..................................................... |
কেউ কেউ কবি...!! বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়।
বাঙালি অথচ প্রকাশ্যে বা
গোপনে এক-আধ লাইন কবিতা লেখার চেষ্টা করেনি এমন ঐতিহ্যভ্রষ্ট কেউ কোথাও আছে
কিনা আমার অন্ততঃ জানা নেই। কোটি কোটি কবির মধ্যে জনা কয়েক 'কবি'--সিংহভাগই হতাশ এবং
ব্যর্থ কবি এবং তারাই আশ্চর্যজনকভাবেই কাব্য সমালোচক !
কবি সেই ব্যক্তি বা সাহিত্যিক যিনি কবিত্ব শক্তির অধিকারী এবং কবিতা রচনা করেন। একজন কবি তাঁর রচিত ও সৃষ্ট মৌলিক কবিতাকে লিখিত বা অলিখিত উভয় ভাবেই প্রকাশ করতে পারেন। একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। কবিতায় সাধারণতঃ বহুবিধ অর্থ বা ভাবপ্রকাশ ঘটানোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধারায় বিভাজন ঘটানো হয়। কার্যতঃ যিনি কবিতা লেখেন, তিনিই কবি। তবে বাংলা ভাষার প্রধানতম আধুনিক এক কবি বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। অর্থাৎ কবিতা লিখলেই বা কবি অভিধা প্রাপ্ত হলেই কেউ “কবি” হয়ে যান না। একজন প্রকৃত কবির লক্ষণ কী তা জীনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’ নামীয় প্রবন্ধ গ্রন্থের বিভিন্ন প্রবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। কবিদের উৎপত্তি রহস্য অজ্ঞাত ও অজানাই রয়ে গেছে। সেই অনাদিকাল থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত যুগ-যুগ ধরে তাঁরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন নিত্য-নতুন কবিতা। কবিতাগুলো একত্রিত করে তাঁরা কবিতাসমগ্র বা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। কখনো কখনো কাব্যগ্রন্থটিকে বিরাট আয়তন দিয়ে সৃষ্টি করেন মহাকাব্য। প্রায় সকল ভাষায়ই কবিতা রচিত হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন ভিন্ন সময়কে উপজীব্য করে রচিত হওয়ায় এগুলোর আবেদন, উপযোগিতা এবং ভাবও সাধারণতঃ ঐ সময়ের জন্য উপযোগী। তবে কতকগুলো কবিতা কালকে জয় করেছে বা কালজয়ী ভূমিকা পালন করেছে। প্রত্যেক সমাজ-সভ্যতা ও নির্দিষ্ট ভাষায় রচিত হওয়ায় কবিরা বহুমাত্রিক, বিচিত্র ভঙ্গিমা, সৃষ্টিশৈলী প্রয়োগ করেছেন তাদের কবিতায় যা কালের বিবর্তনে যথেষ্ট পরিবর্তিত, পরিমার্জিত হয়ে বর্তমান রূপ ধারণ করেছে। পরবর্তীকালে এই প্রায়োগিক বিষয়াদিই ঠাঁই করে নিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসের পর্দায়। সাহিত্যের ইতিহাসে উৎপাদিত এই বৈচিত্র্যময় শিল্প শৈলীই বর্তমান সাহিত্যকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করেছে। কবি শব্দটি 'কু' ক্রিয়ামূলের বংশে প্রসূত একটি শব্দ। 'কু' অর্থ--সাধারণকে নবরূপে উত্তীর্ণকারী। এতেই বোঝা যায় কবি সেই মানুষ যিনি সাধারণ অভিজ্ঞতা বা অনুভূতি অথবা প্রচলিত শব্দকে নতুন রূপে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম। ইংরেজী শব্দ 'পয়েট' (poet), ল্যাটিন ভাষার প্রথম শব্দরূপ বিশেষ্যবাচক পুংলিঙ্গ 'পয়েটা, পয়েটে' ('poeta, poetae') (আক্ষরিক অর্থ 'কবি, কবি এর') থেকে সংকলিত হয়েছে। ফরাসি কবি আর্থার রিমবোঁদ "কবি" শব্দের লিখিতভাবে সারাংশ প্রদান করেছেন, “ একজন কবি দর্শনীয় মাধ্যম হিসেবে নিজেকে অন্যের চোখে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি একটি দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিবিহীন, অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় সকলের দৃষ্টিগ্রাহ্যতার বাইরে অবতীর্ণ হয়ে কবিতা রচনা করেন। সকল স্তরের ভালবাসা, দুঃখ-বেদনা, উন্মত্ততা-উন্মাদনার মাঝে নিজেকে খুঁজে পান তিনি। তিনি সকল ধরণের বিষবাষ্পকে নিঃশেষ করতে পারেন। সেই সাথে পারেন এগুলোর সারাংশকে কবিতা আকারে সংরক্ষণ করতে। অকথ্য দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণাকে সাথে নিয়ে তিনি অকুণ্ঠ বিশ্বাসবোধ রচনা করে যখন, যেমন, যেখানে খুশী অগ্রসর হন। একজন অতি মানবীয় শক্তিমত্তার সাহায্যে তিনি সকল মানুষের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হন। একজন বড় ধরণের অকর্মণ্য ব্যক্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত অপরাধী, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ অভিসম্পাতগ্রস্ত ব্যক্তি, এমনকি সর্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক হিসেবেও তিনি অভিহিত হতে পারেন! যদি তিনি অজানা, অজ্ঞাত থেকে যান কিংবা যদি তিনি বিকৃত, উন্মত্ত, বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন -- তারপরও শেষ পর্যন্ত তিনি নিজের দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে সেগুলো দেখতে পাবেন। তাই, কি হয়েছে যদি তিনি উৎফুল্লে ভেসে অ-শ্রুত, নামবিহীন অজানা বিষয়াদি ধ্বংস করেন-- অন্যান্য আদিভৌতিক কর্মীরা তখন ফিরে আসবে এবং তারা আবার সমান্তরালভাবে রচনা শুরু করবে যা আগেই নিপতিত হয়েছিল! ” অবশ্য, এটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অনেক কবিকূলের মধ্যে একজন কবি যিনি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেছেন মাত্র। বুদ্ধদেব বসু তাঁর সম্পাদিত কবিতা পত্রিকার একটি প্রবন্ধ সংখ্যার (১৩৪৫, বৈশাখ) পরিকল্পনা করেছিলেন মূলতঃ কবিদের গদ্য প্রকাশের উদ্দেশ্য নিয়ে। এরই সূত্রে জীবনানন্দ তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যার নাম ‘কবিতার কথা’। এ প্রবন্ধের শুরুতেই আছে "কবি" সম্পর্কে স্বীয় ধ্যান-ধারণার সারকথা-- সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি--কবি কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না, যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়, নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’ উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ একবার কবিদের কাজ সম্বন্ধে বিবৃত করেছিলেন যে, “ গানের বিষয়বস্তুকে আনন্দের সাথে তুলে ধরা বাইরে নির্গত হয়ে আমার আত্মাকে ঐদিন পরিশোধিত করবে যা কখনো ভুলে যাবার মতো বিষয় নয় এবং এখানে লিপিবদ্ধ থাকবে। (দ্য প্রিলুড বুক ওয়ান)” ম্যারিয়েন মুরে কবিদের কাজ সম্পর্কে বলেছেন যে, “তারা প্রকৃতই সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। (পয়েট্রি)” অন্যান্য অনেক কবি যেমন-- 'এইনিডে' ভার্জিল এবং 'প্যারাডাইজ লস্টে' জন মিল্টন বর্ণনা করেছেন যে, 'গ্রীক পুরাণে বর্ণিত কাব্য ও সঙ্গীতাদির দেবীরা তাদের আবেগিক কর্মকাণ্ড প্রয়োগের মাধ্যমে কবিদের কাজে সহায়তা করেন।’ কবির বেদনা-বিদ্ধ হৃদয়ই কবিতার জন্ম-ভূমি। অর্থাৎ, সময়-বিশেষে কোন একটি বিশেষ সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ-বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায়, তখনই কবিতার জন্ম। কবি বেদনাকে আস্বাদ্যমান রস-মূর্তি দান করেন। ব্যক্তিগত বেদনার বিষপুষ্প থেকে কবি যখন কল্পনার সাহায্যে আনন্দমধু আস্বাদন করতে পারেন, তখন বেদনা পর্যন্ত রূপান্তরিত ও সুন্দর হয়ে ওঠে। বেদনার যিনি ভোক্তা, তাঁকে এটির দ্রষ্টা না হতে পারলে তাঁর দ্বারা কাব্য-সৃষ্টি সম্ভব নয়। কবির বেদনা-অনুভূতির এ রূপান্তর-ক্রিয়া সম্বন্ধে ক্রোচে তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে -- “ Poetic idealisation is not a frivolous embellishment, but a profound penetration in virtue of which we pass from troublous emotion to the serenity of contemplation.” বাইরের জগতের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ-শব্দ বা আপন মনের ভাবনা-বেদনা-কল্পনাকে যে-লেখক অনুভূতি-স্নিগ্ধ ছন্দোবদ্ধ তনু-শ্রী দান করতে পারেন, তাকেই আমরা কবি নামে বিশেষিত করি। অনেকে বলেন যে, যিনি জগতের একখানি যথাযথ স্বাভাবিক চিত্রপট এঁকে দিতে পারেন, তিনিই যথার্থ কবি। অর্থাৎ, কবি জগতের ভালো-মন্দের যথাযথ চিত্র অঙ্কন করবেন। কবি সম্পর্কে আমাদের কবিগুরুর কোনো মতামত থাকবে না--তা তো হতে পারে না। অতএব কবি সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ কি বলছেন একটু শোনা যাক! কবিগুরুর মতে--
লোকে কাহাকে কবি বলে? যে ব্যক্তি বিশেষ শ্রেণীর
ভাবসমূহ (যাহাকে আমরা কবিতা বলি) ভাষায় প্রকাশ করে। তবে, ভাল কবিতাকেই আমরা কবিতা বলি, কবিতা খারাপ হইলে তাহাকে আমরা মন্দ কবিতা বলি, সুকবিতা হইতে আরও দূরে গেলে তাহাকে আমরা কবিতা না বলিয়া শ্লোক বলিতে পারি, ছড়া বলিতে প্রবন্ধটির মধ্যে আড়ম্বর করিয়া কবিতা কথাটির একটি দুরূহ সংজ্ঞা নির্ণয় করিতে বসা সাজে না বলিয়া আমরা নিরস্ত হইলাম। পারি, যাহা ইচ্ছা। পৃথিবীর মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ জীবকে আমরা মানুষ বলি, তাহার কাছাকাছি যে আসে তাহাকে বনমানুষ বলি, মানুষ হইতে আরো তফাতে গেলে তাহাকে মানুষও বলি না, বনমানুষও বলি না, তাহাকে বানর বলি। এমন তর্ক কখনো শুনিয়াছ যে Wordsworth শ্রেষ্ঠ কবি না ভজহরি (যে ব্যক্তি লেখনীর আকার কিরূপ জানে না) শ্রেষ্ঠ কবি? অতএব এটা দেখিতেছ, কবিতা প্রকাশ না করিলে কাহাকেও কবি বলা যায় না। তোমার মতে ত বিশ্ব-সুদ্ধ লোককে চিত্রকর বলা যাইতে পারে। এমন ব্যক্তি নাই, যাহার মনে অসংখ্য চিত্র অঙ্কিত না রহিয়াছে, তবে কেন মনুষ্যজাতির আর এক নাম রাখ না চিত্রকর? আমার কথাটি অতি সহজ কথা। আমি বলি যে, যে ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ হয় নাই তাহা কবিতা নহে ও যে ব্যক্তি ভাববিশেষ ভাষায় প্রকাশ করে না সেও কবি নহে। যাঁহারা ‘ নীরব কবি ‘ কথার সৃষ্টি করিয়াছেন তাঁহারা বিশ্বচরাচরকে কবিতা বলেন। এ-সকল কথা কবিতাতেই শোভা পায়। কিন্তু অলঙ্কারশূন্য গদ্যে অথবা তর্কস্থলে বলিলে কি ভাল শুনায়? একটা নামকে এরূপ নানা অর্থে ব্যবহার করিলে দোষ হয় এই যে, তাহার দুইটা ডানা বাহির হয়, এক স্থানে ধরিয়া রাখা যায় না ও ক্রমে ক্রমে হাতছাড়া এবং সকল কাজের বাহির হইয়া বুনো হইয়া দাঁড়ায়, “আয়” বলিয়া ডাকিলেই খাঁচার মধ্যে আসিয়া বসে না। আমার কথাটা এই যে, আমার মনে আমার প্রেয়সীর ছবি আঁকা আছে বলিয়াই আমি কিছু চিত্রকর নই ও ক্ষমতা থাকিলেই আমার প্রেয়সীকে আঁকা যাইতে পারিত বলিয়া আমার প্রেয়সী একটি চিত্র নহেন।.... কল্পনাকে যথাপথে নিয়োগ করিবার নিমিত্ত বুদ্ধি ও রুচি থাকা আবশ্যক করে। পূর্ণচন্দ্র যে হাসে, বা জ্যোৎস্না যে ঘুমায়, এ কয়জন বালকের কল্পনায় উদিত হয়? একজন বালক যদি অসাধারণ কাল্পনিক হয়, তবে পূর্ণচন্দ্রকে একটি আস্ত লুচি বা অর্দ্ধচন্দ্রকে একটি ক্ষীরপুলি মনে করিতে পারে। তাহাদের কল্পনা সুসংলগ্ন নহে; কাহার সহিত কাহার যোগ হইতে পারে, কোন্ কোন্ দ্রব্যকে পাশাপাশি বসাইলে পরস্পর পরস্পরের আলোকে অধিকতর পরিস্ফুট হইতে পারে, কোন্ দ্রব্যকে কি ভাবে দেখিলে তাহার মর্ম্ম তাহার সৌন্দর্য্য চক্ষে বিকাশ পায়, এ সকল জানা অনেক শিক্ষার কাজ।.... কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিকা পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। অশিক্ষিতদের কুগঠিত কল্পনাদর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসঙ্গত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকেরা কবি, তবে নিতান্ত বালকের মত কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভাল কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই, বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষরূপে কবি। তুমি বল দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন্ জাতির মধ্যে ভাল কবিতা আছে যে জাতি সভ্য হয় নাই। যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল তখন প্রাচীন কাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারো মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে? ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে মহা মহা কবিরা ইংলণ্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কবিতায় কি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রভাব লক্ষিত হয় না? Copleston কহেনঃ Never has there been a city of which its people might be more justly proud, whether they looked to its past or its future, than Athens in the days of Aeschylus.
.......সত্য এক হইলেও যে দশ জন কবি সেই এক
সত্যের মধ্যে দশ প্রকার বিভিন্ন কবিতা দেখিতে পাইবেন না তাহা তো নহে। এক
সূর্যকিরণে পৃথিবী কত বিভিন্ন বর্ণ ধারণ করিয়াছে দেখো দেখি! নদী যে
বহিতেছে, এই সত্যটুকুই কবিতা নহে। কিন্তু এই বহমানা নদী দেখিয়া আমাদের
হৃদয়ে যে ভাববিশেষের জন্ম হয়, সেই সত্যই যথার্থ কবিতা। এখন বলো দেখি, এক
নদী দেখিয়া সময়ভেদে কত বিভিন্ন ভাবের উদ্রেক হয়! কখনো নদীর কণ্ঠ হইতে
বিষণ্ণ গীতি শুনিতে পাই; কখনো বা তাহার উল্লাসের কলস্বর, তাহার শত তরঙ্গের
নৃত্য আমাদের মনকে মাতাইয়া তোলে। জ্যোৎস্না কখনো সত্য-সত্যই ঘুমায় না,
অর্থাৎ সে দুটি চক্ষু মুদিয়া পড়িয়া থাকে না ও জ্যোৎস্নার নাসিকাধ্বনিও কেহ
কখনো শুনে নাই। কিন্তু নিস্তব্ধ রাত্রে জ্যোৎস্না দেখিলে মনে হয় যে
জ্যোৎস্না ঘুমাইতেছে, ইহা সত্য। জ্যোৎস্নার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তন্ন তন্ন
রূপে আবিষ্কৃত হউক, এমনও প্রমাণ হউক যে জ্যোৎস্না একটা পদার্থই নহে, তথাপি
লোকে বলিবে জ্যোৎস্না ঘুমাইতেছে। তাহাকে কোন্ বৈজ্ঞানিক-চূড়ামণি মিথ্যাকথা
বলিতে সাহস করিবে?' যাই হোক, কবি নিয়ে আলোচনা করতে বসলে 'কবিতা' বস্তুটি আসলে কি সেটা অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরি। কবিতা বলতে আমি যা বুঝি--দুনিয়াশুদ্ধু লোক হুবহু তাই বুঝবে বা মানবে--সাহিত্য সংবিধানে এমন কোন মাথার দিব্যি দেওয়া নেই। তবে কবিতা বলতে সাধারণত কি বোঝায় সে সম্পর্কে একটা সহজবোধ্য কাণ্ডজ্ঞান কম-বেশি সকলেরই থাকে। এখানে কবিতা বলতে মোটামুটি আমি কতটুকু কি বুঝি সেটাই তুলে ধরব। কবিতা সাহিত্যের একটি প্রধান শাখা; আরেকটি প্রধান শাখা হলো গদ্য। কবিতা সম্ভবত সাহিত্যের আদিমতম শাখা। কবি হৃদয়-নিহিত ভাবের ছন্দোবদ্ধ ও শিল্পিত প্রকাশ কবিতা বলে পরিচিত। বলা হয়েছে কবিতা হল ধ্বনি সুষমার সাথে ভাবের সমন্বিত প্রকাশ। বলা হয়েছে: কবিতা হলো যথাস্থানে যথা শব্দ যা প্রতিস্থাপনীয় নয়। প্রসিদ্ধি আছে যে, আদি কবি বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুন-বিয়োগ-জনিত শোকই শ্লোকরূপে উৎসারিত হয়েছিল। সহচারী-বিয়োগকাতর ক্রৌঞ্চের বেদনায় কবি চিত্তে বেদনার সঞ্চার হয়। এই বেদনা থেকেই সহসা 'পরিপূর্ণ বাণীর সঙ্গীত' জন্মগ্রহণ করে অপূর্ব ছন্দে কবি-কণ্ঠে উচ্চারিত হল-- “ মা
নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতী সমাঃ। অপরিহার্য শব্দের অবশ্যম্ভাবী বাণী-বিন্যাসকে কবিতা বলে। এখানে শব্দ ভাব-কল্পনা ও অর্থ-ব্যঞ্জনার বাহন। মহাকবি কালিদাস বলেন, বাগার্থাবিব সম্পৃক্তো-শব্দই জ্ঞানের একমাত্র প্রকাশক। অসংখ্য শব্দ যখন কবির লেখনী-মুখে ভিড় করে আসে, তার একটিমাত্র যথাযথ শব্দই কবিতায় ব্যবহার উপযোগী অপরিহার্য শব্দ; এ জাতীয় শব্দ লেখকের কল্পনা বা অনুভূতি-স্নিগ্ধ অন্তর হতে স্বতঃ-উৎসারিত বলে ভাব প্রকাশের পক্ষে এটি একান্ত উপযোগী। অবশ্যম্ভাবী বাণী-বিন্যাস বলতে বোঝা যায় যে, অযত্ন-বিন্যস্ত শব্দে কবিতা হয় না। এখানেই কবিতায় ছন্দের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হয়। অপরিহার্য শব্দ যথাযথভাবে বিন্যস্ত হলেই তাদের মধ্যে চিত্রগুণ ও প্রবাহের সৃষ্টি হয়। শব্দসমূহ তখন রসাত্মক বাক্যে সমর্পিত হয়ে অবশ্যম্ভাবী ছন্দোময় রূপ লাভ করে। সুতরাং, দেখা যায়, মানব মনের ভাবনা-কল্পনা যখন অনুভূতি-রঞ্জিত যথাবিহিত শব্দসম্ভারে বাস্তব সুষমা-মন্ডিত চিত্রাত্মক ও ছন্দোময় রূপ লাভ করে, তখনই এর নাম কবিতা। কবিতা নিরাভরণা নয়। নারী যেমন আকার-ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়, বিলাসে-প্রসাধনে আপনাকে মনোরমা করে তোলেন, কবিতাও তেমনি শব্দে, সঙ্গীতে, উপমায়, চিত্রে ও অনুভূতির নিবিড়তায় নিজেকে প্রকাশিত করে। নীতিপ্রচার শিক্ষাদান বা রাজনীতি বা সমাজনীতি প্রচার কাব্যের উদ্দেশ্য নয়। জীবনের সুখ-দুঃখ, পাপ-পূণ্য, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ প্রভৃতি যে কোন বিষয়ই কাব্যের উপাদান বা অঙ্গ হিসেবে গৃহীত হতে পারে -- কিন্তু এগুলো যেন কাব্যাত্মার দেহ মাত্র। শ্রেষ্ঠ কাব্য পাঠে পাঠক জীবনের যে কোন জিজ্ঞাসা--সামাজিক, আর্থিক নৈতিক-সম্বন্ধে গৌণভাবে অবহিত হতে পারেন। কিন্তু, সৎকাব্য কখনও সাক্ষাৎভাবে কোন সমস্যা সমাধান করতে বসে না। এ সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র উত্তরচরিত আলোচনা প্রসঙ্গে যা বলেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য --“ কাব্যের উদ্দেশ্য নীতিজ্ঞান নহে। --কবিরা জগতের শিক্ষাদাতা -- কিন্তু নীতি ব্যাখ্যার দ্বারা তাহারা শিক্ষা দেন না। তাহারা সৌন্দর্য্যের চরমোৎকর্ষ সৃজনের দ্বারা জগতের চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। ” সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কাব্যের উদ্দেশ্য জগৎ ও জীবনের রহস্যকে সুন্দর করে, রসস্নিগ্ধ করে উপস্থাপিত করা। এজন্য কবির কাছে সৌন্দর্য্যই পরম সত্যরূপে পরিগণিত এবং যা কল্পনায় তিনি সত্য বলে প্রত্যক্ষ করেন, তাই সুন্দর। এই সৌন্দর্য্য-সৃষ্টিই কাব্যের উদ্দেশ্য। একটি উত্তম বা আদর্শ কবিতায় সাধারণতঃ নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যাবলী লক্ষ্যণীয়-- কবিতায় আমরা সাধারণতঃ বাহ্য-জগৎ ও মানব জীবনের কাহিনী এবং ভাব-কল্পনা সুন্দর ও মনোরম করে পাই। সংসার-ধুলিজাল কল্পনার কোমল স্পর্শে কবিতার রাজ্যে আরও মধুর, আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। কবিতা ভাবকে রূপে পরিবর্তন করে। ভাব থেকে রূপে অবিরাম যাওয়া-আসার তত্ত্বই কবিতায় প্রকাশিত। যা অদেহী, অ-রূপ, সূক্ষ্ম বা ইন্দ্রিয়াতীত, কবি তাকে দেহ, রূপ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মূর্ত্তি দান করেন। কবিতার চিরন্তন আবেদন আমাদের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য্যবোধের কাছে। এটি ভাব-সঞ্চারী বলে আমাদের মনে বিচিত্র রস উদ্দীপন করে। কিন্তু সর্বত্রই এটি সৌন্দর্য্য-বোধের পরিপোষক। কবির এই সৌন্দর্য্যবোধের সত্যতার সাথে দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক সত্যের বিভিন্নতা আছে। বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক বিচারের দ্বারা যে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন, তা অসুন্দর হলেও সত্য। কিন্তু, কবি কল্পনা যে-সত্য আবিষ্কার করেন, তা সুন্দর হবেই। কবিতার একটি বিশেষত্ব এর ছন্দ। এ সম্বন্ধে অনেকে বলেন যে, ছন্দ কবিতার পক্ষে অপরিহার্য্য নয়। তারা এজন্যে ছন্দোহীন রচনাকেও কবিতা বা কাব্য নামে আখ্যাত করতে চান। ওয়ার্ডসওর্থ বলেছিলেন যে, কবিতা ও গদ্যের ভাষায় বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কবিতা প্রধানতঃ দু রকম :- (ক) সাবজেক্টিভ বা মন্ময় কবিতা এবং (খ) অবজেক্টিভ বা তন্ময় কবিতা। কবি যখন নিজের আন্তর অনুভূতি, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, ভাবনা চিন্তা বা বহির্গত অনুভূতি তাঁর কাব্যের সামগ্রী মাত্ররূপে গ্রহণ করে আত্ম-প্রকাশ করেন, তখন আমরা তাঁর সৃষ্টিকে মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ কবিতা বলি। এ জাতীয় কবিতা এক হিসেবে কবির আত্ম-চরিত বা আত্ম-বাণী। মন্ময় কবিতায় কবির ব্যক্তি-অনুভূতির নিবিড়তাই প্রধান। কবি যখন বস্তুজগতকে যথাযথরূপে প্রকাশ করেন, তখন আমরা তাকে তন্ময় বা বস্তু-নিষ্ঠ কবিতা নামে অভিহিত করতে পারি। তন্ময় কবিতায় বস্তু-সত্তাই প্রধান। এ শ্রেণী-বিভাগ বিশেষ প্রয়োজনীয় হলেও মনে রাখতে হবে যে, সম্পূর্ণরূপে তন্ময় বা সম্পূর্ণরূপে মন্ময় কবিতা অসম্ভব। একান্ত বস্তু-নিষ্ঠ কবিতায়ও মাঝে মাঝে কবি-প্রাণের শিহরণ সঞ্চারিত হয়ে থাকতে পারে এবং একান্ত ব্যক্তি-নিষ্ঠ কবিতায়ও মাঝে মাঝে বস্তু-সত্তার প্রাধান্য পরিলক্ষিত হতে পারে। কবিতার শ্রেণীবিভাগ এ ভাবে করতে পারি-- কবিতা = মন্ময় বা গীতিকবিতা / তন্ময় বা বস্তু-নিষ্ঠ কবিতা। মন্ময় বা গীতিকবিতা = ভক্তিমূলক কবিতা/ স্বদেশ-প্রীতিমূলক/ চিন্তামূলক/ প্রেমমূলক/ শোক-গীত/ প্রকৃতিবিষয়ক/ চতুর্দশপদী/ লঘু বৈঠকী-কবিতা/ স্তোত্র। তন্ময় বা বস্তু-নিষ্ঠ কবিতা = গাথা/ মহাকাব্য/ নীতি-কবিতা/ রূপক/ ব্যঙ্গ-কবিতা/ লিপি-কবিতা । পদ্যঃ মানুষের যে কোন ভাব, ভাবনা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি ছন্দোবদ্ধ আকারে প্রকাশই পদ্য। কবিতার ছন্দ--ছন্দ কবিতার প্রাণস্বরূপ। বাংলা কবিতায় তিন প্রকার ছন্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলো হলো-- স্বরবৃত্ত ছন্দ, মাত্রাবৃত্ত ছন্দ এবং অক্ষরবৃত্ত ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত পয়ার নামেও অভিহিত। অমিত্রাক্ষর ছন্দ--যে ছন্দে চরণদ্বয়ের অন্ত্যবর্ণের মিল থাকে না, তাকে অমিত্রাক্ষর ছন্দ বলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর প্রণীত মেঘনাদ বধ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে লিখিত। আধুনিক কবিতা--বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা হয়। এর পূর্ববর্তী কবিতা সাধারণভাবে পদ্য হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এটিই বাংলা কবিতায় আধুনিকতার একমাত্র লক্ষণ নয়। বাংলা কবিতা--কবিতা বাংলা ভাষায় সাহিত্যের আদিমতম রূপ। চর্যাপদ বাংলা কবিতার আদিমতম রূপের নিদর্শন। বিভিন্নপ্রকার কবিতা--কাঠামোর বিবেচনায় কবিতা নানাপ্রকার হয়ে থাকে। চতুর্দশপদী--এটি ইতালীয় উৎসের চৌদ্দ পংক্তিবিশিষ্ট একটি কবিতা যা সনেট (ইংরেজি: Sonnet) নামে পরিচিত। ঊনিশ শতাব্দীতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রথম বাংলায় সনেট লেখেন এবং এর নাম দেন চতুর্দশপদী। এর কাঠামো আঁটো-সাটো, পংক্তি সংখ্যা ১৪ এবং চরণান্তক অন্তঃমিলের ধারা ভিন্ন হতে পারে। রুবাই--এটি আরবীয় অঞ্চলের চার পংক্তির একটি কবিতা। ওমর খৈয়াম তাঁর রুবাই-এর জন্য বিখ্যাত। সিজো--এটি সীমিত দৈর্ঘ্যের কোরীয় কবিতা। সাধারণত ৪ পংক্তিতে লেখা হয়। হাইকু--এটি সীমিত দৈর্ঘ্যের জাপানী কবিতা। সাধারণত ৩ পংক্তিতে লেখা হয়। ক্বাসিদা--আধুনিক কবিতা। আমরা এখন এই অত্যাধুনিক যুগে আধুনিক উত্তরআধুনিক উত্তরোত্তর আধুনিক যুগে পৌঁছে কবিতার ক্ষেত্রে কতটা আধুনিক হতে পেরেছি তা নিয়ে প্রচুর আলোচনার অবকাশ থাকছেই। আমার অবশ্য সমকালীন কবিতা পড়ে বার বার মনে হয়--মাইকেল মধুসূধন, রবীন্দ্রনাথ, বিহারীলাল, জীবনানন্দ দাশ তাঁদের সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে চিন্তনে মননে এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে যতটা আধুনিক হতে পেরেছিলেন আমরা আমদের সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ততটা আধুনিক হতে পারি নি। কবিতার মধ্যে পচা-আঁশটে গন্ধ মাখামাখি করে পরিবেশন করতে পারলেই সেটা আধুনিক উত্তর আধুনিক বা উত্তরোত্তর আধুনিক কবিতা হতে পারে না। চিন্তনে ও মননে এখনও জীবনানন্দের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হয় আমাদের। ভাব ও ব্যঞ্জনার গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্যে রবীন্দ্রনাথের সামনে নতজানু হতে হয়। তাই আমি মনে করি, সাবালক কাব্যরসিকদের কাছে খুব সামান্যই গ্রহণযোগ্য কবিতা ইতিউতি লেখা হলেও প্রকৃত আধুনিক কবিতা এখনও (মলয় রায়চৌধুরীকে মনে রেখেও) তেমন একটা লেখা হচ্ছে না। লেখার অনুশীলনও আমার চোখে অন্ততঃ ধরা পড়ছে না! তা আমাকে যে যা-ই বলুন না কেন! |
***