক্লান্ত প্রচেষ্টা ও যত্নে বাঙলা নাট্যশালা আজ স্ফীতকলেবর হতে পেরেছে। সাধারণ
রঙ্গালয়ের ইতিহাসে প্রধানতঃ এই চারজন চারটি সুদৃঢ় স্তম্ভ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে
থাকবেন।
অনেক বিদগ্ধ সমালোচক
সাধারণ রঙ্গমঞ্চের প্রথম পঞ্চাশ বছরকে
‘গিরিশযুগ’
হিসেবে গণ্য করেছেন। এই গিরিশযুগের পরেই বলতে গেলে শিশিরযুগের সূচনা। ১৯২১
সালে ‘বেঙ্গল থিয়েট্রিক্যাল কোম্পানি’
১০ ডিসেম্বর ম্যাডান বাঙলা থিয়েটারে ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত
ঐতিহাসিক ‘আলমগীর’
নাটক প্রথম মঞ্চস্থ করে। সাধারণ রঙ্গালয়ের পঞ্চাশ বছর
পূর্তির মুখে এক বিস্ময়কর নাট্যপ্রতিভার আবির্ভাব ঘটে ঐ নাটকেই। নাট্যাচার্য্য
শিশিরকুমার ভাদুড়ির প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চে আত্মপ্রকাশ ঘটলো এক ঐতিহাসিক
যুগসন্ধিক্ষণে! অবশ্য এটাই শিশিরবাবুর প্রথম অভিনয় নয়। প্রথম অভিনয় সম্পর্কে তিনি
নিজেই জানাচ্ছেন,
‘পুরনো ডালহৌসি
ইনস্টিটিউট যেটা এখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে--এতে বেশ সুন্দর একটা স্টেজ ছিল। এখানে আমি
প্রথম অভিনয় করি ১৯১৩ সালের শেষের দিকে। একটা বই ঠিক করে অভিনয় করার ব্যবস্থা
হল।....ওয়ার ফণ্ড না কি ফণ্ডের জন্যে চ্যারিটি হিসেবে অভিনয় করা হল....। সেই আমার
বাইরের লোকের সামনে প্রথম অভিনয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল
Winter visitor.
তারা আমার
অভিনয়ের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিল। কিন্তু ও প্রশংসার খুব বেশি মূল্য দেওয়া যায় না।’
কিন্তু শিশিরকুমারের
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্রও ছিল একটি নাটকে শিশিরকুমারের
অভিনয়। ১৯১২ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে
‘বৈকুণ্ঠের খাতা’
নাটকে শিশিরকুমার কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের জন্মোৎসবের
আয়োজনেই এই অভিনয় দেখতে রবীন্দ্রনাথ নিজে এসেছিলেন। শিশিরকুমারের অভিনয় দেখে
রবীন্দ্রনাথ খুব খুশি হয়েছিলেন। এই কেদারের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজেই অভিনয়
করেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। এই সংবাদে শিশিরকুমার খুবই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তবু
‘আলমগীর’
নাটকে অভিনয় করার সূত্রেই নাট্যাচার্য্য শিশির ভাদুড়ির
গৌরবোজ্জ্বল নট জীবনের শুরু হয়েছিল বলা যেতে পারে। এরপর নানা দল ও মঞ্চ ঘুরে ১৯২৪
সালে মনোমোহন রঙ্গমঞ্চ লিজ নিয়ে শিশিরকুমার নিজের
‘নাট্যমন্দির’
দল গঠন করেন। ১৯২৪ সালেরই ৬ আগস্ট যোগেশচন্দ্র চৌধুরী রচিত
‘সীতা’
নাটকটি মঞ্চস্থ করেন। অভিনয় এবং প্রয়োগনৈপুণ্যে
‘সীতা’
শুধুমাত্র অসাধরণ জনপ্রিয়তাই অর্জন করে নি,
শিশিরবাবুর নটজীবনে এক বিশেষ সাফল্যের ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। বাঙলা
রঙ্গমঞ্চে,
প্রকৃত অর্থে সেই হল নতুন যুগের সূচনা। ১৯২৬ সালে
‘নাট্যমন্দির’
চলে আসে কর্ণওয়ালিশ থিয়েটারে এবং ২৬ জুন রবীন্দ্রনাথের
‘বিসর্জন’
নাটকের অভিনয়ের মাধ্যমে নতুন মঞ্চের উদ্বোধন হয়।
রবীন্দ্রনাটকের সঙ্গে শিশিরবাবুর ঐ প্রথম বড় সংযোগ। এরপর ১৯২৭-এর ৭ সেপ্টেম্বর
নাট্যমন্দির ‘গোড়ায় গলদ’
এবং স্বয়ং কবিকৃত নাট্যরূপ
‘শেষরক্ষা’
মঞ্চস্থ করে। এরই দু’বছর পরে ১৯২৯-এর ২৫
ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথের
‘তপতী’
নাটক মঞ্চস্থ হয়।
গদ্যে রূপান্তরিত করার
স্বপক্ষে নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য,
‘নেড়া
ছন্দে ব্ল্যাঙ্কভার্স-এ
এ নাটক লেখা থেকে গদ্যে তার চেয়ে ঢের বেশি জোর
পাওয়া যায়। সাহিত্যে পদ্যটা প্রাচীন,
গদ্য ক্রমে ক্রমে জেগে উঠেছে....সুতরাং আত্মপ্রকাশের (গদ্যে) সুযোগ খুবই
প্রশস্ত।’
অতএব
‘রাজা ও রানী’
নাটকের পরিবর্তিত রূাপ
‘তপতী’
জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই প্রথম চারদিন অভিনীত হল। নাট্যকার স্বয়ং রাজা
বিক্রমের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তারপরই ২৫ ডিসেম্বর শিশির ভাদুড়ির নাট্যমন্দিরে
‘তপতী’র সাড়ম্বর শুভমুক্তি ঘটে!
সাত বছর পরে ১৯৩৬ সালের
২৪ ডিসেম্বর শিশিরবাবু রবীন্দ্রনাথের
‘যোগাযোগ’
নাটক (নাট্যরূপ দেন কবি স্বয়ং) মঞ্চস্থ করেন স্টার থিয়েটারে নবনাট্যমন্দিরের
ব্যানারে। ১৯৩৩ সালের জুন মাসে আর্ট থিয়েটার উঠে গেলে ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে
আমেরিকা থেকে ফিরে (যাত্রা ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩০) শিশিরবাবু স্টার থিয়েটার ভাড়া নিয়ে
‘নবনাট্যমন্দির’
গঠন করেন।
নবনাট্যমন্দিরের শেষ রবীন্দ্রনাটক
‘যোগাযোগ’। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের নাটকের ব্যাপারে
নাট্যাচার্য্য শিশিরকুমারের বিশেষ আগ্রহ দেখা যায় নি। তাঁর জীবনের শেষ নাট্য সংগঠন
‘শ্রীরঙ্গম’-এর নাট্য প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাটকের কোন অভিনয় হয় নি। কেউ
কেউ অবশ্য মনে করেন,
শিশিরবাবু ১৯৩৫ সালের ২৮ জুলাই রবীন্দ্রনাথের
‘শ্যামা’মঞ্চস্থ করেছিলেন। কিন্তু এ তথ্য ঠিক নয়।
‘শ্যামা’
নাটকটি সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত রচিত একটি গদ্য নাটক। এ
নাটকের সঙ্গে ১৮৮৯ সালে প্রকাশিত
‘পরিশোধ’
কবিতার নৃত্যনাট্য
‘পরিশোধ
(১৯৩৬) থেকে রূপান্তরিত নৃত্যনাট্য
‘শ্যামা’র (১৯৩৯) কোনো সাদৃশ্য নেই।
কিন্তু ১৯০৮ সালে রবীন্দ্র-গ্রন্থাবলীতে প্র্রথম প্রকাশিত ‘প্রজাপতি নির্বন্ধ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘চিরকুমার সভা’ মঞ্চস্থ করার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথ শিশিরকুমারকেই দিয়েছিলেন। সেই সময় শিশিরবাবু অন্য একটি নাটক নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন এবং সম্ভবত অক্ষয় চরিত্রের জন্য গায়ক-অভিনেতা সংগ্রহ করতে না পারার কারণে ‘চিরকুমার সভা’ মঞ্চস্থ করতে পারেন নি। এ প্রসঙ্গে শিশিরবাবু নিজেই জানিয়েছেন,
‘ঐ বইটাও কিন্তু উনি
আমাকেই লিখে দিয়েছিলেন। তার প্রথম এডিশনের কাটা বই-এ কাগজ মেরে রবিবাবুর হাতে লেখা
কারেকশন,
এতকাল আমার কাছেই ছিল। এখন এই নতুন বাড়ি বদলাতে গিয়ে
হারিয়ে গেল। ‘তপতী’র কাটা কাগজ মেরে কারেকশন করা বইটা এখনও আছে।.....বইটা
(চিরকুমার সভা) পাবার পর আমি অন্য বই অভিনয় করছি,
সেই সময় প্রবোধচন্দ্র
(সেন?)
গিয়ে ওঁকে বললে--এই তো শিশিরবাবু এতদিন রেখে দিয়েছেন,
এখন আবার অন্য বই করছেন। উনি করবেন না।--কান পাতলা লোক (রবীন্দ্রনাথ) ছিলেন
তো,
তখনি ওকে (অহীন্দ্র চৌধুরী) দিয়ে দিলেন।’
তাহলে দেখা যাচ্ছে, শিশিরবাবু রবীন্দ্রনাথের মোট চারটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন। এ কথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, রবীন্দ্রনাটকের সূত্রে শিশিরবাবুর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে নি। তাঁর জনপ্রিয়তার মূলে ছিল প্রধানতঃ আলমগীর, সীতা, মাইকেল মধুসূদন, বিরাজ বৌ এবং বিশেষ করে ‘ষোড়শী’ ইত্যাদি নাটকের বিভিন্ন চরিত্রে অসাধরণ অভিনয় নৈপুণ্য। এ ছাড়াও কয়েকটি বিশেষ কারণও ছিল। শিশিরবাবুই প্রথম ‘গিরিশযুগ’-এর অভিনয় ধারার সম্পূর্ণ পরিবর্তন ঘটান। বাস্তবানুগ দৃশ্যপট, পোশাক-পরিচ্ছদ, আলোক নিয়ন্ত্রণ, ইত্যাদি অত্যন্ত শিল্পসম্মতভাবে দর্শকদের চোখের সামনে উপস্থাপিত করে এবং যাত্রাঘেঁষা দীর্ঘ সময়কে তিন ঘন্টার মধ্যে সম্পূর্ণ নাটককে বেঁধে ফেলার মধ্যে দিয়ে বাঙলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চে শিশিরবাবু নতুন যুগের সূচনা করেন। ভারতীয় নাট্যশাস্ত্র বর্ণিত সাত্ত্বিক-বাচিক-আঙ্গিক-আহার্য--এই চার রীতির অভিনয়ের সঙ্গে পাশ্চাত্ত্য রঙ্গালয়ের মঞ্চ-কৌশলের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন প্রয়োগ নৈপুণ্যের ইতিহাস রচনা করেছেন শিশিরবাবু। সেইজন্য রবীন্দ্রনাথের মতো বিরল প্রতিভাও শিশিরবাবুর প্রতিভাকে সম্মান জানিয়ে বলেছেন,
‘শিশিরবাবু কেবল অভিনেতা নহেন, তিনি একজন মর্মজ্ঞ রসস্রষ্টা। দুই চারিটি এমন-জিনিষের সমাবেশ তাঁহার অভিনীত নাটকের মধ্যে তিনি করেন, তাহাতে নাটকটিতে বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গে তাহার ছায়া স্বরূপ একটি অবাস্তব ও অনুভবযোগ্য লোকেরও আভাস আসিয়া যায়, নাটকটির পার্থিব ঘটনাকে একটি অতিন্দ্রীয় মিস্টিক জগতে উন্নীত করা হয়, এক অপূর্ব বেদনা-পুলকে চিত্ত আপ্লুত হয়।’
রঙ্গ জগতের এক সমালোচক
যথার্থই বলেছেন,
‘অবহেলিত এই শিল্পকলাকে
মর্যাদা দিয়েছেন শিশিরকুমার,
অভিনেতা ও অভিনয় শিক্ষক হিসেবে, আধুনিক রঙ্গমঞ্চের দুই এক
জন বাদ আর সব অভিনেতা এক রকম তাঁরই হাতে গড়া বললেই হয়। তাই রঙ্গালয়ে অভিনেতা
শিশিরকুমার অপেক্ষা,
অভিনয় শিক্ষক শিশিরকুমারের অবদান যথেষ্ট পরিমাণে বেশি।’
(দেশ/ ১৬’সংখ্যা।)
এইসব সুচিন্তিত মন্তব্য
এবং সমালোচনা থেকে একটা কথা খুবই পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে,
বাঙলা নাট্য জগতের ইতিহাসে শিশিরকুমার এক অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্ব। কাজেই
নাটক অভিনয় এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে শিশিরবাবুর মন্তব্য বা মতামতের গুরুত্ব বড় কম
নয়। নাট্যবিষয়ক তাঁর বহুবিধ বক্তব্য আছে। তাঁর সব বক্তব্য বিশ্লেষণ করা আমার
উদ্দেশ্য নয়। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর যে সব মন্তব্য আমাদের চমকিত করে
সেইসব মন্তব্য স্মরণ করে সামান্য আলোচনা করা যেতে পারে।
‘রবীন্দ্রনাথ করতে পারতেন অনেক কিছু , কিন্তু করলেন কই? কবিতায়, গানে, গল্পে উনি অনেক কিছু দিয়েছেন মানি। কিন্তু নাটকে বা উপন্যাসে কি দিলেন? নাটকও লিখেছেন মোটে দুটি।’
‘রবীন্দ্রনাথের নাটক বলতে তো দুখানা। ‘তপতী’ আর ‘মালিনী’। ‘গোরায় গলদ’ শুধু কথা দিয়ে সাজান, তবে কথা যা আছে খুবই সুন্দর। অথচ লোকে বলে রবিবাবুর ভাল বই হল ‘ডাকঘর’ ‘তাসের দেশ’;কিন্তু ওগুলো কি ঠিক নাটক হল? ওঁর কোনো বই-ই দাঁড়ায় নি, এমন কী ‘তপতী’ও নয়।’
‘বাঙলা নাটকের আর মঞ্চের একটা সত্যিকারের ইতিহাস লেখা হল না। সবাই জানল নাটক যা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। গিরিশবাবুরা ত বাদ গেলেন-ই রবীন্দ্রনাথের ‘তপতী’ও নাটক নয়, নাটক হয়েছিল পোস্ট অফিস (ডাকঘর)!’
‘আমায় ব্রেশট্ পড়িয়েছিলেন শিশিরকুমার ভাদুড়ি। তখন কলকাতায় ব্রেশট্-এর নামও শোনা যেত না। শিশিরবাবুর উৎসাহেই ‘বিধি ও ব্যতিক্রম’ (দি এক্সেপশন অ্যাণ্ড দি রুল) লিখেছিলাম। বাংলা নামকরণও তাঁরই।’
‘বাংলার জাতীয় রঙ্গমঞ্চে বিশেষ প্রয়োজন ছিল রবীন্দ্রনাথের মত নাট্যকারের। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একাধারে কবি, নট ও প্রয়োগকর্তা। যৌবনের প্রারম্ভ হতে যদিও ব্যবসাদার হিসেবে নয়, তিনি নট ও প্রয়োগকর্তারূপে তাঁর গুণমুগ্ধদের সম্মুখে অনেকবার আবির্ভুত হয়েছেন। এমন কি বার্ধক্যে পদার্পণ করার পরও তাঁর আশ্চর্য্য প্রয়োগনৈপুণ্যের বিবিধ কলাকৌশল দেখবার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে।...আমাদের রঙ্গমঞ্চের দুর্ভাগ্য সাধারণ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠভাবে গড়ে উঠল না। আমি নিজে তাঁকে এদিকে আনবার অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বাধা এসেছে নানা দিক থেকে।’