ডারফুরের নারী কৃষক
অমল হালদার
২৮ মে সকাল ৯ টা।
দক্ষিণ ডারফুরের (সুদানের একটা স্টেট) রাজধানী নেয়ালা থেকে অফিসের জীপে বসে ২ ঘন্টা সময় লাগলো গ্যড্ল হাবুব পৌঁছাতে। গ্যড্ল হাবুব খুব ছোট মাপের একটা বাজার এলাকা গালদী এর কাছাকাছি দুর্দান্ত মরুভুমির মধ্যে একটা একটি গ্রামের মাঝে। ।দূরত্ব বড়জোর ৩৫ কিলোমিটার নেয়ালা থেকে। রাস্তায় ২ জায়গায় সরকারী মিলিটারীর সম্মুখীন হতে হয়েছে। নেয়ালা থেকে আমরা ৭টা জীপে ৩০ জন (২ জন বিদেশী এবং ২৮ জন দেশী) মানবাধিকার কর্মী এক সাথে রওনা হ্ওয়ার ৪০ মিনিট পরে আমাদের টিম লিডার মোবাইল রেডিওতে বলে উঠল - মোবাইল-১ ফ্রম মোবাইল-৭, প্লীজ স্ললি মোভ টু লেফট এন্ড হল্ট, দিস ইজ এ চেক পোস্ট। জায়গাটা প্রায় সবদিক থেকে ছোট ছোট ঝোপ-ঝাড় ভরা ও মরুময় । একপার্শ্বে ৫০ গজ দুরে একটা উচু টিলা। কপাল দোষে (র্যনডম লটারীর মত) আমি প্রথম গাড়ীর সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসেছি। একটু লক্ষ্য করে দেখি পাহারী টিলার উপর থেকে একটা রকেট লান্সার সরাসসি আমাকে টার্গেট করেছে (খুবই পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছিল)। কিছুক্ষণ পরে ২ জন আর্মড মিলিটারী আমাদের গাড়ীর দিকে এগিয়ে এসে আমাদেরকে বের হয়ে ভ্রমণ কাগজ দিতে বলল। এভাবে দুটা চেকপোস্ট অতিক্রম করার পর দূরে কয়েকটি কুড়েঘরের পাশে বেশ কিছু মহিলা এবং পুরুষ দেখতে পেলাম। সেটাই ছিল আমাদের বীজ বিতরন কেন্দ্র।
দেশে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে ডারফুরের গ্রামে যাতায়াত মারাত্মক ঝুঁকিপুর্ণ। মিলিটারী কন্ট্রোল খুবই কম। কন্ট্রোল মূল শহর কেন্দ্রিক এবং সীমাবদ্ধ মাত্র কিছু পরিসরের মধ্যে । গ্রামে তাদের কোন আধিপত্য নেই।
গ্রামে বা শহরে প্রায় সব মধ্যম সারির পুরুষদের কাছে আর্মস থাকে। গ্রামের পুরুষরা বিচিত্র স্বভাবের। মারাত্মক অলস, কোন কাজ করবে না, শুধুই মতব্বরী, মারামারি, বাজে নেশায় সময় কাটায়। পরিবারের সকল ধরণের কাজ -খামার, কৃষিকাজ, পশুপালন, বাচ্চা জন্মদান এবং পালন, রান্না, পানি সংগ্রহ, কাঠ সংগ্রহ- এসব কাজের ৮০% দায়িত্বই নারীর।পুরুষদের বিয়েরও কোন বয়স নেই। জীবনের শেষ সময়ে এমনকি মৃত্যুর আগেরদিনও পুরুষটি বিয়ে করতে পারে যে কোন মেয়েকে; মেয়েটির বয়স যাই হোক না কেন। মহিলাদের বিয়ের বয়স শুরু হয় ১০ বছর বা তারও আগে।
মরুভূমির মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা পানির স্বল্পতা। তবে মরুলোকদের দেখে মনে হলো না এটা তেমন কোন সমস্যা । ওদের প্রধান খাবার সরগম/মিলেট, সাথে আগুনে সেকা মাংস (গরু/ভেড়া/ছাগল)। মাংস কাটার পরে চামড়া সরিয়ে নিয়ে কোন রকমে রক্তটা সমান্য পানিতে ধুয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। আমার কাছে মনে হয়েছে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে পড়া আদিম যুগের মানুষের খাবার দাবারের কথা। আর আজ নিলাম তার বাস্তব অভিজ্ঞতা । খাবার নিয়ে আমার সমস্যা প্রকট থাকার কারণে আমার ভ্রমণ খুবই কম হয়। আর হলেও আমি আগে থেকে নির্দেশ দিয়ে ব্যবস্থা করে রাখি যাতে করে আমাকে কোন ধরনের খাদ্য-গ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। কারন এই মরুদেশের মানুষগুলো যদি বুঝতে পারে যে আমি তাদের খাবারকে ঘৃনা করি তা হলে আমার আর বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে না এবং এই সত্যতা টিমের সবাই জানে। আমার টিমের শুধুমাত্র আমি ছাড়া সবাইকেই তাদের খাবার খেতে হয়েছে।
কৃষকদের জন্য বীজ বিতরনের এই মাসটাই সঠিক সময়। কারন জুনের শেষের দিকে বর্ষা সিজন এলে কেউ গাড়ি নিয়ে সেখানে যেতে পারবে না। তবে মজার ব্যাপার হল কৃষকেরা বীজ খেয়ে ফেলে না সব চাষ করে তা মনিটরিং করা আর সম্ভব হয় না।
১১:০০ টা থেকে ৪:০০টা পর্যন্ত আমাদের বীজ বিতরন চলছিল। ৫০০ কৃষকদের মধ্যে বীজ বিতরন করেছি । স্থানীয় লোকদের দ্বারা বিতরন পরিচালিত করেছি। ৫০০ কৃষকের মধ্যে ৮৫% কৃষক নারী। তাদের স্বামী থাকা সত্ত্বেও মহিলাদেরকেই আসতে হয়েছে বীজ নিতে।
মরুভূমির গ্রাম ও বাড়ীগুলো খুবই ফাকা ফাকা। মহিলারা ১-৫ কিলোমিটার বা তারও দূর হতে এসেছিল বীজ নেয়ার জন্য। মহিলারা সাধারণত গাধার পিঠে চড়ে দলবদ্ধ হয়ে আসে। একজন মহিলার কাছে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম - বিতরনকৃত বীজ (সরগম, মিলেট, বাদাম, বেগুন, তরমুজ, টমাটো . . . ) দিয়ে ওরা ২ হেক্টর পর্যন্ত জমি চাষাবাদ করতে পারে যা থেকে ৫-৭ জনের একটা পরিবারের কমপক্ষে ৬ মাসের খাদ্যের সংস্থান করা সম্ভব।
তবে আসার পথে তাদেরকে অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। কারন ধর্ষণ, অযথা নারী নির্যাতন, ছিনতাই ওখানে নিত্যকার ঘটনা। মহিলাদের কোন স্বাধীনতা নেই বললেই চলে। তাদেরকে থাকতে হয় কঠোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে। সমস্ত শরীর বস্ত্রাবৃত থাকতেই হবে অন্যথায় ইসলামী শরিয়া আইন তাদের পিছু নেবে সর্বক্ষণ। তবে যেটা মনে হল – মহিলারা এগুলোতেই অভ্যস্ত। কোন সমস্যা বলে মনে করে না। পুরুষদের একাধিক স্ত্রী গ্রহন, মেয়েদর শরিয়া মেনে কৃষিকাজ ও সন্তান দান সহ অন্যান্য যাবতীয় সকল কাজ করা- এটাই এখানকার প্রথা।
মে ২৮, ২০০৯
ডারফুর-সুদান