কবি; এই অভিধাটি ভালো লাগে
আমার। উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, এসবের মধ্যে কবি অভিধাটি বিশেষ
ভাবে ভালো লাগে আমার। আমি কবিতা লিখি বলেই নয়। যদিও আমার কবিতা লেখার বয়স খুব
বেশী নয়। চার বছর মাস দুয়েক বড়জোড়। বাঙলা দেশে নাকি কবি আর কবিতার অভাব নেই। কবি
আর কবিতার উর্বরভূমি এই দেশ। এখানে একসময় সকলেই কবি। মানে কবিতা লেখে। শুনেছি
অনেকেই জীবনের প্রথম কবিতাটি নাকি লিখেছে প্রেমে পড়ে; অথবা প্রেম থেকে পড়ে।
আমার অনেক নিকট বন্ধুরাও একসময় কবিতা লিখতো। দেখতাম তারা প্রতিদিন নতুন নতুন
কবিতা নিয়ে হাজির। স্বাধীনতা, স্বদেশ, মা, বাবা, বিধাতার গুনগানে ভরে থাকতো
কবিতা নামক সেইসব অবয়বের পংক্তিগুলো। স্কুল বয়সেই আমার বন্ধুরা কবি হয়ে উঠেছিল।
আমার(আমাদের) এক বন্ধু আমাদের সকলকে ভীষণ লজ্জায় রেখে নাইনের বছরই প্রেম করার
কৃতিত্ব অর্জন করেছিল। এবং একই সাথে রাতারাতি
রূপান্তরিত হয়েছিল কবিতে। তার
থরোথারো কবিতা দিয়েই নাকি সে জয় করেছিল তার নারীকে। তখন কবিতা লিখতে ইচ্ছে করতো
খুব। আক্ষেপ হতো-
কেন যে কবিতা লিখতে পারি না।
আমার খুব মনে আছে, ক্লাশ নাইনের বছর আমার এক বন্ধুর তাতক্ষনিক কবিতা লেখা দেখে
দারুন মুগ্ধ হয়েছিলাম আমি; তাকে
রীতিমতো রবীন্দ্র-নজরুলের সমবর্তি বলে মনে হতো
তখন। তার হাঁটার স্টাইল, তার তাকানোর ভঙ্গি খুব অন্যরকম মনে হতো। একটা সময়ে এসে
দেখলাম আমার অধিকাংশ বন্ধুই কবিতা লেখে। শুধু আমি ছাড়া। আমি ছিলাম পাঠক;
কেবলমাত্র পাঠক। আমার বন্ধুদের সঙগে চলাফেরা করতাম গর্বিত ভঙ্গিতে।
কিন্তু আমি পারিনি। কবিতা আমি লিখতে পারিনি। আমার বন্ধুরা যখন কবিতার পর কবিতা
লিখে বান্ধবীদের বাহবা কুড়াচ্ছিল; আমি তখন পরাজয়ের
গ্লানির জ্বালা নিয়ে মুখস্থ
করতাম পর্যায়
সারণির মৌল সমূহের নাম; অথবা স্কেলার আর ভেক্টর রাশির সংজ্ঞা
খুঁজতাম। এমন কি ইন্টারমিডিয়েটে যে সুন্দরী বন্ধবীর জন্য ক্লাশ ফাঁকি দিয়েছি
দিনের পর দিন, তার কথা ভেবে তার উদ্দেশ্যেও কোন পংক্তি আসে নি মনে।
বেদনা নাকি শিল্প সৃষ্টির প্রবেশ মুখ। তখন আমি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
প্রথম বর্ষ পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে- অপ্রত্যাশিত ভাবে রেজাল্ট খারাপ হলো।
বেশ খারাপ। সেকেন্ড ক্লাশ টেকে না। রাতে ঘুম হতো না। হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যেতো।
বিশেষ করে ভোরে। ইম্প্রুভমেন্ট দিতে হবে। এদিকে নাকের ডগায় দ্বিতীয় বর্ষের
ফাইনাল। সবচেয়ে বড় কথা ইমেজগত সমস্যা। ততটা খাপরাপ ছাত্র ছিলাম না কখনই। কিন্তু
রেজাল্ট ভালো ছাত্রের
প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক এরকম একটা সময়ে আমার
প্রথম কবিতা লেখা। ২০০৪ সাল; রাত ১২টারও কিছু বেশী। সঞ্চয়িতা পড়ছি।
অতীত কবিতাটি, কথা কও, কথা কও,/ অনাদি অতীত , অনন্ত রাতে কেন বসে
চেয়ে রও... । তখনই হঠাৎ অনিবার্য পরিণতির মতোন মাথায় আসল আমার জীবনের
প্রথম পংক্তি, হে, অতীত, তুই আয় ফিরে। এরপর নিয়তির মতো লিখতে শুরু
করলাম, ঐ অন্ধকারের বুক চিরে,/ নিয়ে সেই লেনিন, কামাল আর আনোয়ার...।
পলকেই লিখে ফেললাম জীবনের প্রথম লেখা; লেখা বলছি এই
কারণে এটি আসলে কবিতা ছিলনা।
ফসকে যাওয়া কয়েকটা লাইন মাত্র, রবীন্দ্রনাথের কবিতারই প্রেরণাজাত পংক্তি। এটির
নাম দিয়েছিলাম হে অতীত। এখন অবশ্য এটি আমার সংগ্রহেও নেই। তার
পর অনেক লিখেছি পদ্য। যেগুলো দেখে আমি নিজেই লজ্জা পাই। নিছক অনুকরণ ওগুলো। সেই
থেকে আমার যাত্রা শুরু; কবিতার সঙ্গে সহবাস। আজ অবধি।
আমি যখন কবিতা লেখা শুরু
করি, তখন
দেখলাম আমার কবি বন্ধুরা- যারা এতদিন কবিতার পর
কবিতা লিখে আমাকে অভিভূত করে দিত-
ওরা ধীরে ধীরে কবিতা লেখা ছেড়ে দিচ্ছে। কবিতায়
তারা আর আনন্দ পায় না। তাদের নাকি আর কবিতা আসে না। তারা যে বয়সে এসে সমাপ্তি
টানলো, সেই বয়সে আমি শুরু করেছিলাম কবিতার সঙ্গে আমার গেরস্থালি। আমি অবশ্য
আনন্দ লাভের উদ্দেশ্যে কবিতা লিখিনি। যদিও কবিতা লিখে আমি অসহনীয় আনন্দ পাই।
মূলত পংক্তির
তাড়নায়-ই আমি কবিতা লিখি। বিভিন্ন সময় আমার মধ্যে অসংখ্য বিচ্ছিন্ন
পংক্তির সৃষ্টি হয়। যন্ত্রনার মতো মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়। এইভাবে চলতে থাকে
কিছুদিন। এর মধ্যে অনেক পংক্তিই চলে যায়। কিন্তু কিছু কিছু অবাধ্য পংক্তি
চিন্তার
মধ্যে থেকে যায়। তখন আর উপায় থাকেনা। এই পংক্তি দিয়েই শুরু হয় জাল বোনা। শুরু হয়
অংক: বীজগণিত, জ্যামিতি। শুরু হয় অমোঘ এক খেলা।
সেই খেলা খেলে চলছি আজ অবধি। পাঠকপ্রিয়তার মধ্যে কখনই সার্থকতা খুঁজিনি। যদিও
পাঠকের প্রশংসা বাক্যে ভীষণ আন্দোলিত হই। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েও কবিতা লিখিনা।
কেবল মাত্র কবিতা লেখার আয়োজনেই কবিতা লিখি, যার দুএকটা কারো কারো ভালো লাগে,
অধিকাংশই লাগে না; তবু লিখি। লেখার আনন্দে লিখি। সৃষ্টির বেদনায় লিখি। এবং লিখবো।
প্রণব
আচার্য্য
নভেম্বর ১৪, ২০০৮