অবসন্ন কথা

গৌতম রায়

সকালে অফিসের বাসে যেতে যেতে মিতা হকের কণ্ঠ পূষণের চোখে পানি এনে দেয়- শুধু যাওয়া আসা, শুধু স্রোতে ভাসা... পাশের সহকর্মী কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পায় না, তার আগেই পূষণ বলে ওঠে- মাথাব্যাথায় আমি একদম ঠিক থাকতে পারি না। বেশ ভোগাচ্ছে দিন ধরে!

আজকাল পূষণের প্রায়ই এমন হচ্ছে। অরিত্রির সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হওয়ার পর থেকেই পূষণ নিজেকে সময় সময় ধরে রাখতে পারছে না। একদিন তো কাজ করতে করতে সবার সামনে হঠাৎ করে হু হু করে কেঁদে উঠলো।

 

 

পরক্ষণেই সহকর্মীদের ত্রস্ত আনাগোনায় সেটিকে ডাইভার্ট করে নিতে হলো মাথাব্যাথায়। সবার সামনে ওষুধও গিলো ফেললো একটি। এটাই তো স্বাভাবিক! কলিগরা চলে গেলো নিজ নিজ ডেস্কে। অরিত্রি অবশ্য তার ডেস্ক থেকে উঠে এসেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু সে কি বুঝতে পারলো কিছু? বুঝতে কি চেষ্টা করেছিলো? অরিত্রি-পূষণ সহকর্মী। ফলে সম্পর্কের এই টানাপোড়েনে কিছুটা জমাট তরল ক্ষণে ক্ষণে কঠিন হয়ে যায়; আবার মাঝে মাঝে সম্পর্কের বরফ কিছুটা তরল হতেও চেষ্টা করে। কিন্তু হিসেবের শেষ ঘরটিতে কেবল ডেবিটই হতে থাকে বারবার।

এই যে পূষণ এখন প্রায় রাতেই না খেয়ে শুয়ে পড়ে, তাতে কি অরিত্রির ক্ষুধা বাড়ে? রাত তো অনেক দূর, তার আগে সূর্যকে ডুবতে হয়; দিনের বেলাতেই কতোদিন পূষণ দিনের পর দিন না খেয়ে সময় কাটিয়ে দিচ্ছে, সে খবর একসময় অরিত্রির নিজস্ব সংবাদপত্রে হেডলাইন হলেও এখন সেটি নিউজ ভ্যালু হারিয়েছে। পূষণ জানে, কোনোকিছুতেই কোনো লাভ নেই, অরিত্রির চোখে যে আরেক আগ্রহ দেখেছে সে- তাতে পূষণের নিজেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই

সুন্দর একটি ড্রেস পরেছিল সেদিন অরিত্রি। এমন সৌন্দর্যকে প্রশংসা না করা অন্যায়- ভেবে পূষণ অরিত্রির ডেস্কে যাওয়ামাত্রই বেজে উঠে অরিত্রির ফোন। নামটা আবছাভাবে দেখতে পায় সে, তার চাইতে পূষণের চোখে অবাক হয়ে দেখা দেয় স্ক্রিনে নাম দেখে অরিত্রির কথা বলার ব্যাকুল আগ্রহ। পূষণ আগ্রহের মানে জানে। খুব ভালো করেই জানে অরিত্রির চোখের আগ্রহ কীসের আশায় ব্যাকুল! পূষণ শুনে 'হ্যালো' শব্দেই কী অসম্ভব মুগ্ধতা ছড়িয়ে দেওয়া যায় অপরপ্রান্তে। অসম্ভব ব্যথিত হতে হতে আস্তে করে সরে আসে পূষণ। আসতে আসতে টের পায়- পূষণ নয়, পূষণ নয়, আর পূষণ নয়...

পূষণের হিসেব ভুল হয় না। উপলব্ধিজাত ক্ষমতা তার জন্মগত, রইসউদ্দিন স্যারের বেতের আঘাতে ছোটবেলা থেকেই শাণিত হয়েছে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাও। নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও পূষণ বুঝতে পারে, কখন মানুষ এমন উজ্জ্বল হয়...

দিন যেতে থাকে, পূষণ দেখতে থাকে অরিত্রিকে। দেখতে থাকে অরিত্রির ব্যাকুলতার বেড়ে ওঠা। পূষণ কাছে যাওয়ামাত্রই অরিত্রির ব্রাউজারের স্ক্রিন বন্ধ হয়ে যায়, ভাঁজ পড়ে কপালে- অপরাধীমুখে পূষণ আস্তে করে সরে আসে প্রায় প্রতিটা দিন। অফিসিয়াল কাজের মেইলও এখন আরেক ডেস্কের কম্পিউটার ঘুরে আসতে হয়। ফেসবুকে পূষণ দেখে অরিত্রির বেড়ে ওঠা। অনেক নতুন বন্ধু হয়; পুরনো একজন ঝরতে থাকে আস্তে আস্তে। নতুন একটি ইলেকট্রনিক পোস্ট-অফিস বরাদ্দ হয় হয়তো শুধু বিশেষ কারো জন্য। সম্পর্কের আপনি দূরত্ব আস্তে আস্তে থিতু হয় তুমি-কাছের উষ্ণতায়। পূষণের জন্য বরাদ্দ টকটাইম হয়তো ঘুরতে যায় আরেক এফএনএফে। হ্যাঁ হয়তো, কারণ নিশ্চিত হওয়া পূষণের জন্য পাপ। কিন্তু পূষণ জানে আকাশে মেঘ থাকলে কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো বৃষ্টি ঝরবেই। নিজের পর্যবেক্ষণকে তাই প্রবলভাবে বিশ্বাস করে সে। হয়তো এখনই ঝরছে, অন্য কোথাও, পূষণ কেবল জানে না জায়গাটার আসল নাম। শুধু জানে, যে উন্মুক্ততা ছিলো একদিন তাদের সম্পর্কের বীজ, আস্তে আস্তে লুকোচুরি হয়ে যায় তাদের দূরত্বের বন্ধন। অরিত্রি অবশ্য টের পায় না পূষণের চৌচিরফাঁটা হাহাকার। যে চোখ যায় আকাশের পানে, সমুদ্রের নীল তাকে টানতে পারে কখনো? যে মন ডুব দেয় সাগর মাঝে, আকাশ তাকে বৃষ্টি দিয়ে ভেজাতে পারে না

পূষণ একটি এপিটাফ তৈরি করে রাখে। না, সেখানে সে কাউকেই দায়ী করে না তার মৃত্যুর জন্য; কিংবা দায়ী করে একমাত্র নিজেকেই; কিংবা দায়ী করতে চায় এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকেই। যে দুটো হাত একসময় পূষণের গালে সুখ খুঁজতো, সেগুলোর স্মৃতি নষ্ট করতে এছাড়া আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না পূষণ। ফার্মেসির দোকানে তাই ফ্রিজিয়াম আর সিডাকসিনের স্টক কমতে থাকে প্রতিনিয়ত। একমাত্র দর্শক পূষণের সামনে সেগুলোর প্রদর্শনী হয় প্রতিনিয়ত, প্রতিরাতে। দেখতে দেখতে পূষণ ভাবে- কী হয় তার ওপর দিয়ে একটা যান্ত্রিক বাহন হঠাৎ করে চলে গেলে, কোনো এক গভীর রাতে? হার্ট অ্যাটাকই বা কেন শুধু বয়স্কদের ভালোবাসে? রাসায়নিক ভালোবাসা খেয়ে চিরজীবনের মতো ঘুমাতে চায় না পূষণ; কাপুরুষতার তীক্ষ্ণতা তাতে ছলকে ওঠে। তার চাইতে যন্ত্রের একলহমার লণ্ডভণ্ড পূষণের শরীরটাকে চরম আদরে ভরিয়ে দিলে জীবন নিয়ে কৈফিয়ত দিতে হয় না কারো কাছে!

 

 

 

 

পূষণের শরীরে তিল জমতে থাকে, কষ্টের তিল। পূষণকে চিকিৎসাবিদ্যা জানিয়ে দিয়েছে, ক্যান্সারের যে বীর্য তার শরীরে বেড়ে উঠছে আস্তে আস্তে, নিজেকে ছুরির তলায় না ফেললে কষ্টকর জীবন শুরু হবে আর কিছুদিন পর থেকেই। ঘুমজাগানিয়া গোলক হাতে নিয়ে উন্মত্ত হয় পূষণ; দেখতে চায় যে কষ্টদাহ বইছে এখন তার পুরো শরীরে- ক্যান্সার কষ্ট তার চাইতে বড় কিছু কিনা!

 

 

 

দুটো নাম মুখস্থ করতে থাকে পূষণ-অরিত্রি আর পূষণের পরস্পরের নিজস্ব নাম- যেন মুখবন্ধ হওয়ার সময় সর্বশেষ সেই শব্দটিই বের হয়।

(অনুমতি থাকলেও আমার একজন বন্ধুর জীবনের এই ঘটনাটিকে গল্প নামে চালিয়ে দেওয়ায় আমি সেই জীবনের প্রতি ক্ষমাপ্রার্থী)

২০০৮-০৫-০১