পৃষ্ঠপোষক

রঞ্জন চক্রবর্ত্তী

 

লন্ডনের গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে পঞ্চান্ন নম্বর গেটের কাছে বসে আছি । সঙ্গে স্ত্রী ও দুটি কেবিন লাগেজ ।কাঁচে ঘেরা অলিন্দের বাইরে বহুদূর বিস্তৃত ঘেরাটোপে অসংখ্য ছোটো বড় প্লেন উড়ানের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে । আমরা উঠবো কন্টিনেন্টাল এয়ারলাইন্সের ইউ এস এ গামী ফ্লাইট ০৬৭ এ। আসে পাশে আরো অনেক সহযাত্রী, কেউ বই পড়ছেন, কারও চোখ কাগজে, কেউ আবার আমাদের মতো বাইরের বিমান সম্ভারের নাড়া চাড়া দেখে সময় কাটাচ্ছেন ।

কিছুটা অন্যমনস্ক ছিলাম – লন্ডনে একশো দশ দিন কিভাবে কাটিয়েছি, মেয়ে জামাই এর কাছে, তার ক্ষণচিত্রের মালা যেন চোখের সামনে উড়ে বেড়াচ্ছে। কত সুখ স্মৃতি, কত বেদনা বিধুর মুহূর্ত । হটাত গিন্নী কিছু একটা ইংগিত করলেন- পেছন দিকে ইশারা করলেন । সম্বিত ফিরতেই কানে এলো বাংলা সংলাপ। অল্প ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, এক বয়স্ক ভদ্রলোক মোবাইল ফোনে কথা বলে চলেছেন,

-       নারে , এখনো ত অভিজি এর কোনো ফোন আসেনি। 

অন্যজ পৃথিবীর কোন প্রান্তে বোঝা গেল পরের সংলাপে । “বলিস কিরে , সবে তো বর্ষা এল, এখনি বেহালায় জল জমতে শুরু করেছে ।

-হাঁ, ডাইরেক্ট ক্লিভল্যান্ড এই নামব, অভিজিতরা বোধহয় এয়ারপোর্টে থাকবে, তোকে পরে জানাবো।

ক্লিভল্যান্ড এ অনেক বাঙালী থাকেন শুনেছিলাম, তাদের এক জনের দেখা লন্ডনেই পেয়ে যাব ভাবিনি । মনে একধরনের আনন্দ পেলেও, আমাদের উপস্থিতি ওনাকে বুঝতে দিলাম না। উতকর্ণ হয়ে বাংলা ফোনালাপ শোনার দিকে মন দিলাম । এ প্রান্তের কথা শুনে বুঝলাম, ফোন নাম্বার পালটে গেছে ইতিমধ্যে।

-“ কিরে, মন খারাপ করছিস না তো”

-“ কি যে বলিস, তোদের ওখানে কত কি দেখলাম- তাকি ভুলতে পারি । প্রায় ছয় শত বছরের স্মৃতি ছড়িয়ে আছে তোদের লন্ডনের আনাচে কানাচে । তুই সঙ্গে না থাকলেও , বিকাশ তো সবই ঘুরিয়ে দেখিয়েছে ।”

বুঝলাম সবে ফেলে আসা কোনো পরমাত্নীয়ের সাথে কথা হচ্ছে । আরও কিছুক্ষণ কথোপকথন হবার পর ফোন নামল কান থেকে । আমরা ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে চোখ রেখেছি,ফাইনাল সিকিউরিটি চেক এর ডাক আসবে যে কোনো সময় । ভদ্রলোকের চেহারাটা ভালো করে দেখে রাখলাম । ক্লিভল্যান্ড এ পৌঁছে যদি কখনও দেখা হয়, এই ফোনালাপের কথা স্মরণ করিয়ে মজা পাওয়া যাবে ।

ক্লিভল্যান্ড এ নেমেছি স্থানিও সময় দুপুর তিনটে ...আমার ঘড়িতে তখন রাত আট টা। আহ্ণিক গতির কল্যাণে আটলান্টিক  পেড়োনোর ফাঁকে পাঁচ ঘন্টা সময় চুরি হয়ে গেছে। এয়ারপোর্ট থেকে ছেলের বাড়ী এনডোভার ড্রাইভ, মেনটর, প্রায় পঁয়ত্রিশ মাইল।বিশাল চওড়া রাস্তা। দুদিকে ছয় লেনের এক মুখি রাস্তার মাঝ খানে প্রায় তিরিশ চল্লিশ ফুট চওড়া সমতল ভূমি, ফলে হাইওয়েতে মুখমুখি সঙ্ঘর্ষের কোনো সম্ভবনা নেই।রাস্তা এত ভাল হওয়া সত্ত্বেও সর্ব্বোচ্চ গতি ঘন্টায় মাত্র পঁয়ষট্টি মাইল। মাত্র চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ছেলের বাড়ী ।

সপ্তাখানেক পর, জুন মাসের আঠাশ তারিখে, অকাল হোলির আয়োজন হয়েছিলো সোলোনে ব্রজেশ বাবুর বাড়ীতে ।ব্রজেশ বাবু বিশ্বখ্যাত ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের হার্ট সার্জেন ।ডলারের কল্যাণে আজ তিনি কোটিপতি ।কিন্তু ভারতের কোটিপতি ডাক্তারদের সাথে তাঁর পার্থক্য, তিনি আজও বাঙালী ।ক্লিভল্যান্ড এর অন্তত শ’দুএক বাঙালীর তিনি যেন গার্জেন । বাঙালীয়ানা বজায় রাখতে আর পরবর্ত্তী প্রজন্ম, যারা আমেরিকাতেই পিতৃসূত্রে শশৈব ও বাল্য কাটাতে বাধ্য হয়ে বাঙালীর বারো মাসে তের পার্বনের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, -নিজেদের সুবিধা মত কোনো এক ছুটির দিনে সময়ানুযায়ী কোনো পার্বন উদযাপনের ব্যাবস্থা করে থাকেন ।তিনি নিজের বাড়িতে মহালয়ায় গনতর্পন করান, ক্লিভল্যান্ড বেঙলী কালচারাল এসোসিয়েশনের উদ্দ্যোগে দূর্গা পূজা, লক্ষী পুজা পরিচালনা করেন। বাঙালী চাকুরীজীবি- তা সে যেকোনো গোত্রের ই হোক না কেনো, সেই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। ফলে আমরাও হাজির হয়েছিলাম অকাল দোল উতসবের  অনুষ্ঠানে । আমাদের দেশে মার্চ মাসে যখন দোল উতসব হয়ে থাকে তখন ক্লিভল্যান্ড থাকে বরফে ঢাকা ।

ব্রজেশ বাবুর আন্তরিক অভ্যর্থনার পর, ভীড়ে মিশে গিয়ে সমবয়স্ক কিছু অপরিচিতের সান্নিধ্য খুঁজে নিয়েছিলাম ।সজাগ দৃষ্টি গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে দেখা চেহারা পেয়ে গিয়েছিল অচিরেই। এগিয়ে গিয়ে আলাপ করলাম-

-“কেমন কাটালেন গত এক সপ্তাহ”

-“আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না”

--“আপনি  গত ২২শে জুন লন্ডন থেকে এসেছেন না”!

-- হাঁ, কিন্ত---

--আসলে সেদিন আপনি গ্যাটউইক এয়ারপোর্টে পঞ্চান্ন নম্বর  গেটের কাছে বসে মোবাইল ফোনে অনেকের সাথে কথা বলছিলেন। আপনার পেছনের সীটেএই আমরা সস্ত্রীক বসে ছিলাম। বাঙলা ভাষার টানে মুখ ঘুরিয়ে আপনাকে দেখেছিলাম। ক্লিভল্যান্ড এয়ারপোর্টে আপনাকে রিসিভ করতে দুজন এসেছিলেন---তাও আমাদের চোখ এড়ায়নি ।

--“ছিঃ, ছিঃ, আপনারা আমার সব কথা শুনে ফেলেছেন তো !”

-“হ্যাঁ, কিছু কিছু শুনেছি—তবে শুধু আপনার তরফের কথা। ও প্রান্তের কারো কথা তো আর শুনতে পাইনি, কাজেই লজ্জা পাবার কিছু নেই

অপরিচিত সমাগমের ভীড় থেকে অজান্তেই অমরা পায়ে পায়ে চলে গিয়েছিলাম ব্রজেশ বাবুর বাগান বাড়ীর প্রান্ত সীমায় জলাশয়ের উপর নিভৃত আচ্ছাদনের নীচে।কিছুটা দূরে তখন পুরো দমে চলছে নাচ গানের সাথে সাথে হোলী খেলার মহড়া। নানারঙের আবীরে আর হুল্লোড়ে ক্ষণে ক্ষণে আকাশ হয়ে উঠছে রঙীন। প্লাস্টিকের ফোলানো চৌবাচ্চায় ক’টি কচি কাচা জলকেলী কোরছে।সমবয়সী মহিলারা পাইন গাছের নীচে জড়ো হয়ে হাসি ঠাট্টায় মশগুল। একদিকে সামিয়ানার নীচে ব্রজেশ গৃহিনী শুভার তত্বাবধানে বুফে টেবিল সাজানোর আয়োজন চলছে। কতিপয় মধ্যবয়স্ক বাঙালি সাহেবী কায়দায় রঙীন পানীয় হাতে নিয়ে উচ্চগ্রামে কথা বলে চলেছেন।

কথায় কথায় জানালেন, সত্যবাবু  লন্ডন এসেছিলেন প্রায় পাঁচ মাস আগে। জামাতা বিকাশ বিখ্যাত মোবাইল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার , মাসে দশ দিনের বেশী বাড়ীতে থাকার সুযোগ পান না। স্ত্রী সন্তান সম্ভাবনা হবার পর তাই রিটায়ার্ড বাবাকে অনেক অনুরোধ করেছিলেন কিছুদিন লন্ডন এসে থাকার জন্য। বিদেশ দেখা আর মেয়েকে সঙ্গ দেবার ডাক অবহেলা করতে পারেননি রিটায়ার্ড প্রোফেসর সত্ত্যবাবু। স্ত্রীকে সঙ্গে আনতে পারেননি সদ্য চাকরি পাওয়া ছোট ছেলের দেখভালের অসুবিধা হবে ম’নে করে।

প্রথম প্রথম বিদেশ ভ্রমনের আনন্দে বিভোর ছিলেন জামাই লন্ডন এর বেশ কিছু টুরিস্ট স্পট নিজে সঙ্গে করে দেখিয়ে এনেছে। নিজের গাড়ী করে বাথ, ব্রাইটন প্রভৃতিও ঘুরিয়ে এনেছে। সাত মাসের সন্তান সম্ভবা মেয়েকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব হয়নি কোথাও। জামাই বাবাজীর সাথে আর কত গল্প করা যায়। কাজেই ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্রীজ থেকে কিউ গার্ডেন, বৃটিশ মিউজিয়াম থেকে মাদাম ত্যুষো, থেমস ক্রুজ থেকে লন্ডন আই সবই চোখে দেখা হয়েছে, কিন্তু মনে গাঁথেনি। আবহাওয়ার বিচিত্র ব্যবহার, এপ্রিল মাসে স্নো ফল, সব আভিজ্ঞতাই হয়েছে—কিন্তু সময় যেন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। মেয়ের সংগ্রহে থাকা সব কটি বাংলা বই পাতা উলটে দেখা হয়ে গেছে। টিভিতে গোটা দুয়েক হিন্দি চ্যানেল এর পারিবারিক কেস্যা আর কত দেখা যায়। মাঝে মাঝে নিজেকে সোনার খাঁচায় বন্দি রাজবাড়ির পাখীর সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করেছে। মেয়ে পুত্র সন্তান জন্ম দিয়েছেন গত মাস। বাড়ীতে বেবী সিটার হিসাবে এক গুজরাতি মহিলাকে পাওয়া গেছে । জামাই তার আসা যাওয়ার ভাড়া, ভিসা, ট্রাভেল ইন্স্যুরেন্স ইত্যাদির জন্য প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ করেছে—কাজেই তাদের ইচ্ছার মূল্য দিতে পাঁচ মাস কাটাতে হয়েছে স্ত্রী, পুত্র, বন্ধু বান্ধব হীন অবস্থায় এখানে এসেছেন ভাইপো অভিজিত এর পৃষ্ঠপোষকতায় । অভিজিত কী ব্যাঙ্ক এর অফিসার। আমেরিকায় অর্থনৈতিক ডামাডোলের সুযোগে  এখানে চার বেড রুমের বেশ বড় বাড়ি কিনেছে রিসেন্টলি । তাই ভাইপোর কাছে কিছু দিন থাকার কথা- ইত্যাদি ইত্যাদি।

নিজেরা গল্পে মশগুল ছিলাম- এদিকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে বুফেতে লাইন পড়ে গেছে মধ্যাহ্ণ ভোজের। ছেলেকে দেখতে পেলাম দূর থেকে আমাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে আমাদের খাবার নিয়ে যেতে বলে সত্যবাবুকে জিজ্ঞাস করল,

--কিছু মনে করবেন না, আপনি কি অভিজিত এর কাকাবাবু ? লন্ডন থেকে এসেছেন !

-হাঁ, কিন্তু তুমি চিনলে কি করে ? অভিজিত এর সাথে তোমার পরিচয় আছে ?

-অভিজিত মুনমুন আমাদের পারিবারিক বন্ধু । আপনি আসবেন ও বলেছিল, তাই মিলিয়ে নিলাম। ও আপনাকে খুঁজছে। চলুন ।

খাবার টেবিলের কাছে কতিপয় মহিলার মাঝে আমার স্ত্রী ও পুত্রবধু  জয়িতাকে দেখতে পেলাম।  জয়িতা ইশারা করে কাছে ডেকে এক মহিলার সাথে আলাপ করিয়ে দিলো—

-- বাবা জানো, ইনি তোমাদের বাড়ির কাছে ডানলপে থাকেন ।

-- তাই নাকি, ডানলপে কোথায় ? --কবে এসেছেন ?

-- মাস দুয়েক হল এসেছি । আমার বাড়ী অশোকনগরে । ওখানকার সারদা মিশন স্কুলে শিক্ষকতা কোরতাম, সবে রিটায়ার করেছি ।

-- তা কোথায় কোথায় বেড়ালেন, আর কতদিন আছেন ?

আমার গিন্নী ই উত্তর দিলেন । জানো, উনি পূজোর আগেই চলে যাচ্ছেন । নায়াগ্রা, ওয়াশিংটন , নিউ ইয়র্ক সব দেখা হয়ে গেছে।

দিদিমনি যোগ করলেন,- এখন অবশ্য প্রতি সপ্তাহে ধারে কাছে কোথাও না কোথাও যাওয়া হয়, মল, পার্ক, লেক, ডাউন টাউন, সিটি সেন্টার কত যাওয়া্র  জায়গা।

আমি জিঙ্গাসা করলাম—দেশ ছেড়ে এখানে কেমন লাগছে ?

- হাঁ, ভালই তো লাগছে। কত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাস্তাঘাট, কত বড় বড় সপিং মল। তবে অসুখ বিসুখ হলে মুস্কিল।

সব জেনেও জিজ্ঞাসা করলাম- কোনো ওভারসিস মেডিক্লেইম করে আসেননি ?

হাঁ, সেতো করতেই হয়েছে। জামাই পঞ্চাশ হাজার ডলারের পলিসি কিনে পাঠিয়ে দিয়েছিল । তবে সে নাকি  হাসপাতালে ভর্তির মতো ব্যামো না হলে বা এক্সিডেন্ট না হলে কোনো কাজে লাগবেনা। আমার আবার গাঁটে গাঁটে ব্যথা শুরু হোয়েছে কদিন হল।

-- তা, দেশ থেকে কোনো ওষুধ আনেননি ?

- হাঁ,সর্দি, কাশি ,পেট খারাপ মাথা ব্যাথার মত মামুলি কিছু অসুখের কথা ভেবে পাড়ার ডিসপেনসারি থেকে কিছু ওসুধ এনেছিলাম। এখানে এসে যে গাঁটে ব্যথা হবে কে জানত।

আমার গিন্নি যোগ করলেন—

-- আর বলবেন না। আমার মিস্টারের তো রোগ ব্যধির বালাই ছিল না । লন্ডনে প্রথম দুমাস ত ভালই ছিলেন, শীতের পরোয়া না করে রেগুলার মর্নিং ওয়াক করে পাড়ার অলিগলি চিনে নিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে আসার ক সপ্তাহ আগে নানা উপসর্গ দেখা দিয়ে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। ইদানিং দাঁতের ব্যথা খুব ভোগাচ্ছে।

-- ডাক্তার দেখান নি

-- হাঁ, খুঁজে পেতে ছেলে এক ডেনটিস্ট এর কাছে নিয়ে গেছিল। সঙ্গে সঙ্গে এক্স রে করে প্লেট দেখিয়ে দিয়েছে। দাঁতে ইনফেকসন হয়েছে। তিন দিন হল এন্টিবায়োটিক আর পেইন কিলার খাচ্ছেন। ব্যথা না কমলে নাকি দাঁত তুলতে হবে।

আমি আর চুপ না থাকতে পেরে বললাম

-এখানে দাঁত তোলার যা খরচা, দেশে গিয়ে দাঁত তুলে সোনা দিয়ে বাঁধানো হয়ে যাবে। আমার পাড়ার ডেন্টিস্ট একটা দাঁত তুলতে আশী টাকা নেন, এখানে লাগবে আট হাজার টাকা। তার পরের খরচা কোথায় টেনে নেবে কে জানে। এটা আবার ওভারসিস মেডিক্লেইম কভার করেনা।

এবার দিদিমণির আমাদের বৃত্তান্ত জানার ইচ্ছা হল। জিজ্ঞাসা করলেন

--আপনারা লন্ডন এ কতদিন ছিলেন, মেয়ের বাড়ী এসেছিলেন  বলেননা ?

আমার স্ত্রী এবার তার লন্ডন প্রাবাসের কথা শুরু করলেন,

-উনি রিটায়ার করার পর থেকেই প্ল্যান হচ্ছিল, লন্ডন এ মেয়ে আর আমেরিকায় ছেলে থাকে, একবার এদের কাছে  না এলে আর সমাজে মুখ থাকবেনা। এ বছর মে মাসে আবার লন্ডন এ নাতির  জি,সি,এস পরীক্ষা দেবার কথা। ময়ে জামাই দুজনেই চাকরি গান বাজনা নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত থাকে। তাই মেয়ে জামাই বলেছিল পরীক্ষার মাস দুএক আগে এলে ওদের একটু সুবিধা হয়। আর যাতায়াত এর ভাড়া, ভিসার খরচ, ইনস্যুরেন্স এর টাকা ভাই বোনে সময় মত পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাই কাগজ পত্র পেয়ে ভিসা হয়ে যেতে আর দেরি করিনি। ভেবেছিলাম দেশে তো চাকরি আর এল,টি,সি এর কল্যাণে দেখার কিছু বাকি রাখিনি, ছেলে মেয়ের দৌলতে ইউরোপ আমেরিকা ঘুরে এলে মন্দ কি। আমার ইচ্ছা ছিল দুমাস দুমাস করে থাকবার, কিন্তু কর্ত্তার মনে হল, ছেলে মেয়েরাও চাইছিল, এত খরচা করে নিয়ে যাচ্ছে যখন, যত বেশি থাকা যায় সেই চেষ্টাই করা ভাল পেনশানের জন্য লাইফ সার্টিফিকেট নভেম্বরে জমা দিতে হয়, সে কথা মনে রেখেই রিটার্ন টিকিট কাটা হয়েছে। কিন্তু একটানা আট নয় মাস দেশের বাইরে থাকার আসুবিধার কথা মনে আসেনি কখনো। এর আগে ওর অফিসের যারা ছেলের সুবাদে আমেরিকা এসে ছয় মাস করে থেকে গেছেন, তারাও কখনো কিছু বলেননি।

   এ বার আমি যোগ করলাম

---আসলে আমার গিন্নি আত্মীয় পরিজন , ননদ ভাসুর পাড়া প্রতিবেশী নিয়ে থাকতে ভাল বাসেন। কাকদ্বীপের মত জায়গায় আঠাশ বছর ছিলাম। ওকে ছোট বড় সবাই খুব ভক্তি শ্রদ্ধা করতো। গানের স্কুলে কত ছাত্র ছাত্রী। অফিস ক্যাম্পাসের যেকোনো অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে থাকতে হত। কাকদ্বীপ ছেড়ে বেলঘরিয়ার নতুন আবাসনে বাড়ি করার এক বছরের মধ্যে সবার প্রিয় মঞ্জুদি হয়ে উঠেছেন। তাই পূজার সময় পাড়ায় থাকবেনা ভাবতে পারেননি। এখন মাঝে মাঝে ভাবি, এক ট্রিপে ইউরোপ আমেরিকা ঘোরার প্ল্যান না করে এক বছর মেয়ের কাছে তিন চার মাস পরের বছর ছেলের কাছে তিন চার মাস থাকার প্ল্যান করলেই ভাল হত।

ডানলপের দিদিমণি বললেন-

--বহু দিন স্কুলের অন্য শিশুদের নিয়ে কাটিয়েছি। তাই নিজের নাতির মুখ দেখার লোভ ছাড়তে পারিনি। ঘর সংসার ফেলে পড়ে আছি। অক্টোবরে নাতির অন্নপ্রাশন হলে চলে যাব। মেয়ে জামাই তো যত্নের ত্রুটি করে না, ভাল ভাল খাওয়া, এদিক ওদিক বেড়ান, টুকটাক কেনা কাটা, এর ওর বাড়ী নিয়ে যাওয়া, নতুন নতুন সাজানো ঘর বাড়ী দেখতে তো ভালই লাগে। আমার আসা উপলক্ষে এদের খরচাও কম হল না।

কথা শেষ হবার আগেই বছর তিরিশের এক সুশ্রী তরুণী এগিয়ে এসে দিদিমণির উদ্দেশ্যে বললেন—

--মা, তুমি তো বেশ বন্ধু খুঁজে নিয়েছো । আমাদের নিন্দে করছো নাকি !

-যাঃ, কি যে বলিস, নিন্দে করব কোন দুঃখে।

আমি বললাম,

--খুব ভালো লাগলো আপনার মা এর সাথে আলাপ হয়ে। আমাদের বাড়ী বেলঘরিয়া, আপনাদের বাড়ী ডানলপ----ইন্ডিয়া তে পাঁচ মাইল ব্যবধানে থাকি, অথচ পরিচয় হল দশ হাজার মাইল দূরে।

তরুণী বললেন,-আপনাদের আগে দেখেছি বলে তো মনে হয়না। কবে এলেন ? থাকতে না বেড়াতে ?

গিন্নি জবাব দিলেন, - আমাদের ছেলের নাম কৌশিক, এই গত বাইশে জুন এখানে এসেছি। চেনেন নাকি কৌশিককে ?

--কৌশিক চক্রবর্ত্তী ! চিনব না মানে ! আমার নাম সোমা। আমার হাসব্যান্ড সুমনের সাথে কৌশিকের ভীষণ বন্ধুত্ব। আগে মেফিল্ড রোডে একই এপার্টমেন্ট এ থাকতাম। যাক, আপনারা একদিন আসবেন কিন্তু। আমি সুমন কে বলে দেব, আপনাদের বাড়ি গিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসবে।

দোল উতসবের পর প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। ক্লিভল্যান্ড এর বেঙ্গলী কালচারাল এসোসিয়েশন উদ্যোগে কলকাতার ভূমির আনুষ্ঠান, কলম্বাস এর বঙ্গ সংস্কৃতি  সম্মেলন, বি,সি,এর এন্যুয়াল ডে উপলক্ষে স্থানীয় বাঙালী পরিবারগুলির সাথে পরিচিতি বেড়েছে।

এ ছাড়া পূজো, জন্মদিন, বিবাহ বা গেট টুগেদার এর মত পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে অভিজিত এর কাকা বা সোমার মায়ের মত আনেকের সাথে আলাপ পরিচয় হয়েছে যারা সন্তান বা অন্য আত্মীয়ের  পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ঘ দিনের জন্য এদেশে এসেছেন। কেউ এসেছেন নাতি নাতনির মর্ত্যে আগমন উপলক্ষে, কেউ এসেছেন এক মাত্র সন্তানের দর্শনে আবার কেউ এসেছেন অবসরের পর বিদেশ ভ্রমনে। কিন্তু তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা হবার পর বুঝেছি, এক দু মাসের পর দেশে ফেরার জন্য মন ছট ফট করে সকলেরই, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারেন না কেউই। ফেরার ব্যস্ততা দেখালে ছেলে মেয়ে বৌমা বলেন, 'বাড়ী গিয়ে কি করবে, সেই ত একা একাই থাকবে আর আই এস ডি করে বলবে, তোদের জন্য মন খারাপ করছে।' এক সংসার ছেড়ে আর এক সংসারে থাকা যে তেলে জলে না মেশার মত আবস্থায় থাকতে হয় সেটা তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয় না।

আসলে আমাদের দেশের মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরা বেশ কিছুদিন যাবত আই, টি বা অন্য পেশায় বিদেশে বিশেষতঃ আমেরিকায় পাড়ি দিতে পারছে। অনেক মেয়ে গৃহবধু হিসাবে এসে কিছুদিনের মধ্যে চাকরি খুঁজে নিচ্ছে। এদের পক্ষে তিন চার বছর চাকরি করার পর লাখ টাকা খরচ করে বাবা মা কে আমন্ত্রন জানাতে সুবিধা হচ্ছে না। এর ফলে এক দিকে যেমন বাবা মায়ের সান্নিধ্য পাওয়া আর তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে, অপর দিকে “কত তাড়াতাড়ি বাড়ি গাড়ির মালিক হয়েছি, কত ভাল আছি” দেখিয়ে দেশে ফেলে আসা আত্মীয় বন্ধুদের তাক লাগিয়ে আত্ম শ্লাঘা অনুভব করতে পাচ্ছে। বাবা মায়েরাও পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনকে “ ছেলে মেয়ে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে ” এ কথা প্রচার করে তৃপ্তি পাচ্ছেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলের এক লাখ টাকা খরচ করে, এত ভাল থাকা মেলার সুজোগ থাকাতে কেউ মাস খানেক থাকার প্ল্যান করে আসেনা। অথচ এই সদা ব্যস্ত সামাজিক পরিবেশে মাস খানেক থাকার পর দেশে ফেরার জন্য মন ছটফট করতে থাকে, নিজেদেরকে ডাঙায় তোলা মাছের মত মনে হয়। সুনশান রাস্তা ঘাট, অপরিচিত প্রতিবেশি, সাধারন পরিবহন ব্যবস্থার অভাব, ভাষার অসুবিধা বড়ই কষ্টকর হয়ে পড়ে। মল ছাড়া দোকান পাট নেই, হাতের কাছে ডাক্তার পাওয়া যায় না, প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ পাওয়া যায়না প্রভৃতি বড়ই পীড়াদায়ক। এদেশ থেকে দেশে টাকা পাঠানোর নানা রকম ব্যবস্থা, কিন্তু দেশ থেকে টাকা আনানোর কোনো সহজ ব্যাবস্থা নেই। ফলে হাত খরচে টান পড়লে বা দেশে ফেরার সময় ফেলে আসা বন্ধু বান্ধবের জন্য কিছু কেনা কাটা করতে গেলেও ছেলে মেয়ের কাছে হাত পাততে হয়, ফলে মানসিক বিড়ম্বনা বারে। কিন্তু দেশে ফিরে মুখ ফুটে কাকে কোনো দিন কোনো অসুবিধার কথা বলতে শুনিনি—এটাই বোধ হয় ভারতীয় সমাজের বৈশিষ্ট্য। আসলে পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের আরও কৃতজ্ঞ করে তোলে – তাই হয়তো নীরবে থাকি আর ভালটুকু স্মরণে রাখি।