চীনা ও বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র: একটি তুলনামূলক আলোচনা
 


ফাহমিদুল হক
 


ইদানীং চীনা ভাষার বেশ কিছু ছবি দেখে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে, বাংলা ভাষার ছবির সঙ্গে তুলনামূলক একটা আলোচনা করার একটি সুযোগ রয়েছে। চীনা ভাষার একটি ছবি মানে একসঙ্গে অন্তঃত তিনটি দেশের দর্শক ঐ ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে দেখতে পারবেন। আমি বলছিলাম চীন, হংকং ও তাইওয়ানের ছবির কমন মার্কেটের কথা। বস্তুত এই বাজার আরও বিস্তৃত। অনেক চীনা ভাষার ছবিই কিন্তু মার্কিন সিনে-থিয়েটারগুলোতে মুক্তি পায়। আর মালয়েশিয়া কিংবা সিঙ্গাপুরের চলচ্চিত্র বাজারও কিন্তু চীনা ভাষার ছবির জন্য উন্মুক্ত।
ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে এই তিনটি দেশের মধ্যে হংকংই বড়ো, তবে চীন তাইওয়ানের ইন্ডাস্ট্রিও বেশ শক্তিশালি। বিশেষত হংকংয়ে যেক্ষেত্রে ভালো-মন্দ দু'ধরনের ছবিই নির্মিত হয়, বাকি দুই দেশের শিল্পসম্মত ছবির সুনামই বেশি। চীনে যেমন রয়েছেন পরিচালক ঝ্যাং ইমু, তেমনি তাইওয়ানে আছেন হোসে সিয়ান। তবে হংকংয়ের ওং কার ওয়াই-এর খ্যাতি এদের কারও চেয়ে কম নয়। আর হলিউডে বসে চীনা ভাষায় ছবি করেন আং লি বা জন উ-র মতো পরিচালকরা। আর এই তিন দেশেরই আছে এক ঝাঁক তারকা, যাদের রয়েছে আন্তর্জাতিক খ্যাতি। বস্তুত এইসব পরিচালকদের আজকালকার সব ছবিই বলতে গেলে কো-প্রডাকশন বা যৌথ প্রযোজিত, এবং কাস্টিংয়ের ক্ষেত্রে তিন দেশের তারকাকেই মাথায় রাখা হয়। চীনের রয়েছে দুই বিখ্যাত অভিনেত্রী, গং লি ও ঝ্যাং জিয়ি। দুজনেই ঝ্যাং ইমুর ছবি দিয়েই বিখ্যাত হয়েছেন। ঝ্যাং ইমুর প্রথম দিককার ছবিতে থাকতেন গং লি, ইদানীংকার ছবিতে থাকেন ঝ্যাং জিয়ি। হংকংয়ের রয়েছে বেশ কয়েকজন শক্তিশালী অভিনেতা: টনি লেয়ুং, এন্ডি লাউ, চৌ ইয়ুন ফ্যাট, জেট লি, জ্যাকি চ্যান। তিন দেশের কয়েকটি বিখ্যাত ছবির কাস্টিং লক্ষণীয়:
 



১. ২০৪৬ (২০০৪), পরিচালক: ওং কার ওয়াই (হংকং), কাস্টিং: টনি লেয়ুং (হংকং), গং লি (চীন), ঝ্যাং জিয়ি (চীন) http://en.wikipedia.org/wiki/2046_(film)
২. ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্রাগন (২০০০), পরিচালক: আং লি (তাইওয়ান/যুক্তরাষ্ট্র), কাস্টিং: চৌ ইয়ুন ফ্যাট (হংকং), মিচেল ইয়ো (মালয়েশিয়া/যুক্তরাষ্ট্র), ঝ্যাং জিয়ি (চীন), চ্যাং চেন (চীন) Click This Link
৩. হাউস অব ফ্লাইং ড্যাগার্স (২০০৪), পরিচালক: ঝ্যাং ইমু, কাস্টিং: ঝ্যাং জিয়ি (চীন), তাকেশি কানেসিরো (তাইওয়ান), এন্ডি লাউ (হংকং) http://en.wikipedia.org/wiki/House_of_Flying_Daggers
৪. রেড ক্লিফ (২০০৮), পরিচালক: জন উ (চীন/হংকং/যুক্তরাষ্ট্র), কাস্টিং: টনি লেয়ুং, তাকেশি কানেশিরো, চ্যাং চেন। http://en.wikipedia.org/wiki/Red_Cliff_(film)

 


চীন-হংকং-তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্র এই কয়েকটি দেশের আওতায় চীনা ভাষার ছবি নির্মিত হয়ে চলেছে। এখানে উল্লিখিত সবগুলো ছবিই বিগ বাজেটের, এসব ছবির আয়ও বিশাল। কো-প্রডাকশন ও কো-স্টারিং এসব ছবির সাফল্যের মূল রহস্য। তবে পরিচালকের দক্ষতার কথা সবার আগে স্বীকার করতে হবে। এই চারটি ছবির মধ্যে শেষের তিনটি ছবিই বিশাল ক্যানভাসের এবং প্রাচীন চীনের রাজতন্ত্রের প্রেক্ষাপটে মার্শাল আর্টনির্ভর একেকটি কস্টিউম এপিক এগুলো। আর ২০৪৬ ছবিটিতে ষাট-সত্তরের দশকের হংকংয়ের প্রেক্ষাপটে সায়েন্স ফিকশনের মিশেলে অভিনব এক মিস্টিক চলচ্চিত্র।

তিনটি দেশেই চলচ্চিত্র বিকশিত হয়েছে এবং জাঁকজমকভাবে টিকে আছে এই কমন মার্কেটের ওপর ভিত্তি করে। হংকংয়ের ভাষা ক্যান্টোনিজ হলেও তা চায়নিজ ভাষারই নিকটতম অপভ্রংশ। ফলে এই তিন দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোচীন অঞ্চলের অন্যান্য দেশ (সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া) চীনা ভাষার চলচ্চিত্রের এক বিরাট বাজার হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বলা যায় তারা বাজারটিকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। যদি সরকারগুলো এসবে বাধা দিত রাজনৈতিক বিবেচনায় (চীন-হংকং বা চীন-তাইওয়ানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কথা স্মর্তব্য) তবে এই বাজার দাঁড়াতো না।

এই বিশাল চীনাভাষীদের মতো বাজার বাংলাভাষীদের নেই। তবে বাংলাভাষীদের পরিমাণও তো কম নয়। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে বাংলা পঞ্চম বা ষষ্ঠ ভাষা। কিন্তু এই ভাষার চলচ্চিত্রের কমন মার্কেট নেই। ভারত ও বাংলাদেশের বাংলাভাষী ছবি যেক্ষেত্রে রুগ্ণ অবস্থায় ধুঁকছে, এই কমন মার্কেট তৈরি করা গেলে তাতে প্রাণ ফিরে পেতে পারতো।

কমন মার্কেট তো ছিলই (অবশ্য তখন কেবল কলকাতাতেই ছবি হতো), দেশবিভাগ ও পূর্ববর্তী ঘটনাবলী পারস্পরিক যে অবিশ্বাস তৈরি করেছে, তা আর যেন ঘোচাবার নয়। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টির পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সরকার ভারতীয় ছবির আমদানি বন্ধ করে দেয়। এর আগে উত্তম-সুচিত্রার ছবি পূর্বববঙ্গে মানুষ প্রেক্ষাগৃহে দেখেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বন্ধ করে দেয়া পাকিস্তানি ছবি, দেশীয় ইন্ডাস্ট্রিকে এভাবে জোর প্রটেকশন দেয়া হয়। এক্ষেত্রে সরকার ও প্রযোজকদের মনোভাব একই ছিল। এর কুফল যেটা হয়েছে, একচেটিয়া বাজারের কারণে ছবির সার্বিক মান নিয়ে প্রযোজক-পরিচালকরা দীর্ঘদিন কোনো হুমকির মুখে পড়েননি। ভিসিআর-কেবল-ডিভিডি পরপর এসে যাওয়ায় দর্শক সাধারণ মানের দেশী ছবি প্রত্যাখ্যান করা শুরু করে। ইন্ডাস্ট্রি বাঁচার জন্য সেক্স-ভায়োলেন্সের দিকে বেশিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ে।

পরিচালক তারেক মাসুদ অনুসন্ধান করে দেখেছেন যে এইযে ভারতীয় ছবির নিষেধাজ্ঞা বা বাংলাদেশী ছবির ভারতে প্রবেশাধিকার না পাওয়া, এর কোনো আইনগত বাধা নাকি নেই। তিনি নানান প্রচেষ্টার পর মাটির ময়নার মুক্তি দিতে সক্ষম হন ভারতে, ২০০৭ সালে।

বাংলাদেশ ও ভারতের কো-প্রডাকশনে বাংলা ছবি যে একেবারো অনালোচিত বিষয় তা নয়। তবে তা তারকাবিনিময়ের মধ্যেই সীমিত। বাংলাদেশের ফেরদৌস কলকাতায় এবং কলকাতার ঋতুপর্ণা ঢাকায়, এভাবেই চলেছে। একটা যথার্থ কো-প্রডাকশন ছিল সম্ভবত পদ্মা নদীর মাঝি, ঠিকঠাকমতো উভয় দেশে একই সময়ে মুক্তি পায়। লাভের টাকা বিনময়রেও একটা স্বচ্ছতা ছিল বলে জানা যায়। এছাড়া অন্যান্য বেশ কিছু ছবি নামেই কো-প্রডাকশন ছিল, বিনিয়োগে স্বচ্ছতা না থাকায় সেগুলো ট্রেন্ড হিসেবে দাঁড়াতে পারেনি। অনেক হাস্যকর ও করুণ চিত্রও আছে। অবিচার ছবির দু’জন পরিচালক ছিলেন, শক্তি সামন্ত ও হাসান ইমাম। পশ্চিমবঙ্গে তা অন্যায় অবিচার নামে মুক্তি পায়, এবং হাসান ইমামের নাম সেখানকার পোস্টারে ছোট করে ছাপা হয়।

যদি মাটির ময়না ভারতে মুক্তি পেতে পারে, তবে অন্য ছবিগুলোরও ভারতে প্রবেশাধিকার পাওয়া উচিত। আবার ভারতের ছবিও বাংলাদেশে আসুক। পাশাপাশি সত্যিকারের কো-প্রডাকশন চালু হোক। বিগ মার্কেটের জন্য (বাংলা ভাষায় ২৩ কোটি লোক কথা বলে) বিগ বাজেটে উন্নত প্রডাকশনের ছবি নির্মিত হোক। দুই ইন্ডাস্ট্রিই দাঁড়িয়ে যাক। বর্তমান সময়ে কো-প্রডাকশনের হার এশিয়া ইউরোপে আগের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে, দিন দিন এই প্রবণতা বাড়ছেই। এর সুবিধা মূলত দুইটি: ব্যয়ের সুবিধা ও বাজারের সুবিধা।

আর বন্ধ হতে থাকা দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য সীমিত সংখ্যায় ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, ইরানি, আরবি, ফরাসি, ইতালীয় ইত্যাদি নানান ভাষার ছবি আমদানির অনুমতি দেয়াও দরকার। (যেমন চীনে সর্বোচ্চ ২০টি হলিউডি ছবি আমদানি করে; মালয়েশিয়ায় স্বদেশী, চীনা, তামিল, হিন্দি ভাষার ছবি একটি সিনেপ্লেক্সে পাশাপাশি চলে) নানান দেশের নানান ছবির সংস্পর্শে দর্শক ও নির্মাতা উভয়েরই রুচিবোধে পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি ভারতেও বাংলাদেশী ছবির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

পরিচালক তারেক মাসুদ কিংবা আবু সাইয়ীদের মুখে শুনেছি, পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্রের কর্ণধাররা বাংলাদেশের ছবিকে আজকাল হুমকি মনে করেন। সেখানে চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথমত বাংলাদেশের সাধারণ মানের ছবিগুলোকে আমন্ত্রণ করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশী ছবির প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সবসময় এমন মিলনায়তন বা প্রেক্ষাগৃহকে বাছাই করা হয়, যার আশেপাশে দর্শকদের যাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের দিন তো নেই, বুদ্ধদেব-গৌতমরাও ফুরিয়ে আসছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের ছবি ধীরে ধীরে হলেও সুনাম অর্জন করছে। আগে ছিল সুপেরিয়রিটি, এখন কি তবে ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স কাজ করা শুরু করেছে? আমি পত্রপত্রিকা থেকে যতটুকু বুঝতে পারি, এক গৌতম ঘোষ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কোনো পরিচালকের বাংলাদেশের ছবি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নাই।

চীনাভাষীরা যদি রাজনৈতিক শত্রুতার পরও সাংস্কৃতিক বিনিময় অবাধে করতে পারে, তবে বাংলাভাষীদের সেভাবে ভাবতে দোষ কোথায়? পশ্চিমবঙ্গের সুপেরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভোগার দিন তো চলে যাচ্ছে, খোদ পশ্চিমবঙ্গেই তো বাংলা ভাষার অবস্থা সঙ্গীন। আর বাংলাদেশের দিক থেকেও ভারত জুজুর ভয় পাওয়া আর পাওয়ানো কতদিন চলবে? রাজনীতি বা অর্থনীতির দর কূটনীতিকের টেবিলে কষা হোক, সাংস্কৃতিক বিনিময়টা জনগণের জন্য উন্মুক্ত করা হোক।