একাধিক একা
(ধারাবাহিক গল্প)
 রোদ্দুর
 


প্রচ্ছদঃ দেবব্রত দত্ত
 


 


 ১
 
ঝুমাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম পুরীতে এসে প্রথম লেখা কবিতা সঙ্গে দিয়ে চিঠি লিখব। কবিতাও লেখা হচ্ছে না, তাই চিঠিও না। আমি চিরকালের আলসে। এখানে এসে যেন আলসেমীটা বেড়ে গেছে। ঝড়ের মত সমুদ্রের হাওয়ায় কেবল ছুটীর গন্ধ।
 
প্রথম দু-দেখার দেখে নিয়েছি। দেখে নিয়েছি বলা ভুল, আমার সঙ্গীরা দেখে নিয়েছে। আমি কেবল বিছানায় গড়িয়ে কাটাচ্ছি। বয়ে এনেছি খান তিনেক শারদীয়া সংখ্যা। একটাও ছুঁইয়ে দেখা হয়নি। ঝুমাকে এতদিন দেখতে পারছি না বলে একটা মনঃকষ্টও আছে।

অনেকটা সময় হোটেলের ঝোলানো বারান্দায় ডেক চেয়ারে বসে থাকি। নিস্পলক তাকিয়ে থাকি সমুদ্রের দিকে। ঢেউ গুনি। গুলিয়ে গেলে আবার প্রথম থেকে গুনি। চার দিন হ'ল পুরীতে এসেছি, এখনও একদিনও সমুদ্রে স্নান করিনি। শুধু মুগ্ধ হয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের তান্ডব দেখেছি। পলকে পলকে আমাকে বিস্মিত করে দিচ্ছে সমুদ্র। আমি এই প্রথম সমুদ্র দেখলাম।
 
আমার হয়ত এই আসাটাও হত না। এই দলে আমার মাতৃদেব আছেন। তার ল্যাং বোট হয়ে আমার আসা। একটু বাধো বাধো নিজেদের কাছে। কারন এই বেড়াতে আসাটা পুরোটাই অন্যের দয়ার ওপর। বলি কাকু, আসলে বাবার বন্ধু। ছোট বেলা থেকেই অবশ্য দেখে আসছি বিনয় কাকু কে। আমাদের পারিবারিক বন্ধুই বলা যায়। দুই পরিবারের মধ্যেও মেলামেশা আছে। তবে আমাদের সামাজিক অবস্থান কখনই এক ছিল না। এখন তো আবার অন্য এক সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। বাবা সাধারণ একটা বেসরকারী কোম্পানীতে কাজ করতেন।
 
আমাদের অবস্থা তেমন স্বচ্ছল কোনদিনই ছিলনা। তবে শান্তি ছিল। সারা দিনের পর বাড়ি ফিরলে কি যে একটা ভালো লাগা শরীর মন ছুঁইয়ে যেত। বাবা চলে যাবার পর এখন সেই ভালো লাগাটা যেন আর তেমন করে অনুভব করতে পারি না। বাবা হঠাত চলে গেল। কেউ কিছু জানতেই পারল না। রাতের ঘুম আর ভাঙল না। আমি দেখেছি বাবার যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া ঠোঁট। কাউকে বলিনি। মাকে তো নয়ই। জানলে কষ্ট বাড়বে। পাশে শুয়ে থাকাটা লোকটা নিঃশব্দে চলে গেল।
 
বাবা ওরকমই ছিল। নিজের অসুবিধের কথা কখনও কাউকে বলত না। নিজেই সামলে নেবার চেষ্টা করত। চলে যাবার সময় খুব কষ্ট পেয়েছে বোধহয়। ডাকেনি মাকে। ডাকেনি আমায়। রাত দুপুরে আমাদের বিব্রত করতে চায়নি। হয়ত বোঝেইনি চলে যাচ্ছে। হয়ত বোঝেইনি ফেলে যেতে হচ্ছে ঘুঁণে ধরা বুক সেল্‌ফ ভরা তার সাধের কবিতার বইগুলো। বাবা ভীষণ ভালোবাসত কবিতা। আমাকেও কবিতা ভালোবাসতে শিখিয়েছে। আমার রক্তে কবিতা বাবাই ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে।

আমার বি কম ফাইন্যাল আর তিন-মাস পরেই। কলেজের ক্লাস তো আর করা হচ্ছে না। বিনয় কাকুর ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় সুপারভাইজারের কাজটা করছি। বিনয় কাকুর-ই বদান্যতায়। সংসারটা না হলে থম্‌কে দাঁড়াতো। ছোট অফিসের যা হয়। বাবার পাওনা টাকা পয়সা কবে পাওয়া যাবে জানি না।
 
বাবা চলে গেছে ছ মাস হয়ে গেছে। এখনও অভ্যেস হয়নি। এখনও মনে হয় পাশের ঘরে বাবা আছে। কোন কিছু আলোচনা করে নিই। আমার এবং মায়ের এই পুরীতে আসা বিনয় কাকু আর মুক্তা কাকীমার ভালোবাসাতেই সম্ভব হয়েছে। ওঁনাদের আসবার প্ল্যান আগে থেকেই ছিল। বাবা চলে যাবার পর মা তো খুব একা হয়ে গেছে। তাই মুক্তা কাকীমাই কথাটা তোলে। মা-র হয়ত সবার সাথে কটা দিন অন্য কোথাও কাটালে ভালো লাগবে। আর মায়ের সঙ্গে আমি, ল্যাং বোট। তবে এখানে এসে মা-র ল্যাং বোট হয়েছে বাপ্পা। বিনয় কাকুদের ছেলে। সাউথ পয়েন্ট ক্লাস নাইন। ভালো ক্রিকেট খেলে।
 
আমার বেড়ানো খুব একটা হয়নি। আমাদের তো সে অবস্থা ছিল না যে কথায় কথায় দেশ বেড়াবো। বাবা একবার শান্তিনিকেতন নিয়ে গিয়েছিল। তখন আমি স্কুলে পড়ি। আর কলেজে এসে একবার এক্সারসানে ফলতা গিয়েছিলাম। যেখানে ঝুমার সাথে আমার প্রথম আলাপ। দিগন্ত বিস্তৃত নদীর বুকে পাল তোলা নৌকো। ঠিক পড়র বইয়ের ছবিতে যেমন দেখেছি। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্রেক্ষাপটে ঝুমা এসে আবির্ভূত হল। আমার বুকের গভীরে খোদিত হয়ে গেল সে। প্রকৃতি আমায় বেশ কাতর করে দেয়। এই এখন যেমন আমি সমুদ্রের রূপ ছেড়ে নড়তেই পারছি না।
 


আমরা বীচে বসে ছিলাম। আমি মুক্তা কাকীমা আর সম্পা। বিনয় কাকু গেছেন বাজারের দিকে আমাদের কোনারক ভ্রমনের ব্যবস্থা করতে। বাপ্পাও গেছে সঙ্গে।
 
চারিদিকে কিশোরী সন্ধ্যার অন্ধকার। এদিক ওদিক ছড়ানো ছোট বড় নানান দল। শামুক ঝিনুক দিয়ে বানানো মূর্ত্তি নিয়ে কিছু বাচ্চা ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঝালমুড়িও আছে।
 
হঠাত সেই অন্ধকারে একটি দল থেকে একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল। বোধহয় কোথাও যাবে। একটি মেয়ের গলা শোনা গেল, মেজদা আমার পোষ্ট কার্ডটা ফেলে দিস্‌। ফেলে দিস মানে অবশ্যই ওয়েষ্ট পেপার বাস্কেটে নয়, ডাক বাক্সে।
 
পোষ্ট কার্ডের কথা শুনে ঝুমাকে চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল। কিন্তু ওকে কথা দিয়ে এসেছিলাম, এখানে এসে প্রথম লেখা কবিতা দিয়ে চিঠি লিখব। ধুর্‌ । ওসব কবিতা ফবিতা শীগ্‌গিরি বেড়োবে বলে মনে হয় না। আজ হোটেলে ফিরে ওকে একটা চিঠি লিখে ফেলব।
সম্পা বালি দিয়ে একটা মূর্ত্তি বানাচ্ছিল। আমাকে ডেকে বলল, দেখ্‌রঞ্জু দা, পারবি এরকম?
সমুদ্র থেকে মুখ ঘুরিয়ে আধো অন্ধকারে সম্পার বানানো শিল্প কর্মটি দেখলাম। বললাম, কি এটা?
ও বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলল, এটার নাম দেব একটি মুখ।
- মুখ তো আমিও বুঝতে পারছি, কিসের মুখ সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
 
প্রথম বর্ষের ছাত্রী সম্পা ছেলেমানুষের মত হাত নাড়িয়ে বলল, এ মা দেখেছো!
মুক্তা কাকীমা গুন গুন করে গান গাইছিল। কাকীমা খুব ভাল রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতে পারে। গান গাইলেও আমাদের কথা শুনছিল। এবার গান থামিয়ে হেসে উঠল। আমিও হাসতে হাসতে বললাম, আচ্ছা কাকীমা তুমিই বলত এটা কিসের মুখ?
- রঞ্জু দা খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। আমি এবার উঠে যাব।

আমি আর কাকীমা হাসতেই লাগলাম। সম্পা রেগে গিয়ে হাত দিয়ে মূর্ত্তিটা ভেঙে দিল। আমাদের হাসির রেশ তখনও যায়নি, দেখলাম চাঁদ উঠেছে, তিন দিন পরেই পূর্ণিমা।
সম্পার রাগ ভাঙানো হয়ত কষ্ট হত। বিনয় কাকু এসে যেতে আবহাওয়াটা স্বাভাবিক হয়ে গেল। বাপ্পা নিঃশব্দে আমার পাশে এসে বসল। ও দেখলাম ঘন ঘন বাজারের দিকে তাকাচ্ছে।
- কালকে গুমোট ছিল। আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে, বলতে বলতে বিনয় কাকুও বসল।

মুক্তা কাকীমা বলল, চাঁদটা যেন আজকে বেশী চক্‌চক্‌করছে।
-কাকু কোনারকের বাস বুক করে এলে?
-হ্যাঁ আমরা পরশু যাব। কাল খুব ভাল করে একচোট স্নান করব ভাবছি।
-সে তো রোজই করছ। কাকীমা বলল।
-না সমুদ্রের অবস্থা ক্রমশঃ খারাপের দিকে। পূর্ণিমা এসে গেলে স্নান করা খুব অসুবিধে হবে।
-রঞ্জু তোকে কাল জলে নামাব। কাকীমা বলল।
-আমার এসব বালি টালির মধ্যে স্নান করতে ভাল লাগে না।
-হোটেলে ফিরে আর একবার করে নিবি?
-ধুর্‌।
-একবার নেবে দেখ, তারপর আর উঠতে ইচ্ছে করবে না।
 
কথাটা বোধহয় ঠিক। কারণ এতদিন দেখছি তো, যেই নামছে, ঘন্টা খানেকের আগে কারোরই জল ছেড়ে ওঠার নাম নেই। বললাম, সে কালকে দেখা যাবে।
কিরে সোনা, তুই কোন কথা বলছিস না তো?
 
সম্পাকে কাকু সোনা বলে ডাকে। সম্পা চুপ করে বসে আছে। তার মানে ওর রাগ এখনও যায়নি। কাকীমা আগের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় হাসতে শুরু করে। সঙ্গে আমিও। কাকু বলে, কি ব্যাপার তোমরা হঠাত হাসতে শুরু করলে?
 
কাকীমা হাসতে হাসতেই বলল, সম্পা বালি দিয়ে একটা মূর্ত্তি বানিয়েছিল, রঞ্জু তাই নিয়ে ক্ষেপিয়েছে, তাই - কাকীমা কথা শেষ করতে পারে না। হেসেই চলে।
কাকু বলে ও এই ব্যাপার। সোনা তুই আর একটা কিছু বানা তো। দেখি তোকে কে কি বলে। এরা সব অর্বাচিন তোর শিল্প কর্ম বুঝবার ফান্ডা এদের নেই।
বাবা, তুমিও শুরু করলে? সম্পার ঠোঁট ফুলে উঠল।
আমি বললাম, সম্পা এত সুন্দর চাঁদ উঠেছে, তুই একটা গান কর।
 
সম্পার গান শেখা কাকীমার কাছ থেকেই। ভালোই গান গায়। কাকু কাকীমাও আমার কথায় তাল মেলালো, হ্যাঁ সোনা একটা গান কর। আমাদের অনুরোধের বিপক্ষে ওর অভিমানকে বেশীক্ষণ টিকিয়ে রাখতে পারল না। শেষে রাজী হল।
সম্পা বলল, আগে আমায় ঝাল মুড়ি খাওয়াও।
কাকু বলল, ঠিক আছে, এক্ষুণি খাওয়াচ্ছি।
-না তুমি খাওয়ালে হবে না। রঞ্জু দা খাওয়াবে।
বাপ্পা ছাড়া আমরা সকলেই জোরে হেসে উঠলাম। বাপ্পা যেন একটু আনমনা। ও দেখলাম তখনও বাজারের দিকে তাকিয়ে আছে।
 

 
হাতের এটাচিটা ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল অনুপম। সুদৃশ্য কাফ-লিঙ্কস লাগানো জামার হাতা সরিয়ে সময় দেখল। কুড়ি মিনিট হয়ে গেল সে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে। আরো কত কুড়ি মিনিট যে দাঁড়াতে হবে কে জানে। এর মধ্যে একটা বাস আসেনি নয়। তবে সেগুলোর যা অবস্থা কোলকাতার কাউকে তা নতুন করে বলতে হবে না। এই যেমন এই মাত্র ঠাসানো মুড়ির তিন ধুক্‌তে ধুক্‌তে এক কাত হয়ে এসে দাঁড়াল।
 
অনুপম রোজ পাতাল রেলেই যাতায়াত করে। ভীড় হলেও সেটা অনেক সহনীয়। কিন্ত বাসের ভীড় এখন আর সহ্য করতে পারে না সে। কলেজ জীবনে বাসের পা দানিতে ঝুলে ঝুলে যাওয়াই এডভেঞ্চার ছিল। বাস কন্ডাক্টার থেকে বয়স্ক যাত্রী কারো অনুরোধ বা ভর্তসনাকে পাত্তা দিত না তারা। এখন আর সে অভ্যেসও নেই, এই অফিস বাবুকেও মানায় না।
 
বাধ্য হয়ে আজ বাসের শরণাপন্ন হতে হয়েছে তাকে। ভবানীপুর স্টেশনে একটি যুবক হঠাৎ লাফ দিয়ে আঁকড়ে ধরে থামাতে গেছে চলন্ত ট্রেনটাকে। তার কি আর এই গতি ভালো লাগছিল না? না কি সে সে পিছিয়ে পড়েছিল? তাই সে নিজেকে জুড়ে দিতে চেয়েছিল সেই গতির সাথে? চারপাশের সময়টা বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে।
 
অনুপম একটু অন্যমনস্ক ছিল। বাসটা কখন এসেছে দেখেনি। বীভতস ব্রেকের আওয়াজে সে কিছটা চম্‌কে ওঠে। এ বাসেও উঠতে পারবে না ভেবেই দরজার দিকে একবার তাকায়। সেখানে তখন পাণিপথের যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ অনুপমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। সে লক্ষ্য করে বাসের জানালায় একটি মেয়ে তাকে দেখছে। বড় বড় দুটো চোখ নিস্পলক তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ঠোঁটের ওপর আলগোছে নেমে আসে একটা দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু বুক ভরা আনন্দ। তার মনে হল বহু কষ্টের মধ্যেও ছুটে গিয়ে আঁকড়ে ধরে দরজার হাতলটা। পা দুটো পাথর হয়েছিল, চোখ দুটোও।
অনুপমের বয়স ত্রিশ। মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। ঠোঁটের ওপর চওড়া গোঁফ। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। অনেক মেয়েই তার দিকে ফিরে ফিরে তাকায়। তবু আজকের এই ব্যাপারটায় অন্য কিছু ছিল। এখানেই এর শেষ নয়।
 
অনুপমের বাড়ি রাসবিহারী অঞ্চলে। পার্ক স্ট্রীটের কাছাকাছি ওর অফিস। বাসের আশা ছেড়ে, সে এস্‌প্ল্যানেডের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সেই চোখ দুটো এখনও বুকের মধ্যে পিং পং বলের মত এদিক ওদিক মাতামাতি করছে। পেছন ফিরে সে দেখল বাসটা অনেক দূরে চলে গেছে। তার এখন হাঁটতে একদম ভালো লাগছে না। ইস্‌এখন যদি চেনা কেউ এখান দিয়ে গাড়ি নিয়ে যেত আর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলত,'এই অনুপম?'
অনুপম চম্‌কে উঠল। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই সে শুনল, 'এই অনুপম'
 
চিন্তার খেই ধরে সে রাস্তার দিকে তাকাল। না কোন গাড়ি এসে থামেনি। ভুল শুনেছে বোধহয় আর তাছাড়া এতগুলো লোকের মধ্যে শুধু কি তারই নাম অনুপম হতে পারে? সে থামেনি হাঁটছিলই। আবার শুনল, এই অনুপম? এবার একেবারে ঘাড়ের কাছে। সে থামল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সলিল। সলিল ওর কলেজ জীবনের বন্ধু। কলেজ ছাড়ার পর কর্মের খোঁজে কে যে কোথায় ছড়িয়ে পড়ল। তবু সলিলের সঙ্গে বন্ধুত্বএখনও গাঢ়। প্রায়ই ওদের দেখা হয়।
 
অনুপম ডান হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আরে সলিল, এখানে কি করছিস্‌?
সলিল প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে অনুপমের কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, কি ভাবছিলি বলত?
-কই কিছু না তো?
-আমি তোকে কখন থেকে ডাকছি।
-এই বাস ট্রামের আওয়াজ -
অনুপম কি ভাবছিল? কিছুক্ষণের জন্যে থেমে থাকা পিং পং বলটা আবার নেচে উঠল। নাঃ বাসটা আর দেখা যাচ্ছে না। তবে, তবে -
হঠাত বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল। যেন নিঃশব্দে ধ্বক্‌করে ওঠা। নিজের ঠোঁটে দাঁত বসিয়ে ঝুমা আনমনেই বলে ফেলল, ইস্‌, তোমায় যদি পেতাম।
 
স্টপেজে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির চোখে চোখ পরতেই তাড়াতাড়ি চোখ ঘুরিয়ে নেয় সে। তবু বুঝতে পারে সেই চোখ দুটো এখনও তার দিকেই চেয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে অনেক আকূলতা।
কনুইয়ের ধাক্কা দিয়ে পাশে বসা রত্না কানের কাছে ফিস্‌ফিস্‌করে বলল, তোর দিকেই তাকিয়ে আছে।
-কে? যেন কিছুই জানে না ঝুমা।
-আহা ন্যাকামী কোরোনা, দারুন হ্যান্ডসাম কিন্তু। চ আলাপ করি।
-ভ্যাট তা হয় নাকি?
-আগে চল।
 
বাস ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। ঝুমার মনেও তাই ইচ্ছে ছিল। যেন সামনের স্টপেজেই নেমে যায়। রত্না আর একবার বলতেই বলল, সত্যিই যাবি?
-অফকোর্স।
 
দুজনে সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সীটের ওপর ঝুঁকে থাকা ভীড়টায় একটু যেন নাড়া পড়ল। এসব জায়গায় নামা খুব শক্ত। সাধারনতঃ এই অফিস টাইমে, এসব জায়গা থেকে লোক ওঠেই, কেউ বিশেষ নামে না। তাই ওদের নামতে বেশ কষ্ট হল। নামতে হল টেনে হিঁচড়ে। বাসটা ছেড়ে দিল। গেটে ঝোলা লোকগুলো, অনেকক্ষণ ওদের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
 
ঝুমা শাড়ি ঠিক করতে করতে বলল, কি পাগলামী হচ্ছে বলত?
-চুপ কর্‌, আগে চল্‌তো। তারপর দেখা যাবে।
 
তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়ল বটে, এখন কাজটা ভীষণ ছেলেমানুষী মনে হচ্ছে ঝুমার। ও বলল, এই রত্না এতে নিজেদের কিন্তু খাটো করা হবে। বিশ্রী ব্যাপার হবে। আমার একদম ভালো লাগছে না।
-আরে বাবা, সে জন্যে নামিনি। তুইও যেমন, ওরকম কারো সাথে আলাপ করা যায়? ইস্‌ উনি একদম গদগদ। দু পলক তাকিয়েছে, আর কি? তুই এই বুদ্ধি নিয়ে রঞ্জু দার সাথে প্রেম করছিস? ছেলেদের একটু না নাচালে মেয়েদের দাম থাকে না।

ঝুমার এসব কথা জানা। পুরোনো কথা শুনতে ভালো লাগছিল না। বিরক্ত হয়ে বলল, তবে তুই কি জন্যে নামলি?

রত্না কৌতুক করে বলল, হঠাত আজকের বিকেলটা মনে হল খুব সুন্দর। ভীড় বাসের থেকে খোলা হাওয়ায় হাঁটা অনেক মনোরম।
-ইয়ার্কি মারিস না। আমার একদম ভালো লাগছে না।
-আরে বাবা, সলিল দা কে দেখলাম।
-কোথায়?
-চল একটু এগোই।
-তারপর?
-ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে। চ ঘাড় মটকানো যাবে।
-কিন্তু কোথায় তোর সলিল দা?
-ওই তো। আরে, সেই ছেলেটা। দেখ সলিল দার সাথে কথা বলছে।
 
ঝুমা ওদিকে তাকাতেই অনুপমের সাথে সঙ্গে আর একবার চোখাচুখি হল। কি আকূলতা ওই চোখ দুটোয়। ঝুমা এবার একটু দেরীতে চোখ নামাল।

ওরা প্রায় সলিলদের কাছে চলে এসেছে। রত্না বলল, ভালই হল, এক ঢিলে দুই পাখী মারা যাবে।
 


ওরা কাছাকাছি আসতেই, সলিল ওদের দেখতে পেল। আর দেখতে পেয়েই বেশ জোরেই চেঁচিয়ে উঠল, আরে রত্না তুমি? পরশু দিন কখন বাড়ি পৌঁছলে? আমার বেশ চিন্তা হচ্ছিল। যে বাসটায় গেলে তার যা অবস্থা ছিল।
- আহা তার জন্যে যেন কত খোঁজ নিয়েছেন?
- আজকেই তোমাদের বাড়ি যাব ভেবেছিলাম।
- ভেবেছেন না ছাই, এখন আমাকে দেখে...
- হ্যাঁ সত্যি।
- আপনি ওই ভেবেই রাখুন।
- বাব্বা, তুমি দেখি একেবারে খাপচুরিয়াস, তোমার বন্ধুর সাথে আলাপ করিয়ে দেবে না? এই আমার এক বন্ধু অনুপম। আমরা দুজনে দুজনের সব কথাই জানি।
 
সলিল বোকা বোকা মুখ করে হাসতে লাগলো। ওদের দুজনের কথার মাঝখানে, অনুপম আর ঝুমার ছোট ছোট দৃষ্টি বিনিময় হয়ে যাচ্ছিল। অনুপমকে ভীষণভাবে টানছিল ওই চোখ দুটো। ঝুমাও ভুলতে পারছিল না সেই আকুলতা। বারবারই মনে হচ্ছিল আর একবার দেখি, আর একবার দেখি।

যেন অনেক কিছু জানি কিন্তু বলব না এই ধরনের একটা হাসি সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে রত্না বলল, আর এই হচ্ছে আমার বন্ধু ঝুমা। ভালো গাইতে পারে, নাচতে পারে, ছবি আঁকতে পারে, আর চাইনিজ খাবার খেতে খুব ভালোবাসে।

যাঃ, এই রত্না কি বলছিস। মুহূর্ত্তের জন্যে লজ্জা পেয়ে অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল, ঝুমা। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবটা কাটিয়ে উঠে বলল, আপনারা ওর কথা বিশ্বাস করবেন না। ও ভীষণ মিথ্যে কথা বলে।

সকলেই অল্প করে হেসে নিল। অনুপমের হাসিটা একটু বোকা বোকা ছিল। সেভাবে হাসতে হাসতেই সে বলল, আচ্ছা না হয় মেনেই নিলাম উনি মিথ্যে বলছেন। আমরা যদি কোথাও বসতে চাই, আই মিন যেখানে চাইনিজ ফুড এভেইলেবল। যতটা সম্ভবমুখের বোকা বোকা ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করতে করতে একবার সলিলের দিকে আড়চোখে দেখে নিল অনুপম। তারপর সোজা ঝুমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি আপত্তি করবেন?

ঝুমা চিন্তিত মুখে একবার তাকাল রত্নার দিকে। রত্নাও ফিরে তাকাল তার দিকে। ঝুমা খুব মৃদু স্বরে রত্নাকে বলল যেন অন্যেরা শুনতে না পায়, দেরি হলে মা দেবে।

রত্নাটা এত অসভ্য, জোরে জোরেই বলতে লাগল, ও কিচ্ছু হবে না। ফেরার সময় আমি তোর বাড়ি হয়ে যাব। আমি থাকলে মাসীমা কিছু বলবেন না।

ঝুমার তখন ইচ্ছে করছিল রত্নার চুলের মুঠি ধরে মাথাটা ঝাঁকিয়ে দিতে। সেটা না পেরে পুরুষ দুজনের চোখ এড়িয়ে রত্নার পেটের কাছে একটা জব্বর চিমটি কাটল ঝুমা। রত্না অস্ফুটে আওয়াজ করল, আঃ। তারপর বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ যাবে। চলুন।

ঝুমা সবার মুখের ওপরেই চোখ ঘুরিয়ে সুন্দর করে হেসে দিল। অনুপমের মনে হল, এত সুন্দর সন্ধ্যে তার জীবনে আর আসেনি।

ওরা থিয়েটার রোডের কাছে একটা রেস্তঁরায় ঢুকল। ঝুমা এতক্ষণে বুঝে গেছে রত্নার মতলবটা। রত্না আসলে সলিলকে দেখেই বাস থেকে নেমেছে। ঝুমার ব্যাপারটা ওর কাছে তেমন জরুরী ছিলনা। সলিলের গল্প রত্নার কাছে অনেক শুনেছে ঝুমা। ওরা অনেক দিন থেকেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে দুজনের সঙ্গে। রত্না ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সলিলের কথা তুলবেই। সলিলের কথা বলতে ভালোবাসে সে। আর যখন বলে, চোখ মুখ অন্য রকম হয়ে যায় ওর। এই আজ প্রথম আলাপ হল।

চৌকো টেবিলের দু পাশে দুটো করে চেয়ার। রত্না টুক করে, সলিলের পাশে বসে পড়ল। ঝুমা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে, বাধ্য হল অনুপমের পাশে বসতে। খারাপ লাগছে না, আবার একটু বাধো বাধো। পাশাপাশি বসার একটা অসুবিধে আছে। বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশের লোকটিকে দেখতে হয়। মুখোমুখি বসলে সে অসুবিধে নেই।

টাই পরা ফিটফাট যুবকটি চারজনের হাতেই চারটে মেনু কার্ড ধরিয়ে দিয়ে গেল। রত্না উলটে পালটে দেখতে লাগল মেনু কার্ডটা। ঝুমা সকলের মুখের ওপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে, ধীরে ধীরে সেটা নামিয়ে রাখল টেবিলে।

অনুপম সেটা লক্ষ্য করে বলল, একি নামিয়ে রাখলেন কেন? বলুন কি খাবেন?
ঝুমা সলজ্জ ভঙ্গিতেচোখ নামিয়ে বলল, ঐ সবাই যা খাবেন।
তা কি করে হয়? আপনারা আজ গেষ্ট। আপনারাই ঠিক করুন। ঝুমার মুখে সে রকমই সলজ্জ হাসি। চোখ নামানো। মেনু কার্ডের কোনা দুটো খুঁটে চলেছহে সে। এখন মনে হচ্ছে, এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতি, না এলেই হত। রত্না এমন একেকটা কাজ করে বসে না, একেক সময়।

অনুপম আবার কিছু বলতে যাচ্ছিল, ঝুমার ব্যাগের মধ্যে তার মোবাইল ফোনটা বাজতে শুরু করে। ঝুমা তাড়াতাড়ি ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে ফোনটা খুঁজতে থাকে। বাকি তিন জনের চোখ এখন তার দিকে।

ঝুমা ফোনটা বের করে জ্বলন্ত স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই রত্নার দিকে তাকাল। শব্দ না করে বলল, মা। বাকিরা কথা থামিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ঝুমা কানে ফোনটা লাগিয়ে বলল, হ্যাঁ মা... এই আসছি একটু পরেই...এসে বলছি...কোথায়...ও...না আমি বাসে চলে আসব...ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ফোন বন্ধ করে ঝুমা। তারপর বলে, ভবানীপুর স্টেশনে একজন সুইসাইড করেছে। মেট্রো বন্ধ।

অনুপম বলল, হ্যাঁ আমি তো সে জন্যেই বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মা টিভি নিউজে দেখেছে, তাই চিন্তা করছে। ঝুমা এবার রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখল, তোকে বললাম। রত্না পাত্তা না দিয়ে বলল, ফোনে তো কথা হয়েই গেল, আর চিন্তা করবে না।

অনুপম বলে, বেশী দেরী করব না। আপনি চিন্তা করবেন না। আমারও কাল সকালে একটা মিটিং আছে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে আমাকেও।

তারপর সে হাতের ইশারায় সেই টাই পরা যুবকটিকে ডাকে। অনুপমের এই দৃপ্ত ভঙ্গীর দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ঝুমা। মনে মনে বলতে থাকে, তুমি যদি বল, তোমার সাথে অনন্ত কাল থেকে যেতে পারি। কোথাও যাবার কোন তাড়া নেই আমার।
 
 

 
হোটেলটার দোতলায় আমরা আছি। টানা লম্বাবারান্দা। তার সাথে সার দেওয়া ঘর। সবাই শুয়ে পড়েছে। বারান্দার আলোটাও নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। রেলিং এর ওপর ঝুঁকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি। অনতিদূরে বীচের ওপর ঝপাঝপ ঢেউ লাফাচ্ছে। সাদা ফেনারা চাঁদের আলোয় ফস্‌ফরাসের মত ঝিকোচ্ছে। চোখ যেন আটকে রাখে।

সারা সন্ধ্যে চিঠি লেখার সময় পাইনি। বীচ থেকে ফিরিতে ফিরিতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। আমি আর বাপ্পা এক ঘরে আছি। ও যদিও গল্পের বই-এর পোকা তবু বেশী রাত জাগতে পারে না। আলো জ্বালিয়ে ওকে আর ডিসটার্ব করিনি। আমার এমনিতেই সহজে ঘুম আসে না, তার ওপর আজ দুপুরে খুব ঘুমিয়েছি।

বারান্দার ও কোণায় মৃদু স্বরে কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছে। বেশ লাগছে শুনতে। সব কিছুই ভালো লাগছে কিন্তু কিছুতেই ভুলতে পারছি না ঝুমাকে একটা চিঠি লিখতে হবে। না, ঝুমা আমাকে সত্যিই খুব ভাবাচ্ছে। ঝুমাকে ফোন করা যায়। ওর মোবাইল ফোন আছে। আমার তো নেই। সম্পার কাছে চাইলে ওর ফোনটা দেবে ঠিকই কিন্তু আমার মনে একটা খচখচানি থেকে যাবে। খুব ঠেকে না গেলে আমি কোন অবলিগেশনের মধ্যে যেতে চাই না।

এখানে আসার আগে ঝুমা আমায় বলেছিল, আমায় না দেখে তুমি থাকতে পারবে?
এত অল্প আলাপে এই কথা বলা যায় না যদিও। আমি বলেছিলাম, কি করব বল, সবাই যাচ্ছে যখন যেতেই হয়। আর রিজার্ভেশন হয়ে গেছে। এখন আর কোন অজুহাত দেওয়া যায় না। তার ওপর আমায় তো যেতে হবে মায়ের ল্যাং বোট হয়ে। মা কে দেখবে কে?

কেন তোমার মা কি অসুস্থ? না থুত্থুরে বুড়ি?

ঝুমার এ কথাটা আমার ভালো লাগেনি। তবু মনে হয়েছিল সরল মনে এ কথা সে বলেছে। অনেক ভালোবাসায় সে আমায় কাছে চাইছে বলে এ কথা বলেছে।

আমি চুপ করে আছি দেখে, হঠাত রেগে গিয়ে সে বলেছিল, যাও না যাও, কে বারণ করেছে, যাও।

আমি কি বলব। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেছিলাম, গিয়েই তোমাকে চিঠি দেব। দেখো ঠিক চিঠি দেব। ওখানে প্রথম যে কবিতাটা লিখব সেটাও পাঠিয়ে দেব।

ইস্‌, কত মনে থাকবে আমাকে।

তোমাকে মনে থাকবে না, কি বলছ।

আমি খুব গলা ছেড়ে হেসেছিলাম। ঝুমার সঙ্গে পরিচয়ের পর সেটা ছিল আমাদের পঞ্চম দেখা। প্রথম দেখা গ্লোবে সিনামা দেখতে গিয়ে। যেদিন আমরা আপনি থেকে তুমি তে উত্তীর্ণহয়েছিলাম। সেদিন সঙ্গে সম্পা ছিল। ঝুমা সম্পার ক্লাস মেট। সম্পার সঙ্গে একদিন বাড়িতে এলে আমার সঙ্গে আলাপ হয়। তারপর মাঝে মাঝেই বাসে ট্রামে রাস্তা ঘাটে যখন তখন ঝুমাকে মনে পড়তে লাগল।
 
সুতরাং কলেজ কেটে একটি সিনামা দেখার প্রোগ্রাম করা এবং ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়া। অবশ্য খুব বেশী আমরা এগোইনি। তবে মেয়েটা বড় ভাবাচ্ছে আমাকে। ওঃ চিঠিটা লিখতে পারলে কিছুটা শান্তি হত।

এই মুহূর্তে ঝুমা কি করছে? ছাদে, ছায়ার মত বসে আছে? নাকি অন্ধকার মশারীর মধ্যে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে। নাকি হালকা ম্যাগাজিনের গল্প পড়ছে? যাই কর ঝুমা, তুমি বড় সুন্দর। তোমার হাতের পাতায় পদ্ম পাপড়ির গভীরের হাল্‌কা গোলাপী রঙ। তোমার ঠোঁটে তিল। তুমি আমার সব হবে। যাঃ বড্ড বেশী কাব্য করছি।

ঝুমার চোখ দুটো ভীষণ সজীব। ওর হাইট আমার থুতনির সমান। ও যখন আমার দিকে চোখ তুলে তাকায়, আমার মনে হয়, এ পৃথিবীতে কিছু নেই, কিচ্ছু নেই, শুধু দুটো চোখ আছে। যে চোখের দিকে তাকালে বুক পাখীর পালকের মত নরম, হাল্‌কা হয়ে যায়।

সত্যিই জলে নামার পর থেকে কি করে যে সময় কেটে যাচ্ছে বোঝাই যায় না। এখানে প্রায় সবাই দল বেঁধে স্নান করতে নামে। হৈ হুল্লোর, সত্যি বেশ একটা মজা আছে এই স্নানের মধ্যে।

আমি ভেতরে বেশী দূর যাইনি। একবার গিয়ে দুটো ডুব দিয়ে তীরে এসে এলিয়ে পরে আছি। গড়ানো ঢেউ এসে সারা শরীর আল্‌তো করে ভিজিয়ে দিচ্ছে।

বাপ্পাকে দেখছি একটা টক্‌টকে লাল শর্ট পরে তখন থেকে ঝাপাচ্ছে। ওর ভয় ডর একটু কম। আমি সাঁতার জানি না বলে ভয়টা বেশী। বাপ্পা খুব ভালো সাঁতার জানে। ও সাঁতার ক্লাবে নিয়মিত যায়।

 জেঠিমা অনেক বার বারণ করেছে। বাপ্পা বেশী দূর যাস্‌না। তবুও দেখছি ঢেউয়ের মাথায় মাথায় লাফিয়ে উঠছে ও। বাপ্পা তীর্থপতিতে পড়ে। এবার ওর ফাইন্যাল ইয়ার। বোধহয় হাঁপিয়ে গেছে। দেখলাম ও জল ছেড়ে উঠে আসছে।

আমার পাশ দিয়ে যাবার সময় বলে গেল, এখানে কি, ভেতরে চল তবে মজা।
আমি বললাম, এই ভালো আছি।

সম্পা নূলিয়ে সঙ্গে নিয়ে ভেতরে গিয়েছিল। এই মাত্র ফিরল। হাত দিয়ে মুখের ওপরের জল মুছতে মুছতে বলল, ভীতু কোথাকার।

আমি শুধু হাসলাম। ইস্‌ ঝুমা যদি এখন এখানে থাকত। বাপ্পাকে কটা বাজে জিজ্ঞেস করব বলে ঘুড়তেই দেখি বালির উঁচু পারে, শুকনো জায়গায় যেখানে আমাদের কাপড় জামা রেখে এসেছি, সেখানে দাঁড়িয়ে বাপ্পা বিকিনি পরা একটা মেয়ের সাথে গল্প করছে। মেয়েটার বয়স এই চোদ্দ থেকে ষোল-র মধ্যে। বাপ্পার কাঁধের ওপর ফেলা একটা ছোত্ত তোয়ালে। অরা দুজনেই খুব হাসছে। মেয়েটা কে?

জেঠুও স্নানে নেমেছিলেন। নাদুস্‌নুদুস ভুড়ি দোলাতে দোলাতে জল ছেড়ে উঠে আসতে আসতে বললেন, আজকের আন্ডার কারেন্টটা বিশেষ সুবিধের নয়। চল ঊঠে পড়া যাক।
হ্যা উঠি। এই বালিগুলো ধুয়ে আসি।

আমি আবার জলের দিকে এগিয়ে গেলাম। জেঠিমাও আমার মত গড়িয়ে আসা ঢেউ উপভোগ করছিল। উঠে দাঁড়াল। দূরে মা বসে আমাদের শুকনো কাপড় সামলাচ্ছে।
 


কলেজ গেট পার করেই থমকে দাঁড়াল ঝুমা। কলেজ প্রাঙ্গনে থিক থিক করছে ছাত্র ছাত্রীতে। মনে হচ্ছে কলেজ বিল্ডিং-এর ভেতরে কেউ নেই। সবাই এসে বাইরে দাঁড়িয়েছে। একটু এগোতেই পেয়ে গেল রত্নাকে।

রত্না, আত্রেয়ী, স্বপ্না আর কলাবতী। ওরা হাসতে হাসতে গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। ঝুমাকে দেখে ওরা থামে। ঝুমাকে যেন ঘিরে ধরে। সবাই একসাথে কথা বলছে। কারও কথাই বোঝা যাচ্ছে না। ঝুমা বলে, অরে বাবা, একজন একজন করে বল। রত্না বলে, চল, আমাদের সাথে।
 
কোথায়? ঝুমা অবাক।
 
আত্রেয়ী বলে, আমরা ওম্‌শান্তি ওম্‌ দেখতে যাচ্ছি।
 
আমি যাব না। ঝুমা বিশেষ উতসাহিত হয়না।
 
স্বপ্না ঝুমার পিঠে চাটি মেরে বলে, আরে দারুণ হয়েছে। শাহ্‌রুখ ফাটিয়ে দিয়েছে। চ না, মস্তি হবে।

স্বপ্নার একটু ছেলে ছেলে ভাব সবসময়ই। ওকে নিয়ে আড়ালে অনেকে আলোচনাও করে। মাঝে মাঝে ব্যাঙ্গ করে স্বপন বলে ডাকে। স্বপ্না এসব জানে। ওর কোন পরোয়া নেই এতে। ও ছেলেদের একদম সহ্য করতে পারে না।
 
ঝুমা বলে, আর ক্লাস?
 
রাখী বলে, ও হরি তুমি কিছু জান না? ইলেক্‌শন গেল না, কলেজ ইউনিয়নের? আজ রেজাল্ট বেড়িয়েছে। এখন হুল্লোরবাজি চলবে দু-দিন।
 
স্বপ্না বলে, দু-দিন? দ্যাখ কদিন চলে?
 
আত্রেয়ী স্বপ্নার কথার রেশ টেনে বলে, তিন মাস বাদে ফাইন্যাল। ক্লাসগুলো নষ্ট হচ্ছে। শেষে গিয়ে সিলেবাসই শেষ হবে না।
 
রত্না বলে, ওসব বাদ দে। চ না ঝুমা।
 
ঝুমা তবুও নারাজ। না রে তোরা যা।
 
রত্না বলে, ও, তোর আমীর এর বই হলে এক্ষুনি ছুটতি। শোন তোর আমীর যতই কচি সাজবার চেষ্টা করুক, এখন বেশ বুড়োতে ছাপ বোঝা যায়।

ঝুমা সঙ্গে সঙ্গে কথার পিঠে কথা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। শোন যা বুঝিস না, তা নিয়ে কথা বলিস্‌না। দিল চাহাতা হ্যায়, রঙ দে বাসান্তি আর তারে জমিন পর লেবেলের ছবি একটাও তোর শাহরুখ করেছে? না পারবে?

কলাবতী এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। চুপ করে শুনছিল। এবার পাশ থেকে বলে উঠল, শোন ওই জোর করে ইন্টেলেক্‌চুইয়াল সাজলেই হয় না। রোববার-এ ঋতুপর্ণ-র তারে জমিন পর-এর ওপর লেখাটা পড়েছিস? নিশ্চয়ই পড়িসনি। পড়ে দেখিস। তাহলে বুঝবি তোর আমীরের ভন্ডামীটা। দর্শককে কি করে বোকা বানিয়েছে। তাদের চিন্তা শক্তির ক্ষমতার ওপর আস্থাহীনতার প্রকাশ দেখিয়েছে।

কলাবতীর পড়ার বিষয় বাংলা। তাই সে সবসময় এই রকম খটমট ভাষায় কথা বলতে ভালোবাসে। খটমট মানে সাজিয়ে গুছিয়ে বইয়ের ভাষার মত। ঝুমার কেমন ন্যাকা ন্যাকা লাগে। তাই সে ঠান্ডা স্বরেই বলল, তার মানে তুই অন্য কারো ধার করা কথা বলছিস। নিজে কিছু বলনা।

স্বপ্না বলে, দেখ তোর অনেক বুদ্ধি। তুই চিন্তা ভাবনা কর। আমরা ঠান্ডা ঘরে বসে বিন্দাস এন্‌জয় করতে যাচ্ছি বস্‌।
 
রত্না আবার বলল, চ না, মজা হবে।
 
অন্য সময় হলে হয়তো এটুকু বলাতেই ঝুমা ওদের সাথে চলে যেত। আমীরকে এমন হেয় করাটা ওর খুব খারাপ লেগেছে। তাই সে বলল, না রে তোরা যা। আমাকে আজ একবার ছোট মাসীর বাড়ি যেতে হবে।

ওরা আর কথা বাড়ায় না। শো-এর সময় হয়ে যাচ্ছিল, ওরা চলে যায়।

ঝুমা চুপ করে দাঁড়িয়ে কি করবে ভাবে। ছোট মাসীর বাড়ি যাবার আজ ওর কথা নেই। জাষ্ট মাথায় এসেছে বলে দিয়েছে। এখন ঠিক করল, ছোট মাসীর বাড়ি ই একবার ঘুরে যাবে সে। মাসীকে একটা ফোন করে নিই, ভাবতে ভাবতে, ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে মোবাইল ফোনটা বের করে।
ডায়াল করতে গিয়ে দেখে একটা মেসেজ এসেছে। অচেনা নম্বর। বার্তাটি ছোট্ট। কেমন আছেন? আমি অনুপম।

ঝুমা প্রথমে ঠাওর করতে পারে না। ভুরু কুঁচকে একটু ভাবে। হঠাত মনে পড়ে যাওয়ায় কপালের ভাঁজ সমান হয়। মুখে হাসি ফুটে ওঠে। সে উত্তর লিখতে শুরু করে। আমি ভালো। আপনি?
আজ বড্ড রোদ। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরে ঝুমা। কিছুটা স্বস্তি। বাস স্টপে এসে দাঁড়ায় সে। বন্ধুদের সাথে বাগ্‌বিতন্ডায় মনটা তেতো হয়েছিল। অনুপমের বার্তা পেয়ে সেটা কেটে গেল। তার ঠোঁটে এখন একটা হালকা হাসি।

ঝুমা দূর থেকে তার গন্তব্যের বাসটিকে আসতে দেখতে পায়। সে ছাতাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় তার ব্যাগের মধ্যে মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। ছাতা বন্ধ করাও হয় না। গন্তব্যের বাসটিতে ওঠাও হয় না। দ্রুত হাতে সে ফোনটিকে ব্যাগ থেকে বের করে দেখে এবং নিজের মনে হাসতে হাসতে ফোনে সাড়া দেয়, হ্যালো।

ওদিকে অনুপম, আমি অনুপম।
হ্যা, বলুন।
কি করছেন? আপনি কোথায়?
কলেজে এসেছিলাম। ক্লাস হলনা। বাড়ি যাচ্ছি।
বাড়ি ফেরাটা কি এখন খুব জরুরী?
না তেমন কিছু না, কেন বলুন তো?
আপনার আপত্তি না থাকলে, আমরা কোথাও বসে কথা বলতে বলতে কফি খেতে পারি।
আপনি কোথায়?

আজ আমার বাইরে বাইরেই কাজ, অফিসে আর ঢুকছি না। আপনি ফোরামে চলে আসুন না।
ঝুমা একটু ভাবে।
কি হল চুপ করে আছেন কিছু বলছেন না?
আসছি।
 
চারপাশে বাতানুকুল পরিবেশ। মুখোমুখি বসে আছে অনুপম আর ঝুমা। ঠান্ডা কফি নিয়েছে ওরা। দূর থেকে দেখেও বলে দেওয়া যায় ওরা দুজনাতেই মগ্ন। চারপাশের পৃথিবী ওরা এই ক্ষণটিতে ভুলে আছে। হঠাৎ বিঘ্ন ঘটায় সেই ফোন। ঝুমার ব্যাগের ভেতর বেজে ওঠে। ঝুমা ফোনটা হাতে নিয়ে অবাক হয়। অচেনা নম্বর।
 
বিরক্তির সঙ্গে বলে, হ্যালো।
 
ওপারে তখন রঞ্জু। হ্যালো ঝুমা আমি রঞ্জু।
 
আমার ক্লাস চলছে। পরে কথা বলব। ফোনটা কেটে দেয় সে।
 
ফোনটা ব্যাগের ভেতর চালান করতে করতে চোখ তুলে তাকায় অনুপমের দিকে। অনুপমের চোখে তখন অনেক জিজ্ঞাসা। মেকী হাসি ফুটিয়ে ঝুমা বলে, ছোট মাসী। ওঁর কাছে আজ যাবার কথা তো তাই ফোন করছিল।
 
আবার ওরা নিজেদের ভালো লাগায় মগ্ন হয়ে গেল।
 


আমি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখতে একটু সময় নিলাম। মনটা একটু ভার হয়ে গেল। এত উৎসাহ নিয়ে ঝুমাকে ফোনটা করলাম। এত দূর থেকে, একটাও কথা বলল না সে। অবশ্য ক্লাস চললে কথা বলবেই বা কি করে। এস টি ডি বুথের লোকটাকে পয়সা দিয়ে আমি বাইরে এসে দেখি বাপ্পা দাঁড়িয়ে।

আজ আমরা কোনারকের মন্দির দেখতে এসেছি। বাস থেকে নামার পড়েই সবাই মন্দির মুখো ছুটেছে। সেটাই স্বাভাবিক। আমি ঝুমাকে ফোনটা করব বলে পিছিয়ে গেছি। একবারেই যে পেয়ে গেছি তাও নয়। একটু এদিক ওদিক খোঁজ করার পর ফোন বথটা আবিস্কার করেছিলাম।

বাপ্পা দেখি এক মুঠো মাউথ ফ্রেস্‌নার লজেন্স আর চিউইং গাম কিনলো। সেগুলো দুহাতের আঁজলার মধ্যে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল নাও। আমি একটা তুলে নিয়ে বললাম, তুই গেলি না মন্দির দেখতে।

-এই তো যাচ্ছি।তারপর আমায় দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে বলল, কি হল? তুমি যাবে না?
আমি বললাম, তুই এগো, আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি এসো, বলে বাপ্পা চলে গেলো।

আমার কিছুই ভালো লাগছিল না। বুকটায় জমাট বাঁধা ভার। আমি সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গেলাম। তাও একটু ভালো লাগছিল, কতদিন বাদে ঝুমার গলাটা শুনলাম। একটা দুটো শব্দ হলেও ওর মিষ্টি স্বর এ কেমন যেন মাদকতা আছে।
 
যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন কোনারকের সমুদ্রতট, পুরীর সমুদ্রতটের থেকে অনেক সুন্দর, আকর্ষনীয়। ঝুমার কথা ভাবতে ভাবতে পায়ে পায়ে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে এসেছি আনমনে। যেখানে এসে দাঁড়ালাম সেখান থেকে পারটা অনেকটা নীচে নেমে গেছে। বীচটায় যেতে হলে ঢাল বেয়ে নেমে যেতে হবে অনেকটা।

ডাইনে বাঁইয়ে অনেক দূর অবধি বালুকাবেলার বিস্তার দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে অনেকটা দূর বলে খুব ছোট ছোট দেখাচ্ছে স্নানার্থীদের। যদিও তারা সংখ্যায় তেমন বেশী নয়। আমি বলছি পুরীর অনুপাতে। সেখানে যেমন সব সময় গিজগিজ করে মানুষ।

একটা অদ্ভুত জিনিষ দেখে সেখানে বসে গেলাম। একটি মানুষ বালি দিয়ে বিশাল এক মৎসকন্যা বানাচ্ছেন। সাগরের জল থেকে কিছুটা দূরে। লোকটি দেখছি মাঝে মাঝেই ছুটে যাচ্ছে জলের কাছে আর আঁজলা ভরে জল এনে ঢেলে দিচ্ছে সেই বানানো মূর্তিটির গায়ে। কেন জানি না। অনেকক্ষণ সেখানে বসেছিলাম। ভালোই লাগছিল । ঝুমার জন্য মন খারাপটাও চলে গেল। এবার মন্দিরের দিকে না গেলে ওরা খোঁজাখুজি শুরু করবে।

আজকাল বোধহয় ফিল্ম ক্যামেরায় আর কেউ ছবি তোলেনা। সকলের হাতেই ডিজিটাল ক্যামেরা। বাবার পুরোনো একটা ফিল্ম ক্যামেরা আছে। সেটা আমি নিয়ে এসেছি। মন্দিরের কয়েকটা ছবি তুললাম। সারাইয়ের কাজ চলছে বলে বাঁশ টাস বাঁধা। তেমন ভালো ভিউ পাওয়াও গেল না।

আমি ছবি তুলছিলাম, আমার পাশেই এসে দাঁড়ালো একটি টুরিস্ট দল। তাদের সঙ্গে রয়েছেন এক গাইড। তিনি বলে চলেছেন এই মন্দিরের ইতিহাস। কত ঘটনার সাক্ষী এই সূর্য মন্দির। শুনতে মন্দ লাগছিল না। আমিও ছবি তোলার ভান করতে করতে উপভোগ করছিলাম সেই গাইডের কথাগুলি। হারিয়ে গিয়েছিলাম অতীতে। সম্পার ডাকে সম্বিত ফিরল।

এই রঞ্জু দা, চ এবার আমরা বাসে ফিরে যাচ্ছি।

আমি বললাম, চ।
আর আমার ভালো লাগছে না। ঝুমা কবে দেখব তোমার মুখ? কোলকাতার জন্য মন উচাটন।
আমার মনে কবিতা এলো।

তোমার বুকে এত্ত বড় হোলাম
আমি কি থাকতে পারি দূরে
যত দূরেই যাই ঠিক আসব ঘুরে
আমি তোমার গোলাম।

মনটা ভালো হয়ে গেলো।


রবীন্দ্র সরোবরের পাশের রাস্তাটা বড় মনোরম। চারপাশে অনেক গাছ। এ রাস্তায় অনবরত গাড়ি যায় বটে, এখন এই দুপুর আর বিকেলের মাঝখানের সময়টা তাও কম। কলকাতার অন্যান্য রাস্তার অনুপাতে এখানটা অপেক্ষাকৃত শান্ত। চওড়া ফুটপাথ ধরে মন্থর হেঁটে যেতে ভালোই লাগে।

অকারণ হাসতে হাসতে, এলোমেলো গল্প করতে করতে ঝুমা আর রত্না হেঁটে যাচ্ছিল গোলপার্কের দিকে। দুই সখী একটু আগেই বিবেকানন্দ পার্কের পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকা খেয়েছে। ঝাল আলু মাখাটার স্বাদ এখনও ওদের জিভে। উহ্‌, আহ্‌ করে দুজনেই উপভোগ করছে সেই অনির্বচনীয়, কষ্টকর মুহূর্ত।

ঝুমা ফিরবে টালিগঞ্জের দিকে। রত্না কেন যে ওকে জোর করে গোলপার্কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সে জানে না। বললেই বলে, আরে চ' না। আমার একটা কাজ আছে। রত্নার তো অসুবিধে নেই। ও থাকে যাদবপুর। ওখান থেকে হাজারটা বাস অটো পেয়ে যাবে।

হঠাৎ রত্না বলে, রঞ্জু দা ফোন করেনি এর মধ্যে?

ঝুমা প্রস্তুত ছিল না প্রশ্নটার জন্য। রত্নার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, উঁ। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলে, না করেনি।
একদিনও ফোন করেনি? রত্না অবাক হয়।
ঝুমা মাথা নাড়ে।
- চিঠি দিয়েছে তাহলে?
- ধুর্‌।
রত্না চুপ করে যায়। কথাহীন কিছুটা এগিয়ে যায় ওরা।

রত্না বলে, সম্পা আমায় ফোন করেছিল। ওরা দারুন ঘুরছে। সামনের রোববার নাগাদ ফিরবে। ঝুমা কোন কথা বলে না দেখে রত্না আবার বলে, রঞ্জু দার তো নিজের ফোন নেই, তাই হয়ত তোকে ফোন করতে পারেনি।
হঠাৎ ঝুমা বলে, অনুপম বলছিল, কি একটা সারপ্রাইজ দেবে। কাল ছুটির পর আমার সাথে যাবি?

রত্না ঠিক এখনই এই কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিলনা, ঘুরে তাকাল ঝুমার দিকে।
- সারপ্রাইজ তো তোর জন্য, আমি গিয়ে কি করব?
- আহা বাজে কথা বলিস না। অনুপম যেন তোর কাছে পর?
রত্না চুপ করে হাঁটতে থাকে। ঝুমা বলে, কি রে যাবি তো?

ওরা গোলপার্কের কাছাকাছি চলে এসেছে। রত্না কিছু বলছে না দেখে ওর দিকে তাকায় ঝুমা, দেখে, রত্না এক দৃষ্টে কিছু দেখছে। সেই দৃষ্টি বরাবর চোখ ঘোরাতেই দেখতে পায়, রামকৃষ্ণ মিশনের দেওয়াল ঘেঁষে সলিল দা দাঁড়িয়ে আছে।

ও তাহলে এই জন্যেই রত্না এদিকে আসাতে জোর করছিল। ঝুমা হয়ত অন্য সময় হলে রাগ করত। সলিল দা'র বোকা বোকা মুখে এদিক ওদিক চাওয়া দেখে হাসি পেয়ে গেল ওর।

দুই সখী কাছে পৌঁছনোর আগেই সলিলের ফোনটা বেজে উঠলো। সলিল দেখে অচেনা নাম্বার, তবু ফোনটা কানে লাগিয়ে বলে, হ্যালো।

রত্না, ঝুমা কাছে এসে এবার বোকার মত তাকিয়ে থাকে সলিলের দিকে। ও কথা বলতে বলতেই হাসি দিয়ে ব্যাপারটা সামলাবার চেষ্টা করতে থাকে।
- আরে বল। এতদিন পর। তোর তো কোন কন্টাক্ট নাম্বারই আমার কাছে ছিলনা। আমি এখনই সেভ করে নিচ্ছি। এখন কি ছবি করছিস? তুমি তো বস সেলিব্রিটি। তো আমরা কবে দেখব? ঠিক তো? ঠিক তো? ও কে, ও কে। টা টা, তুই ও ভালো থাকিস।

যতক্ষণ ফোনটা চলছিল? সলিল আর রত্নার মধ্যে ইশারায় কথা চলছিল। রত্না হাত তুলে বোঝাতে চাইছে কে? আর সলিল হাত দিয়ে থামানোর ভঙ্গীতে বলছে, বলছি বলছি। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বলল, আমার এক পুরোনো বন্ধু। এ্যাসিসট্যান্ট ডিরেক্টর, ঋতুপর্ণের সাথে কাজ করে।

রত্না বলে, ওয়াও। এর কথা আগে বলনি তো?
- আরে ওর ফোন নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
ঝুমা বলে, আমাদের একদিন শ্যুটিং দেখাতে বলুন না সলিল দা।
- সে কথা বলতেই ফোন করেছিল। বিপাশা এসেছে আজ। কাল যেতে বলল।

রত্না, ঝুমা একসাথে বলে উঠল, আমরাও যাব, আমরাও যাব।
দুই সুন্দরীর সামনে সলিল কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিতে যাওয়া পুরুষের স্বরে বলল, দ্যাট্‌স নট আ প্রবলেম।


ডিনারের পর অন্ধকার বারান্দায় এসে বসে রাতের সমুদ্র দেখা, আমার রোজকার রুটিন হয়ে গেছে। যদিও তার আয়ু আর মাত্র একদিন। আমাদের ফিরে যাবার ট্রেন ধরতে হবে পরশু। আজ আবার পূর্ণিমা। সাগরের অনেকটা দূর অবধি আবছা দেখা যাচ্ছে। ঢেউয়ের মাথার মুকুটটা যেন আরো বেশী ঝলমলে আজ।
বাপ্পা ঘরে শুতে চলে গিয়েছিল। দেখলাম হঠাৎ বারান্দায় এসে রেলিং এ কনুইয়ের ভর দিয়ে দাঁড়ালো। আমি বললাম, কি রে ঘুমোলি না?
- এই যাব।
বাপ্পা দেখলাম বারান্দার ডান দিকের ঘরগুলোর দিকে বার বার তাকাচ্ছে। বুঝলাম সেই মেয়েটির জন্য, যার সাথে বীচে ওকে কথা বলতে দেখেছি। আজও সন্ধ্যেবেলা যখন আমরা শেষ বেলার শপিং এ ব্যস্ত, তখনও দেখেছি, মেয়েটি ওর বাবা-মা-র সাথে ঘুরছিল। বাপ্পা ওদের কাছে এগিয়ে যেতে, মেয়েটি বাবা মা-র সাথে ওর আলাপ করিয়ে দেয়। তারপর বেশ কিছুক্ষণ বাজারের মধ্যে বাপ্পা ওঁদের সাথেই ছিল। ওঁরাও যে এই হোটেলেই উঠেছেন আগে জানতাম না। একসাথে সবাই ফিরতে জেনেছি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, মেয়েটা তোর বন্ধু? তোর সাথে পড়ে?
হঠাৎ এই প্রশ্ন করব বাপ্পা ভাবেনি। অন্যমনস্কতা ভেঙে বলল, উঁ, না, ও কারমেলে পড়ে। উই হ্যাভ কমন ফ্রেন্ডস। এখানে এসে আলাপ হয়েছে।
- ও, নাম কি মেয়েটার?
- অনিতা। ওরা মহানির্ব্বান রোড-এ থাকে। ন'নম্বর বাড়ি।
- বাব্বা, তাও জেনে ফেলেছিস?
এবার বাপ্পা একটু লজ্জা পায়। সেটা কাটাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলে, ওর পাড়ার তিন চারটে বন্ধু আমাদের স্কুলে পড়ে।
তারপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। ওর বয়সী ছেলে মেয়েরা কেমন সহজেই মিশে যেতে পারে। আমাকেই কেন শত বাধা এসে আঁকড়ে ধরে বুঝিনা। আজ আর বারান্দার ওপাশ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে আসছে না। হয়ত তাঁরা চলে গেছেন।
বাপ্পা হঠাৎ প্রশ্ন করে, আমাদের ট্রেন তো পরশু? তাই না?
- হ্যাঁ পুরী এক্সপ্রেস। কেন রে?
- অনিতারা কাল সকালেই রওনা দেবে।
- সকালে? কোন ট্রেন?
- ট্রেনে না। ওরা তো বাই কার এসেছে।
- ও
এতক্ষণে বাপ্পার উসখুসের কারণটা বুঝলাম। যাবার আগে যদি আর একবার দেখা হত। পরক্ষণেই আমার ঝুমার কথা মনে পড়ল। আমি অফুরান ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নানান কল্পনায় হারিয়ে গেলাম। ঘোর ভাঙল, আমায় যেন কেউ ডাকছে।
- রঞ্জু দা -
ঠিক যেন সিনেমা। অথবা ম্যাজিক। ছিল রাজকুমার, হয়ে গেল ব্যাঙ। ঠিক যেখানে বাপ্পা দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন সম্পা দাঁড়িয়ে আছে। আমি চমক ভেঙে, ঘাড় ঘুরিয়ে আগে বাপ্পাকে খুঁজলাম। ধারে কাছেও নেই। তারপর সম্পার দিকে ফিরে বললাম, হ্যাঁ বল।
একটুক্ষণ চুপ থেকে ও বলল, তোমার সাথে এর মধ্যে ঝুমার কথা হয়নি?
আমি একটু ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, না রে, কেন বলতো?
ওর মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কথা বলবে? ওকে ফোন করব?
খুব লোভ হচ্ছিল। সংবরণ করলাম। বললাম, না থাক, এত রাতে ফোন করার দরকার নেই। আর পরশু তো আমরা ফিরেই যাচ্ছি।
ও বলল, কাল রত্নার সাথে কথা হয়েছে আমার। ওরাও খুব মজা করছে। ভালই আছে।
আমি ওর মুখের দিকে ঘুরে তাকালাম। অন্ধকারে সম্পার মুখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না। জ্যোৎস্নায় যেটুকু দেখা যায়। বুঝিনি ও কি বলতে চায়। তবে এটুকু মনে হল, ও অনেক কিছুই বলছে না।
আমি বললাম, খারাপ থাকবে কেন বলত? ভালো থাকারই তো কথা।
সম্পা এক ঝটকায় আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর, শুতে গেলাম, বলেই দ্রুত চলে গেল।
আমার চোখ ফিরে গেল সেই ফস্ফরাস মাখা অনন্ত ঢেউয়ের উথালি পাথালিতে। আর মন? কোথায় কোথায় যে ঘুরে বেরাতে লাগল।
১০

অনুপম আজ সকাল থেকেই উত্তেজিত। আজ ও একটা নতুন মোটোর বাইক কিনবে। কিনবে মানে, শো রুমে গিয়ে মডেল, রঙ সব পছন্দ করবে। দাম-টাম, ই এম আই এর নিয়ম কানুন জেনে আসবে। পরে একদিন, সেটা কাল পরশুও হতে পারে, দু দিন পরেও হতে পারে, পক্ষীরাজটি তুলে নিয়ে আসবে ঘরে।

ই এম আই এর ব্যাপারে অফিসের কিছু কাগজ পত্র তৈরী করার দরকার আছে। সেটাতেই যা সময় লাগবে। আর আজ এই পক্ষীরাজ পছন্দের অনুষ্ঠানে অনুপম সঙ্গী করতে চায় ঝুমা কে।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে কাজ অনুপমের। খাওয়া দাওয়ার ঠিক থাকেনা। এখন তো শোনা যাচ্ছে, লাঞ্চ এর মেনুটাও ঝুমাকে ফোন করে ঠিক করে নেয় অনুপম। ঝুমার প্রেমে পাগল অনুপম।

এই মোবাইল কেনার কথা কাউকেই জানায়নি সে। সলিলকেও না। ওকে জানালেই, ও ঠিক রত্নাকে বলবে, আর ঝুমাও জেনে যাবে। ঝুমাকে আজ একটা সারপ্রাইজ দেবে বলে রেখেছে সে।
দুপুরের দিকেই চলে যাবে ওদের কলেজে। খুব চমকে দেবে আজ ঝুমাকে। ঝুমাও নিশ্চয়ই খুব খুশী হবে ওর মোবাইক কেনার কথায়। ঝুমার হাসিখুশী ঝলমলে মুখটা চোখের সামনে যেন দেখতে পেল অনুপম। তার ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি। এখন কেউ ওকে দেখলে নির্ঘাত পাগল ভাবত। সে তো আর জানতে পারত না মানুষটা নিজের মনে কেন হাসছে?

ওদিকে ঝুমাও আজ সকাল থেকে খুব উত্তেজিত। আজ সে আর রত্না সলিল দার সঙ্গে শুটিং দেখতে যাবে। যেমন তেমন শুটিং নয়। বিপাশা বসু থাকবে। দুটো ক্লাসের পরই কাটতে হবে।
অনুপম আজ কি একটা সারপ্রাইজ দেবে বলেছে। কি জানি কি বলবে। বা কোথাও নিয়ে যেতে চাইবে হয়ত। এর মধ্যে একদিন ওরা দুজন ডায়মন্ড হারবারের ভাঙা দূর্গ ছুঁইয়ে এসেছে। সলিল, রত্না কেউই সেটা জানে না। অনুপমটা সত্যিই একটা পাগল। ঝুমাও নিজের মনে হাসতে হাসতে স্নানের ঘরে সাওয়ারের চাবিটা খুলে দিল।

অনুপম যখন ঝুমার কলেজের উল্টো ফুটপাথে এসে দাঁড়ালো, তখন ঠিক দুটো পঁচিশ। আজ খুব রোদ। আর কলেজটা একদম ট্রাম রাস্তার ওপর বলে লোকজনের ব্যস্ততা সবসময়। অনুপম কিছুক্ষণ কলেজ গেটের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করল। তারপর পকেট থেকে ফোনটা বের করে ঝুমার নাম্বারটা ডায়াল করতে শুরু করল।

কোলকাতার নতুন বাসগুলো বেশ ভালো। গাড়ীর ভেতরে অনেক স্পেস। বসার আসনগুলিও বেশ আরামদায়ক। বাসের অনেকটা অংশ কাচ থাকায় ভেতরে প্রচুর আলো। সেই ঘুপচি ঘরের দম বন্ধ ব্যাপারটা আর নেই।

দুই বান্ধবী পাশাপাশি বসে আছে। বাস ছুটে চলেছে বাই পাশ ধরে। হু হু হাওয়ায় দুজনের চুল উড়ছে। পাশে বসেই কথা বলতে অসুবিধে হয়। দুজনে অকারণেই হাসছে। ওরা আজ খুব খুশী।
একটু পেছন দিকে বসেছে সলিল। ঋতুপর্ণের শুটিং যেখানে চলছে সে স্টুডিওটা সেক্টর ফাইভে। ওদের গন্তব্য সেখানেই।

ব্যাগের মধ্যে ঝুমার ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনটা হাতে নিয়ে জ্বলন্ত স্ক্রিনটা চোখের কাছে তুলে ধরতেই দেখে, সেখানে ফুটে উঠেছে অনুপমের নাম। ঝুমা ঘুরে তাকায় রত্নার দিকে। দেখে, রত্না ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
১১

অনুপম খুব মুষড়ে পড়ে। এতটা আশাহত হতে হবে ভাবেনি সে। সকাল থেকেই, শুধু সকাল থেকে কেন, কাল রাত থেকেই উত্তেজনার পারা যেমন ধীরে ধীরে বাড়ছিল, এখন যেন ঝপাৎ করে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল।

সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেল সে? একটু অভিমান, একটু হতাশা, একটু বিরক্তি নিয়ে অনুপম প্রথমে থিক করল মোবাইকের শো রুমে আজ আর সে যাবে না। পরে ভাবল, ওরাও তো তাকে জানায়নি যে বিপাশা বসুর শুটিং দেখতে যাচ্ছে।

কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। আজই সে তার পক্ষীরাজ বাছাই পর্ব সেরে রাখবে। ঝুমাকে তো ডেলিভারির দিনও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। বরং সেটাই আরো রোমান্টিক হবে। প্রথম সওয়ারি হবে দুজনে একসাথে। অনুপম নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল।

সলিল, রত্না আর ঝুমা স্টুডিও চত্বরের একপাশে এসে দাঁড়ালো। সেখানে নানান লোকের ভীড়। কোথাও স্টোভ জ্বালিয়ে চা বানানো হচ্ছে। খাবার জন্যে টেবিল চেয়ার পাতা বোঝাই যাচ্ছে। তার ওপর, বড় বড় রঙীন ছাতা। নানান মাপের আর নানান কোম্পানির গাড়ি প্রায় খান বিশেক। তার মধ্যে ঢাউস ট্রাকের মত দুটো গাড়িও আছে।

সলিল এদিক ওদিক খুঁজছে তার সহকারী বন্ধুকে। ভাবছে কাউকে জিজ্ঞেস করবে কি না। এমন সময় স্টুডিও ফ্লোরের দরজা খুলে স্বয়ং ঋতুপর্ণ বেরিয়ে হন্‌হন্‌ করে। জোর গলায় কাউকে একটা বকছেন বোঝা গেল। পেছনে পেছনে ছুটে আসছে একটি ছেলে। সে বৃথাই কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। কোন কাজ হচ্ছে না। ঋতুপর্ণ ছেলেটির কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা একটা বিশাল সাফারি গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়িটা স্টুডিও চত্বর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। পেছনে আসা ছেলেটি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল।

আরো অনেকেই ফ্লোর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ঋতুপর্ণের প্রস্থানের সময় চারিদিকে ছিল শ্মশানের স্তব্ধতা। তাঁর গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই ধীরে ধীরে গুঞ্জন শুরু হল। শুরু হল বিভিন্ন জটলা।

ওই বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার নাম রাজা। ঋতুপর্ণের দ্বিতীয় সহকারী। সেই সলিলের বন্ধু। সলিল এবার এগিয়ে গেল তার দিকে। সলিলকে দেখে রাজা একটু হাসবার চেষ্টা করল। ঝুমা আর রত্নার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করল সে।

রাজা ইসারা করতেই প্রোডাকসনের লোক এসে প্লাস্টিকের কাপে চা দিয়ে গেল ওদের। সলিল চায়ে চুমুক দিয়ে মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করল, কেসটা কি?
- আরে বলিস না, ঋতু চেয়েছিল সেই পুরোনো দিনের ক্যাম্বিসের স্কুল ব্যাগ। এখন শটের আগে দেখা যাচ্ছে সেটা আসেনি। রেগে যাওয়া স্বাভাবিক। ওটা আর্ট ডিপার্টমেন্টের গাফিলতি। আমি মধ্যস্থতা করতে গিয়েছিলাম। পুরো ঝারটা আমি খেলাম।
- তো চলে গেলেন যে, শুটিং হবে না?
- মনে হচ্ছে আজ আর হবে না। ওই ব্যাগ তো আজ আর আসা সম্ভবনা নেই। ওই ব্যাগ এখন পাওয়া যায় না। কাপড় কিনে বানাতে হবে।

ঝুমা আর রত্না খুবই হতাশ। তার মানে শুটিং দেখা তো হবেই না, বিপাশাকে দেখাও হবে না। ঠিক এমন সময় বাইরে বেরিয়ে এলো বিপাশা। স্প্রিং এর পুতুলের মত পটাং করে সেদিকে ঘুরে গেল দুই বান্ধবী। বিপাশা জিনসের ওপর ছোট্ট একটা টপ পরা। শুটিং এখন হচ্ছে না খবর পেয়ে গেছে নিশ্চয়ই। হোটেলে ফিরে যাচ্ছে। কয়েকজনের সাথে দু-একটা কথা সেরে গাড়িতে উঠে চলে গেল বিপাশা। ঝুমা আর রত্না মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

১২

বিনয় কাকুর ব্যবসাটা ইঞ্জিনিয়ারিং এর। স্টীল বা লোহার পাত কেটে, বাঁকিয়ে, ঝালাই করে নানান মাপের ভেসেল, ট্যাঙ্ক এই সব বানানো হয়। এসব কাজের নির্দিষ্ট ড্রইং থাকে। সেই ড্রইং ধরে, মাপ মত পাতগুলোকে এমনভাবে কাটার চেষ্টা করা হয় যেন বাকি পাতটাও কোন না কোন কাজে লাগানো যেতে পারে। বিনয় কাকুর পুরোনো কাজের লোকেরা এ ব্যাপারে খুবই দক্ষ। তবু সুপারভাইজার হিসেবে আমায় সবটা দেখে নিতে হয়। আমি নিজেই এখনও শিখছি। তবে ড্রইং পড়তে পারি ভালই। আমাকে সারাক্ষণ না থাকলেও চলে। কাজটা বুঝিয়ে শুরু করে দিয়ে আবার পরে এসে দেখে নিলেই হয়।

কাকুকে বলাই ছিল আজ দুপুরে আমি বেরিয়ে যাব। পুরী থেকে ফেরার পর আজ ঝুমার সাথে দেখা হবে। ওর জন্যে ছোট্ট কিছু উপহার এনেছি। সেগুলোও দেওয়া হবে।
কলেজ স্ট্রীটের কফি হাউসে দেখা হবে কথা ছিল। ঝুমা আসতে বেশ দেরি করল। ও যখন এলো আমার এক কাপ কফি শেষ।

ঝুমা এসেই ঝরঝর করে অনেক কথা বলে যেতে লাগল। ওদের কলেজে প্রক্সি দেওয়া নিয়ে তুমুল কান্ড হয়েছে। খুব কড়াকড়ি চলছে। তাই আটকে পড়েছিল। তাও শেষ ক্লাসটা না করেই চলে এসেছে সে।

ঝুমার ঝোলানো দুলের নীচে ঘাড়ের ওপর চূর্ণ চুলের পাশে বিন্দু বিন্দু ঘাম, তাও যেন কত সুন্দর। ঝুমার যা সবচেয়ে আমায় চুম্বকের মত আকৃষ্ট করে, তা ওর গভীর কালো দুটো চোখ। ওই চোখ দুটোর দিকে তাকালে, আমি চোখ ফেরাতে পারিনা, কোন কথাও বলতে পারি না।

ঝুমা অনেক কথা বলে যাচ্ছিল, আর আমি তার কিছু শুনছিলাম, কিছু শুনছিলাম না, কেবল মুগ্ধ হয়ে তাকিয়েছিলাম ওর দিকে। ঝুমা শেষে বলল, রঞ্জু দা এবার একটা মোবাইল ফোন নাও। আমি তো তোমায় জানাতেও পারছি না যে আমার দেরী হচ্ছে।

আমি মুচকি হাসতে হাসতে ঝুমাকে উপহারগুলো দিলাম। একবার চোখ বুলিয়ে ভদ্রতার থ্যাঙ্ক ইউ বলল। খুবই সাধারণ জিনিষ। উচ্ছসিত হবার মত কিছু নয়। উড়িষ্যার বাটিকের কাজ করা ঝোলানো ব্যাগ। ঝিনুক আর কাঠের মালা। যা প্রায় সকলের বাড়িতেই খুঁজলে এক আধটা পাওয়া যাবে। তবে যেটা দেখে ঝুমা খুব অবাক হবে ভেবেছিলাম, সেটাও সে খুব স্বাভাবিকভাবে ব্যাগের মধ্যে রেখে দিল। একটা মুঠো সাইজের কড়িরোপর ওর নাম লেখা। অনেকেই লেখাচ্ছে দেখে আমার ঝুমার কথাই মনে পড়ে। হয়তো বাড়িতে ফিরে ভালো করে দেখে অনুধাবন করবে আর আমার আকাঙ্খিত হাসিটা হেসে উঠবে। কেবল আমার দেখা হবে না তা।

ও ওর মোবাইল ফোনটা নিয়ে খুব ব্যস্ত। কয়েকটা এস এম এস পড়ল, পাঠালো। আমরা কেমন ঘুরলাম একবারও জানতে চাইলো না ঝুমা। আমি তাতেও অবাক হইনি। অবাক হলাম ওকে যে কথা দিয়েছিলাম কবিতা লিখে পাঠাবো, তার কোন উল্লেখই করল না। নাকি রাগ করে সে কথা তুলছেই না। হয়ত খুব অভিমান করেছে আমার ওপর।

ঝুমা একটু উসখুস করে বলল, এখানে বড্ড গরম। সিসিডি বা বারিস্তা অনেক কমফোর্টেবল।
আমি মনে মনে ভাবলাম, ওগুলো আরামদায়ক অবশ্যই, অনেক খরচা সাপেক্ষও বটে। আমার পক্ষে দিনের পর দিন ওখানে বসা বেশ কষ্টকর।

এ সময় ঝুমার ফোন বেজে ওঠে। ঝুমা ফোনের স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে আমার দিকে তাকায়। দেখে আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। বিব্রত হয়ে বলে, এক মিনিট প্লিজ।
- হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই।

ঝুমা ফোনের বোতাম টিপে কানে লাগাতে লাগাতে বলে, হ্যাঁ বল। তারপর ফোন কানেই কফি হাউসের টয়লেটের দিকে চলে যায়।

আমি বেয়ারাটাকে খুঁজতে থাকি আর এক প্লেট পকোড়া দিতে বলার জন্য। একা একা বোকার মত বসে থাকি বেশ কিছুক্ষণ। উদ্বিগ্ন মুখে ফিরে আসে ঝুমা। এসেই জানায়, ছোট মাসি ফোন করেছিলেন। আজ ওঁনার ওখানে যাবার কথা। তাই চিন্তা করছেন। এখুনি যেতে হবে তাকে।

১৩

সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরতেই মা বলল, তুই কোথায় ছিলি? বিনয় ঠাকুরপো বার পাঁচেক ফোন করেছেন। এক্ষুনি ওনাকে একটা ফোন কর।
আমি বললাম, কেন, কি হয়েছে?
মা বলল, আমি তো ঠিক বলতে পারব না, তবে কারখানায় কোনো গন্ডগোল হয়েছে।
- কারখানায় গন্ডগোল? হাতে গোনা পাঁচ সাতটা কর্মচারী, সেখানে আবার কি গন্ডগোল হবে?
- তুই এক্ষুনি ওনাকে একবার ফোন কর।
আমি ফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল করা শুরু করলাম।
যা জানা গেল, ওয়েল্ডার হরি দা, সকালে গায়ে জ্বর নিয়েই কাজে এসেছিল। কাজ করতে করতে অজ্ঞান হয়ে মুখ থুবরে পড়ে যান এবং সেই অচৈতন্য অবস্থাতেই তড়িতাহত হন। হেল্পার ছেলেটি হরি দাকে তুলতে গিয়ে সেও তড়িতাহত হয়। কেউ একজন বুদ্ধি করে মেন সুইচ বন্ধ করে দেয়। তারপর ওদের দুজনকে নিয়ে কি করবে বুঝতে পারে না। বিনয় কাকুকে ফোন করে।
সুপারভাইজার হিসেবে আমার সেখানে থাকা খুবই জরুরী ছিল। বিনয় কাকু আমার খোঁজ করেন। ওদের হাসপাতালে পাঠানো, উপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া, আমারই করার কথা। ওদের দেখা শোনার ভার যখন আমার ওপর।
আর তাছাড়া কাকু বলেছিলেন, তিনি আজ ব্যস্ত থাকবেন ইনকাম ট্যাক্সের উকিল বাবুর সঙ্গে। আমাকে না পেয়ে কাকুকেই সব কাজ ফেলে ছুটে আসতে হয় এবং যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হয়। আমার খুব লজ্জা করছিল। যাক এখন তো আর কিছু করার নেই। কাল কাকুর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব খন।
ভাবলাম রাতে ঝুমা ফোন করবে। আমার দেওয়া জিনিষগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে আমার কথা মনে পড়বে আর ঠিক একটা ফোন করবে। অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা। ঝুমার ফোন আর আসেনি।
পরদিন সকালে কারখানায় পৌঁছেই আমি কাকুর কাছে ক্ষমা চাই। বিনয় কাকু অবাক হয়ে বলেন, তুমি ক্ষমা চাইছ কেন? তুমি কি জানতে এ্যাকসিডেন্টটা হবে? তুমি তোমার কাজে গিয়েছিলে, আমি আমার কাজে গিয়েছিলাম। ও নিয়ে ভেবোনা। আমি যেটা নিয়ে ভাবছি, তোমায় অল টাইম যোগাযোগ করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
আমি চুপ করে বসে শুনছি। যেন আমার বিচার হচ্ছে। কাকুই বললেন, তোমায় ইমিডিয়েটলি একটা মোবাইল ফোন নিতে হবে। কালকে ঝুমাও এই কথাই বলেছিল।

এবার আমি নড়ে চড়ে বসলাম। বিড় বিড় করে বললাম, কাকু এক্ষুনি তো আমি মোবাইল ফোন কিনতে পারব না।
কাকু আমায় পুরো কথা শেষ না করতে দিয়েই বলে উঠলেন, সে নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না। আমি তো এখন ব্ল্যাক বেরী ব্যবহার করি, আমার পুরোনো মোবাইলটা বাড়িতেই পড়ে আছে। কাল ওটা আমি তোমার জন্য নিয়ে আসব।
আমি তাকিয়ে রইলাম কাকুর দিকে। কি বলব, কি বলা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। কাকু বললেন, কাল তোমার ভোটার কার্ডটা নিয়ে এসো। নতুন সিম নিতে ওটা লাগবে। একটু থেমে আবার বললেন, যা বুঝলাম, তোমার আমার দুজনের একসাথে কারখানা ছেড়ে বেরোনো ঠিক হবে না। আমাদের একজনের থাকা জরুরী। কি বল?
আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কাকু বললেন, ভাগ্য ভালো কাল বড় কিছু হয়নি। আজ বিকেলে তুমি আমি গিয়ে হরি আর তপনকে দেখে আসব। কেমন? আমি আবার মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আমি যেন কেমন ঘোরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।
 
১৪

কলেজ ক্যান্টিনের চা টা মুখে দেওয়া যায়না। যাষ্ট গরম জল। কিন্তু চপটা দুরন্ত। কোনো কথা হবে না টাইপ। ওটার লোভেই ওরা এখানে আসে। গুলতানি তো আছেই। গুলতানি চলছে অনেকক্ষণ। আজকে মাইকটা
প্রধানতঃ সম্পার হাতেই। মূল বক্তা সেইই। সদ্য পুরী ঘুরে এসেছে। সেই পুরী ভ্রমন কথাই চলছে, বিস্তারিত বর্ণনা সহকারে।
দলটা নেহাত মন্দ নয়, আট দশ জনের। সে দলে রত্না ঝুমা তো আছেই, রাখী, আত্রেয়ী, স্বপ্না, কলাবতী ওরাও আছে। দারুন জমাটি আড্ডা চলছে। রঞ্জুর সমুদ্র স্নানের ভীতি, সরসে শোনালো
বন্ধুদের। কথায় কথায় তার বালির মূর্তি বানানো, ও তা নিয়ে রঞ্জু দা’র ক্ষ্যাপানো ও শেষে ঝালমুড়ি খাওয়ানো, সে গল্পও করল সম্পা।
রঞ্জু সম্পর্কে এত বিস্তারিত গল্প করার সম্পার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। এ কথাগুলি বলতে বলতে সে বার বার আড় চোখে ঝুমার মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। কিন্তু যে অভিব্যাক্তি, যে উৎসাহ সে দেখবে আশা
করেছিল, তা দেখতে না পেয়ে অবাকই হল সে।
ঝুমা সম্পার কথা শুনছিল ঠিকই, হাসছিল ঠিকই, কিন্তু বেশী মনোযোগী ছিল তার মোবাইল ফোনের প্রতি। এসব আড্ডার মধ্যেই সে যে তার ফোন মারফৎ বার্তা বিনিময় করে যাচ্ছে, তা কারো বুঝতে
অসুবিধে হয় না।
হঠাৎই ঝুমা বলে, এই এবার আমায় উঠতে হবে রে। আমি আসি। বলেই ঝুমা গেটের দিকে এগোতে থাকে।
সম্পা আর ঝুমা এক সাথেই ফিরবে কথা ছিল। অবাক হয়ে সে বলে, দাঁড়া আমিও তো যাব।
ঝুমা না থেমে হাঁটতে হাঁটতেই বলে, আমি এখন বাড়ি যাব না রে।
সম্পা অবাক হয়ে বলে, বাড়ি যাবি না তো কথায় চললি?
ঝুমা এবার ঘুরে দাঁড়ায়, সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে বলে, আজ অনুপম ওর বাইক ডেলিভারি নেবে। আমরা লং ড্রাইভে যেতে পারি।
আর অপেক্ষা করে না সে, সারা মুখে আনন্দ মেখে দ্রুত গেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ সম্পা। তার কপালে ভাঁজ প্রকট হয়। তারপর সে রত্নার দিকে ঘুরে তাকায়। চোখাচুখি হতেই চোখ নামিয়ে নেয় রত্না।
ছন্দ কেটে গেছে এর পরে আর আড্ডাটা জমে না। ভীড় পাতলা হয়ে যায়। বাইরের গেটের দিকে ধীর পায়ে এগোতে তাকে সম্পা আর রত্না। দুজনেই চুপ, গম্ভীর। হঠাৎ সম্পা বলে, অনুপম কে?
রত্না দাঁড়িয়ে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে সম্পাও। দুজনে মুখোমুখি।
১৫

ট্রাম লাইন বরাবর অনন্ত যানবাহনের স্রোত। ট্রাম রাস্তার এপারের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছি আমি। ওপারে কলেজ গেটের থেকে মেয়েরা বেড়িয়ে এসে যে যার গন্তব্যের দিকে চলে যাচ্ছে। সকলের চোখ মুখ এত
উজ্জ্বল, এত প্রাণবন্ত। উচ্চকিত কন্ঠে কথা বলা, হাসি, মনে হচ্ছে একেকটা রঙের ঝরনা হয়ে বয়ে চলেছে।
আমার হাতের মুঠোয় ধরা আজ সকালে পাওয়া বিনয় কাকুর মোবাইল ফোনটা। উত্তেজনায় হাতের তেলো ঘেমে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে হাত বদল করে, জিনসে হাত মুছে নিচ্ছি। ঝুমাকে ফোনটা দেখিয়ে সারপ্রাইজ
দিতেই আসা। ফোনটা প্রথম হাতে পেয়ে ঝুমার মুখটাই মনে পড়েছিল। তক্ষুনি ভেবেওছিলাম প্রথম ফোনটা ওকেই করি, করে ওকে চমকে দিই।
এই ফোনটার সব কিছু এখনও শিখে ওঠা হয়নি। নম্বরটা ডায়াল করে সবুজ বাটনটা টিপলেই কল হয়ে যায়, লাল বাটনটা টিপলে তার সমাপ্তি ঘটে, এটুকু শিখিয়ে দিয়েছেন বিনয় কাকু। আর শিখিয়েছেন
ফোনটা বেজে উঠলে, সবুজ বাটন টিপে কথা বলতে হয়।
আর বলেছিলেন, এই ফোনটা সম্পা কিছুদিন ব্যবহার করেছে। তুমি ওর কাছে ডিটেল জেনে নিতে পারো। আসলে এর বুকলেটটা কোথায় রেখেছি, এখুনি খুঁজে পাচ্ছি না। পেলে তোমায় দিয়ে দেব।
অনেক মেয়েই কলেজের গেট পেরিয়ে বেরিয়ে আসছে। ঝুমার দেখা নেই। কিন্তু ঝুমার কি দোষ, ও তো জানে না, আমি এখানে ওর অপেক্ষাতে আছি। একবার ফোনটা তুলে নিয়ে ভাবলাম, ওকে কল করেই
ফেলি। অবশ্য অত বড় নম্বর আমার মুখস্ত নেই। নম্বর সেভ করা শিখিনিতো। দেখি আরো কিছুক্ষণ।
রাস্তার ওপারে গেটের একটু দূরে, একটি মোটর বাইক এসে দাঁড়ালো। সহজেই সবার দৃষ্টি যাবে সেদিকে। মনে হয় এক্ষুনি শো রুম থেকে নিয়ে এলো। উজ্জ্বল রোদে, আরো যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বেশ
এট্রাক্টিভ বাইকটা।
আরোহী তার ঢাউস হেলমেটটা মাথা থেকে খুলে তার কোলের ওপর রাখলো। মাথায় হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করে নিল সে। নাকের ওপর ঝুলে পড়া কালো রোদ চশমাটা, এক আঙুলে ঠেলে ঠিক জায়গায় করে
দিল সে।
কিছুটা মগ্ন হয়ে ছিলাম, ওই বাইক এবং তার আরোহীতে। এবার আমার চোখ কলেজ গেটের দিকে ঘোরাতেই দেখি, দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসছে ঝুমা। আমি কিছুক্ষনের জন্য স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। যতবার
ঝুমাকে দেখি, নতুন করে দেখছি মনে হয়। আমি দ্রুত, ঝুমা দেখার আগেই ফোনটা জিনসের পকেটে চালান করে দিলাম।
হাত উঁচু করে ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি, ঝুমা আমার দিকে দেখছেই না। ও এগিয়ে গেল ওই নতুন বাইক আরোহীর দিকে। দুজনে খুব হাসছে। হাসতে হাসতেই ওদের কিছু কথা বিনিময় হল। শোনার উপায়
নেই, মাঝে তো যানবাহনের স্রোত। ছেলেটি ঝুমার দিকে এগিয়ে দিল একটি হেলমেট। আমি একবার ঝুমার নাম ধরে ডাকার চেষ্টা করলাম। কতটা স্বর শোনা গেল জানিনা। দুজনের মুখ ঢেকে গেল হেলমেটে।
ঝকঝকে মোটর বাইকটা বিদ্রুপ গর্জন করে আমার সামনে দিয়ে দূরের যানবাহনের মধ্যে হারিয়ে গেল।
কে এই বাইক আরোহী? আমাকে ঝুমা খেয়ালই করল না? আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ ভীষণ খালি হয়ে গেল। আমার চোখ দুটো জ্বালা করছে। যানবাহনের ধোঁয়ায় নাকি অন্য কিছু জানি না। মাথাটা কি
দুলছে? ফুটপাথ ফুঁড়ে ওঠা গাছটার গুঁড়িতে হাত রেখে দাঁড়ালাম আমি। কি করব বুঝতে পারছি না।
আমি হয়তো অকারণ এত বিচলিত হচ্ছি। ওই বাইক আরোহী হয়তো ঝুমার আত্মীয়। কোনো দরকারে আজ ওকে চলে যেতে হল। আমি না হয় কাল এসে ওকে মোবাইলটা দেখিয়ে যাব। ও তো জানত না আমি
এভাবে আসব।
এই সব ভাবতে ভাবতে ফেরার পথে এগোতে যাব, পকেটের মধ্যে আমার নতুন মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। আমি কি করব বুঝতে আমার একটু সময় লাগল। অবশেষে ফোনটা পকেটের বাইরে এনে সবুজ
বাটন টিপে, মৃদু কন্ঠে সাড়া দিলাম।
ওপারে শোনা গেল সম্পার কন্ঠ, রঞ্জু দা।
- হ্যাঁ বল।
- এখানে কি করছ?
- এখানে মানে? তুই কোথায়?
- তোমার বাঁ দিকে ঘোরো, এবার সোজা তাকাও, রাস্তার এপারে, কলেজের সামনে...
দেখি, কলেজ গেটের কাছে, কানে ফোন, সম্পা দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। আমাদের মাঝে যানবাহনের স্রোত।
- কি নতুন ফোন কেমন চলছে?
- এই তো তোর ফোন প্রথম এলো।
- তাই? তোমায় মেসেজ পাঠিয়েছিলাম, উত্তর দিলে না তো?
- তাই বুঝি, আমি তো এর নিয়ম কানুন কিছুই জানিনা। আমায় শিখিয়ে দিবি?
চুপ করে আছে সম্পা। তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমাদের মাঝে সেই যানবাহনের স্রোত। খুব গভীর স্বরে সম্পা বলল, আমার ওপর ভরসা আছে তোমার।
এমনভাবে আমায় কখনও কিছু বলেনি সম্পা। এবার আমি চুপ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। কি বলব ভাবছি। মনে পড়ে গেল পুরীর হোটেলের বারান্দায় সেই জোছনার আলোয় দেখা সম্পার চোখ দুটো। যেন
অনেক কথা বলার আছে ওর।
সম্পা আবার বলে, কি হল বললে না, আমার ওপর ভরসা আছে তোমার?
- আছে।
মৃদু মাথা নাড়ল সম্পা, বলল, রঞ্জু দা, তোমায় অনেক কিছু শিখিয়ে দেব আজ।
তারপর ফোন নামিয়ে নিল কান থেকে। আমিও ফোন বন্ধ করলাম। স্থির তাকিয়ে আছি সম্পার দিকে। এগিয়ে এসে ফুটপাথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে দাঁড়াল সে। আমিও
এগিয়ে গেলাম কিছুটা। দুজনের মাঝখানে তখন যানবাহনের স্রোত।

শেষ


© লেখক