শ্রীলেখার বুনোহাঁস
ইমন জুবায়ের
একটা নারকেলের মালা,
তাতে জল তোলা ফেলা- করঙ্গ সে।
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে। (লালন)
উৎসর্গ
আবহমান বাংলায় যাঁদের আজও বিশ্বাস রয়েছে।
ভূমিকা
অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম: পুন্ড্রনগর নিয়ে একটা লেখা দাঁড় করাব। যে লেখায় থাকবে পুন্ড্রনগরের ঘরদোর, পথঘাটের বর্ননা, ধর্ম-বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্মের সামান্য আবহ, অনিবার্যভাবে একজন দুঃখী নারী- জীবন যার কাছে অসহ্য ঠেকছে, একজন মাঝবয়েসী বৌদ্ধ ভিক্ষু-তার জীবনের গল্প ও লালনের একটি গান-লালন বাংলার শিকড়ে ও অন্তে বলেই .. তেমনই একটি লেখা দাঁড় করাতে পেরে আমার দীর্ঘ দিনের একটি ইচ্ছে পূরণ হল। এই ফাঁকে বলে রাখি: ‘পুন্ড্রনগর’ ছিল প্রাচীন বাংলার অন্যতম নগর। বগুড়া জেলার মহাস্থান গড়ের নাম আমরা তো শুনেছি- তারই আশেপাশের অঞ্চল নিয়েই ছিল খ্রিস্টপূর্ব যুগের সেই প্রাচীন পুন্ড্রনগর । যিশু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৫০০ বছর আগে থেকেই গড়ে উঠছিল নগরটি। ‘পুন্ড্র’ শব্দটির মানে, ‘আখ’। তার মানে, এখনকার মতো সেকালেও আখের চাষ হত পুন্ড্রনগরের আশেপাশে। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকেই পুন্ড্রনগরটি পরিনত হয়েছিল বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের অন্যতম কেন্দ্র - যে কারণে নগরের বাইরে অনেকগুলো বৌদ্ধ বিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) গড়ে উঠেছিল; শুধু তাই নয়- অনেকগুলি জৈন প্রার্থনাগৃহও নির্মিত হয়েছিল পুন্ড্রনগরে। বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল ভাসু বিহার। পুন্ড্রনগরে গৌতম বুদ্ধ অনেকবারই এসেছিলেন। বৌদ্ধ কখনও পুন্ড্রনগরে এলে ঐ ভাসুবিহারেরই থাকতেন। ‘ শ্রীলেখার বুনোহাঁস’ গল্পটির পটভূমি সেই রকমই একটি সময়ে।
বাঁ পাশের খোলা জানালাটি দিয়ে মধ্য আষাঢ়ের শেষবেলার ম্লান রোদ ঢুকেছে ভাসু বিহারের সভাঘরটি। সে হলুদাভ ম্লান আলোয় গৌতম বুদ্ধের শরীরটি অপূর্ব মনে হয়। লাল রঙের চীবর পরে মেঝের ওপর বসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ । পদ্মাসনে। তাঁর স্থির ধ্যানস্থ শরীরটি হলুদাভ; মাথাটি মসৃনভাবে কামানো, গোলপানা মুখটির রংটিও হলুদাভ, দু-চোখের দৃষ্টি কোন্ সুদূরে। বুদ্ধ উচ্চারণ করলেন, মনোপুব্বঙ্গমা ধম্মা মনোসেটা মনোময়া, মনসা চে পদুটেঠন্ ভাসন্তি বা করোতি বা, ততো নং দুক্খমন্বেতি চক্কং বা বহতো পদং। কন্ঠস্বর, জলদ, মধুর ও ইষৎ গম্ভীর।
আষাঢ় মাসের গোড়াতে পুন্ড্রনগর এসেছেন বুদ্ধ । বর্ষাকাল এ নগরেই কাটাবেন। তথাগত কখনও পুন্ড্রনগর এলে ভাসুবিহারেই থাকেন; যেহেতু, প্রসিদ্ধ এই বিহারটির সুনাম আর্যাবত্মের সর্বত্র। এবার কোশল রাজ্য থেকে এসেছেন তথাগত। প্রায় প্রতিদিনই দু-বেলা বিহারের শিক্ষার্থীদের সামনে ধর্ম ব্যাখ্যা করছেন। আজও। বুদ্ধের দু’পাশে বসে আছেন ভিক্ষু আনন্দ ও ভিক্ষু মৌগলায়ন । এরা দু’জনই বুদ্ধের প্রিয় শিষ্য। এদের দুজনকেও ধ্যানগম্ভীর ও স্থিরই দেখায়। ওদের পিছনে সভাগৃহটির সাদা রঙের অমসৃন দেওয়াল, দেওয়ালে লাল রঙের একটি পদ্ম ফুল আঁকা রয়েছে।
হঠাৎই সেদিকে চোখ গেলে পদ্মফুলের কাল্পনিক গন্ধ পায় ভিক্ষু সুমন্ত। তখন থেকেই ভিতরে ভিতরে চাপা চঞ্চলতা টের পাচ্ছিল সে। কেমন এক অস্বস্তি বোধ করছিল। তার চারপাশে ভিক্ষুরা অভিভূত হয়ে বুদ্ধের উপদেশ শুনছে। আশ্চর্য! আজ থেকে আমি এদের কেউ না! যেহেতু-ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়। আর, এই কথাটা বুদ্ধের কানে পৌঁছলে তথাগতর হলুদাভ সৌম মুখটির অভিব্যাক্তি কেমন বিকৃত হয়ে যেতে পারে সে দৃশ্যটি অনুমান করে উদ্বেগ বোধ করে সে। তার পরনে লাল রঙের চীবর। কাল থেকেই শরীরে খসখসে এক অনুভূতি হচ্ছিল। সে বিব্রত চোখে বুদ্ধের দিকে তাকাল। বুদ্ধ বলছেন, যাহারা, অসার বস্তুকে সার বিবেচনা করে এবং সারকে অসার বিচেনা করে, মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা-সেই ব্যাক্তি কখনও সার প্রাপ্ত হয় না। উসখুস করে উঠল ভিক্ষু সুমন্ত। তা হলে? তা হলে শ্রীলেখা কি অসার? তা হলে ওকে দেখে কাল আমি কেঁপে উঠলাম কেন? আমি কি মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা? তা হলে? তা হলে শ্রীলেখা কি মিথ্যা? আর আমি মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা? তাহলে? সার কি? প্রেম কি সার নয়? শ্রী লেখা?। ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়। আর আমি শ্রীলেখাকে ভালোবাসি।
মধ্যবয়েসী ভিক্ষু সুমন্ত কেঁপে উঠল।
বুদ্ধ অর্ধ-মাগধী ভাষায় বলছেন, সারঞ্চ সারতো ঞত্বা অসারঞ্চ অসারতো।
বুদ্ধের কথাগুলি ঠিকমতো কানে ঢুকছিল না ভিক্ষু সুমন্তর। ক্ষণে ক্ষণে শ্রীলেখার মধুর মুখোশ্রীটি মনে পড়ে যাচ্ছিল। শ্রীলেখার ঘন কালো চুল, গায়ের রংটি শ্যামলা, চোখ দুটি বড় বড়- আয়ত, মুখের ছাঁচটি ভারি মিষ্টি। আজই দুপুরে দ্বিতীয়বারের মতো শ্রীলেখাকে দেখল ভিক্ষু সুমন্ত। তবে গতকালই শ্রীলেখাকে প্রথমবার দেখার পর থেকেই শ্রীলেখার মুখটি আর ভুলতে পারছে না সে। ভিক্ষু সুমন্ত মাঝবয়েসি; শ্রীলেখা তরুণী। তাতে কি? শরীর ও শরীরের ভিতরে রয়েছে যে এক অদৃশ্য অলীক মনতন্ত্রবীণা-ভিক্ষু সুমন্ত এখন জানে- সেই বীণাটি যে কোন বয়সেই ঈশ্বরের কারসাজিতে বেজে উঠতে পারে।
ভিক্ষের উদ্দেশে কাল দুপুরে পুন্ড্রনগরের হাঁটছিল ভিক্ষু সুমন্ত। জায়গাটি নিরিবিলি। লোকে বলে: ধান-মোহনী । একটি বৃহৎ পুস্করিণীর পাড়ে একটি জৈন মন্দির-আর একটি হরীতকী গাছ। এদিকটায় আগে তেমন আসা হয়নি। ভিক্ষু সুমন্ত পুন্ড্রনগরে এসেছে আষাঢ় মাসের গোড়ায়। এর আগে উজ্জ্বয়িনী নগরের উপান্তের একটি বৌদ্ধ সংঘে বাস করত । সেই সংঘের প্রবীন অধ্যক্ষ ভিক্ষু ধর্মরক্ষিতকে গভীর শ্রদ্ধা করত সে। আটাত্তর বছর বয়েসে ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত মৃত্যু বরণ করলে এক প্রবল শোকে আক্রান্ত হয় ভিক্ষু সুমন্ত। সে শোক প্রশমনের উদ্দেশ্যেই সে উজ্জ্বয়িনী নগর ত্যাগ করে পথে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর অযোধ্যা-রাজগৃহ প্রভৃতি নগর-উপনগর ঘুরে পুন্ড্রনগর এসে পৌঁছে বর্ষাকালের প্রারম্ভে। পুস্করীণির পাড় দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াল । সম্পন্ন কোনও শ্রেষ্ঠীর গৃহ হবে। বাইরের দেওয়ালটি গোবর লেপা;- শুকনো গোবরের গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। দেয়ালের মাঝখানে কাঠের দরজা- কালো রঙ করা । দেওয়ালের ওধারে একটি বর্ষজীবি বেলগাছ-বেলপাতায় রোদের ঝিলিক। স্তব্দ দুপুর। চারপাশ কী নির্জন। কেবল বেলপাতার আড়ালে কাক ডাকছিল। এই সময়ে কে যেন তার ভিতর থেকে বলল, এই জীবন। কী লক্ষ্য তার?
আষাঢ়ের মধ্যদিনের বাতাসে ভেসে এসে কে যেন উত্তর দিল, পথে যেতে যেতে একটা আলোর মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য।
আর?
আর কী।
সুমন্ত বিভ্রান্ত বোধ করে। একা হলেই কে যেন কথা কয়ে ওঠে তার ভিতরে। কে সে? কে?
রোদ খাঁ খাঁ । ভিতরে সাড়া শব্দ নেই। লোকজন নেই নাকি বাড়িতে? ভিক্ষুদের উচ্চস্বরে ভিখ্ চাইতে নেই। ভিক্ষু সুমন্ত কাশল। তারপর কাঠের দরজায় আলতো করে ধাক্কা মারতে যাবে- তার আগেই সহসা বাতাসের ঘূর্ণিতে দরজার একটি পাল্লা গেল খুলে । দৈব কি? ভিতরে উঠান। রোদ। দু-ধাপ সিঁড়ি;- উঠে গেছে প্রশস্ত একটি দাওয়ায়। হ্যাঁ, কোনও সম্পন্ন শ্রেষ্ঠীর গৃহই মনে হচ্ছে। একটি মেয়ে দ্রুত দাওয়া থেকে উঠানে নেমে আসছে। মেয়েটির হাতে লাল রঙের মাটির বাসন। এলো চুলের শ্যামলা মতন মেয়েটি হাঁটার ধরনে কী ছিল-নিমিষে মুগ্ধ হয়ে গেল সুমন্ত। তাঁর এই মুগ্ধতা বিস্ময়ের সৃষ্টি করল। তার শরীর ও মনে ভিতরে প্রবাহিত হলো এক ধরনের ভালো লাগা চোখের নিমিষে আশ্চর্য! আমি কি ভালোবেসে ফেললাম মেয়েটিকে? অথচ অথচ আমি যে মোহশূন্যতার সাধক। মেয়েটির মাঝারি উচ্চতা। কতই বা বয়স-এই পচিঁশ/ছাব্বিশ। যত কাছে আসছিল, বুকের ভিতরে বেজে উঠছিল মৃদঙ্গ। সুমন্ত তার শীর্ণ বুকের ভিতরে করতোয়ার উছল জলপ্লাবন টের পায়-এই মাঝ বয়েসেও। সদর দরজার কাছে এসে মেয়েটি মুখ তুলে তাকালো। রোদ। কালো পাথরে গড়া নিখুঁত মিষ্টি একটি মুখ। আয়ত চোখ। নাকে রুপোর নথ, ঠোঁটের বাঁ পাশে তিল। জবাকুসুম তেলের গন্ধ পেল। তার শরীর অবশ হয়ে যেতে থাকে। মেয়েটিও থমকে গেল যে! মুখচোখে সামান্য বিস্ময় জমেছে যেন। দ্রুত সামলে নিল। তারপর বলল, শুনেছি, নগরে তথাগত এসেছেন ভিক্ষু?
কী মধুর কন্ঠস্বর। বুদ্ধ যে পুন্ড্রনগরে এসেছেন- কথাটাটি পুরনো। তবে জিজ্ঞেস করল কেন, সচেতন হয়ে উঠল সুমন্ত। ভিক্ষা পাত্রে অন্ন আর সেদ্ধ ওল নিতে নিতে সুমন্ত বলল, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই শুনেছেন।
তথাগতর সঙ্গে দেখা হলে আমার প্রণাম জানাতে ভুলবেন না যেন।
বেশ। তা জানিয়ে দেব।
বেশ কিছু দিন থাকবেন বুঝি?
হ্যাঁ। বর্ষাকালটা তথাগত পুন্ড্রনগরেই কাটাবেন। আশ্চর্য! এই কথাগুলিও তো মেয়েটির জানার কথা। তা হলে জিজ্ঞেস করছে কেন? মেয়েটি কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়? কিন্তু, কেন? মেয়েটির চুল এলোমেলো। বসনও ইষৎ বিস্রস্ত। আর চোখ দুটি লাল। ফোলা ফোলা। কাঁদছিল কি? কেন? মেয়েটি সুখি নয়? ভূভারতে কেউ-ইবা সুখি। কিছু আমোদপ্রিয় পুরুষ হয়তো সুখি-মেয়েরা নয়। মেয়েটিকে সম্পন্ন গৃহিনী বলেই মনে হয়। স্বামী কি বণিক? কী এর কষ্টের রহস্য? ভিক্ষু সুমন্ত বলল, অন্নের জন্য কৃতজ্ঞতা।
মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, সে থাক। বরং, অন্য কথা বলি।
কি?
আপনারাই সুখি।
কেন? এবার মেয়েটির চোখ স্থির হল ভিক্ষু সুমন্তর চোখের ওপর। সে চোখে রোদ। চোখের পল্লবগুলি বড় বড় -ঢেউ খেলানো। কালো রঙের মনি। কী প্রগাঢ়! মেয়েটি বলল, আপনারা কেমন মুক্ত, পাখির মতো, সংসারের দুঃখসুখ বইছেন না।
জন্মের গ্লানি তো বইছি। ভিক্ষু সুমন্ত বলল। অজান্তে তার চোখ দুটি মেয়েটি স্তন দুটির দিকে চলে যায়। আচঁল ঠিক করতে করতে মেয়েটি বলল, তা হলে আমরা দ্বিগুণ দুঃখ বইছি।
নারী বলে?
তাই তো। দীর্ঘশ্বাস ফেলল কি? সতর্কভাবে ভিক্ষু সুমন্ত শুধালো, সন্ন্যাসীনি হওয়ার কথা ভাবছেন কি?
সে রকম ভাবতেও তো পারি। কে না মুক্তি চায়। মেয়েটি বলল। চকিতে একবার ভিতরের উঠানের দিকে তাকাল।
সুমন্তর বুকটা ধক করে উঠল। পুন্ড্রনগরের বামন পাড়ায় একটি ভিক্ষুণী সংঘ রয়েছে। ইচ্ছে হচ্ছে মেয়েটার হাত ধরে যোগীর ভিটার নারী সংঘে ভিতরে লুকিয়ে রাখতে । তারপর নিরালা কক্ষে বসে ধর্মের একান্ত পাঠ। মনোপুব্বঙ্গমা ধম্মা মনোসেটা মনোময়া, মনসা চে পদুটেঠন্ ভাসন্তি বা করোতি বা, ততো নং দুক্খমন্বেতি চক্কং বা বহতো পদং।
আশ্চর্য! মধ্যবয়েসী মধুমেহগ্রস্থ ভিক্ষু সুমন্তর তো অনেক আগেই কাম মরে যাওয়ার কথা। সে কামবোধ মরে গিয়েছে সত্য-তবে ভালোবাসবার সুপ্ত আকাঙ্খা আজও মরে যায়নি। ভিতরে ভিতরে কেমন অসহায় বোধ করে সে।
এ পথে লোকের চলাচল আছে। তারা দেখছে। আর দাঁড়ানো ঠিক না। ভিক্ষু সুমন্ত ঘুরে দাঁড়াল।
আমি শ্রীলেখা। মেয়েটি পিছন থেকে বলল।
ওহ্। আমি ভিক্ষু সুমন্ত। অবশ্য সে ঘুরে দাঁড়াল না। কথাটা শ্রীলেখা শুনল কি না কে জানে। তবে বুকে এক নতুন আবেগ টের পাচ্ছিল সে।
গতকালের রাতটি নির্ঘুম কেটেছিল। আজও সকাল থেকেই শ্রীলেখার দুটি চোখ টানছিল। দুপুর নাগাদ জৈন মন্দিরের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল সুমন্ত। সেই পুস্করিণী, সেই হরীতকী গাছ। আজও শ্রীলেখা নিজেই এল অন্ন ভরা মৃৎপাত্র নিয়ে। আজও শ্রীলেখার হাঁটার ভঙ্গিটি ছিল শ্লথ। চোখ দুটিও কেমন রক্তিম আর কান্না ভেজা। ভিক্ষু সুমন্ত সে দৃশ্যে বিষাদ বোধ করে ভিক্ষু সুমন্ত। তারপর সে আবেগতাড়িত হয়ে জিজ্ঞেস করেই বলল, আপনি কাঁদছিলেন কি?
শ্রীলেখা ম্লান হেসে, নাক টেনে বলল, তা মাঝে মাঝে কাঁদতে হয় বৈ কী ভিক্ষু।
তা মানি।
কাঁদলে কী যে ভালো লাগে। বুকের পাষানটি কেমন গলে গলে নেমে যায়। তখন বড় শান্তি পাই। শ্রীলেখা যেন আপনমনে বলল।
হ্যাঁ, মায়ের কথা মনে করে আজও আমি কাঁদি।
সন্ন্যাসীরা কাঁদে? শ্রীলেখার শ্যামল মুখচোখে কপট বিস্ময় ফুটে ওঠে।
কেন সন্ন্যাসীরা কি স্নায়ুতন্ত্রের অধিকারী জীব নয়?
তা মানি।
শ্রীলেখা ম্লান হাসল। তারপর সুমন্তর ভিক্ষাপাত্রে অন্ন আর এক মুঠো শুষণি শাক পরম যত্নে ঢেলে দিল।
এ পথে লোকের চলাচল আছে। তারা দেখছে। মিছিমিছি শ্রীলেখাকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলে কী লাভ?
ভিক্ষে নেওয়া তো শেষ। তা হলে আর দাঁড়িয়ে থাকা কেন? এখন আমি যাই। ভালো থাকবেন। সুমন্ত বলল। বলে ঘুরে দাঁড়াল। প্রায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে ঠিক তখনই পিছন থেকে ডাকল শ্রীলেখা, একটু শুনবেন?
ভিক্ষু সুমন্ত আবার ঘুরে দাঁড়াল। ইষৎ বিস্মিত। আজ্ঞে, বলেন।
আপনি কি অনেক দেশ ঘুরেছেন?
হ্যাঁ।
ও। বলে একটু থেমে নরম সুরে শ্রীলেখা বলল, আপনি কি কখনও শ্রাবস্তী গিয়েছেন?
হ্যাঁ। গত মাঘে আমি তো সে নগরেই ছিলাম।
কেমন সে নগর?
প্রশ্নটা শুনে ভিক্ষু সুমন্ত কী যেন ভাবল। তারপর মুচকি হেসে বলল, সে কথা জানতে হলে তো পথে নামতে হবে।
তা হলে আমি পথেই নামব ভিক্ষু। শ্রীলেখা বলল। কন্ঠস্বর দৃঢ়।
কথাটা শুনে অবাক হয়নি ভিক্ষু সুমন্ত। এ নগরেই প্রায় দুশোর মতন নারী ভিক্ষু রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহনের পূর্বেই এরা প্রত্যেকেই ছিল দুঃখী, নির্যাতিতা। তারা ভিক্ষু হওয়ার আগে তো পথেই নেমেছিল। শ্রীলেখাও নিশ্চয়ই সুখি নয়। নইলে ও কাঁদছিল কেন? নইলে ও পথে নামতে চাইছে কেন। ভিক্ষু সুমন্ত শুধালো, পথে নামবেন বললেন। কেন? ভিক্ষুণী হবেন কি?
না।
কেন?
এমনি। ভিক্ষুণী হব কেন। কী হয় চীবর পরে?
তাই তো। ভিক্ষু সুমন্ত ভাবল। আমি তো ভিক্ষু হলাম। তাতে কী লাভ হল। শ্রীলেখা আমার কুড়ি বছরের সমস্ত নিষ্কাম সাধনা চূর্ণ করে আমাকে কেমন মায়ার ঘোরে বেঁধে ফেলল আজ! সত্যিই তো-কী হয় চীবর পরে।
শ্রীলেখা বলল, আমি সত্যিই পথে নামতে চাই ভিক্ষু। এবং আজই।
আপনার স্বামী? ভিক্ষু সুমন্তকে সামান্য উৎকন্ঠিত দেখায়।
স্বামী? শ্রীলেখার কন্ঠস্বরে শ্লেষ। বলল, আমার স্বামীর নাম শ্রেষ্ঠী অনন্ত-এ নগরে সবাই তাকে চেনে। বলে শ্রীলেখা চকিতে একবার উঠানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি সুখি হইনি ভিক্ষু।
তিনি কি বাড়িতে নেই? ভিক্ষু সুমন্তর কন্ঠস্বর গম্ভীর।
না। আমার স্বামী বৈশাখ মাসের শেষে বাণিজ্যে গেছে। এখন কোথায় আছে জানি না। কোশল রাজ্যে যাওয়ার কথা, ফেরার কথা শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি। আমি ... আমি আজই আপনার সঙ্গে চলে যেতে চাই। আপনি আমায় সঙ্গে নেবেন না?
নেব। ভিক্ষু সুমন্তর বুক কাঁপছে। বলল, তবে অবশ্য এখনই না।
না। আমিও এখন যেতে চাইনা। শ্রীলেখা দ্রুত বলল। আগে রাত নামুক। আজ রাতে আমি ... আমি ঐ পুস্করিণীর পাশে হরীতকী গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকব। আপনি মাঝরাতে আসবেন।
আচ্ছা। তাই হবে। চাপা স্বরে বলল। বলে শ্রীলেখার আয়ত গভীর চোখের দিকে তাকালো ভিক্ষু সুমন্ত। রোদ। কালো পাথরে গড়া নিখুঁত মিষ্টি একটি মুখ। আয়ত চোখ। নাকে রুপোর নথ, ঠোঁটের বাঁ পাশে তিল। জবাকুসুম তেলের গন্ধ পেল সুমন্ত। তার শরীর অবশ হয়ে যেতে থাকে।
ভিক্ষু সুমন্ত মাঝবয়েসি; শ্রীলেখা তরুণী। তাতে কি? শরীর ও শরীরের ভিতরে রয়েছে যে এক অদৃশ্য অলীক মনতন্ত্রবীণা-ভিক্ষু সুমন্ত এখন জানে- সেই বীণাটি যে কোনও বয়েসেই ঈশ্বরের কারসাজিতে বেজে উঠতে পারে।
সে কথা ভেবে এখন ভিক্ষু সুমন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
আশ্চর্য! আজ থেকে তা হলে আমি ভিক্ষু সংঘের কেউ নই? তা হলে? তা হলে ধর্মের চেয়ে প্রেমই বড়? আর আমি শ্রীলেখাকে ভালোবাসি। শ্রীলেখাই সার। আর, বাকি সব অসার। এই ভাবনায়-পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই ভিক্ষু সুমন্ত সামান্য বিমূঢ় বোধ করে।
জানালার বাইরে কখন যে শেষ বিকেলের রোদ মুছে গেছে। জানলায় সান্ধ্যকালীন জ্যোস্নার ফ্যাকাসে আলো। সভাঘরের অন্ধকার জমে উঠছিল। ভিক্ষুরা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়েছে। রেড়ির তেলের গন্ধ ভাসছিল বাতাসে। বুদ্ধ তখনও উপদেশ দিয়ে চলেছেন। প্রদীপের ম্লান আলোতেও তাঁকে মহিমান্বিত বোধ হয়। সুমন্ত সহসা সচেতন হয়ে উঠল। সভা ঘরের দরজার কাছেই বসেছিল সে; সন্তপর্নে সভাঘর থেকে বেরিয়ে এল। দরজার ওপাশে দু’পাশ ঢাকা দীর্ঘ এক ইটের অলিন্দ। বাঁ পাশে ভিক্ষুদের সার সার কক্ষ । একটি কক্ষে ঢুকল সুমন্ত। ফাঁকা কক্ষ। অন্ধকার জমে আছে। শ্রীলেখার জন্য অতিরিক্ত একটি চীবর চাই। মেঝের এককোণে কতগুলি পাট করে রাখা চীবর পড়েছিল। উবু হয়ে তারই একটি তুলে নিল সুমন্ত। চীবরটি কার কে জানে। চুরি করলাম? চুরিই তো। আর কী। গতকাল শ্রীলেখাকে দেখার পর থেকেই ভিক্ষু জীবনের পাট চুকেছে। আর, আজ পরের দ্রব্য হরণ করতে হল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত পায়ে ঘরটি থেকে বেরিয়ে এল সুমন্ত। অলিন্দে অন্ধকার। প্রাঙ্গনে নেমে যাওয়ার সিঁড়ির ওপর জ্যোস্না। ততক্ষণে সন্ধ্যা ঘন হয়ে উঠেছে। আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি। আকাশে পরিপূর্ণ গোল একখানি পূর্ণিমার চাঁদ। প্রাঙ্গনটি জ্যোস্নালোকিত ও নির্জন। প্রাঙ্গনের ঠিক মাঝখানে একটি বয়স্ক অশত্থ গাছ। যে কারণে প্রাঙ্গনের ওপর অজস্র শুকনো পাতা ছড়িয়ে। আষাঢ়ি সন্ধ্যার বাতাসের টানে পাতাগুলি সরসর করে ওঠে।
দ্রুত পা ফেলে ভাসু বিহার থেকে বেরিয়ে যায় সুমন্ত ।
আর আমি ভাসু বিহারে ফিরে আসব না। তার দীর্ঘশ্বাস পড়ল।
ভাসু বিহারটি পুন্ড্রনগরের পশ্চিমে। ও কিছু বাইরে।
শ্রীলেখার মুখটি স্মরণ করে নগরমুখি হল সুমন্ত। দিন কয়েক বৃষ্টি হয়নি। নগরমুখি এ পথটায় গো শকটের চাকার গভীর দাগ। সান্ধ্য জ্যোস্নায় অনেকটাই স্পষ্ট। পথের দু’পাশে ঘন ঝোপজঙ্গল, কচুবন। তারই ফাঁকে ফাকে ফুটি ফুটি জ্বোনাকি। ঝিঁঝিরা তারস্বরে ডাকছে। দূরবর্তী শেয়ালের আর্তনাদও কানে আসে।
সুমন্ত দ্রুত হাঁটে।
পথের দু’পাশে এখন জ্যোস্নার প্রান্তর, আখের ক্ষেত। আখ বর্ষজীবি উদ্ভিদ। আখ পাতার ওপর বয়ে যাওয়া আষাঢ়ি সন্ধ্যার বাতাসের ঘর্ষণে সৃষ্ট মৃদু সরসরানির শব্দ সুমন্তকে কেমন আনমনা করে দেয়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পথের ওপর তার ছায়াটিও চলমান। সে অভিভূত হয়ে যেতে থাকে। এই সময়ে কে যেন তার ভিতর থেকে বলল, এই জীবন। কী লক্ষ্য তার?
পথে যেতে যেতে একটা আলোর মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কে যেন আজ সান্ধ্যকালীন জ্যোস্নার বাতাসে ভেসে এসে উত্তর দিল।
আর?
আর কী।
সুমন্ত বিভ্রান্ত বোধ করে। একা হলেই কে যেন কথা কয়ে ওঠে তার ভিতরে। কে সে? কে?
আখের খেত শেষ হলে তারপর আমবনের শুরু। আষাঢ় মাসজুড়ে আমবনে এক ধরনের কষায় গন্ধ থাকে। সুমন্ত সে কষায় গন্ধ পায়। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত বলেই এপথটিতে এখন লোক চলাচল কম। এ পথে এখন কেবলি জ্যোস্না ও গাঢ় নির্জনতা । সুমন্ত গুনগুন করে ওঠে: পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে। আশ্চর্য! বুদ্ধ সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছেন বহু আগেই। মুচকি হাসে সুমন্ত। ধর্মের চেয়ে সঙ্গীত বড়। সে দ্রুত হাঁটতে থাকে। বাতাসের গন্ধ সহসা বদলে যায়। ডান পাশে একটা বিস্তীর্ণ বিল। কালিদহ বিল। বিলের জলের রং তরল রুপার মতোই দেখায়। সামনেই একটা হাট। মেছো হাট। মাছের আঁষটে গন্ধ টের পায় বাতাসে। মানুষের কন্ঠস্বরের গুঞ্জন। পথের দুপাশে অনেকগুলি কূপি জ্বলে ছিল। ডুলো নিয়ে বসেছে মেছোরা। মাছ বিক্রি করেই তবে বাড়ি ফিরবে। আঁষটে গন্ধটা ভালো লাগে না সুমন্ত। জায়গাটি সে দ্রুত হেঁটে পেরিয়ে যেতে চায়। দীর্ঘকাল মাছ খায় না সুমন্ত। দীর্ঘকাল কেবল অন্ন আর কন্দ খেয়ে বেঁচে রয়েছে । মাঝেমধ্যে অবশ্য শাকও খায়। একটা সময় ছিল যখন সুমন্ত মাছমাংস খেত; তখনও ভিক্ষু হয়ে যায়নি সে। তা, সুমন্তর মা মহামায়া রাঁধতেন ভালো। সুমন্তর বউটিও-সেই সাবিত্রীরও রান্নার হাত ছিল চমৎকার। মাছ কাছিম ছাগ ও কবুতরের মাংস-কত কী যে রাঁধত সাবিত্রী। সুমন্তর আদি বাড়ি ছিল সমতট রাজ্যের দেবপবর্ত নগরের কাছে ক্ষিরোদা নদীর পাড়ের ময়নার টিলা গ্রামে। ক্ষিরোদা নদীটি ছিল নানাবিধ মৎসে পরিপূর্ন; বিশেষ করে, তিলাশোল। সুমন্তর বউ সাবিত্রী ছিল পাশের শ্মাশনগাছা গ্রামের মেয়ে। সুমন্তর বাবা জয়ন্ত ঘোষ যখন সাবিত্রীকে ছেলের বউ করে ঘরে আনল, সাবিত্রীর বয়স তখন সবে তেরো। বিখ্যাত ময়রা জয়ন্ত ঘোষ ছিল সমতটের প্রসিদ্ধ দই প্রস্তুতকারক। দেবপর্বত নগরের ময়নামতিতে জয়ন্ত ঘোষের দইয়ের বিপনী ছিল। তো, বউকে ভারি ভালো বাসত সুমন্ত। কত রকম পদ যে সাবিত্রী রেঁধে খাওয়াত; বিশেষ করে টাকি মাছের ভর্তা। হায়, তিন বছরও ঘর করা হল না- কী রোগে মরল সাবিত্রী। বউয়ের মৃত্যুর পর সুমন্তকে উদাসী রোগে ধরল। সে রাতদিন ক্ষিরোদা নদীর পড়ে বসে থাকত। সাবিত্রীর শোক দিনদিন বাড়ছিল। দিশেহারা সুমন্ত শোক প্রশমনের জন্য পথে বেরুল। সমতটের পূর্ব-দক্ষিণের ছিল ঘন অরণ্যে। সেখানে গেল। দক্ষিণের সমুদ্রের পাড়ে গেল, পশ্চিমের জমজমাট সব নগরে গেল। এভাবে শোক কিছু প্রশমিত হল বটে। বহু বছর পথে ঘুরতে ঘুরতে একদিন সে পৌঁছল আর্যাবর্ত্মের উজ্জয়িনী নগর। সে নগরের উপান্তে ভিক্ষু ধর্মরক্ষিতের সঙ্গে অনেকটা আকস্মিকভাবেই দেখা হয়ে গেল। ভিক্ষু ধর্মরক্ষিত মগধের রাজগৃহ নগরে স্বয়ং বুদ্ধদেবের কাছে ধর্মান্তিত হয়েছেন। বুদ্ধদেবই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন নগর উজ্জ্বয়িনীতে একটি বৌদ্ধসংঘ নির্মান করতে। কুড়ি বছর উজ্জ্বয়িনীর সংঘে ছিল সুমন্ত । ভিক্ষু ধর্মরক্ষিতের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল গভীর সখ্য । গত বছর মধ্য শ্রাবণে ভিক্ষু ধর্মরক্ষিতের মৃত্যু হল। সে সময় গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল সুমন্ত। শোক প্রশমনের উদ্দেশ্যে সে আবার পথে বেরিয়ে পড়েছিল। জীবন এমন- পুন্ড্রনগরে এসে গতকাল শ্রীলেখার মুখটি দেখে সাবিত্রী ও ধর্মরক্ষিতের মুখ সম্পূর্ন ভুলতে বসেছে সে। আশ্চর্য! শ্রীলেখার সঙ্গে মৃতা সাবিত্রীর মুখোশ্রীর এত মিল!
পুন্ড্রনগরের পশ্চিমের নগর তোরণটির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে । কড়ই গাছের সমান উচুঁ ইটের তৈরি তোরণ। অর্ধবৃত্তাকার অবয়বটা জ্যোস্নায় কেমন ভৌতিক দেখাচ্ছে। তোরণের ছায়ায়, ভিতরে, আশেপাশে সশস্ত্র সৈন্যরা দাঁড়িয়ে। ক’জন অশ্বারোহী সৈন্যও রয়েছে। একটি মেয়েকেও দেখল।
সুমন্ত ভিক্ষু বলেই কেউই তাঁকে আটকালো না।
নগর তোরণের ওপাশে একটি সোজা প্রশস্ত ইট বাঁধানো সড়ক। জ্যোস্নায় উজ্জ্বল। পথের দু-পাশে কিছু দ্বিতল ভবন রয়েছে। সুমন্ত জানে ভবনগুলি অধিকাংশই প্রশাসনিক । বাঁ পাশে একটি বড় দিঘি। সুমন্ত জানে পুন্ড্রনগরের লোকেরা দিঘিটিকে বড় দিঘিই বলে। দিঘি পেরুলে আবার সড়কের দু-পাশে কিছু দ্বিতল ভবন । এই ভবনগুলি প্রশাসনিক নয়-নগরের সম্পন্ন শ্রেষ্ঠীদের বাস। সড়কের পাশে প্রাচীর। প্রাচীরের ভাঙ্গা একটি রথ। রথটির তলায় একটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। কূপী জ্বলেছিল। আর্যাবত্মজুড়েই এরকম হতশ্রী দৃশ্য বিরল নয়। কেন যে জগতে একদল মানুষ অহেতুক কষ্ট ভোগ করে। সুমন্ত হাটার গতি বাড়িয়ে দিল। সড়কটা শেষ হয়েছে বৃত্তাকার একটি ইটের প্রাঙ্গনে। জায়গাটির নাম রাজর্ষী: এটিই পুন্ড্রনগরের প্রধান নগরকেন্দ্র। রাজর্ষী চত্বরের ঠিক মাঝখানে বিশাল একটি পাখা মেলা ধবল রাজহাঁসের মূর্তি। শ্বেত পাথরের তৈরি। মধ্য আষাঢ়ের জ্যোস্নায় স্পস্ট ধবল দেখায়। মগধের সম্রাট বিম্বিসার একবার এসেছিলেন পুন্ড্রনগর। তখন তাঁরই সম্মানে নির্মিত করেছিলেন এ মূর্তি পুন্ড্রনগরের নগরপিতারা ।
কী মনে করে আকাশে মুখ তুলল সুমন্ত।
আশ্চর্য! জ্যোস্নার আকাশে এক ঝাঁক বুনো হাঁস কন্ঠহারের মতন উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণ দিকে।
সুমন্ত তার শরীরে ক্ষীণ শিহরন টের পেল।
রাজর্ষী চত্বর ঘিরে চারটি পথ চারদিকে চলে গেছে। পথগুলির ফাঁকে ফাঁকে সরু সরু গলির মুখ। পূর্বদিকের একটা গলির মুখে একটি মিস্টান্নের আপণ। পুন্ড্রনগরের বিখ্যাত মধু ময়রার ‘শ্রীপর্ণা দধিভান্ডার।’ আপণে আলো জ্বলে আছে। ভিতরে বাইরে লোকজনের জটলা। এখানে এলেই মৃত বাবার কথা মনে পড়ে যায় সুমন্তর। কত শখ করে সাবিত্রীকে ছেলের বউ করে ঘরে তুলেছিল বাবা। বাবা এখন কই? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সরু গলিতে ঢুকল সুমন্ত। এই গলির নাম নবান্নের গলি। সুমন্ত জানে । গলিটা বেশ সরু। কোনও মতে দুটি রথ যেতে পারে। দুপাশে এক মানুষ সমান উচু প্রাচীর। প্রাচীরের ওপাশে মানুষের ঘরবাড়ি। কারা যেন খড়ি পুড়িয়েছে। ধোঁওয়া দেখা না গেলেও স্নায়ূ উতল করা সেই গন্ধ পেল সুমন্ত। শিশুর কান্না। কুকুরের ডাক। পুরুষকন্ঠের তীক্ষ্ম চিৎকার: ‘তুই, মরতে পারিস না!’ দ্রুত পায়ে হাঁটছে সুমন্ত। গলিটা এ জায়গায় বাঁক নিয়েছে। বাঁকের মুখে একটা ছাড়া-ষাঁড়। কাদের কে জানে। অনেকদিন হল এ নগরে শৈব আর বিষ্ণপন্থি উপাসকদের প্রতাপ। বলির জন্য ষাঁড় অপরিহার্য। ষাঁড় বলি দিলে সার্থবাহের পশুর সঙ্কট। আর্যাবত্মজুড়ে ষোড়শ জনপদ গড়ে উঠেছে। পন্য নিয়ে দূরবর্তী নগরে যেতে গো-শকট অপরিহার্য। ওদিকে বুদ্ধ অহিংসধর্ম প্রচার করছেন, তিনি পশুবলির বিপক্ষে। এজন্যই কি বণিকেরা বুদ্ধের পৃষ্টপোষকতা করছে? সুমন্ত মুচকি হাসে। বুদ্ধ যখন ব্যবহৃত হচ্ছেন-তা হলে আমি ধর্মের চেয়ে সঙ্গীত ও শ্রীলেখাকে বড় বললে আমার দোষ কোথায়? কথাটা ভাবতে ভাবতে হাড়ি পাড়ায় চলে এল সুমন্ত। হাড়ি পাড়ায় হাড়ি ছাড়াও ডোমদের বাস। এরা, শৈব আর বিষ্ণপন্থি উপাসকদের চোখে অচ্ছুত। সুমন্ত মুচকি হাসে। আরও কিছুটা হাঁটলে যৌবন বিক্রেতাদের পল্লী। সে কারণেই বাতাসের গন্ধও কেমন বদলে যায়। গলিতে নানাবয়েসী পুরুষের ভিড়। দু’পাশে আলোজ্বলা বাড়ি। বাতাসে মাংসপোড়া গন্ধ, ধেনো মদের গন্ধ। আলো। খিলখিল হাসি। গম্ভীরস্বরে ভর্ৎসনা। বিচিত্র সুরের গান। একজন নেশাসক্ত পুরুষকন্ঠের গান কানে এল সুমন্তর।
তুমি আর আমি সখা, তুমি আর আমি।
ভালোবাসি ভালোবাসি জানে অর্ন্তযামী।
অর্ন্তযামী মানে কি ঈশ্বর? ভিক্ষুজীবনে কি ঈশ্বর মানত সুমন্ত? বুদ্ধ তো নিরেশ্বরবাদী। তা হলে?
আহ্। পুন্ড্রনগর। তুমি সস্তা আর সুলভ নারীদের বুকে নিয়ে আজও সংশয়বাদী। তুমি শ্রীলেখার নগর। আমায় তুমি বদলে দিলে হে পুন্ড্রগনের মহৎ নগর। কেননা, ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়। ঘোরের মধ্যে হাঁটে সুমন্ত। বেশিদিন হয়নি সে এ নগরে এসেছে । প্রথম থেকেই অসম্ভব ভাল লাগছিল তার নগরটি। এ নগরেই কোথাও যদি শ্রীলেখার সঙ্গে বাস করা যেত-ধরা যাক এই নবান্নের গলিতে-হাড়িপাড়ার খুব কাছে । হায়। নাঃ, তা সম্ভব নয়। শ্রীলেখার স্বামী জীবিত। শ্রীলেখাকে নিয়ে পুন্ড্রনগর ছেড়ে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। আজই। শ্রীলেখা শ্রাবস্তী নগরে যেতে চায়। যদিও শ্রাবস্তী যাওয়া অনুচিত হবে। শ্রাবস্তী নগরটি কোসল রাজ্যে। তখন শ্রীলেখা বলল, ওর স্বামী কোসল রাজ্যে গিয়েছে। জৈন মন্দিরের পাশে সেই হরীতকী গাছের নীচে শ্রীলেখার দাঁড়িয়ে থাকার কথা । দাঁড়িয়ে থাকবে তো? সুমন্তর বুকে ঝড়। ধর্মের চেয়ে প্রেম বড়। আর আমি শ্রীলেখাকে ভালোবাসি। আশা ও সংশয়ের দোলায় দুলতে দুলতে ধানমোহনীর জৈন মন্দিরের দিকে হাঁটতে থাকে সুমন্ত।
শ্রীলেখা। অনেকক্ষণ হল জৈন মন্দিরের পাশে হরীতকী গাছটির নীচে দাঁড়িয়ে আছে । এখন রাত্রির কত প্রহর কে জানে। ভিক্ষু এখনও আসছে না । আসবে না? না আমাকে ঠকালো? সবাই আমাকে ঠকায়। আমার বাবা, জয়ন্ত, আমার স্বামী । শ্রীলেখা অসহ্য অভিমান টের পেল বুকের ভিতর। মশারা বিন বিন করছিল পায়ের কাছে। রক্ত শুষে নিচ্ছে। নিক। আমি তো মরতেই চাই। কত আর সহ্য হয়? স্বামী ঘরে না থাকলে দাসী মল্লিকা চোখে চোখে রাখে। অসহ্য। আজ রাতে দাসী মল্লিকা মাধবের ঘরে ঢুকে দোর দেওয়ার পর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই তবে সন্তপর্ণে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে শ্রীলেখা। তখন মোটেও বুক কাঁপেনি। তবে মুক্তির আনন্দও টের পাচ্ছিল না শ্রীলেখা। কেবল ক্ষীণ এক উদ্বেগ টের পাচ্ছিল- দাসী মল্লিকা যদি জেগে ওঠে। দাসী মল্লিকা সাংঘাতিক কুটনি। স্বামীর চর। মাঝেমধ্যে মধ্যরাত্তিরে মল্লিকার ঘরে যান পতিদেবতাটি। পরের দিন দাসী মল্লিকার হাসি হাসি মুখ দেখে সর্বাঙ্গ জ্বলে যায় শ্রীলেখার।
তবে শ্রীলেখার স্বেচ্ছানির্বাসনের কারণ এইটুকুমাত্র নয়।
ভিক্ষু এখনও আসছে না । ইস্। মশারা ছেকে ধরেছে। ধরুক। লাল রঙের চীবর পরা মধ্যবয়েসী শ্যামবর্ণের ভিক্ষুটি আমায় গতকাল দেখামাত্রই ভালোবেসে ফেলেছে। ইস্। লোকটা যদি জানত সবটা! কেন আজও মধ্য আষাঢ়ের পূর্ণিমার রাতে পুন্ড্রনগরের আকাশ দিয়ে উড়ে যায় এক ঝাঁক বুনোহাঁস! থাক। সে সব কথা এখন থাক। তবে মধ্যবয়েসী ভিক্ষুর ওপর নিশ্চয়ই বিশ্বাস রাখাই যায়। একেই কি দৈব বলে না? নইলে আমার স্বামীই-বা কেন ঠিক এই সময়ে কোশল থাকবে? নইলে আজও দুপুরে কেন বাড়ির পিছনের পুস্করিনীতে গা ধুতে যাবে দাসী মল্লিকা - যখন ভিক্ষু এল। কালও তো তাইই হল। ভাগিস্য। আজ থেকে আর আমার পাষন্ড লোকটার মুখটা দেখতে হবে না। কেন যে ঐ চন্ড লোকটা সঙ্গে বিয়ে হল। বিয়ের পরপরই এক ছেলে হয়ে মরে গিয়েছিল শ্রীলেখার-সে ও ছ’-সাত বছর আগের কথা; পুন্ডনগরের প্রবীন কবিরাজ রাজনাথ শ্রীলেখার জন্মপথে কীসব ঢুকিয়ে কী করেছিলেন-তারপর থেকে আর প্রশব বেদনা সইতে হয়নি শ্রীলেখাকে। ভাগ্যিস। সেবার ছেলে হওয়ার সময় শ্রীলেখা বাপের বাড়ি ছিল। শ্রীলেখার বাপের বাড়ি ছিল রাজর্ষী প্রাঙ্গনের পুবে, নবান্নের গলিতে- হাড়ি পাড়ার খুব কাছেই। শ্রীলেখার পিতা ছিলেন প্রসিদ্ধ বৈদিক পন্ডিত-গতবছর দেহরক্ষা করেছেন রামদেব । শ্রীলেখাদের বংশটি বড়ই সম্ভ্রান্ত। দেব পরিবারই তো বংশপরম্পরায় বৈদিক মত প্রতিষ্ঠা করেছে আর্যাবর্তের পূর্বের এই প্রান্তে। তার আগে পুন্ড্রবর্ধনের জনমানুষ পূজা করত প্রকৃতির এবং লৌকিক দেবদেবীর। বৈদিকেরা পুন্ড্রবর্ধনে আসার আগে স্থানীয় লোকজ ডোম-হাড়ি-বাগদির বৈদিক যাগজজ্ঞের ধারনাই ছিল না। নবান্নের গলির হাড়িপাড়ার ক’ঘর মানুষ আজও লৌকিক দেবদেবীর উপাসনা করে। হাড়ি পাড়ার জয়ন্তকে ভালোবাসত শ্রীলেখা। পরিবারের বৈদিক আবহ, বৈদিক শিক্ষা তুচ্ছ করেছিল শ্রীলেখা। ওর শরীরে তখন রক্তের বদলে করতোয়ার জল ঢুকে গেছে- নিত্য ঝড়জল-প্লাবন টের পায়। হাড়িপাড়ার শ্যামবর্ণের তরুণ জয়ন্ত যে দেখতে খুব একটা সুদর্শন ছিল তাও কিন্তু নয় -তবে চলনসই ছিল- শ্রীলেখা কিন্তু রুপ নিয়েও ভাবত না। চৌদ্দ বছর তিন মাস বয়েসে শ্রীলেখা প্রথম জয়ন্তকে দেখেছিল করতোয়ার পূর্ব পাড়ের রুপহাটির মেলায় বৈশাখের প্রথম দিনের রৌদ্রমূখর অপরাহ্নে । রসিক ময়রার মিস্টান্নর আপণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল জয়ন্ত। শ্রীলেখা তো ওকে দেখামাত্র থ। শিরার রক্তে প্লাবন; বুকে ঝড়জল। সে ঝড় বাহিরের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কি? নইলে আচমকা ঝড়ই বা উঠবে কেন। সহসা বোশেখের ঘূর্ণি বাতাসে কে কোথায় ছিটকে গেল। মুহূর্তেই সমস্ত মেলা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। রুপহাটির উত্তরে যে বিস্তীর্ণ আখক্ষেত আছে-সেখানেই নিজের বুকে শক্ত করে শ্রীলেখাকে আঁকড়ে রেখেছিল জয়ন্ত। সন্ধ্যে অবধি। তারপর থেকে জয়ন্তর সঙ্গে নিত্য দেখা হতে লাগল শ্রীলেখার: লুকিয়ে অবশ্যই। শ্রীলেখার বাবা আচার্য রামদেব ছিলেন যেমন রক্ষণশীল-তেমনি চন্ড প্রকৃতির। রামদেব অবশ্য তার কন্যাটিকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। কন্যাটিও- ‘নবান্নের গলির ধোঁওয়ায় মাথা ধরে আছে। নদীর পাড়ে যাচ্ছি’ বলে রথে উঠে বসত। কন্যার কথা শুনে রামদেব মিটমিট হাসতেন। সঙ্গে নবীন তো রয়েছে-চিন্তা কী। বয়সে প্রবীন হলেও নবীন দেবপরিবারের বিশ্বাসী সারথী। তাছাড়া রামদেবের কন্যাকে উক্তত্য করে এমন স্পর্ধা কার আছে এ নগরে। তো, পুন্ড্রনগরের বাগদি পাড়ার কাছেই শালবন। শালবনের ওপাশে চন্দ্রদিঘি। সে দিঘির নিরালা পাড়ে অপেক্ষা করত জয়ন্ত। অপরাহ্নের আলো মুছে না যাওয়া অবধি দুজনের কত কথা, চুম্বন-প্রনয়। কিশোরী শ্রীলেখার শরীরে তখন রক্তের বদলে করতোয়ার জল । যে জলে ঝড়জল-প্লাবন। জয়ন্তের গানের গলা ছিল দরদী। যখন সে এতদঞ্চলের একটি লোকপ্রিয় গান ধরত-
তুমি আর আমি সখা, তুমি আর আমি।
ভালোবাসি ভালোবাসি জানে অর্ন্তযামী।
তখন ...তখন, শ্রীলেখার মনে হত চন্দ্রদিঘির কালো জলে সন্তরণশীল বুনোহাঁসেরা গানের টানে পাড়ের দিকেই এগিয়ে আসছে। চন্দ্রদিঘির পাড় ঘিরে দীঘল দীঘল শিলকড়ই গাছ, কচু বন, আমরাঙা গাছ। সেসব গাছের গভীর ছায়া । পাড়ে উঠে এলেও বুনোহাঁসেদের আমাদের খুঁজে পেতে সমস্যা হবে, শ্রীলেখা তেমনই ভাবত। শেষ বেলার আলোয় অজস্র চুম্বনের পর বড় রাস্তার পাড়ে অপেক্ষমান রথের কাছে ফিরত শ্রীলেখা। রথের বুড়ো সারথী নবীন খুড়ো শ্রীলেখাকে ভারি ভালোবাসত। নবীন খুড়ো হেসে বলত, নদীর ধারে বেড়ানো হল।
খুব হল খুড়ো? লাজুক হেসে বলত শ্রীলেখা।
তাহলি এবার নখখি মেয়ের মতন রথের প’র উঠে পড়নি দেখি। সূর্যবাতি নিভবার আগেই ঘরে ফিরতি হবি যে- তানাহলে তোমার খ্যাস্টো পিতার কোপে পইড়তি হবি না?
শ্রীলেখা রথ দুলিয়ে রথে উঠে পড়ত। নবীন খুড়ো তুরন্ত গতিতে রথ চালিয়ে সন্ধ্যের আগে আগেই নবান্নর গলিতে ফিরে যেতে পারত। তো, নবীন খুড়ো একদিন সকালে পট করে মরে গেল। শ্রীলেখা কী যে কাঁদল। রাতভর কাঁদল, দিনভর কাঁদল। ওর খুব কষ্ট হল । তারপর যা হয়-গুরু জন মরে গেলে আরও আরও বিপদ ঘনিয়ে আসে। জয়ন্তর সঙ্গে প্রনয়ের ব্যাপারটা শ্রীলেখার বাবার কানে পৌঁছল। নতুন সারথী কানাই-সেই প্রভূর বদান্যতার আশায় রামদেবকে যা বলার বলল। বৈদিক রক্তের বিশুদ্ধতা অক্ষুন্ন রাখার মরণ পণ ছিল রামদেবের -সেইটে হয়তো দোষের নয়, তবে রামদেবের স্বভাবটি ছিল চন্ড প্রকৃতির । সুকন্ঠ গায়ক জয়ন্তর সবই ভালো-তবে সে যে জাতে হাড়ি-এই তার পাপ। কানাইয়ের মুখে অচ্ছুতের সঙ্গে কন্যার দৈহিক সম্পর্কের কথা শুনে ক্রোধে অন্ধ হয়ে উঠলেন রামদেব । পারিবারিক কলঙ্কের হাত থেকে বাঁচতে উপযুক্ত সিদ্ধান্তই নিলেন। পুন্ড্রনগরের ধনবান শ্রেষ্ঠী অনন্ত কে ভালো করেই চিনতেন আচার্য রামদেব; শ্রেষ্ঠী অনন্তর ভিটেয় যজ্ঞানুষ্ঠানের মূল পুরুত তো তিনিই। ত্বরিত শ্রেষ্ঠী অনন্তর কাছে পৌঁছে যা বলার বললেন রামদেব । পুন্ড্রনগরের যোগীর ধাপনিবাসী শ্রেষ্ঠী সঞ্জয়ের এক দৌহিত্রের অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে ষোড়শী শ্রীলেখাকে দেখেছিল শ্রেষ্ঠী অনন্ত । তন্বি শ্রীলেখার শ্যামবর্ণের উদ্ভিন্ন শরীরটি শ্রেষ্ঠী অনন্তর বিপুল কামপ্রদাহের উদ্রেক ঘটিয়েছিল। উপরোন্ত, শ্রেষ্ঠী অনন্তর প্রথমা স্ত্রী দেবী সুদেষ্ণা সদ্য গত হয়েছেন। শ্রীলেখাকে দেখার পর থেকেই শ্রেষ্ঠী অনন্ত শ্রীলেখাকে সম্ভোগের সুযোগ খুঁজছিল। সে সুযোগ এল। সে বিপুল উত্তেজনা চেপে রেখে রামদেবকে বলল, আপনি ভাববেন না আচার্য। যা করবার আমিই করছি। এই ঘটনার পর-শ্রীলেখা পরে শুনেছিল- অনন্ত শ্রেষ্ঠীর নির্দেশে তারই কতিপয় বশ্য পেশল পুরুষেরা কাল বিলম্ব না করে হাড়িপাড়ার উদ্দেশে যাত্রা করে দ্রুত হাড়িপাড়া ঘিরে ফেলে। তারপর জয়ন্তকে তারা ঘর থেকে বের করে টেনে হিঁচড়ে অপেক্ষমান রথে তুলে কালীদহ বিলের কাছে নিয়ে যায়। ঘাতকদের সবার হাতে ছিল কাঠের মুষল। তারা কাঠের মুষল দিয়ে জয়ন্তকে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করে। সময়টা ছিল এরকমই মধ্য-আষাঢ়ের এক পূর্ণিমাসন্ধ্যা। অপহরণকারী ঘাতকরা নাকি মেরেই ফেলত জয়ন্তকে-একজন পেশলপুরুষ নাকি জয়ন্তর গানের ভক্ত ছিল-তাই প্রাণে মারেনি। যা, ভাগ, পুন্ড্রনগর থেকে। আর কখনও যেন এ নগরে না দেখি।
এই ঘটনার পর আর কখনও জয়ন্তকে পুন্ড্রনগরে দেখা যায়নি।
নিম্নবর্ণের হওয়ায় মূল্য দিল জয়ন্ত । আগে অবশ্য বর্ণের এহেন বিভেদ ছিল না পুন্ড্রে-যখন বৈদিকেরা এতদ্বঞ্চলের আসেনি। বৈদিকেরা অতিশয় যজ্ঞপ্রবণ- এবং তারা বর্ণবাদীও বটে। তবে কী কারণে যেন শ্রীলেখার হৃদয়টি ঠিক তেমন সংকীর্ণ ছিল না। ও তো ঠিক করেই রেখেছিল যে- কোনও এক আশ্বিন শেষের দিনে শুধুমাত্র কামরাঙার ফুল বিনিময় করেই তবে তার আর জয়ন্তর বিয়ে হবে নির্জন শালবনের সেই চন্দ্রদিঘির পাড়ে। যে বিবাহ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবে কেবল বুনোহাঁসেরা। শ্রীলেখার নিভৃত স্বপ্নটি যে বর্ণবৈষম্যের তোড়ে এমনভাবে মিলিয়ে যাবে-কে জানত। যে দিন শ্রেষ্ঠী অনন্তর পোষ্য ঘাতকেরা জয়ন্তকে ধরে নিয়ে গেল-ঠিক সে দিন রাতেই পুন্ড্রনগরের আকাশে একঝাঁক বুনোহাঁস উড়তে দেখা গিয়েছিল। শ্রীলেখা তো বন্দি হয়েই ছিল। ওর ঘরটি ছিল নিস্পপ্রদীপ। নিস্পপ্রাণ মূর্তির মতো জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল শ্রীলেখা । আকাশে ছিল মধ্যআষাঢ়ী একটি পরিপূর্ন গোল চাঁদ ও ধবল পূর্ণিমা। হঠাৎ চোখ চলে গিয়েছিল আকাশে। এক ঝাঁক বুনোহাঁস হারের মতন অর্ধবৃত্তাকারে উড়ছিল দক্ষিণ অভিমূখে। চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁস নয় তো? শ্রীলেখার প্রস্তর হৃদয়ে অসহ্য কষ্টেরা ভিজে ভিজে ছড়িয়ে পড়ছিল। পুন্ড্রনগরে এর আগে এ রকম কত অচ্ছুত যুবক খুন হয়েছে বর্ণবাদী গোষ্ঠীপিতাদের হাতে! ওকেও কি এখন ওরা খুন করে ফেলবে? এই ভাবনায় শ্রীলেখা হিম হয়ে যেতে থাকে। তা হলে আমিও কি খুনি নই বুনোহাঁস। এক ঝাঁক বুনোহাঁস হারের মতন অর্ধবৃত্তাকারে উড়ছিল দক্ষিণ অভিমূখে। হায়, আমি জয়ন্তকে খুন করেছি। হঠাৎ হাড়িপাড়ার দিক থেকে চীৎকার ভেসে আসল। শ্রীলেখা চমকে ওঠে। ওদিকটায় আগুনের লাল আভা। গনগনে। লাল। হাড়িপাড়ায় আগুন লেগেছে। শ্রীলেখার মাথা কেমন টলে ওঠে। পরদিনই শ্রেষ্ঠী অনন্ত বরবেশে ক’জন অতিথি নিয়ে রাজর্ষী প্রাঙ্গনের পুবের নবান্নের গলিতে শ্রীলেখার বাড়িতে উপস্থিত হল। রামদেব প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন। নামমাত্র বিয়ের পর প্রায় অচেতন শ্রীলেখাকে টেনে হিঁচড়ে রথে তুলে বন্দি করে নিয়ে গেল শ্রেষ্টী অনন্ত। শ্রীলেখাকে যখন শ্রেষ্ঠী অনন্ত ধর্ষন করছিল শ্রীলেখা তখনও প্রায় অর্ধচেতন।
তারপর?
তারপর শ্রেষ্ঠী অনন্তর ধানমোহনীর বাড়িতে শ্রীলেখার দীর্ঘ বন্দি জীবনের শুরু।
কী লাভ হল? আচার্য রামদেবের মৃতদেহটি গত চৈত্রের এক মধ্যরাত্রে করতোয়ার দক্ষিণ পাড়ের বানেশ্বর শশ্মানের চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। শ্রীলেখা ক্রুড় হাসে।
কী লাভ হল?
শ্রেষ্ঠী অনন্তর সেই নিরুঙ্কুশ প্রতাপ আর নেই। সে হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে অলাভজনক বাণিজ্যে জড়িয়ে শ্রীহীন হয়ে পড়েছে আজ। শ্রীলেখা ক্রুড় হাসে।
কী লাভ হল?
জয়ন্ত এখন কোথায়?
মধ্য আষাঢ়ের রাত্রিকালীন বাতাসে হরীতকীর পাতাগুলি সরসর করে ওঠে। পাতাগুলি যেন শ্রীলেখার মুক্তির আনন্দে উদবেলিত-একইসঙ্গে জয়ন্তর নিরুদ্দেশে দুঃখকাতর। অদূরে পুস্করিণীর জলে চাঁদের প্রতিফলিত বিভা। পুস্করিণীময় রুপো গলা জল। সেই রুপো গলা জল থেকে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ঝলমলে ঘাটে । ঘাটের ওপাশে ঘুমন্ত জৈন মন্দির। জল সিঁড়ি মন্দির সবই যেন আর্শীবাদ করছে শ্রীলেখাকে।
বাতাসে বকুল ফুলের কড়া গন্ধ। শ্বাস টানে শ্রীলেখা। হরীতকী তলার গাঢ় ছায়ায় ছায়ার মতো মিশে রয়েছে। চোখ- চাঁদের আলোয় ঝলমলে পথের ওপর। কে যেন আসছে। এদিকেই। ভিক্ষু নয় তো। বুকের ভিতরে ক্ষীণ উত্তেজনা টের পায় শ্রীলেখা।
হরীতকী গাছটির একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল সুমন্ত ।
গাছতলায় অন্ধকার। ওখানে কেউ রয়েছে বলে বোঝা যায় না। তা হলে? বুক ধক করে ওঠে। শ্রীলেখা আমায় ঠকালো? তখন তো দেখে ওকে সেরকম মনে হল না।
এই যে আমি এখানে। শ্রীলেখা চাপা স্বরে বলল। তখনই করতোয়ার দিক থেকে বাতাস এল। বাতাসে বকুল ফুলের গন্ধটা গাঢ় হয়ে উঠল। কেন এমন হয়? দ্রুত পায়ে শ্রীলেখার কাছে এসে চীবরটা বাড়িয়ে সুমন্ত বলল, ধরুন। এটা পড়ে নিন।
কী পরব? শ্রীলেখা থতমত খেল।
চীবর।
চীবর কেন? আমি তো ভিক্ষুণী হব না। ইষৎ তীক্ষ্ম হয়ে উঠল শ্রীলেখার কন্ঠস্বর।
সুমন্ত ইষৎ হেসে বলল,ভিক্ষুণী হবেন না ঠিকাছে। ছদ্মবেশ ধারন করবেন না তাই বলে? একা একজন ভিক্ষুর সঙ্গে যাবেন-লোকে কী ভাববে ভেবেছেন।
ওহ্। নিমিষে শ্রীলেখা নরম হয়ে এল। হরীতকী তলার অন্ধকারে পরনের কাপড়টি দ্রুত খুলে ফেলল শ্রীলেখা। তার নগ্ন দেহ ছুঁল মধ্য আষাঢ়ের মাঝরাত্রির শীতল বাতাস। গাছের অন্ধকারে নগ্নতা বিশেষ কিছু না। তবু সুমন্ত খুব কাছে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠল। তার বুদ্ধের সৌম্য মুখটি মনে পড়ে গেল। শ্রীলেখা নির্বিকার। ধীরেসুস্থে চীবর পরে নিল। সুমন্তর ঝুলিতে ক্ষুর ছিল। আরও কাছে এগিয়ে এল। বলল, আসুন।
কেন? শ্রীলেখার গলার স্বর কেঁপে উঠল।
চুল কাটব।
কেন-ওহ্।
শ্রীলেখা আরও এগিয়ে আসে। কুড়ি বছরের ভিক্ষুজীবনে কত সদ্য দীক্ষাপ্রাপ্তর নারীর চুল কেটে দিয়েছে সুমন্ত। ক্ষৌরকর্মে তার বিশেষ দক্ষতা জন্মেছে। শ্রীলেখা চোখ বন্ধ করে আছে। সুমন্ত অভ্যস্ত হাতে ক্ষুর চালালো। খসে পড়া গুচ্ছ গুচ্ছ চুলের জন্য মায়া লাগছিল শ্রীলেখার। জয়ন্তর রক্তাক্ত মুখটি মনে পড়তেই শক্ত হল।
চুল কাটা শেষ হলে ক্ষুরটা ঝুলিতে ভরল সুমন্ত। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল, তখন বলছিলেন যে শ্রাবস্তী যাবেন। সত্যিই কি আপনি শ্রাবস্তীই কি যেতে চান শ্রীলেখা?
আগে এই নগর ছেড়ে চলে যাই চলুন।
বেশ। চলুন তা হলে। বলে ঘুরে দাঁড়াল। করতোয়া পাড়ের শীলা দেবীর ঘাটটি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। ঘাটে অনেক নৌকা থাকার কথা। কাল ভোর ভোর সময়ে ছাড়বে। সুমন্ত শীলা দেবীর ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকে। শ্রীলেখা তার পিছন পিছন হাঁটছে । আমাকে এখন ঠিক কেমন দেখাচ্ছে? হাঁটতে হাঁটতে শ্রীলেখা ভাবল। এখন যদি আমায় আমার বৈদিক পিতা স্বর্গ থেকে আমায় দেখতে পেতেন! শ্রীরামদেব! কী লাভ হল আপনার? আমি তো আজ বেদ বিরোধীদের ঘরেই চলে গেলাম। আপনি আর আপনার সংকীর্ণ সংস্কার আজ পরাজিত হল। মিছিমিছি রক্ত ঝরালেন। ঘৃনার তীব্র উদগার ছড়িয়ে শান্ত হল শ্রীলেখা। আজ আমি চীবর পড়লাম। জয়ন্ত আমায় চিনতে পারবে তো? চীবর পরার পর থেকে শরীরে কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে। আমার মন বলছে: জয়ন্তকে আমি কখনও খুঁজে পাব না। এ জগৎ কত বড়? কেউ হারিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া সাধ্যি কি। আমি যে পথে বেরিয়েছি-এ আমার বৌদ্ধ হওয়ার ছল। অনেক অনেক দিন আগে নবীন কাকার মুখে শ্রীলেখা শুনেছিল: তথাগত বুদ্ধ যখনই কোনও নগরে পৌঁছোন-তখন কোনও না কোনও নারীর সংসার ত্যাগের উপলক্ষ তৈরি হয়ে যায়। নারীটি তারাপর সংসার ত্যাগ করে অহিংসধর্ম গ্রহন করে ধ্যানের নির্বানের শুদ্ধ নির্মল পথ বেছে নেয়।
আমারও কি তাইই হল?
শ্রীলেখা শিউরে উঠল।
মধ্যরাত্রি বলেই পথ নির্জন। নির্জন এবং জ্যোস্নাময় । দু’পাশে শালের গাছ। ঝিঁঝির ডাক বেশ প্রগাঢ়। শালপাতার ওপর শিশির পতনের শব্দও শোনা যায় । এই সেই শালবন। শ্রীলেখার বুক ধক করে ওঠে। শালাবনের ওধারে চন্দ্রদিঘি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে দিঘির রুপালি জল। বুনোহাঁসেরা সেই জলে ভাসত একদা। ভাসত কি? দিঘির ওপাশ থেকে দলবদ্ধ শিয়ালের ডাকও শোনা যায়।
হঠাৎই ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ শোনা গেল।
কী ব্যাপার?
শীলাদেবীর ঘাট থেকে অশ্বারোহী সৈন্যের একটি দল এদিকেই আসছে।
নিমিষেই সুমন্ত শ্রীলেখার হাত ধরে। তারপর চট করে সরে যায় শালগাছের আড়ালে। সৈন্যরা প্রায় কাছে এসে পড়েছে। কী মনে করে সুমন্ত শ্রীলেখাকে জড়িয়ে ধরে। এবং এই প্রথম সে শ্রীলেখার শরীরের কোমলতা ও ওম একই সঙ্গে টের পায়; সে জেগে উঠতে থাকে। শ্রীলেখা মুচকি হাসে।
প্রথম দর্শনেই গতকাল ভিক্ষু ওকে ভালোবেসে ফেলেছিল । তখনই সামান্য স্পর্শ দেবার কথা নিজে থেকেই ভাবছিল। এই মুহূর্তে সুযোগ এল। শালের বনে ঝিঁঝির প্রগাঢ় ডাক, শ্রীলেখার পায়ের নীচে ভিজে ঘাসপাতা, তার ওপরে চুঁইয়ে পরা জ্যোস্নার রোদ, অশ্বক্ষুরধ্বনি, শালপাতার ওপর শিশির পতনের শব্দ আরও স্পস্ট হয়ে উঠেছে । শ্রীলেখাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে সুমন্ত। মুখ নামিয়ে ঠোঁট রাখল জ্যোস্না ঝরা শ্রীলেখার ঠোঁটের ওপর। নাঃ, শ্রীলেখা চোখ বন্ধ করল না। বরং, শালাবনের গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে চোখ রাখল চন্দ্রদিঘির রুপালি জলে। জয়ন্ত ওখানে প্রথম আমার উরুসন্ধিতে জিভ রেখেছিল ... আমি আসছি জয়ন্ত। আমি জানি তুমি কোথায় আছ। আমি তোমার কাছে ঠিকই পৌঁছে যাব দেখো। চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁসেরা আমায় পথ দেখাবে।
অশ্বারোহী সৈন্যদলের ক্ষুরের শব্দ দূরে মিলিয়ে যায়।
শ্রীলেখা সামান্য জোর খাটিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তারপর শালবন থেকে বেরিয়ে এল।
সুমন্তর বুকটা ভীষন ধকধক করছিল। অনেকদিন পর চুম্বন করে খানিকটা বিহবল বোধ করছিল সুমন্ত। মাঝবয়েসি সে। আর, শ্রীলেখার কতই বা বয়েস। তাতে কি? শরীর ও শরীরের ভিতরে রয়েছে যে এক অলীক মনতন্ত্রবীণা-সেটি যে কোনও বয়েসেই ঈশ্বরের কারসাজিতে বেজে উঠতে পারে। আজ সত্যি সত্যি বেজে উঠল। তাতে প্রশ্নও তৈরি হল কিছু। কেননা, তখন বুদ্ধ বলছিলেন, যাহারা অসার বস্তুকে সার বিবেচনা করে এবং সারকে অসার বিচেনা করে, মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা সেই ব্যাক্তি কখনও সার প্রাপ্ত হয় না। প্রেম কি আসলেই অসার? আর ধর্মই কেবল সার?
সুমন্ত এখন জানে, নারীপুরুষের প্রেমই জগতে একমাত্র সত্য বস্তু। সাবিত্রীর মৃত্যুর পর মিছিমিছি অত উদাস হওয়া ঠিক হয়নি। আরেকটি বিবাহ করা উচিত ছিল। তারপর উচিত ছিল দেহের ভোগে গা ভাসিয়ে দেওয়া। গৃহত্যাগ করে কী লাভ হল। কিন্তু, ধর্মের ধ্বজাধারী পুরুষেরা এত প্রেমবিমূহ কেন? বুদ্ধ? প্রেমে সুবিধে হয়নি বলে। সুমন্তর মাঝবয়েসী শরীরটি ছমছম করে ওঠে। তার পরনে এখনও চীবরবেশ। সুযোগ মতন এটি খুলে ফেলতে হবে। বড্ড ভার ভার ঠেকছে।
শ্রীলেখার অনুভূতি অবশ্য ততখানি অবশ নয়। যদিও ভিক্ষু সুমন্ত ওর স্তনদুটি স্পর্শ করেছিল। দীর্ঘদিন বন্দিজীবন যাপন করে ভোঁতা হয়ে উঠেছে শ্রীলেখা। পুরুষস্পর্শ আর উপভোগ্য নয় জেনে শ্রীলেখা বিস্মিত হয়নি।
শালবনের শেষে বাগদি পাড়া শুরু। পথের দুপাশে মাটিলেপা বেড়ার ঘরদোর। দরিদ্র মানুষের ঘরদোর। পাড়াটি ঘুমন্ত। এত রাতে কে আর জেগে। কেবল শিশুর কান্না শোনা যায়। শুকনো মাছের গন্ধ পেল শ্রীলেখা। বেড়ার ফাঁকে কূপীর মিটিমিটি আলো। এক বৃদ্ধ বাগদি কাশছে। তার কী অসুখ কে জানে।
দ্রুত পায়ে হেঁটে বাগদি পাড়াটি পেরিয়ে যায় ওরা।
পথের দুপাশে এখন সুপারি গাছের ঘন সারি । পথের ওপর ঘন হয়ে দুজনের ছায়া পড়েছে। বাতাসে শিশির ভেজা পাতা ও বাকলের কড়া গন্ধ । অনেকক্ষণ ধরে হাঁটছিল বলে পায়ের গোড়ালি হাঁটু উরু ব্যথা করছিল শ্রীলেখার। জন্মাবধি এতটা হাঁটেনি শ্রীলেখা। এখন তো অনেকটাই পথ হাঁটতে হবে। মানুষ রচিত সংকীর্ণ সংসার থেকে বহূদূরে সরে যেতে হবে। যন্ত্রণা হবে ওর। এই যন্ত্রণা টের পাওয়ার জন্যই ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন? হাড়ি-বাগদিদের কষ্টে রেখেছেন। জয়ন্ত তো হাড়ি বলেই ওকে কালীদহের বিলের ধারে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল। লাশটা বিলের জলে ফেলে দিয়েছিল ওরা। তারপর হাড়িপাড়ায় আগুন দিয়েছিল। জানালা দিয়ে আগুনের লাল আভা শ্রীলেখার চোখে পড়ছিল সে রাতে, যে রাতের পর কেউই আর জয়ন্তকে পুন্ড্রনগরে দেখেনি। হাড়িপাড়া থেকে চীৎকার ভেসে আসছিল। শ্রীলেখা আজও শুনতে পায়। ও শিউরে ওঠে। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি। আমি জয়ন্ত কে হত্যা করেছি ...
মধ্য আষাঢ়ের গাঢ় জ্যোস্নায় পথের দুপাশের সুপারি পাতাগুলি উতল বাতাসে কেমন সরসর করে ওঠে। ক্ষাণিকবাদে বাতাসের গন্ধ বদলে গেল। হাঁটতে হাঁটতে ওরা প্রায় শীলাদেবীর ঘাটের কাছে পৌঁছে গেল। এখন মধ্য রাতও পেরিয়ে গেছে। পূর্ণিমার চাঁদটাও আর আকাশের মাঝখানে নেই। তবে এখনও সমানে তরল রুপা ঢেলে চলেছে।
ওরা ঘাটের চাতালের ওপর এসে দাঁড়াল।
এমন নির্জন ঘাট। এমনকী প্রহরী সৈন্যরাও জেগে নেই বলে মনে হয়। উথালপাথাল হাওয়া। নোনা গন্ধ। করতোয়ার জলে তরল রুপা। ঢেউ। ঘাটে অনেকগুলি ছোটবড় নৌকা। অবশ্য নিথর নয়। ঢেউয়ের দোলায় অল্প অল্প করে দুলছে। এখন মধ্যরাত বলে আগুনের ফুটকি চোখে পড়ল না। ছইওয়ালা বড়নৌকাগুলির পাল গোটানো। নদীর ওপারে ক্ষীণ আভাস। চর। ওই পেরিয়ে আবার করোতোয়া নদী । তারপর ডাঙা। বহুকাল আগে শ্রীলেখাকে জয়ন্ত বলেছিল, করতোয়া পেরিয়ে ডাঙার ওপর ক্রোশ ক্রোশ পথ হাঁটলে যমুনা নামে একটি নদীর কাছে যাওয়া যায়।
সেই কথা মনে করে শ্রীলেখা এখন কেঁপে উঠল।
সমস্ত দৃশ্যটা পূর্ণিমার আলোয় কেমন এক ধূসর স্বপ্নের মতো মনে হয় সুমন্তর। সে ফিসফিস করে বলল, কাল ভোরে নৌকায় উঠব। চল, এখন বসি কোথাও।
চুমু খেয়েছে তো। এখন তো ‘তুমি’, ‘তুমি’ করেই বলবে। শ্রীলেখা মনে মনে ভাবল। চলুন। শ্রীলেখা বলল। লোকটার জন্যও কী রকম খারাপ লাগছে । কোথ্ থেকে এসে একটা গল্পে ঢুকে পড়েছে। ইস্, লোকটা যদি বুনোহাঁসদের কথা জানত!
বাঁ দিকে কয়েক পা হেঁটে ঘাটের ওপর বসল সুমন্ত। ইটের ওপর তার স্পস্ট ছায়া-শ্রীলেখারও। সুমন্তর পাশে, অল্প দূরত্ব রেখে বসল শ্রীলেখা। তখন শালবনের অন্ধকারের ভিতর সৈন্যদের সামনে পড়ে যাওয়ার আতঙ্কে আলিঙ্গন-চুম্বন হল বটে; কিন্তু, এখন প্রকাশ্য জ্যোস্নালোক; এখন এই মাঝবয়েসী ভিক্ষুটি ওর হাত ধরলে সঙ্কোচ বোধ করবেই শ্রীলেখা।
ওরা যেখানে বসেছে-তার ঠিক দুধাপ নীচে একটি কুকুর শুয়ে ছিল। রাত শেষের চাঁদের আলোয় ওটার গায়ের রংটা ঠিক বোঝা গেল না। ওরা বসামাত্র কান খাড়া করল কুকুরটি। শ্রীলেখাকে দেখে নিশ্চিত হয়েই আবার থাবায় মুখ লুকালো। কুকুরটির পাশে কে যেন কাথা মুড়ে শুয়ে। বৃদ্ধা বলে মনে হল। শ্রীলেখা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এ জগতে নির্বাচিত কয়েকজন মানুষকে প্রেমের উপলদ্ধি দিতে কত কত প্রাণকে যে দুঃখকষ্টে রেখেছে ঈশ্বর। মলিন হাসে শ্রীলেখা। ওর হাতে একটা ছোট পোটলা । ওটা খুলে বলল, নেন, খান।
কী।
তেমন কিছু না-গুড়ের সন্দেশ।
ওহ্। দাও।
জয়ন্তর পাশে কত কত রাত যে শীলাদেবীর নির্জন ঘাটে বসে থেকেছে শ্রীলেখা। জয়ন্ত খুব গুড়ের সন্দেশ পছন্দ করত। ওর জন্য গুড়ের সন্দেশ তৈরি করতে শিখেছিল মনো মাসির কাছে। সেসব কথা মনে করে শ্রীলেখা বলল, কাল খানিক দইও পেতেছিলাম। কিন্তু, আনি কী করে।
কেন? বাড়িতে কি করঙ্গ ছিল না? সন্দেশে কামড় দিয়ে সুমন্ত বলল। বাহ্, বেশ স্বাদ তো।
করঙ্গ? করঙ্গ কি? শ্রীলেখা তো অবাক।
করঙ্গ চেনেন না মেয়ে?
না তো।
সুমন্তর পুরোন খোলশটি আজ একেবারেই খসে গিয়েছিল। এককালে সে যে গান গাইত সেকথা মনে পড়ে গেল তার। সে সন্দেশটা খেয়ে শেষ করে দীর্ঘদিন আগে শোনা পদ্মাপাড়েরর একটি লোকায়ত গান ধরল।
একটি নারকেলের মালা,
তাতে জল তোলা ফেলা- করঙ্গ সে।
পাগলের সঙ্গে যাবি পাগল হবি বুঝবি শেষে।
ওমাঃ, আপনি গানও জানেন? শ্রীলেখা কেমন উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
সুমন্তর কন্ঠস্বরে কে যেন ভর করে বলল: পুন্ড্রবঙ্গে যে জন্মেছে -সে অল্পবিস্তর গান জানে না, তা কি করে হয় গো মেয়ে? এ ভারি গানের দেশ। গানে ঝরে দুঃখ, প্রশ্ন ও সন্দেহ।
তা ঠিক। শ্রীলেখা বলল। মনে মনে ভাবল, কী সুন্দর গান করত জয়ন্ত। এমন মানুষকে কেউ পিটিয়ে মারে।
সুমন্তর মধুমেহ। তারপরও সে পরপর দুটি সন্দেশ খেয়ে শেষ করল। আহ্, চমৎকার স্বাদ। মনে মনে বলল, এই জীবন। কী লক্ষ্য তার?
কে যেন করতোয়ার বাতাসে ভেসে এসে উত্তর দিল, পথে যেতে যেতে একটা আলোর মুখে দাঁড়িয়ে যাওয়ার জন্য।
আর?
আর কী।
ঐ কুকুরেরও?
হ্যাঁ। তুমি কি নিশ্চিত যে সে কেবলই কুকুর, ওটি আকাশ পথ থেকে নেমে আসেনি?
সুমন্ত বিভ্রান্ত বোধ করে। একা হলেই কে যেন কথা কয়ে ওঠে তার ভিতরে। কে সে? কে?
শ্রীলেখা মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালো। এক ঝাঁক বুনোহাঁস উড়ে যাচ্ছে পূর্ণিমার আকাশে। সেই চন্দ্রদিঘির বুনোহাঁসগুলো নয় তো ? চন্দ্রদিঘির কালো জলে সন্তরণশীল বুনোহাঁসেরা জয়ন্তর গান শুনে পাড়ে উঠে এসে ওদের খুঁজত।
শ্রীলেখা জিজ্ঞেস করল, নৌকাগুলি কোথায় যায় জানেন?
সুমন্ত বলল, কত জায়গায় যে যায়।
শ্রীলেখা কী মনে করে বলল, আমি আমার স্বামীর মুখে গঙ্গাহৃদয় রাজ্যের কথা শুনেছি। বিদ্যাধরী নদীর ধারে।
হ্যাঁ। চন্দ্রকেতু গড়। সুমন্ত বলল।
আপনি গেছেন?
হু।
আমরা কি সেখানে যেতে পারি?
পারি।
শ্রীলেখা বলল, আচ্ছা, আপনি কি কখনও লঙ্কা দ্বীপে গিয়েছেন?
হু।
আমরা যদি লঙ্কা দ্বীপে চলে যাই তো?
যাওয়া যায়। লঙ্কাদ্বীপের রাজধানী অনুরাধপুর। বেশ চমৎকার নগর। আরাভি আরু নদীর পাড়ে।
কী? কী নদী বললেন?
আরাভি আরু।
আরাভি আরু?
হ্যাঁ।
শ্রীলেখার কী খিলখিল হাসি। শীলাদেবীর ঘাটের নির্জনতা খান খান করে দিল। সুমন্ত অবাক হয়ে যায়। যেন স্বপ্ন দেখছে সে। তখন বুদ্ধ বলছিলেন, যাহারা, অসার বস্তুকে সার বিবেচনা করে এবং সারকে অসার বিচেনা করে, মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা সেই ব্যাক্তি কখনও সার প্রাপ্ত হয় না। আমি কি মিথ্যাদৃষ্টির প্রশ্রয়দাতা? কে জানে। শ্রীলেখার হাত ধরল সুমন্ত। শ্রীলেখা কেঁপে উঠল কি? সুমন্ত নরম স্বরে জিগ্যেস করল, তুমি লঙ্কাদ্বীপ যেতে চাও শ্রীলেখা?
হ্যাঁ।
তাই যাই চল।
ঠিক আছে চলেন। সেখানে কি জয়ন্ত আছে? কে জানে।
সুমন্ত শ্রীলেখার হাতটা ধরেই আছে। কন্ঠে আবেগ এনে বলল, আমার বউয়ের নাম ছিল সাবিত্রী। বেশিদিন বাঁচেনি সাবিত্রী। শ্রীলেখা, তোমার সঙ্গে সাবিত্রীর মুখোশ্রীর এত মিল! এসবই করুণাময় ঈশ্বরের খেলা নয় নি? নইলে আমিই বা কে পুন্ড্রনগরে আসব। তোমার সঙ্গে আমারই বা দেখা হয়ে যাবে কেন।
এসব শুনছিল না শ্রীলেখা। ও বরং আলত করে সুমন্তর হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্যোস্নাবিধৌত করতোয়া নদিটির দিকে তাকালো। নদীটির ওপারেই রুপহাটি। তার উত্তরে বিস্তির্ণ আখের ক্ষেত। চৌদ্দ বছর তিন মাস বয়েসে শ্রীলেখা প্রথম জয়ন্তকে দেখেছিল বৈশাখ মাসের প্রথম দিনের রৌদ্রমূখর অপরাহ্নে রুপহাটির মেলায় । রসিক ময়রার মিস্টান্নর আপণের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল জয়ন্ত। শ্রীলেখা তো ওকে দেখে থ। বুকে ঝড়। সে ঝড় বাহিরের প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল কি? নইলে আচমকা ঝড় উঠবেই বা কেন। ঘূর্ণি বাতাসে কে কোথায় যে ছিটকে গেল। মুহূর্তেই সমস্ত মেলা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। রুপহাটির উত্তরে যে বিস্তীর্ণ আখক্ষেত আছে-সেখানেই জয়ন্তর বুকে শ্রীলেখা নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল। সন্ধ্যে অবধি।
তারপর নিত্য দেখা হত জয়ন্তর সঙ্গে।
তারপর?
তারপর কথায় কথায় কখন যে ভোর হয়ে গিয়েছিল। পুন্ড্রনগরে একটি নতুন ভোরের জন্ম হয়েছিল। পূর্বাকাশের সূর্যদেবের রক্তিম রঙে ক্রমশ রাঙিয়ে উঠেছিল করতোয়ার জল। বাতাস হয়ে উঠেছিল সত্যিকারের ভোরের বাতাস। শীলা দেবীর ঘাটের ওপর শুয়ে থাকা সেই কুকুরটির ঘুমও ভেঙে গিয়েছিল। যাত্রীর পদশব্দে ওটি সম্ভবত ঘুম থেকে জেগেই লাফিয়ে কয়েকটা ধাপ ডিঙিয়ে শ্রীলেখাদের চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
দক্ষিণ অভিমুখী নৌকা ছাড়বে।
শ্রীলেখা ও সুমন্ত উঠে দাঁড়িয়েছিল। তারপর সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে গিয়েছিল। কে জানে। কবেকার কথা। শ্রীলেখা সম্ভবত করতোয়ার জলের অনেকটা কাছে পৌঁছে জলের আষঁটে গন্ধ পেয়েছিল। জলের মৃদু ছলাত শব্দও শুনেছিল বোধ হয়। ঘাটে তো পাশাপাশি অনেক নৌকা থাকার কথা। দু-একজন ব্যস্ত যাত্রী। কিছু পণ্য উঠছিল। এই ধরা যাক আখ, সুপারি, গুড়ের হাঁড়ি। ওরা একটি নৌকায় উঠেছিল। বেশ বড়সড় নৌকা। ছইয়ের ওপর অনেকখানি জায়গা। সিঁড়ি বেয়ে ছইয়ের ওপর উঠেছিল ওরা? তখন দূরন্ত বাতাস ওদের ঠেলে ফেলে দিচ্ছিল প্রায়? পাল তুলছিল মাঝিমাল্লারা? ভালো করে রোদ ওঠার আগেই গলুই ঘুরে গিয়েছিল।
শ্রীলেখারা ছইয়ের ওপরই বসল। শ্রীলেখা সম্ভবত শীলাদেবীর ঘাটের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেননা, মধ্য-আষাঢ়ি বাতাসের তোড়ে পালের বুকে টান খাওয়ায় ওর চোখের সামনে থেকে শীলাদেবীর ঘাট ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছিল। এই ঘাটে আর ফেরা হবে না। কবে যেন জয়ন্তর পাশে নির্জন মাঝরাতে ঘাটের পৈঠায় বসে থাকতাম। সে কবেকার কথা বলে মনে হয। লঙ্কা দ্বীপ কেমন? আমি জয়ন্তকে খুঁজব। কেন যেন মনে হয় অভিমানী জয়ন্ত লঙ্কা দ্বীপে লুকিয়ে আছে। জয়ন্ত কি সত্যিই লঙ্কাদ্বীপে রয়েছে? ও আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়। ভোরের শুভ্র আকাশে এক ঝাঁক বুনো হাঁসের সারি। দক্ষিণমুখি উড়ে চলেছে। শ্রীলেখা হাসল। ওরাই যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। জয়ন্ত যেখানে আছে সেখানে। আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে নেয় শ্রীলেখা। ভিক্ষু সুমন্তর দিকে তাকালো। লোকটাকে কেমন ক্লান্ত দেখাচ্ছে। ছইয়ের এককোণে বড় একটি মাটির ধামা। ধামার ভিতরে কি আছে কে জানে। তারই আড়ালে ঘুমোবার আয়োজন করছে লোকটা। করুক। বয়েস হয়েছে তো। তা ছাড়া কাল সারারাত জেগেছে। এই বয়েসে এত সয়। তা ছাড়া এই গল্পের পরের অধ্যায়ে তার তো তেমন কোনও ভূমিকাই নেই। ঘুমাক, লোকটা ঘুমাক।
শ্রীলেখা শুধু জেগে থাকুক বুনোহাঁসেদের উড়াল পথ চেয়ে।
(সমাপ্ত)