সাধারণ নিয়মেই উত্তরসূরীরা তাদের পূর্বসূরীদের চেয়ে জ্ঞানী
ভাবেন। কারণও আছে, সময় তাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে। তো আমাদের পরিবারে
ব্যাপারটা আরো জটিল। জেনেটিকালি আমি, আমার বাবা, দাদা ও তস্য বাবা সকলেই
বংশের বড় ছেলে এবং একই সঙ্গে বাবা যা বলবেন তার উলেটা পথে যাত্রা।
দাদুর বাবা চেয়েছিলেন ছেলেকে নিজের কাঠ, সুপারি-পান ব্যবসায় লাগাতে, উনি
স্কুলে ভর্তি হলেন এবং মৃতু্যর আগ পর্যন্ত শিক্ষক হিসেবেই তার কর্তব্য পালন
করেছিলেন। আমার বাবাকে নিয়ে তার সাধ ছিল, ছেলেকে তালেবে এলেম বানাবেন। বাবা
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পিতৃভক্ত থেকে বাড়ি থেকে পালালেন। শেষ পর্যন্ত হলেন
ডাক্তার। ওনার সাধ আমিও তার মতো হই। কিন্তু আমার ইচ্ছে ছিল কম্পিউটার
ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। বুয়েটে টিকিনি, কিন্তু ছোট মামা ফ্লোরিডায় সব ব্যবস্থা
পাকা করার পরও আমাকে জোর করে রেখে দেওয়া হলো তার সাধ মেটাতে। কিছুই হলো না।
আমিও নিহিলিজম কার্যকর করলাম পেশা বদলিয়ে।
যাহোক, একটা ব্যাপারে আমার বাবার ওপর তুমুল শ্রদ্ধা, সেটা মুক্তি যুদ্ধের
জন্য। উনি বন্দুক হাতে নেননি, কিন্তু যেভাবে সম্ভব, তার সাধ্যের মধ্যে
তাদের সাহায্য করেছেন- এমনকি একবার প্রাণ বিপন্ন হওয়ার পরও। লেখার আরম্ভ
১৯৮৫; ১৯৮৮ সালে বাবা 'যাদের রক্তে মুক্ত এ দেশ' পাণ্ডুলিপিতে হাত দেন।
কোথায় চেম্বার কোথায় প্র্যাকটিস, ঘরে চুলা জ্বলে কি জ্বলেনা। বাবা কোত্থেকে
একটা টাইপরাইটার এনে খটখটাখট চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি তাকে বললাম, তুমি নতুন কী
দিচ্ছ যা অন্যরা দেয়নি? কারণ রেফারেনসের পর রেফারেনস লাগছে তোমার কথাগুলো।
বরং তুমি একজন বুদ্ধিজীবি হিসেবে যুদ্ধের সময়কার অভিজ্ঞতার কথা লিখ। ওনার
উত্তর, আমি কোনো গল্প উপন্যাস লিখছি না। এটা ইতিহাস, আর সেটা সত্যি বলেই
বাজারে আরো ১০০ বইয়ের সঙ্গে এর অমিল পাবি না হয়তো। কিন্তুআমি এভাবেই লিখব।
তর্ক ওখানেই শেষ। যাহোক, দুবছর প্যারালাইসিসে ভুগে ২৪ জুলাই ২০০৫ -এ মারা
গেছেন বাবা। তার আগেই শেষ করে গেছেন ইংরেজি ও বাংলায় তার পান্ডুলিপি। উনি
উর্দু এবং ফার্সিতেও সমান পারদর্শী ছিলেন।
যাহোক, পাণ্ডুলিপিটি কম্পিউটারে কম্পোজ করতে গিয়ে আমার জানি কেমন কেমন লাগছে।
কিন্তু দলিল তো দলিলই। বিভ্রান্ত প্রজন্মের চোখ খুলতে একটু যদি কাজে লাগে
বাবার কোনো রেফারেনস, স্বর্গ থেকে নিশ্চয়ই তৃপ্তির হাসি হাসবেন।
আমি এতে কিছু ছবি যোগ করেছি যা বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রনালয় থেকে
প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র বইটি থেকে নেওয়া হয়েছে।
ধন্যবাদ সবাইকে।
অমি রহমান পিয়াল
১৯ শে মার্চ, ২০০৬