স্বদেহ মনের ঘরে প্রেমের বাসা


এক গোলোক ধাঁধা। প্রেম দেহে না মনে? আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় এই আলোচনা যেন শুধু এক সময়ের অপব্যয়। আবার এই ধন্ধে পড়েনি এমন নারী বা পুরুষ খুঁজে পাওয়া যাবে কি? অশরীরী আত্মার সাথে প্রেম করে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন কেউ, এমনটা রোজ শোনা যায় না। ঘটলেও তা তাৎক্ষণিক সেটা এক গভীর অবসেষন। সে নিয়ে এই আলোচনা নয়। ইংরেজী Lust কথাটার মানে কি? লাস্যকাম। লাস্যকাম কথাটা লিঙ্গ বিহীন। মানে কোনও নারী-শরীর কল্পনা করে বা তাকে দেখে পুরুষের বা বিপরীতে কোনও পুরুষ-শরীর কল্পনা করে বা দেখে এক নারীর যে জৈবিক ক্ষুধা জাগে তা কে কি লাস্যকাম বলা যায়? হ্যাঁ। ঠিক তাই। আসলে অবলোকন কাম লাস্যকামের জন্ম দেয় আর লাস্যকাম যখন জৈবিক রতি ক্রিয়ায় পরিণত হয় বা দুটি শরীর যখন আষ্টে পৃষ্ঠে দুজনে দুজনার শরীরের স্বাদ নিতে লিপ্ত তখন কি ঠিক প্রেম কথাটার কোনও জায়গা থাকে? শুরুতে থাকেনা। ধীরে ধীরে তৈরী হয় যদি না নারী বা পুরুষ সঙ্গী বদল করার অভ্যাস করে থাকেন। ধীরে ধীরে একটা জায়গা তৈরী হতে থাকে এক বীজের আকারে। লাস্যকাম হল প্রেমের বীজ। প্রেমের জন্ম হয় জৈবিক রতিক্রিয়াশীল দুটি শরীরের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে, অনেক পরে, তাদের মনের মধ্যে। মনে রাখতে হবে সব রতিক্রিয়াই মাতৃত্বে বা পিতৃত্বে নির্দেশিত নয়।


দেহজ কাম ক্রিয়া যদি সুখদায়ক হয়ে থাকে তবেই সেখানে প্রেমের জন্ম হয়। শরীর জুড়োলে মন শীতল। আর শান্ত মনেই প্রেমের উত্তাপ অনুভব করা যায়। দেহের চৌকাঠ না মাড়িয়ে কি মনের মন্দিরের আঙিনায় পা রাখা যায়? বিষয়টি আদৌ জটিল নয় যদি সততার সাথে ব্যাপারটাকে দেখা যায়। ভাবা যাক কোনও পুরুষ বা নারী বা কোনও যুবক বা যুবতী বা কোনও কিশোর বা কিশোরী বলছে ‘আমি খোলা আকাশের প্রেমে পড়েছি‘ কিম্বা ‘হে ঝড় আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্ক ভাগী‘! বেশ হাস্যকর একটা ব্যাপার, না? ঠিক তাই। আকাশের বা ঝড়ের শরীর নেই। শরীরকে বাদ দিয়ে প্রেম আসেনা। কিন্তু প্রেমের জন্মের পর শরীরের সাক্ষাৎ কোনও ভূমিকা নাও থাকতে পারে। আবার থাকতেও পারে। প্রেম হল এক অনুভূতি যা পুরনো হলেই বেশি তীব্রতার সাথে অনুভূত হয়। দেহের আকর্ষিকাসক্তি যত কমে আসে ততই প্রেম বাড়ে। প্রেমের জন্ম হতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে কিন্তু লাস্যকামের জন্ম এক পলকেই ঘটে। ২৩ থেকে ২৯ এর মধ্যে যারা বিয়ে বা লিভ টুগেদার জনিত সহবাস করেন তাদের আচরণ ক্রিয়ার যদি একটা ধারারেখা টানা যায় তবে দেখা যাবে - প্রথম বছর winkly অর্থাৎ চোখের পলক পড়তে না পড়তেই নারী ও পুরুষের দুই শরীরে সর্পিল অনুরণন আর বন্যসুন্দরতার বল্গাহীন বহতা। মানে সকাল, দুপুর বিকেল, রাত্রি বা ঊষাকাল - এনি টাইম ইজ লাস্যকাম টাইম। কিম্বা আসরে, বাসরে, স্নান ঘরে, পাকশালে, টাকশালে, ভূমিতে, জমিতে, মেঝেতে, মেজেতে, আসনে, বাহনে সর্বত্র দুই শরীর নিমেষেই এক হয়ে যেতে পারে - এনি প্লেস ইস লাস্যকাম প্লেস। এর পরের কয়েক বছর weekly অর্থাৎ দোঁহে মিলি শনিবারের রাতে শুক্রদেবের আরাধনা। বংশ রক্ষা করতে হবে তো! অবশ্য বংশ রক্ষা হয়ে যাবার পরও লাস্যকামের মেল ট্রেন থামেনা, থামতে চায়না, তবে ওই সাপ্তাহিকি - দোঁহে বলে চল মন দেহের বাগানে বেড়াতে যাই। এই দীর্ঘ সময় ধরে কেবল লাস্যের বীজ বপন করা হতে থাকে আর এখানে প্রেমের কোনও লেশ মাত্র খুঁজে পেতে হলে এরকুল পোয়ারোঁ হয়ে প্রত্যেকটি নারী পুরুষের মধ্যে আসন পাততে হবে। অসম্ভব। এই লাস্যকামের খেলা চলে আরও বেশ কয়েক বছর। এরও বেশ কিছু বছর পর সাপ্তাহিক মেল ট্রেনের গতি কমে। শরীর তখন ক্যাঁচর কোঁচর করা শুরু করে দিয়েছে। খালি দৌড় করালে হবে? শরীর বিদ্রোহ করে - হয় দেবীর নয় তো দেবার! তখন ঠিক নেই কিছুর। দেহের বাগানে মালী আসেনি অনেকদিন। জল পড়েনি। ধুলো পড়ে জমে আছে। মাঝে সাঝে এই সময়টা দিয়ে সাংসারিক শান্তি ও স্বস্তি দুই উপাদানের একটু বাহুল্য হলে তবে মন যায় লাস্যকামের বাগানে কিন্তু weekly অর্থাৎ দুর্বল বটে তব অঙ্গদখানি সচেষ্ট ইচ্ছাতারা খচিত। এইখানে এসে দেখা যায় কোথা দিয়ে যে দশটা বা পনেরটা বা কুড়িটা বছর কেটে গেছে দুজনের কেউই বুঝতে পারেনি। কত সুখ, কত অভিমানের সম্পদ নিয়ে দুজনে আজও দুজনার। দুজনেই বিশ্বাসের সরু সুতোর ওপর দিয়ে সটান হেঁটে চলেছে। সে তাঁরা প্রোষিতভতৃকাই হোক বা প্রোষিতভর্তকই হন - কোথায় যেন এক বাঁধন তৈরী হয়ে গেছে। সে বাঁধনকে দুজনারই অটুট মনে হয়। সে বাঁধনের মধ্যে এক অহঙ্কার আছে। সে বাঁধনের মধ্যে ত্যাগ আছে। সে বাঁধনের মধ্যে সহনশীলতা আছে, দায়িত্ববোধ আছে, শ্রদ্ধা আছে আর আছে দুজনের দুজনকে আর নিবিড় ভাবে জানার। এই খানে এসে লাস্যকামের সেই অঙ্কুরিত বীজ যা দেহের বাগানে বপন করা হয়েছে বিগত বছর গুলি ধরে তা পরিণত হয় প্রেমে। এই অঙ্কুর হল প্রেম। এইখানে এসে প্রেমের জন্ম হল অর্থাৎ Love, Lust এর সংগে Love-এর অবস্থানগত ও সময়গত পার্থক্য আছে। দু’টোকে গুলিয়ে ফেললে চলবেনা। প্রেম চিরন্তন আর লাস্যকাম ক্ষণস্থায়ী। লাস্যকাম যদি বীজ হয় প্রেম তবে অঙ্কুরিত চারাগাছ বা আরও পরে প্রেমের মহীরুহ। এটা উপলব্ধি। তর্কের সামগ্রী নয়। প্রেম দেহের বাগানে পোঁতা সেই ফুলের চারা যার সুগন্ধ মনের ভেতর এক পাকাপাকি জায়গা করে নেয় দীর্ঘ পথ দেহের বাগানে একসাথে ঘোরাফেরা করার পরে। এই হল প্রেম। আবারও বলি এই লেখা তর্কের সামগ্রী নয়, নিতান্তই ব্যক্তিগত উপলব্ধি।


এক লম্বা জৈব দৌড়ের শেষে দেহ প্রশ্ন করে মনকে। তুমি আগে না আমি আগে? দেহ উত্তর পায় বা পায়না। মন প্রশ্ন করে আত্মাকে। তুমি আগে না আমি আগে? উত্তর পায়না তা নয় তবে মন চঞ্চলা তাই আত্মা উত্তর দেবার আগেই সে চলে যায় আরেক কাজে। আত্মার কোনও প্রশ্ন নেই কারণ আত্মা সব জানে। তাই মহা আত্মায় বিলীন হওয়া পর্যন্ত মনকে খুঁজতে হয় দেহ আগে না মন? প্রেম দেহে না মনে? নিরন্তর এই খোঁজ চলতেই থাকে আর আমরা গড়পড়তা সত্তর বছর বেঁচে নিই। দেহ বেচারা কলুর বলদ। দেহের গাড়ীটাকে টানতে টানতে শেষ পর্যন্ত যেতে হয় তাকে। কিন্তু বোধের গভীরে মন জানে দেহ একটা বাহন। বাহনে কেউ বাসা বাঁধেনা। বাসা বাঁধে ঘরে। আর সেই ঘর হল মন। প্রেম দেহে নয়। প্রেম মনে।
 

সুপ্রতীক অরূপ

মুম্বাই
নভেম্বর ৬, ২০০৬