রাশিয়া ১৯১৯

মূলঃ আর্থার র‌্যানসাম                    অনুবাদঃ তিমুর          

     timursblog@yahoo.com
 

©  সংরক্ষিত

ভূমিকা

ব্রিটিশ সাংবাদিক আর্থার র‌্যানসাম, প্রথম বিশ্বযু্দ্ধ আর বলশেভিক বিপ্লবের পর ১৯১৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন । লেখার নিরপেক্ষতা বা গভীরতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে, তবু মনে হয় সেই চাক্ষুষ অভিজ্ঞতার আবেদন বা প্রয়োজন এখনো ফুরিয়ে যায়নি ।নিরপেক্ষতার সাথে কিন্তু যথেষ্ট দরদ দিয়ে লেখক তাঁর ভ্রমণের বিষয়বস্তু পর্যবেক্ষণ করেছেন ।

পর্ব ১


গন্তব্য পেত্রোগ্রাদ



এ বছর ৩০ ই জানুয়ারি চারজন সাংবাদিক, দুজন নরওয়েজিয়ান, একজন সুইডিশ আর আমি, রাশিয়ার উদ্দেশ্যে স্টকহোম ছাড়ি । সুইডেনর সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হবার ভোরোভস্কি আর লিতভিনভের (মাক্সিম লিতভিনভ, পরবর্তীকালে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী) নেতৃত্বে সোভিয়েত সরকারী প্রতিনিধিদলের সাথেই যাচ্ছি আমরা । কয়েকমাস আগে আমি বলশেভিক নেতৃত্বের কাছে রাশিয়া যাবার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে আমার দরখাস্ত খারিজ হয়ে যায় । যে যাই হোক, আজ সকালের ডাকে মর্নিং পোস্টের একটা কপি স্টকহোমে এসে পৌঁছেছে, তাতে জনৈক মি. লকহার্ট দাবী করেছেন যে আমি ছয়মাসেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার বাইরে আছি, সুতরাং সেখানকার পরিস্থিতি নিয়ে আমার মন্তব্য করার কোন অধিকার নেই । পত্রিকাটা বগলদাবা করে স্থানীয় রুশ কর্তৃপক্ষের আছে আবার আবেদন করলাম যে আমাকে রাশিয়া যেতে না দেয়া খুবই অন্যায় হচ্ছে । এবারে খুব সহজে ভিসা পেয়ে গেলাম আমি ।

বরফ ঢাকা সাগর পাড়ি দিয়ে ফিনল্যান্ডের আবোতে নামলাম আমরা । ফিনিশ কর্তৃপক্ষ আমাদের যাত্রা সম্পর্কিত জটিলতা ব্যাখ্যা করল । আমাদের ট্রেনের উপর শ্বেত রক্ষীরা (প্রতিবিপ্লবী) হামলা করতে পারে । লিতভিনভ চাপা হাসি হেসে বললেন, হতে পারে শ্বেতরক্ষীদের হামলা করে দেবার সময় দেবার জন্য দেরী করিয়ে দেয়া হচ্ছে আমাদের । বেশ কয়েকজন নার্ভাস সহযাত্রীও একই মত দিল । কিন্তু ভিবর্গে এসে আমরা জানতে পারলাম পেত্রোগ্রাদে (বিপ্লবের আগে সেইন্ট পিটার্সবুর্গ, পরে লেনিনগ্রাদ) সিরিয়াস সংঘর্ষ চলছে এবং ফিনরা আমাদের যুদ্ধের মধ্যে নিয়ে ফেলতে চায় না । কেউ একজন একটা খবরের কাগজ যোগাড় করতে খবরটা পড়লাম আমি (পরে ইংল্যান্ডে ফিরে জেনেছিলাম এরকম ঘটনা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল তখন) । পেত্রোগ্রাদে বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে । সেমিওনোভস্কি রেজিমেন্ট বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে । সরকার শহর ছেড়ে ক্রন্সস্তাত দ্বীপে আশ্রয় নিয়ে, সেখান থেকে ভারী জাহাজী কামান দাগছে পেত্রোগ্রাদের দিকে ।

খুব উত্তেজনাকর খবর, কিন্তু আমাদের কিছু করার ছিল না । তাই আমরা জাহাজে শুরু হওয়া দাবার টুর্নামেন্টটা আমরা শেষ করলাম । একজন এস্তোনিয়ান প্রথম হলো, ভাগ্যক্রমে আমার চেয়ে অনেক ভাল দাবাড়ু লিতভিনভকে হারিয়ে আমি দ্বিতীয় হলাম । রোববার রাতের আমরা তেরিওকি পার হলাম তারপর, সোমবার সকালের দিকে ফিনিশ সীমান্তের কাছে বিয়েলেস্ত্রভে পৌঁছালাম ।

স্টেশনে একদল ফিনিশ সৈন্য অপেক্ষা করছিলো আমাদের জন্য, যাতে আমাদের একজনও সাধারন লোকদের ভীড়ে মিশে যেতে না পারে । কোন ঘোড়া ছিল না, কিন্তু তিনটে হাতে টানা স্লেজ আনা হল । সেগুলোতে আমাদের মালপত্র তুলে দিয়ে সৈন্যদের সাথে সীমান্তের দিকে রওনা দিলাম আমরা । একজন ফিনিশ লেফটেন্যান্ট আমাদের মিছিলটার আগে আগে চলছে, খোশমেজাজে আমাদের সাথে সুইডিশ আর জার্মান ভাষায় গল্প করতে করতে চলছে সে, জ্বলন্ত অগি্নকুন্ডতে পা দিতে যাচ্ছে এমন একদল দুর্ভাগা লোকের সাথে ভাল ব্যাবহার করাটাই ভাল মনে হচ্ছে তার কাছে ।

কয়েকশো গজ সামনে পাতা ঝরে যাওয়া বনের মধ্যে দিয়ে চলে গেছে পায়ে চলা রাস্তাটা । একটা জমে যাওয়া নালা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ফিনল্যান্ড থেকে আলাদা করেছে । নালাটার উপরে একটা কাঠের সেতু, রাস্তাটা সেদিকেই নেমে গেছে । সেতুটা বিশগজের বেশি লম্বা হবে না, দুমাথায় চেকপোস্ট, দুজন করে প্রহরী তাতে । রাশান চেকপোস্টটা পুরনো রুশ সাম্রাজ্যের শাদা-কালো রঙ করা । ফিনিশ সদ্য স্বাধীনতা পেয়ে এখনো ওদের চেকপোস্ট রঙ করে উঠতে পারেনি ।

চেকপোস্টের ব্যারিয়ারটা তুলল ফিনরা । তারপরে ফিনিশ অফিসাররা আমাদের জিনিসপত্র সব এনে সেতুটার মাঝখানে এনে ফেলল । নড়বড়ে সেতুটার মাঝখানটা জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে যেতে দেখলাম আমরা, আমরা যতদূর সম্ভব খাবারদাবার সাথে নিয়ে যাচ্ছি । আমাদের কাউকে পার হবার অনুমতি দেয়া হলো না যতক্ষণ না ওপার থেকে একজন অফিসার ও কয়েকজন সৈন্য ওপার থেকে এল আমাদের সাথে দেখা করতে । শুধু ছোট্ট নিনা, ভোরোভস্কির দশ বছরের মেয়ে এতোক্ষণ যে ফিনদের সাথে সুইডিশ ভাষায় গল্প করছিল, এক এক পা করে অন্য পারে গিয়ে রুশ সৈনিকদের সাথে গল্প জুড়ে দিল । রুশ সৈনিকটাও বাধ্যের মত মাথা নীচু করে ও টুপিতে লাগানো নতুন কাস্তে-হাতুড়ি আঁকা ব্যাজটা নিনাকে দেখাল ।

ফিনিশ লেফটেন্যান্ট নাম ধরে আমাদের ডাকতে লাগল, 'ভো রোভস্কি, স্ত্রী ও এক সন্তান সহ,' বলেই ঘাড় ফিরিয়ে সেতুর আরেক দিকে তাকিয়ে হাসল লেফটেন্যান্ট । তারপরে ডাকা হল 'লিতভিনভ' এবং আরো ত্রিশ জন রাশিয়ানের নাম । আমরা চার সাংবাদিক এলাম সবার পরে, 'গ্রিমলুন্ড' সুইডিশ সাংবাদিক, দুই নরওয়েজিয়ান; পুন্টেরফাল্ড ও স্টাং । সবশেষে আমার নাম ডাক হলো । আমরা সবাই চেঁচিয়ে ফিনদের বিদায় জানালাম, নিনা বলল 'হেলসে ফিনলান্ড!' ফিনিশ সৈনিকরা সব ওদের নিজেদের দেশের দিকে চলে গেল আর আমরা হাঁটি হাঁটি পা পা করে টলমল করতে থাকা রাশিয়ার দিকে পা বাড়ালাম । সেতুটার সাথে আমরা আমাদের একটা দর্শন বা সভ্যতা থেকে আরেকটায় গিয়ে পড়লাম । বু্র্জোয়া শাসন থেকে প্রোলোতারিয়েতের শাসনে ।

ফারাকটা প্রায় সাথে সাথেই বোঝা গেল । ফিনিশ দিকের নতুন স্টেশন যতটা কাজে লাগতে পারে তারথেকে অনেক বড় করে বানানো, নতুন ফিনল্যান্ডের মেজাজ বহন করছে । কিন্তু রুশ অংশে সেই পুরনো ধুসর কাঠের স্টেশনটাই পাসপোর্ট সংক্রান্ত সমস্ত জটিলতা নিয়ে টিকে আছে । কোন পোর্টার নেই স্টেশনে, তাতে অবাক হবার কিছু নেই, কাঁটাতারে বেড়া, অত্যন্ত সন্দিগ্ধ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দুইদেশকে ভাগ করেছে, এবং এ লাইনে যাত্রী নেই বললেই চলে । বুফেতে প্রচন্ড ঠান্ডা, এবং কোন খাবার নেই । লম্বা টেবিলগুলো, যা একসময় ক্যাভিয়ার আর যাকুস্কিতে ( অ্যাপেটাইজার) ভরা থাকত, এখন খালি । যা হোক একটা সামোভার এখনো আছে, ষাট কোপেক খরচ করে এক গ্লাস করে চা কেনা গেল সাথে আড়াই রুবল দামের চিনির কিউব । ভিতরের পাসপোর্ট অফিসে বসে চা খেলাম আমরা, সেখানে স্টোভে পুন্টারফাল্ডের শক্ত সু্ইডিশ রুটি দিয়ে কোনরকমে খাওয়া সারলাম আমরা ।

সেই হতশ্রী নির্জন স্টেশনে আমাদেরকে ঠিক কী ধরনের অবসাদ ও উল্লাস পেয়ে বসেছিল তা বর্ণনা করা সত্যি কঠিন । আমরা এখন ঠিক কারো পাহারায় নই, এবং মোটামুটি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি আমরা । দুই দলে ভাগ হয়ে গেল সবাই, একদল কাঁদতে বসল আর আরেক দল গলা ছেড়ে গান ধরল । মাদাম ভোরোভস্কি, যিনি প্রথম বিপ্লবের সময় থেকেই দেশে ছিলেন না, কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন । কিন্তু পরদিন মস্কোতে পৌঁছে যখন তিনি আবিস্কার করলেন যে উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মকর্তার স্ত্রী হবার সুবাদে তিনি বিশেষ কোন সুবিধা পাবেন না, তখনকার কান্নাটা আরো ভয়ানক ছিল । কিন্তু লিতভিনভের মত পাটির্র অল্পবয়েসী মেজাজ, কোন ডিনার না খেতে পেলেও ছিল তুঙ্গে ।

গোটা গ্রামটায় চষে বেড়াতে লাগল ওরা, বাচ্চাদের সাথে খেলতে খেলতে গান ধরল ওরা । কোন বিশেষ বিপ্লবী বা দেশাত্বক গান নয়, যা মাথায় আসে এমন যে কোন খুশির গান । যখন পেত্রোগ্রাদ যাবার ট্রেন এল আমরা আবিস্কার করলাম যে ট্রেনে কামরা গরম করার কোন বন্দোবস্ত নেই । কেউ একজন ম্যান্ডোলিন বের করল, শরীর গরম করার জন্য নেচে চললাম আমরা, ম্যান্ডোলিনের তালে । তবু, আমাদের সাথে পাঁচটা বাচ্চার জন্য সত্যি খুব খারাপ লাগছিল আমাদের । যে দেশে একই সাথে যুদ্ধ, অবরোধ এবং বিপ্লব চলছে সেরকম কোন দেশ কোন শিশু বেড়ে ওঠার জন্য আদর্শ জায়গা নয় । কিন্তু ওরাও দের বাবা-মা আর অন্য বিপ্লবীদের মত ফুর্তিতে আছে ।

সন্ধ্যার সময় পেত্রোগ্রাদের ফিনল্যান্ড স্টেশনে এসে পৌঁছালাম আমরা । স্টেশনটা প্রায় ফাঁকা, তবে চারজন পোর্টারের দেখা মিলল । আমাদের মালপত্র প্ল্যাটফমের্র এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে নেবার জন্য আড়াইশো রুবল দাবী করল ওরা । তবে মাল নেয়ার জন্য যে লরিটা পাঠানো হয়েছিল সেটায় আমরাই মাল তুললাম । আমাদের বিভিন্ন হোটেলে জায়গা বরাদ্দ করার জন্য অনেক সময় গেল । স্টেশনের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহ ও শহরের উপর গোলাবর্ষণ বিষয়ে অনেককে জিগ্যেস করলাম । কিন্তু কেউ কিছু জানে না এ ব্যাপারে । অ্যাস্টোরিয়া হোটেলে আমার জন্য কামরা বরাদ্দ হল জেনে ভাবলাম, আমার ভাগ্য ভাল ।

জমে যাওয়া নেভা নদীর উপর দিয়ে লিতেইনি সেতুর উপর দিয়ে চললাম আমরা । শহর মোটামুটি শান্ত আছে বলেই মনে হল আমাদের । পড়ন্ত তুষার কুঁচির মধ্যে দিয়ে পিটার-পলের দুগের্র অবয়বকে ঝাপসা ভাবে দেখা গেল । তারপরে গত ছয় বছরে, আমি আমার অত্যন্ত পরিচিত সামার গার্ডেন, ব্রিটিশ দূতাবাস আর প্যালেস স্কোয়ার দেখতে । এখানে গত জুলাই বিপ্লবের সময় সাঁজোয়া গাড়ির বহরকে অবস্থান নিতে দেখেছিলাম । এখানেই জেনারেল কর্নিলভকে, ইউংকার রেজিমেন্ট পরিদর্শন করতে দেখি আমি। মার্চের বিপ্লবের কথা মনে পড়ল, অন্ধকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে পিকেটার জারের সরকারের ছাপানো লিফলেট পোড়াচ্ছে । স্মৃতির দরজা আরেকটু খুলে গেল, এবং আমি এই চত্বরেই যুদ্ধের শুরুতে মানুষের স্রোত নেমে আসছে । জার নিকোলাস প্রাসাদের ব্যালকনি এসে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন ।

অ্যাস্টোরিয়া হোটেল এখন একটা ব্যারাকের মত কাঠখোট্টা জায়গা । যুদ্ধের শুরুতে এটা ছীল অফিসারদের আড্ডাখানা। বিপ্লবের সময় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল । বেশির ভাগ ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করা হয়েছে, কিন্তু মেঝেতে লাল কার্পেট উধাও, হতে পারে সেগুলো দিয়ে ব্যানার বানানো হয়েছে । আলোও জ্বলছে না, হতে পারে বিদ্যুত নেই । চার তলায় একটা চমৎকার রুমে লটবহর টেনে নিয়ে গেলাম আমি ।

এই হোটেলের প্রতিটি তলাই স্মৃতিময়। এই রুমেই আমি এক সাহসী প্রতিবিপ্লবী অফিসারের দেখা পাই, যে বড়াই করে বলেছিল বলশেভিকদের উপর হামলা করে মাদাম কোলোনতাই (আলেক্সান্দ্রা কোলোনতাই পরে সুইডেনে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত) এর হ্যাট ছিনতাই করে এনেছে ও, হ্যাটটা দেখেছিলাম আমি। এখানেই পার্সিভাল গিবন্সের কাছে ছোট গল্প লেখার উপর একটা ছোট লেকচার শুনি । এখানেই মিসেস বিটি ক্লান্ত বিপ্লবীদের চা খাওয়াতেন, যুদ্ধের পরে এই সব দিনগুলোর স্মৃতি 'রেড হার্ট অভ রাশিয়া' তে লিখেছেন তিনি । এখানেই ডেনিস গার্সটিন আমাকে বলেছিল, যুদ্ধ শেষ হলে কী রকম শিকারে যাবে সে ।

খাওয়ার কথা জিগ্যেস করতেই ওরা বলল হোটেলে কোন খাবার নেই তবে গরম পানি ব্যাব্স্থা আছে । ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নেয়ার জন্য একটু হাঁটতে বের হলাম । স্রেফ একটা ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে বের হতে ভয় লাগছিল । আমাদেরকে এখনো পাস ইস্যু করা হয় নি । হাঁটতে হাঁটতে রেজিনা হোটেলের সামনে এসে পড়লাম । যুদ্ধের আগে সবচেয়ে অভিজাত হোটেল ছিল রেজিনা । কিন্তু ওখানে যাদের কামরা পড়েছে, ওরা সাংঘাতিক সমালোচনা করছে যে ওখানে আর থাকতে পারলাম না । ময়কা প্রাসাদ থেকে নেভস্কি পর্যন্ত গিয়ে আবার হোটেলে ফিরে এলাম আমি । আমার হোটেলটার মতই গোটা শহর আঁধো আলো-আঁধারীতে ডুবে আছে । পুরনো ভেড়ার চামড়ার পুরনো কোট পরে নিজেকে আমার মনে হল কোন প্রাচীন প্রেত যে সে তার পুরনো মৃত নগরে ফির এসেছে । রাস্তায় খুব অল্প কিছু লোকের সাথে দেখা । তবে রাস্তাগুলোর বরফ মনে হল রুশ সাম্রাজ্যের শেষ শীতকালটার চেয়ে ভালভাবে সাফ করা হচ্ছে ।

 

পর্ব-২

 

 

 

 

 

 

 

স্মোলনি ইন্সটিটিউট

 



স্মোলনি ইন্সটিটিউটে কর্মরত লেনিন

 

পরদিন চায়ের সাথে একটা রুটির কার্ড পেলাম, যাতে সামান্য পরিমান বাদামী রুটি আমার ভাগে জুটবে, রুটির মান গত গ্রীষ্মে মস্কোতে দেয়া রুটির থেকে ভাল । এরপরে লিতভিনভকে খুঁজে বের করে স্মোলনি ইন্সটিটিউটের দিকে রওনা হলাম । স্মোলনি ইন্সটিটইউট একসময়ে অভিজাত শ্রেণীর মেয়েদের স্কুল ছিল, এখানেই বলশেভিক সোভিয়েতের সদরঘাঁটি । পুরো সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রশাসনই চলত এখান থেকে । ক্রন্সদাত দ্বীপে সরকার সরিয়ে নেবার পর স্মোলনি ইন্সটটিউট, পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত, উত্তরাঞ্চলের সদর দফতর । দিনের বেলায় পেত্রোগ্রাদকে খানিকটা জনবহুল মনে হচ্ছে । তবে মনে হল যেন কেরেনস্কির 'শহর খালি করে দেয়ার' পরিকল্পনাটা কিছুটা হলেও ফলেছে । এর কারন হচ্ছে দুর্ভিক্ষ, শহরে জ্বালানী ও কাঁচামাল নিয়ে আসার অসুবিধার কারনে শহরের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া ।

এখানে মনে রাখা দরকার বেশিরভাগ রুশ শ্রমিকই গ্রামের সাথে তাদের সম্পর্ক হারায়নি, শহরের সাথে গ্রামের যাওয়া আসাটা বেশ নিবিড় । বেশির ভাগই শ্রমিক দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিপ্লবের ধারনা বয়ে নিয়ে গেছে । এটাও মনে রাখা দরকার লাল ফৌজের প্রথম দিককার ইউনিটগুলো সব শহরের শ্রমিকশ্রেণী থেকে এসেছিল যারা গ্রামের লোকের থেকে অনেক বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও শৃঙ্খলাপরায়ন ছিল ।

ছ'মাস পরে পেত্রোগ্রাদে আমি আরো একটা জিনিস দেখলাম, রাস্তায় সশস্ত্র মানুষজন নেই বললেই চলে । প্রায় যেন যুদ্ধের আগের শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, কোন বিপ্লবী গ্রুপ রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে না, সৈন্যরা যারা বাইরে ঘুরছে তাদের কারো হাতে রাইফেল নেই । কাঁধে মেশিনগানের গুলির বেল্ট ঝোলানো বিপ্লবের সেই সব জঙ্গী পান্ডারা এখন অদৃশ্য ।

আরেকটা নতুন দৃশ্য চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে সবসময়ে হালফ্যশনের ধোপদুরস্তে মানুষজনে ভর্তি নেভস্কি প্রোসপেক্তে নতুন পোশাক পরা কোন মানুষের অনুপস্থিতি । সবার পরনে অন্তত দু'বছরের পুরনো জামাকাপড় অবশ্য কিছু অফিসার আর সৈনিকের পরনে নতুন উর্দি । পেত্রোগ্রাদের মহিলারা সবসময়ই কেতাদুরস্ত বুটের ভক্ত, আর এখন নতুন বুটের বড়ই অভাব । একজন মাত্র তরুণীকে দেখলাম যার পরনে প্রায় নতুন দামী ফার কোট । কিন্তু তার পায়ে লিনেনের ফালি প্যাঁচানো খড়ের জুতো ।

আমরা অনেক দেরীতে রওনা দিয়েছি তাই, নেভস্কিতে পৌঁছানোর জন্য ট্রাম নিলাম । ট্রামের কন্ডাক্টররা সবাই মহিলা, টিকেটের দাম খেয়াল করলাম এখন এক রুবল । আগে টিকেটের দাম ছিল ছিল দশ কোপেক ।

স্মোলনি ইন্সটিটিউটের সামনে দাঁড়ানো সাঁজোয়া গাড়িটা অদৃশ্য হয়েছে । সেখানে কার্ল মাক্সের্র একটা বদখত মূর্তি শোভা পাচ্ছে, মার্ক্স সাহেব আঠারো ইঞ্চি কামানের নলের একটা মস্ত টপ হ্যাট ধরে আছেন শরীরের পিছনে । অস্ত্র বলতে দুটো হালকা ফিল্ড গান, এই আবহাওয়ায় খুবই করুন দেখা যাচ্ছে । পোর্টিকো পিলারগুলোর মাঝে রাখা, ওগুলো ব্যাবহার করলে আমার বিশ্বাস পিলার সহ গাড়ি বারান্দাটা ধ্বসে পড়বে ।

ভিতরে সব আগের মতই আছে, কেবল সব ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে । করিডর ধরে ঘুরে বেরানো আর স্টল থেকে পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করতে থাকা মফস্বলের ডেলিগেটদের আর দেখা যাচ্ছে না । এখানেই ত্রতস্কির দরজার বাইরে ভিবর্গ থেকে আসা খুদে শ্রমিকটা পাহারায় দাঁড়িয়ে থাকত । সামনের কোনাটার জানালায় দাঁড়ালে নীচের বিশাল হল ঘরটা দেখা যেত যেখানে দিনমান পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত বিতর্কে ব্যস্ত থাকত ।

পেত্রোগ্রাদ কমিশনারদের সাথে ডিনার করার লিতভিনভের দাওয়াতটা খুশি মনেই গ্রহন করলাম, কারন প্রথমত আমার খিদে পেয়েছিল, দ্বিতীয়তঃ যিনোভিয়েভের (গ্রিগোরি যিনোভিয়েভ) সাথে দেখা করার এটাই সবচেয়ে ভাল উপায় বলে মনে হল, বিপ্লবের সময় যখন আমাদের দেখা হয় ভারী রুক্ষ ব্যাবহার করেছিলেন তিনি । লম্বা চুল, নিখুঁতভাবে কামানো মুখ, ইহুদী যিনোভিয়েভের ব্যাবহার খুব চাঁছাছোলা । শুরুতে নভেম্বর বিপ্লবের (পুরনো রুশ পঞ্জিকা মতে অক্টোবর বিপ্লব, গ্রেগোরিয়ান পঞ্জিকা মতে নভেম্বর বিপ্লব) বিরোধী ছিলেন তিনি । কিন্তু বিপ্লব যখন ঘটেই গেল তখন তিনি লেনিনের দিকে আনুগত্য ঘোষণা করে উত্তরাঞ্চলীয় কমিউনের প্রধান হয়ে বসলেন । তিনি মোটেই মৌলিক চিন্তাশীল ব্যক্তি বা ভাল বক্তা নন কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিতে বা তর্ক করতে পারেন চমৎকারভাবে ।

গত বছর তাঁর দুই বন্ধু ভোলোদারস্কি আর উরিৎস্কির হত্যাকান্ডের পর যথেষ্ট ভেঙ্গে পড়েছেন তিনি আর এ বছর লেনিনের উপর হামলার পর বলা যায় মাথাই খারাপ হয়ে গেছে তাঁর । ঘটনার পর পেত্রোগ্রাদে যেসব প্রতিহিংসামূলক ঘটনা ঘটে ছিল সেসবের দায় তাঁর উপর চাপানো হয় । তাঁকে কোনভাবেই জার্মান ঘেঁষা বলা যাবে না, যদিও অবশ্যই তিনি মার্ক্স-অনুরক্ত । তবে দেখলাম তিনি বেশ ইংরেজ বিদ্বেষী । আমাকে 'বুর্জোয়া সাংবাদিক' বলে আমার অসুবিধা করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি আমার আগের সফরে । রাদেকের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতাকেও তিনি খুব ভাল চোখে দেখেন না ।

টেবিলে আমাকে বসতে দেখে যিনোভিয়েভের মুখের ভঙ্গি দেখে হাসি পেল আমার । লিতভিনভ পরিচয় করিয়ে দিলেন, আমার উপর লকহাটের্র আক্রমণের কথাও সূক্ষ্মভাবে বলতে ভুললেন না । এরপরেই যিনোভিয়েভ অনেক বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন । এও বললেন মস্কো থেকে ফিরে যদি আমি পেত্রোগ্রাদে কয়েকদিন কাটাই, তবে আমি যেসব ঐতিহাসিক দলিল দেখতে চাইছি তা তিনি দেখানোর ব্যবস্থা করবেন । আমি বললাম তাঁকে ক্রন্সতাত দ্বীপে না দেখে এখানে দেখে খুব অবাক হয়েছি, বিদ্রোহ এবং সেমিওনোভস্কি রেজিমেন্টের কথাও বললাম আমি । শুনে হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই। পোৎসার্ন ব্যাখ্যা করলেন যে সেমিওনিভস্কি রেজিমেন্ট বলে আসলে কিছু নেই, পুরোটাই ধাপ্পা। মিথ্যাটাকে সত্যের মোড়ক দেয়ার জন্য সেমিওনোভস্কি রেজিমেন্টের নাম দেয়া হয়েছে। এরকম একটা রেজিমেন্ট সত্যিই চোদ্দ বছর আগে ১৯০৫ সালে মস্কোর বিদ্রোহ দমন করেছিল। টেবিলের ওপাশে বসে থাকা পোৎসার্ন, চশমা চোখে রোগাপাতলা, দাড়িওয়ালা একজন মানুষ, উত্তরাঞ্চলীয় কমিউনের সামরিক কমিসার ।

স্মোলনিতে ডিনার আগের মতই ইনফর্মাল ব্যাপার, যদিও খাবার আগের থেকে আনেক কম । মহিলা আর পুরষ কমিশনাররা কাজের জায়গা থেকে এসে খেয়ে আবার কাজে চলে যাচ্ছে। খুব শাদামাটা খাবার, স্যুপ-তাতে ঘোড়ার মাংসের ফালি ভাসছে; কাশা (পরিজ) আর একটা স্বাদহীন শাদা জিনিস শেষে একদলা চিনি সহ চা। আমার খাওয়া যখন শেষ, তখন মাদাম ভোরোভস্কি ছোট্ট নিনা, সুইডিশ আর দুই নরওয়েজিয়ান সাংবাদিককে নিয়ে ঢুকলেন। জানলাম, দলের অর্ধেক লোক আজ রাতের ট্রেনে মস্কো যাবে। ওদের যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে হোটেলে ফিরে গেলাম তাড়াহুড়ো করে ।


পর্ব-৩

 

পেত্রোগ্রাদ থেকে মস্কো

মস্কো যাবার প্রস্তুতি নিয়ে বিরাট হট্টগোল বেঁধে গেল । কিছু দেখা গেল একেবারে শেষ মুহূর্তেও তৈরী হতে পারেনি। আটজন মানুষের জন্য একটা মোটরগাড়ি বরাদ্দ ছিল, ভারী মালপত্রের জন্য একটা ট্রাক। আমি আমার লটবহর নিয়ে ট্রাকে উঠে স্টেশন পর্যন্ত ঝাঁকুনি খেতে খেতে গেলাম । আমার মনে পড়ে গেল বিপ্লবের প্রথম দিককার কথা, যখন এইসব ট্রাকগুলোতে মেশিনগান, সৈনিক, বিপ্লবী, রাজনৈতিক বক্তা বা পথচলতি যেকোনো উৎসাহী ,লোককে তুলে নেয়া হতো ।

নিকোলাই স্টেশনে পৌঁছে মনে হল সবকিছু ঠিকমতই আছে, যতক্ষণ না আমাদের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় পা রাখলাম। আমাদের রিজার্ভ কামরায় বিনা অনুমতিতে কতগুলো লোক উঠে বসে আছে । যা হোক, সে সব সমসস্যাও মেটানো গেল, যেটা একবছর, বা এমন কী ছয়মাস আগেও অসম্ভব ছিল ।

ট্রেনের ওয়াগনটার মাঝখানে একটা দরজা কামরাটাকে ভাগ করেছে। খোলা কুপ আর পাশের সিটগুলোকে বিছানা হিসেবে ব্যবহার করা যায়। আমি দ্বিতীয় সারিতে জায়গা পেলাম, আমার মাথার উপরের বাংকটায় শুধু লাগেজ রাখা। আমার পা ঝুলছে নীচের বাচ্চা নিয়ে মা, বলশেভিক আর অন্যান্য হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে। প্রত্যেক স্টেশনে ট্রেন থামছে, এবং পুরো ট্রেন জুড়ে মানুষ উঠছে আর নামছে। কেতলি, কফিপট বা স্রেফ মাংসের খালি টিন আছে এমন সবাই গরম পানির খোঁজে নেমে যাচ্ছে। দুটো থার্মোস ফ্লাস্ক হাতে আমি ওদের সাথে যোগ দিলাম ।

গরম পানির কলে কেউ খবরদারী করছে না, কিন্তু মানুষ সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে গরম পানি নিচ্ছে । ট্রেন ছাড়া হলে সবাই ট্রেনে উঠে চা খেতে লাগল। সারারাত অসংখ্য স্টেশনে এর পুনরাবৃত্তি হল । মানুষ ঝিমাতে ঝিমাতে জেগে উঠে আলাপ করতে লাগল । উপরে বসে আমি ওদের কথা শুনছিলাম । কেউ কেউ খাবারের দাম নিয়ে গজগজ করছে, কেউ বা বুঝে উঠতে পারছে না কেন অন্যান্য দেশ তাদের সাথে যুদ্ধ করতে চায় । যদিও কামরা ভর্তি কমিউনিস্ট, আরখাংগেলের একজন সমবায়ী বেশ খোলাখুলিই সেখানকার অসন্তোষের কথা বলল ।

আরখাংগেলের কিছু রাশিয়ান সৈন্য ফ্রন্টে গিয়ে অন্য রাশিয়ানদের সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করেছিল বলে ওদের কমান্ডাররা সব ইস্তফা দেয়। ওদের জায়গায় নতুন কমান্ডাররা সাহায্যের জন্য আবেদন করে। আমেরিকান সৈন্যরা ওদের ব্যারাক ঘিরে ফেলে বলে হয় ওরা ওদের মাথাদের ধরিয়ে দেবে নইলে ওখানে যত সৈন্য আছে তাদের প্রতি দশজনের একজনকে গুলি করে মারা হবে। তারপর বিদ্রোহীরা ওদের নেতাদের ধরিয়ে দেয়। তারপর ওদেরকে নিজেদের কবর খুঁড়তে বলে ওদেরকে গুলি করে মারা হয়।

হতে পারে পুরো ঘটনাটাই আরখাংগেল এলাকার গুজব। প্ল্যাটফমের্র আরেক জায়গায় দুজন লোক পরস্পরকে স্বার্থপর বলে গালাগাল করছে। আমি ভেবেছিলাম মারামারি না লেগেই যায় না, কারন দুজনের গালির মজুদই অফুরন্ত, কিন্তু কিছুই হল না। প্ল্যাটফর্মে একদল শ্রোতা জুটে গেল যারা হাততালি দিতে লাগল দু'জনের গালাগাল শুনে ।

শেষ পর্যন্ত আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কামরার হট্টগোল, ধোঁয়া, বাচ্চাদের কান্না, ময়লা কাপড়, আর রুশ চাষীদের গা থেকে আসা একটা বিশেষ গন্ধে আমার ঘুম অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। তাহলেও আমি বেশ আরামেই ছিলাম, লোকজনের গল্পগুজবে অংশ নিচ্ছিলাম, ইংল্যান্ডে মাছধরার কথা ভাবছিলাম আর শক্ত কাঠের উপর এপাশ ওপাশ করছিলাম সামান্য আরামের জন্য ।

 

পর্ব-৪

 

মস্কোর প্রথম দিনগুলি

 

 

দিনটা ছিল প্রচন্ড ঠান্ডা । আমি ট্রেন থেকে নেমে মেত্রোপোল হোটেলে যাবার জন্য স্লেজ-চালকদের জিগ্যেস করতেই ওরা একশো রুবল চেয়ে বসল । একবছর আগে আমি যখন কর্নেল রবিন্স এর সাথে এসেছিলাম তখন আমরা সর্বোচ্চ দশ রুবল ভাড়া দিতাম, অধিকংশ সময় আট রুবলেই হয়ে যেত । অনেক কথা কাটাকাটির পরে পঞ্চাশ রুবলে রফা হল, আমার সাথে লাগেজ বলতে ছিল কেবল একটা টাইপরাইটার ।

রাস্তায় পুরু হয়ে বরফ জমে আছে, পেত্রোগ্রাদের থেকে কম পরিস্কার, তবে গত বছরের মস্কো থেকে বেশি সাফ করা হয়েছে । রাস্তায় ট্রাম চলছে, এবং আমার মনে হল প্রায় ততগুলো স্লেজ চলছে রাস্তায় । স্লেজটানা ঘোড়াগুলোর স্বাস্থ্যও গত গ্রীস্মের থেকে সামান্য ভাল বলে মনে হল । আমি স্লেজ-চালককে জিগ্যেস করতে ও বলল এখন মানুষের ঘোড়াদেরও সামন্য যবের রেশন দেয়া হয় । অনেক লোকজন আছে রাস্তায়, কিন্তু বন্ধ দোকানপাটের সংখ্যা দেখলে মন খারাপ হয় । আসলে তখন সমস্ত ব্যাবসা বানিজ্যের জাতীয়করণ চলছিল, আমি যাওয়ার আগেই বেশ অনেক দোকান আবার চালু হয় সমবায় হিসেবে । নতুন দোকান গুলোর নাম ছিল অনেকটা এরকম, '৫ নম্বর বুটের দোকান, মস্কো সোভিয়েত,' ৩ নম্বর কাপড়ের দোকান মস্কো সোভিয়েত,' '১১ নম্বর বইয়ের দোকান মস্কো সোভিয়েত' ।

ফটকাবাজরা যা করত তা হচ্ছে ধরা যাক আধা ডজন ওভারকোট কিনে সবচেয়ে বেশিদাম যে হাঁকছে তার কাছে বিক্রি করে দিল, যে ভাবে টাকা আছে এমন লোকেরাই জিনিস কিনতে পারত । একন কেউ যদি কাপড় পেতে চায় তাকে তার আবাসিক কমিটিতে গিয়ে পুরনো কাপড় দেখিয়ে কমিটকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে তার সত্যিই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন । ফটকাবাজি বন্ধ করার জন্যই এমন করা হয়েছে । মেত্রোপোল হোটেলে আমার জন্য অন্য চমক অপেক্ষা করছিল । দেয়ালে গত গ্রীস্মের শেলের গর্ত আর গুলির দাগ মেরামত করা হয়েছে ।

লিতভিনভ আমাকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশারিয়েটের কারাখানকে দেয়ার জন্য । দাড়ি-গোঁফ সজ্জিত কারাখান (অথবা কারাহান, যেহেতু রুশ ভাষায় 'খ' এর উচ্চারণ হ এর মত হয়) সুপুরুষ আর্মেনিয়ান, রাদেকের ভাষায় 'একজন ক্লাসিকাল সৌন্দর্য মন্ডিত গর্দভ' । কারাখান সবসময়ে বহির্বিশ্বের সাথে মানিয়ে চলার পক্ষপাতি, বললেন অভ্যাতদের ক্রেমলিনে থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে । আমি যখন বললাম, আমি ক্রেমলিনে থাকার চেয়ে একটা সাধারন হোটেলে থাকাই বেশি পছন্দ করব, তখন তিনি হোটেলের অনুমতি যোগাড় করে দিলেন । কাজটা মোটেই সহজ ছিল না, কারন এজন্য নির্বাহী কমিটির স্ভের্দলভের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হল আমি মেত্রোপোল হোটেল বা ন্যাশনাল হোটেল, এ দুটোর কোন একটাতে আমি থাকতে পারি । প্রথমটা সাধারনত সরকারী ডেলিগেটদের জন্য, তবে দেখা গেল দুটো হোটেলই একেবারে ভর্তি । অতএব আমাকে লোসকুৎনায়া হোটেলে জায়গা দেয়া হল, যেটা তখন নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের থাকার জায়গা ছিল ।

থাকার জায়গা কাপড়ের মতই বরাদ্দ করা হত, জরিপ চালিয়ে মানুষে চাহিদা মাপা হচ্ছিল । আবাসিক কমিটিতে গিয়ে সবাই থাকার জায়গার জন্য আবেদন করতে হবে । প্রত্যেকের একটা করে কামরা থাকবে যতক্ষণ না সবার জন্য দুটো কামরা পাওয়া যায় এই নীতিতে বিশ্বাসী কর্তৃপক্ষ । মস্কোর কাছের এক কারখানা ম্যানেজার বললেন তাঁর বাড়ির একট অংশ কারখানার শ্রমিকদের থাকবার জন্য দিয়ে দেয়া হয়েছে । এই আইন অবশ্যই বাড়ির মালিকদের ভীষণ কষ্টকর, এবং অনেক নতুন লোক এসে বাড়ির অবস্থা বারোটা বাজিয়ে দেয় ।

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর পররাষ্ট্র কমিশারিয়েটের চিচেরিনের সাথে কথা বললাম । কারখানের চেয়ে অনেক কম বন্ধুত্বপুর্ণ চিচেরিন, বয়স আনেক বেড়ে তাঁর । ইংল্যান্ডের কথা জানতে চাইলেন তিনি । আমি বললাম লিতভিনভ এ ব্যাপারে আমার থেকে ভাল জানেন । আজকেই লিতভিনভের একটা সাক্ষাৎকার টেলিগ্রাফ করে পাঠিয়ে দিয়েছি আমি । আমি ব্যাক্তিগতভাবে বললাম যে, রাশিয়ার মত একটা বিশাল দেশকে অবরোধ দিয়ে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না ।

এরপরে প্রাচ্য বিষয়ক কমিসার ভোযনেসেনস্কির সাথে আলাপ হলো আমার । মেত্রোপোলে খাবার জন্য একটা টিকেট দিলেন তিনি আমাকে । টিকেটটা ন্যাশনালে জায়গা পাবার পরে আমাকে ছাড়তে হয়েছিল । ডিনারে ছিল একপ্লেট স্যুপের সাথে অন্য একটা কিছু । প্রতি গ্লাস পাতলা চা ত্রিশ কোপেক করে বিক্রি হচ্ছে । আমার বোন আমাকে এক প্যাকেট স্যাকারিন দিয়েছিলেন । আমার বন্ধুরা যেভাবে স্যাকারিনে মিষ্টি করা চায়ের উপর বাচ্চাদের মত হামলে পড়লেন দেখে মায়াই লাগছিল আমার ।

মেত্রোপোল থেকে লোস্কুৎনায়া হোটেলে গেলাম আমি । ছ'মাস আগে এই হোটেলের পরিবেশ অনেকটা পরিচ্ছন্ন ছিল । কিন্তু নাবিকরা হোটেলটাকে কী রকম নোংরা করে ফেলেছে তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয় । ঘর গরম করার কোন ব্যাবস্থা নেই আর খুব সামান্য আলোর ব্যাবস্থা হোটেলে । ঘরের কোন একটা পুরনো সামোভার আর ঘরভর্তি নানান আবর্জনা । বেয়ারাকে ডাকিয়ে এনে ঘরটাকে কিছুটা সাফ করলাম । একটা নতুন সামোভার আনানো গেল, কিন্তু কোন কাঁটাচামচ, চামচ বা ছুরি দিতে পারল না ও । অনেক কষ্টে পানি খাবার গ্লাস আদায় করা গেল ওর কাছ থেকে ।

টেলিফোনটা অবশ্য ভাল আছে এবং চা কাবার পরে আমি মাদাম রাদেকের সাথে কথা বললাম, উনি মেত্রোপোল থেকে ক্রেমলিনে চলে গেছেন । এখনো ক্রেমলিনে যাবার পাস পাইনি আমি । উনি বললেন কমান্ডান্টের কাছ থেকে পাস যোগাড় করে দিতে পারবেন তিনি । তুষার ঢাকা রাস্তা ধরে পার্কটার পাশ দিয়ে, সেতু পার হয়ে ক্রেমলিনের ফটকে এসে হাজির হলাম আমি । গাছের গুঁড়ি জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে কয়েকজন সৈন্য । মাদাম রাদেক সেখানে হাত গরম করছিলেন, আমাকে তিনি ক্রেমলিনের ভিতরে নিয়ে গেলেন ।

ক্রেমলিনে তখন কমিসারদের একটা সন্মেলন চলছিল । প্রাচীন গির্জাগুলোর নীচে অনেকগুলো কালো রঙের মোটরগাড়ি বরফের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল । আমরা ডানদিকে মোড় নিয়েক্যাভালরি হাউজ আর পোতিশনি প্রাসাদের মধ্যে দিয়ে দ্ভোর্তযোভায়া স্ট্রিট ধরে হাঁটতে লাগলাম । একটা খিলানের নীচের ফটক দিয়ে খুব সম্ভবত প্লেজার প্যালেসে পা রাখলাম । এখানে বিপ্লবের ধ্বংস থেকে জমকালো বেঁচে যাওয়া গোবেলিন ট্যাপেস্ট্রি ঘেরা একটা কামরায় সুইস আন্তর্জাতিক আন্দোলনের নেতা কার্ল মুরকে দেখতে পেলাম । স্কটিশ নেতা কেইর হার্ডি আর হাইন্ডম্যানের প্রসঙ্গ তুলে তিনি বললেন ওঁরা সত্যিকারের সমাজতন্ত্রী ছিলেন । আমি এ দু'জন সম্বন্ধে কিছূ জানি না দেখে ভারী হতাশ হলেন তিনি ।

মাদাম রাদেক অবশ্যই রাদেক (কার্ল রাদেক) সম্বন্ধে জানতে চাইলেন । আমি বললাম স্টকহোমের কাগজে আমি পড়েছি ব্রুন্সইউকের প্রাসাদে আছেন । অনেক পরে আমরা জেনেছিলাম তিনি বার্লিনে আটক হয়ে জেলে গেছেন । গত ছয়মাসে কী কী পরিবর্তন আমি দেখতে পাচ্ছি সেটাও তিনি জানতে চাইলেন । পুরনো চেনাজানাদের খবর জানতে চাইলেন আমি । পিয়াতাকভ মিত্রপক্ষের কাছ থেকে উক্রাইনে জার্মানদের বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য মেশিনগান চাইছিলেন । শুনলাম এখন রাকোভস্কি পিয়াতাকভের জায়গা নিয়েছেন । খার্কভ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, কিন্তু কিয়েভ এখনো মস্কোর নিয়ন্ত্রনে ।

সে রাতে হোটেলে ফিরে আমার এত ঠান্ডা লাগল যে আমি ভেড়ার চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে উপরে সমস্ত কাপড়চোপড় আর তোষক চাপিয়ে শুলাম, তবু শীত গেল না । খুব খারাপ ঘুম হল আমার ।

আরেকটা ভাল জায়গা পাওয়ার জন্য তদবির আরম্ভ করে দিলাম । পথ চলতে চলতে দেখলাম মস্কোর রাস্তাগুলো নানান বিপ্লবী ভাস্কর্যে ভরে গেছে । কোনোটা খুব বদখত দেখতে, কোনোটা বেশ ইন্টারেস্টিং, দেয়ালের বিজ্ঞাপনগুলো স্থানীয় শিল্পীরা ছবি এঁকে ঢেকে দিয়েছে । এই আবহাওয়াতে অবশ্য এর বেশীরভাগই নষ্ট হয়ে গেছে, তবু বোঝা যায় কী দারুন গ্যালারি ছিল সে সব । একটা দালানের সামনের পুরোটা জুড়ে ছিল বিজ্ঞাপন, সেখানে এখন বিপ্লবের নানান মোটিফ নিয়ে বিশাল সব ছবি এঁকে ভরে দিয়েছে । ৎভেরস্কায়ার পুরো একটা ব্লক জুড়ে শোভা পাচ্ছে ফিউচারিস্ট শিল্পীদের পেইন্টিং । সব মিলিয়ে আগের মস্কোর একঘেয়ে হলুদ রঙের জায়গায় নানান ঝকমকে রঙের বাহার ।

কিন্তু ছবিগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভেড়ার চামড়ার কোট আর মাথায় রুমাল বাঁধা মহিলাদের দেখে মনে হচ্ছে মধ্যযুগের সাথে আধুনিক মস্কোর মেলবন্ধন ঘটেছে । বেশ কিছু প্রাচীনপন্থী লোক এসব অতি আধুনিক শিল্পীদের কার্যকলাপে বিরক্ত । সাধারন মানুষ বুঝতে পারে এমন জিনিস আঁকা উচিৎ দাবী করে ওরা ।

সে সন্ধ্যায় ন্যাশনাল হোটেলে, বুড়ো রাইনস্টাইনের সাথে আলাপ হল আমার । রাইনস্টাইন, আমেরিকান সোশ্যালিস্ট লেবার পাটির্র সদস্য, বিপ্লবের নাড়ি-নক্ষত্র জানেন । কম করে হলেও রাইনস্টাইনের বয়স সত্তর, কিন্তু এখনো মস্কো সোভিয়েত বা নির্বাহী কমিটির কোন মিটিং মিস করেন না তিনি । সকাল সাতটায় মস্কোর এ মাথা থেকে ও মাথা ঘুরে বেড়ান, নতুন সোভিয়েত বাহিনীর অফিসারদের উদ্দেশ্যে লেকচার দেন ।

ইংরেজ যুদ্ধবন্দীদের ভাগ্য তাঁরই হাতে বলা চলে । ওদের বলশেভিক হবার কোন আশা তিনি দেখেন না । আমার সাথে করে কোন আমেরিকান পত্রিকা আনিনি দেখে তিনি দুঃখ করলেন । মস্কোতে যোগাযোগ বিভ্রাট নিয়ে তিনি অভিযোগ করলেন, বোধহয় সেদিন তিনি তৃতীয় ব্যাক্তি যে ওই প্রসঙ্গ তুলল । রাজনৈতিকভাবে সরকার তার অবস্থান শক্ত করতে পেরেছে বলেই তিনি মনে করেন, যদিও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ । ট্রেনের অভাবে খাদ্যশস্য শহরে এসে পৌঁছাতে পারছে না । এসব ব্যাপার রাজনৈতিক প্রভাব ফেলবে ।

ইংরেজ বন্দীদের প্রসঙ্গ তুললেন তিনি এরপরে । মস্কোতে যেসব বন্দী আছে, তাদের বিশেষ পাসপোর্ট ইস্যু করা হয়েছে, তারা শহরের যে কোনো জায়গায় আসতে বা যেতে পারে । আমি অফিসারদের কথা জিগ্যেস করতে তিনি বললেন ওরা কারাগারে বন্দী আছে, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রতিনিধিরা ওদের সাথে দেখা সাক্ষাত করতে পারে। একবার রাইনস্টাইন আরখাংজগেল ফ্রন্টে একজন আমেরিকান আর একজন ব্রিটিশ বন্দী অফিসারকে নিয়ে গেছিলেন ওখানকার কোনো ফ্রন্টে একটা বিশেষ সাক্ষাৎকারের জন্য ।

একটা সেতুর মাঝখানে তাদের কথা হলো, রাইনস্টাইনের সাথে দু'জন রাশিয়ানও ছিল । ওদিকের আমেরিকানটা রাইনস্টাইনকে বলল তাদের এলাকায় যেতে । ও একটা হলফনামাও লিখে দিলো যে রাইনস্টাইনের কোন ক্ষতি হবে না (একজন রুশ সৈন্যের তার পিঠটা টেবিল হিসেবে ব্যাবহার করতে দিল) । সন্ধ্যায় যখন যাবার সময় হলো তখন আমেরিকানটা দুই বন্দী (আমেরিকান আর ব্রিটিশ) কে থেকে যেতে বলেছিল । কিন্তু ওরা রাইনস্টাইনের সাথে সেতু পার হয়ে রুশ এলাকায় চলে এল । হলফনামাটা আমাকে দেখালেন রাইনস্টাইন ।

শুনলাম পরদিন নাকি ন্যাশনাল হোটেলের এক গেস্ট চলে যাবে, মানে আমার একটা কামরা পাওয়ার আশা আছে । রাইনস্টাইনের কাছ থেকে ফিরে, কাপড়চোপড়ের পাহাড় বানিয়ে তার ভিতরে সেঁধিয়ে আবার ঘুমাতে চেষ্টা করলাম আমি ।

পরদিন ন্যাশনাল হোটেলে গিয়ে খোঁজ নিতেই কামরা পেয়ে গেলাম আমি । রুমটা চমৎকার, কিচেনের ঠিক পাশে বলে বেশ আরামদায়কভাবে গরম । তবে একশো গজ দূরের পুরনো হোটেল থেকে আমার জিনিসপত্র আনতে চল্লিশ রুবল গুনতে হলো । কিছ বই কিনলাম, যে সব মানুষে রসাথে দেখা হওয়া দরকার তাদের একটা তালিকা বানালাম ।

ঘরটা চমৎকারভাবে পরিচ্ছন্ন । সকালবেলা যে পরিচারিকা এখানে ঘর পরিস্কা করে সে যে কাজে ফাঁকি দেয় না, বোঝাই যায় । মেঝেতে দেশলাইয়ের কাঠি ফেলতে আমাকে বকা দিল সে । নতুন সরকার কেমন কাজ করছে জানতে চাইলাম আমি, মেয়েটা বলল খাবারের অভাব খুব বেশি, তবে পরিস্থিতি আগের থেকে ভাল ।

বিকালবেলায় আমি নীচতলায় হোটেলের মূল কিচেনে নামলাম। সেখানে গরম পানির ঢালাও বন্দোবস্ত আছে । একটা কিচেন শুধুমাত্র হোটেলের লোকজনের ব্যাবহারের জন্য । একদল লোক স্টোভ ঘিরে দাঁড়িয়ে । ওদের মধ্যে একজন ধূসরচুল কসাককে দেখলাম । কসাক বুলেটখচিত লম্বা ঝুলের সরু কোমরের কাল কোটের নীচে লাল টিউনিক পরে আছে । সু্যুপের বাটি গরম করছে সে, পাশে এক চশমা পরা সোভিয়েত সদস্যও খাবার গরম করছেন । দুটো ছোট মেয়ে পুরনো কৌটার মত্যে আলু সিদ্ধ করছে । চুলে নীল রুমাল বাঁধা একজন মহিলা কাপড় ইস্ত্রি করছেন । কেউ সম্ভবত বড় কড়াইটাতে কাপড় সিদ্ধ করছে ।

সারা হোটেল থেকেই মানুষ, কেটলি, জগ এমন কী কৌটা নিয়ে আসছে গরম পানি নেবার জন্য । কিচেনে এক পাশে খাটো একটা কাউন্টার মত রাখা, সেখান থেক সবাই টিকেট দেখিয়ে খাবার নিচ্ছে পাত্রে । রেঁস্তোরায় না গিয়ে সবাই নিজের কামরায় গিয়ে খাবে । হতে পারে ওদের ধারনা এভাবে ওরা বেশি খাবার পাবে । আমার সেরকম কিছু মনে হলো না । তাছাড়া আমার কাছে কোন সসপ্যান ছিল না ।

আমাকে তাতে সপ্তাহের দিনগুলো ছাপানো একটা কার্ড দেয়া হয়েছিল । দিনে একটা করে ডিনার পাবো আমি । খাবার দেয়ার সাথে সেদিনের নাম লেখা কাডের্র অংশটুকু ছিঁড়ে নেয়া হলো । ছিল একবাটি স্যুপের সাথে মাংস বা মাছের একটা পদ । খাবারের দাম পাঁচ থেকে সাত রুবলের মধ্যে ।

খাবার পাওয়া যেত দুপুর দুটো থেকে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে । সকাল বেলাটা ক্ষুধার্ত অবস্থায় কাটিয়ে দুপুরে আমি এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হতাম যে যেকোনো আমি খেতে পারি । এই আশ্বাসের বশবর্তী হবে আমি খাবারে সময় পিছিয়ে দিতাম এবং প্রায় সন্ধ্যা ছয়টায় সময় ডিনার সারতাম । বাইরের লঙ্গরখানাগুলিতে খোঁজ নিয়ে দেখলাম ঠিক একই খাবার একই পরিমানে দেয়া হয় সেখানে ।

একধরনের সহজ সমবায় ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেখানে । একদিন সিঁড়ির উপর নোটিশ দেখা গেল, সবাইকে হোটেল কমিটি থেকে এক বয়াম জ্যাম দেয়া হবে । আমিও জ্যাম পেলাম, আরেকদিন মিলল খানিকটা উক্রাইনিয়ান সসেজ ।

কার্ড ছাড়াও রাস্তায় গলা কাটা দামে খাবার পাওয়া যায় । খাবারের দামের পার্থক্যটা বোঝার জন্য নীচের তুলনাটাই যথেষ্ট হবে । কার্ড অনুযায়ী এক পাউন্ড রুটি এক রুবল বিশ কোপেক, বাইরে ১৫-২০ রুবল । চিনি কার্ডে বারো রুবল, বাইরে পঞ্চাশ রুবল । এর মানে হচ্ছে কার্ড পদ্ধতি তুলে দিলে ধনীরা জিনিস পাবে, তবে গরিবের ভাগ্যে কিছুই জুটবে না । তবে একজন আমাকে বলেছিল কার্ড অনুযায়ী যদি যথেষ্ট জিনিসের সরবরাহ থাকে তাহলেই ফটকাবাজি কমে যাবে । কেউ যদি ১.২ রুবল দিয়ে রুটি কিনতে পারে তাহলে সে কেন আরো চোদ্দ রুবল বেশী খরচ করে বাইরে থেকে রুটি কিনবে ? যুদ্ধ শেষ হলে আশা করা যায় পরিস্থিতির উন্নতি হবে ।

মস্কোতে যে দুর্ভিক্ষ চলছে তাতে কোন সন্দেহ নেই । এখানে আশার তৃতীয় দিনে আমি একজন লোককে স্লেজভর্তি করে ঘোড়ার মাংস নিয়ে যেতে দেখেছি । মাংসের চেয়ে হাড়ের পরিমানই বেশি, খুব সম্ভবত মরে যাওয়া স্লেজটানা ঘোড়া থেকে নেয়া হয়েছে । ও যখন স্লেজটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল একদঙ্গলো কালো কাক স্লেজটাকে অনুসরণ করছিল । কাকেদের এমনই দুরবস্থা এখন যে কিছু কাক আমার ঘরের সরু ভেন্টিলেটর ঠেলে ঢুকে পড়ত কিছু খাবার আশায় । যুদ্ধের আগে অসংখ্য কবুতর চড়ে বেড়াতো, ধর্মীয় কারনে মানুষ মারত না ওদের; এখন সম্পূর্ণ অদৃশ্য ।

ঠান্ডার ব্যাপারেও কিছু বলবার নেই । যখন দেখলাম পররাষ্ট্র দফতরের লোকেরাও আমার মতই কষ্টে আছে তখন ক্ষোভটা একটু কমল । এমন কি ক্রেমলিনের আরকাইভ রক্ষককেও দেখতাম ভেড়ার চামড়ার কোট গায়ে দিয়ে মাঝে মাঝে প্রায় জমে হাত চাপড়ে গরম করতে । যেমনটা আগেকার দিনে লন্ডনের ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের করতে দেখতাম ।
 

পর্ব

 

শান্তি প্রস্তাব

 

প্যারিস পিস কনফারেন্সের তরফ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে রুশ সরকারের প্রতিনিধিদের বসফোরাস প্রণালীর কোন দ্বীপে গিয়ে আলোচনা করার জন্য । যেহেতু সোভিয়েত সরকারকে সরাসরি আমন্ত্রণ জানানোও হয় নি তাই চিচেরিনকে প্যারিসের একটা বামপন্থী পত্রিকা থেকে প্রস্তাবের খুঁটিনাটি বের করতে হলো । শেষ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারীর ৪ তারিখে মিত্র পক্ষের কাছে একটা লম্বা চিঠি দিলেন । যদিও এরকম প্রস্তাবের পক্ষে অনেকের সায় ছিল না, তবু মেনশেভিকরাও সমর্থন করল এ প্রস্তাব । ফেব্রুয়ারীর ১০ তারিখে নির্বাহী কমিটি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করতে বসল ।

চিচেরিন বললেন সোভিয়েত সরকার যদিও আগের চেয়ে সংহত অবস্থানে আছে তাহলেও তারা যুদ্ধ বন্ধ করতে আগ্রহী । এমন কি এজন্য বড় রকম ছাড় দিতে রাজী আছে তারা । ছাড়গুলো হচ্ছে আগের ঋণ শিকার করে নেয়া, যদিও তা এই মুহূর্তে শোধ দেয়া খুবই কঠিন ব্যাপার হবে । খনিজ, বনজ ও অন্যান্য কাঁচামালের যোগান নিশ্চিত করা । এমন কি মূল ভূখন্ডের কিছু অংশ ছেড়ে দিতেও তারা রাজী ।  শেষ ইস্যুটা অত্যন্ত তিক্ত বিতকের্র সৃষ্টি করল । অবশ্য সম্পূর্ণ বোঝাপড়াটা সমারিক অবস্থানের উপরই নিভর্র করবে । সোভিয়েত সরকারের বর্তমান পরিস্থিত সম্বন্ধে চিচেরিন আশাবাদী চিত্র আঁকলেন ।

ফেব্রুয়ারীর ৫ তারিখে বিবৃতিটা কাগজে আসার সাথে সাথেই আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ালো সেটা । বিপ্লবের জঙ্গী রূপ নিয়ে সাধারন মানুষের মধ্যে কোন সংশয় ছিল না । বেশিরভাগ মানুষই শান্তি চাইছিল । একই সাথে যুদ্ধ আর বিপ্লব চালানো খুব কঠিন ব্যাপার । বিপ্লবের আঠারো মাস পরে রুশ নেতৃত্ব এখন গোটা দুনিয়াতে বিপ্লব সৃষ্টির আগে মস্কোর রুটি সরবারাহ নিশ্চিত করতে চান । কেন্দ্রীয় সোইয়েত কী বলে আমি জানতে আগ্রহী ছিলাম ।

হোটেল মেত্রোপোলের বড় হল ঘরটাতে কমিটির বৈঠক বসল বরাবরের মতই লেট করে । একদম ঘড়ির কাঁটা ধরে এসে দেখি হলটা প্রায় ফাঁকা । পাশের কামরায় কমিউনিস্ট পাটির্র একটা মিটিং চলছে । হল ঘরটা ঠিক আগের মতই আছে, এক মাথায় লাল ব্যানার টানানো, তাতে দুনিয়ার সব প্রোলেতারিয়েতকে এক হতে বলা হচ্ছে । ঘরটা যখন মানুষজনে ভরে উঠল, তখন পুরনো পরিচিতদের অনেকের সাথে দেখা সাক্ষাৎ হল আমার ।

অত্যন্ত পুরনো কোট আর ছোট একটা ফারের কালো হ্যাট পরে চশমার ফাঁক দিয়ে চোখ মিটমিট করতে করতে বুড়ো প্রফেসর প্রোক্রোভস্কি ঢুকলেন শরীরের পিছনের দু'হাত রেখে । ব্রেস্ত আলোচনার সময় শেষ দেখেছিলাম আমি তাঁকে । আমি ভেবেছিলাম তিনি আমাকে চিনতে পারবেন না, কিন্তু সোজা এগিয়ে এসে আমাকে মনে করিয়ে দিলেন যখন মনে হয়েছিল পেত্রোগ্রাদ জার্মানরা দখল করে ফেলবে । তিনি জানালেন যে যুদ্ধের শুরুটা নিয়ে তাঁরা অনেক লেখালেখি করছেন, সেখানে ইংল্যান্ড অনেকটা ভালভাবে দেখানো হয়েছে, কিন্তু ফ্রান্স আর রাশিয়ার উদ্দেশ্য ও কর্মকান্ডের উপর খুব খারাপ ছায়াপাত ঘটেছে ।

দেমিয়ান ব্লেদনি এলেন, আগের চেয়ে মোটা হয়ে গেছেন তিনি (গ্রাম থেকে তাঁর ভক্তরা নাকি খাবার পাঠায় তাঁকে) । গোল মুখ, হাসিখুশি চোখ আর সন্দিগ্ধ একজোড়া ঠোঁট, পুরোদস্তুর চাষী এবং বিপ্লবের একজন কবি । দায়সারা ভাবে শেভ করেছেন তিনি, হলদে গোঁফজোড়া ছোট করে ছাঁটা, চামড়ার ট্রাউজার পরে আছেন তিনি । একসময় প্রাভদা আর অন্যান্য পত্রিকায় তাঁর প্রহসন-মূলক কবিতা পড়েছি আমি । তিনি জানালেন তাঁর বইটার আড়াই লাখ কপি ঠিক দু'সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে, এবং তাঁর পোট্রেইট আঁকছে একজন সত্যিকারে শিল্পী ।

মাদাম রাদেক এক বছর আগে লিকের স্যান্ডউইচ বানিয়েছিলেন দারুণ । এখন কমিটির প্রধান হিসেবে যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে কথা তুললেন তিনি । কথা শেষ করে আমার পাশে বসলেন তিনি । কর্তৃপক্ষ তাঁকে ক্রেমলিনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বের করে দিয়ে সেখানে মিউজিয়াম করতে চায় জানালেন তিনি । এটা হচ্ছে তাঁকে ক্রেমলিন থেকে বের করে দেয়ার স্রেফ একটা অজুহাত । মাদাম ত্রতস্কি আসলে মাদাম রাদেক আরেকটু ভাল বাসায় আছেন সেটা সহ্য করতে পারছেন না ।

ঘরটা একটু একটু করে ভরে উঠছিল মানুষজনে । লিতভিনভকে আমি জিজ্ঞেস করলাম উনি বক্তৃতা দেবেন কিনা । এমন সময় লম্বা চুল ছোটখাট একজন লোক ছুটে এসে আমাকে সোভিয়েত ইউনিয়নে আবিষ্কৃত দেশলাই দেখালো । রাশিয়াতে দেশলাই বানাবার কাঠের বা প্যারাফিনের সাংঘাতিক অভাব, দেশলাই সাধারনত ফিনল্যান্ড থেকে আমদানী করতে হয় । এই বিশেষ দেশলাইটা কাঠের বদলে ফেলে দেয়া কাগজ আর বারুদের জায়গায় প্যারাফিনের বদলে ভেড়ার পশম ধোয়ার সময় যে তেলালো জিনিসটা বের হয় তা দিয়ে তৈরী । লোকটার নাম বের্গ, প্রেসিডিয়ামের অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান । আমাকে তিনি এক প্যাকেট দেশলাই উপহার দিলেন । দেশলাইয়ের কাঠিগুলো সব একসাথে লাগানো, জ্বালাতে হলে ভেঙ্গে নিতে হয়, অনেকটা প্যারিসের দেশলাইয়ের মত । আমাকে বের্গকে বললাম আমি এটা প্যাটেন্ট করে নিজেই উৎপাদন করব । আশপাশের লোকেরা হেসে উঠল আমার কথা শুনে ।

ইযভেস্তিয়া পত্রিকা থেকে স্তেকলভ, মাদাম কোলোনতাই এবং আরোপ অনেক লোক এসেছিল যাদের নাম আমার স্মরণে আসছে না । প্রাভদার সম্পাদক বুখারিনও ছিলেন সেখানে। আপনার সাথে যে কোনো দার্শনিক আলাপ করতে তিনি এক পায়ে খাড়া । সে দার্শনিক হতে পারে বার্কলি, লক, বার্গসোঁ বা উইলিয়াম জেমস । তারপর দরজা দিয়ে এলিয়াভা খোঁড়াতে খোঁড়াতে ঢুকলেন । তিনি আমাকে মনে করিয়ে দিলেন গত গ্রীষ্মে যখন তিনি আমাদের সাথে দেখা করেন তখন তিনি আমাদের প্রত্যেককে গোল্ডেন অ্যাংকর হোটেলে পনেরোটা করে ডিম খেতে দেখেছিলেন । গত গ্রীষ্মে আমি আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মি. লিন্ডলের অনুবাদক হিসেবে কাজ করছিলাম । রাদেক বলেছিলেন যে এলিয়াভাকে আবার তিনি জীবিত দেখবেন তিনি এরকম আশা রাখেন না ।

প্রেসিডিয়ামে সামান্য কোলাহল দেখা গেল । আভানাসিয়েভ সেক্রেটারির আসন নিলেন, স্ভের্দলভ বললেন 'এবার কমরেড চিচেরিন বলবেন ।'

চিচেরিনের ভাষণটাকে বলা যায় বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি বিষয়ে একটা সাধারন রিপোর্ট দিলেন তিনি । শান্তি আনার জন্য সোভিয়েত সরকার কী কী করছে বললেন তিনি সবিস্তারে, প্রেসিডেন্ট উইলসনের কাছে পাঠানো টেলিগ্রামের কথা বললেন তিনি । যে কয়টা দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়েছে তাদের প্রত্যেকটা দেশ সম্বন্ধে বিশ্লেষন করলেন তিনি ।

চিচেরিনকে দেখে মনে হচ্ছিলো ভীষণ ক্লান্ত তিনি । অধস্তনদের হাতে কিছু দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কৌশলটা তিনি এখনো আয়ত্ব করতে পারেননি । তাকে 'গুডমর্নিং' বলতেও সংকুচিত বোধ করবেন আপনি, এত ক্লান্ত মন হয় তাঁকে সারাক্ষণ । শোনা যায়, মানুষের অবাঞ্ছিত দেখা সাক্ষাত এড়াতে রাতের বেলা কাজ করেন তিনি । তিনি যে রিপোর্টটা পেশ করেছিলেন তা অত্যন্ত কৌতুহল উদ্দীপক হলেও যেভাবে তিনি বলছিলেন তাতে কারো উৎসাহ বোধ করার কথা নয় ।

এর পরে বললেন বুখারিন । বাদামী পোশাক পড়া এ লোকটার সাথে আমার বার্লিনে অর্থনৈতিক সন্মেলনে দেখা হয়েছিল । যাহোক চিচেরিনের চেয়ে স্পষ্ট গলায় কথা বললেন তিনি । বর্তমান পরিস্থিতিকে তিনি ব্রেস্ত চুক্তির আগের মুহূর্তের মত বলে মন্তব্য করলেন । তারপর বললেন লীগ অব নেশন্স আসলে মস্ত বড় পুঁজির সিন্ডিকেট । ইউরোপের পুঁজির অবস্থা খুব নাজুক, আমেরিকানরা এমন একটা সংস্থা বানাতে চাইছে যেটা পুরো ইউরোপকে নিয়ন্ত্রণ করবে । তিনি বললেন, মিত্রপক্ষ তাদের দাবী দাওয়া পেশ করুক । রাশিয়া যত মূল্যই দিতে হোক শান্তি 'কিনে' নেবে ।

বুখারিনের পর লিতভিনভ বক্তব্য রাখলেন । ধূসর ফারের হ্যাট মাথায় গোলগাল হাসিখুশি মানুষ । উঠে দাঁড়ানোর সময় চশমাটা পিছলে নীচে পড়ে যাচ্ছিল । শুরুতেই ফ্রান্সকে দোষারোপ করলেন তিনি । ফ্রান্সের একগুঁয়েমির জন্যই যুদ্ধটা এখনো চলছে, আমেরিকান যুদ্ধ থামাতে আগ্রহী ।

সবশেষে মস্কো সোভিয়েতের প্রধান কামেনভ উঠে দাঁড়ালেন । ব্রেস্ত চুক্তির সাথে বর্তমান পরিস্থিতির তুলনার বিরোধিতা করে বললেন তিনি রুশ ঐক্য কেবল সোভিয়েত সরকারের অধীনেই সম্ভব । উক্রাইন গত পনেরো মাসে প্রায় সমস্ত শক্তিরই পদানত ছিল । জার্মান, প্রাক্তন বুর্জোয়া এবং আবার সোভিয়েত শাসন । সময় আসছে যখন পাশ্চাত্যের শক্তিগুলোকে সোভিয়েত সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় থাকবে না ।

সভা শেষে বিনা প্রতিবাদে শান্তি প্রস্তাব পাশ হল । সাথে 'সমস্ত লাল ফৌজের সৈনিকদের' ধন্যবাদ প্রস্তাব দিয়ে সভা ভেঙ্গে গেল । গত বছর জার্মানদের সাথে করা 'ব্রেস্ত চুক্তির' থেকেও বড় ছাড় দিতে হবে এবার রাশিয়াকে যাতে আমারিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর জাপান তাদের হস্তক্ষেপকারী বাহিনী সরিয়ে নিয়ে যায় ।

পড়ন্ত তুষারের মধ্যে দিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে হেঁটে চললাম আমি । আমার সামনে দুই শ্রমিক তর্ক করছে । 'আসলে দুর্ভিক্ষই বাধ্য করেছে সরকারকে এমন প্রস্তাব দিতে,' একজন বল আরেকজনকে । 'খাবারের অভাব কী কখনো মিটবে এই দেশে?' অন্যজন জানতে চাইল ।

 

      

 

শেষ