জান্তব


আনিসুল হক


জানান নেই, নেই কোনো রোগের আগাম বার্তা, কিছু না বলেই নাকি বিকল হয়ে গেলো হৃদপিন্ড আর তাতেই মারা গেলো মন্জুর আলী। অন্ততপক্ষে ডাক্তার সাহেবের কথামতে তাই। অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইলো না। তারপরও কোনভাবেই অন্য কোনো সন্দেহের আলামত খুঁজে না পেয়ে তারাও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো। সালেহা বেগমও ছেলের মৃত্যু সহজে মেনে নিতে পারেন নি। কোনো মা-ই তা পারে না। তাকে পাশাপশি কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব খুঁচিয়ে যাচ্ছিল ভতরে । কিন্তু পরে ডাক্তারী পরীক্ষা আর পুলিশী তদন্তের পর সে খোঁচানো দূর হলো অনেকটা।

রাজনীতিতে সফল ছিল মন্জুর। কিন্তু সে সাফল্যের সাথে তাল মিলিয়ে প্রতিপক্ষও আরো শক্তিশালী হয়, এটা জানতে খুব বেশী কাঠখড় পোড়াতে হয়না। সেদিকেও সন্দেহ ঘনিভূত হতে পারে। কিন্তু ডাক্তার যা বলার, তা বলেই দিয়েছে। আর পুলিশও ধস্তাধস্তি বা সে জাতীয় কোনো আলামত খুঁজে পেলনা। অনেকেই ময়না তদন্ত করানোর পরামর্শ দিল। কিন্তু ময়না তদন্তের নামে ডোমের হাতে ছেলের দেহকে কাটাছেড়া করাতে একেবারেই মন চাইল না সালেহা বেগমের। তাই স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মেনে নিয়েই জানাজা শেষে কবর দেয়া হলো ছেলেকে।

সারা বাড়ীতে একটি শোকের আবহ কুয়াশার মতো জেকে বসে রইল। এর মাঝে প্রতিদিনই দলে দলে মানুষ আসছে শোকবার্তা জানাতে। শুরুতে ছেলের এতোটা জনপ্রিয়তার কথা ভেবে নিদারুণ এই শোকের মাঝেও কিছুটা গর্বও হলো তাঁর। কিন্তু ক’দিন পর এতো লোকের আসা যাওয়া বিড়ম্বনার কারণই হয়ে দাঁড়ালো। সালেহা বেগমকে একাই সামলাতে হয় সব। বৌমা তো কারো সামনেই যেতে চায়না। যখন এবাড়ীতে থাকে, নিজেকে ঘরের মাঝে বন্দী করে রাখে, বাকী সময়টা বাপের বাড়ীতে কাটায়। বড় মেয়ে মালার ভাবীকে পছন্দ নয় একেবারেই, অনেক সময় অকারণেই। এবাড়ীতে এলেই ভাবীর খুঁত ধরতেই আনন্দ তার। এবারও এসে সে বেশ হন্তদন্ত হয়েই মায়ের কাছে অনুযোগ জানালো,

- ভাইয়ার মৃত্যর পর এবাড়ীর মান সন্মান কি ধুলোয় মিশে যাবে মা?

মেয়েকে দেখে এই শোকের মাঝেও কিছুটা খুশীর আলো দেখলেন সালেহা বেগম। কিন্তু তার চেহারায় আষাঢ়ঘন ঝড়ের পূর্বাভাস পেয়ে সে আনন্দ মিলিয়ে গেল সহসা।

- কেন কি হয়েছে?
- এ বাড়ীর বউ যদি স্বামীর মৃত্যুর পর রঙবেরঙের সালোয়ার কামিজ পরে শহরের রেষ্টুরেন্টে ঘুরে বেড়ায়, তাহলে আমাদের সন্মান বাড়ে না কমে? লজ্জায় শ্বশুর বাড়ীতে মুখ দেখাতে পারছি না মা! ছি!
- কোথায় দেখেছিস বৌমাকে? বাইরে কোথাও গেলে তো ও একমাত্র বাবা-মা’র কাছেই যায়।
- হ্যা, তার পেয়ারের ভাইবোনদের সাথেই চীনে রেষ্টুরেন্টে দেখেছি। সাথে আরো কেউ কেউ ছিল। স্বামীর মৃত্যুর পর এটা কি ধেইধেই করে ঘুরে বেড়ানোর সময়?
- তাতে কি হয়েছে? বাড়ীতে মন খারাপ করে পড়ে থাকলে কি লাভ হতো?
- লাভ লোকসানের কথা টানছো কেন মা? এ বাড়ীর সন্মান নিয়ে টানাটানি। বাড়ীর বৌ হিসেবে সে কি একটু হালকা রঙের শাড়ী পরে বেরুতে পারে না? এইতো মাত্র ক’টা দিন হলো, মারা গেল ভাইয়া। তাকে কি একটু সন্মানও জানানো যায় না?

ক’দিন আগে বৌমাকে শাড়ী পরতে নিজেও একবার অনুরোধ করেছিলেন সালেহা বেগম। কিন্তু তার সে অনুরোধ রাখা হলো কি না হলো, সে দিকে খেয়াল রাখেন নি তিনি। এসব নিয়ে এতো বেশী মাথা ঘামাতেও ইচ্ছে হয়না তার। মেয়েকে সে কথা বললে তো আবার আগুনে ঘৃত ঢালাই হবে। তাই বললেন,
- ঠিক আছে, ওকে শাড়ী পরার কথা বলবো। তুই মুখহাত ধুয়ে চা-নাস্তা খেয়ে নে।
- একটু জোর দিয়েই বলে দিও মা। নাহলে এসব বেলেল্লাপনা দেখলে এবাড়ীতে আসাও ছেড়ে দেবো। তোমার জামাই তো আসতেই চায়না। আমিই তোমার কথা ভেবে বারবার জোরজারি করে নিয়ে আসি। নিজে দেখেছে বলে এবার তো সাথে আনতেই পারলাম না!

মেয়ে যে ডাহা মিথ্যে বলছে, তা ভাল করেই জানেন সালেহা বেগম। জামাই শাহেদকে তিনি ভাল করেই জানেন। শান্তশিষ্ট একটি মানুষ, বৌএর জ্বালায় তটস্থ। অনেক সময় কিছু বলার চেষ্টা করেও না পেরে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কোনো উত্তর না দিয়ে মেয়েকে চা-নাস্তা দিলেন সালেহা বেগম। সেটা শেষ হলে মায়ের সাথে একটু গল্প করে চলে গেল মালা। ভাবীর সাথে সামান্য দেখা করার কথাটিও ভাবলো না।

ছেলের কথা ভেবে আবার কাঁদলেন সালেহা বেগম। একটি ছেলে আর একটি মেয়ে তার। মেয়েটি রুক্ষ স্বভাবের, আরো রুক্ষ হয়ে উঠছে দিনকে দিন। ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম। ভেতরে ভালোবাসা, মায়া মমতার চেয়ে আত্মগত এক কাঠিন্যই যেন বেশী ছিল তার। সে কাঠিন্য ছোটবেলা থেকেই এক ধরনের নিষ্ঠুরতা হয়ে প্রকাশ পেয়েছে বাইরে। পোষা বিড়ালের বাচ্চাকে পানিতে ডুবিয়ে রেখে মরার একটু আগেই তুলে আনতো বারবার। বাচ্চাটি তাতে মারা যায়নি বটে, কিন্তু হিংস্র এক প্রাণীতে পরিণত হলো। একমাত্র মন্জুর ছাড়া অন্য কেউ কাছে এলেই চাপা গর্জন করে আক্রমণের জন্যে তৈরী হতো। আরেকবার নিজের বোনকে শীতের সময়ে ঠান্ডা পানিতে বসিয়ে রাখলো, কতোটা কষ্ট পায়, তা দেখার জন্যে। সালেহা বেগম সময়মতো টের না পেলে ঠান্ডা লেগে হয়তো মরেই যেতো মালা। এ ছাড়াও নানা ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রমাণ দিয়েছে সে। স্বামী যখন মারা যান, তেরো বছর বয়েস মন্জুর। মৃত্যুর সময় চারপাশে সবাই বসে। নিজেও কাঁদছেন। ছেলের দিকে চোখ যাওয়াতে ভয়ে কান্না থেমে গেলো তার। কেমন যেন ভাবলেশহীন মৃত চোখের দৃষ্টি নিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো মৃত্যু শুধু নিরীক্ষণযোগ্য, মৃত্যুকে শুধুমাত্র নিরীক্ষাই করে যাচ্ছে সে দৃষ্টি। বাবা মারা যাবার পর অবশ্য অনেক কেঁদেছে ছেলে। কিন্তু সে দৃষ্টির কথা আজও ভুলতে পারেন নি, সালেহা বেগম।

স্কুলেও দুরন্তপনার চেয়ে নিষ্ঠুরতাই ছিল বেশী । যে সব অভিযোগ আসতো, বাইরের সবাই তা দুরন্তপনা হিসেবে দেখলেও ছেলের নিষ্ঠুরতাই বেশী চোখে পড়তো তাঁর। পড়াশোনায় তেমন ভাল না হলেও ইউনিভার্সিটি অবধি গেলো মন্জুর। তারপর ছাত্ররাজনীতির সূত্র ধরে ক্যাডার হয়ে রাজনীতিকেই ব্যবসার পাশাপাশি পেশা হিসেবে বেছে নিল। মাঝে মাঝে নানা অস্বাভাবিক ঘটনার উড়ো আভাস ভেসে এলেও এ নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাননি মা। বরং ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করলেন। দেড় বছর পর পোয়াতী হলো বৌমা। নামী ডাক্তারের সার্বক্ষণিক নজরে থাকলেও কোন এক অজানা কারণে মায়ের পেটেই নষ্ট হয়ে গেলো সে সন্তান। বৌমা বেশ কয়েক মাস শোকে ঘরের কোনে বসে রইলো। ছেলের রাজনৈতিক জীবনে নানা মারপিটের আর সহিংসতার কথা শোনা গেলেও সেটাকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিলেন তিনি। আর ছেলে তো স্বাভাবিকই ছিল তার? মায়ের সুবিধা অসুবিধার দিকে যে ছেলের এতোটা নজর, তাকে কি করে অস্বাভাবিক বলবেন তিনি? বরং বললে সবাই উল্টো অবিশ্বাস করতো তাতে। স্বামী যখন বেঁচে ছিলেন, এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে তিনিও বিরক্ত হতেন।

দারোয়ান এসে একটি নিমন্ত্রণপত্র দিয়ে গেলো। মন্জুর যে রাজনৈতিক দলের নেতা ছিল, তাদের শোকসভা। সবাইকে যেতে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে যেতে সালেহা বেগমের ইচ্ছে করেনা একেবারেই। তারপরও যাবেন বলে ঠিক করলেন। ছেলেতো নেই আর, এখন বৌমাকে নিয়ে একা সংসার। ছেলের দলের লোকজন সন্মান করে। কখন কোন্ কাজে দরকার পড়ে কে জানে! বৌমাকেও নিয়ে যাবেন বলে ঠিক করলেন। জোর দিয়ে বলবেন শাড়ী পরে যাবার জন্যে।

সময় মাঝে মাঝেই তার চলার পথে সাপের মতো ফনা তুলে ছোবল মারে। সে বিষে অসময়েই বিদায় নিলেন স্বামী, এবার ছেলেও গেলো। একমাত্র সালেহা বেগমই টিকে আছেন মালাকে নিয়ে। সেও এখন পরের ঘরে। মাঝে মধ্যে আসে বটে, তবে নানা অভিযোগ জানাতেই তার বেশী আনন্দ। এ বাড়ীর কাঠিন্যের দেয়ালে টক্কর খেয়ে জামাইও সহজে এমুখো হতে চায় না। কিন্তু তাঁকে তো টিকে থাকতে হবে। একাই তো সামলালেন জীবনের অনেকটা বছর। আর সেজন্যে পরিকল্পনার দরকার আছে যথেষ্ট। নিজেকে শক্তও হতে হবে। এসব ভেবে, বৌমার জন্যে অনুষ্ঠানের সাথে মানানসই একটি শাড়ীও কিনে আনলেন।

অনুষ্ঠান যেমন হবার, তেমনই হলো। শোক প্রকাশ আর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় শোকের চেয়ে মঞ্চে নিজেদেরকে দাঁড় করানোই জরুরী বলে প্রমাণ করলো উদ্যোক্তারা। নিজের ইচ্ছের চেয়ে প্রয়োজনটা বেশী অনুভব করে তিনি নিজেও দাঁড়ালেন মঞ্চে। কিন্তু বৌমা যে কিভাবে রেহাই পেয়ে গেল, তা নিজেও টের পেলেন না।

বাসায় ফেরার পথে গাড়ীতে শাহানার দিকে চেয়ে মনটা আবার নরম হয়ে গেল তার। শূন্য দৃষ্টিতে গাড়ীর জানালা পেরিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। হুহু করে উঠলো তার বুকের ভেতরটা। এত্তটুকু একটি মেয়ে, বয়েস তিরিশও পেরোয় নি! কী কষ্ট নিয়ে কাটাবে বাকী জীবনটা, ভাবতে ভাবতে খুব মায়া হলো তার। পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে গিয়েই চমকে উঠলেন সালেহা বেগম। সারা পিঠ এমনভাবে কাটা কাটা অমসৃণ দাগ, যেন চাবুক মেরেছে কেউ। তিনি আরেকটু ভাল ভাবে পরখ করতে চাইলেই সরে বসলো শাহানা। তারপরও তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
- কি হয়েছে তোমার পিঠে বৌমা। এসব কিসের দাগ?
ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো শাহানা। কিন্তু চোখের তারায় বেদনা আর কান্নার ভরাট সাগর।
- এসব কিছু নয় মা! সময় পেরুলেই ঠিক হয়ে যাবে সব!

যেন চাবুকের আঘাত পড়লো মুখে। ছেলে যে তার কতোটা অচেনা ছিল, আরেকবার ভাল করে টের পেলেন মা! শাড়ী পড়তে না চাওয়ার কারণটি জলের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠলো। বাইরে তখন অন্ধকার জমাট বাঁধছে ধীরে ধীরে। আকাশের জমানো মেঘ সে অন্ধকারকে আরো ঘন করার প্রচেষ্টায় ছড়িয়ে পড়ছে যত্রতত্র। সালেহা বেগম সেদিকেই শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।