পেহলা পেয়ার


পুরবী গুপ্ত (বারাট)

 


মিহিজাম স্টেসনে নেবে, চিত্তরঞ্জন যেতে হয়ে। চিত্তরঞ্জনের ডি টাইপ কোয়াটার, ৬০ নম্বর রাস্তা, গুপ্তদের বাড়ি, বাড়িতে প্রচুর লোক, মা, বোন, বউদিরা । ভেতরের বারান্দায় শাশুড়ী ঠাকুরণ মেয়েদের, বউদের চুল বেঁধে দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে কাজের বউ ঝাডু দিতে দিতে চলে এল। এসেই বলে উঠল, 'মাজি, ভাবীলোগ উঠ যাইয়ে, ঝাডু লাগানা হ্যায়'। শাশুড়ী বললেন, 'কেন বাবা নবাব নন্দিনী আর একটু পরে এলে কি ক্ষতি হত? ঘোঁড়ায় জিন দিয়ে এসেছ বাছা?' বউ বলে উঠল, 'মাজি, আপ তো বলতে হো, শ্যাম হোনে কে পেহেলে ঝাডু লাগানে কে লিয়ে।'

শাশুড়ী বললেন, 'ঘাট হয়েছে বাছা, নাও ঝাডু লাগাও।' বউমা কে ডেকে বললেন, 'ওকেও সিঁদূর পরিয়ে দাও, সধবা যে আসবে, তাকেই পরাতে হয়।' এই মা ঠাকুরন মহিলা বেশ ভাল মানুষ, তাঁর কাছে সধবা যেই হোক তাকেই সিঁদুরের সম্মান দিতে হবে। খুব গল্পের বই পডতে ভাল বাসেন, খবর শোনা নেশার মতন আর অপুর্ব গল্প বলেন নাতি-নাতনীদের।

যাই হোক শাশুড়ীর কথার মতন বড় বউ সিন্দুর পরাতে গেল কাজের বউকে। বউ বলল, 'রুকো ভাবী', বলেই ঝাডু রেখে হাটা মাথায়ে মুছে, গলা থেকে, একটা কাল তার টেনে বার করল্‌ তাতে একটা পেতলের পাতের মত চৌক লোকেট, সেটা হাতে নিয়ে দেখাল, তাতে একটি মেয়ের আকৃতি আঁকা। বলল, 'আগে একে সিন্দুর দাও।'  অবাক হয়ে বড় বউ জিজ্ঞেস করল, 'এ কে?' বউ বলল, 'এ হচ্চে আমার সউতন।' ছেলের নাম করে বলল, 'মাহাবিরের বাবার পেহলা বিবি।' হিন্দিতেই ও কথা বলত বলল, 'আমাদের নিয়ম আগে পেহলি কে সিঁদুর পরিয়ে তবে নিজে পরা, পেহলা সিঁদুরের হক ত ওর ই।'

গরীব নিরক্ষর কিন্তু, যাকে যতটুকু মর্যাদা দেবার, ঠিক দিতে জানে। তাতে বিন্দু মাত্র লজ্জিত বা কুন্ঠিত নয়। আর গল্প করতে লাগল, ওরও এটা দুসরা শাদী। পেহলা শাদী হয়েছিল ওদের পাশের গ্রামে। তাদের অবস্থা বেশ ভাল ছিল। নিজেদের ক্ষেতি-বাডি ছিল। শ্বশুর শাশুড়ী আর ওদের ও ওই একটি ছেলে ছিল। বউ-এর মা মারা জান খুব ছোটতে, বাবা প্রথমে এ বিয়েতে রাজি হননি, কিন্তু পিসি জোর করেছিল। শ্বশুর শাশুড়ী বর সারাদিন ক্ষেতে কাজ করত। ওর যখন বিয়ে হয় তখন বয়শ মাত্র ১৩ আর বরের ১৮ বচ্ছর। বর দেখতে খুব সুন্দর ছিল, বড় ঘরের পড়া-লিখা আদমির মত প্যার করত। ভাগ ভাল ছিল শাশুড়ী ও বেটি মানতো। সব রান্না-বান্না করে রেখে শাশুড়ী কাজে যেত। আর ওকে দিয়ে ছেলের আর বরের খাবার পাঠাতো। বউ আর বর এক সাথে দুজনে খেয়ে নিত ।

গাঁও ঘরে খুব মেলা হয়। রাম নবমির বড় মেলা হত। শাশ, সব মেলাতে ছেলের সাথে আমাকে পাঠাতেন। আর বর খুব ঘুগ্নি খাওয়াত আর রঙ্গিন চুড়ি কিনে দিতো। ভাল তেল পাউডার সব কিনে দিত। সেই সময় সুলতাঙ্গুঞ্জে নদীর ধারে বড় মেলা হত, আর নদীর মধ্যে শিবের মন্দির ছিল, সেখানে সকলে পুজা দিতে যেত। শঙ্কর ওর বর, এক দিন বলল, চল, আমরা দুজনে সুলতাঙ্গুঞ্জে যাই। ওরা দুজনে যাবার জন্যে তৈরিও হল, কিন্তু সে দিন শাশ বললেন, না বাবা তোমরা দুজনেই ছেলে মানুষ ওই নদীর কোন ঠিক নেই। কখন বাড় আ যায়ে, নাও এ করে যেতে হবেনা। ও মা মরা একটি মেয়ে আর আমার ও এই একটি ছেলে। বড় হও, তখন যাবে।

এরপর আর যাওয়া হয়নি। কারন এর পর বড় মেয় হল, তার বেশ কিছু দিন পরে ছোট মেয়ে যখন সবে হয়েছে, এক দিন গরমের দুফুরে শঙ্কর ফিরল, খুব জ্বর। লু লেগে গেল। গাঁ ঘর ত ভাবী, ঝাড়-ফুঁক অনেক হল। ডাকটর শহর থেকে যখন এসে পৌঁছোল, তখন সব খতম। বউয়ের চোখ থেকে ঝর-ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল।

ভাবীরা, বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ওদের ও চোখে জল। বড় ভাবী, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, 'আজ ও তোমার খুব কষ্ট হয়, না?'

তখন বউ একটু ম্লান হেসে বলল, 'ভাবী, পেহলা প্যার কোই ভুল সক্তা হে ক্যা? দোবারা শাদি ময় ভি কিয়া হে, নারায়ান ভি কিয়া হে, উস্কা খানা পাকানে কা কই নাহি থা, মেরে লিয়ে এক আদমি কা যরুরত থা।'

বউ-এর এই অকপট সত্যি কথা বড় আনমনা করে দিল এদের। সন্ধ্যে হয়ে আসছে, সূর্যাস্ত হচ্ছে। কেমন যেন মন খারাপ করা বেলা মনে হতে লাগল। শাশুড়ী ঘরের ভেতর থেকে বললেন, 'কি গো বউ কখন ঝাড়ু দেওযা শেষ হবে? রাতির বেলা ধূলো আর বাইরে ফেলনা বাছা।'

আচ্ছা বলতে পার এই ভালবাসাকে শ্রেষ্ঠতর আসন দেবনা কেন? ও কাজের মেয়ে বলে কি? কিন্তু ওর ঐ ভালবাসা আজও তাজা হয়ে আছে। যে ক্ষতটায় একটু হাত লাগলেই স্বচ্ছ রক্তক্ষরণ হয়, সেই এত সুন্দর একটি ভালবাসাকে তুচ্ছ না করে শ্রেষ্ঠতর আসন দিলাম।

আজ বউ বা নারায়ন কেউ নেই। কিন্তু ওদের কথা সব সময়ে মনের কোনে বাসা বেঁধে থাকবে।
 


............