আমি শিখেছি


অনেক অনেক দিন হলো। অনেক মাস ওর বছর গেল। শেষমেষ আমিও কিছু শিখে ফেললাম।

তাই আর চুপ করে না থেকে আজ সেই কথা গুলো আমার প্রিয় পাঠকদের কাছে রাখছি। পড়ে যদি একমত হ’ন না হ’ন দয়া আরেকটু কিছু শেখার ব্যবস্থা করে দেবেন। সময় বড় কম। শেখার অনেক বাকী।

তাই জোর কদমে পা চালিয়ে বলেই ফেলি।
 

আমি শিখেছি -
যে আমি কাউকে আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করতে পারিনা। আমি ভালবাসার পাত্র হয়ে উঠতে পারি। বাকিটা অন্যদের ওপর ছেড়ে রাখাই ভাল।
 

আমি শিখেছি -
কারও জন্য চিন্তা করা বা কারোর যত্ন করতে হলে আগে মনটাকে একমুখি করে তুলতে হবে।

কারণ, ভালবাসা একমুখি।
 

আমি শিখেছি -
আমার সুনামের থেকে আমার চরিত্র অনেক বেশী দামী। চরিত্র হল আমি সৎ ভাবে জানি আমি কি, আর সুনাম হল অন্যরা কি ভাবে আমার সম্পর্কে। তিল তিল করে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠা এক লহমার

ভুলে ধূলিস্যাৎ হয়ে যেতে পারে।
 

আমি শিখেছি -
আমার কত জন বন্ধু আছে সেটা বড় কথা নয়। বিনা আমন্ত্রণে, আমার শ্মশানযাত্রায় কত লোক এসেছিল

সেটা অনেক বড়।
 

আমি শিখেছি -
লোককে তাৎক্ষনিক ভাবে চমকে দেওয়া যায় একটা দুটো নতুন কিছু বলে বা করে কিন্তু একটা দীর্ঘস্থায়ী কথোপকথন চালাতে গেলে সমাজ ও মনস্তত্বের মধ্যে সাঁতার কাটা জানা চাই। এটা কোনও চমক নয়।

এই অনুধাবন ব্যপ্ত, গভীর ও নীরব।
 

আমি শিখেছি -
নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্যে শ্রেষ্ঠের সাথে নিজের তুলনা না করে আরও ভাল কি করে করা যায় তার চেষ্টা করাই জীবনের পাথেয়।
 

আমি শিখেছি -
কি করে পড়ে গেলাম সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে এই ভাবনাটা চেতনায় বিঁধিয়ে রাখা, আর কি করে উঠে দাঁড়াব সেটা নিয়ে কাজ করা হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
 

আমি শিখেছি -
তাৎক্ষণিক আনন্দ ভবিষ্যতের হৃদয় যন্ত্রণার কারণ।
 

আমি শিখেছি -
পাপ যতই লঘু হোক সমাজের চোখে সেটা পাপ আর তার সব সময় দুটো দিক আছে। এক দিকে অন্ধকার আরেক দিকে আলো। আলোটাকে খুঁজে পাওয়াই হলো পাপস্খালনের পথে প্রথম পদক্ষেপ।

আমি শিখেছি -
যে আমার সারা জীবনটা চলে যাবে, আমি যে মানুষটি তে চাই তাই হোতে। এই বিনিয়োগ বুদ্ধিমানের কাজ। আমি তাই করার চেষ্টা করে চলেছি।
 

আমি শিখেছি -
প্রতিক্রিয়াশীল মন, সুচিন্তার প্রক্রিয়াকে ও মানুষের সুকুমার বোধকে বিনষ্ট করে দেয়।
 

আমি শিখেছি -
ভালবাসার মানুষগুলোকে আমোদ ও আহ্লাদের সাথে বিদায় জানাতে, কারণ কে জানে এই শেষ দেখা কিনা!
 

আমি শিখেছি -
চলা স্তব্ধ হয়ে যায় ঠিক তখনি যখন মন বলে 'আর পারছিনা'!
 

আমি শিখেছি -
আমার গতকালের কর্মের ফসল আমার আজ আর আমার আগামী কাল আমার আজকের!
 

আমি শিখেছি -
হয় আমি আমার আবেগ গুলোকে আয়ত্তে রাখব, নয় ওরা আমার জীবনটা চালাবে!
 

আমি শিখেছি -
সম্পর্কের শুরুর উত্তাপ সাময়িক। শীতলতার হাতে জীবনকে ছেড়ে দেবার আগে সম্পর্কের বাঁধুনিগুলোকে

শক্ত করে নিতে হয়।
 

আমি শিখেছি -
বীরত্ব হলো পরিণতির কথা না ভেবে সমাজ এবং মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় কাজটা আগে করে ফেলা।

প্রকৃত বীর কখনও বিচারকের সবুজ ঝান্ডা কখন দুলবে সেই আশায় বসে থাকেনা।
 

আমি শিখেছি -
ক্ষমা করা সহজ নয়। ক্ষমা এক অভ্যাস।
 

আমি শিখেছি -
অর্থ হলো অনর্থের মূল। দিনগত পাপক্ষয়। তাই আমি টাকা গুনে নিইনা।

ওতে হাত এবং মন দুইই নোংরা হয়।
 

আমি শিখেছি -
বন্ধুর সাথে সময় কাটানো অর্থনীতি বা হিসাব শাস্ত্রের জ্ঞান বহির্ভূত।
 

আমি শিখেছি -
আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু হলো আমার স্ত্রী কারণ সে আমাকে আমার দুর্বলতা গুলোকে আগে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। তবে ব্যালান্সের খেলাটা ও বোধহয় এই জীবনে ও আর শিখবেনা।

ক্ষতি নেই, লাভ আমারই বেশী।
 

আমি শিখেছি -
রাগ হলো একটা আবেগ যাকে আমি ব্যবহার করতে পারি কিন্তু তার দ্বারা ব্যবহৃত হতে পারিনা। তা হলে, আমি নয়, হিংস্রতা আমার কর্মের মালিক হয়ে যাবে।
 

আমি শিখেছি -
বন্ধুত্বের কোনও ভৌগলিক সীমা নেই। ইন্টারনেট এখন সর্বত্র বিরাজমান। আমার বন্ধুত্বও।
 

আমি শিখেছি -
কে আমাকে কি ভাবে ভালবাসবে সেটা তার ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভাল। বিচারকের ভূমিকা আমার জন্যে নয়।
 

আমি শিখেছি -
মোমবাতির সংখ্যা দিয়ে অভিজ্ঞতার মাপ করা যায়না। প্রতিটি জন্মদিন নতুন কি শিখিয়ে গেল

সেটা অনেক বড় কথা।
 

আমি শিখেছি -
কোনও শিশুকে বলা উচিত নয় যে, সে তার সামাজিক অবস্থার জন্যে বিরাট কিছু হতে পারবেনা। শিশুরা স্বপ্ন দেখে। ওরা ঠিক পথ খুঁজে নেয়। একটি শিশুকে যদি এই বিশ্বাস দিতে পারি - তুমিই পারবে

আর তার হাতটা ধরে একটু দিতে পারি তাহলে আমি মানুষ।
 

আমি শিখেছি -
আমার সাম্পর্কিক এবং রক্তসূত্রের সংসার আমার বহির্বিশ্বের সংসারের কাছে অতি ক্ষুদ্র। আমি এই দুই জগতের মহামিলনের চেষ্টায় আছি।
 

আমি শিখেছি -
আমার দুঃখ বা অর্জিত কষ্ট যতই পীড়াদায়ক হোক না কেন আমার দুঃখে এই পৃথিবী থেমে যাবেনা!
 

আমি শিখেছি -
আমার পারিবারিক ইতিহাস বলে দেয় আমি কে কিন্তু আমি কি হব তা আমার ওপর নির্ভর করে।
 

আমি জানি -
আমার দুই বন্ধুর ঝগড়ার মধ্যে আমার কোনও পক্ষ নেওয়া উচিত নয় কিন্তু আমি এখনও দ্বন্দ্বে পড়ে যাই

ইরকম পরিস্থিতিতে।
 

আমি শিখেছি -
যেখানে কোনও কলহ নেই সেখানে যে প্রেম আছে এটা ভেবে নেওয়া নির্বুদ্ধিতার সমার্থক। যে আমার সাথে সর্বদা তর্ক করে সে আমার বন্ধু ও হতে পারে।
 

আমি শিখেছি -
কখনও কখনও ব্যক্তিকে তার কাজের থেকে বেশী গুরুত্ব দিতে হয় কারণ ব্যক্তির একটা ইতিহাস আছে আর তার কাজটার কোনও ইতিহাস নাও থাকতে পারে।
 

আমি শিখেছি -
আমার বন্ধু বদলাবার দরকার নেই, কারণ বন্ধু বদলাতেই পারে কারণ সেও মানুষ।
 

আমি শিখেছি -
কৌতুহল দমনীয়। কারও গোপনীয়তার জমিতে পা না রাখলেও জীবন ঠিক চলবে। আর সেই জমিতে পা রাখার সাফল্য জীবনে অনেক অকাম্য পরিবর্তন এনে দিতে পারে।
 

আমি শিখেছি -
দুজন মানুষ একই শহরে থেকে সেই শহর সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করতে পারে।

শহরটা কিন্তু একই থাকে, বিন্দু মাত্র বদলায় না।

আমি শিখেছি -
সন্তানকে যতই আগলে রাখার চেষ্টা কর না কেন, সে কিন্তু আদরের নামে অতি আরক্ষণ পছন্দ করেনা।

ফলে সন্তানও কষ্ট পায় আর বাবা মা ও।
 

আমি শিখেছি -
প্রেমে পড়ার অনেক উপায় আছে আর সেই প্রেম টিকিয়ে রাখার আরও বেশী উপায় আছে। প্রেমে পড়া নয়, প্রেম কে বাঁচিয়ে রাখাটাই মুখ্য।
 

আমি শিখেছি -
পরিণতি কি হবে ভেবে লাভ নেই। সৎ ভাবে কিছু করলে সামনের বন্ধ রাস্তাও খুলে যাবে সেটা পাহাড়ও

হতে পারে, যা সরে যাবে।
 

আমি শিখেছি -
নিজেকে বন্ধুত্বের প্রাসাদের স্তম্ভ মনে করলে একাই থাকতে হয়। তাই ইঁট, বালি বা সিমেন্ট হয়ে মিশে যাওয়াই ভাল। বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয় তাতে।
 

আমি শিখেছি -
কোনও অপরিচিতও খুব ভাল বন্ধু হতে পারে। ক্ষণিকের পরিচয়ে জীবন পালটে যেতে পারে।
 

আমি শিখেছি -
যখন মনে হয় আর কিছু দেবার নেই ঠিক তখন এক বন্ধুর চোখের জল আমার দেবার শক্তি বাড়িয়ে তোলে।
 

আমি শিখেছি -
মনের কষ্ট ভাগ করে নিতে হয় - তা সে লিখেই প্রকাশ করি বা বলে।
 

আমি শিখেছি -
আমার চেতনার বাইরে অনেক সুকুমার বোধ আছে যা আমার জানা নেই।
 

আমি শিখেছি -
নামের পাশে অনেক ডিগ্রী থাকলেই মানুষ হওয়া যায়না। মনুষ্যত্ব কোনও ছাপের দয়ায় তৈরী হয়না।

তিনশ ষাট ডিগ্রী মান সম্পর্কে হুঁশ থাকা চাই।
 

আমি শিখেছি -
কাউকে বা কোনও সম্পর্ককে শক্ত আবেগের দড়ি দিয়ে বাঁধলে সে সেই বাঁধন কেটে অসময়ে বা
তাড়াতাড়ি চলে যায়। তাতে দুই কষ্ট। বাঁধার কষ্ট আর বাঁধন ছিঁড়ে যাবার কষ্ট।
 

আমি শিখেছি -
ভালবাসা কথাটার অনেক মানে আছে। কথাটা কে বলছে আর কাকে বলছে, সেটাই বড় কথা। কথাটা
ব্যবহার করার আগে নিজের মনমন্দিরের পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দেওয়া বড় প্রয়োজন।
 

আমি শিখেছি -
ঠিক কোথায় সীমারেখা টানতে হয় এটা ঠিক করা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ আমি কাউকে দুঃখ দিতে
পারবনা আর নিজের মতামত জানাবার স্বাধীকারকেও অসম্মান করতে পারবনা।
 

আমি শিখেছি -
নিজেকে যদি অসম্মানিত মনে করি তবে আমি তাই হয়ে গেছি। যদি মনে করি আমার সাহস নেই তাহলে
নেই। জেতার কথা ভাবার আগে যদি হারার কথা মনে আসে তবে আমি হেরে বসে আছি। সাফল্য আত্মবিশ্বাসের সুসন্তান। আর সন্তান এক দায়িত্ব যার থেকে এক মুহূর্তের জন্য বিচ্যুত হওয়া যায়না।
সাফল্যও তাই। শুধু মনকে বোঝাতে হয় - আমিই পারব। আমিই করব।


এখন প্রশ্ন হল - এই আমি কে?

 আমি হলাম একজন মানুষ। আমি হলাম লক্ষ কোটি মানুষের সমাহার। আমি হলাম দেশ। আমার দেশ। তোমার দেশ। ভারতবর্ষ। আমি এই পৃথিবী। আমি সবার সাথে একটা সত্য ভাগ করে নিতে চাই।

সেই সত্য হল এই কথা বলতে পারার ক্ষমতা যে - আমি শিখেছি।

কিন্তু আমি শিখেছি- অসম্পূর্ণ আছে।

অনেক পথ চলতে হবে।

আসুন একসাথে কিছু করি।
 

সুপ্রতীক অরূপ

মুম্বাই
সেপ্টেম্বর, ১৯, ২০০৬