আমার চোখে আমেরিকা - পূজা

পার্থসারথী ব্যানার্জী
 


অবশেষে পূজো এসে গেল। ভীষণ বাড়ীর জন্য মন খারাপ করছিল। এখানে বলে রাখি আমি নাস্তিক। একমাত্র দুর্গাপূজাটা একটু অন্যচোখে দেখি। দুর্গাপূজা কালে কালে দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে। এই চারটে দিন আমার গোটা রাজ্য যেন পাগল হয়ে ওঠে। হুজুগে বাঙালী তার পূর্ণতা পায়। ছোট্টবেলা থেকে দেখে এসেছি এই সময় আমাদের বৃহত্তর পরিবার একত্র হয়। নির্ভেজাল আনন্দ! বড় হবার সাথে সাথে আমার পরিচিতির বৃত্ত, পরিবার ছাড়িয়ে বন্ধুত্বে বিস্ত্বত হয়েছে। সে আর এক মজা। এই সব ছেড়ে নিঃসঙ্গ বিদেশ - মেনে নিতে পারছিলাম না। বন্ধুরা, বাড়ির সবাই, পূজার মাস খানেক আগে থেকেই নিয়মিত খবর দিয়ে যেতে লাগল। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। দু-এক জনকে জিজ্ঞাসা করায় ভরসা দিল, "চিন্তা নেই, এখানেও পূজা হয়।" ভরসা খুব একটা পেলাম না। কারণ আমার সেই পরিচিত বৃত্তের অভাবে পূজায় মস্তি কি করে করব!
হঠাৎ একদিন দেখি আমার office mail-এ একটা দুর্গাপূজার বিজ্ঞাপণ পাঠিয়েছে আমার এক সহকর্মী। আসলে চমকটা সে কেবল আমাকে পাঠায়নি গোটা অফিসের সবাইকে পাঠিয়েছে। কিন্তু আমি আরও বেশি চমকেছি আর একটা ব্যপারে। দুর্গাপূজার বিজ্ঞাপ!! ধনতান্ত্রিক দেশের তন্ত্র-মন্ত্রে বাঙালীও ব্যবসাটা শিখে ফেলেছে! এতটা সরাসরি ভাবে নিজের দেশেও বাঙালী পারে নি এখনো পর্যন্ত। আমেরিকায় সব সম্ভব। সুন্দর ঝকঝকে flier। আগাগোড়া পেশদারিত্বের ছাপ। আস্তে আস্তে সবার সাথে আলোচনা করে জানা গেল আমার সংস্থার জন্য প্রবেশ মূল্যে বিশেষ ছাড় আছে। ১০০ টাকারটা মাত্র ২০ টাকায়। ভালই হল।
পূজো হবে তিনদিনের। শুক্রবার, শনিবার ও রবিবার। শুক্রবার তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরোলাম সবাই। আগে থেকে একটা ৭ আসনের taxi বলা ছিল। এদেশে taxi রাস্তার ধারে যাত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে না। ওদের সংস্থার অফিসে ফোন করে ডাকতে হয়। আমরা সাতজনে গেলাম পূজা দেখতে। জায়গাটা একটা বিদ্যালয়। সপ্তাহান্ত বলে ছুটি আর তাই ভাড়ায় দিয়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়ে এই বিদ্যালয়। তাই লোক প্রচুর হলেও সমস্যা হয়নি। "আমেরিকান বাঙালী" বলে একটা নতুন জাতি খুঁজে পেলাম। যারা সারা বছর মা দুর্গাকে বাক্সবন্দী করে রেখে সপ্তাহান্তে বার করে পুজো করে! এই বাক্যটা আক্ষরিক অর্থেই সত্যি। বাঙালী সব পারে!
একটা জিনিস মজার লেগেছে, মা দুর্গা আমাদের মতই onsite এসে Dollar কামাচ্ছেন! প্রণামীর থালা dollar-এ ভর্তি ছিল। ABCD (American Born Confused Desi)-রা এসে বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করছে, "Pops I could not understand why the goddess needs to have ten hands? It seems she can kill that bastard with two hands." বাবার উত্তরটা আর শোনা হয়নি!! তবে ভদ্রলোকের মুখ দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল।এক ভদ্রলোক দেখলাম দুই ছেলেকে নিয়ে সস্ত্রীক এসেছেন। উঠতি বয়সের ছেলে দুটো। কি সব বিদঘুটে চুলের কায়দা। হাতে বালা জাতীয় একটা জিনিস। জিনস, টি-শার্ট ও স্নিকারে সম্পূর্ণ। গর্বিত বাবা নির্দেশ দিলেন ছেলেদের, "প্রতিমার সামনে মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে পড়। ছবি তুলব।" সুখী বাঙালী পরিবার। কিন্তু ছেলেদের অতটা সুখী মনে হল না প্রস্তাবটা শুনে। যাইহোক, মায়ের দুপাশে দুই ছেলে, পিছনে মা দুর্গা স্বয়ং। পিতা ছবি তোলার জন্য তৈরী। কিন্তু ভদ্রলোকের কিছুতেই মনপূতঃ হচ্ছে না। অবশেষে বলেই ফেললেন, "Smile please!!" এইবারই হল সমস্যা। ছেলেরা অনেকক্ষণ বাধ্য হয়ে ছিল। আর পারল না। "Am not feeling like smiling. Just take the snap or leave it." বাবা স্তম্ভিত আর সেই সঙ্গে আমরাও। আর বেশিক্ষ বসে থাকা গেল না।
এবার খাবারের জন্য হুড়োহুড়ি। বাঙালী বিদেশে থেকেও সভ্যতা শিখলনা। সেই ধাক্কাধাক্কি আর ঠেলাঠেলি। তবে মিথ্যে বলব না বেশ মজা লাগছিল। আমিও বাকিদের সাথে হুল্লোড়ে ভিড়ে গেলাম। মেনু হল খিচুড়ি, পাঁঠার মাংসের ঝোল, ল্যাংচা, পাঁপড়ভাজা আর আমসত্বের চাটনী। বেশ ভাল রান্না। তৃপ্তি করে খেলাম। এবার জলসা। ঐ বিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহেই ব্যবস্থা হয়েছে। টিকিট এখানেই লাগবে। আজকে গান শোনাবেন বাবুল সুপ্রিয়। কোলকাতার নিকটবর্তী ব্যান্ডেলের বাঙালি ছেলে বম্বে গিয়ে নাম করেছে। বেশ জমাটি অনুষ্ঠান শুরু হল। এইবার শুরু হল এক নতুন অস্বস্তি। দুদুটো গান হয়ে গেছে তাও কেউ নাচছেনা। সবাই যেযার আসনে বসে গম্ভীর ভাবে হাততালি দিচ্ছে। ধুর এই ভাবে কি জলসা হয়। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চায়ি করে একসাথে সবাই মিলে এগিয়ে গেলাম মঞ্চের সামনে। শুরু হল আমাদের উদ্দাম নৃত্য। আয়োজকরা তটস্থ, বিব্রত। তবে এই ভাবে নাচের মজা হল এটা ভীষণ ছোঁয়াচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা হল নাচতে শুরু করল। Michel Jackson-এর দেশে এসে আমরা ABCD-দের নাচ শেখালাম।
পরের দিন অষ্টমী ছিল অনেকে তাই সকাল থেকে এসেছিল অঞ্জলি দেবে বলে। আমরা অবশ্য সেই সন্ধ্যাতেই এলাম। কিছুক্ষণ ভাট মেরে আবার খাবার লাইন। আজকের মেনু হল বিরিয়ানি। আজকের জলসার আকর্ষণ হল দেবোজিৎ। এই ছেলেটা দেশে একটা টিভি চ্যানেলের একটা গানের প্রতিযোগিতা জিতে বেশ নাম করেছে। এর ওপর আবার বেশ নাচতে পারে ছেলেটা। মঞ্চ ছেড়ে নেমে এসে আমাদের সাথে বেশ ভালই নেচে গেল। তবে এই দিনের সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হল একদম শুরুতে। আমরা আসনে বসে প্রথম গানটা শুনছি যখন তখনই দেখি পুরো ABCD জনতা বাঁধনহারা নাচ শুরু করে দিয়েছে। আমরাও এত উতসাহী "ছাত্র-ছাত্রীদের" দলে ভিড়ে যেতে দেরী করিনি।
ভালই কাটল সন্ধ্যাটা।
দশমীর দিন আর যাইনি। পরে শুনলাম যে ও দিন স্থানীয় কচি-কাঁচারা এক মনোজ্ঞ সাংস্ক্বতিক অনুষ্ঠান করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে একটি উঠটি বয়সি মেয়ে হিন্দি ছায়াছবির গানের সাথে নাচতে গিয়ে প্রায় খেমটা নেচে ফেলেছিল। সেই নাচ এমন উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল যে উতসাহী জনতা সেই নাচের ভিডিও You Tube-এ তুলে দিয়েছিল।
সব মিলিয়ে এই হল আমার প্রথম আমেরিকান পূজো।
১১।০৭।০৮