আকাশ উর্বশী একা
 

বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়
 


ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে বসে চুলে হাল্কা ব্রাশ চালাতে চালাতে আয়নার ভেতর দিয়েই অজয়কে লক্ষ্য করছিল কৃষ্ণা। খাটের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে সিগ্রেট খেতে খেতে অজয়ও মাঝে মাঝে কৃষ্ণাকে দেখছিল। দশবছর আগের পাতলা ছিপছিপে অতি সাধারণ কৃষ্ণাকে এখন আর এই শরীরে খুঁজে পাওয়া যায় না। খুব বেশি মোটা না হলেও ফিগার স্ট্যাটিস্টিকস অনেকটাই বদলিয়ে গেছে কোমরের ওপর এবং নিচের অংশে। আগের তুলনায় কিছুটা ভারি হলেও গ্ল্যামার বেড়েছে বহুগুণ।
বিয়ের পর দশটা বছর কম সময় নয়। প্রেম করে বিয়ে হয়নি বলে দশবছরই সঠিক সম্পর্কের বয়স। প্রথম দু'তিন বছর বলতে গেলে চোখের পলকে কেটে গেছে। তিন বছরের মাথায় প্রথম বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে কৃষ্ণা নিজেই মরণাপন্ন হয়ে উঠেছিল। অনেক কষ্টে ওকে বাঁচানো গেলেও বাচ্চাটিকে বাঁচানো যায়নি। এরপর আর ঝুঁকি নেয়নি কৃষ্ণা। অনেক বুঝিয়ে ডাক্তারের ভরসাতেও দ্বিতীয়বারের জন্যে আর মা হতে চায়নি। বলতে গেলে ঐ সময়ের পর থেকেই কৃষ্ণাকে নিয়ে সংসারে সমস্যার সূত্রপাত।
মা-বাপের এক ছেলে অজয়। সুতরাং তার আর সন্তান হবে না এমন অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত ওঁরা মেনে নিতে পারেননি। ফলে ছোটখাটো সামন্য ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই এক একদিন তুমুল অশান্তি হয়ে যেত। ছেলের বউয়ের উদ্ধত আচরণে অপমানিত বোধ করতেন মা-বাবা। পরিস্থিতি ক্রমশ:ই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে চলে যাচ্ছে এটা অজয় টের পাচ্ছিল। এর মধ্যে একটা অ্যাড-এজেন্সিতে কৃষ্ণার চাকরি পেয়ে যাওয়াটা অশান্তির মাত্রাকে বাড়িয়ে দিল। কৃষ্ণার ডিউটি-আওয়ার্স বাড়তে বাড়তে এতটাই বেড়ে গেল যে মাঝে মধ্যেই তার বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাচ্ছিল। অজুহাত হিসেবে কৃষ্ণা কোম্পানির পার্টির কথা বলে অভিযোগ উড়িয়ে দিত।
ব্যাপারটা চরমে পৌঁছুল সেদিন যেদিন মেয়েদের একটা পাক্ষিক পত্রিকায় স্বল্প পোশাকে লাস্যময়ী কৃষ্ণার বিভিন্ন পোজে বেশ কয়েকটা রঙিন ছবি ছাপা হলো।
আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই, যারা বিশেষ খোঁজ খবর নিত না, তারা উপযাচক হয়ে কৃষ্ণার 'কৃতিত্বের' জন্যে অভিনন্দন জানাতে লাগলো। যদিও কৃষ্ণা র চাকরি নিয়ে অজয়ের বিশেষ আপত্তি ছিল না। কিন্তু কাজের চরিত্র এবং ধরণ নিয়ে অজয়ের মনেও অশান্তি ঢুকে গিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে সংসারে শান্তির অভাব দিন দিন তীব্রতর হচ্ছিল। একদিকে সংসারে নিত্য নতুন অমান্তি অন্যদিকে মডেল হিসেবে কৃষ্ণার ডিম্যাণ্ড বেড়ে যাওয়া--এর মধ্যেই একদিন খাবার টেবিলে বসে সকলেরই চোখ যখন টিভি স্ক্রিনে তখন একটা কমার্শিয়াল ব্রেকে হঠাৎই অন্তর্বাসের চটুল বিজ্ঞাপনে দেখা গেল কৃষ্ণাকে। অত্যন্ত দু:সাহসিক এই অ্যাড-ক্লীপিংস দেখে স্তম্ভিত অজয়ের অধ্যাপক বাবা নি:শব্দে খাবার ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। অজয় মায়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না। কৃষ্ণা ভেবেছিল তার পারফরমেন্সে অজয় খুশি হবে। কিন্তু কোথাও বিন্দুমাত্র খুশির ছোঁয়া ছিল না।
অজয়ের মা কঠিন মুখে অজয়কে বললেন--
--ঠিক একমাসের মধ্যেই তোমরা আলাদা ফ্ল্যাটে চলে যাবে। এ বাড়ি আমার নামে তোমার বাবা অনেক কষ্টে বানিয়েছেন। এ বাড়িতে এসব সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
--কিন্তু মা, এত তাড়াতাড়ি--
--আমি কোনো অজুহাত শুনতে চাই না বাবা! আমরা সেকেলে অশিক্ষিত গ্রাম্য মানুষ। এত সাংঘাতিক আধুনিকতা সহ্য করতে না পেরে তোমার বাবার হার্ট-অ্যাটাক হোক তুমি নিশ্চয়ই তা চাইবে না--
--চিন্তা করতে হবে না। এক মাসের মধ্যেই আমরা চলে যাচ্ছি। ইনফ্যাক্ট--উইদিন আ উইক আমরা শিফট্ করছি।
অন্তর্বাসের বিজ্ঞাপন শেষ হতেই বাঁ হাতে রিমোটের স্যুইচ অফ করে টিভি বন্ধ করে দিল কৃষ্ণা।
--এক সপ্তাহের মধ্যে শিফট্ করছো মানে? আমি তো এখনো ফ্ল্যাটের কথা ভাবিই নি!
বিমূঢ় অজয় পুরোপুরি ঘুরে তাকালো কৃষ্ণার দিকে। কৃষ্ণা বলল--
--তিন-চার মাস আগে থেকেই আমি ফ্ল্যাটের সন্ধানে ছিলাম। কারণ আমি জানতাম অ্যাডফিল্মে কাজ করাটা এঁরা মেনে নেবেন না। তাই অরিজিৎ সল্ট লেকে একটা দারুণ ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করছে।
--অরিজিৎ মানে তোমার সেই আঁতেল বস্?
--হ্যাঁ।
--আমাকে তো কিছুই বলো নি!
--বললে আরো কিছু সময় তুমি নষ্ট করে দিতে।
অজয় আর কৃষ্ণার কথোপকথনের মাঝখানেই অজয়ের মা-ও নি:শব্দে উঠে গেলেন।
--এই অ্যাড-ফিল্মের ব্যাপারেও তো কিছু বলো নি।
--তুমি কি বলতে চাও, জানানোর ছলে তোমার পারমিশনের প্রয়োজন ছিল?
--নট এক্স্যাটলি--তবে--
-আরো কত অ্যাড টিভিতে দেখতে পাবে। সাবান, কণ্ডোম, হেয়ার-রিমুভার, বডিলোশন, ন্যাপকিন। ওযান আফটার অ্যানাদার! প্রচুর কনট্যাক্ট রয়েছে আমার হাতে--
--এসব কাজের কি সত্যিই প্রয়োজন ছিল খুব?
--কেন নয়? যে কাজের যে ধরণ! তাছাড়া এসব কাজ খারাপ বলে ভাবছো কেন? হাইফাই ঘরের কনভেন্টে পড়া চাবুকের মতো ছেলেমেয়েরাই এখন কাজে ছুটে আসছে। জামা-কাপড়ের লেংথ নিয়ে ওদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই
--কিন্তু তুমি টিন-এজার ছেলেমেয়েদের একজন নও। তাছাড়া আমাদের ফ্যামেলি স্ট্যাটাস--মানসম্মান বলেও তো একটা কথা আছে--
--পেতি মিডল্ ক্লাস সেন্টিমেন্টস! তোমাদের ঐ স্ট্যাটাসের কোনো মূল্যই নেই এখন। স্ট্রাটাস কাকে বলে--সেলিব্রেটি কাকে বলে এবারে টের পাবে--
--অল্ রাবিশ!
বলে সেদিন যারপরনাই ক্ষুব্ধ হয়ে অজয়ও টেবিল ছেড়ে ইঠে গিয়েছিল।

বাড়ি ছেড়ে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে উঠে আসার দিন ঘরের ভেতর দরজা-জানলা বন্ধ করে বসেছিলেন মা-বাবা দু'জনেই। রাস্তায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভেতরে পটাপট শেকড় ছিঁড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল অজয়।
মাঝে মাঝে দু'এক ঘন্টার জন্য অজয় একলাই মা-বাবার কাছে আসে। বিশেষ কোনো কথা হয় না। মা-বাবা কেউই আবেগ প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিতে চান না। তবু মা ওকে কখনো এক বাটি পায়েস কিংবা পছন্দের দু'একটা রান্না খাইয়ে দেন। অজয়ের রক্তচাপ তখন হু হু করে নেমে যেতে চায়। মাথা ঝিম-ঝিম করে। পা দুটো ভারি বোধ হয়। গোটা বাড়ি কেমন যেন অসহ্য এক শূন্যতায় তলিয়ে গেছে। মা-বাবার চোখের দৃষ্টিতে অজয়ের বিরুদ্ধে একরাশ নীরব অভিযোগ যেন বাঙ্ময় হয়ে ওঠেঅ অজয় বেশিক্ষণ থাকতে পারে না।
এভাবেই চলতে চলতে একদিন অজয় স্পষ্ট বুঝতে পারে কৃষ্ণা এখন যতটা তার, তার চেয়ে অনেক বেশি অরিজিতের। চারপাশে বেশ রসালো কানাকানিও হচ্ছে। পত্র-পত্রিকায় অরিজিতের সঙ্গে কৃষ্ণার ঘনিষ্ঠ ছবিসহ মুখরোচক গুঞ্জনও পরিবেশিত হচ্ছে আজকাল।
ইদানীং অজয়ের প্রতিমুহূর্তেই মনে হয় এই জীবনের কাছে বিশেষ করে কৃষ্ণার কাছে ওর আর কিছু পাওয়ার নেই। অজয় তাই চায় এইভাবে দু'নৌকায় পা না রেখে কৃষ্ণা একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিক। অনেকদিন ধরে বলবে বলবে করেও সে কথাটা স্পষ্ট করে বলার সুযোগ হচ্ছিল না। আজ কৃষ্ণা সকাল সকাল বাড়ি ফেরায় অজয় সেই কথাটাই বললো কৃষ্ণাকে—
--অরিজিতের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক নিয়ে চারদিকে যে সব কথাবার্তা চলছে সে ব্যাপারে তুমি কিছু ভাবছো?
আয়নার ভেতর দিয়েই অজয়ের চোখে চোখ রাখলো কৃষ্ণা। ব্রাশটা ড্রেসিং টেবিলের ওপর রেখে বিদেশি বডিলোশনের শিশিটা হাতে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো--
--অরিজিতের ব্যাপারে কি তুমি জেলাস ফীল করছো?
--না, ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক উল্টো। আমাকেই অরিজিত হিংসে করে বলে সে তোমাকে গ্রাস করতে চাইছে।
--ছি:, কী ভাষা! গ্রাস মানে কি?
--মানে বুঝতে তোমার এক সেকেণ্ডও দেরি হয়নি। ওর চেয়ে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট টার্ম আর হয় না। যাই হোক, আমার মনে হচ্ছে আমাদের পরস্পরের কাছে আর কিছু প্রত্যাশা নেই--
--তোমার প্রত্যাশা মানে তো একটা বেবি। আমার জীবনের বিনিময়ে তুমি যা চাও--
--সন্তানের প্রত্যাশাটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সাইকোলজিক্যালি তুমি এ ব্যাপারে হ্যাণ্ডিক্যপড্ হয়ে গেছে। কাজেই--
--কি বললে তুমি!
অজয়ের দিকে পুরোপুরি ঘুরে বসলো কৃষ্ণা। গোটা মুখে এবং গলা থেকে অনেক নীচে পর্যন্ত বডিলোশন লাগানোর ফলে ঐসব জায়গা থেকে আলো পিছলে পড়ছে। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকে শারীরিক সম্পর্কের মধ্যেও দূরত্ব কমতে কমতে এখন আর কোনো সম্পর্কই নেই বলতে গেলে। এক বিছানায় শুলেও মাঝখানে কখন যে অরিজিতের অদৃশ্য উপস্থিতি ব্যবধান গড়ে দেয় অজয় বুঝতেই পারে না। তখনই টের পায় জৈব চাহিদাকে গলাটিপে নিস্তেজ করার ক্ষমতা শরীরের নয়--মনের। এই মন-ই অজয়কে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বলে চলেছে, এভাবে চলতে পারে না। চলা উচিত নয়। অজয় কৃষ্ণার প্রশ্নকে এড়িয়ে গিয়ে জানতে চাইলো--
--তুমি কি অরিজিতের সঙ্গে থাকতে চাও?
--এখনো ফাইন্যাল কিছু ভাবিনি। অরিজিতের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
--অর্থাৎ অরিজিৎ চাইলে তুমি চলে যাবে--
--না! আমি এই ফ্ল্যাট ছাড়ছি না। অরিজিৎ এই ফ্ল্যাটে আসবে আর তুমি চলে যাবে। অবশ্যই তোমার যা কিছু আছে--
--কিছু বইপত্র ছাড়া আমার আর কিছু নেই এই ফ্ল্যাটে। চারপাশে যা কিছু রয়েছে সবই তোমার নিজের হাতে সাজানো তোমারই জিনিসপত্র।
শেষ হয়ে যাওয়া সিগ্রেটটা ফেলে অজয় দু'এক সেকেণ্ড চুপচাপ থাকার পর বললো--
--আমি চাই সহমতের ভিত্তিতে ডিভোর্স হয়ে যাক। কেউ কাউকে দোষারোপ না করে--
--দোষারোপ করলেও অবশ্য আমার কিছু যায় আসে না--
--কিন্তু আমার যায় আসে। তুমি তাহলে কালই একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করে নিও তুমি কি চাও--
--কি চাই মানে? খোরপোষ?
--প্রধানত: তাই--
--তুমি এতবছর কলেজে ছেলে পড়িয়ে যা রোজগার করেছ, আমি গত দু'তিন বছরে তার তিনগুণেরও বেশি রোজগার করেছি। আরো করবো। কত খোরপোষ তুমি আমাকে দিতে পারবে? এই ফ্ল্যাটের ভাড়া, আমার ড্রাইভারের মাইনে, আমার কসমেটিক্সের খরচ--পারবে?
--এসব তোমার তালিকা-নির্ভর বিষয় নয়। আমার ক্ষমতার বিচারে কোর্ট যা বলবে--
--চিন্তা কোরো না। আমি খোরপোষ চাইবো না। আমি জানি একজন পেতি মিডল্ ক্লাস মেন্টলিটির লোক সংসার-বউ ছাড়া চলতে পারে না। তুমি আবার টোপর মাথায় দেবে ফর আ বেবি! তাই না?
--এখনই অতদূর কিছু ভাবিনি। ভাবলে এ নিয়ে তোমার সঙ্গে তো কোনো আলোচনা হতে পারে না।
--এনিওয়ে, কাগজপত্র রেডি করো, আমি সই করে দেবো।
--রেডিই আছে। তাহলে কাল সকালেই--
--ও! তুমিও তো দেখছি চূড়ান্তভাবেই তৈরি হয়েই আছো!
--খুবই স্বাভাবিক নয় কি?
--ঠিক আছে। আইনের কচকচি আমি বুঝি না। পেপারগুলো বরং অরিজিতকে দেখিয়ে নিয়েই সই করে দেবো।
--বেশ তো!
অজয় দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। কৃষ্ণার জীবন যাপনের স্টাইল অজয়ের পছন্দ ছিল না। নিজের অপছন্দ নানাভাবে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। কৃষ্ণা পাত্তা দেয়নি। আসলে অ্যাড-এজেন্সির চাকরিটা ওর সামনে এমন একটা জগতের দরজা খুলে দিয়েছিল যেখানে একবার ঢুকে পড়লে শুধু ছুটতেই হয়। থামার কথা ভাবাও যায় না। কৃষ্ণাও থামেনি। দিনদিন প্রতিদিন দু'জনের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিস্তর। তবু দশ বছরের বেশি একটা সময় একসঙ্গে কাটাবার পরও অজয় সত্যি সত্যি ভাবেনি একদিন ওদের মধ্যে কোনো সম্পর্কই থাকবে না।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর স্টুডিওর ভেতরই অরিজিতকে পেল কৃষ্ণা। একটা সতের-আঠারো বছরের মেয়ের ছবি তোলায় তদারকি করছিল অরিজিৎ। চারপাশে উজ্জ্বল আলো। ক্যামেরা। বাজারে একটা নতুন সাবান আসতে চলেছে। এক বিখ্যাত কর্পোরেট কোম্পানির প্রোডাক্ট। কোম্পানির নামেই প্রোডাক্ট বাজার পেয়ে যায়। তবু কোনো ঝুঁকি এরা নেয় না। দশ-বিশ লাখের এক-দেড় মিনিটের অ্যাডফিল্মের জন্যে এরা ইদানীং অরিজিতের ওপর চোখ বুঁজে নির্ভর করে।
স্যুইমিং কস্টিউম পরানো হয়েছে বে-ওয়াচের পামেলা এণ্ডারসনের মতোই। বিন্দুমাত্র জড়তা নেই মেয়েটার মধ্যে। বলতে গেলে বাচ্চা মেয়ে। অথচ ফিগারটা দুর্দান্ত রকমের কমার্শিয়াল।
বেশ কিছুটা দূরে চেয়ারে বসে ক্যামেরাম্যানকে অরিজিৎ ওর চাহিদাটা মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছে। ছবিগুলোর প্রিন্ট আজই ম্যানেজমেন্টকে পাঠাতে হবে। যদিও অরিজিৎ জানে ওর স্ক্রীপ্টের সঙ্গে এই মেয়েটার দুর্দান্ত ছবি দেখে কোম্পানি স্পেলবাউণ্ড হয়ে যাবে। তবু স্রেফ ক্যামেরাম্যানের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না।
অরিজিতের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে কৃষ্ণা জিজ্ঞেস করলো--
--কে মেয়েট? আগে তো দেখিনি?
--ইনা। একেবারে ফ্রেশ টিন-এজার। কমার্শিয়াল ডায়মণ্ড। ওর মাকেও তুমি চেনো। ফিল্ম অ্যাকট্রেস। উনি যদি পামেলা এণ্ডারসনের মতো স্যুইমিং কস্টিউমে তোমার সামনে হাজির হন তুমি অজ্ঞান হয়ে যাবে। মহিলার এখনো সেই গ্ল্যামার রয়েছে--
অরিজিতের এই উচ্ছ্বাস ভালো লাগলো না কৃষ্ণার। বললো--
--জানো, অজয় ডিভোর্স প্রোপোজ করেছে। আমিও চাই ডিভোর্সটা তাড়াতাড়ি হয়ে যাক। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। তুমি কি বলো?
--আমি! তোমাদের দু'জনের ডিভোর্সের মাঝখানে আমার কি বলার আছে?
ইনার পোজগুলো হাত তুলে অ্যাপ্রিসিয়েট করতে করতেই কথাগুলো বললো অরিজিৎ।
--তার মানে? তোমার কিছুই বলার নেই?
--তোমরা ডিভোর্স চাইছো। কারুরই কোনো আপত্তি নেই। তাহলে সমস্যাটা কি?
--সমস্যার কথা হচ্ছে না। তবে ডিভোর্সের পরেই আমাদের বিয়েটা তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার অরিজিৎ।
--ওয়েট আ মিনিট! আমাদের বিয়ে মানে?
--আমাদের মানে তুমি আর আমি--
--হাউ ফানি! আমি তোমাকে বিয়ে করবো এমন প্রতিজ্ঞা আমি কখন করেছি?
--কিন্তু অরিজিৎ--
--লুক কৃষ্ণা! আমার এই প্রায় ছ'ফুট দীর্ঘ ফর্সা হ্যণ্ডসাম চেহারা--এই কাঁচা-পাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি--ডানহাতের কব্জিতে এই সোনার চেন--এই জীন্সের প্যান্ট-পিটারপ্যান শার্ট--ফ্রেঞ্চ পারফিউম--এমন কী আমার এই হেয়ার স্টাইল--এ সবই আমার কর্মাশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট। এর সঙ্গে রয়েছে আমার ক্রিয়েটিভ পাওয়ার এবং এন্টলেকচুয়াল অ্যাপ্রোচ--অর্থাৎ পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত আমার যা কিছু তুমি দেখছো এসবই আমি ব্যবহার করি আমার কাজের স্বার্থে--
--কি বলছো এসব! অরিজিৎ আমি--
--দিস ইজ আ কমার্শিয়াল স্কাই বেবি! লুক, তুমি যখন প্রথম এই আকাশে এলে তখন তোমাকে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। কেন না তুমি তৈরি হয়ে এখানে আসোনি। তোমাকে তৈরি করতে আমাকে যা যা করতে হয়েছে সে সবই নাথিং বাট আ কমার্শিয়াল গেম। তোমাকে যেমন ব্যবহার করেছি তেমনি তোমাকে দিয়েছিও তো প্রচুর--
--নো! তুমি আমাকে স্রেফ ব্যবহার করেছো--
--অ্যাবসিলিউটলি! আমি নিজেও তো নিজেকে প্রতি সেকেণ্ডে ব্যবহার করি। এখন এই ইনাকে দ্যাখো--ওকে তৈরি করতে হবে না। তৈরি হয়েই এসেছে। কোনোরকম সেন্টিমেন্টাল ইমোশন্যাল ট্রিটমেন্টের দরকার হবে না। এখন ওকে ব্যবহার করাই হবে আমার কাজ। এটা ও জেনে বুঝেই এই লাইনে এসেছে। ফলে ইনা কখনোই ওর জীবনে আমাকে ক্লেইম করবে না।
অরিজিতের স্পষ্ট নির্মেদ কথা শুনতে শুনতে কৃষ্ণার মাথা ঝিম-ঝিম করছিল। এতদিন অজয়কে একটু একটু করে নিজের জীবন থেকে ছেঁটে ফেলতে ফেলতে অরিজিতকেই নিজের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলার পর অরিজিৎ যা বললো তা শোনার এবং বিশ্বাস করার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিল না কৃষ্ণা। তবু শেষবারের মতো বলার চেষ্ট করে--
-- আমার তাহলে কি হবে অরিজিৎ?
--ডোন্ট ওয়্যারি কৃষ্ণা! এখন এই সময়টাকে জাস্ট আ কমার্শিয়াল ব্রেক হিসেবে নাও। দিস ইজ আ ট্রু লাইফ বেবি!
অরিজিতের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলোগুলো নিভে গেল। ছবি তোলা শেষ। দৌড়ে ছুটে এলো ইনা।
--কেমন হয়েছে অরি'দা? চলবে তো?
--হান্ড্রেড পারসেন্ট সিওর!
একেবারে চোখের সামনে ইনার শরীরটা চাবুকের মতো হিল হিল করে দুলে উঠলো। অরিজিৎ চেয়ার ঠেলে উঠে ইনার কাঁধের ওপর দিয়ে নিজের ডান হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো--
--চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। বাই কৃষ্ণা!
বলে বাঁ হাতটা বাতাসে ফ্লাই করে অরিজিৎ স্টুডিও ছেড়ে চলে গেল।
মাঝখানে নি:স্পন্দ কৃষ্ণা বসে রইলো একা। প্রায়ান্ধকার স্টুডিও ফ্লোরে অরিজিতের কণ্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে--
--দিস ইজ আ কমার্শিয়াল স্কাই বেবি!

(শেষ)