গুগল কথন   

রাগিব হাসান

ragibhasan@gmail.com                                                                                              http://www.ragibhasan.com

 

ব্রিন আর পেইজের কথা

সের্গেই ব্রিন আর ল্যারি পেইজ গুগলের প্রতিষ্ঠাতা দুই টগবগে তরুণ তাঁদের পরিচয় হয় স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞানে পিএইচডি করার সময়, আর সময়েই দুজনে মিলে পেইজর‌্যাংক নামের একটি অ্যালগরিদম লিখেন পেইজর‌্যাংকের মূল লক্ষ্য ছিলো ইন্টারনেটের ওয়েবপেইজগুলোর সম্পর্ক বের করা, কোনো পেইজের গুরুত্ব বের করে অনুযায়ী একটা ক্রম বের করা ব্যাস, এই পেইজর‌্যাংক অ্যালগরিদমটিই সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের সূচনা করে দেয় আগের সার্চ ইঞ্জিনগুলো কোন কোন ওয়েবপেইজে অনুসন্ধিত শব্দগুলো আছে, তা বের করতে পারতো, কিন্তু ওয়েবপেইজগুলোর র‌্যাংকিং ভালো ভাবে করতে পারতোনা বলে সার্চের ফলাফল ভালো আসতোনা

সার্চ ইঞ্জিন হিসাবে গুগলের মান অনেক ভালো, এটা বোঝার পরে ব্রিন আর পেইজ গুগলকে একটা স্টার্ট-আপ কোম্পানি হিসাবে শুরু করেন ১৯৯৮ সালে সিলিকন ভ্যালির অন্য অনেক নামজাদা কোম্পানির মতোই গুগলের যাত্রা শুরু হয় একটা গ্যারেজে, কিছু কম্পিউটার সার্ভার নিয়ে গুটি কয়েক প্রোগ্রামার নিয়ে শুরু করা সেই গুগল আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে মূল্যায়িত এক মহীরূহে পরিণত হয়েছে

কিন্তু, ব্রিন আর পেইজকে দেখে তা বোঝার উপায় নেই এখনও দুজনে মাটির মানুষ, ভাবভঙ্গীতে সেই পিএইচডি করতে থাকা গ্র্যাজুয়েট স্কুলের ছাত্রের মতো গুগলে ইন্টার্নশীপ পাওয়ার সময় ভেবেছিলাম, পুরা গুগলের সবার বস ব্রিন, পেইজ, এবং গুগলের সিইও এরিক স্মিড্‌টকে আদৌ চোখে দেখতে পাবো কি না বাংলাদেশে অন্য কারো কথা বাদ থাক, বুয়েটের শিক্ষকতা করার সময়েও বুয়েটের ভিসির সাথে দেখা করতে এক দিন ঘন্টা পাঁচেক বসে থাকতে হয়েছিলো কোম্পানিগুলোর কথা তো বাদই দিলাম ... কোনো কোম্পানিতে সদ্য যোগ দেয়া কেউ কি আশা করতে পারে, কোম্পানির মালিকের সাথে সরাসরি কথা বলা বা বেফাঁস প্রশ্ন করা যাবে?

প্রথম দিনেই ধারণাটা পালটে গেলো, ব্রিন আর পেইজকে দেখে প্রতি শুক্রবার গুগলে এক বিশাল পার্টি হয় টিজিআইএফ, অর্থাৎ থ্যাংক গড ইটস ফ্রাইডে হলো এই পার্টির নাম আসলে সোমবার থেকে কাজ শুরু হয়ে শুক্রবার আসতে আসতে মানুষের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, কাজের চাপে মাথা গরম হয়ে থাকে শুক্রবার আসলে আসন্ন দুই দিনের উইকেন্ড বা সপ্তাহান্তের ছুটির আনন্দে শুকরিয়া করে ... তাই থেকেই এই মিটিংটার নাম হয়েছে যাহোক, এই মিটিং এর মোদ্দা কথা হলো, গুগলের বিশাল ক্যাফেটাতে হাজার কয়েক গুগল ইঞ্জিনিয়ার অন্যান্য কর্মী জড়ো হবে, বিশাল একটা খাওয়া দাওয়া চলবে, আর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ব্রিন আর পেইজ গল্প গুজব করবে

ওখানে হাজির তো অবাক দেশে থাকতে দেখতাম, কোনো কোম্পানির বড়সাহেব, এমন কি সরকারী কোনো অফিসের জিএম সাহেবের বিশাল ভাব, আর আশে পাশে চামচার দল, অনেক সময় সিকিউরিটির লোকজনের হুমকি ধামকি সে তুলনায় দুনিয়ার বিলিয়নিয়ারদের তালিকায় ২৬ তম স্থানে থাকা ব্রিন পেইজকে (প্রত্যেকের সম্পত্তির পরিমাণ ১৬ বিলিয়ন ডলার করে) দেখে বোঝারই উপায় নেই, ওরাই এই কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা এবং অধিকাংশ শেয়ারের মালিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রতি শুক্রবার ওরা প্রথমে এই সপ্তাহে কি কি প্রডাক্ট গুগল ছাড়ছে, তার কথা বলে খানিক ক্ষণ অনেক প্রডাক্ট, যেমন স্ট্রিট ভিউ, মার্কেটে আসার আগেই ভিতরের সবাইকে জানানো হয় এর ফাঁকে ফাঁকে ব্রিন পেইজের ভাড়ামি চলতে থাকে, অনেকটা "ইত্যাদি" অনুষ্ঠানের মতো করে দুইজন নানা রকমের রসিকতা করতে থাকে ব্রিনের জন্ম শৈশব কেটেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের কড়া সমাজতন্ত্রী শাসনে, সেটা নিয়ে ওকে পেইজ প্রায়ই ঠাট্টা করে ব্রিনও কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে হাঁসাতে পারে ভালোই

এর পরেই শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব এই পর্বে গুগলের কর্মীরা সরাসরি, বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রশ্ন করতে পারে ব্রিন, পেইজ, এবং এরিককে আর এই পুরো ব্যাপারটাই খুব [ইংলিশ]transparent[/ইংলিশ], যে কোনো ধরণের প্রশ্ন যে কেউ নির্ভয়ে বলতে পারে এমন কি গুগলের কোনো একটা পদক্ষেপ খুব বাজে এবং নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, এরকম প্রশ্ন করতেও কোনো বাঁধা নেই আমি যে কয়দিন এই অনুষ্ঠানে গিয়েছি, দেখেছি গুগলের কর্মীরা প্রত্যেক দিনই এরকম প্রশ্ন করছেন যেমন, গুগল ভিডিও বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত কেনো নেয়া হলো, কেনো ইবে কে গুগল খেপিয়ে দিলো, এরকম অনেক প্রশ্ন এমন, যেন ব্রিন পেইজকে রীতিমত জবাবদিহি করতে বলার মতো ভাবতে পারেন, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানির মালিকদের এরকম প্রশ্ন করা হচ্ছে, আর প্রশ্ন করছে একেবারে নতুন কর্মীরা? গুগলের চমৎকার পরিবেশে আসলে এটাই খুব স্বাভাবিক

ব্রিন আর পেইজকে প্রশ্ন করার সুযোগ আমিও হাতছাড়া করিনি অনলাইনে যে প্রশ্ন করার ব্যবস্থা আছে, তাতে শুক্রবার সকাল বেলা প্রশ্ন দিলে বিকাল নাগাদ ভোটাভুটিতে যে প্রশ্ন টিকে যায়, সেটাই করা হয় বেশ কয়েক সপ্তাহ চেষ্টা করে আমার প্রশ্নটা একদিন প্রথম ১০টি প্রশ্নের মধ্যে আসলো আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলাদেশের দিকে গুগলের নজর কবে পড়বে, আর গুগল যেসব ভাষাকে প্রাধান্য দেয়, তাদের মধ্যে ২৫ কোটি লোকের মুখের ভাষা বাংলা কবে আসবে

প্রশ্নের জবাব সের্গেই ব্রিন খুব আগ্রহের সাথেই দিলো বললো, গুরুত্ব দেয়ার ব্যাপারটা অনেকটা অর্থনীতি ভিত্তিক বাংলাদেশে কয়েক কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে, তাই অচিরেই দিকে গুগল চিন্তা করবে, মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের জন্য কাজ করবে আরেকটা ব্যাপার হলো, বাংলা ভাষায় ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কেমন, সেটা দেখতে হবে ... বাংলাদেশ থেকে যত মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের কতজন বাংলায় গুগল সার্চ করেন, ইংরেজি গুগলের বদলে, তাও বিবেচ্য এসব কিছু বিবেচনা করে অচিরেই গুগল বাংলার উপরে কাজ শুরু করবে

ব্রিন অবশ্য সিরিয়াস কমই থাকে, আগেই বলেছি ব্যাগি প্যান্ট আর টি শার্ট পরা ব্রিনকে দেখলে মনে হয়, ইউনিভার্সিটির ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসেছে এই মাত্র পেইজকেও তাই আর গুগলের প্রতিষ্ঠাতা হলেও চামচা বাহিনী নিয়ে ঘুরবে, বা তাঁদের ঘিরে বডিগার্ডের দল থাকবে, তা না একদিন মজার ব্যাপার হলো, আমি সেদিন গিয়েছি বিল্ডিং ৪৩ এর নো-নেইম ক্যাফেতে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে হলো, সামনের লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই টের পেলাম, এটা সের্গেই ব্রিন মনে হলো, ভলিবল কোর্টে অন্য কর্মীদের সাথে খেলে এসে এখন খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, অন্য সব সাধারণ গুগল কর্মীদের সাথে

সিলিকন ভ্যালির সবাই বেশ ইনফর্মাল, তবে গুগলের মতো এতোটা না ব্রিন আর পেইজের মতো মাটির কাছে থাকা মানুষদের দেখলে বোঝা যায়, কেনো গুগলের অন্য কর্মীরা এতো উৎসাহের সাথে কাজ করে থাকে আর এজন্যেই কাজ করার জায়গা হিসাবে ফর্বস ম্যাগাজিনের জরীপে সব কোম্পানিকে পেছনে ফেলে গুগল এখন নাম্বারে
 


(
ছবিতে বামে সের্গেই ব্রিন, ডানে ল্যারি পেইজ ছবিটি ২০০৬ সালের গুগল জিও ডেভেলপার ডে তে ডেভিড ম্যাক্লুরের তোলা, এবং ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্সে প্রদত্ত্ব)

 

 

গুগল কথন

কর্মীরা যেখানে রাজা

 

গুগলের কর্মীদের সাথে কাজ করতে করতে অল্প দিন পরেই যেটা লক্ষ্য করি, সবাই প্রচন্ড কাজ পাগল দিনে ঘন্টা কাজ করার জন্য গুগল পয়সা দেয় কিন্তু গুগলের কর্মীরা অফিসে থাকে আরও অনেক বেশি সময় কাজে আসার ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা সময় নেই, যে যার মতো সময়ে আসতে পারে অফিসে প্রথম দিনেই আমার বসকে প্রশ্ন করেছিলাম, কয়টার সময় আসতে হবে রিচার্ড (আমার বস) বললো, তোমার যখন ইচ্ছা তখনই আসতে পারো রিচার্ড আসতো সকাল নয়টার সময়, আর যেতো বিকাল ছয়টায় আমি অবশ্য নয়টায় আসতামনা প্রতিদিন, যেতাম সাড়ে নয়টা বা দশটায়, আর বেরুতাম অফিস থেকে সাড়ে ছয়টা বা সাতটার দিকে আমাদের গ্রুপের অন্য সদস্য ব্রায়ান এগারোটার দিকে এসে থাকতো রাত নয়টা সাড়ে নয়টা পর্যন্ত

কাজে ডুবে থাকার এই সাধারণ প্রবণতাটার পেছনে কারণটা কি, বুঝতে শুরু করলাম কয়েক দিন পর থেকেই সিলিকন ভ্যালিতে কাজ পাগল মানুষদের কষ্টের ফসল হিসাবে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, কিন্তু তাদের মধ্যেও গুগলের কর্মীদের অফিসে পড়ে থাকার আপ্রাণ চেষ্টাটা বেশি আসলে এর পেছনের সবচেয়ে বড় কারণ হলো অফিসের পরিবেশটাকে অসাধারণ করে রাখা

শুরুতেই বলা যায় অফিস তার আসেপাশের স্থাপনা আমার অফিসটার পাশে ল্যান্ডস্কেপিং করে ফোয়ারা, জলপ্রপাত, আর মিনি সাইজের লেক বানানো ফুলের বাগানে গুগলের লোগোতে ব্যবহৃত মৌলিক বর্ণের নানা ফুল সাজানো আছে বিচিত্র নকশায় প্রথমবার গেলে পার্ক বলে ভ্রম হতে পারে


অফিসের ভেতরে আবার খাবারের ছড়াছড়ি আগেই বলেছিলাম একবার, অফিসের প্রতি ১৫০ ফুট পর পর একটা মাইক্রোকিচেন রয়েছে এর মানে হলো, দুই তিনটা বিশাল ফ্রিজে ভর্তি রয়েছে খাবার থরে থরে - স্যান্ডউইচ, চকলেট, কম করে হলেও ১০-১৫ রকমের ফলের রস, ডাবের পানি, কোক/পেপসির ক্যান, স্পেশাল মিনারেল ওয়াটার, আর এনার্জি ড্রিংক পাশের টেবিলে বাদাম, চিপস, ফল, বীফ জার্কি (মাংশের শুটকি), এরকম অনেক কিছু আর কফি তো আছেই সবই ফ্রি - যার যখন ইচ্ছা এসে খেয়ে যাচ্ছে, বা দু-হাত ভর্তি করে অফিসে নিয়ে যাচ্ছে ভুরি-ভোজনের জন্য


এতো গেলো কেবল মাইক্রোকিচেনের কথা প্রতিটা অফিস ভবনেই রয়েছে একটা করে ক্যাফে পুরো গুগলপ্লেক্স এলাকাতে ভবন ১৬টা, তার মানে বুঝতেই পারছেন, ক্যাফের সংখ্যাও ১৬ আর ক্যাফেগুলো মোটেও গতানুগতিক নয়, একেকটা ক্যাফে একেকটা ধাঁচে সাজানো যেমন আমার অফিসের ক্যাফের নাম "অফ দা গ্রিড", ওখানে একটু অন্য রকমের বিচিত্র প্রকারের খাবার দিতো নিজের ইচ্ছে মতো সালাদ বানিয়ে নেয়া, সব্জ্বীর নানা রান্না, আর মাংশের কিছু আইটেম প্রায় দিনেই অদ্ভুত সব খাবার আসতো, যেমন ক্যাঙ্গারুর বার্গার, হরিণের মাংসের কাবাব, এরকম সপ্তাহে একদিন বারবিকিউ হতো বাইরে, যে লেক আর জলপ্রপাতের কথা বলেছি, তার পাশে চাদর বসিয়ে পিকনিকের মতো করে খাওয়া চলতো আর সকালে প্রতিদিন থাকতো ডিমভাজি সহ নানা রকমের নাস্তা, বিকেল ৩টার সময় আবার বিকালের নাস্তা দিয়ে পেট পুজার ব্যবস্থা থাকতো

পাশের ভবনেই ফাইভ নামের ক্যাফে, প্রতিটা খাবারে ঠিক ৫টা করে উপাদান দিয়ে তৈরী আরেকটা ক্যাফে ছিলো ইউরোপীয় খাবারের আরেকটা (প্যাসিফিক ক্যাফে) হলো চীনা, জাপানি সুশি অন্যান্য খাবারের বিল্ডিং ৪৪এর ক্যাফেটা ছিলো স্লাইস - ওখানে রয়েছে দুর্দান্ত ফলের রস আর স্মুদি (লাসসি টাইপের)

তবে সব কিচ্ছুকে ছাড়িয়ে যায় গুগলপ্লেক্সের কেন্দ্রস্থলের "চার্লিজ ক্যাফে" গুগলের প্রথম শেফ ছিলো চার্লি, তবে বেতনের বদলে শুরুতে গুগলের শেয়ার পেতো বলে চার্লি এখন মিলিয়নিয়ার হয়ে রিটায়ার করেছে, তার নামেই এখন রয়ে গেছে ক্যাফেটা বিশাল ফুটবল মাঠের সাইজের ক্যাফেতে ৫টা সাবক্যাফে ছিলো - নমস্তে হলো ভারতীয় খাবারের, পাশেরটা জাপানী খাবার আর ইতালীয় খাবারের ক্যাফে, তার সামনেরটা "ইস্ট মীটস ওয়েস্ট" অর্থাৎ ফিউশন ধাঁচের এছাড়াও ছিলো মেক্সিকান খাবার আর গতানুগতিক মার্কিন/ইউরোপীয় খাবারের দুটো সাব ক্যাফে এগুলোতে প্রতিদিন দুপুর আর সন্ধ্যাতে ভীড় হতো প্রচন্ড পুরোটা অবশ্য প্রচন্ড সুশৃংখল, সবাই ট্রে নিয়ে লাইন বেঁধে খাবার নিয়ে টেবিলে, অথবা বাইরের মাঠে বসানো পিকনিক টেবিলে চলে যায় প্রতিদিন কম করে হলেও হাজার চারেক কর্মী এখানে খেয়ে থাকে ভারতীয় বা চীনারাতো মনে হয় বিকেল বেলাতে পুরো পরিবারের বাপ, মা, বাচ্চা কাচ্চা সহ গোটা দশেক লোক সাথে নিয়ে আসে উল্লেখ্য, প্রত্যেকেই অতিথি নিয়ে আসতে পারে, কোনো বাঁধা নেই আর খাওয়া যে ফ্রি, তা তো আগেই বলেছি

গুগলের এই খাওয়ার অঢেল ব্যবস্থার কারণে নতুন আসা গুগল কর্মীরা হাপুস হুপুস করে খেতে থাকে, নিজের চোখে দেখা "গুগল ফিফটিন" বলে কথা চালু আছে, গুগলে ঢোকার প্রথম দুই সপ্তাহে নাকি কর্মীদের ওজন বাড়ে ১৫ পাউন্ড অন্তত

শুধু কি খাওয়াই মূল আকর্ষণ? মনে হয় না, কারণ গুগলের অন্যান্য ব্যবস্থাও চমৎকার চুল কাটা দরকার? কোন সমস্যা নেই, গুগলের চুল কাটার মিনিবাস আছে একটা, সারা দিন অফিসে অফিসে ঘুরতে থাকে, জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পেলেই নেমে গিয়ে চুল কেটে ফেলা যায় গাড়ির অয়েল চেইঞ্জেরও ব্যবস্থা আছে আর রাজভোগ খেয়ে ওজন বাড়লে ভুড়ি কমানোর জন্য রয়েছে জিম বাচ্চাদের রাখার জন্য নার্সারি ডাক্তার, ডেন্টিস্ট আর কাজ করতে করতে অবসন্ন বোধ করলে ম্যাসেজ করার জন্য অটোম্যাটিক চেয়ার ম্যাসাজ, বা এক ঘন্টার টেবিল ম্যাসাজের ব্যবস্থাও রয়েছে আর যাতায়াতের জন্যও অনেক ব্যবস্থা -- নিজের গাড়ি না থাকলে বা প্রতিদিন ড্রাইভ করতে ইচ্ছা না হলে গুগলের শাটল গিয়ে নিয়ে আসবে, এমনকি ৪০ মাইল দূরের সান ফ্রান্সিস্কো থেকেও অনেকে গুগলের বাসে করে আসে আর গুগলের ইলেকট্রিক গাড়িও অনেক কর্মীকে দেয়া হয়, চালাবার জন্য

আর সব সময় কাজ করা? তা নয় মোটেও, বরং খেলাধুলার ব্যবস্থা রয়েছে বিস্তর ক্যাফের পাশেই ভলিবল কোর্ট, আর টেনিস খেলা, সাঁতার কাটা, কৃত্রিম স্রোতে সার্ফিং এর ব্যবস্থা, এসব তো রয়েছেই কিন্তু তার চেয়েও ইন্টারেস্টিং হলো ভিডিও গেইমের কালেকশান, বাংলাদেশে আমরা যেমন খেলতাম কয়েন অপারেটেড মেশিন, সেরকম মেশিন সাজানো আছে আমার অফিসের এক কোনাতে একটা বড় স্ক্রিন পেয়ে তো একজন দেখি রীতিমত ভিডিও গেইম কর্নার বানিয়ে ফেলেছিলো, উইই, পিএসপি, আর অন্য সব মেশিন দিয়ে


সিলিকন ভ্যালির অন্যত্র অবশ্য এতোটা সুযোগ সুবিধা নেই আমার বন্ধু কেউ কেউ ইন্টেলে কাজ করেছে, ওদের ক্যাফেতে নাকি পানিটাও কিনে খেতে হতো গুগলের কর্মীরা থাকে রাজার হালে অবশ্য এর পেছনে গুগলের লাভটাও অনেক কর্মীদের এভাবে রাজার হালে রেখে রেখে অফিসে ধরে রাখাটা খুব সহজ হয়, সকাল থেকে এসে সবাই রাত করে ফিরে, মাঝের সময়টাতে পাগলের মতো কাজ করে চলে আর মনে ফুর্তি আনার মতো সব ব্যবস্থা আছে বলে সারাদিন চরম উৎসাহে, আগ্রহে তৈরী করে চলে অসাধারণ সব সফটওয়ার
 

    
(
ছবি, আমার অফিসের বাইরের অংশ, চার্লিজ ক্যাফের বাইরের বসার পিকনিক টেবিল, আর শেষে মাইক্রোকিচেনের কিয়দংশ)

 

গুগল কথন

প্রযুক্তির স্রোতে অবগাহন

 

গুগলপ্লেক্সের প্রধান ক্যাফেতে প্রতিদিন দুপুরে বা বিকেলে যেতাম ... ওখানকার রকমের বিভিন্নদেশী খাবারের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে এই ক্যাফেটার নাম "চার্লি' ক্যাফে" ... জানতে চেয়েছিলাম একদিন, চার্লিটা কে? জানলাম, চার্লি ছিলো গুগলের প্রথম বাবুর্চি যখন গুগলের মোট কর্মী সংখ্যা দশ বিশ জন, তখন যোগ দেয়া চার্লি বেতনের বদলে গুগলের কিছু শেয়ার পেয়েছিলো যখন স্টক মার্কেটে গুগল শেয়ার ছাড়লো বছর কয়েক আগে, ততদিনে সেই সব শেয়ারের দাম হয়েছে কয়েক মিলিয়ন ডলার সেই মিলিয়নিয়ার চার্লি আজ গুগল থেকে অবসর নিয়ে নিজের রেস্তোঁরা খুলতে পেরেছে, কিন্তু তার নাম রয়ে গেছে

গুগলে কাজের পালা শেষ হয় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি তিনটা চমৎকার মাস সেখানে কাটাবার পর বুঝতে চেষ্টা করলাম, কেনো গুগল এতো প্রচন্ড সফল হয়েছে দুনিয়ার সেরা সব প্রোগ্রামারদের আকর্ষণ করতে শুধু তিনবেলা মজাদার খাবার নিশ্চয় এর কারণ না ... অথবা গুগলের মহামূল্যবান শেয়ার/স্টকও প্রধান কারণ হতে পারে না সিলিকন ভ্যালির অনেক কোম্পানিরই স্টক/শেয়ারের দাম তর তর করে বাড়ে তাহলে ব্যাপারটা কী?

ভেবে চিন্তে যেটা মনে হলো, গুগলের প্রধান সাফল্যের পেছনে রয়েছে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, আর কর্মীদের কাজ করার অশেষ স্বাধীনতা দেয়া এখানে সবাই সপ্তাহে একটা পুরো দিন পায় নিজের ইচ্ছা মতো কোনো কিছু নিয়ে কাজ করার সেটা গুগলের কাজে আসুক বা না আসুক, কোনো সমস্যা নেই এমনকি অন্য কাজের ডেডলাইন থাকলেও সপ্তাহে এক দিন সবাই পাবেই আরো দেখেছি, পারস্পরিক সম্মান দেয়া দেশে থাকতে দেখতাম, কোম্পানির মালিক তো বটেই, অফিসের বড়কর্তা তাদের অধীনস্ত সবাইকে "তুমি" বলে সম্বোধন করছে, আর অন্য সবাই বড়কর্তাদের হুজুর-সালাম দিয়ে চলেছে কিন্তু গুগলে যেদিন ক্যাফের সাধারণ কর্মীদের খাবার লাইনে আমার ঠিক সামনে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা সের্গেই ব্রিনকে অন্য সবার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম, তখন বুঝলাম এখানে পদমর্যাদার জোর খাটানো নেই অফিসে গ্রুপের মিটিং থেকে শুরু করে সর্বত্র এটা অনুভব করেছি ... তিন মাসের জন্য আসা শিক্ষানবিশ ইন্টার্ন বলে আমার মতামতকে কেউ অবজ্ঞা করেনি, বরং যুক্তিসঙ্গত মতামত, অভিমত - এসব সবাই যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে


কর্মীদের অজস্র সুবিধা দেয়া, তিনবেলা রাজভোগ খাওয়ানো, কনফারেন্স বাইকে আড্ডা - এসবের মাধ্যমে মানুষ অফিসে বসে থাকছে সারাদিন, তা সত্যি, কিন্তু আসল কাজের উদ্দীপনা আসছে কাজের পরিবেশ, আর নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেয়ার সুযোগ পাওয়ার মধ্য দিয়ে আর সেই সাথে মজা করার অসংখ্য সুযোগ তো আছেই ... দুই দিন পর পরই অফিসের সবাই হই চই করে ঘুরে বেড়াতো বিভিন্ন স্থানে আমার এই তিন মাসের মধ্যেই ৪টা অফিস পিকনিক হয়েছে ... আর অন্য সময় একেবারে স্কি-করার ট্রিপ থেকে শুরু করে আরো অনেক চমৎকার অফ-সাইট ট্রিপ হয়ে থাকে প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের কোম্পানি মিটিং এর কথা আগেই বলেছি ... সেটাও এক বিশাল পার্টি আর গুগলে কাজ করে নানা দেশের নানা ধর্মের লোকজন ... সবার জন্যেই সব রকম ব্যবস্থা রয়েছে চীনা আর কোরীয় খাবারের উপরে আলাদা আলাদা একটা করে ক্যাফে তো আছেই, আর সেই সাথে বিভিন্ন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন হয় মূল ক্যাফেতেও আমি থাকার সময় ভারতের ৬০তম জাতীয় দিবস উপলক্ষে চার্লি' ক্যাফেতে বিশাল খাবার দাবারের আয়োজন হলো আবার শুক্রবারে মুসলমান কর্মীদের জন্য বিশেষ হালাল খাবারের ব্যবস্থা দেখেছি শুনেছি, রমজান মাসে ক্যাফে গুলোতে ইফতারের ব্যবস্থাও করা হয় মুসলমানদের জন্য

গুগলের কর্মী সংখ্যা আজ ছাড়িয়ে গেছে ১০ হাজারের উপরে তবে একটু মন খারাপ হলো এটা ভেবে, শিশির, সবুর, আর অল্প দুই-একজন ছাড়া এখানে বাংলাদেশী কর্মী নেই বললেই চলে অথচ বাংলাদেশে প্রতিভার অভাব নেই যে কয়দিন কাজ করেছি, মনে হয়েছে, এখানে কাজ করার মতো যোগ্যতা বাংলাদেশের অনেক প্রতিভাবান প্রোগ্রামারের রয়েছে আমি আশাবাদী ... ভবিষ্যতে, বছর কয়েক পরেই গুগলে বাংলাদেশের আরো অনেক প্রাণবন্ত মুখের আবির্ভাব ঘটবে ভারতের বাঙ্গালোর, দিল্লী, আর হায়দরাবাদের মতো বাংলাদেশেও গুগলের গবেষণাকেন্দ্র স্থাপিত হবে

---

অনেক মজার, অনেক স্মৃতির শেষে গুগলে কাজের পালা শেষ হলো আমার আগস্টের ১৭ তারিখে শেষের দুই তিন দিন আমাদের বিদায়ী অনুষ্ঠানে কেটে গেলো, আমার হোস্ট রিচার্ড আর ব্রায়ানের সাথে পুরো অফিসের সবাই মিলে ঘুরতে যাওয়া হলো বিভিন্ন স্থানে একেবারে শেষ দিনে গুগলপ্লেক্সকে বিদায় জানাতে বেশ খারাপ লাগছিলো তবু জীবনের গান চলতেই থাকে, ঘুরতে থাকে প্রযুক্তির স্রোতে গুগলের কর্মীদের অবগাহন, এগিয়ে চলে পৃথিবী
 

              


(
ছবিতে, শেষ দিনের পিকনিকে আমার সহকর্মী রিচার্ড ব্রায়ানের সাথে আমি, কোনো এক সকালে আমার অগোছালো ডেস্ক, আর গুগলপ্লেক্সের চত্ত্বর]

 

(সমাপ্ত)