বাস্তবতা নয়, কল্পনা নয়, জাদুকল্পের ভুবন নয়
বা
নয় কাল্পনিক-বাস্তবতার-জাদু মোচড়
মৃদুল মাহবুব
কোন কোন দিন জীবনকে অসীম বলে বোধ হতেই পারে। মনে হতে পারে সমস্ত ফুলের জন্ম অন্ধকারে, দেহ থেকে খসিয়ে নেওয়া লাল চামড়ার মত লাল আকাশ থেকে ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে বাতাসে, আমাদের লাবণ্য ঘরের কোন রং নেই, কোন পোড়া মাটির দেয়াল নেই; নীল পাখির পালকের দেয়াল দিয়ে আমরা যে যার মত পৃথক হয়ে বসে আছি এঘর ওঘর। তবে কি কোন পাখি শরীরের পালকের অরণ্যে দিনযাপন, দিনমান উড়তে থাকা মহাশূন্যতায় ঐ অসীম ডানায় চড়ে। আর এই নিরীহ ঘরের ভেতর আকাশ থেকে নেমে আসছে ফুল গন্ধ, পাতার সবুজ ঘ্রান, সবুজ পাতার মেঘ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বার্তা পাহাড়ের ওপারের কোন মাঝি পল্লিতে। সিলিন্ডার টাইপ থ্যাবড়ানো সূর্য তার মাছের পুচ্ছের মত একটা সরল যন্ত্র দিয়ে সবুজ সুগন্ধময় মেঘ কেটে কেটে পার হচ্ছে পাখি বিশ্ব। আমাদের এই অসীম পাখি ডানার নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সবুজ মেঘের দেশ আর লক্ষ লক্ষ সিলিন্ডার সূর্য, বোবা পোড়া ঘেয়ো নক্ষত্র, উল্কা। কোথা থেকে ভেসে আসছে রাগ হংসধ্বনি ?
এ কল্পনার থেকে অধিক অতিকল্পনার ভুবন। কথাহীন সুরের মত এর বিস্তারণ। অথবা এ কি প্রতি-কল্পনা নয়?
কবিতা, শিল্প বোধ -- বাস্তবতা নয়, কল্পনা নয়, জাদুকল্পের ভুবন নয় বা নয় কাল্পনিক-বাস্তবতার-জাদু মোচড়।
কবিতা আজ এক ভিন্ন প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় আমার কাছে। বিগত কবিতার সরল রেখার বিপরীতে আমাদের এই 'প্রান্ত-আধুনিক' ত্রিমাত্রিক কবিতা সলিডের জ্যামিতি বেশ ভিন্ন। এরা পরস্পরকে যে বিন্দুতে ছেদ করে তা বোধ হয় দ্বন্দ্ব-বিন্দু। তাহলেতো কমন ফ্যাক্টর থাকার কথা এই দুই ভাষা বিশ্বের দু'জাতীয় কবিতায় যেহেতু তার পরস্পর কে সঙ্গী করে, ছেদ করে। কি এই ভিন্নতা? ভিন্নতা বেশ প্রখর, চৈত্র দিনের সূর্য তাপের মত বা শীত সকালের কুয়াশার মত অনুভূতিময়। সমগ্র ঋতু জ্ঞান দিয়েও একে ঠিক আর বোঝা যায় না। কারণ এখানে নির্মিত হয়েছে প্রতিটা ঋতুর বিপরীতে প্রতি-ঋতু। বাস্তবতা আর কল্পনার বিপরীতে প্রতি-অতি-কল্পনা। আধুনিক কবিতা যেমন রেখার বাইরে এক কদমও এগোয় না তেমনি আমাদের এই কবিতাও কি তার জাদু কল্পনার মায়া বাগান থেকে এই পৃথিবীর দিকে এক পা'ও এগিয়ে আসতে পারে বা পেরেছিলো? এর সম্ভাব্য উত্তরটা পর্যন্ত করা কঠিন। কেননা তাকে সচল রাখার জন্য তত্ত্বে পাওয়ার হাউজ গড়ে উঠেছে দিকে দিকে। তাহলে আধুনিকতার সে সীমাবদ্ধতা তার বিপরীতে যেদিন থেকে আমাদের নবআবিস্কৃত কবিতা দাঁড়ানো শুরু করলো সেদিন আসলেই কি খুব বেশি কিছু ঘটে গিয়েছিলো? আসলে কিছুই ঘটেনি। মাত্র শিল্পবোধের একটা পরিকল্পিত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। ফলে মনে হয় রুচিই আমাদের শিল্পের মূল শাসক এখন পর্যন্ত। যেকোন স্পর্শই ক্ষয় বয়ে আনে, হোক তা মিহি শীতল বাতাসের শরীর প্রবাহন বা তোমার শরীর স্বচ্ছতার দিকে ছুটে যাওয়া আমার কামনা বা প্রত্যাশার অন্ধত্ব। পাহাড় আর পাগলা গারদের দেয়াল আর আমাদের লজ্জা-বর্ম পোষাকের সুতোয় বাতাসের যে আনাগোনা বা আলোর পতন তাও ক্ষরণ করে, মিঠা রোদ ঝলসে দেয় অনুর জীবনী, একক।
শিল্পের রুচির শাসনহীন কবিতাই আমাদের অবধারিত লক্ষ্য, এপিক যাত্রার পথরেখা।
আলোহীন অন্ধকারহীন বল-বীর্যহীন শাশ্বতের উচ্চাশাহীন বিজ্ঞানহীন শূন্যআরএককহীন মিথহীন সময়হীন আশাহীন ব্যাপ্তিহীন স্পেসহীন মাত্রহীন মুখহীন ভূগোলহীন অতীবর্তভবিষ্যহীন এক দশ দিগন্তের দিকে তার যে নতুন আবাস, বসত বাড়ি সেখানে ভাবি জন্মের পাঠক খুঁজে পাবে শব্দ মুখোস, নতুন ভূবন-দীক্ষা। শব্দকে ঠিক এই এপিক ভুবনে ডেকোরেটিভ মুখোস হিসাবে, বেড শিটের চাদর হিসাবে, সাজানো শো পিচ হিসাবে আমার মা'র হাতের খুন্তির সাধারণতা হিসাবে বাবার স্ক্রু ডাইভার হিসাবে বেখেয়ালের মত তাকে অবহেলায় ব্যবহার করা হয়েছে ঐ পাখি পালকখচিত ডানার ভুবনে। সামগ্রিক প্রয়োজনীয়তা নিয়ে শব্দ হেলায় ফেলায় পড়ে আছে এই প্রদেশে, তার সীমনা শব্দের কাটাতারে ঘোরপ্রস্থ ভাবে ঘেরা। শব্দ মানেই প্রয়োজনীয়তা অনুভব, তৃতীয় কোন দিক নির্দেশনার তাড়া এর নেই। অথবা নেই কেন্দ্রহীন অভিনয় প্রবনতা। অপ্রোয়োজনীতার অধিক্য বর্জিত অর্জনের নিশান উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে একে ঠিক চিনে ফেলা যাবে। যে নিশান দেখে কপোত ফিরে আসে আমাদের ঘরে সন্ধ্যার আগে, মহাপাখির ডানা বন্ধ হবার আগে। এখনই বন্ধ করোনা ডানা।
কল্পনা থেকে কবিতার যাত্রা অতিকল্পনার দিকে, আলাদা এক ভাষা পৃথিবীর দিকে।
কবিতা আর কিছু বোঝানোর দায় রাখে না। আমি একে দেখি এক শব্দ আল্পনায় খচিত বিয়ে বাড়ি হিসাবে। যেখানে লাজুক অতিথি, যাকে কেউ চেনে না তিনি একা একা এই আল্পনা শিল্পের সাথে তার গোপন সময়টা কাটাবেন। খুব সঙ্কোচে তিনি পায়ে পাড়িয়ে পাড় হয়ে যাবেন এই অর্থহীন শব্দচিত্র, গন্তব্যহীন; তারপর তিনি আর সেখানে কোন দিন ফিরে আসবেন না। মাত্র কিছু একটা যেনো উৎসব ঘটে গিয়েছিলো কোন একদিন, তিনি খুব একা লজ্জিত নিঃসঙ্গতা নিয়ে সেই রং আর রূপের পাশে বসে ছিলেন। এভাবে তিনি একের পর এক পার হয়ে যাবেন হাজারো হাসি উৎসব, ঠাট্টা, রস আর একা একা অনুভবের সাথে জড়িয়ে নেবেন সীমাবদ্ধতার দুঃখ সূত্র, ব্যক্তি হাহাকার আর মলিন এক মুখ কালো মানুষ তার বুকের ভেতর কথা বলে উঠবে। বুকের ভেতরের এই মানুষ যেনো তিনি নয়, এ যেনো না হয় ঐ লাজুক অতিথির আপন ভুবন, নিজস্বতা; এই বুকের ভেতরের যুক্তিহীন শুভ্রতা অস্বচ্ছতা বা নীল রঙ আর অসুস্থতাই যেনো হয় তার কাছে কবিতা।
রিয়ালিটি এক মরিচীকা।
কোন বস্তুকে খুব উপর থেকে দেখলে বস্তুর অনুভূত অস্তিত্ত্ব লোপ পায় আর বস্তুর গভীর থেকে তাকে দেখতে গেলে বস্তু তার স্বকীয়তা হারায়। ফলে বস্তু দর্শনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট দুরত্বে বসে তাকে পর্যাবেক্ষণ প্রয়োজন আমাদের এই তৈরিকৃত বিজ্ঞান ভবনে বসে। এতো গেলো বস্তু সত্য, তবে শিল্প সত্য? এর কোন দৃশ্যমানতা নেই। সে থাকে অসীমে বা অতিগভীর গভীরতায়। এটা বস্তুর সারবত্তা। শিল্পো হলো বস্তুর অদৃশ্য আত্মা, তার মননশীলতা। সে থাকে খুব গভীরে বা অসীমে ধ্রুপদি সংগীতের মত সে থাকে মার্গীয় উচ্চতায়। পৃথিবীর সমস্ত বস্তু নিজ কম্পনে কম্পমান নিজ আত্মা সমেত। তারা একসাথে গাইছে সেই সূচনা শব্দের গুরুগম্ভীরা। আমার সমস্ত শরীরের প্রতিটি কোষ আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলছে এক খন্ড পাথরের প্রতিটা কোষের সাথে। এদের একের সাথে অপরের যোগাযোগের ভাষা রিড করতে পারে না আমার সুচেতনা। এ কারণেই কি পাথরের ভাষা, আমার শরীরের প্রতিটা কোষের ভাষা, সমুদ্র ফেনার ভাষা, কাছিম পায়ের ভাষা, পাখি নখের ভাষা বর্জিত হবে আমাদের কাছ থেকে। বস্তুর সাথে বস্তুর এই যে বাস্তব অদেখা সম্পর্ক, ভাষা বোধ, অদৃশ্য আকর্ষণ তা যুক্তির জগত বর্হিভূত, কেননা যুক্তির কোডিং আর ডিকোডিং কৌশল চেতনা নির্ভর। তা অদৃশ্যের পাথরের গান, অনুর উচ্চারণ, বৃক্ষ মজ্জার কাঁপনকে স্বীকৃতি দেয় না। আমাদের যুক্তি ভুয়োদর্শনের বিশ্বকে অর্ধেক উন্মোচিত করে। অদৃশ্যের যুক্তিহীন অপর অর্ধেক বিশ্ব, বাকি অর্ধেক অর্ধজ্ঞান সীমিত প্রযুক্তি আর এক রৈখিক মানব বিদ্যার সোনার স্রোতের নিচে হীরের কাদায় আটকে আছে। এই অযুক্তির পৃথিবীকে ঐ বিয়ে বাড়ির মেজেতে এঁকেছিলো কোন চিত্রী, লাজুক নিঃসঙ্গ অতিথির বুকের ভেতর কথা বলছে যুক্তির সাপেক্ষের অর্থহীনতা। এ কিন্তু অর্থহীনতা নয়, নবআবিস্কৃত অবশিষ্ট অর্ধবিশ্ব, ব্রহ্মাণ্ডকে সে পূর্ণ করছে গোপনে একা; মেঝের আল্পনা মাত্র এর গুপ্ত সংকেত।
আর এই পূর্ণ পৃথিবীর প্রকাশ যখন ধরা পরে কোন এপিক শিল্পে তখন তাকে অচেনা লাগে। মনে হতে পারে সামগ্রিক বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা যেনো এর ভরকেন্দ্র। মনে হয় মগজের সাথে তার যেনো গভীর বিরোধ। কিন্তু এর সাথে সমস্ত দেহের অদেখা কথোপোকথন। তাকে যুক্তির ফিলটার বসানো চোখ দেখে দেখতে পায় না। প্রজ্ঞার মিহি সুরের সাথে বস্তু ভুবনের স্বরের ঐকতান ঘটে যায়। এক্ষেত্রে সমস্ত শিল্প রুচিকে বাদ দিয়ে সরাসারি বস্তুর চোখের দিকে, তার প্রাণের দিকে, তার ভাষার দিকে তাকালে এই বিরোধের উলোখগড়ার ময়দানে বসে পাওয়া যেতে পারে আকাশের সবুজ হিমেল গন্ধ যেনো সমস্ত আকাশ মাত্র একটা নীল অপরাজিতা ফুল হয়ে গাঢ় নীল হয়ে ফুটে আছে বাতাসের লতায়।
চাঁদে যাবার পথ অবশ্যই ছিলো উপবৃত্তাকার।
অনন্ত বিয়োগ চিহ্ন থেকে অনন্ত যোগ চিহ্নের দিকে চলে যাওয়া আমাদের সমান্তরাল রুপোর পাতে বসানো রেল পথ দিয়ে সসীমের মেলে যেতে যেতে আমার মনে পড়ছে এখানে শব্দ নামক বস্তু আত্মার মুখোশ ছিলো। আমি এই রেল কামরায় বসে সে মুখোশ পরিনি। মুখোশ আমার মুখের চামড়ার নিচে নিরীহ নির্লিপ্ত চাতুর্য্য নিয়ে ঢুকে যাচ্ছে। আর শব্দের মরা কাঠের উপর, ঐ রঙীন ধাতুর মুখোশের উপর জীবন্ত প্রান, বস্তু আত্মার ভাষা হয়ে ছত্রাকের মত জন্ম নিচ্ছে আমার দেহ; এই আমার পুরোটা দেহ আমার মগজ। আমরা লোকাল ট্রেনে চড়ে উপবৃত্তাকার পথে চলেছি চাঁদের দিকে। শূন্যে উড়ছে আমাদের পথ নিদের্শ, সবুজ সিগনাল।