দুর্গা পূজার একাল সেকাল
শুভ শঙ্কর সরকার
বিশ্বকর্মা পূজায় ঢাকে বাড়ি পরতেই মনটা কেমন উদাস হয়ে বাড়ি ছুটে যায়। শরতের নীল আকাশের সাথে মিলিয়ে যাওয়া কাঁশবন হাওয়ায় দুলতে দুলতে হাতছানি দিয়ে ডাকে। কাজে আর মন বসেনা। একে একে মনে পরতে থাকে ফেলে আসা পূজোর দিনের স্মৃতি গুলো। মেঘের ভেলায় সওয়ার হয়ে মন ছুটে বেড়ায় বছর থেকে বছরে।
ছোটবেলায় ঠাকুর আনতে গেলে বড়রা গাড়ি থেকে নামতে দিতেন না। ওরা সবাই নেমে ঠাকুর গাড়িতে তুলতেন। গাড়ির সামনে লাইন দিয়ে পাড়ার মহিলারা লালপাড় শাড়ি পরে হেঁটে আসতেন। হাতে প্রদীপ। আমার দাদা আর ওর বন্ধুবান্ধব বড়দের হাতের ব্যরিকেডে নাচতে নাচতে ফিরতো। আমরা গাড়ির থেকে দেখতাম আর ভাবতাম, কবে বড় হব।
সপ্তমীতে সেই স্থলপদ্মের গাছ থেকে ফুল পেড়ে পূজোর জন্য নিয়ে যাওয়া। যাওয়ার আগে বাবা মাকে প্রনাম করে কাতর নয়নে চেয়ে থাকা একটা টাকার আশায়। মিলত টাকার ভগ্নাংশ। তাই অনেক। ১০ পয়সার বেলুন দশটা, মটরভাজাও অনেক। সারাদিন পূজোর মন্ডপে দৌড়ে বেড়াত মনের সাথে শরীর।
মূলতঃ অষ্টমীর দিন এখানে পূজোয় ঠাকুর দেখতে বেড়োবার রেওয়াজ ছিল। আত্মীয় স্বজন, পাড়া পড়শী সবাই একসাথে দলবেঁধে ঘুরে বেড়াতাম মন্ডপে মন্ডপে। পায়ে হেটে। প্রচন্ড ভীড়ে হাত ছাড়লেই হারিয়ে যাওয়ার ভয়। পুরো শহর ঘুরতে হয়ে যেত ১০-১২ কিলোমিটারের জার্নি। ফেরার পথে জিলিপিতে কামড় দিয়ে মায়ের হাত ধরে টানতাম। মা বুঝতে পেরে কোলে তুলে নিতেন। ফেরার কিলোমিটারগুলো ট্রান্সফার হয়ে যেত মায়ের পায়ে।
নবমীর দিন আমাদের এখানে আরতি প্রতিযোগিতা হয়। পুরো এলাকা ভেঙ্গে পড়ত পাড়ার মন্ডপে। কঁচি কাঁচাদের সাথে আরতি দিতে নেমে পড়তেন বড়রাও। মহিলারাও শাড়ির আচল কোমরে গুঁজে। নাচতে পারতাম না। আরতির ঢাকের বাজনায় পা নাচতো শুধু। এখনও নাচে। ঢাকের বাজনায় অদ্ভুত আবেশ আছে। আরতি শেষে পুরস্কার বিতরনী। এই সময়টাতেই শুধু আফসোস হত নাচতে না জানার। খিচুড়ি খেয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতাম পুরস্কার নিচ্ছি। অনেক স্বপ্নই পূরণ হয়েছে স্বপ্নে।
দশমীর দিন গোটা শহরের প্রতিমা বিসর্জন হয় "করলা নদী"তে। প্রায় ৫০-৬০টা পূজো ছিল। নদীর ঘাট ভাগ করে দেওয়া হত। সাথে বসত মেলা। তখনও মদের ব্যাপ্তি ঘটেনি। এইদিনের জন্য একটু শিথিল থাকত বড়দের রাশ। তারাও একটু আধটু গলা ভেজাতেন শরীরে তাল আনতে। উদ্দাম পরিবেশ। একটা একটা ঘাটে কয়েক হাজার মানুষ। নদীতে নৌকোর সার। প্রতিমা আসছে গরুর গাড়িতে খুব বড় পূজো হলে ট্রাকে। সাথে মিছিল করে সে পাড়ার ছোট বড় সবাই। স্লোগান চলছে, দূর্গামাই কি....জয়....আবার কবে? বছর পড়ে। ঘাটের পাশে মাঠে প্রতিমা নামিয়ে উদ্দাম নাচ। একসাথে কয়েকশ ঢাক। বাজির আওয়াজ, আলোর রোশনাইতে মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র। মহিলারা সেই নাচে সাধারনত অংশ নিতেন না। তালিকা অনুসারে মাইকে ক্লাবের নাম ঘোষণা করা হত। এক এক করে হয়ে যেত বিসর্জন। শান্তিজল ছিটিয়ে বিজয়ার কোলকুলি শেষে আস্তে আস্তে বাড়ির পথ।
এখন বদলে গেছে অনেক ধরণ। বদলায়নি শুধু আসছে বছর পূজোর জন্য অপেক্ষার শুরু।
২২.১০.২০০৭