ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রাসঙ্গিকতা: পরিপ্রেক্ষিত বাংলাদেশ
তারেক মাসুদ
[চলচ্চিত্রকার ও লেখক তারেক মাসুদ-এর এই নিবন্ধটি ফাহমিদুল হক ও আল মামুন সম্পাদিত যোগাযোগ পত্রিকার সংখ্যা ৮ (ফেব্রুয়ারি ২০০৭)-এ প্রকাশিত হয়।]
চলচ্চিত্রের একাডেমিক অঙ্গনে সিনেমা শব্দের পরিবর্তে 'মুভিং ইমেজ' শব্দটি প্রবর্তনের জোরালো তাত্ত্বিক আওয়াজ তোলা হচ্ছে আজকাল। চলচ্চিত্রের বৃহত্তর সংজ্ঞা কি খুবই দরকার হয়ে পড়েছে? লক্ষ্য করার বিষয়, মুভিং ইমেজ শব্দটি বাংলা ‘চলচ্চিত্র’ শব্দের আর্থরিক অর্থের অনেক কাছাকাছি।
চলচ্চিত্র কোন দ্রব্য বা পদার্থের নাম নয়, এটি একটি শিল্প-মাধ্যম। দৃশ্যকে সেলুলয়েডে ধারণ করলেই তা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না -- যেমন টেলিভিশনে কোনো ধ্রূপদী ছবি সম্পপ্রচার করলেই তা টেলিফিল্ম বা নাটক হয়ে যায় না। কারিগরি অর্থে সিনেমার সংজ্ঞা বার বার বদলেছে। মাধ্যমটির আকার-প্রকারের সামান্য পরিবর্তন-পরিবর্ধনে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। কিন্তু বোদ্ধাজনের আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়েছে -- সিনেমার মৃত্যু ঘটেনি।
সিনেমা প্রযুক্তির ফসল। নিত্যনতুন উদ্ভাবনের সাথে সাথে এর বিবৃদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি দু’ই হয়েছে। এটা সত্য, নির্বাক যুগের বাক্সময় ছবিতে আমরা ‘শিশিরের শব্দ’ শুনতে পেতাম, আর আজকের ছবি সারাক্ষণ বকবক করে। তাই বলে এতকাল পরে মাধ্যমটির কণ্ঠরোধ করা বোধ হয় ঠিক হবে না। বহুকাল সাদা-কালোর আলোছায়া ছিল চলচ্চিত্রের মূল বিশেষত্ব। তাতে রঙ লাগলে ‘সর্বনাশ’ হয়ে যাবে বলে তখনকার ডাকসাইটে নির্মাতারাও আশঙ্কা করেছিলেন। অশনি সংকেত (১৯৭৩) দেখে আমরা এখন অবশ্য মেনে নিয়েছি -- দুর্ভিক্ষেরও রং আছে। ৩৫ মি.মি.-এর সাথে ১৬ মি.মি.-এর পার্থক্য মূলত মাত্র ১৯ মি.মি. -- একথা মানতে অনেক চলচ্চিত্র পণ্ডিতই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো ষাট-সত্তর, এমনকি আশির দশকের প্রথম সারির অনেক নির্মাতাই তাদের মাস্টারপিস তৈরি করেছেন ১৬ মি.মি. ফরম্যাটে। বাংলাদেশেও তার উদাহরণ রয়েছে -- তানভীর মোকাম্মেলের চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯) ও মোরশেদুল ইসলামের চাকা (১৯৯৩)।
কেউ কেউ ধর্মাচারের সাথে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির মিল খুঁজে পান। ধর্মের দুটো দিক আছে -- এক. অনুশাসন, দুই. সংস্কৃতি। তেমনি চলচ্চিত্র মাধ্যমেরও রয়েছে আকার-আকৃতি ও প্রকার-প্রকৃতির দিক। অর্থাত কারিগরি ও সংস্কৃতির দিক। সিনেমার সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি ‘তুলনামূলকভাবে একটি বড় আকারের অন্ধকার ঘরে অনেকে একত্রে অথচ নিঃশব্দ একাকীত্বের সাথে বড় পর্দার কাছে আত্মসমর্পণ করা’। রিমোট আর মোবাইল টেপার ফাঁকে, লোডশেডিং আর বিজ্ঞাপন বিরতির আগে-পরে, ফোন আর বাচ্চা সামলানোসহ যাবতীয় গার্হস্থ্য কাণ্ডকারখানার মাঝে মাঝে ক্যাবল ও ডিভিডির কল্যাণে আমরা টিভির মিনি পর্দায় যা দেখি তা দেখা নয় -- তাকানো; চলচ্চিত্র নয় -- চলমান চিত্র মাত্র।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ডিজিটাল চলচ্চিত্র এখন আর তাত্ত্বিক আলোচনার বিষয় নয়। ভবিষ্যতের ব্যাপারও নয়। এটি ইতোমধ্যে একটি বাস্তবতা। বিখ্যাত-অখ্যাত, প্রবীন-নবীন, বড় বাজেট - ছোট বাজেট, উন্নত দেশ - অনুন্নত দেশ, কাহিনীচিত্র-প্রামাণ্যচিত্র নির্বিশেষে নির্মিত হচ্ছে ডিজিটাল ফিল্ম। বিচিত্র কারণে নির্মাতারা ঝুঁকছেন এই ফরম্যাটটির দিকে। অভিন্ন কয়েকটি কারণ অবশ্য ধারণা করা যায়, যা ফরম্যাটটিকে ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। নির্মাতার স্বাধীনতা, কারিগরি সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক সাশ্রয় ও সৃজনশীল নিয়ন্ত্রণ তাদের অন্যতম। তবে সৃজনশীলতার সুবিধার দিকটিই হয়তো প্রধান কারণ, যা ভিম ভেন্ডারস, কিয়েরোস্তামি, ‘ডগমা’ ধারার নির্মাতা থেকে শুরু করে মাইকেল মুর, হলিউড ব্লকবাস্টার ওপেন ওয়াটার-এর (২০০৩) পরিচালক -- সবাইকে একত্র করেছে।
২০০০ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিজিটাল চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনেক বিখ্যাত নির্মাতার সাথে আব্বাস কিয়েরোস্তামি ও সামিরা মাখমালবাফ অংশগ্রহণ করেন। ঐ সেমিনারের জন্য সামিরার লেখা নিবন্ধের কিছু অংশের অনুবাদ এখানে তুলে ধরছি --
ঐতিহাসিকভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের সৃজনশীল প্রক্রিয়াকে রাজনৈতিক, আর্থিক ও কারিগরি -- এই তিনটি নিয়ামক শক্তি নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। . . . চাকাকে যদি বলা যায় মানুষের পায়ের গতি সঞ্চালন, তাহলে নির্মাতার জন্য ক্যামেরা তার চোখের সম্পপ্রসারণ। গত শতাব্দীতে ব্যবহৃত ক্যামেরার অতিরিক্ত ওজনের পাশাপাশি, জটিলতার কারণে এটি চালাতে যে পরিমাণ যান্ত্রিক জ্ঞানসম্পন্ন জনবল দরকার হতো, তাতে করে চলচ্চিত্র-নির্মাতার আবেগ ও চিন্তার জন্য এই চোখ আসলে একটা বোঝা ছিল। কিন্তু আজ ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমরা ক্যামেরাকে কল্পনা করতে পারি একজোড়া সরু কাঁচের চশমা কিংবা একজোড়া লেন্সের সঙ্গে, যা চোখের কর্নিয়ায় সংযোজিত হবে অথচ বোঝাই যাবে না . . .
ডিজিটাল বিপ্লবকে আমি কারিগরি জ্ঞানের সর্বশেষ অর্জন হিসেবে দেখি। তবে এই বিপ্লব সিনেমার বিরুদ্ধে নয়। বরং সিনেমা-ইন্ডাস্ট্রির কিছু পেশাদারী কাঠামো ও চরিত্রের বিরুদ্ধে। ডিজিটাল সিনেমার কারণে আমরা চলচ্চিত্রের কেন্দ্রবিন্দু -- চিত্রনাট্য, দৃশ্যায়ন, সৃজনশীল সম্পাদনা, অভিনয়সহ কোনো কিছুই হারাবো না। ডিজিটাল ছবি যা বদলে দেবে, তা হলো চিত্রগ্রহণের ধরন, আলোর আয়োজন, পোস্ট-প্রোডাকশন ল্যাবের কাজ ইত্যাদি। চলচ্চিত্র উৎপাদন যন্ত্রের এই কারিগরি বিপ্লরের ফলে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে হয়তো চলচ্চিত্রের মৃত্যু হবে, তবে এই বিপ্লবই চলচ্চিত্রকে সৃজনশীল শিল্প হিসেবে বাঁচিয়ে রাখবে।
এবার আসা যাক বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের পরিপ্রেক্ষিতে ডিজিটাল ফরম্যাটের প্রাসঙ্গিকতা বিষয়ে। প্রথমত, আমাদের দেশে ৩৫ ও ১৬ মি.মি.-এ চিত্র নির্মাণের কারিগরি অবকাঠামোর প্রধান সীমাবদ্ধতা কী কী তা আলোচনা দরকার:
বিভিন্ন স্পিডের ফিল্ম স্টক বেছে নেয়ার সুযোগ থাকাতো দূরের কথা, অনেক সময় তারিখ পার হয়ে যাওয়া স্টক ব্যবহার করতে বাধ্য হন স্থানীয় নির্মাতারা। দরকারি লেন্স, ভিডিও এসিস্টসহ একটি ভালো ক্যামেরাও নেই এদেশে। শব্দ ট্রান্সফারসহ ল্যাবের যাবতীয় কাজ এতই নিম্নমানের যে ‘চলচ্চিত্র অবনয়ন সংস্থায়’ বাকি ও ফাঁকিতে নির্মিত বস্তাপচা কিছু ফ্লপ ‘বাণিজ্যিক’ ছবি ছাড়া সব ছবিরই সম্পাদনাসহ পোস্ট-প্রোডাকশন হয় ভারতে। ব্যবসা সফল মনের মাঝে তুমি ছবির কেবল পোস্ট প্রোডাকশন নয়, প্রোডাকশনও ভারতেই হয়েছে। আর এজন্য নির্মাতাদের মাসের পর মাস মাদ্রাজ, বোম্বে, কলকাতায় কাটাতে হয়েছে।
বিদেশে রাশ প্রিন্টের অন্য নাম ‘ডেইলিস’ (Dailies)। কেননা দিনের শুটিংয়ের ফল দিন শেষেই দেখে কোনো ত্রুটি থাকলে তা পরের দিন শুধরিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু আমরা রাশ প্রিন্টকে ‘মান্থলি’ (monthly) নামেও ডাকতে পারি না, কারণ আমলাতন্ত্রের লাল ফিতার গিট খুলে দেশের বাইরে ফুটেজ নিতে নিতে তিন মাস পেরিয়ে যায়। ততোদিনে বসে থেকে থেকে এক্সপোজড ফুটেজ তার রং, রূপ, রস সব হারাতে বসে। এরকম ব্যাপক কারিগরি বিপত্তির মুখে অসহায় নির্মাতার সৃজনশীলতা হার মানে। তার স্বপ্নের চলচ্চিত্রটি প্রায় পুরোপুরি থেকে যায় তার মনের কোণে, অনেকটা থেকে যায় তার চিত্রনাট্যে, কিছুটা রয়ে যায় চিত্রায়নের সময় আর সম্পাদনার টেবিলে। যা অবশিষ্ট থাকে তা মেরামত করাই হয়ে দাঁড়ায় সম্পাদকের কাজ। এই কারিগরি সীমাবদ্ধতার কারাগারে থেকে কেবল ছবির শৈল্পিক দিকটাই বিসর্জিত হয় না, রাজনৈতিক বিসর্জনও হয় বিস্তর। নানাবিধ সরকারি অনুমতি, অনুমোদন, অনাপত্তির ঘেরাটোপে সেলফ সেন্সরশীপ এসে পড়ে নির্মাতার অজান্তে। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারে ডিজিটাল ফিল্ম।
বেশ কয়েক বছর ধরে দুয়েকটি ক্যাবল টেলিভিশনে টেলিফিল্মের বাজেটে ৩৫ মি.মি.-এ দু-আড়াই ঘণ্টার ছবি বানিয়ে টিভি প্রিমিয়ার করছে। তার সঙ্গে একটি, বড়জোড় দুটি হলে, প্রতীকী মুক্তি দিচ্ছে। লক্ষ্য করার বিষয়, টিভি মাধ্যম থেকে একঝাঁক মেধাবী তরুণ নির্মাতা, কলাকুশলী ও শিল্পী বেরিয়ে এসেছেন। বিশেষ করে ভিডিও ফরম্যাটে তাদের অনেকেই দতা অর্জন করছেন। কিন্তু এই টিভি প্রযোজনা সংস্থাগুলো নিজেদের তৈরি কলাকুশলীদের তাদের প্রযোজিত সিনেমায় ব্যবহার করতে পারছেন না। কারণ তাদের ৩৫ মি.মি.-এর কারিগরি জ্ঞান নেই, তারা নির্ভর করছেন তথাকথিত বাণিজ্যহীন বাণিজ্যিক সিনেমার কলাকুশলীদের উপর। একই সাথে ছোট পর্দার সফল নির্মাতারা বড় পর্দায় কাজ করতে এসে তাদের মান বজায় রাখতে পারছেন না। এর কারণ ৩৫ মি.মি.-এর অবকাঠামোর স্থানীয় সীমাবদ্ধতা ও মাধ্যমটির কারিগরি জ্ঞানের অভাব। অথচ তাদের ডিজিটাল প্রোডাকশন ও পোস্ট প্রোডাকশনের অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার করলে চ্যানেল প্রযোজিত ছবিগুলোর চেহারা বদলে যেত। ছোট পর্দায় -- বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মেধাবী যেসব নির্মাতা কাজ করছেন তারা -- ক্যামেরা থেকে শুরু করে পোস্ট-প্রোডাকশনের শেষ কাজটি পর্যন্ত কম্পিউটার বা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে করে অভ্যস্ত। এই তরুণ প্রজন্ম যদি তাদের পরিচিত কারিগরি যন্ত্রাদি ও কৃৎ-কৌশলকে ভিত্তি করে ছবি বানাতে পারে, তাহলে তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রে তাদের প্রতিভার প্রমাণ রাখতে পারবে বলে আমার ধারণা।
ক্যামেরা যতদিন কলমের মতো সহজ ও সস্তা না হবে, ততোদিন চলচ্চিত্র-শিল্পের সৃজনশীল মুক্তি ঘটবে না -- একথা এখনও ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকলেও তরুণ প্রজন্মের কম্পিউটার-স্বারতা স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রে ইতোমধ্যেই ইতিবাচক ফল নিয়ে আসছে -- চলতি চলচ্চিত্র উৎসবই এর প্রমাণ। এই উৎসবের ১৬৫টি ছবির মধ্যে কয়টি ছবি চলচ্চিত্র ফরম্যাটে তৈরি? কয়টি ছবি চলচ্চিত্র ফরম্যাটে প্রদর্শিত হচ্ছে? দু’মাস আগে নেপালে অনুষ্ঠিত একটি চলচ্চিত্র উৎসবে জুরিপ্রধান হিসেবে যোগদানের সুযোগ হয়েছিল আমার। শ’খানেক ছবির মধ্যে মাত্র একটি ছবি ছিল ৩৫ মি.মি.-এ তৈরি এবং সেটি ছিল হলিউডের নির্মাতা মিরা নায়ার প্রযোজিত।
আমাদের দেশে চলচ্চিত্র ফরম্যাটে, এমন কি স্বাধীন ধারায়ও, এমন কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যা ঠিক চলচ্চিত্র হয়ে ওঠেনি। অথচ ভিডিও ফরম্যাটে এমন কিছু ভাল কাজ হয়েছে, যেগুলো নিয়মিত ভিডিও ফরম্যাটের পরিবর্তে ডিজিটাল ফরম্যাটে চিত্রায়ন করলে তাকে সহজেই ৩৫ মি.মি.-এ উন্নীত করে দেশে-বিদেশে বড়ো পর্দায় পরিবেশনার সুযোগ নেয়া যেত। এক্ষেত্রে অনেকের সাথে স্বাধীন ধারায় নির্মিত নূরুল আলম আতিক ও শামীম আখতারের ভিডিও ফিল্মসহ বেশ কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এরকম ভিডিও চিত্রগুলোর চূড়ান্ত পরিণতি টেলিভিশনের odd hour।
গত বছরের জানুয়ারিতে ভারতের মুম্বাইয়ে তুলনামূলক ফরম্যাটের একটি কর্মশালায় যোগদানের সুযোগ হয়েছিল আমার। এর উদ্যোক্তা ছিল ভারতীয় চিত্রগ্রাহকদের সংগঠন সিনেমাটোগ্রাফারস কম্বাইন। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন কে কে মহাজন থেকে শুরু করে অনিল মেহতাসহ ভারতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন চিত্রগ্রাহক। জার্মানি থেকে এসেছিলেন একজন নামকরা চিত্রগ্রাহক। তিনি একই আলোতে ১৬ মি.মি., এইচডি, ডিভি ক্যাম বিভিন্ন ফরম্যাটে একই সঙ্গে তোলা দৃশ্যগুলো ৩৫ মি.মি.-এ রূপান্তর করে কর্মশালায় প্রদর্শন করেছিলেন। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সবাই একমত হন -- ১৬ মি.মি. থেকে ৩৫ মি.মি.-এ ব্লো-আপ করা ছবির তুলনায় উন্নতমানের ডিভিক্যামে তোলা ডিজিটাল চলচ্চিত্রের ব্লো-আপের পিকচার কোয়ালিটি অনেক ভালো। এইচডি-তো অবশ্যই আরো বেশি ভালো।
চলচ্চিত্রের প্রযুক্তি কেবল উন্নত হচ্ছে না, ক্রমশ সহজ, সহজলভ্য ও সস্তাও হচ্ছে। এটি সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তির আগমনের ফলে। চলচ্চিত্রের চিত্রায়নের প্রকরণ হওয়ার আগে থেকেই, ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যান্য কারিগরি দিকগুলোতে কেবল ব্যবহৃতই হচ্ছে না, এর ব্যবহার এখন অনিবার্যও হয়ে পড়েছে। শব্দ-গ্রহণ, শব্দ-মিশ্রণ, সম্পাদনা এমনকি পরিস্ফুটনের ক্রিয়াকর্মও এখন ডিজিটাল ডিভাইসের আওতায়। ডিজিটাল ইন্টারমিডিয়েট (D.I.) আজকের রক্ষণশীল নির্মাতাদের কাছেও অজানা নয়। হলিউড-বলিউডের প্রথম সারির নির্মাতারা ৩৫ মি.মি.-এ চিত্রায়ন করেও প্রথাগত এনালগ প্রক্রিয়ায় ফেড-ইন, ফেড-আউট থেকে শুরু করে সব ধরনের অপটিক্যাল ইফেক্টের দৈন্য ঢাকতে এই ডিআই প্রক্রিয়া ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ ডিজিটাল ফরম্যাটের শরণাপন্ন হচ্ছেন।
তবে পশ্চিমে, বিশেষ করে স্টুডিও ভিত্তিক চলচ্চিত্রে ডিজিটাল ফরম্যাটের ব্যবহারের চরিত্র বেশ ভিন্ন। সেখানে High end H.D. ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে -- যা বাজেটের দিক থেকে ৩৫ মি.মি.-এ ছবি নির্মাণের থেকে সস্তা নয়। তাছাড়া একাধিক ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে উন্নত বিশ্বে স্বাধীন ধারায় ডিজিটাল ফরম্যাটে যে সব কাজ হচ্ছে, তা অনেকটা প্রোডাকশন পর্যায়ে ১৬ মি.মি. ব্যবহার করে পরে পরিবেশক বা তহবিল সংগ্রহ করে ৩৫ মি.মি.-এ ব্লো-আপ করার সাথে তুলনীয়। অর্থাৎ বড় বাজেটের ছবির ক্ষেত্রে ডিজিটাল ফরম্যাট নির্মাতার বেছে নেয়া মাধ্যম। স্বাধীন ধারার ক্ষেত্রে এটি এখনও বিকল্প মাধ্যম। কারণ ফরম্যাটটি সহজ, সুলভ ও সস্তা।
আশির দশকে যেকোনো সৃজনধর্মী নির্মাতার জন্য যখন মূলধারায় চলচ্চিত্র নির্মাণ অসম্ভব হয়ে পড়েছিল, তখন মোরশেদুল ইসলাম ও তানভীর মোকাম্মেলের নেতৃত্বে বেশ কিছু তরুণ ১৬ মি.মি.-এর বিকল্প ফরম্যাটে ছবি বানিয়ে একটি আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কম্পিউটার স্বার নতুন প্রজন্মের জন্য আজ ১৬ মি.মি.-এর সেই বিকল্পধারার সময়োপযোগী বিকল্প খুঁজে বার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এখন হয়তো গুরুত্বের সঙ্গে হয়তো ভাবতে হবে ডিজিটাল ফরম্যাটের কথা। নতুন প্রজন্মকে বড় পর্দার কাছে -- বৃহত্তর দর্শকের কাছে -- যেতে হবে। বুঝতে হবে ভিডিও চিত্রের চূড়ান্ত দৌড় টেলিভিশন পর্যন্ত। পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে, দখল করে নিতে হবে মূলধারা। মাত্র দশ বছর আগেও বাংলাদেশের একজন নির্মাতার পে ইউরোপ, আমেরিকার ছবির কারিগরি মানের সাথে পাল্লা দেয়া সম্ভব ছিল না। কিন্তু ডিজিটাল বিপ্লব (Digital Revolution) প্রযুক্তির গণতন্ত্রায়নের মাধ্যমে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আজ এই সুযোগ ব্যবহার করে অর্জন করতে হবে ডিজিটাল লিপ ( Digital leap)। শুধু দেশীয় মূলধারা নয়, স্থান করে নিতে হবে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের মানচিত্রে।
ডিজিটাল বিপ্লব চলচ্চিত্র মাধ্যমের চরিত্র নষ্ট করবে না, বরং চলচ্চিত্র নির্মাণের অতিযান্ত্রিক চরিত্রকে নির্মাতার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে, নির্মাতা ও টেকনিশিয়ানদের মধ্যকার বিশাল বিভাজন ও দূরত্বকে দূর করবে। একজন নির্মাতা সহজেই টেকনিশিয়ানের দায়িত্বের ভাগ নিতে পারবেন। টেকনিশিয়ানরাও নির্মাতাকে কারিগরি অবদান বোঝাতে সক্ষম হবেন।
ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবাদে একজন চলচ্চিত্রকার কারিগরি বোঝায় ভারাক্রান্ত না হয়ে, ইয়াসুজিরো ওজুর ভাষায়, সত্যিকারের কারিগর হয়ে উঠবেন। আর চলচ্চিত্র মাধ্যমকে ইন্ডাস্ট্রির অট্টালিকা থেকে নামিয়ে সাধারণ কুটিরে এনে তাকে কুটির শিল্পের সৃজনশীলতা ফিরিয়ে দেবে।
তবে বর্তমানের ডিজিটাল ফরম্যাটই শেষ কথা নয়। একটা সময় হয়তো আসবে, যখন কেবল নির্মাণ নয় প্রদর্শনও ডিজিটাল হয়ে যাবে। তখন হয়তো ডিজিটাল ফরম্যাটে চিত্রায়ন করে ৩৫ মি.মি.-এ রূপান্তর করার প্রয়োজন হবে না, বরং ধ্রূপদী চলচ্চিত্রগুলোও ডিজিটাল ফরম্যাটেই আমরা দেখবো। সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন আমরা আজকের এই উত্তপ্ত, উত্তেজিত তর্ককে নিয়ে নিজেরাই হাসাহাসি করব।
ছবিঃ বাংলাদেশের প্রথম ডিজিটাল কাহিনীচিত্র, তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ পরিচালিত 'অন্তর্যাত্রা' (২০০৬) ছবির দৃশ্য।