জবান বন্দি
ফিরোজা হারুন
এ গল্পটি 'জীবনেরে কে রাখিতে পারে' গল্পের পরিপূরক যাতে ছিল স্ত্রীর বক্তব্য আর এ গল্পে স্বামীর জবান বন্দি। এ গল্প দুটি একই ভাবধারা বহন করছে। গল্প দুটি নিছক কাল্পনিক। কোন ঐতিহাসিক চরিত্র নির্ভর নয়। কিম্বা কোন বাস্তব ঘটনার ছায়া অবলম্বনেও নয়। আবহমান কাল ধরে নারী পুরুষের জটিল সম্পর্ক নিয়ে এ গল্প দুটি লেখা। স্থান কাল অতিক্রম করে এ পাত্র পাত্রী চিরকাল নীড় রচনা করবে, হাসবে,কাঁদবে। উপগ্রহের মত কেউ কাউকে কাছেও টানবে না, দূরেও যেতে দেবে না।
সমাজ সংসারে একজন অপরের সাথে নানারকমক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। বিমল মিত্র বলেছেন, 'তার মধ্যে সবচেয়ে জটিল সম্পর্ক হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক'। বস্তুত স্বামী স্ত্রীর বন্ধন সত্যিই রহস্যময়। পরিবার ও সমাজ মিলে এই সেতুবন্ধন রচনা করে। কিন্তু তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব কার, সে শুধু বিধাতাই জানেন। দায়িত্বটি কার তা যদি মানুষের জানা থাকতো, তবে সব দম্পতিই সুখের সাগরে 'অমল ধবল পাল তুলে' দিয়ে জীবন তরী বেয়ে যেত। আমার লেখা দুটিতে নীলা বিবাহিত জীবনে সুখী হতে চেয়েছিল। সুখে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার তা ছিল। কিন্তু বিধি বাম। তার ভাগ্যে তা জোটেনি। অথচ সুখ তার হাতের কাছেই ছিল, কিন্তু মুঠোর ভেতর আসেনি। অন্যদিকে নায়ক ইলিয়াস খান নীলাকে ভালবাসতে পারেনি তা নয়। সাহস করে ভালবাসা দিতে পারেনি। পাছে নীলা তাকে প্রতারক মনে করে। ইলিয়াস খান সহসী হলে হয়তো তারা জীবনে সুখী হতো, অথবা আরো বেদনা, আরো জটিলতা তাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতো। গল্প দুটি কাল্পনিক হলেও বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটে না তা নয়। কারণ লেখকের অভিজ্ঞতা বাস্তব থেকেই অর্জিত। হয়তোবা কারো জীবনের ঘটনা আংশিক হলেও মিলে যাবে।
জবান বন্দি
১
আমি ইলিয়াস খান। এইটুকু আমার পরিচয় বলার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার পরিচয়ের দুটো দিক আছে। একটি অন্তরের অন্যটি বাইরের। বাইরের পরিচয় দেবার দরকার নেই। কারণ সেটি আপনারা দেখতে পান সবাই জানেন। আমি সুন্দর, সুপুরুষ, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, গম্ভীর। ডাগর আঁখিতে বিদ্যুতের চমক। মেয়েদের কল্পলোকের কাঙ্খিত পুরুষের সঙ্গে আমার যথেষ্ট মিল রয়েছে। সেজন্য আমি মোটেই গর্বিত নই। অন্য পরিচিতি হল আমি শিক্ষিত, বিনয়ী, যোগ্য। আমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য আমি হৃদয়বান। ঝিনুকের পরিপক্ক মুক্তাটির মতো আমার বক্ষপিঞ্জরে সে হৃদয়টির বসবাস। যার হৃদয় আছে তিনিই শুধু তার সন্ধান লাভের অধিকারী।
মলিকে আমি এই মুক্তো অনুসন্ধানের অধিকার দিয়েছিলাম। মলি দক্ষ কারিগর। তার নাগাল পেয়েছিল। আমরা দুজন দুজনকে হৃদয় মন আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলাম। পৃথিবীতে যদি স্বর্গ স্থাপন করা যায় সেই প্রত্যাশা ছিল আমাদের মনে। চেহারা নিয়ে আমার কোন অহংকার ছিল না আগেই বলেছি। কিন্তু মলির ছিল। সে ছিল মোহবিষ্ট। আমার জন্য সে খুব গর্ববোধ করতো। তার হৃদয়ের ঝাঁপিটিও সে খুলেছিল আমার জন্য। দিয়েছিল তার অন্তরের মণি মুক্তার সন্ধান। মনের ভেতরের মনে লুকিয়ে রাখতাম মলির ভাবনাকে। কি যে ভাল লাগতো মলিকে ভাবতে। মলি আমার দিবস মলি আমার যামিনী। মলি আমার আনন্দ, মলি আমার দুঃখ। মলি আমার বর্তমান, ভবিষ্যত সবকিছু। আমার ভিতর বাহির আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এ মলিই। তাই তাকে আমি কখনো যাচাই করে দেখেনি। কখনো তার ভালবাসার গভীরতা মেপে দেখার প্রয়াস পাইনি। পরীক্ষা করে প্রেমের ঘনত্ব মাপলে মলি হয়তো পাসও করে যেত। আমার তা মনে হয়।
মলি আমাকে ত্যাগ করতে পারে এ যেমন কখনো চিন্তা করিনি, আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারে তাও কখনো ভাবিনি। তবুও একদিন সে ঘটনাই ঘটলো। মলি আমাকে ত্যাগ করলো। সত্য যে কঠিন। কত কঠিন তা আমার জানা ছিল না। এ যেন সমস্ত কাঠিন্যকে ছাড়িয়ে গেল। একটি নাটকের ডায়ালগের মতোই মলি তার শেষ উচ্চারণে আমাকে প্রবোধ দিল। আমি ইলিয়াস খান সমাহিতের মতো তার উপদেশ বাণী শ্রবণ করে স্তব্ধ হলাম। প্রতিবাদ করিনি। 'যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে রইবো কত আর।' তবে অনুভূতি চরমভাবে ক্ষত বিক্ষত। আমার দিন রাত্রি, জীবন মৃত্যু দন্ডায়মান হল এক সমতলে। সময় নাকি সব দুঃখ শোক হরণ করে। আমার ক্ষেত্রে সে বড় অনুদার। যতদিন যেতে লাগলো, যন্ত্রণা বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকলো। আমি উপরে নির্লিপ্ত। ভেতরে ক্ষত-বিক্ষত, যুদ্ধরত। কি করে পরিত্রাণ পাই এরকম মানসিকতার হাত থেকে। কেউ কোথাও নেই যে বলে দেবে কোথায় আমার শান্তি।
এই মুহূর্তে অনুভব করছি আমি মলিকে কত ভালবাসি। মলি আমার কে। আমার আকাশ বাতাস লক্ষ লক্ষ মলিতে ছেয়ে আছে। যে দিকে তাকাই কেবল মলি আর মলি। যা কিছু আমার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে তাই যেন মলির রূপ ধারণ করে আছে। চোখ বন্ধ করেও রেহাই নেই। চিত্ত আমার বিকার গ্রস্তের ন্যায়। আমার আত্মা যেন আমার মধ্যে থাকতে চায়না। রঙিন প্রজাপতির মতো কেবল সহস্র মলির পেছনে ধেয়ে যায়।
আমার আর মলির ঘনিষ্ঠতার কথা সকলেই জানতো। মলির আনাগোনা হঠাত বন্ধ হয়ে যাওয়াতে অনেকেই জানতে চাইলো, মলি কোথায়, আসে না কেন? জবাবে বলি মলি খুব ব্যস্ত। সময় করতে পারছে না। আমার স্বভাব গাম্ভীর্য বিষন্নতার রূপ নিল। ভাঙা বুক নিয়ে আমি বন্ধু বান্ধবের সঙ্গ এড়িয়ে চলি। বড় বড় লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করি। বাজার থেকে ভাল ভাল বই কিনে বাসায় বসে বসে পড়ি। এর মধ্যে মলির বিয়ের কার্ড পাই। মলি নিজেই তার নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে আমার বাসায় এলো। মলির হাসি খুশী যেন বাঁধ ভাঙা। কোথাও কোন সংকোচ নেই। দ্বিধা নেই। যেন এতদিন আমরা মঞ্চে প্রেমের অভিনয় করেছি। অনেক সংবাদ দিয়ে গেল মলি আমাকে। বাবা মায়ের কথা তাকে শুনতেই হলো।উপায় ছিলনা। তবে পাত্র ব্যক্তিটি খুবই উপযুক্ত। থাকে সাত সমুদ্রের ওপারে বিলেতে। প্রচুর ইনকাম, উচ্চ শিক্ষিত্, ইত্যাদি। দেখতে শুনতে আমার চাইতে ভাল না হলেও, খারাপ নয় মোটেই। মলির অন্তর যেন মেঘমুক্ত নীল আকাশ। আমি যে মলি বিহনে প্রচন্ড পীড়িত সে কথাটি ওকে বলতে পারলাম না। না বলে হয়তো ভালই করেছি। কারণ তাতে তার অহংকার আরও বৃদ্ধি পেত। আমাদের বাসায় মলির বিয়ের কার্ড তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। তারা মলিকে কপট, নির্লজ্জ, উচ্চভিলাষী মেয়ে বলে কেবল ধিক্কারই দিতে লাগলো। আমি তাদেরকেও বারণ করতে যাইনি।
২
মলির বিয়ের কার্ডখানা সামনেই পড়েছিল খোলা। চোখ পড়ে গেল একবার। চোখ আটকে গেল। ভদ্রলোক সত্যি যোগ্য। বুকের ভেতর যেন হিমবাহের ধ্বস নামছে। চোখে আঁধার, অমানিশার সীমাহীন নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। বায়বীয় পদার্থের মতো তীরবেগে আমি কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকলাম। এত অন্ধকার জীবনে কখনো দেখিনি। এ অন্ধকারকে অতিক্রম করা আমার সাধ্যের বাইরে। বড় অসহায় আমি। কোথায় গিয়ে আমার পতন হবে কে জানে। বেদনার পারাবার পার হয়ে আনন্দের তীর খুঁজে পাওয়া স্বপ্নের মতো। জানি না, কিভাবে কতক্ষণ কোথায় ছিলাম। সম্বিত ফিরে পেতে দেখি আমি নির্জীব হয়ে চেয়ারের একপাশে হেলে আছি। ঘর্মাক্ত কলেবর। বড্ড শান্ত। অনেক পরিশ্রমের পর মানুষের যে অনুভূতি হয়। মন চাইলো মলি এসে স্মিত হাস্যে দন্ডায়মান হোক আমার নয়ন সম্মুখে। তবেই আবার ফিরে পাব প্রাণ। পরক্ষণেই মন বললো, না না, মলিকে আমি আর দেখতে চাই না, কোন দিন না কখনো না।
আমি কথা বলতাম কম। এখন বলি আরও কম। কথা বলতে ভাল লাগেনা। তারচেয়ে চুপ থাকাই শ্রেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী লাভ হয়েছিল আগেই। বিসিএস পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর আমার ভাগ্যেই জুটেছিল। চাকুরীর জন্য দরখাস্ত দিয়েছিলাম নানান জায়গায়। ডাক এসেছে অনেক। যাইনি। এবার এলো চট্টগ্রামের চা বাগান থেকে। অ্যাসিসট্যান্ট ম্যানেজারের পদ। লাফিয়ে উঠলাম আনন্দে। এইতো চাই। ঢাকার বাইরে যাওয়া এখন আমার প্রধান কাজ। অনেকদিন পর অন্তরে আনন্দের জোয়ার এলো। খবরটা বোনকে দিলাম সকলকে দেয়ার জন্য। আমার ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা শুনে সকলের কন খারাপ। সব চাইতে মন ভাল আমার নিজের। অপরিচিত মহলে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবো নতুন করে। এখানে প্রাণ আমার ওষ্ঠাগত। ঘরে বাইরে প্রত্যেকে করুণার দৃষ্টি দিয়ে আমাকে দেখে। মনে মনে বলে আহা! বাসায় আমার জন্য বয়ে চলছে নীরব এক সহানুভূতির বন্যা।
অবশেষে এলো সে কাঙ্খিত ক্ষণ। আমি হাজির হলাম চা বাগানে। সবুজের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দেখি এক বিরাট প্রাসাদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। জনমানবহীন এলাকা। চারিদিক্র সবুজের সমারোহ। সুন্দর, সুবিন্যস্ত। এত সবুজ একসঙ্গে জীবনে দেখিনি। হাওয়া দোল দিয়ে যাচ্ছে গাছের পাতায়। মনের আনন্দের ছুটে বেড়াচ্ছে নানারকম প্রাণী। হথাত অর্থহীন হয়ে গেল আমার অতীত। সব ভুলে গেলাম আমি। অনুভব করলাম এক দুর্লভ সুখ, যা ভাষায় প্রকাশ করা আমার মতো অর্বাচীনের পক্ষে সম্ভব নয়।
একবার আমাদের বাড়ীর নিকটস্থ এক বিরাট বৃক্ষে বজ্রপাত হয়। গাছটি দ্বিখন্ডিত হয়ে একভাগ মাটিতে পড়ে যায়। অন্য অংশটি পুড়ে কালো হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার না ছিল পাতা, না ছিল কোন শ্রী। মলিকে হারাবার পর নিজেকে মনে করতাম ঐ গাছটি। ঝলসে যাওয়া বৃক্ষটি যেন আমার অন্য একটি রূপ। আজ চা বাগানে এসে মনে হল আমার সেই মরা গাছের ডালে যেন অতি সূক্ষ্ম কচি পাতার আবির্ভাব সমাগত।
অফিসে অনেক কাজ। এসিসট্যান্ট ম্যনেজার আমি। অফিস ঝকঝকে পরিষ্কার।অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো। যেখানে যে জিনিসটি থাকা দরকার তাই থাকে। বাইরে চমতকার চা বাগান। বাগান যে এত সুন্দর সুসজ্জিত হতে পারে তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। বাগান করাও একপরকার শিল্প। তারমধ্যে কাব্য আছে, কল্পনা আছে। না হলে ফুল পাতা ঘাস দিয়ে এমন সৌন্দর্য সৃষ্টি হত না। অদূরে পাহাড়। মাটির পাহাড়। আর টিলাময় চা গাছে সারি। মাঝে মাঝে উঁচু উঁচু খাকড়া মাথার বৃক্ষ। নাম তাদের শেইড ট্রি। সবুজ মখমলে ঘেরা নয়ন জুড়ানো দৃশ্য মনের সংকীর্ণতা ঘুচিয়ে দেয়। আমার অতীত যাতনায় পিষ্ট জীবন কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সূচনা হলো নতুন জীবনের। এখানে লোকজন নেই তা নয়। লোকজন অনেক আছে। আমার মতো অনেকে। আর আছে অসংখ্য কুলি-কামিন। কেবল একটা জিনিস নেই। সেটা হলো কোলাহল। পরিবেশ শব্দহীন। বেল টিপলেই আলাদিনের দৈত্যের মতো কেউ এসে হাজির হয়। নিঃশব্দে সব কাজ করে দিয়ে যায়। প্রথম প্রথম অন্তরে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করি।
কাজ শেষে বাংলোতে ফিরি।নিস্তব্ধ বাড়ী। নির্জন নয়। আমার একটুও খারাপ লাগেনা। আমি বোধহয় এইই চেয়েছিলাম। এসে টেইপ রেকর্ডারে পছন্দের গান লাগিয়ে দিই। তাছাড়া আছে রেডিও টিভি আর পত্র পত্রিকা। বই তো আমার নিত্য সঙ্গী। হ্যারল্ড রবিনস্ সহ অন্যান্য বিদেশী লেখকদের বই পরার এক বিশেষ সুযোগ। চা বাগানের কর্তা ব্যক্তিরা আগে বিদেশী ছিল। তাই লাইব্রেরী গুলো ভাল ভাল বইয়ে ভরা। বাগানের ভিতর সরু রাস্তা ধরে বিকেলে ভ্রমনে বের হই। মাঝে মাঝে শহরের ক্লাবে যাই। সেখানে দেখা পাই অনেক বিচিত্র মানুষের। আমার ভাল লাগে তাদের। মানুষ দেখা আমার চরিত্রের একটা বিশেষ দিক। এভাবে কেটে গেল কয়েকটি বছর।
৩
আমি এখন ম্যানেজারের পদে কাজ করি। কখনো ঢাকায় যাই আমাদের বাসায়। সেখানে মা, বাবা, এক ভাই আর দুই বোন থাকে। ভাই পাস করে বেরিয়েছে। বোনেরা কলেজে পরছে। এরকম সময়ে একবার আমার মা আমাকে একটি মেয়ে দেখার অনুরোধ জানান। মলির কথা মনে পড়ে যায়। হঠাত দীর্ঘ দিন পরে বক্ষের অভ্যন্তরে একটা মৃদু বেদনা সেতারের একটি তার ধরে বাজতে থাকে। বিয়ের কথা কোনদিন চিন্তা করিনি। তাই মায়ের প্রস্তাবে সহসা কোন উত্তর দিতে পারিনি। তার পরদিন আমার মা আবার আমাকে বিয়ে করবার জন্য বলেন। আমার ভাই বোন ও অন্য আত্মীয়রা এগিয়ে এলেন। পাত্রীর গুণের অন্ত নেই। এরকম ভাল মেয়ে আর নেই। অসাধারণ। এ মেয়েই আমার জন্য উপযুক্ত। সকলের আবেদন নিবেদন এবং মা বাবার করুণ অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারলাম না। আরও ভাববার জন্য কিছু সময় চেয়ে চট্টগ্রাম চলে আসি। ইতিমধ্যে একদিন আমার মা এবং বাবা স্বয়ং আমার চট্টগ্রামের বাসায় এসে হাজির। দারুণ ভাবে চমকে উঠলাম আমি। বললেন আমাকে ঢাকায় যেতে হবে। এমন ওকটি ভাল পাত্রী হাত ছাড়া করা যাবেনা। আমাকে না নিয়ে তারা যাবেন না। সুতরাং ছুটি ম্যানেজ করে ঢাকার পথে রওনা হতে হলো।
পাত্রী দেখে বিয়ে করার আগ্রহ আমার কোন কালেই ছিল না। মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ ধরে নিয়ে তাঁরা বিয়ের দিন তারিখ ধার্যা করে ফেললেন। কেন জানি না, শেষ পর্যন্ত আমি বিয়ে করে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম এই বিয়ে, বিয়ের এত অনুষ্ঠান আমার অন্তরে কোন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারলো না। কোন উচ্ছ্বাস বা আবেগের গতি সঞ্চার করতে ব্যর্থ হল। যন্ত্র মানবের মতো আমার আচরণ। সব অনুষ্ঠান শেষে আমার মনে হল আমি একা।কেউ কোথাও নেই। ওই কনেটির পানে আমি একবারও তাকাই নি। তার জন্য আমার কোন দায় নেই। আমি যেন আচ্ছন্নের মতো সব ঘটনা অতিক্রম করে যাচ্ছি। বাড়িতে এত লোকজন, এত কোলাহল কিছুই যেন আমাকে স্পর্শ করছে না।আমার ভেতর কেউ নেই। একদম ফাঁকা।
অবশেষে এলো বাসর ঘর। চোখ ধাঁধানো পোশাকে আবৃত একটি মেয়ে। জবুথবু বসে আছে আমার শয্যায়।আমার কোন ভূমিকা আছে বলে মনে হল না। রাত গভীর হতে চললো তবুও তার কোন নড়ন চড়ন নেই। বিশ্রাম নিতে হবে তাই তাকে শুয়ে যেতে বলে আমিও শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের আনুষ্ঠানিকতার ফলে আমি বেশ ক্লান্ত। সুতরাং নিদ্রার কোলে ঢলে পড়তে বেশী সময় লাগলো না। পরদিন সকালে জেগে দেখি আমার জন্য সকলে নানান উপাদেয় খাদ্য সামগ্রী নিয়ে অপেক্ষা করছে। টেবিলে এত মজার মজার খাবার। উতসবের কেন্দ্রবিন্দু ঐ নবোঢ়া যিনি আমার বিবাহিত স্ত্রী।যার নাম নীলা। এখন তার পরনে আর চোখ ধাঁধানো ভূষণ নেই। তবে অতিশয় মার্জিত সজ্জায় সজ্জিত। সুন্দর বটে, তবে তার চাইতে অধিক যা তা হলো ইস্পাতের মতো ধারালো চেহারা। বুদ্ধির আলোকে উজ্জ্বল মুখশ্রী। সমীহ করার মতো ব্যক্তিত্ব। সাধারন নয়। বাড়ীতে আনন্দ ধারা বইছে যেন। সকলেই সেই ধারায় যেন স্নাত। আমারও মন্দ লাগছে না। হাসি গল্প গানে দিন কেট গেল। আবার রাত। আস্বাভাবিক রাত। দুজনেই একা। ইচ্ছে ছিল দুএকটি কথা বলবো। কথা খুঁজে পেলাম না। কোন এক মেয়ে এসে মলির জায়গা দখল করবে তাও আমাত চেতনায় ছিলনা। কিন্তু একে দেখে আমার হৃদয় কন্দরে কোথায় যেন বিচিত্র বোধ জেগে উঠলো। মেয়েটির প্রতিটি নড়াচড়া, পদক্ষেপ, দৃষ্টিপাত সব যেন তার বুদ্ধর কথা, যোগ্যতার কথা বলে। তাকে আমি কোথায় রাখি। 'আমার এ শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর।' আমি একজন দেউলিয়া হয়ে যাওয়া মানুষ। নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি দেবার কিছু নাই। নেবার অধিকারও আজ আমার জন্য অনধিকার। এ মেয়েকে আমার মা বাবা কি করে আবিষ্কার করলেন। তারা তবে আমাকে যথেষ্ট পদার্থ জ্ঞান করেন। আমাকে সংসারী করার জন্য এ মেয়েকে খুঁজে বের করেছেন।
সেই বিচিত্র বোধ আমাকে বলছে, আমি এই মেয়ের উপযুক্ত নই। একে ধারন করবার মতো ক্ষমতা আমার মত পাত্রের নেই। তাকে আমার ভাল লাগার কথা বলতে যাওয়া মানেই প্রতারনা করা। অন্তর প্রকোষ্ঠে নিমেষে চমকে উঠলো ভবিষ্যত জীবনের প্রতিচ্ছবি। আমি সেখানে প্রতারকের ভূমিকায়। আমি প্রতারক, এ অনুভূতি আমাকে প্রবলভাবে শিহরিত করলো। মলি পরিত্যাক্ত আমি ইলিয়াস খান। কোনদিন নীলাকে বলতে পারবো না আমি তোমার। এ বঞ্চনা, প্রতারণা, মিথ্যাচার। নীলার মতো মেয়ে আমার স্ত্রী হলো কেন। যে কোন একটি সাধারণ মেয়ে, সুখসম্পদের আকাঙ্খা যার প্রবল সে রকম কেউ হতে পারতো আমার স্ত্রী। তার সঙ্গে আমি অন্তত একটি কথা বলতে প[আরতাম। এই মেয়ে সাত রাজার ধন। একটি রত্ন।একে পেতে হলে আমারও কিছু থাকতে হবে। আমি যে সব হারিয়ে বসে আছি। সব দিয়ে ফেলেছি মলিকে। আমি পরিত্যক্ত, বর্জিত। স্থির করতে পারছিনা আমার কি করা উচিত। তাই কোন কথা বলা হলনা আজও।
পরদিন সন্ধ্যায় বৌভাতের অনুষ্ঠান। সেই ধূমধামের বর্ণনায় গিয়ে কাজ নেই। আমার পিতা মাতা আকাশের চাঁদ পেয়েছেন তাদের আকাশের মুঠোয়। তাঁদের ধারণা এই মেয়েটি তাদের কক্ষচ্যুত পুত্রটিকে জাদুর কাঠির স্পর্শে প্রাণবন্ত করে তুলবে। কথা না বলেও আমি উপলব্ধি করতে পারছি এ মেয়ের জন্য অন্তত আমার জন্ম হয়নি। আমি সাধারণ, অতি সাধারণ। মলির মতো একটি মেয়ের সাথে প্রেম করে চোখের উপর পর্দা পড়েছিল। হৃদয়ের উপর পড়েছিল কালো আচ্ছাদন। অন্ধের মতো নিজেকে ভাবতাম হিরো, নায়ক। মলির প্রেম নিয়ে রীতিমতো অহংকার ছিল আমার। এখন দেখছি সে সমস্তই ছিল ছেলেমানুষী খেলা। অর্বাচীনের আত্মপ্রসাদ। অর্বাচীনের খেলা বলেই তা স্থায়ী ছিলনা। কর্পূরের মতোই মিলিয়ে গেল। আসলে তা প্রেম নয়। ওটা ছিল মোহ। নীলাকে দেখে মোহমুক্তি ঘটেছে আমার।
৪
বিয়ের পর আমার এরকম মানসিক পরিবর্তন ঘটবে তা এই কয়দিন আগেও ছিল কল্পনার বাইরে। বিস্মিত আমি আরোও নির্বাক হলাম। ছুটি শেষ হল একদিন। ফিরতে হল চা বাগানে। সেখানে আমাদের জন্য বিরাট আয়োজন। সহকর্মীরা বিপুল উতসাহে সম্বর্ধনা জানাল আমাদের। আমার বাংলো কারো পদস্পর্শে ধন্য হল। চারিদিক আলোয় ভরা। ভৃত্যদের চোখেমুখে আলোর আভা। নীলার আন্তরিক আচরণে সকলেই মুগ্ধ। সহকর্মীরা ও তাদের স্ত্রীরা নীলার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কেবল আমার অন্তরের নিভৃততম প্রদেশে এক খন্ড কালমেঘ ছায়াপাত করে একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলো। এই ছায়াকে অতিক্রক করা বড়ই দুরূহ কাজ।
একটি অপরাধবোধ আমার আত্মাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। আমি আর নীলার সঙ্গে সহজ জতে পারছিনা। ভীষণ ঝড় বইতে থাকে আমার হৃদয় কন্দরে। একই চিন্তা আমাকে ক্ষত বিক্ষত করছে দিবা রাত্র। কি করে নীলাকে বলি আমার কথা। নীলা কিভাবে নেবে এসব কথা। কি হবে তার প্রতিক্রিয়া। আমি তো তার সাথে ভাল ব্যবহারও করিনি। যদি সে প্রচন্ডভাবে ব্যথিত হয়। যদি সে চলে যায়। আমার অপরাধের সীমা পরিসীমা থাকবে না। ওর জীবন নষ্ট হবে। ওদের পরিবারের সম্মান ক্ষুণ্ণ হবে। আমাদের পরিবারের উপর বর্ষিত হবে ঘৃণা আর অভিশাপ। কেন আমি বিয়ের ব্যাপারটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করি নাই। আমি তো সেই মলির মতই। একজনের জীবন নিয়ে খেলায় নেমেছি। মলি প্রতারিত করেছে আমাকে। আমি প্রতারিত করেছি নীলাকে। এখন আমি কি করতে পারি নীলার জন্য। তাবে আমার কোন কাজে সে যেন আঘাত না পায় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিলাম। তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করিনি। বই, পত্র-পত্রিকা, গান , কবিতা যা কিছু আমার পক্ষে যোগাড় করা সম্ভব সবই দিলাম। অফিসের পরে তার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করছি। তার কোন কষ্ট না হয় সেদিকে বাসার লোকদের নজর রাখতে বলেছি। অন্যান্য বেগম সাহেবাদের সাথে মেলামেশা করতে বলেছি। নীলাই আমার সঙ্গে কথা বলে। আমি বলি না। কারণ কথা খুঁজে পাইনা। তবে নীলার কথার উত্তর দেই।
এভাবে পরম অনিশ্চয়তার ভেতর সময় কাটে আমার। উতকন্ঠা আর উদ্বেগের মধ্যে আমার অবস্থান।নীলা তো সাহসী মেয়ে। আমার সাহস নেই। নীলা চুপচাপ বসে নেই। সবকিছু তার অধীনে। সংসার তার হুকুমে চলে। এমন সময়ে একটি দিন এলো । সেই মহাপ্রলয়ের ক্ষণ। নীলা পাশের রিডিং রুমের বইপত্রগুলো বিন্যাস করতে গেল। এই কামরার বইপত্র আমার বয় বেয়ারাদের তত্ত্বাবধানে থাকে। ওরাই গোছগাছ করে পরিপাটী করে রাখে। বাড়ীর সবকিছু শ্রীমন্ডিত হয়েছিল নীলার হাতের ছোঁয়া পেয়ে। বইগুলো গোছাতে গিয়ে সে আবিষ্কার করলো পুরোনো এলবামগুলো। মূর্খ আমি। ওগুলো সরাবার কথা মনে নেই পড়ে নাই কখনো। ওতে ছিল আমার আর মলির অসংখ্য ছবি। বর বড় সাইজের অনেক ফটো। বিভিন্ন পোজের। কত হাসি, কত আনন্দের স্মৃতি ধারণ করে আছে। সত্যি আমি আর মলি কি নেশার ঘোরে দিন কাটাতাম।আমার সুখের দিনের সে আলেখ্য দর্শনে নীলার হৃদয় বিদীর্ণ হল। সব রহস্যের আবরণ ছিন্ন হল।বিস্ময়ে বিমূঢ় নীলা চৈতন্য হারালো।
অল্প সময়ের মধ্যে বয়-বেয়ারা নীলার খোঁজে এসে তাকে এ অবস্থায় আবিষ্কার করলো। ওরা আমাকে ফোনে এ সংবাদ দেয়। আমি বাগানের ডাক্তারকে নিয়ে বাসায় যাই। ডাক্তারের চিকিতসায় নীলা চোখ মেলে চাইলো। সেই রকম মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে ডাক্তার নীলাকে তার সন্তান আগমনের আভাস দিল। ধরা পড়ে গিয়ে আমি যেন কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। আর আমার ভয় নেই। এবার যা হয় হবে। যে গ্লানি আমি বয়ে বেড়াচ্ছিলাম, এতদিন পর তার হাত থেকে নিস্তার পাব। নীলা এইটুকু বিশ্বাস করবে যে আমি প্রবঞ্চক নই। নীলা শিক্ষিতা, বুদ্ধিমতি এই সত্যটুকু উপলব্ধি করবে। নামিয়ে আনবে আমাকে ফাঁসির কাঠগড়া থেকে। এইবার নীলার সেবা শুশ্রূষার ভার আমি নিজে নিলাম। সেবা, যত্ন, নীরব সহানুভূতি আর সান্নিধ্য দিলাম। আমার আর ভয় নেই। মাথা পেতে দন্ড নেব তাও ভাল।
৫
শুনেছিলাম প্রেম একবার আসে জীবনে। আরো শুনে ছিলাম প্রথম দর্শনের প্রেমই যথার্থ প্রেম। এখন মনে হয় ঐসব কথার কথা। কে কবে তার নিজের উপলব্ধি বয়ান করে গিয়েছে তাই সকলে বিশ্বাস করে। আসলে এসব ঠিক নয়। আমার আর মলির প্রেম আজ অর্থহীন অতীত মাত্র। নীলাকে দেখা মাত্র আমার মনে হয়েছে এই মেয়ে যাকে আমি জন্ম জন্মান্তরে খুঁজেছি। এ তো প্রেমের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। নিঃসংকোচে যাকে আমার জীবনের ভালবাসা নিবেদন করা যায়। প্রতিদানে কিছুই চাইনা। শুধু দিতে চাই এজন্মে, পরজন্মে আরোও শতজনম ধরে। আমার কোন অতীত নেই, কোন ভবিষ্যত নেই, আছে শুধু নীলা। আমার দুর্ভাগ্য কোনদিন বলতে পারিনি এসব কথা। মলির দেয়াল এসে সামনে দাঁড়ায়। এ প্রাচীর অতিক্রম করে আমি নীলার কাছে উদঘাটিত হতে পারিনি। পাছে সে আমায় মিথ্যাবাদী ভাবে। আমি জানি প্রচন্ড মোহনীয় এক ব্যক্তিত্বের আড়ালে নীলা একজন অভিমানিনী। তার অভিমান পর্বত সমান। তাই মনের কথা নীরব ভাষায় বলার চেষ্টা করেছি। তবে ভাষা তো মানুষের হৃদয়ের অভিব্যক্তি। ভাষা শ্রুতিগ্রাহ্য বটে। মনের ভেতর দিয়ে মরমে পৌঁছে। ভাষাই যোগাযোগের শ্রেষ্ঠ বাহন। আমার পক্ষে এর সাহায্য গ্রহন করা সম্ভব ছিল না পাছে সবটুকুই হারাই।
নীলা আমাকে মাফ করে দিল। মলিকে সে চিনতো। অনেক কিছু জানতো তাই আমাকে কিছু আর বলতে হল না। আমি আগের চাইতে অনেক সহজ হতে পারছি। যথাসময়ে আমাদের ঘরে একটি শিশুর আবির্ভাব হল। দেবদূতের মতো। আনন্দের আর সুখের জোয়ার এলো বাড়িতে, ঢাকায়, আমাদের দুই পরিবারে। প্রত্যেকে এলো চট্টগ্রামে তাকে দেখার জন্য। ছোট মানুষটিকে কেন্দ্র করে আমার আর নীলার জীবন তরী নতুন খাতে বয়ে চললো। আমরা নিজেদের ভুলে গেলাম। জীবনের নতুন স্বাদ, নতুন অনুভব। এভাবে কিছুদিন পর এলো আমাদের ঘরে নতুন আরেক অতিথি। আমাদের কন্যা। আনন্দ ধারা আবার বইতে থাকলো আমাদের পরিবারে। তার নূপুর পরা পাদ-পদ্মের স্পর্শে আমার অঙ্গন মুখরিত হলো।
দুটি পুষ্প মঞ্জুরীদল মেলতে থাকে ধীরে ধীরে। আমার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। নীলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত, সাবলীল নয়। বাচ্চাদের সঙ্গে তা ছিলনা। আমি ছিলাম তাদের বন্ধুর মত। বাচ্চাদের সঙ্গে আমার এ সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে নীলার সহায়তায়। নীলা অনেক উদার, তার অনেক দয়া। তাই সে ছেলেমেয়েদের ভালবাসবার অধিকার আমায় দিয়েছিল। কিন্তু আমার জন্য চারিদিকে সে সুগভীর পরিখা খনন করে রেখেছিল। ঐ পরিখা অতিক্রম করে তার নিঝুম দ্বীপে আমি ইলিয়াস খান প্রবেশ করতে পারিনি। এদিক থেকে সে ছিল বড়ই অনুদার। কোনদিন আমার কথা একবারও ভেবে দেখতে চাইলো না। সে আমার বাইরেরটা দেখলো। অন্তরের অন্তস্থলে যে মমতার ফল্গুধারা নিরন্তর বয়ে চলেছে, সে দিকে ফিরেও তাকালো না। তার চোখে আমি একজন অপরাধী, অস্পৃশ্য। তাই চিরকাল আসামীর কাঠগড়ায় আমাকে দন্ডায়মান থাকতে হলো। তবে নীলার অন্তরে যাই থাক বাইরের ব্যবহার ছিল চমতকার। আমি কি চাই, কেমন চাই সবই সে জানতো। কোনদিন আমার কাছে সে কিছু চায়নি। দিয়ে গেছে সারাজীবন। আমি যে ভালবাসি এ কথাটি তাকে বলতে পারিনি। সে আমার সব কথা বিশ্বাস করবে ঐ কথাটি বাদে। হয়তো প্রতারণা করছি বলে আমাকে ঘৃণা করবে। তাই সে কথাটি চিরকালের মতো অনুক্ত রইলো।
'দিন যায়, ক্ষণ যায়, বেগে ধায়, নাহি রয় স্থির।' ছেলেমেয়েরা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। তারা দু'জনা আমার, তাদের মায়ের আকৃতি প্রকৃতি বহন করছে। আমাদেরও কম সময় পার হলো না। এমন সময় নীলা আমাকে একটি প্রস্তাব দিল। সে ইংল্যান্ডে তার বড় বোন ইভার কাছে বেড়াতে যাবে। প্রস্তাবটি আমার কাছে মনঃপুত হলো না। নীলা-বিহীন বাড়ি অন্ধকার। বিদেশ ভ্রমণ তো লম্বাই হয়। এতদিন আমি একা কি করে কাটাবো। অন্তর প্রকোষ্ঠের প্রদীপটি কেঁপে উঠলো। নীলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেই এটা নিভে যাবে। সহসা উত্তর খুঁজে পেলাম না। সে তো কোন্দিন আমার কাছে কিছু চায়নি। এবার যখন যেতে চেয়েছে তাকে তো বারণ করা যায় না। আমি জীবনে বহুবার বিদেশে গিয়েছি। নীলা যাবে না ভেবে কখনো তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়নি। এবার আমি ওর সঙ্গে যেতে পারতাম। কিন্তু ও হয়তো পছন্দ করবে না। তাই এ ব্যাপাড়ে কিছুই বলিনি। বললাম শ্যীতের শেষে যেও। শীতের সময়ে বিলেতে খুব ঠান্ডা।
শীত শেষে নীলা ইভার কাছে রওনা হলো। ঢাকা পর্যন্ত সঙ্গে গেলাম আমি আর ইশতিয়াক। ঢাকায় সকল আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা হলো আমাদের। নীলাকে এত উতফুল্ল কখনো দেখা যায়নি। ওর জন্য ভীষণ মায়া হলো। আমার এত্ত কিছু থাকা সত্ত্বেও নীলা আমাকে গ্রহন করতে পারে নি। নীলার মতো ঐশ্বর্যশালী একটি মেয়েকে অধিকার করেও তাকে আমি পাইনি। কেন এই ট্র্যাজেডীর অবতারণা আমার জানা নেই। নির্দিষ্ট দিনে নীলা আকাশ যানে চড়ে সাত সমুদ্র ওপাড়ে চলে গেল। আমরা চট্টগ্রামে ফিরে এলাম। নীলা বাসায় নেই। শূন্য বাড়ি যেন কেউ নেই। আমি কি করে এই কয়েক মাস একা থাকবো ভাবতে পারছি না। তাড়াতাড়ি অফিসে গিয়ে হাজির হলাম। কাজে ব্যস্ত থাকলে নীলার কথা আর মনে পড়বে না।
ছেলেমেয়েরাও একা। বিকেলটা আমাদের ভাল কাটে। ওদের নিয়ে মাঝে মাঝে এদিক ওদিক বেড়াতে যাই। বাসার পশ্চিমদিকে একটি সুন্দর বর্ধিত চক্রাকার বারান্দা আছে। ফুলে আর সবুজ পাতায় ঘেরা চারিদিক। ওখান থেকে সামনে একটি সবুজ প্রান্তর, তারপর একটি রূপালী নদী।তার ওপাড়ে সবুজ পাহাড়। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। এ জায়গাটি বাসায় সকলের প্রিয়। ওই গোল বারান্দায় বসে বিকেলে আমরা চা খাই। ছেলেমেয়েরা ওদের মায়ের কথা বলে। মায়ের লেখা চিঠি পড়ে।
৬
সময় গড়িয়ে যায়। তবে অনেক ধীর। কয়েক মাস। এবার নীলার বাড়ী ফেরার পালা। চিঠি পেলাম নীলার। দিন, ক্ষণ , ফ্লাইট নাম্বার সব জানিয়ে চিঠি দিয়েছে। আমাদের বাংলোর 'রুদ্ধ দ্বারের পল্ললে' জোয়ার এলো। আমাদের খুশী আর বাধা মানে না। যথাসময়ে আমার ঢাকায় যাওয়া স্থির হলো। বাসায় রইলো রত্না আর ইশতিয়াক। আগে ভাগেই আমি এয়ারপোর্টে উপস্থিত। নীলার ভাবীরাও ছিলেন আমার পাশে। নীলার এরোপ্লেন পৌঁছাবার আগেই লাউড স্পিকারে একটি ঘোষণা উচ্চারিত হলো। প্রথম ঘোষণা বুঝতে পারিনি। দ্বিতীয় বারে প্রচন্ড ভাবে চমকে উঠলাম। নীলার প্লেন বিমানদস্যুর কবলে পড়েছে। আতংকে শিউরে উঠলাম আমরা। নীলার কথা ভেবে আমার যে কিরকম কষ্ট হতে লাগলো, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অন্তুর বিদীর্ণ হলো। প্রাণ স্পন্দন থেকে গেল যেন। এ কি হল? কেন হলো? লক্ষ লক্ষ মানুষ পৃথিবীর একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছে সারাদিন। অথচ নীলার বেলায় দস্যুর ছোবল। কার ঘরে জন্ম এ দস্যদের? তাদের জইন্ম গ্রহণ করার কি প্রয়োজন ছিল। জন্মের আগেই তারা মরে যায়নি কেন।
কত কথা যে মনে হতে লাগলো। কয়েকদিন অপেক্ষা করে আমি বাগানে ফিরে যাই।ছেলেমায়েরা বেতার যন্ত্রের সাহায্যে এ খবর পেয়েছিল। ধাকায় মামাদের কাছ থেকে ফোনে সব খবর পায়। ওরাও মারাত্মকভাবে মর্মাহত। কাজেই আমাকে যেতে হলো ওখানে ওদের কাছে। নীলার ভাইয়েরা ঢাকা বিমান বন্দরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। একদি তারা জানতে পারলেন নীলা বেঁচে আছে এবং সপ্তাহ খানেকে মধ্যে আই সি আর সি'র তত্ত্বাবধানে ঢাকায় পৌঁছাবে। আমার মন এতই ভেঙ্গে পড়েছিল যে নীলার মুখোমুখি হওয়ার সাহস ছিল না। হয়তো কেঁদে ফেলবো আমি। তাই স্থির করলাম ইশতিয়াক আর রত্নাই অদের মাকে নিয়ে আসুক।
ওরা ঢাকায় গেল। কয়েকদিন পর নীলাক নিয়ে অনেকে চট্টগ্রামে পৌঁছালো। খবর পেয়ে আমি বাসায় এলাম। দেখলাম আগের নীলা নেই। খুবই অসুস্থ এবং আংশিক পঙ্গু। ওর নার্ভাস সিস্টেম মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠার ক্ষমতা নেই। চেহারা শীর্ণ বিধ্বস্ত। আমার চেতনা লোপ পাওয়ার মতো হলো। অদৃষ্টকে ধিক্কার দিতে লাগলাম মনে মনে। তবুও এর মধ্য সান্ত্বনা পেলাম যে সে বেঁচে আছে এবং আমাদের কাছে ফিরে এসেছে। তার চিকিতসার দিকে মন দিলাম। দেশের সর্বোচ্চ চিকিতসা ব্যবস্থা আমার দরজায় নিয়ে এলাম। কিন্তু আশা দিতে পারলো না কেউ। ধৈর্য্য ধারণ করবার উপদেশ আর সান্ত্বনা ছাড়া আমার ভাগ্যে কিছুই মিললো না।
নীলার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করার চাইতে আমার নিরুদ্দেশ যাত্রা করা উচিত ছিল। কি করে ওকে মরে যেতে দেখবো ভাবতে পারি না। আমি যে বড়কর্তা ইলিয়াস খান । আমি যে রাশভারী। আমার কাঁদতে মানা, দুঃখ করতে মানা, অস্থির হতে মানা। আমাকে সবকিছুতে স্থির অচঞ্ছল স্থবির থাকতে হবে। কিন্তু কোথায় আমার সে শক্তি। আজ আমার ইচ্ছে করছে চিতকার করে ক্রন্দন করি। সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে ফেলি। গৃহত্যাগ করি, সেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। নীলাকে গিয়ে একবার বলি, 'নীলা তুমি বিশ্বাস করো আর নাই করো, একবার আমাকে বলতে দাও আমি তোমাকে ভালবাসি। এর চাইতে বড় সত্য আমার জীবনে আর নাই। তুমি ছাড়া আমার জীবন সীমাহীন শূন্যতায় ভরা, আধাঁরে আচ্ছন্ন। আর কোন নীলা এসে আমার জীবনে তোমার মতো মশাল জ্বালাতে পারবেনা। তুমি অনন্য সাধারণ , অপরূপ। বিধাতা কেনই বা তোমাকে দিলেন, কেনই বা তোমাকে নেবার আয়োজন করছেন। মলির অনেক খবরই তুমি বয়ে এনেছ। মলির কথা জেনে আমার তো আর কোন লাভ নেই।সে তো অন্তরের যাদুঘরে রক্ষিত স্মৃতি মাত্র। তার কথা আমাকে আর বলো না।
তুমি আমাকে অনেক উপদেশ দিলে। তোমার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। তুমি বিহীন আমার সংসার কর্ণধার বিহীন নৌকার মতো। তুমি চিরদিন ছায়ার মতো থাকবে আমার সঙ্গে।
৭
নীলা ধীরে ধীরে শেষ হতে চললো।আত্মীয় আপনজন আমরা সকলেই থাকে ঘিরে।সে সকলের ভীষণ প্রিয়।ছোট বড় সকলেই তার সমান ভালবাসা পেয়েছে। সেই প্রাণবন্ত নীলা আজ প্রাণশক্তির অভাবে ধুকে ধুকে প্রহর গুনছে।
অনেক শক্তি সঞ্চয় করে আমি তার পাশে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি। সাহস যোগাই। একদিন বিকেলে তার অবস্থা সংকটজনক মনে হলো। সে তার ঐ গোল বারান্দাটিতে গিয়ে বসার ইচ্ছা ব্যক্ত করলো। কিন্তু তার পক্ষে আর উঠে বসা সম্ভব ছিল না। আমরা ঘর ভরা লোক তার মুখের উপর ঝুঁকে। নীলার হাত আমার হাতের মুঠোয়। কিন্তু তাকে ধরে রাখতে পারলাম কই। সকলকে ফাঁকি দিয়ে সে অমৃতলোকের সন্ধানে দেহত্যাগ করলো। আমরা গভীর দুঃখে মগ্ন হলাম।
জীবনের কে রাখিতে পারে। আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে, তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে।'
নীলা তার জীবনের বন্দীশালায় নিপীড়িত হচ্ছিল। জীবনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে তাকে মুক্ত করে নিল মৃত্যু। পরপারের অতল অন্ধকারে প্রবেশের ছাড়পত্র পেল সে। হয়তো শান্তির দেশে। জীবন মৃত্যুর এই আলো আধাঁরির হেয়ালি আমার বোধগম্য নয়। তবুও মুক্ত জীবনের সন্ধানে নীলা অনন্তলোকে বিচরণ করুক। তার দেখা হয়তো আমি একদিন পাব। সেদিন হয়তো আজকের এই বিচ্ছেদ বেদনা তুচ্ছে বলে মনে হবে।
***********
লেখক পরিচিতি - ফিরোজা হারুন
জন্মঃ জানুয়ারি ১, ১৯৪৪, ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানার হরিরামপুর গ্রামে। স্নেহময় পিতা জনাব আব্দুস সোবহান বিশ্বাস ও মাতা জুবাইদা খাতুনের ছায়ায় বেড়ে ওঠা।
শিক্ষাঃ ময়মনসিংহ বিদ্যাময়ী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। তারপর টাঙ্গাইলের কুমুদিনী কলেজ হতে বি.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এম. এ. সমাপ্ত করে ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ফর উইমেন থেকে বি. এড. ডিগ্রী অর্জন এবং ঢাকায় আদমজী ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলে যোগদান।
এক কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জননী ফিরোজা হারুনের সাহিত্য অঙ্গনের অগ্রযাত্রার মূলে প্রেরণা যুগিয়েছে তাঁর স্বামী ডাঃ মোহাম্মদ হারুন। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'জীবনেরে কে রাখিতে পারে' সাপ্তাহিক রোববারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশের পর ১৯৯৭ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। আর আন্তর্জালে প্রকাশ পেয়েছে ২০০৮ সালে। দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস ২০০০ সালে 'সুখের লাগিয়া'। ২০০৮ এ প্রকাশিত হয়েছে আরো ছয়টি গ্রন্থ। কিশোর সংকলন -মেঘরাজা রোদরাজা, কাব্য সংকলন-নিশি লোর, উপন্যাস-প্রতীক্ষা, তিন পুরুষের গল্প, স্মৃতির দুয়ারে এবং গল্প ও প্রবন্ধ সংকলন-ছিন্ন বীণার তার।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সমাজকল্যাণ মূলক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন তাঁর মায়ের স্মৃতিস্মরণে একটি প্রাইমারি স্কুল তাঁরই নিজ গ্রামে।
********