বান্ধব


লীমা জামান শিল্পী


সেই প্রতিবাদী দুঃসাহসী মেয়ে পলা আজ তিলতিল করে যে মানুষে পরিণত হয়েছে তা নিজের কাছেও অচেনা। পলা ভবিষ্যত দেখতে পেতো তবু কেন সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়লো কে জানে। সত্যি সে বদলে গ্যাছে। বাইরে থেকে হাসির আনন্দের যে চিত্র সবাই দেখে সেটা আসলে তার সুন্দর পরিপাটি খোলস। এর আড়ালে যন্ত্রনার বিভৎস রূপটি ঢাকা পড়ে আছে। বিশ্বাস করে যে ভূমিটি আকড়ে ধরেছিল সেটা ছিলো ভুলে ভরা চোরাবালি।
পলা সাতদিন আগেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল। রিপোর্ট পজেটিভ। সমস্ত পেপারস্ রেডি করতে সপ্তা কেটে গেল। রাত প্রায় একটা বাজে। পাশে পাভেল ঘুমোচ্ছে। কি শান্ত নিষ্পাপ মুখ। চোখের সামনে বারবার টুকরো স্মৃতি ভেসে উঠলো। ফেলে আসা ছয় বছর আগের ছবি। একুশ বছরেও কাউকে নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি। তখন ভেবেছে বাকীটা জীবন সুরের সাধনায় কেটে যাবে। এক বৈশাখে অবধারিত এমন ভাবে পলার জীবনে পাভেল নামের পুরুষ শান্তির বাক বাকুম বীনা বাজালো। এই বয়সে দূর্দান্ত প্রেমে ভাসতে লাগল পলা। কে জানতো ভাসতে ভাসতে জল খেতে খেতে শ্বাস রোধ হবে তার। আহ্ প্রচন্ড শ্বাস কষ্ট । চোখ মেলে দেখে পলা জানালা তো খোলাই আছে। তবু অক্সিজেন কেন তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। পাশ ফিরে দেখে পভেল ঠিক আগের মত ঘুমোচ্ছে। মনে পড়ে বিয়ের পর পাভেলকে বলেছিল-
: এই আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি মা হতে চাই।
: পড়াশুনার কি হবে?
: আর পড়বো না সোনা বাচ্চা!
: বেশী বাকী নেই তো।
: আল্লা তিন বছরের মানে বোঝো? তুমি ভাই এইসব বলতে আইসো না। বিয়ে করছি বাচ্চাকাচ্চা পালবো ব্যস। কিসের পড়া?
: আর গানের কি হবে?
: আশ্চর্যতো গায়িকাদের বাচ্চা হয়না নাকি ?
: ঠিক আছে তুমি যা ভালো মনে করো তাই করবা।
: থ্যাংক ইউ জানটুস।
: ফাঁকিবাজ।
: স্বামীর কাঁধে পা তুলে খেতেই বেশী ভাল্লাগে। জানো আমি মেয়ে চাই। মেয়ের নাম রাখবো তোমার নামের সাথে মিলিয়ে 'পায়েল'।
: পাভেল হেসে বললো, আর ছেলে হলে ?
: ছেলে হবে না তো।
: তোমার কল্পনার দৌড় দেখে আমার ঘুম আসছে। আসো শুয়ে পড়ি।
: এই সারাদিন এতো ঘুমাস ক্যান।
একটু ভালোবাসার কথা বলনা পাখী।
: কি শুনবা আমি তো বলতে পারি না।
: বা-বা বিয়ের আগে তো ভালোয় পারছো। ঢং করবা না বলো আই লাভ ইউ।
: বললাম।
: কই বললা ?
: আচ্ছা যাও আই লাভ ইউ, এখন ঘুমাও।
: আমিও তোমাকে আই লাভ ইউ!
প্রায় ভোর হয়ে এল। সব কাগজ পত্রের সাথে একটা চিঠিও লিখে যেতে যায় পলা।
 

পাভেল,
আমার চলে যাওয়াতে তুমি অবাক হবে না জানি। তুমি সব কিছু খুব স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারো। বিয়ের পনের দিন আগে তুমি যখন গয়নার ডিজাইন আর সবকিছু পছন্দ করার পর আমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে তখন আমি ছিলাম তোমাতে বিভোর। তোমার হাসপাতালে ডিউটি ছিল তাই আমাকে রেখে চলে গেলে। ঐদিন প্রথম তোমার মাকে পা ছুঁয়ে ছালাম করলাম। শ্রদ্ধায় মনভরে গেল। রুচি আর শিক্ষার দীপ্ত মুর্তি। উঁনি বলেছিলেন আজ স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছি তোমার গান শুনবো বলে। উনি আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিলেন না। চা হাতে কুলসুম ঢুকে জিগ্যেস করল খালা আম্মা এই আপা কে ? উত্তরে মা বলেছিলেন, এখন বলা যাবে না। পরে শুনবি। যা ওকে ও চা আর নাস্তা দে। দুপুর বারোটার দিকে বসে টিভির চ্যানেল বদলাচ্ছি আর তোমার ভদ্র সৌম্য মুখটা ভাবছি। কুলসুম ঘর মুছছিল জিগ্যেস করলাম তোমার নাম কি? লাজুক হেসে উত্তর দিল । আমি ওকে কুসুম বলে ডাকলাম । হঠাৎ খেয়াল করলাম ওর বুকের আঁচল ঘসে পড়েছে। খোলা বুকের অর্ধেকটা যেন ইট চাপা হলদে ঘাস সেখানে পুঞ্জ পুঞ্জ মেয়ের মত জমে আছে নীল রং রক্ত জমাট চুম্বন দাগ। জিগ্যেস করলাম, কুসুম তোমার বিয়ে হয়েছে কবে? লজ্জায় ওর শ্যামলা মুখটা যেন খয়েরী হয়ে গেল। ও শুধু হাসলো কিছুই বললো না। এদিকে আমিও অকারণ লজ্জায় লাল নীল খয়েরি হলাম।
বিয়ের পর ওকে দেখিনি। দু’মাস পর হঠাৎ একদিন সকালে কুলসুম এসে হাজির। আমার পায়ে হাত দিয়ে ছালাম করতে গেছে আমি বাধা দিয়ে বললাম এই তুমি কে? বললো আপা আমি কুলসুম। কুসুম তোমাকে তো চিনতেই পারিনি। তুমি কি অসুস্থ?
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছি বললো, আপা আমার খুব বিপদ। বললাম, আমাকে খুলে বলো কোন চিন্তা করোনা।
: আপা আমি মরতে চাইছিলাম। বুড়া মা আর ছোট বোন মরতে দিল না।
: ক্যান মরতে চাও আমাকে বলো কোন ভয় নেই। কি বিপদ তোমার কুসুম?
: আপা গো আমি পুয়াতি আমারে বাঁচান।
ওর সর্বনাশের পিশাচকে আমি ঐ প্রথম চিনলাম। তার ছবিতে থুতু ছিটিয়ে অসংখ্যবার ঘৃনা করি বলেছিলাম।
আমার গয়না বেচে ওকে ক্লিনিকে নিয়ে এবরশান করালাম। ওর চিৎকার আমি শুনেছিলাম কিন্তু আমার চিৎকার কেউ শোনেনি। কারণ আমার জন্য কেউ বাইরে অপেক্ষা করে ছিল না। কুলসুমকে বাড়ী পৌঁছে দেবার ৩ দিন পর আমাকেও আমার চেতন অবচেতন তাড়িয়ে নিয়ে গেল সেই ক্লিনিকে। এ যুদ্ধ আমি একা করেছি। আমার যন্ত্রণার নীল মুখ আর অক্ষমতার লাল রক্ত শুধুই ডাক্তার দেখেছে বারবার । বারবার।
ধীরে ধীরে মন খারাপের ক্যান্সার আমাকে আঁকড়ে ধরলো। অগ্নিবলয়ের এপারে যেন কিছুতেই আসতে পারছিলাম না। আমার বদলে যাওয়া ক্লান্ত শরীর মন, তোমার মত বিচক্ষণ চিকিৎসকের চোখকে কি সত্যি এড়িয়ে গিয়েছিল? জানতে ইচ্ছে করে না। গত ছয় বছরে আমি ভিতু ব্যক্তিত্বহীন মিথ্যেবাদী অথর্ব মানুষে পরিণত হয়েছি। যখন দেখলাম অন্য এক ভূবনে চলে যাচ্ছি। তখন মনে হলো না না সিজোফ্রেনিয়া কে সঙ্গী করে পথে পথে ঘুরবো না। সাত দিন আগে নিশ্চিত হলাম প্রেগনেন্সি পজেটিভ। এবার “ও” কে এবোলা ভাইরাস মনে হলো না। মনেহলো না ও আমার সর্বস্ব গ্রাস করবে। উপলব্ধি করলাম স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে মুক্তি চাই। পথে নামবো। কিন্তু আমি যে একা তাই ওকে সঙ্গে নিলাম। গন্তব্যহীন পথ চলবো বহুদূর। হাঁটতে হাটতে সমস্ত ক্লান্তি একদিন দুর হবেই। তোমাকে একদিন একমাত্র বন্ধু ভেবে ভুল করেছিলাম আজ তাই আমার সমস্ত গোপন কষ্ট তোমাকে জানিয়ে ছুটি নিলাম।

 

“পলা”
 

সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লো পলা। তারপর পলার পথচলা। পলকের জন্ম । কিছু আর ভাবতে চায় না পলা। অথবা ভাবনাগুলো কাউকে বুঝাতে চায় না। সব অনুভূতির অনুবাদ হয় কি?
একদিন আট মাসের পলককে নিয়ে নিউ মার্কেটে গানের কিছু সিডি খুঁজছে পলা। দোকানের লোকটা ওকে তিনদিন ঘুরালো। পলা বেশ রেগে গিয়ে বললো, 'আপনি খুঁজে পাবেন না তাহলে আমাকে আসতে বললেন কেন?' হঠাৎ দেখে কেউ একজন কম্পিউটার থেকে মুখ তুলে হাসছে। পলার দিকে তাকিয়ে বললো, গানগুলো কি আপনার খুব দরকার?
: দরকার বলেইতো বাচ্চা নিয়ে তিনদিন এলাম।
: আমি বোধয় আপনাকে হেল্প করতে পারি।
: আপনার দোকানে আছে?
: জ্বী আছে।
দোকানের সব ছেলেরা হাসছে।
: আমি কবে পাবো? বললো পলা।
: আপনাকে কষ্ট করে আসতে হবে না। ঠিকানা ফোন নাম্বার রেখে যান পাঠিয়ে দেবো।
দু’মাস পর লোকটার সাথে দেখা। ওকে দোকানদার ভেবেছিল বলে লজ্জা পেলো পলা। ও হঠাৎ বললো আপনি কি আমার বন্ধু হবেন? কথাটাও ইংরেজীতে বললো। কথাটার বাংলা কি পলার প্রশ্ন। ও একই কথা আবার বললো।
হাসলো পলা। বললো, আপনার হাতে এতোগুলো আংটি। এসব কি কি পাথর?
: আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন।
: এরকম ফ্রেন্ডশীপ কতবার করেছেন?
: আপনি খুব প্রশ্ন করেন তাই না?
: প্রশ্নটা কি অবান্তর?
: আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না আমি মেয়েদের সাথে মিশিনা।
: হঠাৎ আমার বন্ধুত্ব দরকার হলো কেন?
: জানি না কেন?
: নিজের দরকারটা জানেন না?
ও চুপ করে ছিলো। খুব ঠান্ডা গলায় পলা বললো, আমি বন্ধুত্বে বিশ্বাসী না। মানে ছেলেতে মেয়েতে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। যদি দুটো ইলেকট্রিক তার পাশাপাশি থাকে তবে দূর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশী। বলেই বুঝলো খুব বাজে হয়ে গেল উদাহরনটা।

লোকটা বললো, ওটা তারের বেলায়। ছেলেতে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয়না এমন কিছু করেই তা ভুল প্রমাণ করবো।

পলার মাথায় দুষ্টুমী খেলে গেল। মনে মনে ভাবলো ভেরী স্মার্ট।এই ছেলে আমাকে চ্যালেঞ্জ করছে?
: বাসায় যাবি না? কোথায় বাসা?
: আপনি আমাকে তুই করে বলছেন?
: বন্ধুকে কেউ আপনি বলে নাকি?
: কোথায় বাসা?
: বেইলী রোডে। আপনি কি জোর করেই আমাকে বন্ধু বানাবেন?
: ইয়েস্।


এই হলো তুহিন। বাসায় ফিরে শাওয়ার নিতে নিতে হঠাৎ পলার মনে পড়লো সেই ভয়ংকর বন্ধুর কথা। যে স্মৃতি সে ভুলে যেতে চেয়েছে বহুবার।
তখন ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে। ছেলেটা সম্পর্কে দুঃসম্পর্কের চাচা। পলার চেয়ে বছর তিনেকের বড়। চেহারায় সততার একটা ছাপ। প্রায়ই ফোন করতো। একদিন হুট করে বাসায় এসে পলার হাতে একটা রুপালী রাখী বেঁধে দিয়ে বললো আজ থেকে তুমি আমার 'রাখীবন্ধু' ঠিক আছে? পলা মাথা নেড়ে বললো, ঠিক আছে।
সেই বন্ধু পলাকে রাখী বলে ডাকতো। ধীরে ধীরে রাখী নামটা ঢাকা পড়লো অন্য সব নামের আড়ালে। একদিন কলেজ থেকে বাসায় ফিরে  গোসল করছে পলা। গোসলের শেষ দিকে ওর মনে হলো কাঁচের জানালায় একটা ছায়া। ভালো করে তাকাতেই (রাখী বন্ধু?) চোখে চোখ পড়লো। ও সরে যেতেই বসে পড়লো পলা। সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো। মনে হলো এ জীবনে বাথরুমে থেকে বের হতে পারবে না। কষ্টে যেন মরে গেল। জীবন্ত লাশ হয়ে সারাক্ষণ বিছানায় শুয়ে থাকে। নিজেকে ভীষণ অপবিত্র আর বেমানান মনে হয় পৃথিবীতে। দুচোখ মরুভূমি।

একদিন তপতী ম্যাডাম বাসায় এলেন, যিনি পলার ইংরেজী সাহিত্যের টিচার। ম্যাডাম প্রায়ই বলতেন, তুমি অনেক বড় গায়িকা হবে। আজ ম্যাডামের চোখে মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
: পলা গান পড়াশুনা কেন ছেড়ে দিলে? আমায় বলা যায় না?
সব কষ্টের ভার দিতে চেয়ে ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরে পলা কান্নার সাগরে বইয়ে দিল। তপতী ম্যাডাম বললেন, চোখের জল নয়, প্রতিশোধ!
তিনদিন পর ম্যাডাম ফোন করে পলাকে যেতে বললো। পলা গেল। ওর ব্যাচমেটরা খুব খুশী হলো। পলা বিব্রত বোধ করলো। ঐদিন পড়া হলো না। ম্যাডাম সব মেয়েদের ভেতরের রুমে যেতে বললো এবং কে কে তার আদেশ পালন করতে রাজী জিগ্যেস করলো। সবাই একসাথে হাত তুললো। পলা দূর্বল পায়ে ম্যাডামকে অনুসরন করলো। ঘরে ঢুকে দেখলো কেউ একজন ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পলা ঘুরে দাঁড়াতেই ম্যাডাম খুব কঠিন গলায় বললো, মেয়েরা শোন তোমাদের সামনে একজন শয়তান দাঁড়িয়ে, তোমরা একে একে ওর মুখে থুতু দাও! মেয়েরা সানন্দে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা শয়তানের মুখে থুথু ছিটালো। ম্যাডাম ভয়ংকর ভাষায় ওটাকে বেরিয়ে যেতে বললো। পলা চোখে ঝাপসা দেখলো। ম্যাডাম অন্যদেরকে ছুটি দিল। পলা দাঁড়িয়ে কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। মনে পড়ছে না। চোখের সামনে শুধু ম্যাডামের অসম্ভব সুন্দর কালো মুখটা ভেসে উঠলো। কালো কখনো এতো সুন্দর হয়! ম্যাডামের কালোর আলোয় পলার সব কুয়াশা কেটে গেল। ভাবলো ম্যাডামের সিঁথিতে লাল রেখাটা কেন যে নেই! যদি থাকতো তবে কি অসহ্য সুন্দরই না লাগতো।
তপতী ম্যাডাম বলেছিল, পলা পড়া শুনায় মন দাও। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনে রেখো, নারীর শরীর এক পবিত্র গ্রন্থ। কোন পাপী এসে যদি সেটা ছুঁয়ে দেয় তাতে গ্রন্থের কোন অসম্মান হয় না।


তুহিনের সাথে দেখা হয় কথা হয়। পলা ভাবে তুহিন কি সত্যিই বন্ধু হয়ে গেল।
একদিন তুহিনকে বললো, চল রিক্সায় ঘুরি। বুঝলো তুহিনের ইচ্ছে নেই। রেগে গিয়ে বললো, আমার সাথে রিক্সায় বসলে কি তোর সতিত্ব নষ্ট হয়ে যাবে? তুহিন বাধ্য হয়ে রিক্সা নিল। পলা বললো, হুড তোল আমার সমস্যা হবে। তুহিন বিরক্ত হয়ে হুড তুললো। কথা বলতে বলতে উদ্দেশ্যহীন ঘুরছে। হঠাৎ তুহিন পলার ওড়না ঠিক করে দিলো। প্রথমে পাত্তা দিলো না পলা। কিছুক্ষণ পর একই কাজ করলো তুহিন। পলার মাথায় খুন চড়ে গেল। বললো, তুহিন রিক্সা থামা। তুহিন রিক্সা থামিয়ে নেমে গেল। পলক ওর কোলেই আছে। পলা বুঝতে পারছে না তুহিন এতো ঘামছে কেন? পলা বললো,
: নিজে ফ্যাশন করলে কোন দোষ নেই আমি করলেই দোষ?
: ভুল জায়গায় ওড়না রাখা ফ্যাশন নাকি?
: ভুল সঠিক তোর কাছ থেকে শিখতে হবে? তুহিন তুই তোর আমার সম্পর্কের সীমানা অতিক্রম করছিস। তোর গার্জেনগিরি অসহ্য লাগে। তোকে চোদ্দবার হজ্জ্ব করতে কে বলছে? হিপোক্রেসি অসহ্য লাগে।
: তোর সাথে আগে দেখা হলে হজ্জ্ব করতাম না।
: মানে?
: হজ্জ্ব করাটা তোর কাছে হিপোক্রেসি তাই।


একদিন তুহিনের হাত খালি দেখে পলা জিগ্যেস করলো,
: অঙ্গুঠী কোথায়?
: খুলে রেখেছি।
: ক্যান।
: তুই তো পছন্দ করিস না। বলিস আংটি পরলে নাকি আমাকে ব্যাপারি ব্যাপারি লাগে।
: ওহ তুহিন! তোর নিজস্বতা বলে কিছু নেই? অন্যের পছন্দে নিজেকে ক্যান পাল্টাবি? নিজের মত হওয়ার চেষ্টা কর বুঝলি?
: পলকের খিদে পেয়েছে চল কোথাও খাই।
ওরা খুব সাধারন একটা হোটেলে ভাত খেলো। পলা বললো, তুহিনরে তোকে তো সিগারেট খেলে দারুন লাগে। তুহিন ভীষণ রোমান্টিক চোখে তাকালো পলার দিকে নয় সিগারেটের দিকে।
পলা মনে মনে বলে, ঈশ্বর তুহিন যেন কোনদিন আমাকে ভালোবাসার কথা না বলে। ওকে অপমান করে কষ্ট দিতে চাই না।
তুহিন খুব অসহায় চোখে আকাশ দেখছে।
: তোর কি মন খারাপ তুহিন? আয় একটা খেলা খেলি।
: কি খেলা?
: চোখেচোখ রাখা খেলা। তুই আমার চোখের দিকে তাকাবি আমি তোর চোখে। পলক পড়তে পারবে না।
: তোর চোখে চোখ রাখা খেলা আমি খেলবো না।
: আমার চোখে সমস্যা কি ?
: খেলবো না ব্যস।
: তোর ফালতু মুড আমার ভালো লাগে না। খেলতেই হবে। তাকা নে শুরু কর। যে জিতবে সে একটা গান গাবে।
: কি গান?
পলা হাসতে হাসতে গাইল, পড়ে না চোখের পলক/ কি তোমার রুপের ঝলক। হেসে ফেললো তুহিন। বললো
: তুই গান জানিস?
: গান কে না জানে? তুইতো গানও কম্পেজ করছিস। মডেলিংও করছিস। অল রাউন্ডার হবার ইচ্ছে ছিল?
তুহিন খুব গম্ভীর হয়ে বললো,
: এতো সেজেছিস কেন?
: তোকে ইমপ্রেস করার জন্যে না, নিজের জন্যে।
: তোকে না সাজলেই বেশী সুন্দর লাগে।
: সুন্দর না লাগলে কি হয়?
: সুন্দর লাগলেও কিছু হয় না।
পলা বললো, একটা গল্প শুনবি? একটা মেয়ে প্রতিদিন খুব যত্ন করে সাজে স্বামীর দৃষ্টি কাড়ার জন্যে। স্বামী ফিরেও তাকায় না হঠাৎ একদিন স্বামীর চোখ পড়লো। স্বামী হাসি মুখে বেচারা মেয়েটির কাছে গিয়ে বললো, আরে আজ তোমাকে পরস্ত্রীর মত লাগছে! তুহিন বিরক্ত হয়ে বললো
: এটা আবার কেমন গল্প?
: বুঝলি না পুরুষের চোখে পরস্ত্রী সব সময় সুন্দর।
: এসব ফালতু গল্প আমাকে শুনাবি না।
: শুনাবো না যা।
তুহিনের মুরব্বী ভাবটা পলার অসহ্য লাগে। ওকে দেখে মনে হয দশ বছরের বড় অথচ তুহিন পলার চেয়ে আট বছরের ছোট।
: তুহিন একটা বুদ্ধি দেতো। কিভাবে চেহারার খুকী ভাবটা দূর করা যায়? মানে কি করলে চেহারায় বয়স ফুটে উঠবে ‘চশমা পড়বো’ ?
: মেয়েরা নাকি বয়স কমাতে চায় তুই বাড়াবি কেন?
: কারণ আমি সো কল্ড মেয়ে না। বল বল তাড়াতাড়ি বল!
: হেয়ার স্টাইল চেঞ্জ করে ফেল । ফোবি ক্যাটস থেকে মাধুরী হয়ে যা।
: মানে কি?
: মানে চুল বড় কর। কাটা চুলগুলো ক্লীপ দিয়ে আটকে রাখ। আর টিপ পড়বি।
: টিপ পড়বো কি কারণে?
: টিপের সাথে বিয়ের একটা সম্পর্ক আছে।
: তুমি বেশী পন্ডিত। মেয়েরা বুঝি বিয়ের আগে টিপ পড়ে না? জলজ্যান্ত বাচ্চা নিয়ে ঘুরছি ...... তুই সত্যি আজব।
তুহিনের কথা মতো ক’দিন শাড়ী চুড়ী টিপ পড়ে ঘুরলো পলা।
ফোন করলো তুহিনকে -
: তুহিন সাহেব্ আপনি ফেল
: কেন?
: তোর পরামর্শ কাজে লাগলো না। বেবীরা আমাকে বেবী ভেবে প্রেম পত্র লিখতেছে।
: বই মেলায় যাবি?
: উহ্ তুহিন যাবি? কতো বছর যে বই মেলায় যাইনি।
: কাল সকালে রেডি থাকিস।
রাতে তুহিন “শাড়ী” শব্দটা অসংখ্য বার লিখে পাঠালো। মেজাজ খারপ হলো পলার। সে লিখলো – 'শাড়ী পড়ে নারী না সাজলে তোমার আর ভালো লাগছে না, না? আর কোনদিন শাড়ী পড়বো না। বই মেলায় আমি একাই যাবো। তুই থাকবি না'।
আজ সকালে পলা দেখলো বই মেলার সামনে তুহিন ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। পাশ কাটিয়ে বইয়ের দোকানে পলা মনে মনে হেলাল হাফিজের বই খুঁজছে যে বইটিতে সেই কবিতা আছে 'কষ্ট নেবে? কষ্ট' পেয়েও গেল। 'যে জলে আগুন জ্বলে'
: একটু শোন।
: কি বল।
: তোর তো খুব শরীর খারাপ । ইচ্ছে করে টেনশান করিস।
: হ্যা, ডেল কার্নেগী মুখস্থ করছি সব টেনশন শেষ হয়ে যাবে।
: তোর সাথে ভীষণ জরুরী কথা আছে।
: বল কি জরুরী কথা?
: হ্যা বলবো,মাথা ঠান্ডা করে শুনবি। তোর শরীর দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তুই ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ছিস। আয়নায় নিজেকে দেখিস না? এতো পরিশ্রম তোর সইছে না। তাছাড়া এভাবে সংসার চলে না।
: অন্য চাকরীর কথা বলছিস? নাকি বিজনেস? আচ্ছা তুই ইঞ্জিনিয়ার হয়ে ব্যবসায়ী হলি কেন? অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। বানা না একটা গাড়ী। মেড ইন বাংলাদেশ। কি বানাবি?
: একটু মনোযোগ আশা করতে পারি? কথাটা খুব জরুরী।
: তোর ভুমিকার ভনিতা দেখলে গা জ্বলে যায়। বলে ফ্যাল কি কথা? তোর এই এসেছি গিয়েছি মার্কা কথা শুনলেও মেজাজ খারাপ হয়।
: তাহলে যে এতো বানান ঠিক করে দিস?
: আর বানান ঠিক করবো না যা।
পলা এক সময় ভাবতো যে ভাষার জন্য এত রক্তপাত সেই ভাষাটা শুদ্ধ করে বলি না কেন। এখন ভাবে মনের ইচ্ছে প্রকাশ করাটাই বড় ব্যাপার। পৃথিবীতে কতো কতো দেশ কত কত সব ভাষা কিন্তু মানুষ তো একই। অনুভূতি তো একই।
পলা ভাবেনি এতো বড় নাটক ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ তুহিন কিছু কাগজ পত্র বের করলো বললো, রেগে যাবি না খুব ঠান্ডা মাথায় এগুলো দ্যাখ।
: তুই বল কিসের কাগজ এগুলো আমি বুঝবো না। কি এসব?
: ক্যানাডায় যাবার কাগজ।
: তুহিন তুই আরো পড়বি? কবে যাচ্ছিস?
: সেটা তুই জানিস।
: আশ্চর্য তো যাবি তুই আর জানবো আমি?
: কারণ আমার সাথে তুইও যাচ্ছিস।
: আমি যাবো? কিভাবে?
: তুই সেটা ভালো করে জানিস।
: তুহিন আমি বুঝতে পারছি না।
: তুই খুব ভালো করে বুঝতে পারছিস।
: মানে তোর বৌ হয়ে আমি যাবো কানাডায়? তুই কি পাগল হয়ে গেলি? এই দুঃস্বপ্ন তুই তিন বছর আগে দেখেছিস? এতবড় সিদ্ধান্ত তুই একা নিলি? তুহিন পলককে কোলে তুলে নিয়ে বললো আমি তোদের ভালোর জন্য করেছি তোর ভালো। পলকের ভালো ....
: পলকের ভালো চিন্তা করার তুই কে?
: শোন পলা এখনও সময় আছে ঘুরে দাঁড়া। এটা কোন জীবন নয়। আর একবার ভাব।
: আমার সব কিছু ভাবাই আছে। আমার হাত ছাড় তুহিন!
পলা কাঁপছে। বলছে, যেতে হলে পলকের জন্মের আগেই যেতাম ...!
: তার মানে তুই যাবি না। তাহলে ঐ দুইরুম ছেড়ে অন্ততঃ আমার ফ্ল্যাটে আয়।
: প্রশ্নই আসে না। তুই অনেক বড় ভুল করলি তুহিন। তুই একাই চলে যা। তোর মুখ কোনদিন দেখতে চাই না।
: তুই আমার ফ্ল্যাটে আসবি কি না বল।
: না না এবং না।
তুহিন দ্রুত হাতে কাগজগুলো ছিঁড়ে টুকরো করলো।
মাথা ঘুরছে পলার। ভীষণ কান্না পেল। পড়ে যাচ্ছিল এমন সময় তুহিন ধরে ফেললো। ওদেরকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল। বাসায় ফিরে ঘুমের ওসুধ খেলো। ঘুম তবু এলো না। গভীর রাতে ম্যাসেজ এলো, 'বউ খুব বেশী ভালোবাসী তোকে। চুমু তোর মনে।' পলা ক্লান্ত কণ্ঠে ফোন করে বললো
: তুই বাজিতে হেরে গেছিস তুহিন। তুই চ্যালেঞ্জ করেছিলি না? হিপোক্রাট....
লাইনটা হয়তো চিরদিনের জন্যে কেটে গেল। হয়তো আর কোনদিন তুহিন নিজেকে মেলে ধরবে না।
ধারণা ভুল প্রমান করে তিন মাস পর তুহিনের ফোন এলো। পলা সেল ফোনটা সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো। এই বলে নিজেকে প্রবোধ দিল-
নারী তুমি আজন্ম একা। পথ চলতে চলতে পুরুষের ছায়ায় জিরোবার প্রয়োজন তোমার নেই। তুমি অন্তহীন একা তোমার চারপাশে গড়ে তোল কঠিন দেয়াল, যাতে পুরুষ বান্ধব তোমাকে ছুঁতে না পারে।