মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি?

 

ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর নিয়ে কিছু প্রশ্ন

 

অবহেলিত পশ্চিম বঙ্গের শিল্পের গরুর গাড়ির চাকায় রোলসের এঞ্জিনের গতি আসছে, না কি এসে গেছে! কলকাতায় পা রাখলেই চতুর্দিক থেকে সবাক হোর্ডিংগুলো জেগে উঠে গান গায় আমার মনের মধ্যে - পশ্চিম বঙ্গে শিল্প বিপ্লবের নবজন্ম হয়েছে বা হচ্ছে। বেশ খুশী খুশী লাগে। পুলকিত হই। চারি দিকে একটা বেশ সাঁজ-সাজ রব। ভাল লাগে। চারিদিক থেকে বিদেশী পুঁজি আসছে, এসে গেছে, স্বপ্ন জেগে উঠছে, উঠেছে, মহা আশ্বাসের প্রবল নিশ্বাসের দুর্দমনীয় গতির সামনে সব চক্রান্ত, বাধা, বিপত্তি ও বিঘ্নকে উঠে দাঁড়াতে হবেনা আর! তা বেশ! ভাবতে ভাল লাগে, ’নবদিনমনি উদিবে আবার এই পুরাতন পূরবেঅর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গে। কত কি নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠছে বা উঠবে। ব্র্যান্ড বুদ্ধ (বিমান বাবু বা বিনয় বাবু মাফ করবেন) সত্যি এক শিল্প বিপ্লবের ঝড় আনতে সক্ষম হলেন, এটা আমার মত পশ্চিম বঙ্গ প্রেমিকের কাছে এক বিরাট আশার কথা।

 

কিন্তু আমি না কেমন যেন ঘোলাটে মেরে যাই যখন সব এই শিল্প বিপ্লবের বরমালার পুঁথি গুলোকে কুড়িয়ে এক জায়গায় করতে চাই, যাতে আমার বুদ্ধি দিয়ে আমি আমার সাধের বাংলাকে আবার গরবিনী রূপে দেখতে পাই! কিছুতেই পরিস্কার করে দেখতে পাই না ঠিক কি হলো এই গত চার পাঁচ বছরের শিল্পের প্রসার ঘটানোর প্রচারের পর? খবরের কাগজে, চারিদিকে তো কেবল বেকারি, মাস্তানি, খুন, ছিনতাই আর অনেক রকমের পুঁজিহীন মাফিয়াদের কর্মকান্ডের পুঁজ রক্তে ভরা কৃতির বিজ্ঞাপন। তাহলে হলো টা কি?

 

ব্যাপারটা কি এরকম, কোন ও পুঁজি পতি তার বাড়তি পুঁজির ঝুলি নিয়ে লাল কার্পেটের ওপর দিয়ে সদর্পে আসবেন। লালবাড়ির বিশেষ কামরায় মিডিয়ার চোখ ঝলসানো ক্যামেরার সামনে করমর্দন করবেন। দীর্ঘ সময়ের নীরবতা পালন করবেন কেননা এদিক ওদিকে উঁকি মেরে দেখা একটা বেনিয়া অভ্যাস। অন্য কোথা, অন্য কোন ও খানে যদি আর ও বেশি পাওয়া যায় তাহলে এক লহমায় জানিয়ে দেওয়া যাবে যে পশ্চিমবঙ্গের থেকে বেশি সুবিধা অন্য কোন ও রাজ্য দিচ্ছে। বাই বাই ওয়েস্টবেঙ্গল! এরকম ও তো শুনতে পাই, যে অমুকের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ চলে গেল পশ্চিমবঙ্গ থেকে অমুক রাজ্যে। অজ্ঞতা ক্ষমার্হ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটা স্টেট প্ল্যানিং বোর্ড আছে। সেই বোর্ডে অনেক হোমড়া চোমড়া আমলা, অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞেরা আছেন। তাদের কি কোন ও ব্লু-প্রিন্ট আছে?

 

পশ্চিমবঙ্গে কোন শিল্পে বিনিয়োগ হলে সব দিক থেকে ভাল হতে পারে! কোন শিল্প গুলোকে একটু সাহায্য করলে তাড়াতাড়ি সেগুলো বেড়ে উঠতে পারে! তার কোন ও জার্নাল বা খতিয়ান কি আছে, তাঁদের কাছে? প্রাজ্ঞজনের সমাহার ঘটে নিরুপম বুদ্ধত্বের মেধা যখন খুলিমুদ্দিনের আকাশে সূর্যের আলোয় বিমান যাত্রা করে। তাঁরা কি শুধুই, বিনিয়োগ আসছে, এসেছে, এসে গেছে বা এই এল বলে এই সব বলেই তাদের দায়িত্ব পালন করবেন? সাধারণ মানুষের কি এটা জানার অধিকার নেই যে কবে, কি ভাবে কারা এই বিনিয়োগের সুফল পাবেন!

প্রসঙ্গান্তরে বলি, ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল এই পশ্চিম বঙ্গে। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের বিদ¦দ্ধ নেতৃত্বে এই গোড়াপত্তন হয়েছিল মানিকতলার বেঙ্গল কেমিক্যাল এর জন্মলগ্নে। তাঁর অবর্তমানে ও, দীর্ঘ দিন সেই নেতৃত্ব পশ্চিম বঙ্গের হাতেই ছিল। কিন্তু ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের বিকাশের জন্য কিছু মাত্র করা হয়নি ষাটের দশক বা সত্তরের দশকে। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা

প্রবাদ পুরুষ বিধান রায় থেকে কিংবদন্তী জ্যোতি বসুর সরকারের কখন ও মনে হয়নি যে স্বল্প বিনিয়োগে এই সংবেদনশীল শিল্পের মধ্যে অনেক সম্ভাবনা রয়ে গেছে বা আজ ও আছে!

 

পশ্চিমবঙ্গের অনেক পরে শুরু করে মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্র প্রদেশ বা গুজরাত কি দ্রুত গতিতে ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের বিকাশ ঘটিয়ে ফেলল। আমরা দেখতে থাকলাম। দেখতেই থাকলাম। নীরব দর্শকের ভুমিকায় পশ্চিমবঙ্গ - মহারাষ্ট্রের ও গুজরাতের ফিনিশড প্রডাক্ট বা অন্ধ্রের র মেটিরিয়ালস এর প্রগতির ধ্বজা উড়তে দেখতে থাকলো। তার মানে এই নয় মহারাষ্ট্র ও গুজরাতে র মেটিরিয়ালস বা অন্ধ্রে ফিনিশড প্রডাক্টএর বিকাশ ঘটেনি।

 

মুখ্যতঃ এই তিনটি রাজ্য সারা পৃথিবীতে আজ পরিচিত আর হ্যাঁ তার সাথে পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসটাও ফারমা ইন্ডাস্ট্রি-রকাইভ এ আছে। আজ শুনি পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীতে বা কলকাতার আশেপাশে অনেক ওষুধ কম্পানী আছে। কি ভাবে আছে সেই কম্পানীগুলো? তালা বন্ধ। কোন ও প্রকারে শ্বাসটা চালু আছে। বা বলা যায় অমুক কম্পানীর মালিক হন্ডা একর্ড চড়ে ঘোরেন। আর হ্যাঁ, কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি পড়ানোর মান নিয়ে দেশে ও বিদেশে বেশ সুনাম আছে। যাদবপুরের ছেলে মেয়েরা কলকাতার বাইরে গিয়ে বড় বড় ফার্মা কম্পানীর ভবিষ্যত গড়ছে আর আমরা নতুন পশ্চিমবঙ্গের স্বপ্ন বিক্রি করছি লাল বাড়ির তখৎ-এ-তাজ এ বসে। এই শিল্পের ভবিষ্যত যে সবথেকে উজ্জ্বল সেটা জানতে কোন ও বিশেষ মস্তিস্কের প্রয়োজন হয়না। খবরের কাগজ খুললেই জানা যায়। আই টি ইন্ডাস্ট্রির থেকেও বেশি ধ্বনাত্মক সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের মধ্যে। আমেরিকা বা ইউরোপের বা আফ্রিকার কোন ও শহরে গিয়ে যদি বলেন আপনি ইন্ডিয়ান ফার্মা ইন্ডাস্ট্রির সাথে যুক্ত তাহলে দেখবেন আপনাকে কি সমাদর করা হয়। আজ ভারতীয় কম্পানীগুলো কি ভাবে সেই সব দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে তা পরিসংখ্যান বলে দেবে। আমরা এখান থেকে সারা পৃথিবীর বাজারের প্রসারে প্রভাব ফেলতে পারি কিন্তু আমাদের নিজের রাজ্যেই শোনবার কেউ নেই! কিন্তু কি লাভ এ সব কথা বলে?

 

পাঠক যদি সাদা মনে পড়েন তো একটা ঘটনা এখানে বলি। আমি এই ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের সাথে গত ৩০ বছর ধরে যুক্ত। ভেষজ ও ওষুধ শিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়েই আমার কাজ তবে আমাকে তা করতে হয় সুদুর মুম্বাইতে, কলকাতায় নয়। কারণ? এতক্ষণে তা বোধ করি আপনারা বুঝে গেছেন। কিন্তু ওই যে মাটির টান! তাই ২০০২-০৩ নাগাদ আমি আমার বেশ বড় একটা পাকা চাকরী ও তার বেশভূষা ত্যাগ করে কলকাতায় গিয়েছিলাম একটা কিছু করবো বলে। তার ও ছমাস আগে থেকে আমি লাল বাড়ির সব মন্ত্রীদের কে সবিনয়ে আমার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ই-মেইল করেছি বেশ কয়েক বার। কোন ও উত্তর পাইনি। তখন ও ঠিক ই-মেইল ব্যাপার টা আয়ত্ত হয়ে ওঠেনি (আজ ও কি হয়েছে?) তাই আমার বিবেচনা ও বোধ আমায় আর ও জেদী ও আশাবাদী করে তুলল। আমি কলকাতায় গিয়ে লাল বাড়ির সঠিক ঘরটায় ঢোকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমার কোন ও দাদা বা মামা কোন ও রং এর সাথে সম্বন্ধ রাখেন না। অগত্যা আমার চেষ্টা প্রায় যখন বিফল তখন একদিন লাল বাড়ির এক মাঝারী আমলার কাছ থেকে একটা ফোন পাই। ফোন পেয়ে যাই সেখানে পরের দিন। গিয়ে আড়াই ঘন্টা বসে থাকি। তিনি চার হাতে আটটা ফোন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন আর আমি গলা শুকিয়ে কাঠ অবস্থায় বসে আছি। শেষে উনি আমাকে নিয়ে পড়লেন এবং অত্যন্ত স্বল্প সময়ে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কি কি ভাবে আমি কিছু করতে পারবনা পশ্চিমবঙ্গে। আমি চেয়ে ছিলাম যদি কোন ও একটা বন্ধ ওষুধ কম্পানীকে চালান যায়, তাকে লাভের মুখ দেখান যায় আর বেশ কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে একটা নতুন দিনের শুরু হতে পারে। আমি সেটা এখন ও চাই। আশা ছাড়িনি। কিন্তু সে পথে এত জটিলতা যে ভয় হয় পারবো তো কিছু করতে এই বাংলার মাটীতে যেখান থেকে আমার কর্ম জীবনের শুরু। আজ ও অনেক প্রস্তাব বিদেশ থেকে আসে কিন্তু তারা চান যে আমি কলকাতার বাইরে কিছু করি। কিন্তু কেন এই দ্যোতনা! এক দিকে মুখ্যমন্ত্রী বলবেন যে আসুন কলকাতায়, সবাই আসছে আর অন্য দিকে বুনিয়াদী ব্যাপার গুলোই পায়ের তলায় জমি পাবেনা! এটা কি করে সম্ভব! আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবু এই লেখা পড়বেন কিনা জানিনা।

 

তবে যদি কখনও এই লেখা পড়েন তবে তাঁর কাছে কয়েকটা প্রস্তাব রাখছিঃ

 

ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে একটু নজর দিন। স্বল্প পুঁজিতে অনেক কিছু করা যাবে। অনেক ভাল ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।

আর যদি তা করেন তবে আমলা তন্ত্রের ফাঁস আর দলীয় লতাপাতার বাধন টাকে আলগা করুন বা একেবারে সরিয়ে রাখুন।

বন্ধ ওষুধ কম্পানী গুলোকে কি ভাবে খোলা যায় তার জন্যে সঠিক প্রফেশনাল দের সাথে সরাসরি কথা বলুন।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে রপ্তানী করার সমুহ সম্ভাবনা আছে। স্থানীয় বাজারেও অনেক ভাল বানিজ্য করার উপায় আছে। সেই সব তথ্য যথা সময়ে পাওয়া যেতে পারে।

ফার্মা সেক্টরের 'ট্রেনিং নীড' কলকাতা থেকে পুরণ করা যেতে পারে। অপার সম্ভাবনা আছে এই ব্যাপারে।

কোন ও রকম রাজনৈতিক প্রভাবহীন একটা ফার্মা বিসনেস ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তৈরী করুন, 'প্রফেশনাল' দের নিয়ে।

 

বাঙালীদের অনেকেই ফার্মা বিসনেস ওয়ার্লডে প্রতিষ্ঠিত আর তাঁরা ও কিছু করতে চান তাঁদের নিজের রাজ্যের জন্যে। এত কথা। এত সম্ভাবনা। অনেক কাজের হাতের দরকার হবে। একটু সংবেদনশীলতার সাথে বুদ্ধবাবু যদি একটু সময় দিয়ে শোনেন তাহলে ভেষজ ও ওষুধ শিল্পে পশ্চিমবঙ্গের আবার সুদিন আসবে। ভুলবেননা এখান থেকেই শুরু য়েছিল এই জয়যাত্রার।

মুখ্যমন্ত্রী শুনছেন কি?

 

সুপ্রতীক অরূপ

মুম্বাই

অগাষ্ট ২৭, ২০০৬